Monday, July 23, 2012

সাকা চৌধুরী গুডস হিলে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন:অধ্যাপক মো. সালেহ উদ্দিন

২৪.০৭.২০১২: বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল সোমবার জবানবন্দি দিয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. সালেহ উদ্দিন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাকা চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি গুডস হিলে তাঁকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। সাকা চৌধুরী সেখানে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
সালেহ উদ্দিন (৬১) এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী। 
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি এই জবানবন্দি দেন।
আসামির কাঠগড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে সালেহ উদ্দিনের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম। প্রায় দেড় ঘণ্টার জবানবন্দির শুরুতে সালেহ উদ্দিন তাঁর শিক্ষাজীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। 
তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরের বছর তিনি একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। একাত্তরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলে থাকতেন। মার্চের মাঝামাঝি ক্লাস-পরীক্ষা না থাকায় তিনি চান্দগাঁও থানার মোহরা গ্রামে রাজা খান চৌধুরীর বাড়িতে চলে যান। স্কুলজীবন থেকে হলে আসন না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ওই বাড়িতে লজিং ছিলেন। 
জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহের একদিন সকাল সাড়ে পাঁচটা-ছয়টার দিকে বুড়িশচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সদস্য শামসু মিয়া তিনজন লোকসহ তাঁর দরজায় কড়া নাড়েন। শামসু চেয়ারম্যান নামে পরিচিত এই ব্যক্তি ফজলুল কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরীর বাবা) অনুসারী ছিলেন। তিনি আতঙ্কিত হয়ে দেখেন, শামসুর ডান হাত পাঞ্জাবির পকেটে এবং সেখানে একটি ছোট অস্ত্র আছে। শামসু তাঁকে (সাক্ষী) সঙ্গে যেতে বলেন।
সাক্ষী সালেহ উদ্দিন বলেন, সাদা হাফ শার্ট ও লুঙ্গি পরা অবস্থায়ই তিনি তাঁদের সঙ্গে রওনা হন। আনুমানিক ২০০-৩০০ গজ যাওয়ার পর দেখেন, পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। দুজন পাকিস্তানি সেনা জিপে তুলে তাঁর শরীর তল্লাশির পর জিপটি চলতে শুরু করে। জিপটি গুডস হিলে যায়। সেখানে তাঁকে চেয়ারে বসা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সামনে নেওয়া হয়, পাশে ছিলেন সাকা চৌধুরী। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ফজলুল কাদের বলেন, ‘ওকে (সাক্ষী) তক্তা কর।’ এরপর দুজন পাকিস্তানি সেনা তাঁকে গুডস হিলের পাশে গ্যারেজের ওপরের একটি ঘরে নিয়ে যায়। কয়েক মিনিট পর ওই ঘরে তাঁর পূর্বপরিচিত হামিদুল কবীর ওরফে খোকা ও ট্যারা (গ্যানা) সেকান্দার ঢোকেন। খোকাকে তখন মানুষ আলশামস বাহিনীর প্রধান হিসেবে বলাবলি করত।
এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী বলেন, ‘ওই দুজন কোনো কথা না বলে আমাকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। তারা জানতে চায়, আমার সঙ্গে কে কে আছে, অস্ত্র কোথায় আছে? কারও সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই জানালে তারা আমাকে আরও মারধর করে। ঠোঁট ও মুখের কয়েক জায়গা ফেটে গেলে আমি মাটিতে পড়ে যাই।’
 তিনি বলেন, ওই ঘরের একপাশে কয়েকটি মশারির স্ট্যান্ড রাখা ছিল। এক পাকিস্তানি সেনা মশারির একটি স্ট্যান্ড দিয়ে তাঁকে পেটাতে থাকে। ওই স্ট্যান্ড ভেঙে গেলে আরেকটি নেয়। পিটিয়ে অন্তত তিনটি স্ট্যান্ড ভাঙা হয়। প্রায় অচেতন অবস্থায় তাঁকে মাটিতে ফেলে তারা চলে যায়।
সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘আধা ঘণ্টা বা এর কিছু সময় পর দুজন পাকিস্তানি সেনা আমাকে সিঁড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামায়। সিঁড়ির গোড়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি “একে কী মেরেছিস, এর চোখে তো পানিই আসেনি” বলে আমার বাঁ গালে সজোরে একটা থাপড় মারেন। এরপর বলেন, “একে নিয়ে যাও।” এ সময় অপরিচিত দুজন লোক আমাকে গ্যারেজে ঢুকিয়ে হোসপাইপ জাতীয় জিনিস দিয়ে অনবরত পেটাতে থাকে। মার খেয়ে মনে হচ্ছিল, আর বাঁচব না। অনেকক্ষণ ওই জায়গায় অচেতন পড়ে ছিলাম।’ তিনি বলেন, কিছুক্ষণ পরে তাঁকে আবার আগের ঘরে (গ্যারেজের ওপর) নেওয়া হয়।


 কিছুক্ষণ পর সেখানে তাঁর পূর্বপরিচিত নুরুল ইসলাম আসেন। নুরুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) করতেন। নুরুল জানতে চান, তিনি কিছু স্বীকার করেছেন কি না? জবাবে তিনি (সাক্ষী) বলেন, তিনি কোনো কিছুর সঙ্গেই জড়িত নন যে স্বীকার করবেন। নুরুল চলে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানতে চান, মোহরার ইউপি সদস্যসহ মুসলিম লীগপন্থী বা বিশিষ্ট কেউ তাঁর পক্ষে কথা বলবেন কি না? এতে তিনি (সাক্ষী) আশার আলো দেখেন। কারণ, মোহরা গ্রামে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি নুরুল হুদা কাদরী ওরফে মাইজ্যা মিয়া ও বাদশা মিয়া সওদাগরের নাম বলেন। এঁরা মুসলিম লীগ করলেও তাঁকে স্নেহ করতেন। নুরুল তাঁকে আশ্বাস দিয়ে চলে যান।
উপাচার্য সালেহ উদ্দিন বলেন, প্রায় শেষ বিকেলে কাদরী ও সওদাগর এবং হারুন-অর-রশীদ (সাক্ষীর ছাত্র) গুডস হিলে গিয়ে সাকা চৌধুরীকে বলেন, তিনি (সাক্ষী) ভালো ছেলে, দীর্ঘদিন এলাকায় আছেন। তাঁর সম্পর্কে খারাপ কিছু জানা নেই। পরে সন্ধ্যার দিকে তাঁকে নিচে নামানো হয়। এ সময় সাকা চৌধুরী পাঁচ-সাতজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাকা চৌধুরী বলেন, ‘তোমার সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মোহরা থেকে অন্য কোথাও যাবে না।’ তাঁর গায়ের রক্তাক্ত জামাটি বদলানো হয়। মোহরায় ফিরে তিনি নির্যাতনের এই ঘটনা অনেককে বলেছেন এবং রক্তাক্ত জখম দেখিয়েছেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি অন্যত্র পালিয়ে যান।
জবানবন্দি শেষে সালেহ উদ্দিনকে একটি প্রশ্ন করে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আহসানুল হক। পরে এই মামলার কার্যক্রম আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে এক সিনেট সভায় তিনি সালেহ উদ্দিনের নির্যাতনের ঘটনাটি শুনেছেন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা: একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিনকে গতকাল ৩৫তম দিনের মতো জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। 

No comments:

Post a Comment