Monday, February 29, 2016

‘অপাপ নারী আমি এসেছি পাপের কূলে’ -সুমি খান


 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের জন্যে সংকলনে প্রকাশের জন্যে এই লেখাটি কিছুটা সময়োপযোগী করার চেষ্টা করেছি। একজন সংবাদকর্মীর পেশাদারীত্বের প্রতিবন্ধকতার কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলাম মাত্র।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আশৈশব আমার আদর্শ। মনে পড়ে, সেই কিশোরীবেলা থেকেই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত মোনাজাতউদ্দিনের রিপোর্ট নিয়ে বাবা-মায়ের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য শুনতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, একদিন আমিও এরকম করে রিপোর্ট করবো, দেশের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের সুখ-দু:খের কথা তুলে ধরবো পত্রিকার পাতায়। তখনো বুঝিনি, আমি এই সমাজের কাছে প্রথমত: মেয়েমানুষ - মোনাজাতউদ্দিনের মতো চারণ সাংবাদিক হবার বাস্তবতা আমার নেই।
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করলাম লেখালেখি। ।চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণে লিখলাম নারী অধিকার, মানবাধিকার, কালো মানুষের অধিকার নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের বিপ্লবের গণজাগরণের কবি বেঞ্জামিন মলয়ঁসে কে ১৯৮৫ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। সেসময়ে স্কুলে পড়ি। মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না বিপ্লবের কবি মলয়ঁসের ফাঁসির আদেশ।লিখলাম , বেঞ্জামিন মলয়ঁসে: মৃত্যুহীন প্রাণ
এর  কয়েকদিন আগে রাজধানীতে সোগেরা মোর্শেদ নামে একজনকে  ছিনতাইকারীরা  হত্যা করেছিলো। সেই ঘটনার প্রতিবাদে একটি লিখা দিয়েছিলাম। বলা প্রয়োজন,এই লেখাটি আমাকে লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলেক্স আলীম। চিন্তাশীল অনুভূতিকে কাজে লাগানোর মোক্ষম উপায় সাংবাদিকতা। আমার কৈশোরের সেই স্বপ্নের কথা জানতেন তিনি। তাই সহযোগিতা করলেন লিখা শুরু করবার জন্যে। দৈনিক পূর্বকোণের  জুবলী রোড সিগনেট প্রেস অফিসে গিয়ে  নারী সহসম্পাদক ‌এর হাতে দিয়ে এলাম লেখাটি। তিনি লিখাটি চিঠিপত্র কলামে ছেপে দিলেন।
 আমার মতো এক কিশোরীর আবেগঘন প্রতিবাদী লেখাটি কলাম হিসেবে ছাপার যোগ্য মনে করেন নি হয়তো। মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম।পূর্বকোণে আর লেখা দিলাম না; আজাদীতে লিখতে থাকলাম। বেঞ্জামিন মলয়ঁসে , ফরাসী বিপ্লবে নারীর অবদান,শ্রমজীবি নারীর শ্রমের অধিকার নিয়ে লিখতে থাকি। একসময়ে দৈনিক পূর্বকোণে লিখতে শুরু করি সাংবাদিক আবুল মোমেনের হাতে লিখা দিয়ে আসতাম।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৎকালীন ডীন অধ্যাপক আবদুল মান্নান (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান )আমার ভাশুর। তাঁর প্রোমোশান উপলক্ষে বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এলেন অনেকে। তাদের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজের তৎকালীন চট্টগ্রাম ব্যুরোচীফ আবুল মোমেন অন্যতম। তাকে  কাছে পেয়ে বললাম, মোমেন ভাই, জে এম সেন এর মতো দেশনেতার নামে চট্টগ্রামের একমাত্র এভেনিউ জানতে পারলাম বাবার কাছে। আমি বাবাকে সাথে নিয়ে দেখেছি,দুয়েকটি হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ছাড়া অধিকাংশ দোকানের সাইনবোর্ডেই তার এই নামটি লিখা নেই। এভাবে জে এম সেনের কর্ম, নাম হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কি একটা রিপোর্ট করতে পারি ,যদি অনুমতি দেন? আবুল মোমেন তার স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে চোট্ট করে জবাব দিলেন, করো।তার কাছে কৃতজ্ঞ ,তিনি আমার রিপোর্টিং এর সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেদিন।
আমার অসাধারণ উদ্যমী আর সাহসী বাবা সাইফুদ্দিন খান আমাকে নিয়ে প্রতিটা দোকান মালিক এবং কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শেখালেন মানুষের সাথে মিশে কী করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কোতোয়ালী, লালদীঘি , আন্দরকিল্লা এসব জায়গা বাবার শৈশব, কৈশোর, ভাষা আন্দোলন , শ্রমিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মিছিলের পায়ে পায়ে চেনা। চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত প্রতিটি দোকানে কথা বললাম। এই এলাকার একমাত্র পেট্রোলপাম্প এর মুসলমান মালিক ( নামটি মনে করতে পারছিনা, তিনি বেঁচে নেই) বললেন এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ হিসেবে কী করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অন্যতম সেনানী ব্যারিষ্টার যাত্রা মোহন সেন -জে এম সেনের নাম মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র থেকে সাইনবোর্ডে তার নাম লিখা হয় না। অথচ চট্টগ্রামে তখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র এভেনিউ ছিল। যাই হোক্ জে এম সেনের ইতিহাস এবং জে এম সেন এভেনিউর ইতিহাস তুলে ধরলাম। একটি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের চলমান চট্টগ্রামে ১৯৯৩ সালের সম্ভবত: জুন মাসে প্রকাশিত হলো লেখাটি। এর পর নারী বানিজ্যব্যক্তিত্ব, শহীদ পরিবার সহ নানান বিষয় নিয়ে অব্যাহত থাকলো লিখালিখি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বিল করতেন একটা লেখাতে ১০০ টাকা । এসব নিয়ে কোন কথা বলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই রিপোর্টিং অব্যাহত রাখলাম। বসে থাকতাম রিপোর্টিং য়ের প্ল্যান আর আইডিয়া পাওয়ার জন্যে। না, সে আশার গুঁড়ে বালি। নিজেই ভাবতে থাকি কী করা যায়!
বাবার কাছে শুনেছি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল বাবার প্রথম কারাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। এর পর আরো অনেকবার বাবা গ্রেফতার হয়েছেন। এখনো পংকজ ভট্টাচার্যের লেখায় তার কিছুটা পাওয়া যায়। কারাগার থেকেই বাবা বি.কম পাশ করেছেন।দেশের শীর্ষ অনেক রাজনীতিকের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে ও তার কারাগারে দেখা হয়েছে বলে শুনেছি। রাজবন্দী হিসেবে তারা বেশ সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ছিলেন বলেই মনে হতো বাবার প্রাণোচ্ছ্বল গল্পে। তাই কারাগার নিয়ে আমার আলাদা আগ্রহ ছিল।
একদিন বললাম , কারাগার নিয়ে আমি একটা রিপোর্ট করতে চাই। বিশ্বজিৎ চৌধুরী সাথে সাথে বলে উঠলেন, কারাগারে আপনাকে ঢুকতে দেবে কেন? রিপোর্ট করতে চাইলেই তো আর করতে দেবে না
সামান্য একজন কন্ট্রিবিউটর হয়ে ও কোথা থেকে মনের জোর পেলাম জানি না। জবাবে কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বললাম, আমি করে আনতে পারবো
গেলাম চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল সুপারের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বন্দীরা কুয়া থেকে পানি নিয়ে গোসল করছে , হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবার কাছে নাশতার টেবিলে বা খাওয়ার টেবিলে শোনা গল্পগুলো মনে পড়লো।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এবং জেল সুপার অনেক তথ্য দিলেন। সেসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম। বিশ্বজিৎ চৌধুরী চলমান চট্টগ্রামের কাভার ষ্টোরী করলেন। বক্স করে চট্টগ্রাম কারাগারের ইতিহাস আলাদা করে দিলেন। সেটাতে আমার স্বামী আবদুল আলীমের নাম দিলেন। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম এবং কিছুটা ধাক্কা খেলাম আমার কাজ অন্যের নামে প্রকাশ হতে পারে।এভাবে কেটে গেলো দিন।
১৯৯৩ সাল থেকেই প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে চাকরির চেষ্টা করেছি । ভোরের কাগজের কাজ গুলোর ব্যাপক প্রশংসা কাজের স্পৃহা বাড়িয়ে দিতো শতগুণ। কিন্তু চাকরি দেবার আগ্রহ দেখায়না নীতিনির্ধারকেরা।
নারী নেত্রী মালেকা বেগম কে সেই শৈশব থেকে দেখেছি মায়ের সাথে পথে প্রান্তরে নারী আন্দোলনের কাজে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্য সব কেন্দ্রীয় নেত্রীদের মতো মালেকা বেগম ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে চট্টগ্রামে গেলে আমাদের বাসাতেই থাকতেন। আমার মা নূরজাহান খান ব্যাংকার ছিলেন। কোনরকমে অফিস পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই মালেকা খালাম্মাকে সাথে নিয়ে মা বেরিয়ে পড়তেন । হেঁটে হেঁটে সারা শহরের নারীদের সংগঠিত করতেন। মালেকা খালাম্মার পায়ের চটির দিকে দেখতাম ধুলো- ময়লা মাখামাখি।রাজনৈতিক গল্প, একাত্তরের গল্প, সাংগঠনিক , পারিবারিক গল্প , আড্ডা হৈচৈ করে মা এবং মালেকা খালাম্মা ঘুমাতে যেতেন অনেক দেরিতে। মনে পড়ছে ,এসব করে ও মা আমাদের দেখা শোনা, মেহমান দের জন্যে উপাদেয় রান্না, কোনটাই বাদ দিতেন না। বাবা বেশ উৎসাহের সাথে অনেক বাজার করে আনতেন মেহমানদের জন্যে। ১৯৮৫ সালে প্রথম বান্দরবান যাই ।মালেকা খালাম্মা নিয়ে যান আমাদের। মালেকা খালাম্মার ছেলে সাশা, আমরা তিন ভাই বোন আর মা। খুব আনন্দ করেছিলাম।
১৯৯৩ সালের পর যখন ভোরের কাগজ বা প্রথম আলোর কোন প্রোগ্রামে আসতেন মালেকা খালাম্মা বা মতি চাচা ( প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ), তখন তারা হোটেলে থাকতেন। ১৯৯৫ সালের পর আমার মা মালেকা খালাম্মাকে বলেছিলেন , আমাকে ভোরের কাগজের সাথে যুক্ত করতে। আমি দেখেছি, তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলতেন, এটা তো মোমেন ই পারে নূরজাহান আপা
এর পর একদিন মা আবুল মোমেন কে বললেন, মোমেন ভাই, সুমি তো আপনাদের সাথেই কাজ করছে অনেক দিন। আপনারা নতুন ভাবে পত্রিকা শুরু করছেন । ওকে কি আপনাদের কাজের সাথে নিতে পারেন? ওতো কাজ করে ।" আবুল মোমেন হেসে বললেন, কাজ একটু বেশী ই করে, কিন্তু এই মুহুর্তে তো সম্ভব না, দেখা যাক্ কী করা যায়। মাকে এভাবে বারবার বিব্রত হতে দেখে আমার খুব কষ্ট হলো। প্রথম আলো বাজারে এলো। একদিন আমি ই আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আবুল মোমেন বললেন, চট্টগ্রামে মেয়েদের সাংবাদিকতা করার পরিবেশ নেই। তুমি ফ্রিল্যান্স করছো, করে যাও। বুঝলাম আমাকে সাংবাদিকতা করার পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে।
একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে আনা প্রয়োজন। আমার বড়ো চাচা ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের আন্দোলন, সংগ্রাম , ক্রীড়া জগৎ, সংস্কৃতিক জগতের নিবেদিতপ্রাণ প্রচারবিমুখ অসাধারণ এক ত্যাগী সংগঠক ছিলেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চট্টগ্রাম সফর মানেই আয়োজক এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান। তার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগবেষক ওয়াহিদুল হক শিল্পকলা একাডেমীতে বলেছিলেন , ডা. কামাল এ খানের নামে মেলা হওয়া উচিত এমন নিষ্প্রাণ শোকসভা নয়
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বাপ্পুর প্রসঙ্গ আনবার কারণ হলো, ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলো দুটি পত্রিকার নীতিনির্ধারক এবং সংবাদকর্মীরা শুরুর সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম কিছুদিন অফিস হিসেবে বাপ্পুর চেম্বারেই বসেছেন। কথাটা এজন্যেই বলছি ,বাপ্পু মারা যাবার পর প্রথম আলোতে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করার জন্যে আমাকে বেশ অনেক বার ফোন করতে হয়েছে ঢাকায়। বাপ্পুর পারিবারিক বন্ধু এবং তার অনেক অনুগ্রহের পাত্র হলে ও এই মানুষটির ত্যাগ এবং তিতিক্ষার কথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বশীলতা থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সংগঠক এবং সাংবাদিকেরা অনেক দূরে । ডি. কামাল এ খানের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশেও ভীষণ হীনমন্যতার প্রকাশ দেখলাম তাদের। সাংবাদিকদের পেশাদারীত্ব আর দায়বদ্ধতার এমন অভাব কাছে থেকে দেখতে হয়েছে আমাকে বার বার।
গোষ্ঠী চিন্তা আর ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার উর্ধে উঠে একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার সংগঠকের স্মৃতির প্রতি সামান্যতম দায়িত্বশীলতার পরিচয় ও দিতে পারলেন না কেউ।আমাদের দুর্ভাগ্য।
যাই হোক্ এক সময়ে ঢাকায় এলাম । দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদকের কাছে গেলাম। বললাম আমি মোনাজাত উদ্দিনের মতো কাজ তুলে আনতে চাই প্রত্যন্ত জনপদ থেকে । সম্পাদক আহমেদুল কবীর চাচা তখন গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি । বাবা তার ভীষণ স্নেহভাজন অনুজ। তিনি নিয়মিত বাবাকে ফোন করতেন ল্যান্ড ফোনে। আমি রিসিভ করলে তার ভরাট কন্ঠ শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেতাম।তাকে আমার চাকরির কথা বলতে পারলাম না কেন যেন। বাবা কেও বলি নি।১৯৯৯ সালে যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান জসীম চৌধুরী সবুজআমাকে বললেন, আপনি তো ভালো লিখেন, আমাদের পত্রিকায় আসেন
এ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো ফিচার এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। আরো একজনের একই সাথে এ্যাপয়েন্ট হলো, তাদের কারো আগে কোন রিপোর্টিং য়ের অভিজ্ঞতা নেই। তারা পুরুষ বলেই তাদের রিপোর্টার হিসেবেই চাকরি হলো। নভেম্বর ১৯৯৯ থেকে নভেম্বর ২০০০ ।
এর মধ্যে শিক্ষা বোর্ড এবং নারী নির্যাতন ইস্যুতে অনেক আলোচিত রিপোর্ট করেছি। অনেক রিপোর্ট বাস্কেটে ফেলে দেয়া হতো। এরকম একটি ঘটনা এসিড ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো স্ত্রীকে। অপরাধী স্বামীর ছবি জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। দেখলাম সেই ছবি টি ব্যুরোচীফ তার টেবিলের পাশে বাস্কেটে ফেলে দিলেন। অপরাধ কী? এখনো জানি না।একবছরের মাথায় আমাকে যুগান্তর ছাড়তে বাধ্য করা হলো। এর কারণ টি এর আগে আরেকটি লেখায় আমি দিয়েছিলাম। তবু এখানে বলতে হচ্ছে-এক কিশোরী গৃহপরিচারিকা কে ধর্ষণ করে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। সেই রিপোর্ট করে আমি সাংবাদিক সমাজের চোখে অপরাধ করেছিলাম। ধর্ষণকারীর ছোটভাই এবং ভাগ্নী জামাই তখন প্রভাবশালী সাংবাদিক। প্রেসক্লাবে আমার বিচার বসলো আবুল মোমেন এবং অন্যান্য সাংবাদিক দের নেতৃত্বে । যাই হোক্, সে সময়ে সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম। প্রথম সারির পত্রিকার সাংবাদিকেরা ও অপেক্ষায় থাকতো আমি সপ্তাহশেষে কী রিপোর্ট দিচ্ছি। দিন রাত খাটনি আর পরিশ্রম করে সপ্তাহের কাভার স্টোরী করতাম। চট্টগ্রাম থেকে একমাসে ৩/৪টা কাভার স্টোরী আমার থাকতো। আমি কাজ করার আগে চট্টগ্রামে পত্রিকার সার্কুলেশন ৭৫/একশ কপি ছিল। আমার রিপোর্ট প্রকাশ হতে শুরু করলো আর ৫/৭ হাজার কপি পর্যন্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, জাপান সহ অনেক দেশে সাপ্তাহিক ২০০০ এর সার্কুলেশন । পাঠকদের অনেক চিঠি পাই। অস্ত্র , চোরাচালান , জঙ্গীবাদ, জামাত শিবিরের সন্ত্রাস নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতাবেদন করতে থাকি। তরুণ প্রধান প্রতিবেদক গোলাম মোর্তোজা এবং আরো অপেক্ষাকৃত তরুণ নির্বাহী সম্পাদক মোহসিউল আদনান প্রচন্ড সম্মান করেন এবং সহযোগিতা করেন। সাপ্তাহিক ২০০০ চট্টগ্রাম অফিস করা হয় আমাদের বাসার ই একটি ছোট্টরুমে।
২০০২ এর ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪টায় আমার অফিস থেকে কোতোয়ালী থানার ও সি রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং এসআই ইয়াসমিন বেগমের নেতৃত্বে একটি দল এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমার ছোট ছেলেটার গায়ে সেদিন প্রচন্ড জ্বর। কনভেন্টে প্লে গ্রুপে পড়তো।  গেট পেরিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে একা একা পুলিশের গাড়ির পেছনে রাস্তায় চলে যায়, দুচোখে জলের ধারা। তার মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছেতার কারণ কিছুই বুঝতে পারে নি আমার ছেলেটা।
 আমার বাবা বাষা সৈনিকনির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন দুপুরে একটু বিশ্রামে ছিলেন । হঠাৎ মায়ের চেঁচামেচি শুনে  অসুস্থ শরীরে লুঙ্গী-শার্ট পরা অবস্থায় পুলিশের জীপের পেছন পেছন সিএমপি হেডকোয়ার্টারের পাহাড়ে  ছুটে যান। এসি ডিবির রুমে ঢুকে আমাকে দেখে তৎকালীন এসি ডিবি শফিকুর রহমান কে বিনয়ের সাথে অসহায় হাসি মুখে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন , আমি তো পাকিস্তান সরকারের সময়ে অনেক জেল খেটেছি, নির্যাতন সয়েছি। এখন স্বাধীন দেশ। আমার মেয়েটাকে কেন ধরে আনলেন?  জবাবে তিনি বললেন ,তিনি কিছুই জানেন না। মোর্তোজা ভাইকে মোবাইলে জানালাম। আমার হাতে তখনো মোবাইল ছিল, এর পরেই পুলিশ আমার মোবাইল সীজ করে নেয়। মোর্তোজা ভাই ঢাকা থেকে ফোন করে আমার গ্রেরফতারের বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলে তৎকালীন এসি ডিবি আমার সামনেই তার রুমে  আমার অবস্থানের কথা  অস্বীকার করলেন। সাড়ে ১১ ঘন্টায় দফায় দফায় ইন্টারোগেশান হয়। সিদ্ধান্ত ছিল রাতেই আমাকে ঢাকায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশান সেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। বাবা ইফতার নিয়ে গিয়েছিলেন, রাতের ভাত এবং পরনের কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন । হঠাৎ করে  রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। কিসে যে  আমাকে সাইন করালো, জানিনা। তখন চোখে যেন অন্ধকার দেখছিলাম।
তার দুদিন আগে সাংবাদিক সালিম সামাদ, প্রিসিলা রাজ, চ্যানেল ফোরের জাইবা মালিক এবং লিও পোল্ডো গ্রেফতার হন ঢাকা এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে। তাদের সাথে আমার কোন চেনা পরিচয় না থাকলেও তাদের সাথে আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় জড়ানো হয়। সালিম ভাই পরে  আমাকে বলেছিলেন, ওনাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো –“ সুমি খান আপনাদের কাজের সহযোগী ছিল বলে  যদি স্বীকার করেন,আপনাদের মুক্তি দেয়া হবে। তখন সালিম ভাইয়ের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তিনি  স্বাবাবিক বাবেই প্রশাসনের সেই অন্যায় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিস চৌধুরী বিবিসি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে বলেছিলেন, সুমি খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে । এবার ছেড়ে দিলেও তাকে আবার ধরা হবে।   
এখন মনে মনে ভাবি, আমাকে বিনা কারণে নিগৃহীত করে হারিস চৌধুরী বা তার নেতারা কী পেয়েছিলেন? তারা আজ কোথায়? আমি তো আমার মতোই স্বাধীন সাংবাদিকতা পেশাতে আছি। এখনকার সাংবাদিকেরা ভাবতেও পারবেন না ২০০১ থেকে ২০০৫  জামাত বিএনপি শাসনামলে  নিরীহ সাধারণ মানুষ,সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবিদের নিগ্রহের সে কী ভয়াবহ সময় আমরা পার করেছি!!
 যাই হোক্ মুক্ত হবার পর জানতে পারি আমাকে ছেড়ে দেবার পেছনে সাপ্তাহিক ২০০০ সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহফুজ আনাম, মতিয়া চৌধুরী এবং মালেকা বেগম এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ অনেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন । মালেকা বেগম খালাম্মা  আমার মাকে বলেছেন, নূরজাহান আপা, আপনি এখন সুমির মা শুধু নন, আপনি মহিলা পরিষদ নেত্রী। একটা মেয়েকে কিছুতেই রাতে থানায় রাখতে দেবেন না
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাকে বললেন, আমি আইজি কে বলেছি, সুমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমন্বয়কারী। ওকে ১৯৯৫ সাল থেকে আমি চিনি। যদি ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোমরা প্রমাণ করতে না পারো, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে না, মনে রেখো
২০০৪ সালের ২৭ এপ্রিল আমি একটি রিপোর্ট নিয়ে রাতের বেলা রিক্সায় করে এস এ পরিবহনে যাবার পথে অন্ধাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীরা আক্রমন করে। আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলাম। এলাকার ছেলেরা আমায় সেন্টার পয়েন্ট ক্লিনিকে নিয়ে যায় । সাংবাদিকেরা জানতে পেরে আমার বাসায় খবর দেয়।এর আগে থেকে ই আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে হুমকি দেয়া হয়। আমি মুখে এবং হাতে বেশ আহত হই। আমার বড়ো ছেলে অতুলন ভয়ে আমার দিকে তাকাতো না।আমার ছোট ছেলে গহন তার ছোট ছোট মাটির পুতুল গুলো এনে আমার মাথার কাছে বসে বসে আমাকে খেলতে বলতো, যেন এতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এর মধ্যে ৩ মে ২০০৪ প্রেস ফ্রিডম ডে। হঠাৎ দেখি সালিম সামাদ আমাকে দেখতে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি। সব অনুষ্ঠান ফেলে তিনি বললেন, চট্টগ্রামে আমার বোন  সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, । প্রেস ফ্রিডম ডেতে তাকে আমার দেখে আসতে হবে। সেদিন ই প্রথম তাঁর সাথে পরিচয় এবং আপন বড়ো ভাই হিসেবেই যেন তাঁকে বিপদের সময়ে পাশে পেলাম। সেই থেকে আজো আমার এই ভাইটির প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের প্রত্যেকের বিনম্র শ্রদ্ধা।
 হামলায় কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে  গিয়েছিলো ।  হাতের আঙ্গুল সোজা করতে পারতাম না। ভেবেছিলাম আর কখনো লিখতে পারবো না। দাঁতের চিকিৎসা চট্টগ্রামে করলাম।  কিন্তু হাতের কী হবে? এমন অচল হয়ে আজীবন বসে থাকতে তো পারবো না। যা দেখছি, যা দেখছি না-লিখতে তো হবে। কারো কাছে টাকা চাইতে ইচ্ছে হলো না। সোনালী ব্যাংকে ৩শ টাকার একটা ডিপিএস ছিল আমার । কাউকে কিছু না বলে সেই ডিপিএসএর থেকে ঋণ কতো পাবো খোঁজ নিলাম। ২৭ হাজার টাকা ঋণ পেলাম।  হাতের আর নার্ভের চিকিৎসা  নিতে মাদ্রাজ চলে গেলাম।মাদ্রাজে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর কোন উপায় ছিল না। তাই গাড়ি বাড়া রেখে খরচ করতে হলো।  সেখানে এক বেলায় ১০ টাকা করে পেঁপে খেতাম। ১০০ টাকা রুম ভাড়া দিতাম।  মাদ্রাজে আমার হাতের  চিকিৎসা নেবার পর ধীরে ধীরে আমার আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিকভাবে নাড়তে পারলাম।  আবার লিখালিখি শুরু করলাম ।আমার যেন পুনর্জন্ম হলো!
২০০৪ সালে চট্টগ্রামের জামাতের শীর্ষসন্ত্রাসী আহমইদ্যা প্রকাশ আহমদু বিএনপি নেতা  গয়েশ্ব্বর রায়ের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিলেন।  স্পর্ধার সাথে বললেন, জামাতের এক গুণ, ধর্মের নামে মানুষ খুন...! আহমেদুল হক চৌধুরী প্রকাশ আহমদ্যা জামাত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৯০ দিন সময় বেঁধে  ঘোষণা দিলেন –“হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয়তো আহমদু থাকবে।
 এসময় আমি চট্টগ্রামের ত্রাস আহমেদুর ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা করি।
তার সাথে যোগাযোগ হয়। আমাকে সময় দিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়, তার লোকজন রেকি করে আহমদুর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার পর আহমদু আসেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে।  সেই দিন এবং সেদিনের কথাগুলো আমি কখনো ভুলবো না। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় সেই কাবাব হাউজের বাইরে দেখলাম ঢাকার সাংবাদিক নজরুল কবির তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে কাবাব খেতে গেছেন। তার সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে একটি টেবিলে বসলাম ভয়ংকর এ শীর্ষ সন্ত্রাসীর ইন্টারভিউ নিতে।  একেবারে স্যুটেড বুটেড ধবধবে যুবক আহমদুকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায় !আমি সময়ের মূল্য বুছে দ্রুত প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করলাম। কোথ্থেকে তার  সন্ত্রাসী হিসেবে উথ্থান এবং কিভাবে তার অস্ত্রের সাথে সহবাস....?   আমার সাথে  খোলামেলা আলাপে আহমদু বললেন, তিনি  ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে  ছাত্র শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে তার হাতে একে-৪৭ এর মতো ভয়ংকর অস্ত্র  তুলে  দিয়েছিলো জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী।
 লম্বা , ফর্সা আকর্ষনীয় যুবক আহমেদু অকপটে বলে যান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির নেতা কর্মীদের খুন করে তাদের রক্তে হোলিখেলায় শিবির ক্যাডারদের মাতাল করেছেন জামায়াত নেতা এবং সাংসদ শাজহাজান চৌধুরী। বোরকা পরে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে খুন করেছেন, এমন কয়েকটি খুনের বর্ণনাও দিলেন আহমদু । গয়েশ্বর রায়ের হাতে ফুলের মালা দিয়ে বিএনপিতে যোগদানের কয়েকটি ছবি ও তিনি আমাকে দিলেন। সাপ্তাহিক ২০০০ টপ কভার ষ্টোরি করলো । মার মার কাট কাট সার্কুলেশন। সেই সংখ্যাটি দেশে বিদেশে ব্যাপক চাহিদা ছিল। অনেকে ৪/৫ হাজার কপি কিনে নেন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহুর্তে র্যা।বের ক্রসফায়ারে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয় আহমেদু কে। র্যা ব-৭ এর তৎকালীন পরিচালক কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) কে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, " কেন আহমেদু কে হত্যা করা হলো ? " তিনি জবাব দিলেন," আপনাকে আহমইদ্যা যা ইন্টারভিউ দিয়েছে এর পর কী আর তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?" প্রশ্ন করেছিলাম, " তাহলে আহমইদ্যাকে সন্ত্রাসের দীক্ষা যে দিয়েছে, তার মতো অসংখ্য কিশোর তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে জামাত নেতা শাহজাহাস চৌধুরী - এই তথ্য নিশ্চিত হয়েই কি শাহজাহান চৌধুরীর জীবনের হুমকি কে সরিয়ে দিলেন?" হাসলেন কর্ণেল এমদাদ। সাপ্তাহিক ২০০০ পরের সংখ্যায় কর্ণেল এমদাদ এর সেই ইন্টারভিউ ছাপা হলো। আহমদুকে হত্যার পর  তার লাশের কাছে কাউকে যেতে দিলো না  তৎকালীন জামায়াত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী । কাউকে জানাজা পড়তে দিলেন না। গোষণা দিলেন, আহমদুর জানাজা গয়েশ্বর রায় পড়াবে । তবু এলাকায় রবীনহুড বা দস্যু বনহুরের মতো জনপ্রিয় আহমদু এবং তার শিষ্য মিনহাজের লাশের জানাজা, দাফন সবই করলেন এলাকার সাধারণ জনগণ।
বিএনপি নেতা এবং সংগঠক জামালউদ্দিন অপহরণ হলেন ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। তিনবছর পর তার কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় ফটিকছড়ির জঙ্গল থেকে। এই তিন বছর নানান রকমের গল্প। আমার এক অজানা সোর্সের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য গুলো পেয়ে যেতাম। জামালউদ্দিনের নবোতিপর  মা শুধু আমাকেই ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন , আমাদের রাখালের ছেলে সরওয়ার জামাল নিজাম এমপি আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমি ধারাবাহিক ভাবে জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে থাকি। সেই সংখ্যা গুলোর বেশ কাটতি হয় বারবার চেয়ে পাঠান অনেকে।
আক্রান্ত হবার পর চিকিৎসা করতে গেছি। সে সময়ে , সরওয়ার জামাল নিজাম  (তৎকালীন  সাংসদ) সাপ্তাহিক ২০০০ অফিসে ফোন করে গোলাম মোর্তোজাকে বললেন, আপনাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি কী করে চট্টগ্রামে চলাফেরা করে আমি দেখে নেবো। এবার গোলাম মোর্তোজা বিশেষ প্রতিবেদন লিখলেন। সেখানে তিনি আশংকা প্রকাশ করে বললেন এভাবে প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিবেদককে হুমকি দেবার কারণে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।  বার বার মনে হয়, সাপ্তাহিক ২০০০ এর তৎকালীন সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর নির্দেশনায় অনেক পেশাদারীত্ব ছিল, যা এখন আর কারো নেই।
এসবের পরও আমার কাজ থেমে থাকে নি। কিছু টি শংকা ছিল সন্তানদের নিয়ে। আমি চেষ্টা করতাম তাদের স্কুলে যাওয়া এড়িয়ে চলতে । যাতে আমাকে চিনে ফেলে আমার সন্তানদের উপর হুমকি বা আঘাত না আসে।
২০০৫ সালে তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করি।সৎ সাংবাদিকতা এবং প্রেস ফ্রিডম এর জন্যে বিশ্বের একজনকেই ইনডেক্স গার্ডিয়ান হুগো ইয়ং এ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দেয়া হয়। । লন্ডনের সিটি হলে ২০০৫ এর ৪ মার্চ আমাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এর পর ই নিউইয়র্ক থেকে পেলাম ইন্টারন্যাশনাল উইমেন মিডিয়া ফাউন্ডেশন এর আই ডব্লিউ এম এফ ক্যারেজ এ্যাওয়ার্ড
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিষ্ট ' সিপি জে  কারেজ এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি তার আগেই। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পর প্রধান প্রতিবেদক কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন বারবার ।একদিন বললেন, আপনি আমার সাথে কথা না বলে কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না। কোন ইন্টারভিউ ও দিতে পারবেন না। কাজ করা কঠিন হয়ে গেলো । সিপি জে এ্যাওয়ার্ড নিতে অস্বীকার করলাম।  বিশ্বের প্রথম সারির সম্মানজনক এই পুরস্কার দাতা কর্তৃপক্ষকে বললাম ,"তোমরা এই পুরস্কার এর ঘোষণা দিও না। আমাকে কাজ করতে দাও। আমি কখনো কোথাও পুরস্কারের জন্যে আবেদন করিনি। পাঠকের স্বীকৃতি ই আমার পুরস্কার। "  তারা আর ঘোষণা দেন নি। তবে পরবর্তীতে আইডব্লিউ এমএফ কারেজ এ্যাওয়ার্ড নিতে গেছি যখন, তখন নিউইয়র্কে সিপিজে থেকে অশীতিপর এক বৃদ্ধা এসে আমার হাতে ৫ হাজার ডলারের একটি চেক দিয়ে যান আকুল হয়ে। বলেছিলেন, এই চেকটি নিয়ে একটু আমাদের উদ্ধারন করো।
 আমার এমন আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘটনা নিয়ে নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি টিপু সুলতান সেই থেকে এখনো অনুযোগ করে বলেন, সুমি আপাসিপিজের পক্ষ থেকে এতো বড়ো অনুষ্ঠান করে পুরস্কার দেয়া হয়, এতো বড়ো পুরস্কার, কেন আপনি নিলেন না? কাজটা একদম ঠিক করেন নাই।!  আমি হেসে উড়িয়ে দেই। টিপু ভাই চট্টগ্রামে গিয়ে আমাকে সাথে নিয়ে ২০০২ থেকে ২০০৫ অনেক মাদ্রাসার ভেতরে গিয়ে জঙ্গী রিপোর্ট করেছেন।  বাংলাদেশ থেকে আমি ছাড়া একমাত্র তিনিই সিপিজে কারেজ এ্যাওয়ার্ড পুরস্কার পেয়েছেন।
চট্টগ্রামে কাজের পরিবেশ না পেয়ে ২০০৬ সালে ঢাকায় চলে আসি ।২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে একুশে টেলিভিশনের সাথে কাজ শুরু করি। ২০০৭ এর মার্চের ১৯ তারিখ সকালে ১৫ মার্চ এর তারিখে আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে বাধ্য হয় এইচ আর প্রধান রুহুল আমিন। এ ধরণের ঘটনা ঢাকায় এসেও বার বার  আঘাত হেনেছে। সেসব পরে অন্য কোন দিন বলা যাবে ।
২০০৫ সালে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে আমার কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায়। আমি যথারীতি কোন পুরস্কারের জন্যে নিজের রিপোর্ট জমা দিতে অস্বীকার করি। পরে তারা ভীষণভাবে চেপে ধরে মানবাধিকার রিপোর্ট পাঠাতে বলে।সেদিন শেষ সময়। তাড়াহুড়ো করে জামালউদ্দিন অপহরণ মামলায় পুলিশ কাস্টডিতে নিহত ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যানের ক্যাশিয়ার অমর কর এর বিষয়ে সাপ্তাহিক ২০০০য়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি দ্রুততার সাথে পাঠাই। প্রথম আলো , ভোরের কাগজ সহ সব পত্রিকার বাঘা বাঘা রিপোর্টাররা তাঁদের  প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। তাঁদের একজন অমর করের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলন বলে আমাকে জানান।
একদিন বিকেলে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে আমিনুল এহসান আমাকে ফোন করে জানালেন চট্টগ্রাম বিভাগে 'শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার রিপোর্ট এ্যাওয়ার্ড ' টি আমি অর্জন করেছি। ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট নিতে গিয়ে পরিচয় হলো বিখ্যাত রিপোর্টার গৌরাঙ্গ নন্দীর সাথে। খুলনার শ্রেষ্ঠ  মানবাধিকার রিপোর্ট এর পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। এর কয়েকদিন পর ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে এহসান ভাই ফোন করে বললেন, সুমি আপা, আপনি যে কিসের মধ্যে কাজ করছেন, আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি। আমি একটু অবাক হলাম তার কথা শুনে। বললেন , চট্টগ্রামের রিপোর্টারদের  অনেকে  আমাদের ফোন করে বেশ রাগ করলেন। তাদের থেকে অনেক বকাঝকা  শুনতে হলো আমাদের ! তারা বলছে, চট্টগ্রামে সুমি খান ছাড়া আর রিপোর্টার নাই আপনাদের চেনা? মেয়েমানুষ বলেই তাকে পুরস্কারটা দিতে হলো? এহসান ভাই আরো বললেন তাকে কিভাবে বিব্রত করা হয়েছে আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করে এবং মেয়েমানুষ কে পুরষ্কার দেবার মনগড়া অভিযোগে দায়ী করে। আমি মনে মনে এতো কষ্ট পেলাম, এতো হতাশ হলাম! এরা তো আমারই সহকর্মী! কেন এমন হতাশাজনক আচরণ এদের??
চট্টগ্রামে ২০০৪ সালের ২৪শে জুন থেকে সাড়ে ৩ বছর ধরে নিখোঁজ  বিএনপির  একনিষ্ঠ দাতা এবং নেতা  জামালউদ্দিনের অপহরণ এবং হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার মূল হোতা আরেক বিএনপি নেতা এবং সাংসদ সারোয়ার জামালের বিরুদ্ধে প্রথম তথ্যপ্রমাণ সহ  অনুসন্ধানী  স্কুপ প্রতিবেদন  প্রকাশ করেছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার প্রচ্ছদ কাহিনীতে। সাড়ে তিন বছরে নানান কল্প- গল্প ও প্রকাশ করেন অনেক সাংবাদিক। সাড়ে তিন বছর পর জামালউদ্দিনের কঙ্কাল  ফটিকছড়ির  গভীর জঙ্গলের কবর থেকে উত্তোলন করার পর র্যা ব হেফাজতে নেয়া হলে জামালউদ্দিনের স্ত্রী তাঁর পাশে আমাকে রাখেন।  কঙ্কালের সাথে কয়েকটা চুল পাওয়া যায়। চুলগুলো  লালচে ছিল, আমাকে বললেন, ওনার (জামালউদ্দিন) চুলে মেহেদি দেয়া ছিল, এই চুল গুলো লালচে না? সাড়ে তিন বছর এই নারী জানতেও পারেননি তাঁর স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে ! আমার বুকের ভেতরও তখন  নাজমা বেগমের বুকের পদ্মার ভাঙনের ঢেউয়ের তোলপাড়। কী অপরাধ ছিল এই পরিবার টিরএই পরিবারের প্রতিটি সদস্য আমার প্রতিবেদনকে তাদের জীবনের চিত্র উঠে এসেছে বলে বিশ্বাস করতেন।এ কারণেই হয়তো নাজমা বেগম তাঁর অপারেশন টেবিলে শুয়েও পুত্রদের বলেছেন, আমার যদি কিছু হয়, তোরা সুমি খানকে দেখিস্...  একজন সাধারণ সংবাদকর্মী হিসেবে এই তো আমার অনেক বড়ো পাওয়া। জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যা প্রসঙ্গে শেষ পর্যন্ত আমার প্রতিবেদনগুলোই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে সেসময়ে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির থেকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ তথ্য পেতাম। সেসব প্রকাশ করতাম প্রতি সপ্তাহের সাপ্তাহিক ২০০০এর প্রচ্ছদে।
 চট্টগ্রামে বসবাসকারী  খ্যাতিমান কবি এবং সাংবাদিক ওমর কায়সার দীর্ঘদিন ভোরের কাগজের ব্যুরোপ্রধান ছিলেন। বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোর দায়িত্বশীল পদে আছেন। ১৯৯৩ সালে প্রথম যখন ভোরের কাগজে আমার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তখন  আবুল মোমেন ব্যুরোচীফ এবং ওমর কায়সার ভোরের কাগজের সহ সম্পাদক । আমার লেখালিখি এবং সাংবাদিকতা ঠেকানোর অনেক ঘটনা পত্রিকার ভেতর থেকে তিনি দেখেছেন। তিনিও তো নীতিনির্ধারকদের একজন। তাই জানতাম না সেসব ঘটনা তিনি মনে রেখে আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন। 
২০১০ সালের  শেষে কোন একদিন  ভোরের কাগজ অফিসে পুরনো ফাইল দেখতে গিয়ে ওমর কায়সার ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি তখন ব্যুরো চীফ। জামালউদ্দিন অপহরণ সহ চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর রিপোর্ট প্রসঙ্গে ওমর কায়সার ভাই আমাকে  বললেন, জামালউদ্দিন অপহরণের পর অনেক বড়ো বড়ো সাংবাদিকও  অনেক গল্প লিখেছে।একমাত্র তুমি জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যার ঘটনা নিয়ে ৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সত্য উদ্ঘাটন করে গেছো।  আসলে কি জানো সুমিতুমি কখনো মিথ্যা বা ভিত্তিহীন  রিপোর্ট করো নাই ।এ কারণেই তুমি আজকে এতোদূর গেছো । শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ওমর কায়সার ভাইয়ের কথায় সেদিন সত্যিই আমি অনেক আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলাম।

তাতে কী, বারবার একই ভাবে আমাকে হতাশ হতে হয়েছে। কাজ করাই যেন অপরাধ। হঠাৎ কোন এক সকালে বা কোন এক সন্ধ্যায় হাতে চিঠি ধরিয়ে বলা হয়েছে আর যেন সেই অফিসে না আসি। কেন যে এভাবে বারবার  কর্মহীন হতে হয়েছে, সেএসব অনুসন্ধানেই নেমেছি এখন। এটাই আমার প্রধান কাজ এখন। কারণ, বিনা অপরাধে মিথ্যা দায়ে আমাকে  দায়ী করা হয়েছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, পেশাদারীত্ব রক্ষা করতে গিয়ে কেন আমাকে এভাবে মিথ্যা দোষে দোষী করা হয়অথচ কখনো কারো সাথে প্রতিযোগিতায় নামিনি। কারো কোন কাজে ডিসটার্ব করি নি কখনো। নিভৃতে  সংবাদকর্মী হিসেবে আমার কাজ আমি করে গেছি। তবু কেন কোন কোন গোষ্ঠী আমার উপর এতো ক্ষুব্ধকয়েকদিন আগে তথ্য মন্ত্রনালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সেক্রেটারীর সাথে হঠাৎ দেখা। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বশালী এই ব্যক্তিটি আমার সাপ্তাহিক সূর্যবার্তার ডিক্রারেশান দিয়েছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোথায় কাজ করছি। বললাম আমার অবস্থান।জানতে চাইলেন কোন টিভি বা পত্রিকায় কেন কাজ করছি না। বললাম, আমি সত্যিউ জানিনা এর জবাব। তিনি বললেন, সত্যি কথা হলো, কারো কারো যোগ্যতাই অপরাধ হয়ে যায়। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ... এ কথাগুলো  সহকর্মী এবং সহপাঠীদের উদ্দেশ্যে স্বগতোক্তির মতো বলে যাওয়া । নিজের ভুল ত্রুটি, ব্যর্থতা অনুসন্ধান করা। মনে মনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সাথে মিলিয়ে গেয়ে উঠি, ওহে অপাপনারী আমি এসেছি পাপের কূলে, প্রভূ দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া করে লও তুলে...!! এর মধ্যে  সূর্যবার্তা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিকশিত করার প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি। এ কাজে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা গড়ে তুলবে পেশাদার সাংবাদিকতার নবপ্রজন্ম। শুভ কামনা থাকলো সকল সাংবাদিক সহকর্মীর প্রতি। ০১ মার্চ ২০১৬নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।