Saturday, May 24, 2014

১১৫ তম জন্মদিনে যুগোত্তীর্ণ কালোত্তীর্ণ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রণাম তোমায়


 ১১৫ বছর আগে এই দিনে পরাধীন বাঙালির মুক্তির বাণী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অবিভক্ত বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ কবি। তাই বাঙালির নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করার দিনও এটি। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবির ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীর দিনটি এবং কবির অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিও জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায় আজ উদযাপন করবে। উল্লেখ্য, বাধার দুর্লংঘ পর্বত পাড়ি দেয়া এ কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে। তার ডাক নাম ‘দুঃখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। নজরুল বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরুলের কাব্যসাধনা শুরু হয়েছিল একটি ক্রান্তিকালে। তার উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচার, অবমাননার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ এবং মানবিক জীবনের গভীরে মঙ্গলদায়ি শক্তিরূপে বিরাজমান যে প্রেম ও সৌন্দর্যের চেতনা রয়েছে তার উদ্বোধন করা। আর তা করতে গিয়েই এক সময় সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে আত্মপ্রকাশ।

সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষের  প্রাণের ভেতরের যে সত্য , যে ধর্ম, তার উপর কোন ধর্ম নেই- এ কঠিন সত্যটি নজরুল বারবার আমাদের শিখিয়ে গেছেন । কবি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রাখেন "কৃষ্ণমোহাম্মদ"--ধর্মের উপরে যে মানুষ সত্য, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবার আগে আমরা যে মানুষ , সেটাই বারবার বলে গেছেন নজরুল।

অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৪১৮৯৯ – আগস্ট ২৯১৯৭৬)(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ - ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)। আজ তাঁর ১১৫ তম জন্মদিন।  তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ওগান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর ' বিদ্রোহী' কবিতা তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যা দেয়। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। 


বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে কবিকে নিয়ে আসেন ঢাকায় ।কবির জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন- পাশাপাশি পিজি হাসপাতালে কবির চিকিৎসা চলে।স্বাধীন দেশে কবির গানকে  রণসংগীত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে অন্তিম শয়নে কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল তাঁর শেষ ভাষণে বলেছেন, "যদি আর বাঁশি না বাজে... আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন..."ভুলে যেতে বলাটাই কবিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। আমরা ভুলতে পারিনা সাম্যের গান । আমরা ভুলতে পারিনা বৈষম্য বিরোধী গান । আমরা ভুলতে পারিনা কী দারুণ সাহসে কবি বলে গেছেন -- "তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ !" 

“যদি আর না ফিরি” শিরোনামে কবির ভাষণটি  এখানে উল্লেখ করছি। কবি নির্বাক হওয়ার আগে এটিই সম্ভবত তাঁর শেষ বক্তব্য, যেখানে তাঁর সকল হতাশা, বেদনা আর কষ্টের কথা অকপটে উঠে এসেছে। এবং যা আজো সত্য!

বন্ধুগন,

আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রান আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের আমি একজন,এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই,আমি সকল মানুষের। কবি চায় না দান;কবি চায় অঞ্জলী ,কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম ।
তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি,তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে  তাকে ক্ষুধা-দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি! যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি,কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি,ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি ,বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে -অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন,পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে । ধর্মের নামে  ভন্ডামি ও  কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। 

কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন , কাফের! আমি বলি,ও দু'টোর কোনটিই নয় । আমি কেবলমাত্র  হিন্দু -মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালি কে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি ।সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে  ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা , একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে  আছে ছুরি। 

হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি , জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ- বিগ্রহ।জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষানস্তুপের মত জমা হয়ে আছে। 

এই অসাম্য, ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও  সুন্দর- সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আমি যশ চাইনা ,খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা ,নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান,বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলীন। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত- এই আমার সাধনা- এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ্  উন্মাদ , তোর জীবনে শেলীর মতো,কীট্‌সের মতো খুব বড়ো একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ",জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য  আমি কতোদিন  অকারণে  অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই  জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের উর্ধে শূন্যের মতো। কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।

আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহাঅনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেই দিনই ,সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। 

যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ঞা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে,  আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন ,আমায় ভুলে যাবেন। 

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি,আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। 
যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে-দেশপ্রেমিক-ত্যাগী, বীর-বিদ্রোহী - বিশেষনের পর বিশেষন, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা!

 এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পারো, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও , সেটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—-“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা,কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা-নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ!"

 সন্তানের মৃত্যু, সমাজের ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতাসীন দের অত্যাচার এবং নিপীড়নে প্রচন্ড আঘাত  এবং বেদনা সয়ে র্নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কবি, তবু তিনি বেঁচে আছেন, চিরকাল থাকবেন বাংলার মানুষের মনে,হৃদয়ে।তিনি তাই তিনি  অমর।

কবির স্মৃতিকে তাঁর সাহিত্যকে আমাদের নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সে সবের চর্চা করতে হবে।পাকিস্তান সরকারের বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিনাশী হীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নজরুল কে বিকৃত ভাবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা  করা হয়েছিলো। সেই কালো ইতিহাস এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে  এই প্রজন্মের কাছে  স্বমহিমায় স্বরূপে উপস্থাপন করতে হবে কবি কে ।উপস্থাপন করতে হবে এক ধর্মনিরপেক্ষ,অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতান্ত্রিক,সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশ্ব নাগরিক,মানবতাবাদী বাঙালী কবিকে।

  একথা বারবার উঠে এসেছে , বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- এ কারণে  "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় নজরুল একাডেমী  গবেষণা কাজের জন্যে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। 


বাংলা কাব্যে ভক্তিগীতি রচনা  করে  তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। অনুজ নজরুলের ‘ধূমকেতু’ ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) প্রকাশিত হলে ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে প্রথম ৬টি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর তা ছাপা হয়- “আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,/র্আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দে'রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন!” রবি ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। 

 সমাজে ধর্মের নামে মানবতার অবমাননাকারী ধর্মবেসাতি করে যারা, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন নজরুল।  তাঁর 'আমার কৈফিয়ত কবিতায় লিখেছেন," মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও বজাত মেরে!/ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!/‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’"

ব্রিটিশ সরকারের পীড়নের কথা তুলে ধরেছেন এই কবিতায়-"বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!/যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু/শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?" 

লিখেছেন ক্ষুধাকাতর শিশুর কথাও ,"  ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,/বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।/কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!/কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?" 

কষ্টের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, "বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!/দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,/তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,/বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!/পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,/মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।/প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!"  এভাবেই নিজের রক্ত দিয়ে হলেও অত্যাচারীর সর্বনাশ চেয়েছেন নজরুল।

অসাম্প্রদায়িক জাতি , সমাজ প্রত্যাশায় তাঁর 'কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় লিখেছেন,"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন/কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র।...কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার/ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান/আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!"


“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,তবু আমারে দেব না ভুলিতে” _ এই আত্মপ্রত্যয় ছিল যার মরণোত্তর অস্তিত্ব নিয়ে,তিনি চিরবিদ্রোহী,চিরবিরহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রেমে ও বিদ্রোহে, কোমলে-কঠিনে গড়া এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।আজও দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভক্ত পৃথিবীতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই যথার্থ অহঙ্কারেই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘আমারে দেব না ভুলিতে’।

 আর তাই ,জাতীয় কবিকে কখনও ভোলা সম্ভব নয়। বাংলা কাব্যে আর গানে যে নতুন জোয়ার তিনি এনেছেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যে অবিস্মরণীয় প্রেরণাসঞ্চারী দ্রোহের বাণীতে উচ্চকিত করে তুলেছেন অবিভক্ত বাংলার কোটি কোটি মানুষের চিত্ত, সে বাণীর শাশ্বত দর্শন চিরপ্রাসঙ্গিক। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুন ঝরানো কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’ ‘অগি্নবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও।কারণ এমন কবিতা প্রথম শুনল বাঙালি।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানালেন এই নতুন কবিকণ্ঠকে। ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন কারাবন্দি নজরুলকে।’বিদ্রোহী’ কবিতায় এমন আশ্চর্য এক নতুন সুর আর নতুন ছন্দের দোলা, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য আর পুরাণের এমন অপূর্ব প্রয়োগ, প্রেম আর বিদ্রোহের এমন আশ্চর্য সমন্বয়, এর তুলনা অতীতে ছিল না, পরবর্তীকালেও দেখা যায়নি।এই একটি মাত্র কবিতার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমগ্র নজরুলের জীবনদর্শন আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ।’বিদ্রোহী’ কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাণী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার আর চিরস্বাধীনতার স্বপ্ন।

তাঁর আবির্ভাব ঝড়ের মতোই। তিনি নিজেই লিখেছেন আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়।তবে তাঁর লেখা অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’র জন্যই তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন।কবিতাটি আলোড়ন তোলে বাংলার সাহিত্যের ধারায়।তখন উপমহাদেশ ভাগ হয়নি। চলছে দোর্দ- প্রতাপে ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের শাসন।যিনি দাঁড়িয়েছেন সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের বিরম্নদ্ধে,অবিচারের বিরম্নদ্ধে,মানুষের পূর্ণ মুক্তির পৰে।তাঁর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি দেশের মানুষের অনত্মরে স্থায়ীভাবে আসন লাভ করেন। আজ এমন একটা দিন নাই যেদিন তাঁকে কোন না কোনভাবে স্মরণ করা হয় না।তিনি সত্যিকার অর্থেই প্রাতঃস্মরণীয়। কবি নজরম্নল আমাদের গর্ব। তাঁকে আমরা এখন প্রতিদিন স্মরণ করি।

পাকিস্তানী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ সময়কালে তাঁর কবিতা উচ্চারণ হয়েছে, তাঁর গান গেয়ে উদ্দীপনা লাভ করেছে মানুয।তাঁর ‘শিকল পরা ছল, মোদের এ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’, ‘দুর্গম গিরি কানত্মার মরম্ন দুসত্মর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানগুলো মানুষের মনে হৃদয়ে শক্তি যুগিয়েছে,মনে জয়ের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর এসব এবং অন্যান্য গান মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি  যুদ্ধে প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে।

 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর  শেখ মুজিবর রহমানের কাছে কবি নজরুলের বিশেষত্ব ছিল কবির বিদ্রোহী চেতনা। কলকাতায় পড়ার সময় হোস্টেল প্রতিবেশী কবি গোলাম কুদ্দুসের কাছে  বঙ্গবন্ধু জেনেছেন কবি সম্পর্কে। তাঁর বন্ধু পল্লীকবি  জসীমুদ্দিনও  নজরুল সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়েছেন। নজরুলের অপর শুভানুধ্যায়ী কবি জুলফিকার হায়দারের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর সখ্য ছিল । যাকে সম্পাদক করে বঙ্গবন্ধূ ১৯৬৮-১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত  ট্যাবলয়েড আকারে সাপ্তাহিক “নতুন দিন” বের করতেন (লালরঙের লোগো)।
পাকিস্তান জাতীয় গণপরিষদে ৫০দশকে বঙ্গবন্ধু প্রথম দাবি তোলেন কলকাতায় বাসরত কবি নজরুলকে মাসিক ভাতা প্রদানের। তার দাবি গ্রাহ্য হলেও টাকা পূর্বপাকি সরকারকে প্রদান করতে হয়। ১৯৬৫’র যুদ্ধকালে ভাতা পাটানো বন্ধ ছিল। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৮,৬৯ ও ৭০ সালে  পার্টির লোক পাঠিয়ে কবির জন্য কাপড়চোপড় -খাবার , টাকা পাঠাতেন। মুস্তফা সারওয়ার দুবার গেছেন। মুজিবনগর সরকার মাসিক ২৫০টাকা দিত। সরকারী প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবির খোঁজ নিতেন।স্বাধীনতার পর ১০০০টাকা ভাতা দেওয়া হয়। 

  বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে  বিশেষ  অনুরোধ করে কবি নজরুলকে নিয়ে আসেন ঢাকায় । তাঁর জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন-পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। অসুস্থ  নির্বাক কবিকে অতি উৎসাহি বাঙ্গালী নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেন শাস্তি দিতেন। তাঁকে দেখার জন্য ঢল পড়ে যেতো,কেউ  কেউ গান শোনাতেন।  বঙ্গবন্ধুর পাঠের তালিকায় নজরুল ছিলেন। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু  কবিকে পেয়েছেন নিবিড় করে।

 ব্রিটিশ শাসনামলেই অসুস্থ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কবি । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে কলকাতা থেকে  সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়।এসময়ে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়।এর কিছুদিন পর তাঁকে 'জাতীয় কবি' ঘোষণা করা হয়।তখন থেকেই তাঁর ঢাকায়  বসবাস এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।আজ  আমাদের  প্রাণপ্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই প্রাণের প্রণতি, গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Thursday, May 22, 2014

'৭১ পূর্ববর্তী অভিবাসীদের নাগরিক গণ্য করতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিরর নির্দেশ দিলো মেঘালয় হাইকোর্ট

সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, ৪০ জনের বেশি বাংলাদেশি উদ্বাস্তুর করা একটি রিট আবেদনে গত ১৫ মে মেঘালয় উচ্চ আদালতের বিচারক এস আর সেন ঐতিহাসিক এই রায় দেন।
আবেদনকারীরা সবাই আসাম সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের রি-ভয় জেলার আমজং গ্রামের বাসিন্দা। সম্প্রতি মেঘালয়ের ওই জেলার ডেপুটি কমিশনার রিট আবেদনকারীদের নাগরিকত্ব সনদ জব্দ করার পর তারা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতার কারণ দেখিয়ে তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। 
বিচারপতি সেন রিট আবেদনকারীদের নাগরিকত্ব সনদ ফিরিয়ে দিতে এবং পরবর্তী নির্বাচনের আগে তাদের নাম ভোটার তালিকায় তুলতে ওই ডেপুটি কমিশনার পূজা পান্ডেকে নির্দেশ দেন। বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, কারা ভারতে থাকবে আর কারা বাংলাদেশে ফেরত যাবে সে ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা ছিল। “এটা পরিষ্কার, আবেদনকারীদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালের ২৪ মে’র আগে ভারতে এসেছিল। যেহেতু তাদের আমজং গ্রামে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, তাই এখন আর তাদের ফেরত পাঠানোর প্রশ্নই আসে না।” এসব নাগরিককে ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে আদালত।
একইসঙ্গে এসব তাদের কোনোভাবে বিব্রত না করার পাশাপাশি সঠিক পুনর্বাসনে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত। 
বাংলাদেশের জন্মের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের মেঘালয়সহ বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেন অনেকে।
এদের সম্পর্কে রাজ্য সরকারের দাবি ছিল- এসব বসতি স্থাপনকারী ও তাদের পূর্বপুরুষরা রাজ্যের স্থায়ী নাগরিক নয়। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন তাদেরকে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করেছিল।

Wednesday, May 21, 2014

মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত আশৈশব বিপ্লবী পূণ্যপ্রাণ প্রণতি দস্তিদার হোক্ নব প্রজন্মের প্রেরণা-সুমি খান


স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার , যেখানে  এদেশের নারী -পুরুষ-হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান  নির্বিশেষে আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্ব মানচিত্রে! সেই স্বপ্নে জীবন উৎসর্গকারী পূণ্য প্রাণ প্রণতি দস্তিদার! তাঁর বাবা খ্যাতিমান আইনজীবী নগেন্দ্র কুমার দাশের পথ ধরে স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে পরাধীন দেশের মুক্তি অর্জনে  শৈশবেই শপথ নিয়েছিলেন প্রণতি দস্তিদার, আমাদের রাণী মাসী ! আমৃত্যু বড়ো ত্যাগী এবং  সাধারণ জীবন যাপন করেছেন! তাঁর মহাপ্রয়াণে আমার বিনম্র প্রণতি!
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদার আর নেই। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ মে , ২০১৪ বুধবার দুপুর পৌনে ১টায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। প্রণতি দস্তিদার প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা এবং ওয়ার্কার্স পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সাবেক সদস্য প্রয়াত শরদিন্দু দস্তিদারের সহধর্মিনী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। 
বিভিন্ন সময়ে বারবার সাম্প্রদায়িক আক্রমনে জর্জরিত এদেশের মানবসমাজ। বিংশ শতাব্দীর  পাঁচের দশকের   ৪৮% হিন্দু বিতাড়িত এবং হত্যার শিকার হয়ে ৮% নেমে এসেছে। এ ধরণের বর্বর সন্ত্রাসের ক্রীড়নকেরা ঘোষণা দেন  সব মানুষকে হত্যা করে  'মুসলিম সাম্রাজ্য' প্রতিষ্ঠা করবেন কবে? আর এই বর্বর অমানবিক যন্ত্রনায় নির্যাতিতদের  বেদনা আর যন্ত্রনায় একাত্ম এবং  হতাশ হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও   'হিন্দু'   সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। নারীবাদীরা ভাবেন নারী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার । তারা কি কখনো ভাবতে পারেন , একবিংশ শতাব্দীর এই 'সভ্য' সমাজ আর নিশ্চিন্ত কর্মসংস্থান, স্বাধীন মাতৃভূমির জন্যে কতো প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে? 
১৯৩১ সালের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় খ্যাতিমান আইনজীবী নগেন্দ্র কুমার দাশের  ঘরে জন্ম নেন তাঁর কন্যা বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদার ।  তাঁর  বড়ো বোন আরতি দস্তিদার ও একই ধারার বিপ্লবী ছিলেন। আরতি দত্ত মারা যান ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। আরতি দস্তিদার ছিলেন চট্টগ্রামের কিংবদন্তী কমিউনিষ্ট নেতা সুধাংশু দত্তের স্ত্রী। সুধাংশু দত্ত পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই সাতের দশকের শেষে মৃত্যুবরণ করেন। আরতি দস্তিদার চট্টগ্রামের পোস্তারপাড় বালিকা বিদ্যালয়ের  প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।  বছর পাঁচেক আগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদারের মৃত্যুতে  চট্টগ্রামের নারী আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই প্রজন্মের তারুণ্য কখনো ভাবতে পারবে কি ,কতোটা নির্যাতন সয়ে, কতোটা আত্মদান তাারা এদেশ আর এদেশের মানুষের জন্যে করে গেছেন। 
প্রণতি দস্তিদারের প্রজন্মের বিপ্লবীরা মানবমুক্তির সংগ্রামে সেই শৈশবেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। নিজের চেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তাঁরা দু'বোন।  তাঁদের বাবা স্বদেশী আন্দোলন সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকায় শৈশবেই  দেশমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেন প্রণতি দস্তিদার।১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর শরদিন্দু দস্তিদারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন প্রণতি।  সে সময়ে তিনি গ্ল্যাক্সো তে চাকরি করতেন। বিয়ের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে । স্বামী এবং পার্টির নির্দেশে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। কয়েকদফায় গ্রেফতার হলে তাঁর চাকরি চলে যায়। রাজনৈতিক জীবনে প্রণতি দস্তিদার কয়েক দফা কারাগারে বন্দী হন ।  কারাগারে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন প্রণতি দস্তিদার। 

 আজ  মনে পড়ছে আমার আশৈশব এই বিপ্লবীদের সাথে ওঠাবসা ছিল আমার  বাবার কারণে । আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান কমিউনিষ্ট পার্টির  ষাটের দশকের অন্যতম সংগঠক ছিলেন; তাই এই বিপ্লবী দের সাথে  বাবার  প্রায় ছয় দশকের  সখ্য যা আমৃত্যু লালন করেছেন-তা স্মরণযোগ্য! সত্তরে  বামরাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়- চীন পন্থী আর মস্কো পন্থী । বাবা মস্কোপন্থী আর শরদিন্দু কাকা, রাণী মাসী (প্রণতি দস্তিদার) , আরতি মাসী  চীনপন্থী। কিন্তু তাদের গুরুশিষ্যের শ্রদ্ধাপূর্ণ সখ্য  আমৃত্যু অটুট ছিল। সবসময়েই বাবার হাত ধরে যেতে হতো শরদিন্দু কাকার বাড়িতে । সেখানে দেখতাম রাণী মাসী (প্রণতি দস্তিদার) আর আরতি মাসী কে।  বাবাকে দেখতাম, শরদিন্দু কাকা আর এই দুই মাসীর সাথে আড্ডয় মেতে উঠতে। আমার ছেলে অতুলন ফুলকিতে পড়তো। বাবা তার দৌহিত্র অতুলন কে আনতে যেতেন। প্রতিদিন ফুলকি থেকে ফেরার পথে বাবা অতুলন কে সাথে নিয়ে নন্দনকানন ২ নং গলিতে  শরদিন্দু কাকার ঘরে চলে যেতেন!  শরদিন্দু কাকার মৃত্যু বার্ধক্যজনিত, তবু বাবার সে কী কান্না!!  এই প্রজন্মে বাম রাজনীতিক এবং তার অনুসারী দের মধ্যে যে অবক্ষয় , একে অন্যকে অশ্রদ্ধা এবং অসম্মান করার যে অপচর্চা, তা ঠেকাতে হলে এই মহামানব দের অবদান তুলে ধরতে হবে নতুন প্রচন্মের কাছে। এর কোন বিকল্প নেই!

কতো স্মৃতি  এই চিরপ্রণম্য বিপ্লবী দের নিয়ে! রাণী মাসীর এমনই হাস্যোজ্জ্বল মুখ মনে পড়ে বারবার । চিরদিনের সব দুঃখ  ভুলে যাঁর মুখে স্মিতহাসি চিরকাল লেগে ছিল!  তাঁর প্রয়াণে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে এই মহাপ্রাণ দের আত্মদানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায় , নারীর ক্ষমতায়ন সর্বত্র। অথচ যারা এই সফলতার বীজ বুনেছিলেন প্রায় একশতক আগে-তাঁদের অবদান যদি আমরা স্মরণ না করি , ইতিহাস কখনো আমাদের ক্ষমা করবে না। রাণী মাসী, আপনার প্রতি এ জাতি যোগ্য সম্মান দেখাতে পারেনি, ক্ষমা করবেন! 

Tuesday, May 20, 2014

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১০৬ তম জন্মদিনে প্রণাম






চরম দারিদ্রের মধ্যে থেকেও সাহিত্য কর্মকেই জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে যিনি বেছে নিয়েছিলেন তিনি হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের অবচেতন মনে যে নিগুড় রহস্যলীলা প্রচ্ছন্ন থাকে তার নিপুণ বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ’পদ্মা নদীর মাঝি ’। ষাটটি গ্রন্থ ও অসংখ্য অগ্রন্থিত রচনার প্রণেতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো হচ্ছে- জননী, দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা, চিহ্ন, চতুষ্কোণ, জীয়ন্ত, সোনার চেয়ে দামী ইত্যাদি। ১৯০৮ সালের ১৯শে মে এই সাহিত্যিকের জন্ম দিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি  বিনম্র প্রণাম ।  ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে  শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন ।

জীবনবাদী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। সাহিত্যই ছিল তাঁর উপার্জনের একমাত্র উপায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মূহুর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভারে নুইয়ে পড়া মানিক পাঠককে তার অভিজ্ঞতার ভাগ দেয়ার জন্যই লেখা শুরু করেন। তার রচনার মূল বিষ্যবস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেনিসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে মাত্র আটাশ বছরের সাহিত্যজীবনে রচনা করেন বিয়ালি্লশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোটগল্প। তাঁর রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।বাঙলা ছাড়াও তার রচনাসমূহ বিদেশী বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। জন্মপত্রিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তার পিতার দেয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদনীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ঐ সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারনা ছিল মানিকের। তাই ঐ অঞ্চলের সাধারন মানুষের জীবন চিত্রকে তার সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। পদ্মার তীরবর্তি জেলেপাড়ার প্টভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।

১৯২৬ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ সালে বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। তবে পড়া লেখা শেষ না করেই সাহিত্য রচনাকেই তিনি তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন। সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের ফলে তার একাডেমিক পড়াশুনার ব্যপক ক্ষতি হয় শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। বিচিত্রায় তাঁর প্রথম গল্প অতসী মামী প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। তখন থেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। এরপর কিছুদিন 'নবারুণ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তিতে 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। তার এই সকল অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিচিত্র সব চরিত্রের আড়ালে। 

১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সংসার জীবনে সচ্ছলতা আনবার মানসে ১৯৩৯ সালে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে কয়েকমাস তিনি একটি সরকারী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদেন এবং আজীবন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এসময় থেকে তাঁর লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৬ সালে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

মানিক বন্দ্যোপাধায়ের উল্লেখ যোগ্য সাহিত্য কর্মের মধ্যে 
উপন্যাসঃ
১। জননী (১৯৩৫), ২। পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), ৪। পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), ৫। জীবনের জটিলতা (১৯৩৬), ৫। স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১) ৬। পাশাপাশি (১৯৫২), 
৭। সার্বজনীন (১৯৫২), ৮। ফেরিওয়ালা (১৯৫৩), ৯। হরফ (১৯৫৪), ১০। পরাধীন প্রেম (১৯৫৫), ১১। হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬)

ছোটগল্পঃ ১। প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), ৩। মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮), ৪। সরীসৃপ (১৯৩৯), ৫। বৌ (১৯৪০), ৫। সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), ৫। ভেজাল (১৯৪৪), ৬। হলুদপোড়া (১৯৪৫), ৭। আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), ৮।খতিয়ান (১৯৪৭), ৯। মাটির মাশুল (১৯৪৮) ১০। ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯), ১১। ফেরিওলা (১৯৫৩), ১২। লাজুকলতা (১৯৫৪), এবং নাটকঃ ভিটেমাটি (১৯৪৬) উল্লেখযোগ্য। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখনিতে বিশাল বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় সাধারণ মানুষের যেমন বস্তুনিষ্ঠ জীবন চিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমনি মানুষের কাম-পিপাসায় জীবন চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আদিমতার অন্ধকারে ফিরে গেছেন বারবার। অদ্ভুত নিরাসক্ত ভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন নিজের নিয়মে। নর নারীর জৈবসত্তা বিকারের নানাদিক লেখককে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি বাংলা উপন্যাসে নতুনত্ব ও আধুনিকতা নিয়ে আসেন। তার প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা উপন্যাসগুলোতে মানব মনের জটিলতার অসাধারণ যৌক্তিক ব্যাখ্যা মেলে।

জীবনযুদ্ধে পর্যদুস্ত, বিপন্ন, নিরাশ্রিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনকাল ছিল মাত্র আটচল্লিশ বছরের। ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। আজ এই বিখ্যাত লেখকের জন্মদিন, তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (মে ১৯, ১৯০৮ - ডিসেম্বর ৩, ১৯৫৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মূহুর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি রচনা করেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোটোগল্প। তাঁর রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।বাংলা ছাড়াও তাঁর রচনাসমূহ বহু বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

জীবন :
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন।
কলেজ ক্যান্টিনে একদিন আড্ডা দেওয়া অবস্থায় এক বন্ধুর সাথে মানিক বাজী ধরেন তিনি তাঁর লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপাবেন। সে সময় কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত এবং কেবল নামকরা লেখকেরাই তাতে লিখতেন। বন্ধুর সাথে বাজী ধরে মানিক লিখে ফেললেন তাঁর প্রথম গল্প অতসী মামী এবং সেটি বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দেন। গল্পের শেষে নাম সাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে। পাঠানোর চার মাস পর বিচিত্রায় ছাপা তার লেখা। প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক।
সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের ফলে তার একাডেমিক পড়াশুনার ব্যাপক ক্ষতি হয়; শেষাবধি শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। সাহিত্য রচনাকেই তিনি তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন।
এরপর কিছুদিন নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তী কালে বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় ।১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মানিক কয়েকমাস একটি সরকারী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তাঁর লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে।[১] তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা।[১] চাকরী সূত্রেই তার পিতা সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গমন করেন। সেখানেই মানিকের জন্ম হয়েছিল । কিন্তু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ঐ সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই ঐ অঞ্চলের সাধারন মানুষের জীবনচিত্রকে তাঁর সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। তার এই সকল অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিচিত্র সব চরিত্রের আড়ালে। পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।

জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছড়া মার্কসবাদও তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিঁড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী। তাঁর প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামী ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্তির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনী নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন চিত্রও তার বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তার সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙ্গা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে।
মৃত্যু :
১৯৩৫ সাল  থেকে লেখক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তী কালে জটিল রূপ নেয়। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর  ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে তার প্রয়াণ হয়। 

Sunday, May 18, 2014

মমতা -মোদীর বিরোধিতায় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি রদ-সুমি খান


  

১৯ ডিসেম্বর , ২০১৩ ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বুধবার তৃণমূল কংগ্রেস এবং আসাম গণপরিষদের সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত একটি বিল রাজ্যসভায় উত্থাপন করেছে।
এ বিলটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্তবর্তী ছিটমহল বিনিময় সহজ হবে।তবে বৃহস্পতিবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড সোয়াপ বিল টেবলড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাহায্য করতেই দ্রুত এ বিল পাসে তৎপর হয়েছে ভারতের জোট সরকার।


বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনে বুধবার রাজ্যসভার অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপন করতে গিয়ে বিরোধিতার মুখে পড়েন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ।তিনি বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নিতেই ডেরেক ও’ব্রায়েনের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বীরেন্দ্র প্রসাদ বৈশ্যর নেতৃত্বে আসাম গণপরিষদের সদস্যরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের হাত থেকে বিলের কপি ছিনিয়ে নেয়ারও চেষ্টা করেন।


এক পর্যায়ে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে বীরেন্দ্র বৈশ্যসহ কয়েকজন সালমান খুরশিদের দিকে তেড়ে যান। ফলে ব্যাপক হট্টগোলের  মধ্যে অধিবেশন ২০ মিনিটের জন্য মুলতবি করা হয়। ২০ মিনিট পর অধিবেশন শুরু হলে সালমান খুরশিদ ভারতের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের এই বিল উত্থাপন করেন। তবে তখনো তৃণমূল ও অসম গণপরিষদের সদস্যরা হৈ চৈ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিলটি উত্থাপনের পরপরই রাজ্যসভার চলতি অধিবেশন শেষ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী অধিবেশনে তা নিয়ে আলোচনা হবে।


ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগেও গত মে ও আগস্ট মাসে দুই দফা এই বিলটি উত্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতা কারণে তিনি সফল হননি।
বুধবার বিক্ষুব্ধ রাজ্যসভার সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়েন তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি তা রক্ষা করেননি। তাদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে।


টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নতুন সরকার গঠনে সহায়তা করতেই এ বিল পাশে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে আবারো সরকার গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দল। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ দলটির ফের ক্ষমতায় আসাটা দিল্লির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আর হাসিনা সরকারের দাবি এ চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তার পক্ষে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা সম্ভব হবে।হাসিনার বারবার তাগাদার মুখেই সরকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিলের সঙ্গে এ চুক্তিটি জুড়ে রাজ্যসভায় উত্থাপন করে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়। কংগ্রেস নেতারা আশা করছেন বিলটি পাস হলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তারা সহজেই মুসলমান ভোটারদের সমর্থন পাবে।


কিন্তু বুধবার স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপনের সময় তৃণমূল কংগ্রেস, আসাম গণপরিষদ ও বিজেপির বিরোধিতার কারণে বিপাকে পড়ে ক্ষমতাসীনরা। রাজ্যসভায় পাস হওয়ার পর এটি লোকসভায় তোলা হবে।
 সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকলের আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোট ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা রয়েছে।বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার।

বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ শুরু থেকে এই বিলের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের আশঙ্কা ছিটমহল বিনিময় হলে ভারত প্রায় ৭ হাজার একরের বেশি জমি হারাবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসও এর বিরোধিতা করছে। মমতা বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না।


দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বিনিময় ॥ ভারতের গণমাধ্যমও সোচ্চার 


৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’-দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক। মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে একটি টকশোতে উঠে আসে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন এবং তিস্তা চুক্তি। প্রশ্ন তোলা হয়, রাজনৈতিক হঠকারিতার কাছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু কি-না।



বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করার কারণে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার আদর্শ থেকে সরে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনেকদিন চলেছে। ছিটমহলে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে জনগণনা করা হয়েছিল। এর দীর্ঘদিন পর মনমোহন-হাসিনার ২০১১ সালের চুক্তি ছিটবাসীদের আশাবাদী করেছে।


এই নিরীহ মানুষগুলোর জন্যেও কথা বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে এদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতা ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশকেই চরম হুমকির মুখে রেখেছে। এই বাস্তবতা দুই দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।

ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র। একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও। ছিটমহলবাসীর পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ।
 
ভারতীয় ছিটমহল বা বাংলাদেশের ছিটমহলের প্রকৃত বসবাসকারীরা এখন আর নেই। বাংলাদেশী ছিটমহলে ভারতীয় আর ভারতীয় ছিটমহলে বাংলাদেশীরাই বর্তমানে বসবাস করেন। এটি একটি জটিল সমস্যা। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুসারে জমি নেয়া যেতে পারে কিন্তু দেয়া যায় না। এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেই তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং ভারতীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির আপত্তি।

বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারত ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন নাগরিক বাস করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় নাগরিক (নাগরিকত্ব না থাকলেও জন্মসূত্রে নাগরিক)। আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশী আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয়। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেবার সময় এসেছে। 

ছিটমহলের ‘নাইদেশের নাগরিক’দের মানবেতর জীবনের জন্যে দায়ী রাজনীতিকদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসে গেছে। ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস কলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন।বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও বাদ সাধেন ভারতের অসম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতার দাবি, এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে। ‘নিজেদের স্বার্থ’ বিসর্জন (?) দিয়ে কোন বিনিময় চুক্তি হতে দেবেন না তিনি। মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
 
মমতা কদিন আগে হঠাৎ বলেন, ‘ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে।’ অথচ ১৯৯৪ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী অবস্থান ধর্মঘট ও অনশনসহ নানান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা এসব না জানার ভান করলেন। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাকে বলেছেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার।’ 

সম্প্রতি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়া হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির আসামের দুই সাংসদ আপত্তি করেছে। বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে।
 
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদকের বরাতে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।

নাগরিকত্ব না থাকার কারণে কোনো সন্তানসম্ভবা মা তার সন্তানের জন্ম দেয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী নেই। এ কারণে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে এই বাসিন্দারা যা এড়াতে পারে না দু’দেশ।

এই ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার ফলে দুদেশের সরকার রাজস্ব বা বিভিন্ন প্রকারের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সুযোগে একদল অসাধু লোক ছিটের বাইরের লোকদের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে জোর করে নামমাত্র মূল্যে ছিটমহলের নামে স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে জমি-বাড়ি রেজিস্ট্রি করাচ্ছে। এই খবর প্রথম বাংলানিউজে প্রকাশ হবার পর ছিটমহলের নিরীহ বাসিন্দাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে দেয়।

আগেই বলেছি, নাগরিকত্বের কোন প্রমাণ নেই বলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা থাকছেন ভারতের ছিটমহলে। পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন তারা। ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে তারা ভারতের কোন ঠিকানা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন, ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
 
এমনই মানবেতর জীবনযাপন করছে ছিটমহলের নিরীহ মানুষগুলো। এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান তাঁরা। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের। তাই তাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন। 

ছিটমহল বিনিময়ের অযৌক্তিক বিরোধিতা ছিটমহলবাসীর জটিল সঙ্কট নিরসনের প্রতিবন্ধক। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঠেকিয়ে দেবার কারণে মমতা-বিজেপি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছিটমহলবাসী ক্ষুব্ধ। 

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিটমহল বিনিময়ে দুই দেশ রাজি হলে ছিটমহল বিনিময়ের কয়েক দশকের আন্দোলন সফলতার পথ উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেয় উভয় দেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সফরের তিনদিন আগে মমতা হঠাৎ বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন। আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া।
 
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার ভারতের বাত্রিগাছ ছিটমহল। এখানে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি পরিবার বাস করে। ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায় হতাশ, ক্ষুব্ধ স্বরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এভাবে আর বাঁচা যায় না। এবার ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ”। এবার এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চাইছেন তাঁরা। আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তারা যেন ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে এসে দাঁড়ান।

তিনবিঘা করিডরে চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এবার ছিটমহল বিনিময় হবে। আইনী জটিলতার কারণে কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালে ভারতের জনগণনার সময় কোচবিহারের জেলাশাসক বলেছিলেন আমার জেলায় গণনা করতে গেলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লাগবে। কারণ বাংলাদেশী ছিটমহল এই জেলায় রয়েছে। তাদের প্রশ্ন তাহলে এই এলাকায় ভারতের সার্বভৌমত্ব কোথায় আছে? ছিটমহলবাসী প্রশ্ন তোলেন, গোয়া, সিকিম যদি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তাহলে কেন ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে না? 

বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারকে বিস্তারিত সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিকভাবে জানতে হবে ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোথায় যেতে চান।

বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার ৩২৯ জন বাস করেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে তার মধ্যে মাত্র ৭৪৩ জন ভারতে আসতে চান-এটা জরিপের তথ্য। ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় মনসুর আলি মিঞা বলেন, ‘আমি আজ যেভাবে এখানে এসেছি, তা রাষ্ট্রের ভাষায় অবৈধ। কারণ আমি খাতা-কলমে বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু আমার বাংলাদেশের কোন পরিচয়পত্র নেই। আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বাংলাদেশে গিয়ে আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমি জন্মেছি ভারতে। ভারতেই মরতে চাই। একইভাবে বাংলাদেশের ভেতরে ছিটের বাসিন্দারাও তাই চান।
 
৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সম্প্রচারিত এক মুক্ত আলোচনায় বিজেপির মুখপাত্র তরুণ বিজয় স্বীকার করেন, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থেই’ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে মনে হচ্ছে। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ও অসম গণপরিষদ এখনও বিরোধিতা করে যাচ্ছে।

এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তিন দফা বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও দুইবার বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ এবং একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। 

মমতার ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করা হয় এই টক শোতে।টিভি টকশোতে বিজয় বলেন, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে সাড়া দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘সঠিক বার্তাটি’ পৌঁছে দিতে’ ভারতেরও উচিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করা।


পশ্চিমবঙ্গ ও অসম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বরুণ গান্ধীও গত মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন।


তবে এনডিটিভির টকশোতে বিজয় আবারও বলেছেন, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উচিত ছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি করার আগে বিরোধী দলের মতামত নেয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ চুক্তির বিষয়ে যে উদ্বেগের কথা বলে আসছেন, তাও কেন্দ্র সরকারের আমলে নেয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিজেপি নেতা। 
কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী থারুর ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত দেন। শশী থারুর বলেন, ‘ঢাকা আমাদের বড় বন্ধু। এখন আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকার রাখতে না পারলে তা হবে একটি বিপর্যয়।’


বীণা সিক্রি বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। ভারত যদি বিশ্বের কাছে গুরুত্ব আশা করে, তাহলে কোন দেশের সঙ্গে করা চুক্তি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার থাকা উচিত।’ স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ভূমি হারাবে বলে যে অভিযোগ তৃণমূল ও আসাম গণপরিষদ করে আসছে, তাও নাকচ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।


শশী থারুর ও বীণা সিক্রির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বলেন, পররাষ্ট্রনীতি যদি পাকিস্তানের মতো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়Ñ সেটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ভারতের ভবিষ্যত এর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর অনেকটা জড়িত। আর এ দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। আর সম্পর্ক উল্টে গেলে ক্ষতিও হবে একই মাত্রার। বাংলাদেশে হাসিনার শাসন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্যে নিরাপদ। কারণ, শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজেপি নেতা তরুণ বিজয় বলেন, ‘আমি সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে একমত।’ 


আলোচকদের অধিকাংশই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেয়ায় একপ্রকার কোণঠাসা স্বাগত রায় ‘কূটনৈতিক কৌশলের’ আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী হিসেবে শশী থারুরের এমন কিছু বলা উচিত নয়, যাতে মনে হয় যে দিল্লী­ ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে শশী বলেন, ‘কার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে মিস্টার রায় এবং তার নেত্রী (মমতা) কি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? তারা কি ভাবছেন যে, কে আমার বন্ধু আর কে তা নয়- এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও আমার নেই?’


এই টকশো দেখে ছিটমহলবাসীর মনে অন্তত আশা জাগবে তাদের দাবি এবার নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। উচ্চ আদালত অথবা গণমাধ্যম সকল প্রচেষ্টা সফল করে ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকার সচেষ্ট হবে এমন আশা করছে ৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী।


শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ২২ ভাদ্র ১৪২০, দৈনিক জনকণ্ঠ



http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2013-09-06&ni=147841