Wednesday, August 7, 2013

আমাদের ঈদ- সুমি খান


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আমাদের ঈদ
১৯৭১ সাল। চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামের জমিদার এবং গভর্নমেন্ট প্লীডার মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁর মসজিদ ও স্কুলের মাঠে ঈদের নামাজ শুরু হয়েছে। মসজিদ পুকুরের সিঁড়িতে দুই শিশুকে গোসল করাচ্ছেন এক বিপ্লবী!
এক বছর ও তিন বছর বয়সী দুই শিশুকে গোসল করাতে গিয়ে বিপ্লবী বারবার বলে যাচ্ছেন-“ আহা! একটু তাড়াতাড়ি করো! আমি তো ঈদের নামাজটা মিস্ করলাম মনে হয় আজ!”
এই বিপ্লবী এবং মুক্তিযোদ্ধার নাম কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো। পটিয়ার কেলিশহর জমিদার পরিবারের সন্তান তিনি । ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা দলের অন্যতম সংগঠক সাইফুদ্দিন খানের সূত্রে তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং এর আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক পরিবার।
একটা চিরকুটে স্বাক্ষর করে নাকি আব্বু ( সাইফুদ্দিন খান) অনেককে পাঠিয়ে দিতেন তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। এমন দুর্যোগের মাঝেও কনিষ্ঠ সন্তানের এমন ‘অন্যায় আব্দার’ এর ঝড় –অবলীলায় মেনে নিতেন তার বাবা মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ এবং বাড়ির অন্যরা।
সাইফুদ্দিন খানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আলবদর রাজাকার বাহিনী। বাবার খোঁজে বাড়িতে রেইড দিয়ে গেছে পাকি সেনারা- “ কালাইয়া কাঁহা হ্যায়?” বাড়ির তরুণদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গেছে। সিন্দুক লুট করে বাড়ির বৌ-ঝি দের হীরে আর সোনার গয়না লুট করে নিয়ে গেছে । পরে কিছু গয়না নাকি ফিরিয়েও দিয়ে গেছে শুনেছি।
আমার দাদু মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের আইন বিভাগের ছাত্র । দাদুমণি গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট অনেক কিছুই করেছেন। শর্ত ছিল- কখনো যেন তার নামে কিছু করা না হয়।
তার বাবার নামে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে আমি দেখিনি। তবু বাবার কাছে শুনে জেনেছি কিছুটা। তার দীক্ষায় আমাদের শৈশব কেটেছে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে। একাত্তরে সবাই মিলে অসাম্প্রদায়িক ঈদ উদযাপন করেছেন-এমন ই স্মৃতিচারণ করতেন আমার বাবা-মা। দাদুমণি মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ সে বছরই মারা যান।
আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোকে ‘সেলিম ভাই’ নামে চেনে তখন সবাই। যে শিশুদের তিনি গোসল করাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে ছোট জন আমি। অনেক বড়ো হয়ে জেনেছি, আমার জীবনের আদর্শ -আমার সবচেয়ে প্রিয় সেলিম চাচ্চুর আসল নাম পূর্ণেন্দু কানুনগো।
ঈদের দিন সবার মাঝে চাচ্চু নিজের পরিচয় আড়াল করার জন্যে আমাকে আর ভাইয়াকে খুব ধীরে সুস্থে গোসল করাচ্ছিলেন আর তাড়া দিয়ে বলছিলেন, তার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে! আব্বু- আম্মু খুব মজা পাচ্ছিলেন এসব দেখে! গ্রামের লোকজনও অনেক পরে জেনেছে চাচ্চুর আসল পরিচয়!
শৈশবের স্মৃতিতে মনে পড়ে, আমাদের বিশাল বাড়িতে সাত গ্রামের হিন্দু-মুসলিম- জেলেপাড়া সব ধরনের মানুষ আসতো । ঘরের গরুর দুধে তৈরি সেমাই , গুরাপিঠা আরো নানান নাশতা দিয়ে বড়ো জে-আম্মা, মেজ আম্মা, আম্মু অক্লান্ত আতিথেয়তা করছেন।
কতো মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছেন ঢেঁকি ঘর, রান্নাঘর, দেউড়ি ঘর, পূবের ঘর- সবখানে বড়ো আপা, বড়ো ভাইয়ারা আড্ডা দিচ্ছেন- কী মধুর সব স্মৃতি!
আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান ছিলেন ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক –এক অসাধারণ মানবতাবাদী! চট্টগ্রাম বন্দর এর প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে বিশাল বাংলো ছিল তার । ঈদের চার/পাঁচ দিন আগে সেখান থেকে চার সাম্পানে করে আমরা বাড়ি যেতাম।
আমাদের পারিবারিক মাঝি ছিল। মতলব মাঝি ছিল তাদের প্রধান। দাদুমণির পর বাপ্পুর প্রখর ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ নেতৃত্ব পুরো পরিবারকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলো। আর ছোট ভাই হিসেবে আব্বু নিজের মতো করে নিভৃতে কাজ করে যেতেন গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে।
আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা অন্নদাচরণ দত্ত লেনে আমাদের তিন/চার পুরুষের ভিটে। যার অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে বাবা আর মা তাদের ব্যাংকের চাকরির বেতন থেকে হোমলোন কেটে খুব সাধারণ একটি বাড়ি করেন এই জায়গায়। নিতান্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই যাকে বলে।
এই বাড়ির চিলেকোঠায় একটা ছোট্ট রুম করে বাবা বলেছিলেন, এই ঘরটি চিরজীবন আন্ডারগ্রাউন্ড বাম নেতাদের জন্যে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভাষা সৈনিক মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন এই ঘরটিতে।
আজমী চাচ্চু খেতেন আমাদের সঙ্গে, ঘুমাতেন এই চিলেকোঠায়।
১৯৮৩ সালের দিকে সেই বাড়িটির গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া নেন ‘যুগান্তর’কর্মী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সীতানাথ দাস এর পুত্র স্কুল শিক্ষক রঞ্জন রশ্মি দাস। আমাদের অনেক শ্রদ্ধার অনেক প্রিয় ‘দাদা’। তার স্ত্রী সুচন্দা দাস দোলা- আমাদের চিরদিনের ভীষণ প্রিয় ‘দিদি’ চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। তার প্রথম সন্তান টুম্পা তখন আড়াই বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে। ১৯৮৪ সালে এ ঘরেই জন্ম নিলো দাদা এবং দিদির একমাত্র পুত্র জনি। আমাদের সবকিছুতে তাদের সম্পৃক্ততা আর অংশগ্রহণ অনিবার্য।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। কেন যেন সেবার আমাদের বাড়ি যাওয়া হয় নি। আব্বুর গ্যাস্ট্রোলজি প্রবলেমের কারণে বড়ো রকমের অপারেশন হয়েছিলো সেবার । তাই মনে হয় যেতে পারি নি আমরা বাড়িতে।
যে কারণে এতোগুলো বিষয়ের অবতারণা- ১৯৮৪ সালের ঈদের দিন দিদি আমাকে, আমার ছোটভাই অমিকে আর ভাইয়াকে ডাকলেন। ঈদের দিনের সেই সকালে কপালে লাল সিঁদুরের বড় ফোঁটা, পাটভাঙ্গা শাড়ি পরা সদ্যস্নাতা সুন্দর দিদিকে কী যে স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিলো দেখতে!
আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দিদি কিছু টাকা গুঁজে দিলেন আমাদের হাতে! কতো টাকা সেটা মনে নেই। শুধু মনে আছে এই টাকা বা ‘বখশিশ’ এর মধ্যে কী পরম ভালোবাসা আর আন্তরিকতা ছিল দিদির! প্রশ্ন আসে মনে –কেন দিদি প্রতি বছর ঈদে আমাদের ‘বখশিশ’ দিতেন?
খুব সামান্য চাকরি করতেন। দাদা-দিদির টানাটানির সংসারে আমরা তিন ভাই-বোন কে? কেন দিদি প্রত্যেক বছর ঈদের বখশিশ দিতেন? দিদির চেহারায় একটা অসহায়ত্ব ছিল- লুকিয়ে টাকাটা দিয়ে যেন তার অতৃপ্তি রয়ে গেছে- যতোটা চাইছেন যেন পারেন নি!
আমার অনেক স্মৃতি দিদির প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে! অন্নদাচরণ দত্ত ছিলেন মাস্টার’দা সূর্যসেনের আইনজীবী। তার বাড়িটি দখল হয়ে নিশ্চিহ্ণ এখন। তার নামে করা রাস্তাটি এখন কাগজেপত্রে এ সি দত্ত লেন- সেই নাম ও মানুষের মুখে বিলীন। আদালত ভবন, কোতোয়ালী থানা, সিএমপি হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, লালদীঘির সঙ্গে সংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড়ো সুইপার কলোনির নামে পরিচিত হয়েছে গত ২৫ বছর । কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
সেই রাস্তাটি দিয়ে হাঁটলেই দিদির কথা মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে সম্পৃক্ত দিদি হঠাৎ কবে যেন মারা গেছেন। আমরা জানতেও পারি নি। টুম্পা আর জনির বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গেছি । আর দিদির শূন্যতা অনুভব করে নিজের অজান্তেই বারবার চোখ ভরে গেছে জলে।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৮৪ সালে আব্বু চট্টগ্রাম মেডিকেলে অপারেশনের জন্য ভর্তি। কমরেড অনঙ্গ সেন আব্বুকে দেখতে গেছেন প্রতিদিনের মতো। আব্বুর পাশের বেডের বয়স্ক রোগী অনঙ্গ চাচ্চুর সঙ্গে খুব আড্ডা জমালেন। কারণ- লম্বা, সাদা দাড়ি নিয়ে চাচ্চু দেখতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।
চাচ্চু তো আরবী ভাষা, হাদিস কোরান সবই জানতেন। আড্ডা বেশ জমে গেলো। আব্বু খুব মজা পেলো- যখন মাগরেবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ চাচ্চুকে পানি আর ইফতার সাধলেন সেই রোগী। চাচ্চু বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে অচেনা নিরীহ মানুষটির অনুরোধ রক্ষা করলেন।
এই তো আমাদের সমাজ! এই তো আমাদের সাধারণ মানুষ! ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসা আর আন্তরিকতা যেখানে সবার আগে!! জয় হোক মানবতার! জয় হোক ভালোবাসার!

সুমি খান: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, sumikhan29bdj@gmail.com

Tuesday, August 6, 2013

৭২তম প্রয়াণ দিনেও অনিবার্য চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ৭২তম প্রয়াণ দিবস আজ বাইশে প্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ বাঙ্গালীর মন আর মননে চিরঅম্লান । মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নতুন তিনি। সবসময় প্রাসঙ্গিক। বাঙালীর চেতনার রঙ স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ করা এই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন। আজ ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেও অনিবার্য তিনি। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী।

হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে ব্রজবলী ভাষায় লিখেছেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহের পদাবলীতে কবি লিখেছিলেন- মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেন- প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে।
মহাপ্রয়াণ দিবসে আজ মঙ্গলবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী। তবে রমজানের কারণে এবার আনুষ্ঠানিকতা থাকবে কম।