Friday, April 18, 2014

বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস ও সংস্কার- শামসুজ্জামান খান

বাংলাদেশ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অংশ। এই সভ্যতা কৃষি সভ্যতা। নদী তীরবর্তী গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশের এই সভ্যতা বেশ প্রাচীন। মিসরের নীলনদ-তীরবর্তী অঞ্চলে যেমন প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, চীন ও মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা তাও নদীতীরবর্তী এবং সুপ্রাচীন। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার আনুষঙ্গিক নানা সংস্কার-বিশ্বাসও এই সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এসব সংস্কার প্রথমে কৃষি উৎসবের অঙ্গীভূত ছিল, পরে নববর্ষ উৎসব চালু হলে এসব সংস্কারমূলক আঞ্চলিক উৎসব তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রাচীন এমন একটি সংস্কারমূলক উৎসবের নাম ‘আমানি’ উৎসব। আমানি ছিল মেয়েলি উৎসব, এর লক্ষ্য ছিল পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনামূলক। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির মহিলাকর্ত্রী। কৃষি আবিষ্কারে নারীর পথিকৃতের ভূমিকা এবং তারই ফলে নারীতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতিচিহ্নবাহী বলে কেউ কেউ এ আচারমূলক অনুষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেন। এ ছাড়া সমাজে শত্রুনিধনের আচার পালন করার রীতি ছিল বছরের প্রথম দিনে। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর শত্রুর আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে নববর্ষে উদযাপন করা হতো বিগত বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানও। চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নতুন বছরের শুভ কামনা। লোকবিশ্বাস : চড়কের বাণফোঁড়ের ক্লেশের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপক্ষয়ের আরাধনা এবং নতুন বছরের সুখ কামনা করা হতো। আবার অন্য একটা চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন : ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবেরই স্মারক।’ ‘দোলযাত্রা’ ও ‘হোলি’ আনন্দোৎসব, চড়ক ক্লেশ ও বেদনার। তাহলে দেখা যাচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে জোড়া উৎসব ধরা হলে তা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনা দু ধরনের উৎসবকেই অঙ্গীভূত করেছে।
দুই
বাংলা নববর্ষের উৎসব এখন বাংলা বর্ষপঞ্জির বোশেখ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বহু আগে নববর্ষ যে অন্য সময়ে হতো তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি ফাল্গুনী পূর্ণিমার তিথিতে নববর্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় অগ্রহায়ণ বন্দিত হয়েছে এই ভাষায়, ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনমতার, নাই যার চাষ।’ কবির অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ যতদূর জানা যায়, তখন অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ ছিল। তবে কখন কীভাবে বৈশাখ মাসে নববর্ষ উদযাপন শুরু হলো তা জানা যায় না। কিন্তু মুকুন্দরামের সময়ে অগ্রহায়ণ মাসে যদি নববর্ষ হয়ে থাকে তাহলে ভারতচন্দ্রের সময়ে যে বৈশাখে নববর্ষ হয়ে গেছে তার প্রমাণ আছে তাঁরই কবিতায় : ‘বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়। নানা ফুল গন্ধে মন্দ গন্ধবহ হয়।’ তাছাড়া বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এবং আলীবদ্দী খাঁ বৈশাখের প্রথম দিনে পুণ্যাহ করতেন। এ দেশের কবিদের কবিতা ও গানে নববর্ষের নানা আবহ ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষের উৎসবকে ভিন্ন তাৎপর্য ও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। ফলে বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক মিলনমেলা। স্বার্থহীন বা লোভ-লালসাহীন মানবমৈত্রীর গভীরতর দ্যোতনায় বৈশাখের এ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে সর্বসম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালি জাতির এক সর্বজননীন মহান উৎসব। সকল বাঙালির মিলনমেলা। কৌম, গোত্র বা সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ক্রিয়াকরণধর্মী (Ritualistic) আঞ্চলিক নববর্ষ উৎসব-আচারের জায়গায় গড়ে উঠতে থাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঐতিহ্যভিত্তিক নতুন এক জাতীয় দিবস : বাংলা নববর্ষ, বাঙালির নববর্ষ।
তিন
সুপ্রাচীনকাল থেকে বঙ্গদেশে বাঙালি কৃষিজীবী মুসলমান সম্প্রদায় নানা দেশীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ আবাহন করেছেন। হিন্দু জমিদারের পুণ্যাহ আর দোকানদার-মহাজনের হালখাতা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছে। জমিদারি উচ্ছেদের পর পুণ্যাহ অবলুপ্ত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিতে নগদ পয়সার নিত্যনৈমিত্ত প্রবাহ না থাকায় বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেচাকেনা ছিল অপরিহার্য। ফলে হালখাতার গুরুত্বও ছিল বিরাট। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন ভোক্তার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বাংলাদেশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ঢুকে যাওয়ায় মানুষের হাতে নগদ পয়সাও জমা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কেনাকাটায় বাকির ব্যবসা প্রায় উঠেই গেছে। আর তাই জৌলুস হারিয়েছে হালখাতা অনুষ্ঠানটিও। তবে নববর্ষের অন্যান্য গ্রামীণ অনুষ্ঠান ও মেলা এখনো কিছু পরিমাণে চালু আছে, উদাহরণ হিসেবে লাঠিখেলা বা কাঠি নাচ (কুষ্টিয়া, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জ), ষাঁড়ের লড়াই (কেন্দুয়া, নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চল), মোরগের লড়াই (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), গরুর দৌড় (মুন্সিগঞ্জ), হাডুডু খেলা (মানিকগঞ্জসহ অন্যান্য স্থানে) এবং সারা দেশে নানা রকমের মেলার নাম উল্লেখ করা যায়। এসব অনুষ্ঠান-উৎসব বা প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক আনন্দের উৎস এবং ঐতিহ্যে অংশগ্রহণের উপযোগী মাধ্যম। কিন্তু সর্বজনীন জাতীয় বিস্তার এসব অনুষ্ঠানের ছিল না এবং এসব অনুষ্ঠানকে পরিকল্পনার মাধ্যমে নববর্ষের উৎসবের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তও করে নেওয়া হয় নি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নব উদ্ভূত শিক্ষিত নগরবাসী বাঙালি মুসলমান ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যেও তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নানা গোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকরণকে (Rituals) জাতীয় আধারে বিন্যস্ত করে নতুন এক সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগঠনমূলক কর্মকা-ে শামিল হতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক এবং পূর্ব বাংলায় তার অনুসারীরা বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করেছে, একে নানা কৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কারণ এর মধ্যে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুবীজের অঙ্কুরোদগম লক্ষ করেছে। তাই এর বিরুদ্ধে শুরু করেছে বাঙালিকে জাতিগত নিপীড়ন তার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেওয়ার কূটকৌশল। এই ধারাতেই বাধা এসেছে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনেও। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উদযাপন করে।
চার
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির উৎসমুখ খুলে যাওয়ায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে স্বৈরশাসন চালু এবং রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি সংস্কৃতিক্ষেত্রের প্রগতিশীল সক্রিয়বাদীদের বিপুলহারে গ্রেপ্তার করায় সংস্কৃতির মুক্তধারার যে উৎসমুখটি খুলে গিয়েছিল তা আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৫৮-এ আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা, গণমুখী সংস্কৃতির অনুশীলন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু জনতার সংগ্রাম থেমে থাকতে পারে না। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগ বের করে গোপন লিফলেট ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’। ১৯৬২ সালে চার ছাত্রনেতার নেতৃত্বে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠন, এই বছরেই ‘দেশ ও কৃষ্টি’ বইয়ে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ওপর তীব্র আঘাত হানতে থাকে এবং বাঙালির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন তার রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। এই সময়ের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ এক নতুন ও নব দিকনির্দেশক স্লোগান হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র চাপে সে বছর (১৯৬৪) প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন নববর্ষ অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম হয়। বাংলা একাডেমী, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, ছায়ানট (প্রতিষ্ঠা ১৯৬১), পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ, নিক্বণ ললিতকলা কেন্দ্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্র সংসদ, গীতিকলা সংসদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বাংলা একাডেমীর বটতলায় ‘ঐক্যতানের’ অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতার সমাগম হয় যে, ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হয়। বাঙালির নববর্ষ অনুষ্ঠানে এত বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখে দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার বিস্ময় প্রকাশ করে।
এরপর বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়ে রমনার অশ্বত্থমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৬ সারে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’ আন্দোলন শুরু করার পর এই আয়োজন এক নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য লাভ করে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পাঁচ
এবার আমরা বাঙালির বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করব। নববর্ষ উৎসব সব দেশেই সর্বজনীন উৎসব। সে জনেই সমাজ বিকাশের ধারায় একটা উন্নত পর্যায়েই কোনো জাতির নববর্ষ উৎসব ও তার পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটে। তাই এর একটা ধারাবাহিক ইতিহাস থাকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করলে বাংলায় বর্ষবরণ ও বাঙালির বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা অন্যান্য সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রক্রিয়ারই পরিচয় বহন করে।
ইংরেজি ‘ক্যালেন্ডার’ শব্দটি মূলে ল্যাটিন শব্দজাত। যত দূর জানা যায়, এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো : ‘হিসাব-বই’। অন্যদিকে ইংরেজি আলমানাক শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে বলে অনুমিত হয়। ‘আলমানাক’ যে অর্থ প্রকাশ করে তার বাংলা অর্থ করলে ‘পঞ্জিকা’ বলা যেতে পারে। ক্যালেন্ডার বলি, আর আলমানাক বলি–দুয়েরই জন্মস্থান প্রাচীন মিসর। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পঞ্জিকা মিসরে প্রস্তুত হয়েছিল বলে পঞ্জিকাকে মিসরীয় সভ্যতার অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিসরীয়রাই প্রায় ৬ হাজার বছর আগে চান্দ্র হিসাবের ভুল চিহ্নিত করে সৌর পদ্ধতির গণনা শুরু করে। নীলনদ-তীরবর্তী এই বাসিন্দারা অত আগে প্রায় ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাবের খুব কাছাকাছি পৌঁছে (The Calender : Devid Erwing Duncan : Fourth Estate, London, 1998)। এখানে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার অপরিহার্য সম্পর্ক। মিসরকে নীলনদের দান বলেছেন বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক হেরোডেটাস। নীলনদের একেিদক সবুজ কৃষিক্ষেত্র, অন্যদিকে ধূসর মরুভূমি। নীলনদ না থাকলে মিসর কৃষি সভ্যতার জননীস্বরূপ হতে পারত না। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের সমুদ্রতীরবর্তী রোমে রোমান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি ক্যালেন্ডার কথাটি ভূল। কারণ ওই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে রোমের ক্যাথলিক ধর্মের সম্পর্ক ছিল–প্রটেস্টান্ট ইংরেজরা তাই ওই ক্যালেন্ডার ১৭০ বছর পর্যন্ত গ্রহণ করে নি) বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে তা পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বহাল থাকে। পরে সে ক্যালেন্ডারের ভুলভ্রান্তি শুধরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়। সে ক্যালেন্ডার এখন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে।
আমরা বলেছি, কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার সম্পর্ক নিবিড় ও অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ আমরা মিসরীয় ক্যালেন্ডার এবং ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের কথা বলব। মিসরীয় সভ্যতায় বিশ্বের প্রথম যে ক্যালেন্ডার তৈরি হয় তাতে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবই ছিল প্রধান। কারণ কৃষি ঋতুনির্ভর। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফসলের বীজ সংগ্রহ, বীজ বপন, ফসলের পরিচর্যা ফসল কাটা, সবকিছুই সময়মতো করা চাই। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার কৃষির জন্য উপযোগী নয়। চান্দ্র ক্যালেন্ডারে বছরে সাড়ে ১০ দিনের হেরফের হয়। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার (হিজরি ইত্যাদি) অনুসরণ করলে এ বছরে যখন ফসল বোনা হবে, তিন বছর পরে তা এক মাস পিছিয়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন ও তার ব্যবস্থাপনায় তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে সৌর ক্যালেন্ডার প্রচলন হয়। মিসরীয় ক্যালেন্ডারেই এ সংশোধন করা হয়। বহু পরে (১৫৫২) ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। ফলে জাগতিক কর্মকা- সূর্যের আবর্তননির্ভর বা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় উৎসবাদি চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আসলে পঞ্জিকার মধ্যেও আমাদের সমাজ জীবনের ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ দুই সত্তাই একত্রে অবস্থান করাতে পঞ্জিকা জীবনের পূর্ণতারও প্রতীক।
বাংলা ও বিহারের (বাংলার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এবং বিহারের ঐতিহাসিক অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল প্রমুখ) প্রখ্যাত বিজ্ঞানী-ঐতিহাসিক মনে করেন বাংলা সনের উদ্ভাবক সম্রাট আকবর। তিনি তাঁর রাজ্য শাসনের ২৯ বছরে (হিজরি ৯৯২ এবং ১৫৮৪ সালে) পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দেন। তিনি তার নবরতœসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সনকে সৌর ও চান্দ্র বৈশিষ্ট্যে সমন্বিত করেন। তিনি একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করেন বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করে দেন। সেই কাঠমো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন। আমরা মনে করি নবাব মুরশিদ কুলি খান বাংলা সনে প্রবর্তক। আকবর অন্য যে আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তা হলো উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এই সনগুলোকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি ফসলি সন। “আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়েছিল বলে লক্ষ করি। কেননা বাংলা সন যেমন হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে।”
বাংলা সন একেবারেই স্বকীয়। আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের (ত্রিপুরা রাজ্য), কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে। তাই এ সন বাঙালির এত প্রিয়, জনজীবনে এত গুরুত্ববহ।
ভারত উপমহাদেশে পঞ্জিকা-সংস্কার উদ্যোগ প্রথমে নেওয়া হয় মহারাষ্ট্রে। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক, শঙ্করবালকৃষ্ণ দীক্ষিত (দ্র. The Indian Calender, Robert Sewel & Sankara Balkrishan Dikshit : M. B. Das Publishers, Delhi, 1995), ভেংকটেশ বাপুশাস্ত্রী কেতকর, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, ড. মেঘনাদ সাহা ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ। শহীদুল্লাহ্ বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ছিলেন। তাঁর সংস্কারের পর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স শহীদুল্লাহ্ কমিটির সংস্কার প্রস্তাবনার উন্নয়ন সাধন করেন। তা নিম্নরূপ :
১. সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হবে।
২. গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে।
৩. অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণ্য হবে।
৪. আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে।
উপসংহারে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় বাংলা সন-তারিখে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে, সে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা দরকার। এই অসামঞ্জস্যের ফলে নববর্ষ, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তি দুই অঞ্চলে একদিন আগে পরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর দায় বাংলাদেশের নয়। শহীদুল্লাহ্র সংস্কারে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাবকেই বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কারে গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভারতে ড. সাহার প্রস্তাবের কিছু সংশোধন করে এস.পি. পাণ্ডে কমিটি ১৪ই এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত পাণ্ডে শীর্ষক কমিটির রিপোর্টে বলা হয় “The Year shall start with the month of vaisaka when the sun enters niranayana mesa rasi which will be 14th April of the Gregorian calendar. (Indian Journal of History of sciences 39.4(2004) 519-534). বাংলা একাডেমীর টাস্কফোর্সও একই তারিখে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করেছেন এবং বাংলাদেশে সরকারিভাবে তা চালু হয়েছে। কিন্তু ভারতে সেখানকার পঞ্জিকাকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পান্ডে কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হয় নি।

শামসুজ্জামান খান: প্রাবন্ধিক এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক।