Tuesday, September 18, 2012

বাংলাদেশ পরপর তিনবার স্থিতিশীল অর্থনীতি সমেত বিএ৩ রেটিং পেয়েছে



ঢাকা: ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৮ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থা মুডি’স এর রেটিংয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি তৃতীয়বারের মতো বিএ-৩ রেটিং অর্জন করেছে, যা অর্থনীতির সুষ্ঠু ও জোরালো অগ্রগতির জন্য স্বীকৃতি।

তাৎক্ষণিক ঝুঁকি মোকাবেলায় অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির উপর ভিত্তি করে মুডি’স বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং নির্ধারণ করেছে।

‘ঋণ পর্যালোচনা: বাংলাদেশ সরকার’ শীর্ষক মুডিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চলমান ধারা অর্জন করলেও রেটিংয়ে থাকা সবগুলো দেশের চেয়ে এর মাথাপিছু জিডিপি কম।

এ ছাড়াও প্রবাসী আয়ের উপর নির্ভরশীলতা ও স্বল্প বৈচিত্র্যের রপ্তানি খাত নিম্নমুখী বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১১ সাল পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির চাপ বেড়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যেও পতন অব্যাহত ছিল। সম্প্রতি এসব উপাদান নিয়ন্ত্রণে এলেও বছরে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে বিদ্যুত খাতের প্রতিবন্ধকতাগুলোর মৌলিক সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে; যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাকে একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পর্যালোচনায় আরো বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বাংলাদেশের রেটিংয়ের জন্য প্রতিবন্ধক। দুর্বল শাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়নের পথে বাধা এবং তা বিনিয়োগের পথে ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে মনে করে মুডিস। তবে এপ্রিলে শুরু হওয়া আইএমএফের কর্মসূচি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতি এনেছে।

এদিকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও মুডিস মূল্যায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে শুধু ভারত এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে।


বিএ রেটিং প্রাপ্ত গ্রুপের দেশগুলোর গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় চার হাজার ৬২০ ডলার। সেই তুলনায় বাংলাদেশের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় সাড়ে পাঁচগুণ কম। এতো কম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশের রেটিং ওই সব সমৃদ্ধ দেশের সমান।
আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার মুডিস বাংলাদেশের ওপর তাদের বার্ষিক পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল অর্থনীতি সমেত বিএ৩ রেটিং পেয়েছে। পরপর তিনবার বাংলাদেশ একই রেটিং পেল।এই রেটিং বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান অগ্রগতি প্রকাশ করে।

শান্তি চুক্তির ফলে পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছে , ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াত বেড়েছে ;আমি যখন আছি- তখন আপনাদের সমস্যা দেখব"-প্রধানমন্ত্রী


ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৮ -মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে পার্বত্য জেলাগুলোর তিন সার্কেলের হেডম্যানদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় আশ্বাস দিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন। আমি যখন আছি- তখন আপনাদের সমস্যা দেখব।”

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

“আমি চাই- আপনাদের ঐতিহ্য, নিয়ম ও প্রথা যেন বজায় থাকে”, হেডম্যানদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন “আমি তো চাই- আপনাদের ঐতিহ্য, নিয়ম ও প্রথা যেন বজায় থাকে”,।
চিরদিন থাকব না। বার বার এই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।” ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জমি রেজিস্ট্রির বিষয়ে মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আপনাদের ভরসা থাকা উচিত- আমরা যখন শান্তি চুক্তি করেছি, তখন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের।”

“আগের সরকার সমস্যা জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চেয়েছিল। আর এই সমস্যা তাদেরই সৃষ্টি”, অভিযোগ করেন তিনি।

সবাইকে সহনশীল আচরণ করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নিজের দেশে কেন সংঘাত হবে? রক্ত ঝরবে?”কোনো গোষ্ঠী, সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীর নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদেরও ছাড় দিতে হবে। আপনাদেরও দেখতে হবে, আপনারা কতোটা ছাড় দিতে পারেন। অনেকে বন্ধু সেজে কাছে আসবে। কিন্তু মঙ্গল হবে না।”


এর আগে চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় পার্বত্য এলাকার খাজনা সীমিত পরিমাণে হলেও বাড়ানোর কথা বলেন। সার্কেল চিফ, হেডম্যান ও কারবারীদের ভাতা বাড়ানোর দাবি জানান খাগড়াছড়ি জেলার হেডম্যান শক্তিপদ চাকমা।

বান্দরবান জেলার হেডম্যান মাসৈড়ি মারমা পার্বত্য এলাকায় শিক্ষার প্রসার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে খাগড়াছড়ির ১৯ মৌজার হেডম্যান আন্নাইউ চৌধুরী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন সংশোধনসহ সবার পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাতা বৃদ্ধি করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।“কিঞ্চিৎ হলেও বাড়ানো হবে”, বলেন তিনি।

এর আগে গত ৬ জুলাই হেডম্যানদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী সার্কেল চিফদের মাসিক ভাতা এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার, হেডম্যানদের ভাতা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং কারবারিদের জন্য মাসিক পাঁচশ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করার কথা বলেন


পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, “ভূমি কমিশনের বৈঠকে তো আপনাদের সমস্যার কথা বলতে হবে। যোগ না দিলে তো সমস্যা জানা যাবে না।” শান্তি চুক্তির ফলে পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াত বেড়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভবনের কাজ দ্রুত শুরু করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরাকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

বিবাহ নিবন্ধন ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বিল পাস


হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ নিবন্ধনের বিধান ঐচ্ছিক রেখে ‘হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বিল-২০১২’ সংসদে পাস হয়েছে। এ আইন কার্যকর হওয়ার আগে হিন্দু ধর্মমতে অনুষ্ঠিত বিয়ে এ আইনের অধীনে নিবন্ধন করা যাবে বলেও বিধান রাখা হয়েছে।মঙ্গলবার বিলটি জাতীয় সংসদে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের পক্ষে পাসের প্রস্তাব করেন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। পরে এটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। উল্লেখ্য, ভারতে ১৯৫৫ সালে ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট’ প্রণীত হয়েছে।

গত ৩ জুলাই বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়। পরে এটি পরীক্ষা করে সংসদে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।হিন্দু বিবাহের দালিলিক প্রমাণ রাখা ও বিবাহ সংক্রান্ত প্রতারণা থেকে হিন্দু নারীদের রক্ষা করতে এ বিল পাস করা হয়েছে।

বিলের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব উত্থাপনের সময় একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম ‘ঐচ্ছিক’ বিধান বাদ দেওয়ার দাবি জানান। পরে সংশোধনী প্রস্তাব ওঠানোর সময়েও তিনি বিয়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান। পরে সেটি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ তাদের শাস্ত্রমতে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর কোনো দালিলিক প্রমাণ থাকে না। দালিলিক প্রমাণ না থাকার কারণে বিবাহ পরবর্তী বিবাহ সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয় মৌখিক সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিবাহের যে কোনো পক্ষ বিশেষত: হিন্দু নারীরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তাদের সহজে আইনি সুরক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয় না। বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণ, অভিবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিবাহ নিবন্ধন সম্পর্কিত দালিলিক প্রমাণ একটি অপরিহার্য বিষয়।

আরো বলা হয়েছে, প্রতারণার সুযোগ বন্ধ করা এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা সৃষ্টির লক্ষ্যে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন প্রণয়ন করা সমীচীন। বিলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ ঐচ্ছিকভাবে নিবন্ধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়নের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় থেকে দাবিও উত্থাপিত হয়েছে।

বিলের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে সময় সময় নির্ধারিত এলাকা এবং সিটি করপোরেশন বহির্ভূত এলাকার ক্ষেত্রে প্রতিটি উপজেলা এলাকায় একজন ব্যক্তিকে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক হিসেবে নিয়োগ দেবে।বিলের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন, ২১ বছরের কম বয়স্ক কোনো হিন্দু পুরুষ বা ১৮ বছরের কম বয়স্ক কোনো হিন্দু নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তা এ আইনের অধীন নিবন্ধনযোগ্য হবে না।

প্রস্তাবিত আইনের ৬ ধারায় বিবাহ নিবন্ধনের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, হিন্দু ধর্ম, রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান অনুযায়ী হিন্দু বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর ওই বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে যে কোনো পক্ষের নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধক নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিবাহ নিবন্ধন করবেন।

Sunday, September 16, 2012

সমঝোতার ফলে দেশ অনিবার্য গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্তি পেয়েছে :পিলখানা হত্যাকাণ্ড: জেরায় সাক্ষী প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির



পিলখানা হত্যা মামলায় সাক্ষী স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, সেদিন সমঝোতার ফলে দেশ অনিবার্য গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্তি পেয়েছে। সমন্বয় না থাকায় সেদিনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি—জেরায় আসামিপক্ষের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী মহানগর দায়রা জজ আদালতে গতকাল সোমবার প্রথমে জবানবন্দি দেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাঁকে জেরা করেন। এই মামলার সাক্ষী আওয়ামী লীগের সাংসদ মির্জা আজমও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীর কবির জবানবন্দিতে বলেন, বাসা থেকে সচিবালয়ে যাওয়ার সময় সকাল ১০টার দিকে মৎস্য ভবনের কাছে টেলিফোনে জানতে পারেন, পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে। এরপর তিনি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ মির্জা আজমকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বাসভবন যমুনায় যাওয়ার অনুরোধ জানান। তিনিও গাড়ি ঘুরিয়ে যমুনায় যান।

পরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বেলা একটার দিকে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ও মির্জা আজমকে পিলখানায় গিয়ে বিডিআরের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায় কি না, সেই চেষ্টা করে দেখতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে ব্রতী হয়ে তাঁরা পিলখানার উদ্দেশে রওনা হন। তিনি বলেন, ‘পিলখানার ফটকে গিয়ে মাইকে আমার ও মির্জা আজমের নম্বর জওয়ানদের দেই। আমরা সাদা পতাকা হাতে এগোতে থাকি। একপর্যায়ে তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা এগিয়ে যাই। জওয়ানরা আমাদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে পাঠান, তাঁর সঙ্গে কথা বলব। আমরা সেনাবাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী। আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। ঢাকা শহর তামা করে দেব।” একপর্যায়ে আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে বলে, “তোদের মেরে ফেলব।”’
জেরা: জবানবন্দির পর জাহাঙ্গীর কবিরকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম।
প্রশ্ন: যেসব সৈনিককে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসায় গিয়েছিলেন এবং হোটেল আম্বালায় আলোচনায় বসেছিলেন, তাঁদের কারও নাম কি আগে থেকে জানতেন?
নানক: না।
প্রশ্ন: গন্ডগোলের খবর পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসায় ঢোকার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কাছে কি ফোন করেছিলেন?
নানক: না, করিনি।
প্রশ্ন: যমুনায় যাওয়ার পর আপনার মোবাইলে বারবার ফোন আসছিল, এ কথা তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, যা তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় নথিভুক্ত করেছেন।
নানক: এটা মনে নেই।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে একটি ও সেনাবাহিনীর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল, জানতেন?
নানক: সেনাবাহিনীরটা জানতাম।
প্রশ্ন: সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটি আপনাকে কি ডেকেছিল?
নানক: হ্যাঁ, আমি সেখানে জবানবন্দি দিয়েছি।
প্রশ্ন: সেনাবাহিনীর তদন্ত দলের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে আসার পর অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন?
নানক: আমি কবে গেলাম বলেন? এটা সত্য নয়।
প্রশ্ন: ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় প্রধানমন্ত্রীর রাতের খাবারের দাওয়াত ছিল। ২৪ তারিখে সেটা বাতিল করা হয়েছিল, জানেন?
নানক: জানা নেই।
প্রশ্ন: বিদ্রোহ শুরুর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাংসদ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে সৈনিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা হয়েছিল?
নানক: জানা নেই।
প্রশ্ন: পিলখানার ভেতরে হত্যাযজ্ঞের খবর কখন পেয়েছিলেন?
নানক: ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটার দিকে পিলখানার ভেতরে যাওয়ার পর হত্যাযজ্ঞের খবর জানতে পারি।
প্রশ্ন: বাইরে কিছু লোক মারা যাওয়ার খবর?
নানক: পিলখানার বাইরে কিছু বেসামরিক লোক, পুলিশ আহত হওয়ার খবর আগে পেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আপনি তো তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘আমরা বাসার ভেতর গিয়ে দেখি, যমুনায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানগণ এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন।’
নানক: এটা স্মরণে নেই।
প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী তো তাঁর বক্তৃতায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন?
নানক: এটা ছিল শর্ত সাপেক্ষে।
প্রশ্ন: আপনারা যাঁদের মুক্ত করেছিলেন, তাঁদের নাম বলতে পারবেন?
নানক: না, মনে নেই।
প্রশ্ন: বিদ্রোহের পর ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে দরবারে গিয়েছিলেন, জানেন?
নানক: আমি যাইনি।
প্রশ্ন: সেনাকুঞ্জে আপনার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
নানক: সেটা আমি জানি না।
মাসুদের জবানবন্দি: নানকের জেরা শেষে আদালত কিছু সময় মুলতবি হয়। এরপর বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার (বর্তমানে চীনে বাংলাদেশের দূতাবাসে সহকারী সামরিক উপদেষ্টা) সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাসুদ জবানবন্দি দেন। মাসুদ বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় একটি হেলিকপ্টার নিয়ে পিলখানার ওপর দিয়ে উড়ে যান। পরে তাঁকে বলা হয়, পিলখানা থেকে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি হচ্ছে। তখন তিনি তিন হাজার ফুট ওপরে চলে যান।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জানতে চান, হেলিকপ্টারে কজন বসতে পারেন? জবাবে মাসুদ বলেন, দুজন পাইলটসহ আটজনের বসার ব্যবস্থা আছে। আইনজীবী বলেন, ‘আপনারা হেলিকপ্টার থেকে পিলখানায় বৃষ্টির মতো গুলি করেছিলেন।’ সাক্ষী বলেন, ‘এটা সত্য নয়।’
পরে ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুল মুনিরা জবানবন্দি শুরু করার কিছুক্ষণ পর আদালতের কার্যক্রম আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
প্রতিমন্ত্রী দ্রুত বক্তব্য দেওয়ায় বিচারক জহুরুল হক তাঁকে আস্তে বলার অনুরোধ করে বলেন, ‘ব্রিটিশ পদ্ধতিতে আদালত চলছে। মাননীয় মন্ত্রী দেখে যান, বিচারব্যবস্থা কীভাবে চলছে।’

শিক্ষানীতির জন্য ছাত্রসমাজের সংগ্রামের ৫০ বছর নুরুল ইসলাম নাহিদ |




আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের শিক্ষানীতির জন্য গৌরবময় সংগ্রামের অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হলো। ১৯৬২ সালের সেই গৌরবের দিনটি আমরা প্রতিবছর ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছি।
ষাটের দশকে আমাদের দেশের গৌরবময় ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র সংগঠনগুলোর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষানীতি প্রতিরোধ করা এবং একটি গণমুখী, অগ্রসরমাণ, বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, আধুনিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯৬২ সালে তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতি, ১৯৬৪ সালে হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষানীতি, ১৯৬৯ সালে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে শিক্ষানীতি—সবই তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মুখে বাতিল করতে পাকিস্তানি সরকার বাধ্য হয়েছিল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত করে আনলেও তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর, তা আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরপর প্রায় তিন দশক ধরে পাঁচ-ছয়টি শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হলেও কোনোটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। বাষট্টির গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আমি শিক্ষানীতির আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলাম। আজ অর্ধশতাব্দী পর সফল শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গেও আমি সরাসরি সম্পৃক্ত আছি। আজকের এই শিক্ষা দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সেদিনের শহীদ বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ শিক্ষা আন্দোলনের সব নেতা-কর্মীকে।
জাতীয় শিক্ষানীতি দু-এক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করার বিষয় নয়। ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, অনেকগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। ২০১১ সালের মধ্যে সব শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ২০১৮ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১১ সালের মধ্যেই ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অন্যটির জন্য বহু কার্যক্রম ও প্রস্তুতি চলছে।
অনেকে বলেন, শিক্ষানীতি তো বাস্তবায়িত হলো না। তাঁদের ধারণা, কোনো এক সরকারি ঘোষণায় এক দিনে সবকিছু বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এই দরিদ্র দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিক্ষার্থী। মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নিরক্ষর, বহু ধারার শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। দুনিয়ার মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করা হয় যেসব দেশে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। পুরোনো পদ্ধতি, পুরোনো পাঠ্যক্রম, পুরোনো ধ্যান-ধারণার অধিকাংশ শিক্ষক, সুযোগ-সুবিধার অভাব, বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষমতাবানদের চাপ এবং তার ফলে যথাস্থানে উপযুক্ত লোক নিয়োগদানে বাধা, এমনকি আইন ও বিধিমতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি করাও বড় বাধা ইত্যাদি হাজার সমস্যা কাটিয়ে ওঠা এবং একদিকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, অন্যদিকে দক্ষ জনবল, দক্ষ শিক্ষক, দক্ষ পরিচালকসংকট ইত্যাদি তো সচেতন মহলের একেবারেই অজানা নয়।
এসব বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে সীমাবদ্ধ সম্পদের ব্যবহার করে আমাদের এগোতে হচ্ছে। অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও জঞ্জাল পরিষ্কার করে একটি স্বচ্ছ, দক্ষ, গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার কাজ শুরু থেকেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনেক ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা ও বাধা রয়েছে, তা আমরা বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সংশোধন করে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
নিচে বর্তমান সরকারের সময়ে শিক্ষা খাতে অগ্রগতির কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো:
১. সব মত-পথ, শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে প্রচার, আলোচনা, সভা-সেমিনার, ওয়েবসাইটে মতামত, লিখিত মতামত গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রথম একটি জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে।
২. ২০১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশের বেশি শিশু স্কুলে ভর্তি করা সম্ভব হয়েছে। ঝরে পড়ার হার ৪৮ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে।
৩. আন্তর্জাতিকভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নির্ধারিত বছর ২০১৫ সাল। কিন্তু আমরা তার অনেক আগেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলে ও মেয়েদের সংখ্যাসমতা অর্জন করেছি এবং তা এখন স্থিতিশীল। উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের সমতা অর্জন এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আদর্শ (মডেল) দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
৪. ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারি মোট ৬৫ কোটির অধিক পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর আগে শুধু প্রাথমিক স্তরে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হতো। তা-ও মার্চ-এপ্রিলের আগে সম্ভব হতো না। ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারিতে নতুন পাঠক্রম (কারিকুলাম) অনুযায়ী লিখিত প্রায় ২৭ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।
৫. বর্তমানে যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়, তা লেখা হয়েছে ১৬ বছর আগে। ইতিমধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। এর প্রভাব আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। আমরা পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছি। গত বছর নতুন পাঠক্রমে সাতটি নতুন বই দিয়েছি। ২০১৩ সালে আরও ৮৬টি নতুন পাঠক্রমের বই তুলে দেওয়ার কাজ চলছে।
৬. সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণী শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাদ্রাসায় জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখা, সারা দেশে সমমান অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন আর ভিন্নভাবে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না। পরীক্ষার সংখ্যাও কমে গেছে।
৭. এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এগিয়ে এনে সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এখন প্রতিবছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু করা হয় ১ এপ্রিল। এসব পরীক্ষার ফলাফল ৬০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু। ফলাফল ৩০ দিনের মধ্যে। প্রথম বছর মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ফল প্রকাশ, পরে ইন্টারনেট, টেলিকনফারেন্স এবং এ বছর পেপারলেস অনলাইনে এসএসসি-এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে।
৮. পাসের হার সারা দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৮৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া কৃতী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও প্রতিবছর বেড়ে চলেছে।
৯। অনুরূপভাবে এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায়ও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হার লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে।
১০. সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও পরীক্ষার ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয় যৌক্তিকভাবে বোঝা ও উপস্থাপনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে একটি যুক্তিনির্ভর সমাজ তৈরি হচ্ছে।
১১. প্রায় ১২ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষক-প্রশিক্ষককে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
১২. স্কুলে ১ জানুয়ারি এবং কলেজে ১ জুলাই ক্লাস চালু করা সম্ভব হয়েছে। আগে ফেব্রুয়ারি-মার্চের আগে নিয়মিত ক্লাস শুরু হতো না।
১৩. প্রায় ৭৮ লাখ প্রাথমিক ও প্রায় ৪০ লাখ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মেধা তালিকায় প্রায় ১ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার লক্ষ্যে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে।
১৪. প্রাথমিক স্তরে ৮৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে প্রায় দুই হাজার এবং স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
১৫. ৪৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় আট হাজার নতুন ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে অথবা চলছে। সরকারি উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে দুই শিফট খোলা হয়েছে।
১৬. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। নতুন আরও আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পেয়ে চালু হয়ে গেছে।
১৭. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য দেশের ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৬টি গবেষণা উপপ্রকল্পে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষা খাতের গবেষণায় এর আগে এত বেশি বরাদ্দ আর কখনো দেওয়া সম্ভব হয়নি।
১৮. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে ব্যাপক প্রচার, জনমত গড়ে তোলাসহ বহু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীসংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯. ২০ হাজার ৫০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু করার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। তৈরি করা হচ্ছে ডিজিটাল কন্টেন্ট।
২০. কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি হাতে-কলমে শিক্ষাদানের জন্য ১৭টি মাইক্রোবাসে মোবাইল কম্পিউটার ল্যাব এক বছর ধরে দেশের পশ্চাৎপদ অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে।
২১. শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন, পরীক্ষার ফরম পূরণ প্রভৃতি কাজ এখন অনলাইনে হয়ে যাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার যাবতীয় কাজ, নিয়োগ, মন্ত্রণালয়ের সব সিদ্ধান্ত, পরিপত্র, সার্কুলার, প্রজ্ঞাপন, বদলি, প্রমোশন, ছুটি, অবসরভাতা ও কল্যাণ ট্রাস্ট এখন বেসরকারি শিক্ষকদের অনলাইনে আবেদন গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় অনলাইনে মুহূর্তের মধ্যেই সবাই জানতে পারছেন।
২২. ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২৩. বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু প্রভৃতি বিষয়ে যেসব মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ শুদ্ধ করে সঠিক তথ্য ও ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে যথাযথভাবে স্থাপন করা হয়েছে।
২৪. ভর্তি-বাণিজ্য, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
২৫. মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
২৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। অপচয় ও অপব্যবহার বন্ধের জন্য সদা সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুরু থেকেই আমি বলে আসছি, জনগণের সীমিত সম্পদ দিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। তাই এক টাকা দিয়ে দুই টাকার কাজ করতে হবে, এ জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
৩২। প্রথম থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোর তত্ত্বাবধানে বছরে দুবার স্কুল-মাদ্রাসা থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে। শারীরিক-মানসিক বিকাশের জন্য এটা জরুরি।
৩৩। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচলিত নানা অনিয়ম, অসংগতি দূর করা এবং আরও উন্নত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, বিশেষ করে শিক্ষানীতি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য ‘নতুন শিক্ষা আইন’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
এখানে সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের বিগত সাড়েতিন বছরে শিক্ষা খাতে সাধিত কতিপয় অগ্রগতির বিষয় উল্লেখ করা হলো। সহজেই এ রকম তালিকা বহু গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ ধরনের বহু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ সবকিছুই জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর বাস্তবায়ন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার লক্ষ্য এবং মৌলিক নীতিগুলো ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য ও নীতি বাস্তবতার ভিত্তিতে সৃজনশীলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটাই সঠিক পন্থা। শুধু স্লোগান দিয়ে নয়, এর ফলাফল দেখেই বিচার করতে হবে। এভাবেই শিক্ষা দিবসের লক্ষ্য ও তাৎপর্য অর্জন সম্ভব।
নুরুল ইসলাম নাহিদ: শিক্ষামন্ত্রী। প্রথম আলো

নো ইজি ডে :লাদেন হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-৪: হ্যাঁ, ওসামা বিন লাদেন : মশিউল আলম



আকাশে চাঁদ নেই, অ্যাবোটাবাদ শহরে লোডশেডিং চলছে। সর্বাধুনিক সমরপ্রযুক্তিতে সুসজ্জিত মার্কিন কমান্ডো বাহিনী পুরো অভিযান চালাচ্ছে পিচকালো আঁধারে নিমজ্জিত বাড়িটির ভেতরে। অভিযানে অংশগ্রহণকারী ২৪ জন কমান্ডো, অভিযান পরিচালনাকারী অফিসার ও সিআইএর লোকজন পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বেতারযন্ত্রের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যেটাকে বলা হচ্ছে ‘ট্রুপ নেট’।
অন্ধকার আকাশের কোথাও চিলের মতো চক্কর খাচ্ছে চালকবিহীন বিমান (ড্রোন), সেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে পুরো অভিযানের ভিডিওচিত্র। ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে অভিযান পর্যবেক্ষণ করছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিসহ পেন্টাগন-সিআইএর কর্তারা। লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে—অভিযান পরিচালনাকারীর মুখ থেকে তাঁরা এই নিশ্চিত ঘোষণা শোনার জন্য উদগ্রীব।
কিছুক্ষণ আগেই নিথর হয়ে গেছে লাদেনের বিধ্বস্ত-রক্তাক্ত দেহটি; মেঝেতে নিজের রক্তের ধারায় ডুবে যাচ্ছে তাঁর লাশ। খাটে নিজের একটি পায়ের কবজি চেপে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করছে একটি মেয়ে; দূরের এক কোণে, ব্যালকনিতে যাওয়ার স্লাইডিং কাচের দরজার গোড়ায় গুটিসুটি বসে আছে তিনটি ভয়ার্ত, নির্বাক শিশু।
ম্যাট বিসোনেট লিখছেন, ‘লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াল্ট। এখনো অন্ধকার, লোকটির মুখ দেখে তাকে চেনা যাচ্ছে না।..আমি আমার হেলমেটের রেইল সিস্টেমের সঙ্গে লাগানো লাইটটি জ্বালালাম।... বাড়ির সব জানালায় পর্দা টানা, বাইরে থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, সুতরাং এখন আলো জ্বালানো চলে।
‘..বুলেটের আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে লোকটির মুখমণ্ডল। কপালের ডান পাশে একটা গর্ত, মাথার ডান অংশটি উড়ে গেছে। ঝাঁজরা হয়ে গেছে বুকের বুলেটবিদ্ধ জায়গাগুলো। সে পড়ে আছে, রক্তের ধারা বেড়ে চলেছে তার চারপাশে। আমি উবু হয়ে আরও কাছে থেকে তাকে দেখার জন্য তাকালাম, আমার পাশে টমও তাই করল।’
‘টম বলল, “আমার মনে হচ্ছে, এ সে-ই।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বেতারে জানিয়ে দিল না টম, কারণ ও জানে এই খবর ওয়াশিংটনে পৌঁছে যাবে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গের মতো। আমরা জানি, প্রেসিডেন্ট ওবামা শুনছেন। সুতরাং আমাদের কোনো ভুল না হয়ে যায়।
‘আমি আমার মাথার ভেতরের চেকলিস্টগুলো একবার উল্টেপাল্টে দেখে নিলাম: লোকটা বেশ দীর্ঘ। প্রায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। ঠিক আছে, মিলে যাচ্ছে। তিনতলায় পুরুষ লোক থাকার কথা মাত্র একজন, তিনি লাদেন। মিলে যাচ্ছে। দুই বার্তাবাহক যে দুই জায়গায় থাকবেন বলে সিআইএ আমাদের বলেছিল, তাঁরা ঠিক সেই দুই জায়গাতেই ছিলেন। মিলে যাচ্ছে।
‘যতই তাঁর মুখের দিকে দেখি, আমার চোখ আকৃষ্ট হয় নাকটির দিকে। নাকটি অক্ষত আছে, আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিট থেকে বুকলেট বের করে কমপোজিট ফটোগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। লম্বা নাকটি মিলে যাচ্ছে। দাড়ি ঘনকালো, আমি যেমন ভেবেছিলাম, সে রকম পাকা চুল একটাও চোখে পড়ল না।...
‘রাবারের গ্লাভস হাতে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলাম, ওয়াল্ট তৈরি হতে লাগল কয়েক সেট ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য।..খাটের ওপর যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন যে মহিলা, তাঁর পায়ের জখমের শুশ্রূষা করছিল উইল, ও আরবি বলতে পারে। আমরা পরে জেনেছি, মহিলার নাম আমাল আল-ফাতাহ, লাদেনের পঞ্চম স্ত্রী। আমি জানি না কখন কীভাবে তিনি জখম হয়েছেন, কিন্তু জখমটা খুবই সামান্য। সম্ভবত বুলেটের টুকরা বা ভাঙা কোনো কিছুর টুকরার আঘাত লেগেছে তাঁর পায়ের কবজিতে..।”
ঘটনার পরদিন লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে লেখা হয়, মহিলার নাম আমাল আহমেদ আল-সাদাহ, বয়স ২৯, একজন ইয়েমেনি, লাদেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় আফগানিস্তানে, ১১ বছর আগে। তিনি তাঁর পঞ্চম স্ত্রী। হোয়াইট হাউসের সূত্রে গার্ডিয়ান লেখে, তিনি পায়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। পত্রিকাটির একই প্রতিবেদনে লেখা হয়, ওই ঘরেই আহত হয়েছিল লাদেনের ১২ বছর বয়সী মেয়ে সাফিনা/সাফিয়া বা আয়েশা। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লেখা হয়, মেয়েটির জখম ছিল পায়ের গোড়ালিতে; মার্কিন কমান্ডোরা লাদেনের শোবার ঘরে ঢোকার আগে সম্ভবত গ্রেনেড ছুড়েছিলেন।
লাদেনের মুখমণ্ডলের ছবি তোলার চেষ্টা করছেন ম্যাট। তিনি লিখছেন, ‘ওয়াল্ট তার কিট থেকে ক্যামেলব্যাক হোস টেনে বের করে লোকটার মুখে পানি ছুড়তে লাগল। আমি খাট থেকে একটা কম্বলের এক অংশ ব্যবহার করে তাঁর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছে দিতে শুরু করলাম। প্রতি ঘর্ষণে মুখটি আরও পরিচিত মনে হতে লাগল। আমি তাঁকে যে রকম বয়স্ক ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বেশ কম বয়সী দেখাচ্ছিল তাঁকে। তাঁর দাড়ি কালো, মনে হয় কলপ লাগানো হয়েছে।’
অভিযানের প্রস্তুতির সময় এক রাতে ম্যাট, ওয়াল্ট ও চার্লির মধ্যে গল্প হচ্ছিল: লাদেনকে পাওয়া গেলে তাঁর শরীরের কোন অংশে গুলি করা উচিত হবে, কার কী মত। ম্যাট লিখছেন: “‘ওয়াল্ট বলেছিল, ‘চেষ্টা কোরো, [মুদ্রণ-অযোগ্য] ..টার মুখমণ্ডলে গুলি না করার। কারণ, ওর ছবি সবাই দেখতে চাইবে।’ চার্লি বলেছিল, “কিন্তু যদি অন্ধকার থাকে, আর আমি ওর মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পাই, তা হলে আত্মঘাতী বোমায় মরার অপেক্ষা করব না।” আমি বলেছিলাম, ‘..সুযোগ যদি পাওয়া যায়, আমি বলব, বুকে গুলি চালানোই ঠিক হবে।’
ম্যাট দেখতে পেলেন, সেই এখন মুখটা সত্যিই বিধ্বস্ত। ছবি তোলার জন্য রক্ত পরিষ্কার করতে করতে তিনি ভাবছেন: ‘এ রকম জঘন্য একটা মুখ এমন কাছে থেকে দেখা কী অদ্ভুত! গত এক দশক ধরে আমরা যুদ্ধ করে চলেছি যে লোকটার কারণে, সে এখন আমার সামনে পড়ে আছে। ছবি তোলার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দাগি আসামির মুখমণ্ডলের রক্ত পরিষ্কার করার চেষ্টা কেমন পরাবাস্তব মনে হচ্ছে!...এখন আমার দরকার ভালো মানের কিছু ছবি...
‘কম্বল সরিয়ে রেখে আমি আমার ক্যামেরাটা টেনে বের করলাম। এই ক্যামেরায় গত কয়েক বছরে শত শত ছবি তুলেছি আমি।..প্রথমে তুললাম পুরো শরীরের ছবি। তারপর হাঁটু গেড়ে তাঁর মাথার কাছে বসে তুললাম মুখের কয়েকটি ছবি। তাঁর দাড়ি ডানে ও বাঁয়ে সরিয়ে প্রোফাইলের কয়েকটি ছবি নিলাম। আমি আসলে চাচ্ছিলাম তাঁর নাকের ওপর ফোকাস করতে...আমি ওয়াল্টকে বললাম, “ওর ভালো চোখটা খুলে ধরো।” ওয়াল্ট নিচু হয়ে তাঁর চোখের পাতা টেনে ধরল, খুলে গেল প্রাণহীন খয়েরি চোখটি। আমি জুম ইন করে চোখের একটা ছবি নিলাম।...’
নিহত লাদেনের ছবি যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি। কিন্তু ইন্টারনেটে অনেক ছবি বেরিয়ে পড়েছিল। সেগুলোর অধিকাংশই নকল, বানানো ছবি। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ফ্রিডম অব ইনফরমেশন আইন ব্যবহার করে নিহত লাদেনের ছবি প্রকাশ করার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছবি প্রকাশের অনুমতি দেননি এই যুক্তি দেখিয়ে যে তার ফলে আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ বেড়ে যাবে। ম্যাট বিসোনেট (মার্ক ওয়েন) তাঁর নো ইজি ডে বইটিতেও কোনো আলোকচিত্র প্রকাশ করেননি।
তিনতলায় লাদেনের শোবার ঘরে ম্যাট যখন নিহত লাদেনের ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন বাইরে অভিযান শেষ করে কমান্ডোদের আফগানিস্তান ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানে একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই লেখার আগের পর্বগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি যে কমান্ডোদের বহনকারী দুটি ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টারের একটি নামার সময় লাদেনের বাড়ির বাইরের প্রাচীরের সঙ্গে তার পুচ্ছদেশের আঘাত লেগে ক্র্যাশ করে। সেটি অচল হয়ে সেখানেই পড়ে আছে। কমান্ডোদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশিষ্ট হেলিকপ্টারটি যথেষ্ট নয়। তাই তাঁদের নিতে আসছে একটি চিনুক হেলিকপ্টার। কিন্তু তার আগে অচল হেলিকপ্টারটিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। বাইরে সেসব আয়োজন চলছে, ম্যাট বিসোনেট তাঁর হেলমেটের সঙ্গে যুক্ত ‘ট্রুপ নেটের’ মাইক্রোফোনে অন্য কমান্ডোদের কথাবার্তা শুনছেন, আর লাদেনের ছবি
তুলছেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি ছবি তুললেন, সিল বাহিনীর ক্যামেরায়।
ওপাশে তাঁর সহযোদ্ধা ওয়াল্ট সংগ্রহ করছেন লাদেনের ডিএনএ নমুনা: ‘ওয়াল্ট লাদেনের রক্তে তুলা চুবিয়ে নিল, আর কিছু তুলা তাঁর মুখে গুঁজে দিয়ে নিল লালার নমুনা। অবশেষে ও বের করল সিআইএর দেওয়া স্প্রিং লাগানো একটা সিরিঞ্জ, অস্থিমজ্জার নমুনা সংগ্রহের জন্য। ঊরুর হাড়ে এই সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে অস্থিমজ্জার নমুনা কীভাবে সংগ্রহ করতে হয় তা আমাদের শেখানো হয়েছে। ওয়াল্ট লাদেনের ঊরুতে সিরিঞ্জ ঢোকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সুঁই কিছুতেই হাড়ের ভেতরে ঢুকছে না...’
অভিযানের এ পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তখনো বাকি। সেটি করার চেষ্টা করছেন ম্যাটের আরবি-জানা সহযোদ্ধা উইল। মেঝেতে যে লাশটি পড়ে আছে, সেটি যে সত্যিই ওসামা বিন লাদেনের, এটা নিশ্চিত করতে হবে। ম্যাট লিখছেন, ‘লাদেনের স্ত্রী আমাল পায়ের জখম নিয়ে এখন ছটফট করে চলেছেন, তিনি কোনো কথা বলতে নারাজ। অন্য মহিলার চোখ দুটি কান্নায় ফুলে উঠেছে, উইল আরবিতে তাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, মৃত লোকটি কে? কিন্তু মহিলা কিছু বলছেন না, শক্ত হয়ে আছেন।
“তাঁর নাম কী?”
‘মহিলা বললেন, “শেখ।”’
‘উইল বলল, “শেখ কে?” মহিলা আরও কয়েকটি ডাক নাম বা ছদ্মনাম বললেন। উইল তখন সেখান থেকে গেল ব্যালকনিতে, শিশুদের কাছে। ওরা তখনো সেখানে দেয়ালের পাশে চুপ করে বসে আছে। উইল হাঁটু গেড়ে ওদের সামনে বসে একটি মেয়েকে বলল, “কে এই লোক?”
‘মেয়েটি মিথ্যা বলতে জানে না, সে বলল, “ওসামা বিন লাদেন।”
‘উইলের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ও মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সত্যিই জানো তো, এটা ওসামা বিন লাদেন?”
মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ।”
‘...ব্যালকনি থেকে ফিরে আসার সময় উইল হলওয়েতে লাদেনের এক স্ত্রীর হাত চেপে ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এখন তামাশা বন্ধ করেন!”
আগের চেয়ে কঠোর কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, “শোবার ঘরে লোকটি কে?”
মহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। ভীষণ ভয় পেয়ে বললেন, “ওসামা।”
উইল বলল, “ওসামা কী?”
মহিলা বললেন, “ওসামা বিন লাদেন।”’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।#প্রথম আলো