Tuesday, June 3, 2014

আদম মালিক, জিয়া এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বিতর্ক- আনিস আলমগীর


স্বাধীনতার একযুগের মাথায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার দল আবিষ্কার করে যে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। আর স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর জিয়ার স্ত্রী-পুত্র মিলে আবিষ্কার করেছেন জিয়া শুধু ঘোষকই নন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি!
মূলত গত ২৫ মার্চ মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দেড়টায় পূর্ব লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি অডিটরিয়ামে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারেক রহমান প্রথম তার আবিষ্কারের কথা বলেন। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া তারই প্রতিধ্বনি করেন ঢাকায়। জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে সঠিক ইতিহাস জানানোর সময় এসেছে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট এটাই সত্যি, এটাই ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
প্রথম রাষ্ট্রপতি বানানোর এই আয়োজন যে হঠাৎ করে আসেনি, এটা যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সেটা তারেক জিয়ার আলোচনা সভার টাইটেল থেকেই বোঝা যায়, ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক।’ আমার জানা মতে, বেগম জিয়া ঢাকায় তার ছেলের বক্তব্য প্রতিধ্বনি করার আগে ১৯ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গেও এটা নিয়ে আলাপ করেছেন এবং তাদেরও একই সুরে কথা বলার অনুরোধ করেছেন। কাজী জাফররা হয়তো শিগগির একই সুরে বাজনা বাজাবেন।
তারেক জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শিশু ছিলেন। ওই যুদ্ধের স্মৃতি তার তেমন না থাকারই কথা। বেগম জিয়া ভালোভাবেই দেখেছেন ওই যুদ্ধ। তার স্বামী স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে যখন ভারতে, তাকে চট্টগ্রামের বাসা থেকে শুভপুর হয়ে আগরতলা নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছিলেন জিয়া। সেই লোকদের একজন আমাকে বলেছেন, তিনি হাঁটতে পারবেন না। বাসে, হেঁটে এতদূর কীভাবে যাবেন প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে জাহাজে করে ঢাকা চলে গেছেন। দেশের বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টমেন্টে ছিলেন। বেগম জিয়ার ক্যান্টমেন্টে অবস্থান নিয়ে নানা কথা চালু আছে। সেই ইতিহাসে না গিয়ে শুধু একটা কথা বলতে চাই, আজ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে, ?ফাঁসিও হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর। পাকিস্তানি আর্মিকে সহযোগিতার অভিযোগ এনে একদিন কেউ খালেদা জিয়াকেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার দাবি করলে আশ্চর্য হব না। খালেদা জিয়া যখন ইতিহাস বিকৃতিতে নেমেছেন তখন আওয়ামী লীগ মুখ বন্ধ করে বসে থাকবে মনে হয় না। তবে তাতে কী হবে? জাতীয় নেতাদের অতীতের বিতর্কিত জীবন জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে যাবে। অহেতুক আরেকটি বিতর্কের শুরু হবে, যা দেশের মানুষের মোটেও কাম্য নয়।
উচ্চ আদালত থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনার পরও যারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেন, এখন প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে যারা রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চান, তারা আসলে কুতর্কের জন্যই এসব চান। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে অবদান ছিল সেটাকে খাটো করার জন্য, তার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের নেপথ্য কাহিনী যে যেভাবেই আবিষ্কার করা হোক না কেন এটা তো বলা যাচ্ছে না, মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার কোনো অবদান ছিল না। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেতার থেকে তিনি একটি ঘোষণা দিয়েছেন। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওই ঘোষণার প্রথমটিতে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। পরোক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মরহুম একে খানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা জিয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নানসহ অন্যরাও পাঠ করেছেন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সিটি নেতা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী দাবি করেন, ‘ঘোষণা পাঠ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা হয় তাহলে ছাত্রলীগ নেতারাই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষক’। ২৫ মার্চ রাতে জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন বলে আমাদের মাইকিং করতে নামিয়ে দেন শহরে। রিকশায় রিকশায় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন বলে প্রচার চালাই।

 প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যানুসারে, জিয়া যখন ২৭ মার্চ কালুরঘাটের ব্রিজের নিচ থেকে রেডিওস্টেশনে আসেন, তার পরিচয় জানতে চান বেলাল মোহাম্মদসহ রেডিও কর্মীরা। তিনি বলেন, আমি মেজর জিয়া। তখন তারা বলেন, আমরা সবাই তো মাইনর, আপনি একজন মেজর আছেন। আপনি কিছু বলেন। আমরা আগ্রাবাদ থেকে রেডিওর সম্প্রচার যন্ত্র খুলে নিয়ে এসেছি। জিয়া তখন নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও স্বাধীনতার অস্থায়ী প্রধান সমরনায়ক বলে তার প্রথম ঘোষণাটি দেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ঘোষণা দিলেই জিয়া দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন? পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সেখানকার নেতা আদম মালিক, যিনি পরে সেদেশের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি কিন্তু সুকর্ণই ছিলেন, জাতির পিতাও তিনি। যুদ্ধের ডামাডোলে কত ঘটনাই ঘটে, জাতি সেটা ভুলে যায়। জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি কি ইনটেনশনাল নাকি নেহায়েত ভুল এ নিয়ে যুদ্ধকালে কলকাতায় প্রবাসী সরকারেও চলছিল নানা আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, জেনারেল ওসমানী, মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণার জন্য তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরীর হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি।

 বিএনপির নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দিচ্ছেন, যেহেতু কালুরঘাটের সেই ঘোষণা থেকে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠন পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না,  রাষ্ট্রপ্রধান ছিল না তাই জিয়া ওই সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান এ প্রসঙ্গে একটি কলামে  লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানের ঘোষণা অস্বীকার করলে স্বাধীনতার যুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়, এর ইতিহাস বিকৃত ও ধারাবাহিকতা বিঘিœত হয়। জিয়া নিজেকে তার ঘোষণায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা বৈধ হলে, প্রবাসী সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও তিনিই বৈধ ছিলেন। তার এই ঘোষণাকে আর কোনো ঘোষণা মারফত কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কখনো রদ বা রহিত করেননি।’
কি হালকা, হাস্যকর যুক্তি। তিনি এর পরের কাহিনী বেমালুম চেপে গেলেন কেন জানি না। জিয়ার ঘোষণা তো জিয়া নিজেই রদ করেছেন পরোক্ষণে ‘আমি মেজর জিয়া প্রভিশনাল কমান্ড ইন চিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে ভাষণ দিয়ে। এখানে অন্যকে রদ করতে হবে কেন! এই যে যার পক্ষে তিনি তার ঘোষণা রদ করলেন তিনি তাহলে কে? যিনি নিজের ভাষণে নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলে পরোক্ষণেই তা বাতিল করে দিয়েছেন, যিনি নিজেকে জীবিত থাকাকালে কোনোদিন স্বাধীনতার ঘোষক বলেননি তাকে জোর করে আরেকজনের সমান বানানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা কতটুকু সন্মান বয়ে আনে ওই মানুষটির জন্য?
স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি আর এখন গোপন কোনো দলিল নয়। সবাই জানেন। মনে হচ্ছে জানতে এবং মানতে চান না শুধু বিএনপির কিছু নেতা। তারা এটাও বিশ্বাস করাতে চান যে, শেখ মুজিবের ডাকে নয়, জিয়ার ডাকে এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, ২৭ মার্চ এবং তার পরের কালুরঘাটের সেই ঘোষণা নাকি সারাদেশের মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে! রংপুরের বিএনপি নেতারা তেমন দাবি করেন, নিজের কানে শুনেছেন বলে। বাস্তবতা হচ্ছে, কালুরঘাট বেতারের চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত আসা মুশকিল ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারেক রহমান বা বেগম জিয়ার ভাষ্যানুসারে ‘জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার  মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল’ কথাটা যদি সত্য হয়, সেনাবাহিনীর মেজরের চাকরির মোহ ত্যাগ করে সেনানিবাস ছেড়ে জিয়াউর রহমান সহকর্মীদের নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজের নিচে অবস্থান নিয়েছিলেন কার আহ্বানে? কেন ট্র–পস নিয়ে ব্যাংকারে অবস্থান করে আরাকান রোড দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা কক্সবাজারের দিকে মার্চ করলে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি? কার আহ্বানে মেজর শওকত, মেজর রফিক, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন শমশের মবিনসহ অন্যরা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন? ক্যান্টনমেন্ট ছেড়েছেন? খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া না বললেও, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না আহ্বানটি ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের।
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটি কোনো নিয়মিত যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল জনযুদ্ধ। ঘরে ঘরে গিয়ে বলে এলে যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার। দীর্ঘ ২৩ বছর সে প্রস্তুতির কাজটি করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। আমরা বাঙালি, ওরা পাকিস্তানি আমরা কখনো এক হয়ে থাকতে পারব না, এই বোধ একদিনে তৈরি হয়নি। যুদ্ধের এই প্রস্তুতি কত তেজদীপ্ত ছিল যে জিয়াউর রহমানের মতো একটি নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কালুরঘাটে অবস্থান নিয়েছেন, মওলানা ভাসানীর মতো একজন বরেণ্য নেতা পথের ক্লান্তি ভুলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসামে পৌঁছেছিলেন। শেখ মুজিব বাঙালির ধমনীতে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া তা নির্বাপিত হতো না। বাঙালির সে আকাক্সক্ষা কারো ঘোষণার মুখাপেক্ষী  ছিল না। কোনো জনগোষ্ঠীর কাজ সফল হতে পারে না যদি না সময় ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকে। শক্তিশালী নেতা আবহাওয়া তৈরি করে সাফল্য আনতে পারেন। শেখ মুজিব ৬ দফা আন্দোলন করে জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তিনি বাঙালি জাতির আইনানুগ অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ মিলে আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা তখন ছিল ৪১৭টি।  মূলত তখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঋষি হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে আভির্ভূত হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলব, সীমার বাইরে নিজেকে, নিজের পরিবারকে মর্যাদার আসনে বসাতে গিয়ে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার জন্য সুখকর হবে না। একটি ঐতিহাসিক সত্য তাদের অবগতির জন্য বলে রাখি গান্ধী না থাকলেও ভারত স্বাধীন হতো কিন্তু জিন্নাহ আর শেখ মুজিব না থাকলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না।

Monday, June 2, 2014

পাঠ্যবইয়ে জামায়াতের ভূয়সী প্রশংসা- উবায়দুল্লাহ বাদল



মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধিকাংশ বইতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নীতি ও আদর্শ। ইসলামের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে জামায়াত-শিবির যেসব কৌশল অনুসরণ করছে, সেগুলোই সরকারি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবর্তন করা হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা।

মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) থেকে শুরু করে কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যন্ত সব স্তরের পাঠ্যপুস্তক ও নোট-গাইডে সুকৌশলে জামায়াতের দর্শন- মওদুদীবাদ ও তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি এসব বই প্রকাশ করেছে জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ১০টি প্রতিষ্ঠান।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আলিয়া মাদ্রাসার অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রণয়ন করা হয়েছে এ প্রতিবেদন। বিশেষজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসির ও মুহাদ্দিস সমন্বয়ে গঠিত ২১ সদস্যের কমিটি ব্যাপক পর্যালোচনার পর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জামায়াতি ও মওদুদী দর্শনযুক্ত বই অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহারসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


এছাড়া মাদ্রাসার বইতে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, জাতির পিতা শব্দ ব্যবহার না করা এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বদলে জামায়াতি দর্শন শেখানো হচ্ছে বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। ২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সোমবার সরকারের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ প্রতিবেদনই প্রমাণ করবে কিভাবে শিক্ষার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জামায়াতি ও মওদুদী দর্শন পড়ানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে দেশ ও জাতি জঙ্গিবাদ থেকে রেহাই পাবে।

প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন পেয়েছি। কমিটির আগামী বৈঠকে তা উত্থাপন করা হবে। তাদের সুপারিশ পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবির সহযোগিতায় মাদ্রাসা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রচিত ও প্রকাশিত হয়। সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে এনসিটিবি বইয়ের যাচাই-বাছাই বা মনিটরিং করতে একটি কমিটি কাজ করলেও মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম (একাদশ) শ্রেণীর বইয়ের সিলেবাস প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বোর্ড নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। তবে অধিকাংশ বইয়ে লেখা থাকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অথবা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী প্রণীত। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নামে এসব বই বাজারজাত করা হলেও সিলেবাস প্রণয়ন ও বই প্রকাশের অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো তদারকি নেই তাদের।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসার প্রথম থেকে কামিল শ্রেণী পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তকের প্রচুর নোট ও গাইড বই বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে থাকে। সেসব নোট-গাইডে সিলেবাসের বাইরে জামায়াত-শিবিরের মতাদর্শ সুকৌশলে তুলে ধরা হয়। কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বাংলা অনুবাদ দেয়া হলেও কোনো রেফারেন্স বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। এসব অনুবাদের ক্ষেত্রেও দলটির নীতি ও আদর্শ তুলে ধরা হয়।


এসব বই ও গাইড যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে, সেগুলো জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা। ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াতের আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা এমন ১০ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে কমিটি। এগুলো হচ্ছে- আল-ফাতাহ পাবলিকেশন্স, আল-বারাকা প্রকাশনী, পাঞ্জেরী প্রকাশনী, কামিয়াব প্রকাশনী, আল মদিনা প্রকাশনী, মিল্লাত প্রকাশনী, ইমতেহান প্রকাশনী, ইসলামিয়া কুতুবখানা, মাদ্রাসা লাইব্রেরি ও আল-আরাফা প্রকাশনী।


মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বোর্ডের অনুমোদিত ও এনসিটিবি প্রকাশিত মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজপাঠ বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশ পরিচিতি, ধর্মীয় জীবন, জীবন সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে কৌশলে পরিহার করা হয়েছে। সিলেবাস এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যাতে বাংলাদেশ অধ্যায় স্থান না পায়। এছাড়া এসব বইয়ে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ পরিহার করে শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আলিম থেকে কামিল শ্রেণীর একাধিক বইয়েও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধকে পরিহার করা হয়েছে।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইতে প্রচুর তথ্যগত ভুল ও অসংগতি রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় ও পারিভাষিক বানানের ক্ষেত্রে কোথাও সমতা রক্ষা করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক রচনায় যাদের নাম রয়েছে তারা অনেকেই লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত নন। এমনকি আলেম হিসেবেও তাদের অনেকের পরিচিতি নেই। পাশাপাশি তৃতীয় থেকে উচ্চতর শ্রেণী পর্যন্ত বয়সস্তর অনুযায়ী কোন শ্রেণীতে কি ধরনের পাঠ ও বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন তাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

সুপারিশ : মাদ্রাসার পাঠ্যবই জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংশোধন করতে সাত দফা সুপারিশ করেছে পর্যালোচনা কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- 

১. যেসব পুস্তকে জামায়াতি আদর্শ ও মওদুদী দর্শন তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করা। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া সমীচীন। কারণ ইসলামের নাম ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ প্রচার জাতীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। 


২. বাজারে প্রচলিত পাঠ্য সহায়ক পুস্তকগুলোও পর্যালোচনা করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে পর্যলোচনা করা।


 ৩. মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে এনসিটিবির ন্যায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটি, লেখক নির্বাচন কমিটি, সম্পাদক নির্বাচন কমিটি ও পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটি থাকা প্রয়োজন। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ তৈরি করতে হলে এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞ আলেম, ওলামা, মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাচ্ছিরদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পাঠ্যপুস্তকে কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেদের হীন দলীয় স্বার্থ হাসিল করতে না পারে।


 ৪. মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণীর বইও সরকারিভাবে প্রণয়ন ও বিতরণের ব্যবস্থা করা। আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন লাখ। তাদের বিনামূল্যে বই দিলে সরকারের যে আর্থিক ব্যয় হবে, তার চেয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ অনেক বেশি হবে।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এটি জটিল সমস্যা। একদিনেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যারা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যেতে পারে। পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করার পাশাপাশি কমিটিকে মাদ্রাসার সার্বিক বিষয় মনিটরিং করার ক্ষমতাও দেয়া যেতে পারে। ওই কমিটি পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের মানবিকতা, সহনশীলতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয় ও উদার নৈতিক চিন্তার বিষয়গুলোসহ আধুনিক বিজ্ঞানও প্রযুক্তির বিষয় তুলে ধরবে। দলবাজ লোক দিয়ে এ জটিলতা দূর করা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা ড. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলছে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। হঠাৎ করেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এতদিন কেউ বিষয়টির প্রতি নজর দেয়নি, এবার তা সরকারের নজরে এসেছে। সুতরাং দেরি না করে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে জাতিকে এ বিষয়ে পরিত্রাণ দেয়া উচিত





‘যুগে যুগে ব্যক্তি সমষ্টি তথা সমিতি, সংঘ, দল প্রভৃতিও ইসলামী মূল্যবোধের অনুশীলনে যথেষ্ট অবদান রাখছে। বর্তমান শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে বহু দেশে বহু সংঘ বা দল সমাজে ইসলামী মূল্যবোধে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইখওয়ানুল মুসলেমীন, ইন্দোনেশিয়ান শরীয়ত পার্টি, মালয়েশিয়ায় প্যান মালেয়ান ইসলামী অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফগানিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের মধ্যে সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘ, ছাত্রশক্তি পরে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রভৃতি ছাত্র সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টায় মুসলিম সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বা হচ্ছে।’

এটি কোনো রাজনৈতিক দল বা ইসলামী দলের কোনো ওয়েবসাইট বা দলীয় লিফলেট বা মুখপত্রের ভাষা নয়। খোদ বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত নতুন সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ের ৫৬ পৃষ্ঠার অংশ বিশেষ। বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াত-শিবিরের আর্থিক সহায়তায় গড়ে উঠা আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স। এভাবেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পৌরনীতি শিক্ষার নামে কৌশলে ধর্মের দোহাই দিয়ে জামায়াত-শিবির কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়েছে। এমন অসংখ্য চিত্র উঠে এসেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা প্রতিবেদন’-এ। সোমবার সরকারের ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটি’র কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে ফাউন্ডেশন।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে জামায়াতি আদর্শ প্রচারের নিয়ামক হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইটির সিলেবাস প্রণীত হয়েছে। সচেতনভাবেই ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাংলাদেশ অধ্যায় বাদ দেয়া হয়েছে। এ বইয়ে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ কোনো কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বই প্রকাশের দায়িত্ব বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়া এবং সার্বিক মনিটরিং না থাকায় আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বই মওদুদী দর্শন এবং জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। 


বইগুলোতে কোরআন-হাদিসের যে অর্থ দেয়া হয়েছে তার অনুবাদক কে বা কোন সংস্থা তা উল্লেখ না থাকায় জামায়াতি মতাদর্শের আলোকে অর্থ বিকৃত করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামের পৌরনীতিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রচারপত্র বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘পাঠ্যবই অভিজ্ঞ আলেম-ওলামাদের দ্বারাই প্রণীত। তারা কোনো ভুল করে থাকলে তা পর্যালোচনা করে সংশোধন করা হবে। আর নোট বা গাইডে কোনো ধরনের ভুল তথ্য থাকলে তার ডাবল শাস্তি হবে। কারণ একে তো নোট-গাইড অবৈধ, তার ওপর ভুল তথ্য দিয়ে আরও বড় অপরাধ করেছে। তাদের ধরে পুলিশে দেয়া হবে।’


ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী আলিম শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত এবং আল-বারাকা লাইব্রেরির প্রকাশিত ‘ইসলামী পৌরনীতি’ প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র বইতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বিংশ শতাব্দীর ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইতে ‘ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়’ আবুল আলা মওদুদী, অধ্যাপক গোলাম আযম, মোহাম্মদ আসাদ ও আবুল কাশেম সিফাতুল্লাহসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।


বইটির ৪৯১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামী চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখেন এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র.)। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

একই বইয়ের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোনো কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূলকথা হল কোনো ধর্মই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে বাকি মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করতঃ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’


মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ে জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতের প্রশংসা করে ৫৮২ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে না দেয়ায়, তাদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সম্পর্ক ছিল তিক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ। ...বর্তমান সরকার পরিচালনা করছে চারদলীয় ঐক্যজোট। এ জোটের অন্যতম দুটি দল হল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। তাই বলা যায়, এদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে হয়তো একদিন তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হবে- এমন ধরণা এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের।’একই বইতে জামায়াতে ইসলামীর গুণকীর্তন করে ৫৯১ পৃষ্ঠায় আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর তার অনেক রচনাবলী রয়েছে। 


জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলী ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এদেশের ইসলামী অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। মাদ্রাসাটির শিক্ষাদানের মান বেশ উন্নত। প্রতিবছর বোর্ডের পরীক্ষায় ছাত্ররা বেশ ভালো ফল করে।’


এ বিষয়ে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘এভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করে শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হতে পারে না। পাঠ্যপুস্তক দলীয় মতাদর্শ প্রচারের মুখপত্রও নয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় পাঠ্যপুস্তকে কিভাবে এবং কেন অন্তর্ভুক্ত হল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদিও লেখাটি দেখে প্রতীয়মান হয়, এ বক্তব্যটি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনও তা একইভাবে রয়েছে এবং শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।’


পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বইয়ে এমন সুকৌশলে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের আল্লাহ রাসূলের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের বিষয়গুলো প্রতিফলিত না হয়। যাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীই একমাত্র ইসলামের ধারক ও বাহক।’


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। পাঠ্যবই কোনো দলীয় প্রচারপত্র নয়। কিন্তু এসব বক্তব্যের কারণে পাঠ্যপুস্তকগুলো দলীয় প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা, নিরপেক্ষ ও সৃজনশীল মানসিকতা গঠনের পরিবর্তে এসব লেখা শিক্ষার্থীদের 'জামায়াতি দর্শনে ' অনুপ্রাণিত করেছে। মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাসের আওতায় এসব বক্তব্য তুলে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। আর শিক্ষার্থীরা এসব পড়েই সনদ অর্জন করছে। বিষয়টি জাতির জন্য কাঙ্খিত কিনা তা বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন।’


বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ও মাদ্রাসা লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় ওহি নাজিল হওয়ার বিবরণে বলা হয়েছে, “আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কি পড়ব’। বললেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড হতে সৃষ্টি করেছেন।’ [সূরা আলাকের শেষ পর্যন্ত]’’ এই তথ্যটি ভুল বলে মন্তব্য করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত নাজিল হয়েছে। একইভাবে কুতুবখানা এমদাদিয়া থেকে প্রকাশিত মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত আলিম ইসলামের ইতিহাস সৃজনশীল বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় আরবের আয়তন উলেখ করা হয়েছে ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল। অথচ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যা বর্গমাইলে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৮,৩০,১১৫ দশমিক ৪৩ বর্গমাইলে।

জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম সাইফুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বলা হলেও বাস্তবে ওসব বই আমাদের অনুমোদিত নয়। বাইরের এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা বোর্ডের নামে ব্যবসা করছে। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিবেদন তৈরি করার আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারত।’ 

নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় - বাঁধন সেনগুপ্ত

কাজী নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক । কোন সৃষ্টিশীল মানুষ নজরুলের মত অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত জীবনের শেষ দিনগুলো আত্মীয়-পরিজনহীন, চরম দারিদ্র ও অবহেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু নজরুল ইসলামের শেষ জীবন আরো বেশি মর্মন্তুদ,বেদনাদায়ক ।

নজরুলের অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন নিয়েও সঠিক তথ্য জানা যায় না । কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই অগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটিঐদিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় কবির কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন । হতেপারে একটা প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছিল ঐদিন থেকে । একবছর পর ১০ই জুলাই নজরুল তাঁরসুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন “তুমি এখনি চলে এসো ... আমি কাল থেকেঅসুস্থ” । অতয়েব আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২এর ৯ই অগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন ।কবি তখন আক্ষরিক ভাবেই কপর্দকহীন । সংসারে দুই শিশু পুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীপ্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা । ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষলক্ষ টাকা মুনাফার সন্ধান দেওয়া গ্রামফোন কোম্পানী কোন রয়ালটি, প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছেনা,তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না । ১৭ই জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণাউপেক্ষা করে এক বন্ধুকে পত্র লেখেন কবি । লিখেছিলেন -  “আমি blood pressureএ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি । আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ,পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি । তারপর নবযুগের worries ৩/৪মাস পর্যন্ত । এইসব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে । ... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতেপারি,বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।

কবির অসুস্থতার কারণ বা কি ছিল তাঁর অসুখ, তা নিশ্চিত ভাবে কেউজানাননি । নানারকম কথা নানান জনে লিখে গেছেন । শোনা যায় ‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলেরকাছে প্রহৃত হয়েছিলেন, কয়েকজন যুবক উত্তরপাড়া থানার হেপাজত থেকে, ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত পাওয়া নজরুলকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন । এই আঘাতের কথা কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । শোনা যায় নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তখন নাকি তাঁরচিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড, কবির ঘাড়ে পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন । 

বিস্ময়েহতবাক হয়ে হয় - কি নিদারুণ অব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর । প্রথমসাতদিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার ।অথচ মাত্র তিনদিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেনবলে । বাইশ বছর পরে লেখা তাঁর গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় – ১৯৬৪) জুলফিকারহায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তোঅসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে,দেখতে আসবে’ । অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’রমিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুইবছর পরেও ১৯৪৪এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন - “শ্রীমান মোহম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীবহয়ে থেকো । আমায় ও আমার ছেলে দুটিরে চিরদিন মনে রেখো”।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল১৯৪২এর ১৯শে জুলাই, কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শেসেপ্টেম্বর । ১৯৪৪এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটিআবেদন প্রচারিত হয় । আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত । অসক্ত হইয়া পড়ায় তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন । তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী । চিকিৎসা দূরের কথা,এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়,রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণরক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুন্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’ । 

এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয় । কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকেদেখেন একাধিকবার, কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদেরউদ্যগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানোহয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই । কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোন উন্নতি না হওয়ায়ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় । পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে ।সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কেরসংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেওচিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন । তাঁর অভিমতছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে । সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর ।

এর পরেও ২৩বছর জীবিত ছিলেন নজরুল । অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট,নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনেরসঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হ’ল, কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন ।

জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর সাত ঘন্টার মধ্যেই তাঁর আপনজনেরউপস্থিতির আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নীরব কবিকেসমাহিত করলেন সে দেশের সরকার

[ তথ্যসূত্র– নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় / বাঁধন সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা , কাজী নজরুলইসলাম শতবার্ষিকী সংখ্যা ]

ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক: কাজী সেলিম


১৯৮৩ সালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশে জনগণ ও সরকারগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম, অর্থের উৎস, ব্যাংকঋণের সুদের পরিমাণ ও সুদ আদায় পদ্ধতি, চেয়ারম্যান মহাব্যবস্থাপক, বোর্ড সদস্য পদ্ধতি ও বয়স মেয়াদসহ ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ এক অন্ধ ধারণা পোষণ করছিল। ২০১০ সালের ৩ নবেম্বর নরওয়ে টেলিভিশনের ধারণকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টারি ছবি প্রচারণার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সকল গোপন, অবৈধ, অপ্রকাশিত কার্যক্রম, লেনদেন ঘুমন্ত বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে জাগ্রত করে তোলে। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশেই গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রচারিত উক্ত প্রামাণ্য চিত্রের মূল ও প্রধান বিষয়সমূহ ফলাও করে প্রচারিত হয়, যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে শুধু কলুষিত ও কলঙ্কিতই করেনি, নোবেল পদক, পদকপ্রাপ্ত ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের উপর বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করেছে সন্দেহ, বিতর্ক ও দাতা দেশসমূহের নজরদারি ও জবাবদিহিতার চরম গাফিলতির। পুরস্কারপ্রাপ্ত ডেনমার্কের ডকুমেন্টারি ছবি প্রস্তুতকারক, টম হেইনিম্যানের পরিচালনায় প্রামাণ্য চিত্র ‘মাইক্রো ঋণের খপ্পরে’ তৈরির সময় পরিচালক টম বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্র্থঋণ গ্রহণকারীদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ আলোচনা ও সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন। টম হেইনিম্যান তাঁর বহুল প্রচারিত ও সমালোচিত উক্ত প্রামাণ্য ছবিতে গ্রামীণ ব্যাংকের কি কি স্পর্শকাতর বিষয় কয়েক যুগ পরে ফাঁস করে বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচার করে ইউনূস সাহেবকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে বিতর্কিত, সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত ওই প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করে দেখানো হয়েছে যে, ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংকের নামে নরওয়ে ও অন্য দাতা দেশসমূহের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার (মার্কিন) নরওয়ে ও অন্যান্য দাতা দেশসমূহের বিনা অনুমতি ও অনুমোদন ব্যতীত ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামে অপর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান নামে স্থানান্তর করে যা মাইক্রো ঋণের সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক বা লেনদেন ছিল না।

 ওই প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করা হয় যে, ঢাকার নরওয়ের দূতাবাস, নরওয়ের দাতা সংস্থা, নোরাড এবং বাংলাদেশে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের চাপের ফলে, গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস সাহেব ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরত প্রদান করেছে, যা ছিল নরওয়ে, সুইডেন ও জার্মানির প্রদত্ত অর্থের অংশবিশেষ। ওই প্রামাণ্য চিত্রের পরিচালক টম দাবি করেছেন যে, ড. ইউনূস সাহেবের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাড, বাংলাদেশস্থ নরওয়ের দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে নীরবতা পালন করছিল বলে প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করে আরও বলা হয়েছে যে, উল্লেখিত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির নিকট হতে ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংককে প্রদান করা হয়েছিল, গ্রামীণ কল্যাণ নামে অপর কোন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে নয়।

 ওই ডেনিশ সাংবাদিক ও প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা টম হেইনিম্যান কয়েকবার গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ কাজে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এবং কয়েকজন আন্তর্জাতিক অর্থ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন, তিনি তার প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করেছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের কঠিন ঋণের শর্তের যাঁতাকলে বহুসংখ্যক মহিলা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। প্রামাণ্য চিত্রে টম দাবি করেছেন যে তিনি বহুবার ইউনূস সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রামাণ্য চিত্রটি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র ধরে তুলে প্রচার করে যে, গ্রামের দরিদ্র মহিলাগণ শতকরা ৩০ শতাংশ সুদ প্রদান করে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অর্থঋণ গ্রহণ করেন এবং এক সপ্তাহ পরই ঋণের সুদের টাকা শোধ করা শুরু হয়। ওই প্রামাণ্য চিত্রে কয়েকজন ঋণগ্রহীতার সাক্ষাতকার তুলে ধরা হয়েছে। কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রামের গরিব মহিলাদের ঋণের টাকা পরিশোধ ও আদায় করার জন্য ভয়ভীতি ও বল প্রয়োগ করে থাকে। সাংবাদিক টম দাবি করেছেন যে, প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার পূর্বে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যপদ্ধতি ও দৈনন্দিন লেনদেনের উপর বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে বিতর্কিত ও বহুল সমালোচিত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তরের চিঠিপত্র এবং তথ্য প্রমাণাদি দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠেন। তিনি বলেন যে, ওই তথ্য প্রমাণাদি অসলোস্থ নোরাড ও নরওয়ের সাহায্য সংস্থার আর্কাইভ বা গ্রন্থশালা থেকে সংগ্রহ করেছেন।

প্রামাণ্য চিত্রে ৯০ দশক থেকে শুরু করে চিত্র প্রদর্শন পর্যন্ত সাহায্য সংস্থা নোরাড অনেক গোপন তথ্যাদি প্রকাশ বা প্রচার করে বিশেষভাবে গোপন করে রেখেছিল, যা নরওয়ের জনগণ সরকার ও পার্লামেন্ট সদস্যদের বৈদেশিক ঋণ প্রদান ও তার অপব্যবহারের সংবাদ জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল বলে প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করা হয়। প্রামাণ্য চিত্রটি প্রচারিত ও প্রদর্শনের পর নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এরিক সোল হেইম এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘প্রামাণ্য চিত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো সত্য ও সঠিক এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।’ এর পরই নরওয়ের পার্লামেন্ট গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্রের বিষয়গুলোর ওপর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা করে এবং নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। নওয়ের প্রামাণ্য চিত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা, এন আর কের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, প্রামাণ্য চিত্রটি প্রদর্শনের ছয় সপ্তাহ পূর্ব থেকে ড. ইউনূসের সঙ্গে ই-মেইল করে তার মতামত জানার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্ত ড. ইউনূস কখনই তাদের ই-মেইলের জবাব প্রদান করেন নি।
বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম ও দাতা সংস্থার ও দেশের অর্থ অপব্যবহারের ওপর প্রামাণ্য চিত্র সংবাদ আকারে প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত বার্ষিক তদন্ত ও অনুসন্ধানের উপস্থাপিত রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের আদেশ জারি করে।

 প্রামাণ্য চিত্রের অভিযোগ ও সরকারের পরিচালিত তদন্ত সাপেক্ষে যে বিষয়গুলো অভিযোগ হিসেবে নির্দিষ্টভাবে উদঘাটন করা হয় সেগুলো হলো :

১. দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাদের নিকট থেকে জোরজবরদস্তি ভয়ভীতি ও হয়রানি করে ঋণের সুদের অর্থ আদায় করা হয়। ২. ঋণের টাকার সুদের হার সম্পর্কে বানোয়াট ও বিভ্রান্তমূলক ড. ইউনূসের স্বাক্ষরযুক্ত তথ্য সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। ৩. ড. ইউনূস বেআইনীভাবে ৫৪টি কোম্পানি গঠন করেন যার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের নাম ব্যবহার করেন। এ সম্পর্কে ড্যানিয়েল পার্ল ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে উক্ত প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে ব্লগ করে রাখা হয়েছে যাতে কেউ আর প্রতিবেদনটি পড়তে না পারেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দেশী-বিদেশেী সাংবাকিদের নিকট গোজামিল তথ্য প্রদান করেন এবং ড. ইউনূস তাদের সঙ্গে সাক্ষাত প্রদান না করে লুকোচুরি খেলেছেন।
দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সম্পর্কে বিরূপ সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে কলঙ্কিত করেছে। স্বভাবতই কোন সরকারই এ ক্ষেত্রে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থেকে দেশ- বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম, দুনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সংবাদ ও সচিত্র প্রতিবেদনকে নীরবে হজম করতে পারে না। তা হলে সেটা হতো বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের জন্য এক লজ্জাকর জঘন্য অন্যায় ও রীতি নীতিবিবোধী জাতীয় অপরাধ। 

২০০৯ সালের জানুযারি মাসে তদানীন্তন সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অনিয়ম, ক্ষমতার অব্যবহার এবং ড. ইউনূসের বয়স অতিক্রম করার পরও গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিয়োগ প্রদানসহ সকল বিষয় তদন্ত শেষে, গঠিত কমিটি তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সরকারের নিকট দাখিল করে। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫% শতাংশ মালিকানার অংশীদার, সে ক্ষেত্রে দেশের সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নিয়ন্ত্রণ “বাংলাদেশ ব্যাংক”ও দীর্ঘদিন পর নড়েচড়ে বসে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কয়েক যুগ নাসিকায় সরিষার তেল দিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব মুনাফা প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য পালনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে অপসারণ করার নির্দেশ জারি করে বলে যে, ড. ইউনূস অবসর গ্রহণ আইন ৬০ বছর লঙ্ঘন করে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান হিসেবে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের ব্যাংক কোম্পানির ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের যে কোন ব্যাংক বীমা ও আর্থিক লেনদেন ও যে কোন অর্থ লগ্নি সংস্থা বা সংগঠনের গচ্ছিত কর্তা বা সঞ্চয় কর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে।

গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের পদ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপসারণপত্র প্রাপ্তির পর ড. ইউনূস স্ব-প্ররোচিত হয়ে (সরকার নয়) স্বেচ্ছায় বাংলাদেশের হাইকোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপসারণ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে একটি আপীল করেন। ২০১৩ সালের ৮ মার্চ হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ড. ইউনূসের অপসারণ সংক্রান্ত আদেশকে যথাযথ বলে সমর্থন করে এই মর্মে মত প্রকাশ করে যে, ২০০০ সালে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ব্যতীত ও পুনর্নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল, যা সরকারের আংশিক মালিকানাধীন ব্যাংকের লিখিত আইন বা বিধির প্রকাশ্য লংঘন ও ভঙ্গ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপের কোন একটি এ ধরনের ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক বা চেয়ারম্যান যদি এভাবে বিদেশের প্রাপ্ত ঋণ বা সাহায্যের অর্থ অবৈধভাবে অন্য যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে লগ্নি করত তাহলে তাকে নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রেও কংগ্রেসের সিনেট অর্থ সংক্রান্ত সাব কমিটি অথবা ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টের অর্থসংক্রান্ত সাব কমিটির সম্মুখে গলদের টাই ধরে টেনে হিঁচড়ে অপরাধী আসামি হিসেবে সশরীরে হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হতো।

ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক কেন ১০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ প্রদান করেছেন? ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করার মধ্যে যে একটি গভীর বড় ধরনের রহস্য বিদ্যমান, দেশের সচেতন ও শিক্ষিত জনগণ ও বিদেশে ড. ইউনূসের বন্ধুদের এটাই বাস্তবভাবে অনুধাবন করা উচিত। বাংলাদেশে সরকারকেও এই স্পর্শকারত বিষয়ে চুপচাপ না থেকে, যেহেতু প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্রের বিষয়াবলী দেশের সুনাম ও মর্যাদাকে কলঙ্কিত করেছে, তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত নরওয়ের টেলিভিশনের পরিচালক প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কয়েক শত মিলিয়ন ইউরো দাবি করে মামলা দায়ের করা উচিত ও দেশের ও বিশ্ব জনগণকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে, ড. ইউনূস সাহেবকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের প্রধান পদ থেকে অপসারণ করা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রচলিত আইন কানুন বিধি মোতাবেক সঠিক ছিল, এ ব্যাপারে কোন দেশ, পরিবার, বা গোষ্ঠীর অহেতুক আস্ফালন করার কোন অধিকার নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা

ব্যর্থ জনকের পুত্রঋণ -রণজিৎ বিশ্বাস


সংসারে কোন্ পিতা সবচেয়ে হতভাগ্য? সেই পিতা যাকে কাঁধে তুলতে হয় আপন সন্তানের প্রাণহীন দেহ। তেমন কাউকে কি আপনি দেখেছেন? নিয়তই দেখি। প্রায় প্রতিদিনই দেখি। সেদিন চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় একই বাহনে ছিলেন আমার এক সহকর্মী, যার মেধাবী সন্তান সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করতে নেমে আর কূলে ফিরতে পারেনি। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া পুত্রের দেহটি অন্তত পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার সেই সেন্টমার্টিনসে যাচ্ছেন। উন্মাদপ্রায় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে।
: আপনার নিজের জীবনে কি এমন কিছু ঘটেছে? আপনি কখনও কি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন?
: হয়েছি। বড় অকালে অসময়ে ও অপ্রয়োজনে হয়েছি। ষোলোটি বছর ধরে সে যন্ত্রণা পুষে চলেছি ও সে যন্ত্রণা আমি বয়ে মরছি। যে আমার হাতের কাজ কেড়ে নিত, সে তার একমাত্র বোনের বিয়ের সময় বলতে পারত- একটুও কাঁদবিনে বুড়ি, তোর সঙ্গে আমি আছি। বাবার কথা কিছুও ভাববিনে তুই, বাবাকে বোঝাবার দায়িত্ব আমার, মেধা বিচারে যে হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেরা শিক্ষক, সে আমার সঙ্গে নেই। তার কাছে আমার ঋণের কোন শেষ নেই। সে অনেকটা বছর ধরে আমার আনন্দে নেই, আমার ক্রন্দনে আছে কিন্তু ক্রন্দনসিক্ত পিচ্ছিল পদযাত্রায় নেই; আমার উদ্বেগে আছে কিন্তু পরিকল্পনায় নেই; বঞ্চনায় আছে কিন্তু আমার স্বপ্নে নেই; আমার ভাবনায় আছে কিন্তু সম্ভাবনায় নেই। যে দিন থেকে সে নেই, সেদিন যদি তার পিতৃত্বের অভিষেক হতো, একদিন এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অসামান্য সুন্দর একটি বক্তৃতা দিয়ে বিজিত দলের যে মেয়েটির মনিবন্ধ চোরাচুরি করে মুঠোয় নিতে গিয়ে তার বাবার কাছে ধরা পড়েছিল, সেই কান্তিময়ী মেয়েটিই যদি তার জীবনের সঙ্গী হতো, এতদিনে তাদের ঘরে দশবারো বছরের অন্তত একজন পৌত্র বা পৌত্রী আমার থাকতে পারত।
যা হোক এসব নিয়ে এখন আর খুব বেশি ভাবি না আমি। মাঝেমাঝে কাঁদি, কান্নার সে জল মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে উবে যায়।
সে হয়ত এখন পরপারের সিংদুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবাকে আর মাকে গ্রহণ করার জন্য। হয়ত সে পরিকল্পনা সাজিয়ে বসে আছে কী সেবা করবে তার বাবাকে, কী সেবা করবে তার মাকে অথবা কী শাসন করবে তাদের দু’জনকে, তার বয়স্ক ও অবাধ্য দু’সন্তানকে।
এই পুত্রের কাছে আমার ঋণ অপরিসীম। সে তার বাবাকে তৃপ্তপরিতৃপ্ত; সম্মানিত, ব্যর্থ, সমৃদ্ধ, পরিচিত, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, আঁধিমুক্ত, তর্কিত-বিতর্কিত, বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত ও চিরদিনের জন্য ক্রন্দনশীল করে রেখে গেছে। জীবনের বাকি সময়ের জন্য সে তার বাবাকে অরণ্যবিদীর্ণ নির্জন ও শ্বাপদসঙ্কুল পথ বড় অসময়ে বড় অপ্রয়োজনে বড় উদারভাবে উপহার দিয়ে গেছে। এখন অসামান্য ও অমেয় মূল্যের উপহার সংসারে খুব বেশি লোকের জোটে না। যখনই সে আমার মনে আসে, তখনই সে বুঝিয়ে ছাড়ে- সন্তানের কারণে তো মা-বাবার ভোগবিপাক দুর্যোগ দুর্ভোগ অনেক হয়, সন্তান যদি রোগে ভোগে জরায় পড়ে, যদি সে উপযুক্ত না হয়, যদি সে ঝাপটাশিল্পী হননশিল্পী পেশীশিল্পী কিংবা কর্তনশিল্পী হয়, যদি তাকে ঘনঘন প্রহৃত হতে হয় ও ‘রাজবাড়ির অতিথি’ হয়, যদি তার কারণে মা-বাবাকে ক্যামেরার সামনে বা কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হয়, যদি তার ভাল একটা চাকরি না জোটে মা-বাবাকে কত দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়, কত অঘাটকে ঘাট মানতে হয়- তাতো তোমাদের জানা আছে বাবা। তাহলে আমার অকাল প্রস্থান নিয়ে এত ভাবাভাবি আর কাঁদাকাঁদি কেন কর! আমি তো তোমাদের অনেক বিপদ অনেক দুশ্চিন্তা ও অনেক খরচাখরচ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি বাপ! তাহলে আর আমার ‘আর্লি ডিপার্চার’-এর জন্য আফসোস কেন! তুমি কি পত্রপত্রিকা পড় না। তুমি কি দেখনা সন্তানের হাতে পিতামাতা আলাদা আলাদা অথবা জোড়াজোড়া খুন হয়ে যাচ্ছে। অথবা, পিতার হাতে সন্তানের জীবন যাচ্ছে! দেখ না তুমি! দেখে না আমার মা! এইসব ঝুঁকি থেকে আমি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি তো বাবা ‘রক’-এ বসে আড্ডা দিতে পারতাম, ইভটিজিঙে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে পারতাম, পাশের বাড়ির মেয়েটির অথবা আমার বন্ধুর বোনটির জন্য আতঙ্ক হয়েও উঠতে পারতাম। আমি তো পরীক্ষায় নকল করে ধরা পড়তে পারতাম, চুরিডাকাতি, বদমাশি, খুন খারাবি, রাহাজানি করে এক নিরীহ হাবাগোবা আর ইডিয়টিক টাইপের শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক আর তার শিক্ষক স্ত্রীর মাথা কাটাতে পারতাম, তার জীবনের সমস্ত অর্জন ধুলোয় বালিতে ও আবর্জনে কাদায় মিশিয়ে দিতে পারতাম। আমি তো নষ্ট ও ভ্রষ্টদের পদপ্রান্তে তোমাকে মাথা নইয়ে চলার ব্যবস্থা নির্দয়ভাবে পাকা করে দিতে পারতাম। আমার তো একটা বিকলাঙ্গ সন্তান হতে পারত, আমার স্ত্রী তো একটি অটিস্টিক বাচ্চার মা হতে পারত, আমার দাম্পত্যজীবনে অশান্তি ও অবিশ্বস্ততা থাকতে পারত, আমাকে বারবার হয়ত বিবাহ বিচ্ছেদে জড়াতে হতো, তোমার বৌমা একজন ক্যান্সার পেসেন্ট হতে পারত, চাকরিজীবনে তোমার মতোই হয়ত বঞ্চনা, অবিচার আর দলনপীড়নের শিকার হতে হতো। আমি এ্যাকসিডেন্টে কিংবা হরতালে অবরোধে কিংবা হার্ট-এ্যাটাক’-এ প্রাণ হারাতে পারতাম।
এই সব তো বটেই, আরও তিন হাজার সাঁইত্রিশ রকম ঘটন দুর্ঘটন আমাকে নিয়ে হতে পারত, তোমাদের ছেড়ে অসময়ে চলে আসায় আমার কারণে এসব পোহানোর ঝুঁকি থেকে তোমরা মুক্ত আছো। চলে আসার আগে যদি কোন কারণে অথবা একাধিক কারণে তোমাদের ভুগিয়ে থাকি, যদি আমাকে দেয়া স্বাধীনতার অপব্যবহার করে থাকি; যদি তোমার ও তোমাদের দেয়া স্নেহপ্রশ্রয়ের অপচয় আমি করি, এখন মনে হয় যে করেছিও; আমাকে ক্ষমা করো। সেটি করতে পারো না পারো, এটুকু অন্তত বুঝে নিও, আমি কিন্তু অনেকগুলো কারণে তোমাদের কৃতজ্ঞও করে এসেছি, দায়মুক্তি আর স্বস্তি সোয়াস্তিতও দিয়ে এসেছি। আমাকে নিয়ে তোমাদের যে অনেক সুখস্মৃতি আর নন্দনন্দ আনন্দ স্মৃতিও আছে, তাও তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না বাপ! সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, আমার কাছে তোমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবনের অকাল অবসানের জন্য কোন দুঃখ নেই। এখন বুঝতে পারি, এর জন্য কতটুকু দায় এই অপোগ-জনার ছিল। দুঃখ শুধু পাঁচ বছরের ছোট বোনটির জন্য। দুঃখ ছাড়া ওর দাদার কাছ থেকে কিছুই সে পায়নি। তাও পেয়েছে বড় ছোট বয়সে। ঐ শিশুটির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ আমার নেই। তবে, আমি মানি এবং ভালমতোই মানি, জীবন এরকমই, জীবন জীবনের মতোই, তার মতো আর কিছু নেই।

লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক।