Monday, June 2, 2014

পাঠ্যবইয়ে জামায়াতের ভূয়সী প্রশংসা- উবায়দুল্লাহ বাদল



মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধিকাংশ বইতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নীতি ও আদর্শ। ইসলামের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে জামায়াত-শিবির যেসব কৌশল অনুসরণ করছে, সেগুলোই সরকারি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবর্তন করা হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা।

মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) থেকে শুরু করে কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যন্ত সব স্তরের পাঠ্যপুস্তক ও নোট-গাইডে সুকৌশলে জামায়াতের দর্শন- মওদুদীবাদ ও তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি এসব বই প্রকাশ করেছে জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ১০টি প্রতিষ্ঠান।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আলিয়া মাদ্রাসার অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রণয়ন করা হয়েছে এ প্রতিবেদন। বিশেষজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসির ও মুহাদ্দিস সমন্বয়ে গঠিত ২১ সদস্যের কমিটি ব্যাপক পর্যালোচনার পর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জামায়াতি ও মওদুদী দর্শনযুক্ত বই অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহারসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


এছাড়া মাদ্রাসার বইতে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, জাতির পিতা শব্দ ব্যবহার না করা এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বদলে জামায়াতি দর্শন শেখানো হচ্ছে বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। ২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সোমবার সরকারের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ প্রতিবেদনই প্রমাণ করবে কিভাবে শিক্ষার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জামায়াতি ও মওদুদী দর্শন পড়ানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে দেশ ও জাতি জঙ্গিবাদ থেকে রেহাই পাবে।

প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন পেয়েছি। কমিটির আগামী বৈঠকে তা উত্থাপন করা হবে। তাদের সুপারিশ পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবির সহযোগিতায় মাদ্রাসা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রচিত ও প্রকাশিত হয়। সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে এনসিটিবি বইয়ের যাচাই-বাছাই বা মনিটরিং করতে একটি কমিটি কাজ করলেও মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম (একাদশ) শ্রেণীর বইয়ের সিলেবাস প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বোর্ড নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। তবে অধিকাংশ বইয়ে লেখা থাকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অথবা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী প্রণীত। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নামে এসব বই বাজারজাত করা হলেও সিলেবাস প্রণয়ন ও বই প্রকাশের অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো তদারকি নেই তাদের।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসার প্রথম থেকে কামিল শ্রেণী পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তকের প্রচুর নোট ও গাইড বই বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে থাকে। সেসব নোট-গাইডে সিলেবাসের বাইরে জামায়াত-শিবিরের মতাদর্শ সুকৌশলে তুলে ধরা হয়। কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বাংলা অনুবাদ দেয়া হলেও কোনো রেফারেন্স বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। এসব অনুবাদের ক্ষেত্রেও দলটির নীতি ও আদর্শ তুলে ধরা হয়।


এসব বই ও গাইড যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে, সেগুলো জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা। ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াতের আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা এমন ১০ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে কমিটি। এগুলো হচ্ছে- আল-ফাতাহ পাবলিকেশন্স, আল-বারাকা প্রকাশনী, পাঞ্জেরী প্রকাশনী, কামিয়াব প্রকাশনী, আল মদিনা প্রকাশনী, মিল্লাত প্রকাশনী, ইমতেহান প্রকাশনী, ইসলামিয়া কুতুবখানা, মাদ্রাসা লাইব্রেরি ও আল-আরাফা প্রকাশনী।


মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বোর্ডের অনুমোদিত ও এনসিটিবি প্রকাশিত মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজপাঠ বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশ পরিচিতি, ধর্মীয় জীবন, জীবন সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে কৌশলে পরিহার করা হয়েছে। সিলেবাস এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যাতে বাংলাদেশ অধ্যায় স্থান না পায়। এছাড়া এসব বইয়ে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ পরিহার করে শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আলিম থেকে কামিল শ্রেণীর একাধিক বইয়েও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধকে পরিহার করা হয়েছে।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইতে প্রচুর তথ্যগত ভুল ও অসংগতি রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় ও পারিভাষিক বানানের ক্ষেত্রে কোথাও সমতা রক্ষা করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক রচনায় যাদের নাম রয়েছে তারা অনেকেই লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত নন। এমনকি আলেম হিসেবেও তাদের অনেকের পরিচিতি নেই। পাশাপাশি তৃতীয় থেকে উচ্চতর শ্রেণী পর্যন্ত বয়সস্তর অনুযায়ী কোন শ্রেণীতে কি ধরনের পাঠ ও বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন তাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

সুপারিশ : মাদ্রাসার পাঠ্যবই জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংশোধন করতে সাত দফা সুপারিশ করেছে পর্যালোচনা কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- 

১. যেসব পুস্তকে জামায়াতি আদর্শ ও মওদুদী দর্শন তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করা। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া সমীচীন। কারণ ইসলামের নাম ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ প্রচার জাতীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। 


২. বাজারে প্রচলিত পাঠ্য সহায়ক পুস্তকগুলোও পর্যালোচনা করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে পর্যলোচনা করা।


 ৩. মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে এনসিটিবির ন্যায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটি, লেখক নির্বাচন কমিটি, সম্পাদক নির্বাচন কমিটি ও পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটি থাকা প্রয়োজন। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ তৈরি করতে হলে এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞ আলেম, ওলামা, মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাচ্ছিরদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পাঠ্যপুস্তকে কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেদের হীন দলীয় স্বার্থ হাসিল করতে না পারে।


 ৪. মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণীর বইও সরকারিভাবে প্রণয়ন ও বিতরণের ব্যবস্থা করা। আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন লাখ। তাদের বিনামূল্যে বই দিলে সরকারের যে আর্থিক ব্যয় হবে, তার চেয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ অনেক বেশি হবে।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এটি জটিল সমস্যা। একদিনেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যারা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যেতে পারে। পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করার পাশাপাশি কমিটিকে মাদ্রাসার সার্বিক বিষয় মনিটরিং করার ক্ষমতাও দেয়া যেতে পারে। ওই কমিটি পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের মানবিকতা, সহনশীলতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয় ও উদার নৈতিক চিন্তার বিষয়গুলোসহ আধুনিক বিজ্ঞানও প্রযুক্তির বিষয় তুলে ধরবে। দলবাজ লোক দিয়ে এ জটিলতা দূর করা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা ড. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলছে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। হঠাৎ করেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এতদিন কেউ বিষয়টির প্রতি নজর দেয়নি, এবার তা সরকারের নজরে এসেছে। সুতরাং দেরি না করে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে জাতিকে এ বিষয়ে পরিত্রাণ দেয়া উচিত





‘যুগে যুগে ব্যক্তি সমষ্টি তথা সমিতি, সংঘ, দল প্রভৃতিও ইসলামী মূল্যবোধের অনুশীলনে যথেষ্ট অবদান রাখছে। বর্তমান শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে বহু দেশে বহু সংঘ বা দল সমাজে ইসলামী মূল্যবোধে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইখওয়ানুল মুসলেমীন, ইন্দোনেশিয়ান শরীয়ত পার্টি, মালয়েশিয়ায় প্যান মালেয়ান ইসলামী অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফগানিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের মধ্যে সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘ, ছাত্রশক্তি পরে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রভৃতি ছাত্র সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টায় মুসলিম সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বা হচ্ছে।’

এটি কোনো রাজনৈতিক দল বা ইসলামী দলের কোনো ওয়েবসাইট বা দলীয় লিফলেট বা মুখপত্রের ভাষা নয়। খোদ বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত নতুন সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ের ৫৬ পৃষ্ঠার অংশ বিশেষ। বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াত-শিবিরের আর্থিক সহায়তায় গড়ে উঠা আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স। এভাবেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পৌরনীতি শিক্ষার নামে কৌশলে ধর্মের দোহাই দিয়ে জামায়াত-শিবির কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়েছে। এমন অসংখ্য চিত্র উঠে এসেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা প্রতিবেদন’-এ। সোমবার সরকারের ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটি’র কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে ফাউন্ডেশন।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে জামায়াতি আদর্শ প্রচারের নিয়ামক হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইটির সিলেবাস প্রণীত হয়েছে। সচেতনভাবেই ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাংলাদেশ অধ্যায় বাদ দেয়া হয়েছে। এ বইয়ে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ কোনো কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বই প্রকাশের দায়িত্ব বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়া এবং সার্বিক মনিটরিং না থাকায় আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বই মওদুদী দর্শন এবং জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। 


বইগুলোতে কোরআন-হাদিসের যে অর্থ দেয়া হয়েছে তার অনুবাদক কে বা কোন সংস্থা তা উল্লেখ না থাকায় জামায়াতি মতাদর্শের আলোকে অর্থ বিকৃত করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামের পৌরনীতিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রচারপত্র বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘পাঠ্যবই অভিজ্ঞ আলেম-ওলামাদের দ্বারাই প্রণীত। তারা কোনো ভুল করে থাকলে তা পর্যালোচনা করে সংশোধন করা হবে। আর নোট বা গাইডে কোনো ধরনের ভুল তথ্য থাকলে তার ডাবল শাস্তি হবে। কারণ একে তো নোট-গাইড অবৈধ, তার ওপর ভুল তথ্য দিয়ে আরও বড় অপরাধ করেছে। তাদের ধরে পুলিশে দেয়া হবে।’


ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী আলিম শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত এবং আল-বারাকা লাইব্রেরির প্রকাশিত ‘ইসলামী পৌরনীতি’ প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র বইতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বিংশ শতাব্দীর ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইতে ‘ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়’ আবুল আলা মওদুদী, অধ্যাপক গোলাম আযম, মোহাম্মদ আসাদ ও আবুল কাশেম সিফাতুল্লাহসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।


বইটির ৪৯১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামী চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখেন এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র.)। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

একই বইয়ের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোনো কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূলকথা হল কোনো ধর্মই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে বাকি মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করতঃ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’


মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ে জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতের প্রশংসা করে ৫৮২ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে না দেয়ায়, তাদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সম্পর্ক ছিল তিক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ। ...বর্তমান সরকার পরিচালনা করছে চারদলীয় ঐক্যজোট। এ জোটের অন্যতম দুটি দল হল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। তাই বলা যায়, এদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে হয়তো একদিন তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হবে- এমন ধরণা এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের।’একই বইতে জামায়াতে ইসলামীর গুণকীর্তন করে ৫৯১ পৃষ্ঠায় আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর তার অনেক রচনাবলী রয়েছে। 


জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলী ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এদেশের ইসলামী অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। মাদ্রাসাটির শিক্ষাদানের মান বেশ উন্নত। প্রতিবছর বোর্ডের পরীক্ষায় ছাত্ররা বেশ ভালো ফল করে।’


এ বিষয়ে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘এভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করে শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হতে পারে না। পাঠ্যপুস্তক দলীয় মতাদর্শ প্রচারের মুখপত্রও নয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় পাঠ্যপুস্তকে কিভাবে এবং কেন অন্তর্ভুক্ত হল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদিও লেখাটি দেখে প্রতীয়মান হয়, এ বক্তব্যটি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনও তা একইভাবে রয়েছে এবং শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।’


পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বইয়ে এমন সুকৌশলে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের আল্লাহ রাসূলের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের বিষয়গুলো প্রতিফলিত না হয়। যাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীই একমাত্র ইসলামের ধারক ও বাহক।’


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। পাঠ্যবই কোনো দলীয় প্রচারপত্র নয়। কিন্তু এসব বক্তব্যের কারণে পাঠ্যপুস্তকগুলো দলীয় প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা, নিরপেক্ষ ও সৃজনশীল মানসিকতা গঠনের পরিবর্তে এসব লেখা শিক্ষার্থীদের 'জামায়াতি দর্শনে ' অনুপ্রাণিত করেছে। মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাসের আওতায় এসব বক্তব্য তুলে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। আর শিক্ষার্থীরা এসব পড়েই সনদ অর্জন করছে। বিষয়টি জাতির জন্য কাঙ্খিত কিনা তা বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন।’


বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ও মাদ্রাসা লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় ওহি নাজিল হওয়ার বিবরণে বলা হয়েছে, “আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কি পড়ব’। বললেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড হতে সৃষ্টি করেছেন।’ [সূরা আলাকের শেষ পর্যন্ত]’’ এই তথ্যটি ভুল বলে মন্তব্য করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত নাজিল হয়েছে। একইভাবে কুতুবখানা এমদাদিয়া থেকে প্রকাশিত মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত আলিম ইসলামের ইতিহাস সৃজনশীল বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় আরবের আয়তন উলেখ করা হয়েছে ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল। অথচ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যা বর্গমাইলে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৮,৩০,১১৫ দশমিক ৪৩ বর্গমাইলে।

জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম সাইফুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বলা হলেও বাস্তবে ওসব বই আমাদের অনুমোদিত নয়। বাইরের এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা বোর্ডের নামে ব্যবসা করছে। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিবেদন তৈরি করার আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারত।’ 

No comments:

Post a Comment