Friday, January 24, 2014

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯০ তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র অভিবাদন- সুমি খান





হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল কানন!
স্বপনে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে—
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই যারে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপে খনি, পুর্ণ মণিজালে।।

 বাংলা ভাষার প্রথম এই চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের স্রষ্টা  মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত  বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক । ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা  এ ব্যক্তিত্ব অবিভক্ত বাংলার যশোহর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়ি গ্রামে   ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ২৯ জুন, ১৮৭৩ মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় কপর্দকশূন্য করুণ অবস্থায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির। তাঁর ছদ্মনাম ছিল টিমোথি পেনপোয়েম ।
তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন সাত বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাঁকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্কস সরণী) অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন।
মহাকবির জন্মস্থান 
 প্রায় দু'শো বছর আগে অসাম্প্রদায়িকতার  এক বিরল দৃষ্টান্ত  মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসী ও আরবি পড়েছেন।  এভাবেই  সাগরদাঁড়িতেই এক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।

মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।


১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তাঁর "মাইকেল" নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে।

 তাঁর এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত ধর্মত্যাগী পুত্র মধুসুদন কে  ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। রাজনারায়ণ বসু তাঁকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তাঁর সেই মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। কথিত আছে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি।
মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি মধুসূদন। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন যা পেতেন, তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলান হত না। এই সময় তাই তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি তাঁর প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন সাত বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।

এদিকে মাইকেল তাঁর এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডি বন্ধু গৌরদাস বসাককে উপহার পাঠালে, গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন।
১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। পত্নীকে সেই সময় তিনি সঙ্গে আনেননি। তাঁর বংশধরদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় লিয়েন্ডার পেজ ।

মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত 'রত্নাবলী' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ খৃস্টাব্দে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা' নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খৃস্টাব্দে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এবং পূর্ণাঙ্গ 'পদ্মাবতী' নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ খৃস্টাব্দেই তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় 'মেঘনাদ বধ কাব্য' (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬১), 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক (১৮৬১), 'বীরাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।

বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব আকস্মিক। ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার, জে. সি. গুপ্ত ও রামনারায়ণ তর্করত্নের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। এই সময় লেখা নাটকগুলির গুণগত মান খুব ভাল ছিল না। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকটি অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জিত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের বিপুল অর্থব্যয় ও উৎসাহ দেখে মধুসূদনের শিক্ষিত মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্যরচনায় ব্রতী হন। রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করেন।
মাইকেল মধুসূদনের নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুইই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ - এই তিন বছর তিনি নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তাঁর রচিত নাটকগুলি হল: শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)।
এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে মায়াকানন (১৮৭৪) নামে একটি অসমাপ্ত নাটক।

শর্মিষ্ঠা একটি পৌরাণিক নাটক। রচনাকাল ১৮৫৯।
এটিই আধুনিক পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত প্রথম বাংলা নাটক। নাটকের আখ্যানবস্তু মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত রাজা যযাতি, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী থেকে গৃহীত। অবশ্য পাশ্চাত্য নাট্যশৈলীতে লিখলেও, মাইকেল এই নাটকে সংস্কৃত শৈলীকে সম্পূর্ণ বর্জন করেননি। এই নাটকের কাব্য ও অলংকার-বহুল দীর্ঘ সংলাপ, ঘটনার বর্ণনাত্মক রীতি, প্রবেশক, নটী, বিদুষক প্রভৃতির ব্যবহার সংস্কৃত শৈলীর অনুরূপ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক ধারার প্রভাবও এই নাটকে স্পষ্ট। প্রথম রচনা হিসেবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও, সেই যুগের ইংরেজি-শিক্ষিত পাঠকসমাজে এই নাটকটি খুবই সমাদৃত হয়। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে নাটকটি অভিনীতও হয়।

শর্মিষ্ঠার পরে ১৮৬০ সালে মাইকেল রচনা করেন একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নামে দুটি প্রহসন। এই প্রহসন দুটি তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা। প্রথম নাটকটির বিষয় ছিল ইংরেজি শিক্ষিত নব্য বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা ও দ্বিতীয়টির বিষয় ছিল সনাতনপন্থী সমাজপতিদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। এই নাটকে মাইকেলের পর্যবেক্ষণ শক্তি, সমাজবাস্তবতাবোধ ও কাহিনী, চরিত্র ও সংলাপ রচনায় কুশলতা বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু নব্য ও সনাতনপন্থী উভয় সমাজকেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত হওয়ার কথা থাকলেও, শেষপর্যন্ত তা হয়নি। এতে মাইকেল খুবই হতাশ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রহসন রচনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।

১৮৬০ সালেই মধুসূদন রচনা করেন পদ্মাবতী নাটকটি। এটিও পৌরাণিক নাটক। তবে এই নাটকের ভিত্তি পুরোপুরি ভারতীয় পুরাণ নয়। গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাপেল অফ ডিসকর্ড’ গল্পটি ভারতীয় পুরাণের মোড়কে পরিবেশন করেছেন মধুসূদন। গ্রিক পুরাণের জুনো, প্যালাস ও ভেনাস এই নাটকে হয়েছেন শচী, মুরজা ও রতি। হেলেন ও প্যারিস হয়েছেন পদ্মাবতী ও ইন্দ্রনীল। তিন দেবীর মধ্যে রতিকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচিত করলে অন্য দুই দেবী ইন্দ্রনীলের প্রতি রুষ্টা হন এবং ইন্দ্রনীলের জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনেন। শেষে রতি ও ভগবতীর চেষ্টায় ইন্দ্রনীল উদ্ধার পান এবং বিচ্ছিন্না স্ত্রী পদ্মাবতীর সঙ্গে তাঁর মিলন ঘটে। মূল গ্রিক উপাখ্যানটি বিয়োগান্তক হলেও, মাইকেল এই নাটকটিকে ইংরেজি ট্র্যাজি-কমেডির ধাঁচে করেছেন মিলনান্তক। এই নাটকে সংস্কৃত নাট্যরীতির প্রভাব অল্পই। প্লট-নির্মাণ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব উপস্থাপনা ও চরিত্র চিত্রণে মাইকেল এখানে আগের থেকে পরিণত হয়েছেন।

কৃষ্ণকুমারী নাটক রচনার পর মাইকেল কাব্যরচনায় পুরোদমে মনোনিবেশ করেন। শেষ জীবনে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের কর্ণধার শরচ্চন্দ্র ঘোষের অনুরোধে তিনি মায়াকানন নাটকটি রচনায় হাত দেন। নাটকটি তিনি শেষ করতে পারেননি। করেছিলেন ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এই নাটকটি শিল্পমূল্য বিশেষ নেই। এমনি মাইকেলের সৃষ্টিপ্রতিভার কোনো সাক্ষর এতে পাওয়া যায় না।

মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে - অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্যটি। চরিত্র-চিত্র হিসেবে রয়েছেন - রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমূখ। তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশও করেছেন। কিন্তু সর্গান্তে তিনি নূতন ছন্দ ব্যবহার করেননি, সর্গশেষে পরবর্তী সর্গকথা আভাসিত করেননি। যদিও তিনি বলেছিলেন -
গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত
তবুও কাব্যে করুণ রসেরই জয় হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয় - এটি নবজাগ্রত বাঙালীর দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নবমানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে একক সৃষ্টি।[৩]
মধুসূদন অতি আশ্চর্য্যজনকভাবে নির্মাণ-কুশলতা গুণে মহাকাব্যোচিত কাব্য-বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এ কাব্যের তাৎপর্য্য রাবণ-চরিত্রের প্রতীকতায়। তাঁর সৃষ্ট রাবণ চরিত্রে পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে উঠেনি। রামায়ণকে তিনি তাঁর মানবতার আলোকে বিধৌত করে যে মহাকাব্য রচনা করেছেন, তা আসলে রোমান্টিক মহাকাব্য। এ কারণে আকারে 'মেঘনাদবধ কাব্য' মহাকাব্যোচিত হলেও, এর প্রাণ-নন্দিনী সম্পূর্ণ রোমান্টিক এবং মধুসূদন এ কাব্যে জীবনের যে জয়গান করেছেন, তা বীররসের নয়, কারুণ্যের। কবি তাই, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্মারক, কলকাতা
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তাঁর সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছেঃ-

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী"

 তাঁর ৪ কাব্য  

মেঘনাদ বধ কাব্য
তিলোত্তমা সম্ভব
দি ক্যাপটিভ লেডী
ব্রজাঙ্গনা

নাটক ২টি
শর্মিষ্ঠা
কৃষ্ণকুমারী
পদ্মাবতী
প্রহসন ২টি 
বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ
একেই কি বলে সভ্যতা

সনেট ২টি
কপোতাক্ষ নদ
বঙ্গভাষা

মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে মধুপল্লী। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কবির আবক্ষ মূর্তি। বাড়ির উঠোনে জমিদারবাড়ির ঠাকুরঘর। তারপর প্রতিটি ঘরে কবির ব্যবহূত বিভিন্ন আসবাব রয়েছে। কবির বাড়ির পূর্ব ও পশ্চিম পাশ দিয়ে সরু ধারায় বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর সামনেই রয়েছে স্মৃতিময় বাদামগাছ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যেতে হলে প্রথমে যশোরে আসতে হবে, যশোর বাস টার্মিনাল থেকে বাসে কেশবপুর আসতে হবে। ৩২ কিলোমিটার পথের বাসভাড়া ২৫-৩০ টাকা। এরপর কেশবপুর থেকে পশ্চিমে ১২ কিলোমিটার ব্যাটারিচালিত গাড়ি অথবা ভ্যানে যাওয়া য়ায়। ভাড়া ২০ টাকা। সাগরদাঁড়িতে থাকার জন্য পর্যটনের একটি মোটেল আছে। ভাড়া ৩০০ টাকা।
 যুগে যুগান্তরে শত শত বছরে মাইকেল মধুসুদন অমর হয়ে থাকবেন বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অমর কীর্তিতে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই  মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!



যাচ্ছো কোথায়? - সুমি খান

 বেলা ১২টা- বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিট , শুক্রবার ,২৪ জানুয়ারী ২০১৪ , উত্তরা

যাচ্ছো কোথায়?
তোমার আমার হিসেব আছে -
একটু দাঁড়াও-

না মেটানো হিসেব গুলো
সুদ- আসলে অনেক হলো!
 সামনে তাকাও-
অস্ত্র-বোমার পথ এড়িয়ে
সৎ সাহসে বিচার মেনে  
শাস্তিটি নাও মাথা পেতে!

 যুদ্ধবাজ আর বোমাবাজের কোলে বসে
 ভ্রষ্ট ভ্রুণের নষ্ট বীজের সন্ত্রাস আর পেট্রোল বোম
 হাজার তিনেক প্রাণ কেড়েছে '১৩ সালের শেষ প্রহরে-

আমার মায়ের আঁচল আবার রক্তে ভেসে গেলো-
বিষন্ন দিন  শেষ বিকেলে  আবার এলোমেলো-

 রক্তবানে ভেসে গেছে ভুল রমনীর ছল!
 কোন্ মেজরের ছাউনী  থেকে ঘন্টাধ্বনি বল্?
কী ভেবেছিস্ জারজ খুনির দল? 
জলপাই রং ড্রামের ভেতর-
জন্ম তোদের হয়;
 বীর বাঙ্গালীর নয় !!

ইস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁড়ে
বুদ্ধ-যিশু -ভগবানের
খোদার আসন-আরশ ছুঁয়ে 
বলেছিলাম ধিক্!
 জ্যান্ত কবর হবে  তোদের 
 এই মাটিতে  ঠিক!!

 সাকা- গিকা- মুজাহিদ-সাঈদী 
কামারুজ্জামান- গোলাম আর 
কাশেম-মওদুদী
কসাই কাদের পথ দেখালো-
তোদের সে পথ এগিয়ে এলো 
লাখো শহীদের রক্তধারায় 
 এবার জাতির জিৎ!

বীর শহীদের রক্তধারায় 
রক্তমাখা ছুরির শানে কবর খুঁড়েছিলি -
পবিত্র এই মাতৃভূমে
বীর জনতার মনের জোরে
ফাঁসির দড়ি গলায় পরে 
সেই কবরে এবার তোদের ঠাঁই!

এমন ও দিন আসবে
 যেদিন  বীর বাঙ্গালী বলবে -
" জারজ তোরা খুনি কসাই-
কবরে ঠাঁই নাই-
এ পবিত্র বাংলায়!"
 সাগর ডেকে বলবে,"তোদের
জলে ও ঠাঁই নাই!"
মর্ রে কুলাঙ্গার-
 মায়ের ঘাতক হয়ে তোরা 
হইলি  রে ছারখার!"

Thursday, January 23, 2014

জীবন কথন ॥ গবেষণ ॥ মানবপরিচয়ের স্থানিক বিশেষণ রণজিৎ বিশ্বাস

রায়গঞ্জের হলে রায়গঞ্জি, গোলাপগঞ্জের হলে গোলাপি, জিলবাংলার হলে জিলাপি, গোপালগঞ্জের হলে গোপালিÑ এমন ফর্মুলায় নাম কি কারও হতে পারে?
: পারবে, এক শ’ বার নয়, দু’ শ’ তিনবার পারবে, দু’ শ’ তিনবার নয়, তিন শ’ উনিশবার পারবে, তিন শ’ উনিশ নয়, পাঁচ শ’ সাঁইত্রিশ বার পারবে, আট শ’ পঁয়তাল্লিশ বার পারবে, নয় শ’ পঞ্চান্নবার পারবে, এগারো শ’ আটানব্বইবার পারবে। যেমনÑরংপুরী, দিনাজপুরী, শরিয়তপুরী, টাঙ্গাইলি, বাসাইলি, পাতরাইলি, চৌদ্দগ্রামী, চাঁদপুরী, এনায়েতপুরী, মনোহরপুরী ইত্যাদি। বাখেরগঞ্জি, বালাগঞ্জি, ঈশ্বরঞ্জি, ফেঞ্চুগঞ্জি, শ্রীহটলি ইত্যাদিও হতে পারে। হওয়ালেই হয়, চালালেই চলে, বলালেই বলে, নাচালেই নাচে, ফাটালেই ফাটে। 
: তারপরও বলি, আপনার ই-ফর্মুলা বা ঈ-ফর্মুলা সব জায়গায় খাটবে না। 
: চাটগাঁর মানুষকে কী বলবেন? চাটলী? 
: সে রকম কেন বলব?! আমি পাগল নাকি? 
:অন্যের বেলা জানি না, আমার কোন সন্দেহ নেই।
: অমন বিড়বিড় করে কী বলছেন! যা বলবেন পরিষ্কার করে বলবেন, স্পষ্ট করে বলবেন। শুনিয়ে শানিয়ে বলবেন। এমনভাবে বলবেন আমাকে যেন বলতে না হয়- এই ভদ্রলোক, কী বলছিলেন এতক্ষণ! পরিষ্কার করে বলুনতো শুনি। বাড়ি, কোথায়? ইত্যাদি ইত্যাদি, ওগাইরা ওগাইরা। 
: আমি বলছি, কিছু কিছু জায়গা আছে, নাম এমন খটমট, আপনার ফর্মুলা প্রয়োগে ভজকট বাধবে। 
: বাধবে না। 
: আমি বলছি, বাধবে। চট্টগ্রামের লোকেদের না হয় আপনার দীর্ঘ ঈ-ফর্মুলায় চট্টগ্রামী বলে চালিয়ে দিলেন, ‘চাটগাঁ’ যদি আমি বলি? তখন কী করবেন?
: তখন ভিন্ন ফর্মুলা। তখন হবে, চাটগাঁইয়া, যেমন সোনারগাঁইয়া, বনগাঁইয়া ইত্যাদি। 
: যদি বলি নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, স্বরূপকাঠি, নেছারাবাদ, চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ভোলা? 
: আমার কোন অসুবিধা হবে না। তখন স্থানিক বিশেষণগুলো হবে- নোয়াখাইল্যা, কুমিল্লাইয়া, বরিশাইল্যা, পউট্টাখাইল্যা, কক্সবাজাইরগ্যা, স্বরূপকাইট্টা, নেছারাবাইদ্যা, চন্দ্রঘোইন্যা, কাপ্তাইয়া, বান্দরবাইন্যা, খাগড়াছইড়গ্যা, ভোলাইয়া ইত্যাদি। 
: তারপরও দেখবেন, কোন কোন জায়গার নাম আপনি এমন পাবেন, স্থানিক বিশেষণ আপনি সহজে যোগাড় করতে পারবেন না। বড় মনের কিছু ছোট মানুষের মতো-আউটডেইটেড ও আউটফ্যাশানড মানুষগুলোর কথা বাদ দিন, ছোট মনের বড় মানুষগুলোর মতো অন্য মানুষকে অসম্মান করার মতো উপযুক্ত, উন্নত, লাগসই, উপযোগী, ও ‘খাপখাইটিং’ শব্দ আপনি খুঁজে পাবেন না। আপনার ফর্মুলা ছক মানবে না। 
: বুঝলাম না!
: বুঝতে হবে আপনাকে। সন্দ্বীপ, উড়িরচর, চরফ্যাশান, চরকুকড়িমুকড়ি, লালমোহন, দৌলতখান, তজুমদ্দিন, রাঙ্গুনিয়া, গোমদ-ী, রাজশাহী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, রাঙ্গাবালি, সুন্দরবন, কটকা, হিরণ পয়েন্ট, উল্লাপাড়া, হাটিকুমরুল, চৌহালি, কাজীপুর, লাহিড়ীমোহনপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজবাড়ি, পলাশবাড়ি, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাঞ্ছারামপুর, বিতঙ্গল, নাগরপুর, এলাসিন, চৌহালি, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, বগুড়া, বাদলগাছি, পঞ্চগড়, হাতিয়া, রামগতি, ময়নামতি, নারাঙগিরি চিৎমরং, আলুটিলা, সাজেক, দিঘীনালা, তাড়াশ, হরিণঘাটা, মেলাদহ, পোড়াদহ, ঈশ্বরদী, নরসিংদী, বেলাব, জামুর্কি, চরভদ্রাসন 
-এসব এলাকার মানুষগুলোকে অবজ্ঞা করার জন্য অসম্মান করার জন্য ছোট মনের বড় মানুষদের মুখে আপনি কী কী শব্দ তুলে দেবেন?!
: আমাকে একটু সময় দিন, গবেষণা করে দেখি!
: না। সময়ও আপনাকে দেয়া যাবে না, গবেষণা করে দেখতেও আপনার হবে না।
: আমি তাহলে কী করব?
: কিছুই আপনাকে করতে হবে না। আপনি শুধু বহু পুরনো একটি কথা মেনে নিন। খেলিলে খেলোযাড়, কিন্তু জানিলে জানোয়ার নয়, লিখিলে নয় লেখোয়াড়, আনিলে নয় আনোয়ার, মনে মনে ভাবিলেই নয় মনোয়ার। 
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক

Wednesday, January 22, 2014

শুভাশীষের সঙ্গে সতর্কবাণীও -আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাঁর হাতের দুই আঙুলে ভি চিহ্ন তৈরি করে তাঁর দেশের মানুষকে ভিক্টোরি বা বিজয়ের প্রতীক দেখিয়েছিলেন। এবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভি চিহ্ন দেখাননি, তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার গঠন করেছেন। ১২ জানুয়ারি রবিবার এ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছে।
অনেকের ভয় ছিল, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের মতো হয়তো এমন একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, যা জনগণের অনেকের পছন্দসই হবে না। আমিও কয়েক দিন যাবৎ আমার বিভিন্ন কলামে শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়েছি, এবার যেন তিনি দেশকে একটি ক্লিন ও যোগ্য মন্ত্রিসভা উপহার দেন। যারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করবে। তা যদি হয়, তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে যাঁরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রশ্ন তুলছেন, বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইছেন, তাঁরা নিশ্চুপ হবেন এবং জঙ্গি মৌলবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও একটি নিরপেক্ষতার মুখোশধারী সুধীসমাজ নতুন করে চক্রান্ত শুরু করার সুযোগ পাবে না।
নতুন মন্ত্রিসভায় ২৯ জন পূর্ণ মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুজন উপমন্ত্রী আছেন। সাকল্যে ৪৯ জনের মন্ত্রিসভা। আরো দু-একজন বেশি মন্ত্রী গ্রহণ করা না হলে একে একটি মাঝারি সাইজের মন্ত্রিসভা বলা চলবে। এই মন্ত্রিসভায় ২০০৮ সালে গঠিত মন্ত্রিসভার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য, দক্ষ, প্রবীণ ও নতুন মন্ত্রী আছেন। তাতে আমরা আশ্বস্ত। এই মন্ত্রিসভা একেবারে ক্লিন- সে কথা আমি বলব না। কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি অবশ্যই আছেন। কিন্তু শতভাগ ক্লিন মন্ত্রিসভা গঠনের মতো ফেরেশতা বাংলাদেশে কেন, কোনো দেশেই আজকাল পাওয়া যাবে, তা মনে হয় না। যদি পাওয়া যেত, তাহলে নয়াচীনের মতো একটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট দেশে ক্ষমতাসীন পার্টি ও সরকারের বহু শীর্ষস্থানীয় নেতাকে দুর্নীতির দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হতো না।
বর্তমান যুগে ডান ও বাম দুই ধরনের রাজনীতিই অনেকটা সোনার গয়নার মতো। খাঁটি সোনা দিয়ে যেমন গয়না গড়া যায় না, তাতে খাদ মেশাতে হয়, তেমনি রাজনীতিতেও ভালোমন্দের মিশ্রণ না থাকলে তা কার্যকর রাজনীতি হয়ে ওঠে না। জনসাধারণও অতি ভালো মানুষ বা ফেরেশতাদের অক্ষম সরকার চায় না। তারা চায় ভালোমন্দে মিশ্রিত মানুষের সরকার। তবে সেই সরকারে ভালো ও দক্ষ মানুষের সংখ্যা যেন বেশি হয় এবং তাঁরা যেন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হন। তাদের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়ান।
শেখ হাসিনা এবার দেশকে এমন একটি সরকার উপহার দিতে পেরেছেন বলে অনেকেই মনে করেন। তোফায়েল আহমদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, রাশেদ খান মেননের মতো অভিজ্ঞ প্রবীণ মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা তো এই মন্ত্রিসভায় আছেনই; তাঁদের সঙ্গে গত মন্ত্রিসভায় যাঁরা দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তাঁরাও আছেন। যেমন ওবায়দুল কাদের ও হাসানুল হক ইনু। শেষোক্ত দুজনই তুলনামূলকভাবে তরুণ। নতুন আইনমন্ত্রী হয়েছেন আনিসুল হক। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় তাঁর আইনি দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া গেছে। আশা করা যায়, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা ও দণ্ডদানের কাজও তিনি যোগ্যতার সঙ্গে দ্রুত শেষ করে সারা দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূর্ণ করবেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
মন্ত্রিসভায় পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে নতুন মুখ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জাতীয় পার্টি থেকে এসেছেন। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। পানিসম্পদ নিয়ে দেশ এখন বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন। ফারাক্কার পানির ভাগ পাওয়া নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিতর্ক তো এখনো রয়েছেই। তার ওপর গোঁদের ওপর বিষফোড়া সৃষ্টি করেছে তিস্তার পানি, মনু নদী ও টিপাইমুখ বাঁধের সমস্যা। ভারতের সঙ্গে এসব সমস্যার আশু সুসমাধান না হলে বাংলাদেশ একদিকে ভয়াবহ খরা, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও প্লাবনের দ্বারা ধ্বংস হবে।
এসব সমস্যা সমাধানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখালেও প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই দপ্তরের মন্ত্রীকে তাই তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দ্বারা এই পানি সমস্যা সমাধানে দ্রুত সাফল্য দেখাতে হবে। আমার ধারণা, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ ব্যাপারে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দেখাতে পারবেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভায় আরেকজন প্রতিশ্রুতিশীল নতুন মুখ আসাদুজ্জামান নূর। তিনি একাধারে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রয়াত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি টেলিনাটকে বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। সব চেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনা, নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ যাতে না হয় তার দাবি জানিয়ে ঢাকায় বিরাট মিছিল বের হয়েছিল। নূর সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শিবিরের লোক। তিনি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হয়েছেন। এই মন্ত্রী বাছাইয়ে শেখ হাসিনাকে প্রশংসা করতে হয়। তিনি যোগ্য হাতে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
বহুকাল এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যোগ্য হাতে ছিল না। অথচ এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্টেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা ক্রমাগত হামলা চালাচ্ছে, যাতে বাংলাদেশ ও বাঙালির লোকায়ত ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তি ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপসংস্কৃতির আগ্রাসনকে জয়যুক্ত করা যায়। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে পরাজয় দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক পরাজয়ও ডেকে আনবে। এদিকটা মনে রেখে আসাদুজ্জামান নূরের মতো একজন প্রগতিশীল মানুষের হাতে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় আশা করা যায়, দেশের প্রায় ঝিমিয়ে পড়া প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাটিকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন এবং সাংস্কৃতিক শিবির আবার সেক্যুলার আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়ে উঠবে।
মন্ত্রিসভায় দুটি নাম না দেখে একটু বিস্মিত হয়েছি। একজন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আরেকজন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। সাবেক মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী (বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও একই পদে আছেন) ও ড. আবদুর রাজ্জাক খাদ্যমন্ত্রী থাকায় দুজনের আন্তরিকতা ও পরিশ্রমে দেশ শুধু কৃষি উৎপাদনেই উদ্বৃত্ত হয়নি, খাদ্যেও স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই আবদুর রাজ্জাক নতুন সরকারেও একই পদে থাকবেন ভেবেছিলাম। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কী বিবেচনা করেছেন, তা আমি জানি না। সুতরাং অধিক মন্তব্য আর করছি না।
জাহাঙ্গীর কবির নানক যুবলীগের নেতা হিসেবে যে সংগঠন শক্তির পরিচয় দেখিয়েছেন, তা প্রশংসাযোগ্য। এক-এগারোর সেই দুঃসময়ে আগরতলায় পলাতক অবস্থায় থেকে নানক কিভাবে দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তা আমি জানি। তিনি আগরতলায় বসে সুদূর লন্ডনে টেলিফোনে আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং প্রতিরোধ আন্দোলনে সহায়ক এমন লেখার উপাদান আমাকে সরবরাহ করতেন।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অনেক দুর্নাম রটেছিল, এ কথা সত্য, তা কতটা সঠিক তা আমি জানি না। নেহরু একবার বলেছিলেন, 'যেকোনো কাজেই যারা একটু বেশি সক্রিয় ও বেশি দায়িত্ব পালন করে, দুর্নামের বোঝা তাদের বইতেই হবে।' এ কথা নানকের বেলায় প্রযোজ্য কি না জানি না। বর্তমান মন্ত্রিসভাকে তুলনামূলকভাবে একটা ক্লিন চেহারা দানের জন্য বা অন্য কোনো কারণে যদি জাহাঙ্গীর কবির নানককে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপত্তি নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে আমার একটি নিবেদনও আছে। নিবেদনটি তাঁকে জানতে দ্বিধাবোধ করছি না।
জাহাঙ্গীর কবির নানকের বর্তমান জীবন বলতে গেলে এক প্রকার বিপর্যস্ত।
মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর একমাত্র পুত্রের অত্যন্ত তরুণ বয়সে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মেয়েরও পারিবারিক জীবন সুখের নয়। নানক তার পরও রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন এবং শুধু সক্রিয় থাকা নয়, দলের কাজে তাঁর সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেখাচ্ছেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল। সুতরাং আর কোনো কাজে না হোক, দলকে চাঙ্গা করে তোলার কাজে নানক ও তাঁর মতো অভিজ্ঞ নেতা-কর্মীদের লাগাতে হবে। আওয়ামী লীগের এক বন্ধু-নেতা আমাকে বলেছেন, 'নানক দুর্নীতি করেছেন।' আমি তাঁকে বলেছি, 'ঠগ বাছতে গেলে গাঁও উজাড় হয়ে যাবে।'
বর্তমান মন্ত্রিসভায় সব মন্ত্রী পদ এখনো পূর্ণ করা হয়নি। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এই পদে মাত্র অভিজ্ঞ হয়ে উঠছিলেন। এখন প্রশ্ন মাহমুদ আলী এ পদে থাকবেন, না নতুন কেউ আসবেন? যদি নতুন কেউ আসেন, তাহলে পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অভিজ্ঞ কেউ এলে ভালো হবে। এ পদে নতুন নতুন মুখ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা ঠিক হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়টি তো সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ দেশে যে জঙ্গি উৎপাত ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস এখনো বন্ধ হয়নি, তা বন্ধ করে জনজীবনকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে একটি শক্তিশালী ও পুনর্গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দরকার।
আগেই বলেছি, দেশের এক ভয়ানক অস্বাভাবিক অবস্থায় স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সংসদ ও নতুন সরকারের গায়েও অস্বাভাবিকতার কিছু চিহ্ন সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সাময়িকভাবে মেনে নিতে হবে। যেমন এই সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। আবার এ দলের কিছু সদস্য মন্ত্রিসভায়ও আছেন। তাহলে এটা কি একটি 'রেইনবো' বা রংধনু সরকার?
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, দেশের বর্তমান সরকার কতিপয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হয়তো একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য (পূর্ণ মেয়াদের জন্য নয়) ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যগুলো হলো, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করা, দেশে জামায়াতসহ জঙ্গিবাদী দলগুলোর উৎপাত ও সন্ত্রাস স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, আইনের শাসনের সুপ্রতিষ্ঠা ও কঠোর হাতে দুর্নীতি দমন, নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান এবং শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য দূর করা। সর্বোপরি দেশকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা।
এই লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে মহাজোটের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোনো মতানৈক্য আছে বা থাকবে বলে মনে হয় না। সুতরাং এই লক্ষ্য অর্জন ও দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হয়েও অবশ্যই সরকারকে একটা সময় পর্যন্ত সমর্থন দিতে পারে এবং এই সমর্থনের প্রতীক হিসেবে তাদের কয়েকজন সদস্য মন্ত্রিসভায়ও থাকতে পারেন। আপৎকালীন সময়ে এ ধরনের সরকার গঠনের অনেক নজির আছে। তবে এই সমঝোতা সত্ত্বেও দেশের অন্যান্য সমস্যার ব্যাপারে বিরোধী দলকে অবশ্যই সরকারের ভুলত্রুটিকে সমালোচনা ও বাধাদানের নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং আপৎকালীন সময় পেরিয়ে গেলে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে সংসদীয় বিরোধী দলের স্বাভাবিক ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে এরশাদ সাহেবও আর মন্ত্রীর পদমর্যাদা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের ভূমিকায় থাকতে পারবেন না।
প্রচণ্ড বাধার মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সরকার গঠনে সক্ষম হলেও শেখ হাসিনার সামনে এখনো কণ্টকাকীর্ণ পথ প্রসারিত। বিএনপি-জামায়াতি সন্ত্রাস ও ইউনূস-শিবিরের চক্রান্ত, সুধীসমাজের বিরোধিতা এবং সেই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর ঘোঁটপাকানো সাময়িকভাবে পিছু হটেছে; পরাজিত হয়নি। সুযোগ পেলেই তারা আবার মাথা তুলবে। আরো বড় ধরনের ছোবল মারার চেষ্টা করবে। এর একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে চেতনা সৃষ্টি করা এবং জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই সরকারকে শুভাশীষ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার সতর্কবাণী হচ্ছে, বর্তমান সাফল্যে কমপ্লাসেনসিতে না ভুগে সরকার যেন নিজেদের আপৎকালীন সময়ের অস্থায়ী সরকার মনে করে সর্বশক্তি নিয়ে এই আপদ প্রতিরোধের জন্য নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।
লন্ডন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০১৪

জামাতের লবিষ্ট হিউম্যান রাইটসওয়াচ নিরীহ মানুষ হত্যার পক্ষে ?- সুমি খান

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মিথ্যা প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরী –সুমি খান
  ধর্মীয় কাজে রাজনীতির ব্যবহার, অথবা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার- মানবতার জন্যে দুই-ই  বিপজ্জনক এবং সর্বনাশা। বিশ্বজুড়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সবাই। ইসলামী দেশ তিউনিসিয়া ও নিজেদের ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ পরিচয় বদলে  রিপাবলিকান দেশ হিসেবে পরিচয় দিতে সংসদে প্রস্তাব পাশ করেছে। মসজিদে খুৎবা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে সৌদী আরব। এই আইন গুলো এদেশে ও কার্যকর জরুরী । নাহয় মসজিদ আর ‘ইসলামী জলসা’ কে ব্যবহার করে সংখ্যালঘু এবং নারীদের বিরুদ্ধে অশ্লীল প্রচারণা বন্ধ হবে না। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তৃণমূল পর্যায়ে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানি দিয়ে এ দেশকে সংখ্যালঘু এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি শূন্য করার ষড়যন্ত্র  ঠেকানো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
নতুন মন্ত্রীপরিষদ দায়িত্ব নিয়েই অভিনন্দন পাবার মতো কিছু কাজ করেছেন যার মধ্যে রয়েছে  সাতক্ষীরায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে ভারতীয় যৌথবাহিনীর অবস্থান সংক্রান্ত ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে দৈনিক ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং তথ্যমন্ত্রী  হাসানুল হক ইনুকে এজন্যে অভিনন্দন জানাই।  এই ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে মিডিয়াকে ব্যবহার করে পরিকল্পিত মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানি ঠেকানো কঠিন হবে । দেশের সার্বভৌমতা কে চ্যালেঞ্জ করেছে বিভ্রান্তিকর এ প্রতিবেদন। এ ব্যাপারে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর স্পষ্ট বক্তব্য এই অপপ্রচার এবং সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি ঠেকাতে জরুরী।
দৈনিক  প্রথম আলো ৬ জানুয়ারী কলঙ্কিত নির্বাচন: জাল ভোট শিরোনামের  লিড রিপোর্টে  ফটোশপের মাধ্যমে সিঁদুর বসিয়ে হিন্দু নারী ভোটারদের আলোচিত  ছবি প্রকাশ করে। যা পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক হামলায় উস্কানি দেয়।জালভোটের মিথ্যা ছবি প্রকাশ করে; যার প্রতিবাদ জানায় ছবির তরুণ। তার জীবনের প্রথম ভোট দিতে গিয়ে ভোট কিভাবে দিতে হবে জিজ্ঞেস করছিলো ঐ তরুণ।ঐ তরুণের ব্যাপারে না জেনে এ ধরণের ছবি প্রকাশ সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তার জীবনের প্রারম্ভেই যে কলঙ্ক প্রথম আলো তার জীবনে লেপন করে দিলো- তার কী শাস্তি হওয়া উচিত? এ ধরণের হরুদ সাংবাদিকতা ঠেকাতে এর  বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। একই ভাবে  ইনকিলাবের মিথ্যা ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের রেফারেন্স ব্যবহার করে মানুষকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভ্রান্ত করার অপরাজনীতি ও ঠেকাতে হবে ।
অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামাত মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে  তাদের ঘাতকদের পক্ষে সমর্থনমূলক ভূমিকা  আদায় করে নিচ্ছে তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ।এর বিপরীতে শুভ শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরী। রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রদর্শন জরুরী। সরকারের প্রতিটি পর্যায় থেকে  সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে সুষ্পষ্ট অবস্থান  নিতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার এক পর্যায়ে দেখা গেলো,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিও) ধর্মব্যবসায়ীদের পক্ষে নির্লজ্জ অবস্থান নিয়েছে।কী কারণে তাদের এ  হঠকারী অবস্থান? এর ব্যাখ্যা দাবি রাখে।
  তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে  দাবি করা হয়েছে,মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে পিছনের দিকে চলে গেছে।”  কারণ  হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর সরকার কঠোর দমন-পীড়নে নিয়োজিত ছিল।হিউম্যান রাইটস ওয়াচের  এ প্রতিবেদনে সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করা হলেও এক্ষেত্রে জামায়াতের ভূমিকার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। গাড়ি পুড়িয়ে, পেট্রল বোমা মেরে মানুষ হত্যাকারীদের বিষয়েও বলা হয়নি কিছু।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার বিষয়েও কিছু নেই।
উল্টো ক্ষমতাসীনদের ‘নির্যাতনের শিকার ’ হিসেবে  বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ‘অধিকার’ এর দুই কর্তাব্যক্তি আদিলুর রহমান খান ও নাসিরউদ্দিন এলানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যারা হেফাজতবিরোধী মতিঝিল অভিযানের তথ্য বিকৃতির জন্য  সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত।এছাড়া বিএনপি নেতা, ‘নাস্তিকব্লগার এবং  ‘আমারদেশ’কে ‘প্রধান সংবাদপত্র’ উল্লেখ করে এর  সম্পাদককে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।  অন্যায় আর মিথ্যাচারের প্রতি কী  নির্লজ্জ এবং ভয়ংকর সমর্থন!  আবারো বলছি, শুধু রাষ্ট্র বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নয়, এর প্রতিবাদ করতে হবে আমাদের সাধারণ নাগরিক সমাজ থেকেও।
 এই প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হলো  যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে  মার্কিন মানবাধিকার সংগঠন 'হিউম্যান রাইটসওয়াচে'র অবস্থান  স্পষ্টভাবে  একাত্তর এবং সাম্প্রতিক সময়ের জামাত শিবিরের ঘাতকদের পক্ষে ।একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আর রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলিয়ে  ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশিত হলো ২১ জানুয়ারী মঙ্গলবার ।
 ২০১৩ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি  যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়, তাতে  বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশ সরকার বেআইনিভাবেশক্তি প্রয়োগ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।  
  রিপোর্টে ব্যালেন্স দেখাতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস আবার বলেছেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মতপার্থক্যের কারণে সহিংস ঘটনার জন্য  দুই পক্ষই দায়ী । বিরোধী দলগুলো তাদের সমর্থকদেরকে হিংসা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, অন্য পক্ষে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কখনো কখনো চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলতে হয়, পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে নিরীহ মানুষদের জীবন্ত দগ্ধ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী সাজা দেয়া হতো?  গণহত্যা , ধর্ষণ , অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের  দায়ে তারা কী শাস্তি দিতেন?   সাদ্দাম , লাদেন , গাদ্দাফির শেষ পরিণতি কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? তখন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ  এর  পর্যবেক্ষক টীম কোথায় ছিল? 
 একাত্তরের ঘাতককূল শিরোমণি গোলাম আযমের রায় নিয়ে  অনাকাঙ্খিত মন্তব্যের জন্য সংগঠনটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিলো আন্তর্জাতিক অপরাধ  ট্রাইব্যুনাল  এর পর ও যেন ‘টাকা কথা বলে’- আর তাই  ঘাতকদের বিচার বন্ধ করার জন্যে লাগামছাড়া মন্তব্য করেই যাচ্ছে তথাকথিত এই মানবাধিকার সংগঠন- যা হত্যা আর নির্যাতনের পক্ষেই তাদের হঠকারী অবস্থান স্পষ্ট করছে বারবার।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলেছেন, “এই সরকার গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি এবং আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু বরং তারা ক্রমশ স্বৈরাচারী ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তবে কি একাত্তরের ঘাতক দের মুক্তির দাবি তে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে সরকার বিরোধিতার নামে জনজীবন অচল করে দিয়ে বোমার মুখে মানুষকে জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছে যারা, তাদের আইনী প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা স্বৈরাচারী এবং অসহিষ্ণুতার প্রকাশ?  
 অনেকের মতে ,মুসলিম ব্রাদারহুড  এর নামে সন্ত্রাস দমনে সিরিয়া, মিশর  এবং সৌদী আরবে নিয়মিত মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হচ্ছে , প্রকাশ্য রাজপথে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।  সেই পথেই যেতে হবে বাংলাদেশ কে।
একাত্তরে গণহত্যাকারীদের বিচার ঠেকাতে লবিস্ট নিয়োগ করেছে জামায়াত।হিউম্যান রাইটস ওয়াচও  সেই লবিষ্ট দের অন্যতম । তাই গণহত্যাকারীদের বাঁচাতে চাইছে ।
সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রাস্তায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সারা বছর তা চলতে থাকে এবং এতে প্রায় ২০০ জন মারা যায় এবং হাজারেরও বেশি আহত হয়।প্রতিবেদনে  আরো উল্লেখ করা হয়েছে ,আগের বিক্ষোভগুলোর সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুন্যাল (আইসিটি)-এর নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর যোগসূত্র ছিল, যা হল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটা অপরাধ ও অন্যান্য নির্যাতনগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য গঠিত একটি দেশীয় আদালত।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত আব্দুল কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ গোপন করে তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন বর্ষীয়ান সদস্য – এই পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়,“মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর বছর শেষে আরো বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। "
 আরো বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আইসিটির আইনে  সংশোধনীগুলো অনুসরণ করে তাকে অভিযুক্ত করা হয় ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।এ ধরণের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জরুরী।
 আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের এ ধরণের হঠকারী ভূমিকা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক  অপশক্তি কে। যে কারণে এখনো হিন্দু পরিবার গুলোর  উপর হামলা  অব্যাহত রয়েছে।
 মসজিদের মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পুলিশ ও জনগণের ওপর জামায়াতীদের হামলা করা হচ্ছে বারবার।  ১৮ জানুয়ারী শনিবার আবার সেই  ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি এলাকায়। শনিবার মধ্যরাতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট এলাকায়  পুলিশ হত্যা মামলা সহ কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার করতে অভিযান চালায় পুলিশ ।এ সময় একটি মসজিদ ও মাদ্রাসার মাইক থেকে প্রচার করা হয়, গ্রামে সশস্ত্র ডাকাতরা হামলা চালিয়েছে। গুজব ছড়ানো হয়, আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ডাকাত সেজে হামলা চালিয়েছে। মসজিদ ও মাইকে এই মিথ্যা ঘোষণা শুরু হলে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং তাদের চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তারা পুলিশের পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়।  খানাবাড়ি গ্রামের ১২টি বসতবাড়ি ও খড়ের গাদায় আগুন দেয়া হয়। জামায়াতের ক্যাডার ও জামায়াত সমর্থক গ্রামবাসীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ২২ পুলিশ জখম হয়। কিছু গ্রামবাসীও আহত হয়েছে ।এসবের দায় কার?
১১ এপ্রিল ২০১৩ দুপুরে ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুরের কাজীরহাটে মসজিদের মাইকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিলের ওপর হামলা হয়, যাতে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। হামলায় স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মী নিহত হন, আহত হন দেড়শতাধিক। পুড়িয়ে দেয়া হয় মিছিলের সঙ্গে থাকা দুই শতাধিক মোটরসাইকেল, কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও জিপ। ভুজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও থানা জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিউল্লাহ নুরী সরাসরি এই  হামলার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত। সেদিন কাজীর হাট জামে মসজিদ থেকে মাইকে প্রচার করা হয় আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে মসজিদে হামলা করা হয়েছে এবং স্থানীয় মাদ্রাসার বড়হুজুরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরিকল্পিত এই ঘোষনার গুজবে কান দিয়ে জামায়াতকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় গ্রামবাসীরাও হামলায় অংশ নেয়।
সেই ভয়ংকর ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন এভাবে  মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে হত্যা এবং নির্যাতনে যেন  আর কোন মসজিদের মাইক ব্যবহার করা না হয়। এই ঘোষণার কোন কার্যকারিতা দেখা গেলো না। আবারো পুনরাবৃত্তি হলো, আক্রান্ত হলো স্বয়ং পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং তাদের বহন করা গাড়ি। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কী বলা যায় একে?
 ৫ মে নবম সংসদ নির্বাচনের পর  অনেকের ধারণা ছিল, জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা হয়ত জঙ্গী তৎপরতা থেকে বিরত থাকবে। হয়তো তাদের কৌশল বদলাবে।
কিন্তু গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পুলিশের ওপর জামায়াতী সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলার পর প্রমাণ হলো, জামায়াত-শিবির চক্র  মরিয়া।  নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আরও বড় ধরনের হামলা চালানোর আশংকা স্পষ্ট। এ জন্য এখন থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বক্ষণিকভাবে সম্ভাব্য যে কোন ধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন-  সেটা তাদের কর্মকান্ডে বারবার প্রমাণিত। 
এটাও প্রমাণিত হলো, তারা  পবিত্র ধর্মের কথা বলে, কিন্তু কল্যাণমূলক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না। মওদুদীর দীক্ষামতে মিথ্যাচার আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ তাদের মূল লক্ষ্য।
মিথ্যাচার প্রতারণা ও লুটপাট তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি। মসজিদ মাদ্রাসার মতো পবিত্র স্থানকে তাদের হীন রাজনৈতিক কৌশল চরিতার্থের জন্য  ধর্মকে ব্যবহার করে। তারা ধর্মভীরু মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে জিম্মি করে ফেলে। যে নিরীহ ছা-পোষা মানুষেরা ভাবতেও পারে না, কেউ কখনো মসজিদের মাইকে মিথ্যা প্রচার চালাতে পারে। কিন্তু জামায়াতী দুর্বৃত্তরা তাই করছে। তারা মাইকে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে পুলিশ এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর উপর  পরিকল্পিত হামলা করছে। চট্টগ্রামের পাথরঘাটার জেলেপাড়া, হাটহাজারী , ফটিকছড়ি, সাতক্ষীরা , রামুর বৌদ্ধমন্দির  সহ অসংখ্য ঘটনার ধারাবাহিকতা তার ই প্রমাণ। পুলিশ বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর নামে তারা মূলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে।  একাত্তরের চরিত্র অপরিবর্তনীয়। কারণ, বাংলা এবং বাঙ্গালী কৃষ্টি সংস্কৃতি বিনাশে তাদের লক্ষ্যে তারা স্থির। 
জামায়াত-শিবির চক্র বারবার প্রমাণ করছে তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল এবং সন্ত্রাস বিধ্বস্ত  ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।স্পষ্টত: তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। আর তাই বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রদ্রোহী জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের ক্ষমা করার সুযোগ নেই। এখন থেকে মাদ্রাসা ও মসজিদে রাখা প্রতিটি মাইক ব্যবহারের বিষয়ে কঠোর বিধিনিষেধ চালু করা দরকার। ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন নাশকতার উদ্দেশে এসব মাইক ব্যবহার করা যাবে না। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে যারা হামলা করেছে, তাদের অবিলম্বে দ্রুত বিচারব্যবস্থায় বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
১৫ জানুয়ারীর দ্য উইক পত্রিকা লিখেছে, আরব বসন্তের দু’টি দেশ মিসর এবং  তিউনিসিয়া গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইতে নেমেছে।  ৯৮% মুসলিমের দেশ তিউনিসিয়া। তাদের সংসদে মেজরিটি-ভোটে গঠনতন্ত্র পাশ হল । দেশের আইন ব্যবস্থা শারিয়া-ভিত্তিক হবে না, হবে আধুনিক। তিউনিসিয়াকে আর "ইসলামী রাষ্ট্র" বলা হবেনা, বলা হবে রিপাবলিক বা "প্রজাতন্ত্র"। বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের শিরোমণি সৌদি  আরবের মন্ত্রনালয় নির্দেশ দিয়েছে "জুমা'র নামাজের খুতবায় রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে ইমাম চাকরী হারাবেন"।এটা জরুরী ভিত্তিতে চালু করতে হবে এদেশেও।আবারো বলছি,সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে যে দৃষ্টান্ত , সেটা অনুসরণ করতে হবে।
 অনেক বিপর্যয়ের পর দেশে আবার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরছে মনে করছে মানুষ। এ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে মানবতা রক্ষার সংকল্পে অটল থাকতে হবে।আর এ কারণেই রাজনীতিতে ধর্ম এবং ধর্মে রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে সরকারকে।রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এর কোন বিকল্প নেই।  

Sumikhan29bdj@gmail.com