Saturday, March 22, 2014

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিন - ড. মো.আনোয়ার হোসেন

মার্চ মাস নানা কারণেই এদেশের মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আপামর দেশবাসী এক সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তারই হাত ধরে এসেছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর অমর ভাষণ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে জাতিকে দ্বিধাহীন চিত্তে জীবনপাত করতে চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

তারপর এসেছে ২৫ মার্চের কালরাত। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির অদম্য বাসনাকে হত্যা করতে ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের ‘অপারেশন সার্চ লাইট।’ ইতিহাসের নৃসংশতম গণহত্যা। সেই কালরাতের অব্যবহিত পরই এ ভূখন্ডের  মানুষের হাজার বছরের পূর্ব ইতিহাস এবং সামনের অনাগত কালের মহত্তম দিন ২৬ মার্চ এসেছে। বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

আরও একটি মহৎ দিন আছে এই মার্চ মাসে। ১৭ মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। আবার এই মার্চেই জাতীয় প্যারেড গ্রাউডে ৪৩তম স্বাধীনতা দিবসে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ গাইবে দেশবাসী। এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার রেকর্ড সৃষ্টি শুধু নয়, ’৭১-এর পরাজিত যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা আজও যাদের আছে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শুভক্ষণ রচিত হবে ২৬ মার্চে। এখন এই মার্চ মাসেই বাংলাদেশ আয়োজন করছে টি২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপ।

কি অপার দুঃখ, কি অসহ্য বেদনা, অপমান ও পরিতাপের কথা এই মার্চ, এই স্বাধীনতা দিবস, এই জাতীয় সঙ্গীত, অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই ক্ষণ আমাদের মহত্তম সব অর্জন ও অহঙ্কারকে চরম উপহাস করতে, মলিন করতে, প্রশ্নবিদ্ধ করতে তিন কোটি টাকার ভিক্ষা পাত্র নিয়ে এসেছে ইসলামী ব্যাংক। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, এই অর্থ প্রত্যাখ্যান করা হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেছেন, অর্থ নেয়া হয়নি। ইসলামী ব্যাংক ঔদ্ধত্যভরে সে কথার জবাব দিয়েছে। ২৬ মার্চে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার অনুষ্ঠানে তাদের অর্থায়নের কথা তারা প্রচার করেছে। উদীচী, গণজাগরণ মঞ্চ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা এই অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যয় হলে অনুষ্ঠানটি বয়কট করা হবে। তাদের এই দাবি কোনভাবেই অন্যায্য নয়। এটা আমাদের সবার প্রাণের দাবি। অতীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের দিয়ে আমাদের নানাভাবে অপমান করেছে। রাষ্ট্র প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার, অর্থ ব্যবস্থা, সামাজিক সংগঠন সর্বত্র তাদের পুনর্বাসন করেছে। কিন্তু এখন ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে শুধু নয়, ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। আর এই সময়ে, এই গৌরবময় মার্চ মাসেই কিনা আমাদের এই অপমান!

বঙ্গবন্ধু কন্যা দুঃসময়ের কান্ডারী। গভীর অমানিশায় আমাদের আশার প্রদীপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত নিবেদন ২৫ মার্চের মধ্যেই একটি পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে ভারমুক্ত করুন। চূড়ান্ত অপমানের হাত থেকে রক্ষা করুন। ঐ ভিক্ষামুষ্টি ফিরিয়ে দিন। 

জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের সংযোগের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। মনে পড়ছে, এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পর্যন্ত সংসদে এই ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক জঙ্গী অর্থায়নের কথা প্রকাশ করেছিলেন। গণজাগরণের এক অন্যতম সেøাগান ছিল ‘ই’ তে ইসলামী ব্যাংক- নিষিদ্ধ কর। আমরা ক্ষুব্ধ ও আশাহত হয়েছিলাম যখন মহাজোট সরকারের আমলে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনে অর্থায়ন ও প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ইসলামী ব্যাংককে। তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সে প্রতিবাদের ভাষা ও মর্মবাণী পড়তে পারেননি লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার আয়োজক নীতিনির্ধারকরা। তাই দ্বিতীয়বারের মতো এই মার্চ মাসে কোটি কোটি মানুষের গালে চপেটাঘাত। আমরা তা গ্রহণ করতে পারি না। গভীর পরিতাপের কথা এই নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রয়েছে। কোন্ বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইসলামী ব্যাংকের ভিক্ষামুষ্টি নিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার আয়োজনের কথা ভাবছে। 

বাংলাদেশের বহু ব্যাংক অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে এই আয়োজনকে সফল করতে। ইসলামী ব্যাংকের তিন কোটি টাকা ছাড়া এই আয়োজন সফল হবে না তাও কি আমাদের মানতে হবে? সেনাবাহিনীতে গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারের আনুকূল্যে। আমরা দেখেছি গোলাম আযমের বিচার কাজ চলাকালে ঐ নরাধম পুত্রের ঔদ্ধত্য। কোন অনুশোচনা, পিতার পাপের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান সে নেয়নি। এখন সে অবস্থা নেই। জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত ইসলামী ব্যাংকের পয়সা জাতীয় সঙ্গীত গাইবার এমন মহৎ অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যয় হতে কেন দেবে সেনাবাহিনী?

২০১৩ সালের মার্চ মাসে আমার জীবনের একটি মহৎ ক্ষণ উপস্থিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অমর ভাষণের ওপর স্মারক বক্তৃতা প্রদানের বিরল সম্মান দেয়া হয়েছিল আমাকে। ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ’ শিরোনামের স্মারক বক্তৃতাটি লিখে ফেলি। ওসমানী মিলনায়তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বক্তৃতা প্রদানের পূর্বেই আমার অনুরোধে তিনি আমাকে মূল্যবান সময় দিয়েছিলেন। খসড়া ভাষণটি তাঁকে শুনিয়েছিলাম। জাতির জনকের ৭ই মার্চের অমর ভাষণের মর্মবাণীর সঙ্গে শাহবাগে নতুন প্রজন্মের জাতীয় পুনর্জাগরণের সেতুবন্ধন রচনা ছিল ঐ স্মারক বক্তৃতার মূল উপজীব্য। বঙ্গবন্ধু কন্যার নজর তা এড়ায়নি। পরবর্তী সময়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খার  প্রতিফলন আমরা দেখেছি। আমি নিশ্চিত জানি আগামী ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে নতুন প্রজন্ম যেভাবে অপমানিত বোধ করছে, এখনও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারবর্গ ইসলামী ব্যাংকের অর্থ প্রত্যাখ্যান করার যে প্রবল আকুতি জানাচ্ছে তাকে পূর্ণসম্মান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি জানাবেন। ২৬ মার্চের পূর্বেই এই প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা এবং জঙ্গী-জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নেয়ার ঘোষণাটি আপনার কাছ থেকে আমরা চাই।


আমরা চাই নবীন-প্রবীণ-শিশু, পরিবার-পরিজন সবাই মিলে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। আমাদের চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলার’ অমৃতগাঁথা এক মহান সুর লহড়ীর সৃষ্টি করবে। অনুরণিত করবে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীকে। সেই আত্মমর্যাদাবোধ, মানবিক আবেগ, ভালবাসা ক্ষমার অযোগ্য নিকৃষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের অর্থ সাম্রাজ্যের প্রতিভু ইসলামী ব্যাংকের কাছে নতজানু হতে দেবেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে - মুহম্মদ জাফর ইকবাল


স্বাধীনতা দিবস আসছে, তাই মনটা ভালো ছিল, হঠাৎ করে দেখি মনটা ভাল নেই। স্বাধীনতা দিবসে লাখো মানুষ নিয়ে আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইব, এখন শুনছি সেই গান গাওয়ার জন্য টাকা দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নিজেদের ইসলামী ব্যাংক। যে গানটির একটি কথা মুখে উচ্চারণ করার জন্য এ দেশের মানুষকে যারা চোখ বন্ধ করে জবাই করেছে তাদের দল এখন এই গানটি গাওয়ার জন্য টাকা দেবে আর সেই টাকা নিয়ে আমাদের গানটি গাইতে হবেÑ আমাদের কী এতই অবস্থা খারাপ হয়েছে?

উদীচীকে দুই হাতে স্যালুট, তারা বলে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা দিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে তারা সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে না। আমাদের ভালোবাসার এ গানটির সম্মান রক্ষা করার জন্য তাদের এই ভূমিকার কথা দেশের মানুষ অনেক শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।

আমি এখন পর্যন্ত যত তরুণ-তরুণী কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেছি তারা সবাই বলেছে অনেক আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে তারা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল এখন তারা আর নিজের ভেতর উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের তরুণ প্রজন্ম কোনটি সঠিক কোনটি ভুল অনুভব করতে পারে দেখে আমি খুব আশান্বিত হয়েছি।

স্বাধীনতা দিবস আসছে, এখন আমি মন খারাপ করার কথা বলতে চাই না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মতো এত সুন্দর একটি সঙ্গীত আর কোন দেশের আছে কিনা, আমার জানা নেই। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তাদের কাছে এই গাটির একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আবেদন আছে; তার একেকটি চরণ যখন আমরা শুনি আমাদের চোখ ভিজে আসে। এটি যদি শুধু একটি গান হতো তাহলে সবাই নিজের মতো করে গাইতে পারত, কিন্তু এখন এটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত তাই এটি এখন আর নিজের মতো করে গাইতে পারব না। এটি শুদ্ধভাবে গাইতে হবে। 

আমি লক্ষ্য করেছি, অনেক বড় অনুষ্ঠানেও এটি পুরোপুরি শুদ্ধভাবে গাওয়া হয় না, এক দুটি লাইন বাড়তি যোগ করে দেয়া হয়। গানটি কিভাবে গাইতে হবে শেখানোর জন্য স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাঠ্য বইয়ে সেটি লিখে দেয়া হয়েছে, আশা করছি এই প্রজন্ম যখন বড় হবে তখন তারা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সঠিকভাবে গাইবে।

এই লেখার সঙ্গে আমি জাতীয় সঙ্গীতটি যেভাবে গাইতে হবে সেটি যুক্ত করে দিচ্ছি, খবরের কাগজ হলে কেটে সবাই যেন তার পকেটে রেখে দেয়। কপি করে অন্যকে দেয়। (আমার পকেটে সব সময় এর কপি থাকে!) ইন্টারনেট হলে এক কপি প্রিন্ট করে নিয়ে নেয়, নিজে রাখে, অন্যকে দেয়।

গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের পূর্ণপাঠ

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে
ও মা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি,
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গোÑ
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন
ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

শেষ করার আগে সরকারের কাছে অনুরোধ ইসলামী ব্যাংকের দেয়া টাকাটা যেন তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমরা আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীতটি ভালোবাসা দিয়ে, মর্যাদা দিয়ে, সম্মান দিয়ে গাইতে চাই। আমাদের আশাহত করবেন না ,দোহাই আপনাদের। ২১.৩.১৪

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ

ভায়েরা আমার,

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।

তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।

ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।

গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

Friday, March 21, 2014

নীতি, নৈতিকতা, বিবেকবোধ আজ বাক্সবন্দী ------ নাসরিন হক

মানুষ পরিবর্তনশীল আমরা সবাই এ কথা জানি। তবে প্রতিটি মানুষের কিছু নীতি থাকে। একজন সত্যিকারের মানুষ নীতির সাথে কখনই আপোষ করতে পারে না, করা যায় না। কিন্তু আজকে যারা আমাদের সমজের বড় বড় স্থানে অধিষ্ঠিত, জীবনে প্রতিষ্ঠিত তাদের নীতিহীন কর্মকান্ড দেখে তরুণ প্রজন্ম তাদের কাছে কি শিখবে! ব্যক্তি জীবনের সফলতা, সামাজিক সাফল্য আকাশচুম্বী, তারপরও তাদের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লিপ্সা তাদেরকে করেছে বিবেকহীন, নীতিহীন। 
ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক, এদেশের একজন প্রথম সারির আইনজীবি। সফল জীবন তার। বিভিন্ন সময় আমরা দেখি সাংবাদিকেরা তার কাছে ছুটে যান রাজনৈতিক মতামতের জন্যে। তিনি তার সুবিধামত মতামতও ব্যক্ত করেন। কাল যা বলেন আজকের বলার সাথে দেখা যায় সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থান। এমনই চলছে। তারপরও তারই কাছে আমাদের ছুটে যাওয়া, মতামত নেয়া, যেহেতু তিনি বিশিষ্টজন। 
গত ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তিনি বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, সংবিধান পেয়েছি”। 
তিনি সত্যি কথাই বলেছেন। এক সাগর রক্ত আর তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিয়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ, ৭২’এর সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা সেই সংবিধান পেয়েছি। 
বেশ কয়েকমাস আগে ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক তারেক রহমানের কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে তারেক রহমানকে নিয়ে একটি বক্তব্য রাখেন। যে তারেক রহমান ৭২’ এর সংবিধান মানেন না! তারেক রহমান ৫ জানুয়ারি লন্ডনে একটি সভায় প্রকাশ্যে বলেন-"বাহাত্তরের সংবিধান গণতন্ত্রের আকাঙ্খার পরিপন্থী"।
 সেই ৭২’এর সংবিধানের চেতনা বিরোধী তারেক রহমানের জন্যে যখন ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক যখন তার বক্তব্যে বলেন -"যে ব্যবস্থাই হোক বিএনপি আগামী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। আর এটাই হবে তারেক রহমানের প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তারেক রহমান আমার চেয়ে ছোট। আমি তার বাবা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছি। আবার তার মা বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে কাজ করেছি। 
এমন কি তারেক রহমানের মামলাগুলোও দেখছি। তার মাত্র একটি মামলা জামিনের বাকি আছে। তাহলেই তারেক রহমান আইনিভাবে মুক্ত হবেন। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তার বাসায় ডিনার খেয়েছি। তিনি এখন সুস্থ আছেন। পড়াশোনা করছেন। তারেক রহমানকে বলেছি, তুমি যখন দেশে ফিরবে, বিমান বন্দরে অন্তত ২০ লাখ লোকের সমাগম হবে”।
 সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫/৯/১৩ইং। 
শুধু তাই নয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করতে ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় তারেক রহমান বলেন- “নির্দেশনার অপেক্ষা না করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ুন”।
 যা ছিল সারাদেশে ১৯দলের সহিংসতা ছড়ানোর প্রত্যক্ষ নির্দেশ। তার পরবর্তীতে কি ঘটেছিল এই দেশে সারা দেশবাসী সহ গোটা বিশ্ববাসী দেখেছে।
যা বলছিলাম, একদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭২’এর সংবিধান পেয়েছেন বলে ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক গর্বিত, ওপরদিকে ৭২’এর সংবিধানের বিপক্ষে তারেক রহমানের জন্যে তার অবস্থান! পেশার কারনে নীতি, বিবেক সব বাক্সবন্দি করে রেখে দিয়েছেন! কবে, আর কবে সেই বাক্স খুলতে পারবেন তিনি তার এই জনমে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন, এদেশের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী। বঙ্গবন্ধুর সহচর বিখ্যাত সাংবাদিক মানিক মিয়ার আত্মীয়ও বটে। এখন তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা। যিনি এখন বিডিআর ট্রাজেডির খলনায়কদের পক্ষে আইনী লড়াই লড়ছেন! শুধু কি তাই, কসাই কাদেরের অন্যতম আইনজীবীও বটে। আমরা তাকে কসাই কাদেরের জন্যে ছুটোছুটি করতে দেখেছি, ট্রাইব্যুনালকে হুমকি দিতেও দেখেছি। বিচারকদের বিচার করবার হুমকী পর্যন্ত তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে দিতে পারলেন !
অথচ ৪০ বছর আগে এই খন্দকার মাহবুব হোসেনই রাজাকারদের বিপক্ষে লড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে রাজাকারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিম্নলিখিত মামলাগুলোতে শাস্তি নিশ্চিত করতে এডভোকেসি করেছেন তৎকালীন স্পেশাল পিপি খন্দকার মাহবুব হোসেন -- 
১.১৯৭২ সালের দালাল আইন এর ১(খ) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৩৬ নাম্বার ধারায় হানাদার বাহিনীর দালালী ও অগ্নিসংযোগ অভিযোগের দায়ে দুই জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড:
সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ৮/৯/ন১৯৭২ইং। 
২. খুনি রাজাকার আব্দুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে ট্রাইবুনালের জজ খোরশেদ আলী: 
সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ২৯/১১/১৯৭২ইং। 
৩. শাহজাহানপুর কলোনির ত্রাস রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান ওরফে মুন্নার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের জজ জনাব এস এম মাহমুদ।
সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ১/৯/১৯৭৩ইং। 
৪. রাজাকার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে দায়েরকৃত মামলা নং: (৫)৭২, জি আর নং- ২৫০ (২) ৭২ ৫) সাকা চৌধুরীর নামে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে চট্টগ্রাম জেলার হাট হাজারী থানায় ১৩/৪/১৯৭২ তারিখে ১৭ নং মামলা দায়ের হয়। রাউজান থানায় ৪১(১)৭২ নং এবং ৪৩(১)৭২ নং মামলা দায়ের করা হয়। এফআইআর নাম্বার হচ্ছে- ইউ/এস/৩০২/১২০(১৩)/২৯৮ দণ্ডবিধি। 
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব ৪০ বছর আগে যাদের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ছেন ৪০ বছর পর এখন তাদের পক্ষে লড়ছেন! শুধুই পেশার কারনে মানুষের এমন নৈতিকতার অধঃপতন হতে পারে কি? সমাজের এমন উচ্চ পর্যায়ে থেকে এমন নীতিহীন কাজ তখনই করা সম্ভব যখন তাদের বিবেক আর নীতিবোধকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন। এসব নীতিহীন মানুষদেরাই আজ আমাদের বাংলাদেশের এলিট শ্রেণী, দেশের মানুষকে, সরকারকে সুযোগ পেলেই উপদেশ দেন, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের সময় এদের ভূমিকা স্পষ্ট ধরা পরে যায় আমজনতার চোখে। তাদের ভূমিকায় আমরা লজ্জিত হলেও তারা থাকেন উজ্জ্বীবিত ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হবার দিবাস্বপ্নে। 
নাসরিন হক।

Wednesday, March 19, 2014

আপোসের আর্ট ও ইসলামী ব্যাংক - স্বদেশ রায়


৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যখন দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনলেন, তখন সাধারণ মানুষ একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। তাঁরা হাফছেড়ে বেঁচেছিলেন। কারণ, জামায়াত ও বিএনপির সন্ত্রাসের কারণে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ব্যবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা সবই। পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, রেলের স্লিপার তুলে রেল দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ হত্যা এ সবের বিচার তো আছেই। শুধু যত কৃষিপণ্য নষ্ট হয়েছে এবং ‘ও’ লেভেলের ছেলেমেয়েদের একটি বছর পরীক্ষা দিতে না পেরে যে ক্ষতি হয়েছে এর বিচার হলেই কিন্তু ওই গোটা সন্ত্রাসের মূলনেতা খালেদার কমপক্ষে যাবজ্জীবন কারদন্ড হওয়া উচিত। আর মানুষ হত্যার বিচার তো আছেই। 

বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অবশ্য পার্লামেন্টে বলেছেন, জামায়াত-বিএনপির ওই সন্ত্রাসের, নরহত্যার বিচার করবেন। শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলেন। বার্ন ইউনিট থেকে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন, আগুনে পুড়িয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে এটা গণহত্যা। শেখ হাসিনা যখন এ কথা বলেছিলেন তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী। এখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী। 

তাই তাঁর কাছে প্রশ্ন আসে স্বাভাবিকভাবে, তিনি নিজেই যাকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করেছেন তার বিচার শুরু কবে হবে? কারণ কোন দেশে গণহত্যাকারীরা ও গণহত্যার নেতা বিচারের আওতার বাইরে থাকতে পারে না। ইতোমধ্যে অবশ্য দেখা গেছে শাহবাগ ও পরিবাগের বাসে আগুন দেয়া মামলায় বিএনপির যে নেতারা হাইকোর্টে জামিন পেয়েছিলেন, মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণ সে জামিন বাতিল করেছেন। এবং এখন তারা কারাগারে। সাধারণ মানুষকে যারা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, নারী শিশুকে যারা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, কিশোর মনিরের দেহ আগুনে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে যারা উল্লাস করেছে তারা এবং তাদের হুকুমদাতা নেতারা যদি জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় তাহলে ওই দেশের আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে সরকারের চরিত্র নিয়ে।

আগেও এই কলামে লিখেছি, এখনও বলব শেখ হাসিনা একাই সরকার নয়। তিনি একা বা তার সঙ্গে আরও কয়েকজনই গোটা সরকার নয়। বাস্তবে এই সরকারের মধ্যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘পাকিস্তান’ আছে। ‘আপোস’ আছে। 

আর আছে বলেই কিন্তু ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে প্রায় সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে এই দেশে খালেদা জিয়ার নির্দেশে যে গণহত্যা হয়েছে তারপরেও খালেদা জিয়াকে গণহত্যার আসামি করে এখনও অবধি কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। এমনকি কোন দৃশ্যমান উদ্যোগও নেই। পার্লামেন্টে প্রথমত পার্লামেন্ট সদস্যরা উপস্থিত হন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকলেও তারা উপস্থিত থাকেন না। অথচ এই পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনেই পুরো হাউসের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল নির্বাচনের আগে সাত মাসে দেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার তদন্ত করে ওই গণহত্যার নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হোক। তাকে বিচারের আওতায় আনা হোক। সে কাজটি করা হয়নি। কারণ ওই মনোজগতে পাকিস্তান এবং আপোস। কিন্তু বর্তমান সরকারকে ভবিষ্যতের দিকে এগুতে হলে, দেশকে রক্ষা করতে হলে এই মনোজগতকে পরিবর্তন করতে হবে। আজ দেশে বেশ কয়েকটি জায়গায় সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পরে যারা সরকারী অফিস ধ্বংস, নরহত্যা ও শিশু হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। তারা জামিন নিয়ে নির্বাচন করেছে?

 প্রশ্ন ওঠে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ধারায় মামলা করা হয়েছিল যে, তারা জামিন পেল? তাদের এই জামিন পাবার পিছনেও কিন্তু কোথাও কোথাও যেমন প্রশাসনের ভেতর থাকা ভূত কাজ করেছে তেমনি আওয়ামী লীগের ভূত কাজ করেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের তদবির, তাদের সুপারিশেও অনেকে জামিন পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা অনেক অর্থ জামায়াতের কাছ থেকে নিয়েছে তারও খবর প্রতিনিয়ত কিন্তু সংবাদপত্র অফিসে আসে। শুধু তাই নয়, ওই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা আবার অর্থ দিয়ে তাদের এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের বশ করেছেন। 
আর জামায়াতের অর্থ যে কত শক্তিশালী সে তো ২৬ মার্চের কোটি কণ্ঠের জাতীয় সঙ্গীত উৎসব নিয়েই বোঝা যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক গত সাড়ে চার বছর ধরে কী করছে সেটা সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাকে রগকাটা অস্ত্রসহ রাজশাহীতে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া সরকারের জানা থাকা উচিত যে, সাতক্ষীরায়, সীতাকুন্ডে প্রভৃতি জায়গায় জামায়াত যে তান্ডব চালিয়েছিল সেখানে গৌরি সেনের মতো টাকার জোগান দেয় ইসলামী ব্যাংক।

 সাতক্ষীরা থেকে সাধারণ মানুষ আমাদের ফোন করে তখন বলেছে, সন্ত্রাসীদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায় আর ইসলামী ব্যাংকের টাকা চলে আসে থানায়, বের হয়ে আসে সন্ত্রাসীরা। এই ইসলামী ব্যাংকের তিন কোটি টাকা না হলে কি কোটি কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে না এ দেশে? এ দেশের তিন কোটি দরিদ্র কৃষককে বলা হলে তারা এক ঘণ্টার মধ্যে এক টাকা করে তিন কোটি টাকা সরকার প্রধানের হাতে তুলে দেবে। কারণ, তাদের মাথার ভিতর ক্ষমতা নেই, পাকিস্তান নেই, টাকা নেই, আপোস নেই। তাই তারা তাদের জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানকে কলুষিত করবে না। 

সরকার তাদের গত আমলে বিশ্বকাপের সময় রাজধানীর শোভাবর্ধনের দায়িত্ব দেয় ইসলামী ব্যাংককে। জানি না ক্ষমতার চশমা সরকারের কোন ব্যক্তিকে পড়তে দিয়েছিল কিনা- কী সাইনবোর্ডগুলো ইসলামী ব্যাংক রাজধানীতে টাঙিয়ে ছিল? কোথাও তারা ‘বাংলাদেশ’ লেখেনি। লিখেছিল ‘এই দেশ।’ অর্থাৎ তারা এখনও বাংলাদেশকে স্বীকার করে না। তারা তাদের অবস্থানে ঠিক আছে।

 আপোস শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর ভর করেছে। আর এই আপোসের কারণেই কিন্তু আজ ইসলামী ব্যাংক এমনি করে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত উৎসবে ঢুকে পড়ছে। এবং দুঃখজনক হলো, সরকারের ভুল স্বীকারের কোন লক্ষণ নেই। দেখা যাচ্ছে ১৮ মার্চ ১৬.৪৯ মিনিটে বিডি নিউজ ২৪ডটকম সংবাদ আপলোড করছে যার শিরোনাম, ‘ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিয়ে দুই মন্ত্রীর দুই কথা।’ তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি এ টাকা ফেরত দেয়া উচিত।’ বিডি নিউজের ওই সংবাদে আরও বলা হয়, ‘তার কিছুক্ষণের মধ্যে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার কর্মসূচীর জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে কোন টাকা বা অনুদান নেয়া হয়নি।’ এর মাত্র এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৭.৪৪ মিনিটে বিডি নিউজ ২৪ ডটকম আরেকটি নিউজ আপলোড করে, যার শিরোনাম ‘৩ কোটি টাকা দিয়েছি : ইসলামী ব্যাংক।’ ওই নিউজে বলা হয়, ‘ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান বিডি নিউজ ২৪ডটকমকে বলেন, ‘লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত আয়োজনের জন্য ১৪ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিন কোটি টাকা অনুদানের চেক তুলে দেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মুস্তফা আনোয়ার।’ ওই সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান আতাউর।’ ইসলামী ব্যাংকের এই দাবির পরে সংস্কৃতি মন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর কোন বক্তব্য পাইনি। 
তবে বিডি নিউজ ২৪ডটকমের ওই নিউজে একটি আপোসের আর্ট কিন্তু পাওয়া গেছে। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রী অনেক বড় আর্টিস্ট বরং তার তুলনায় মন্ত্রিত্ব তার জন্য অনেক ক্ষুদ্র। বাংলাদেশে অনেকেই সংস্কৃতি মন্ত্রী আগেও হয়েছেন পরেও হবেন। কিন্তু আর্টিস্ট আসাদুজ্জামান নূর একজনই। দেশবাসী মুগ্ধ হয়ে তার অভিনয় দেখেছে অতীতে। এখনও মঞ্চে নামলে দেখবে। 

এই বড় অভিনেতার যে বক্তব্যটি এসেছে সেটা কিন্তু বর্তমান সময়ের জন্য খুবই উপযোগী টনিক, যা খেলে আমাদের সকলের স্বাস্থ্য ভাল থাকতে পারে। তিনি ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা তো (ইসলামী ব্যাংক) আর বেআইনী ব্যাংক নয়।’ 

বাস্তবে এই আপোসের টনিকটি শুধু আজ নয়, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তো আর বেআইনী ছিলেন না, যে কারণে কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিংও তার সঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন। এ সব স্বেচ্ছাসেবী কাজে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন সব সময়ই ভাল তাই তারা সেদিন ভালই খাল কেটেছিল। আর সেই খাল দিয়ে যে সব কুমির এসেছে এই যেমন জামায়াতে ইসলামী- এরা তো বেআইনী নয়। আইন অনুয়ায়ী তো তারা রাজনীতি করছে। খালেদা জিয়ার বিএনপি, সেও তো বেআইনী নয়। আইন অনুযায়ী তারা রাজনীতি করছে। তাই জামায়াত- বিএনপি নরহত্যা, নারী হত্যা, শিশু হত্যা সর্বোপরি গণহত্যা করলেও তাদের সঙ্গে আপোস চলে। কারণ, তারা তো বেআইনী নয়। 

তবে এইটুকু সত্য মনে হয়- এখন মনে রাখার সময় এসেছে যে, ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ছিনতাই করার পরে অনেক কিছু আইনী কাঠামোর ভিতর ঢুকানো হয়েছে, যা কোনক্রমে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে না। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের উষ্ণতার সঙ্গে, সাড়ে ছয় লাখ মা-বোনের আব্রু হারানোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মানুষ জামায়াত-বিএনপির হাতে জীবন দিয়েও এই সরকারকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে কেউ যেন মনে না করেন মানুষ তাদের ক্ষমতায় পাঠায়নি। মানুষ তাদের পক্ষে ছিল বলেই কিন্তু নির্বাচনের পরের দিনই বিএনপি-জামায়াতের তা-ব ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। আর এই মানুষ স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ। এই মানুষ যারা গণজাগরণ মঞ্চে সারা দেশে এক হয়েছিল সেই মানুষ। 

তাই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে যারা তথাকথিত আইনী কাঠামোয় ঢুকে গেছে তাদেরকে ‘ওরা তো বেআইনী নয়’ বলে জায়েজ করা এই সরকারের দায়িত্ব নয়। সেটা বিএনপির দায়িত্ব। 

হ্যাঁ, এটা সত্য ইসলামী ব্যাংক এখনই বন্ধ করে দেয়া হয়ত সম্ভব নয়। কারণ, এর সঙ্গে বিদেশী অন্যান্য ব্যাংকের পুঁজি আছে। দেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তার মানে এই নয়, তারা জঙ্গী মদদ দেবে আবার জাতীয় সঙ্গীততে থাকবে। ঢুডুও খাবে তামাকও খাবে এটা হতে পারে না। জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানের যে টাকা সরকার নিয়েছে সেটা ফেরত দিয়ে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা স্বীকার করে এই ব্যাংকটি জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত। পাশাপাশি এই ব্যাংককে জঙ্গী ও জামায়াতমুক্ত করার ক্রাশ প্রোগ্রাম সরকারকে নিতে হবে। এর পরিচালনা বোর্ড থেকে সকল জামায়াত ও জঙ্গীদের বাদ দিতে হবে। এখানে চাকরি করে যারা জঙ্গী ও জামায়াতের সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচার করতে হবে। 

পাশাপাশি এই ব্যাংকের নিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে দিতে হবে। যাতে জঙ্গী সংগঠন শিবিরের ছেলেমেয়েরা এখানে ঢুকতে না পারে। এমনিভাবে চরম কঠোরতার ভেতর দিয়ে এই জঙ্গী অর্থায়নের উৎস বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থই সন্ত্রাসের লাইফ ব্লাড। অতএব এটা বন্ধ করতে হবেই। এখানে আপোসের আর্ট প্রয়োগ করার নীতি এই সরকারকে বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি যেমন জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হতে চলেছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তেমনি সন্ত্রাসী সংগঠনের অর্থ জোগানদাতা হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবিলম্বে তদন্ত শুরু করে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কারণ, দীর্ঘদিন যাবত তারা সন্ত্রাসে অর্থ জোগান দিয়ে আসছে। এখানে ‘টাকা আমারও দরকার জগৎ শেঠ’ এই নীতিতে শরীর ও মনপ্রাণ ডুবিয়ে আপোস করার সুযোগ নেই। সে আপোস যদি এই সরকার করতে যায় তাহলে সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবে। এবং বাংলাদেশের শেষ আশ্রয়স্থল শেখ হাসিনাকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে গত তিন মাসে বার বারই এ ধরনের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
swadeshroy@gmail.com

Monday, March 17, 2014

যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান!- সুমি খান

 ‘...এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?


যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান!


তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-


চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি!


/যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান-ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ


১৭ মার্চ – বিশ্বজয়ী কিংবদন্তী  রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৫ তম জন্মদিবস! রাষ্ট্রীয় নিয়মে দিনটি  শিশু দিবস। কিন্তু অনেক শিশুই জানেনা  দিনটির কথা। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোতে তো নয়ই, বাংলা মাধ্যম স্কুলে ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায় না। শিশুরা জানতেই পারে না , কার কারণে তারা বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে । 


 ২০০ বছরের ব্রিটিশ আর পাকিস্তান অপশাসনের গ্লানি মুছে বাঙ্গালীর আত্মপরিচয় ফিরে পাবার জন্যে যে মানুষটি কৈশোর থেকে সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন- তাঁর  প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তাঁর জন্মের  এ শুভক্ষণটি গৌরবের সাথে পালনে আমাদের দীনতার শেষ নেই!


 আমরা ভুলে যাই, বা ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি  বিশ্ব মানচিত্রে গর্বের সাথে ঠাঁই করে নেয়া ‘বাংলাদেশ ‘ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে আমাদের অনেক জানার আছে।  শেকড়ের খোঁজে যেতেই হবে একদিন। তাই আমাদের প্রজন্মান্তরে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা জরুরী!


বঙ্গবন্ধুর  রাজনীতি ছিল দেশমাতৃকা আর মানবতার কল্যাণে !! বর্তমান রাজনীতিকেরা নিজেদের যে পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন –তারা কখনো বিবেচনা করেন না- বঙ্গবন্ধু র জীবন এবং কর্মযজ্ঞ তাদের আদর্শের ভিত ।


সেই বিবেচনা বোধ নেই বলেই আজ নগরে বন্দরে রাজপথ আর গলিপথ নেতা কর্মীদের বিশাল বিশাল সব ছবির বিলবোর্ডে সয়লাব। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্মদিনে কেক কেটে পত্রিকা বা ফেসবুকে ছবি প্রচারের চেয়ে  তার যোগ্য অনুসারী হলে তাদের জীবনধারায় বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্কতা প্রতিষ্ঠা অনেক জরুরী।  


 গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে  মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুত্‍ফর রহমান আর মা মোসাম্মৎ সায়েরা বেগমের ঘরে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ  জন্ম নেন  তাদের প্রথম পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান  ।  ৪ বোন ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় মুজিবকে বাবা-মা বোনেরা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’৷ ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে গমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ।এরপর ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ।১০ বছর বয়সে বাবার কাছে মাদারীপুরে যান৷ সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাদারীপুরে থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। তার চোখে ছানি পড়ে ।  শেখ লুত্‍ফর রহমান কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিত্‍সক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করান মুজিবরের । এর পর থেকে সেই কৈশোরেই চোখে চশমা পরতে হয় মুজিবের। এরপর গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন ।এরপর ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । সেখানে সফল অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পরতে শুরু করেন।


১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন৷ পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়৷ অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুঁইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা৷ তা মেরামতের দাবি জানায় সে৷ প্রধানমন্ত্রী তত্‍ক্ষণাৎ তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে বারোশ’ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন । সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্‍সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন।  পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে  আলাপ করে মুগ্ধ হন। এই ছেলেটিই পরবর্তীকালের অগ্রপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু  সোহরাওয়ার্দীকে ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলে স্বীকার করতেন । শেরেবাংলা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন।


কিশোর মুজিবের ২ ঘন্টার কারাবাস


নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন মিশন স্কুলে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা ছিল।  ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন এসডিও । ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে  সেই সভা করে৷ শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক করে রাখা হয় মুজিবকে ।  মুজিবের মুক্তির দাবিতে অন্যান্য ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত মুজিব কে মুক্তি দেবার নির্দেশ দেন আদালত । মুজিবের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এই ছিল প্রথম গ্রেফতার ।


১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে  শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে৷ পরবর্তীকালে এ দম্পতি ৩ পুত্র ও ২ কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।


১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে(বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ)আইএ ক্লাসে ভর্তি হন৷ তখন থেকেই মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি৷ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন । ইসলামিয়া কলেজ থেকে ।১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন মুজিব। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী ।


১৯৪৩ সালে মুজিব সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি  সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন । ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্ব দেয়।


১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট  পাকিস্তান ও  ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ।  ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন । বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।  এই কারণে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ এরপর তাকে  গ্রেফতার করা হয়। তাঁর  আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত  করা হয় না।


১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি  কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব৷


১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হয়। একজন রাজবন্দী হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন৷ কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।


 ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।


 অক্টোবরে আর্মানিটোলা থেকে এক বিশাল ভুখামিছিল থেকে আবার  গ্রেফতার হলেন মুজিব। সাথে  মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক সহ অন্যেরা।


১৯৫২ সালে মুজিব কারাবন্দী।ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ উত্তাল।  ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ‘ভাষা দিবস’  ঘোষণা করা হয়।


 মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রনেতারা  গভীর রাতে  ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন । শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।




২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারের ভেতর একটানা অনশনে মুজিবের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হয় । পাকিস্তান আমলে রাজবন্দীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কারা কর্মকর্তাদের কঠিন সাজা হতো। শেখ মুজিবের শারীরিক অবনতি ঠেকাতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ কারা কর্তৃপক্ষ  মুক্তি দেয় । মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলিম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন ।


১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব।  ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।


দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন মুজিব।  তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক।  শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব  গভীর ভাবে অনুধাবন করতেন।  ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ নেন মুজিব। সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন।


 এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শেখ মুজিব  ১৯৬৩ সালে এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন।  ২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  


১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন । প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ।


 ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।  ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে  ৮ বার গ্রেফতার হন  জননেতা শেখ মুজিব।


এ সময় রাজনীতির মাঠ ভীষণ উত্তপ্ত । বাঙালির জন্যে নতুন আশার সঞ্চার করে ৬ দফা।  ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়৷ এর আগের ২০ মাস জেলে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ৷১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন।একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।


এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে৷ পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে৷ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ।


পাকিস্তান সরকার সরকার শেখ মুজিবকে  ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন ।শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা মুক্তি লাভ করেন।


১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন  ।পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এ ধরণের অন্যায় এবং অবাস্তব প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।


১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ‘বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয় ।দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।


আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ৷ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে । সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়৷।এই সেই দিন, যেদিন তিনি সেই  ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাতে ছিল দিক নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। ভায়েরা আমার,



আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।


তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।


আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।


কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।


টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।


ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।


গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!!

এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন। আলোচনার ছল করেন, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে।আলোচনা অসমাপ্ত রেখে গোপনে ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে৷ নিরীহ বাঙ্গালী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে গণহত্যার মতো বর্বরতম ঘটনা ঘটায়।


২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চীফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ড ও অন্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে৷ ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়৷ প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হয়৷


 বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড তাজউদ্দিন আহমেদ গোপনে ভারতে চলে যান৷ সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।  ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথতলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে।প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে৷ অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে ।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়৷ যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।


স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন৷ এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে।” দৈনিক পূর্বদেশের  শিরোনাম ছিল, “ভেঙ্গেছো দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময়, তোমারি হোক্ জয়!! ”


আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান  শেখ মুজিব। লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু নিয়ে জাতির জনককে বরণ করে নেয় !!


এবার তিনি হাত দেন দেশগঠনে।  মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন ।১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত প্রতিকূল এবং বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ এগিয়ে নিলেও তাকে বাঁচতে দেয়া হয় নি।


 যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে ।আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উত্‍পাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের হাতে রয়ে গেছে। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন করেন। একাত্তরের ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় এ  শুভ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়৷।এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্‍পরতায়,  দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।  কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ৷ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দূরত্ব বেড়ে যায়৷ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।


বাংলাদেশের  উন্নতি ঠেকাতে  ষড়যন্ত্র সফলে  প্রাণপণে নেমে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি।  নেতৃত্বে থাকে এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য৷ এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা  জানান।


এর জবাবে  বঙ্গবন্ধু  বলতেন-‘এরা আমার সন্তান, আমাকে কেউ কিছু করবে না।’ তাঁর স্বভাবসুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে ৷ তাঁর কাছে  ষড়যন্ত্রকারীদের নামে কোন গোয়েন্দা তথ্য পৌঁছানোর আগেই গায়েব করে দেয়া হতো।


১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল৷ রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কর্মকর্তা ও সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে। নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁর ৩ পুত্র, ২ পুত্রবধু, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে ! পরদিন তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং কোনরকম জানাজা না পড়িয়ে জাতির পিতাকে  তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়৷ একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়৷ ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ বাঙালি জাতি স্তম্ভিত- দিশেহারা হয়ে যায়৷   এ দেশের কুলাঙ্গার সন্তানদের হত্যার শিকার হয়েছেন জাতির জনক- এই পবিত্র মাটি অপবিত্র হয় জনকের পবিত্র রক্তে!!  এর চেয়ে লজ্জার , হতাশার কোন উদাহরণ বিশ্বে নেই ! !!


তবু সময় প্রমাণ করেছে  বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ-  তবে সেই পাইপ থেকে এড়িনমোরর’স তামাকের সুবাস নেই  - তার নির্দেশনা পাচ্ছে না দুর্ভাগা এ জাতি! তাই এই জাতি আজো বিভ্রান্ত- দিশেহারা!


প্রশ্ন আসে কারা ছিল জাতির পিতার হত্যাকারী?


বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি লে· কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশিদ  এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং কর্নেল (অবঃ) তাহের বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের গ্রামীণফোন তৃতীয় মাত্রায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিলুর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি কর্নেল (অবঃ) রশিদের একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। চ্যানেল আইয়ের সাথে উক্ত সাক্ষাতকারের বিস্তারিত-  জিলুর রহমান জানিয়েছেন, টানা পাঁচদিনে তিনি এ সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন। তবে পুরো সাক্ষাতকার প্রচারিত হয় নি।


এই সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধ, ভারত সম্পর্কে তার মনোভাব, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে বিতর্ক এমনকি জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে অকপটে খোলামেলা কথা বলেছেন কর্নেল (অবঃ) রশিদ। সাক্ষাতকারের কিছু বক্তব্য চ্যানেল আই সংবাদে প্রচারিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সাক্ষাতকারে কর্নেল (অবঃ) রশিদ বলেন,  “ ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে তৎকালীন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে ডেকে পাঠান। সেখানে কর্নেল তাহেরও ছিলেন। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অব·) রশিদ অকপটে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য তাকে সম্মানিত করা উচিত। কেউ কেউ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বললেও তিনি তা বলতে নারাজ। তিনি মনে করেন, রেডিওতে জিয়ার এক মিনিটের বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যায় তাদের মনোবল শক্ত করতে সাহস যোগায়। তার মানে এই নয়, তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। সে সময় শফিউল্লাহ সহ জিয়ার অনেক সিনিয়র আর্মি অফিসারও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবন-যাপন প্রসঙ্গে কর্নেল (অব·) রশিদ বলেন, ব্যক্তিস্বার্থে তিনি কিছু করেননি। তার বিশ্বাস মুসলমান হিসেবে সবকিছুর জন্য তিনি আলাহর কাছে দায়ী।


তিনি জানান, ১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর কুমিলার চান্দিনা থানায় তার জন্ম। শৈশবে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে বিয়ে করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল (অব·) ফারুক সম্পর্কে তার ভায়রা। ১৯৭৩ সালে তার শ্যালিকাকে ফারুক বিয়ে করেন। তার বাসভবনেই দু’জনের পরিচয় ও মন দেয়া-নেয়ার পর দু’পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে কর্নেল (অব·) রশিদ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কর্নেল (অব·) ফারুক তখন ডেপুটেশনে আবুধাবিতে ছিলেন। তিনি যোগ দেন ১২ ডিসেম্বর।


তার মতে, পরিস্থিতি যেদিকে গড়িয়েছিল তাতে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব মেজরিটি অর্জনের পর যখন পাকিস্তান  ক্ষমতা হস্তান্তর করল না তখন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে জনগণ ব্যাপক অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিব যতটুকু যাওয়ার ততটুকুই গেছেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব পরিস্কার বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ মার্চের ভাষণ তিনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে শুনেছেন। তিনি জনগণের আকাঙ্খা দেখে বুঝতে পেরেছেন, জনগণ প্রস্তুত। ৭ মার্চের ভাষণের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে পূর্ব পাকিস্তানি পিআর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।তিনি জানান, ওই সময় সেনাবাহিনীতে কনফেডারেশন নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতো। তিনিও মনে করতেন, কনফেডারেশন হলে মুসলমান দেশটির জন্য ভালো হয়। কর্নেল অলিসহ কেউ কেউ মনে করেন, ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৭ এপ্রিল সামরিক যুদ্ধ ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা এভাবে কথা বলেন সেটা আত্মপ্রচার ছাড়া কিছু নয়। তাদের দাবির কোন সত্যতা নেই।


কর্নেল রশিদ বলেন, যদি সার্ভিস হোল্ডার হিসেবে যুদ্ধের কথা বলেন তাহলে সেটা যুদ্ধ হয় না। সামরিক বাহিনীর ভেতর বিদ্রোহ হয়। কর্নেল অলি যদি মনে করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল না সেটা হবে তার ভুল ধারণা। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা তখনই হল, যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। ৭ মার্চের পর মুজিবকে আটক করা পর্যন্ত পাক আর্মি আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে লড়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ জিয়া দেননি, মুজিব দিয়েছেন। এসব বিবেচনা করলে, যারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে চায় তাদের বক্তব্য ঠিক নয়। শেখ মুজিবের যা পাওনা তা তাকে দেয়া উচিত। জিয়াকেও তার প্রাপ্য দেয়া উচিত।


কুমিলায় বাড়ি হলেও এবং নামের পদবি খন্দকার হলেও খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা নেই বলে জানান কর্নেল (অব·) রশিদ। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিল কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতের জন্য তখন অবশ্যই একটা সুযোগ এসেছিল এবং তা তারা নেবেই। পাক-ভারত যুদ্ধ বহুবার হয়েছে এবং ফাইনাল রেজাল্ট ছাড়াই শেষ হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই অনেকে ভারত চলে যায়। প্যারা-মিলিটারিতে যোগ দেয় এবং তারা সরকার গঠন করে। যে সরকার গঠন হয়, অবশ্যই জিয়া তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। সবাই পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ায় তাদের থাকা-খাওয়া সবই ভারতের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  এতো গুলো মানুষের বোঝা  সীমাহীন সময় ধরে বহনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা  কোন রাষ্ট্রের থাকে না। এ কারণে তারা জেতার আগ্রহ নিয়ে কাজ করে। তিনি একাত্তরে ভারতের সহযোগিতার জন্য ভারতকে  ধন্যবাদ জানান। তবে  একাত্তরে পাক আর্মির রেখে যাওয়া অনেক জিনিস ভারত নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে মানুষ মাত্রই ভুল করে। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে যদি কেউ আবারও ইস্যু করে তা ঠিক হবে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করেন। এসব বাদ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পর কি জাতীয় সরকার গঠন ভালো হতো না? এই প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অব·) রশিদ বলেন, ’৭০-এর জয়লাভের কারণে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন সঠিক ছিল। ’৭২-এর সংবিধান ছিল গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনায় কর্নেল তাহেরের সংশিষ্টতা সম্পর্কে কর্নেল রশিদের মন্তব্যকে ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তাহেরের রাজনৈতিক ভাবধারার অনুসারী ও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু। ৬ নভেম্বর ,২০০৭ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইনু বলেন, রশিদ ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা নিজেরাই বহুবার এ হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আটক রয়েছেন তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। আদালত তাদের বক্তব্য শুনেছেন। এ মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কখনোই কর্নেল তাহেরের সংশিষ্টতা দাবি করেননি। তিনি বলেন, যারা বিদেশে পলাতক তারাও এ ব্যাপারে গত ৩০ বছরে একটি কথাও বলেননি। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট একটা দাবি। ইনু বলেন, আসামিরা বুঝতে পারছে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি সংকুচিত হয়ে আসছে। এ কারণেই তারা সবার মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এসব বিভ্রান্তিমূলক কথা বলছেন। কর্নেল রশিদ তার সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও কর্নেল (অব·) তাহেরের বৈঠক হয়েছিল বলে যে দাবি করেছেন ইনু তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। তবে টেলিফোনে কথাবার্তা হতো। ক্রমশঃ

Sunday, March 16, 2014

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসি- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সব হারিয়েছেন যিনি






দেশ স্বাধীন করার জন্যে গুরুদাসী মাসির যে আত্মদান -তা কেউ মনে রাখেনি।নিজের চোখের সামনে স্বামী,সন্তানের মৃত্যু ও নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী ততক্ষনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।


১৯৭১ সাল,মুক্তিকামী মানুষের উপর চলছে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতন।
তাদের পাশবিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা শিশু,বৃদ্ধা সহ মহিলারা।
এমনই একদিনে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাক বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় হামলা চালায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে।

ফুলবাড়ি গ্রামের গুরুপদ মন্ডল,পেশায় একজন দর্জি।২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী গুরুদাসী মাসিকে নিয়ে তার সংসার।স্থানীয় রাজাকারের ইন্ধনে পাক বাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়।

একে একে বাড়ির লোকজনরে উঠোনে এনে জড়ো করা হয়।
গুরুদাসী মাসির উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের।  স্ত্রীকে বাঁচাতে গেলে গুরুদাসীর সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় স্বামী,২ ছেলে ও ১ মেয়েকে।এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকন্যাটিকেও কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাশে কাদা পানির ভিতরে।তারপর তার উপর চলে পাক সেনাদের পাশবিক নির্যাতন।পাক সেনারা চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। দেশ স্বাধীনের গুরুদাসীর খবর কেউ রাখেনি। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষে করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান।