Saturday, March 22, 2014

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিন - ড. মো.আনোয়ার হোসেন

মার্চ মাস নানা কারণেই এদেশের মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আপামর দেশবাসী এক সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তারই হাত ধরে এসেছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর অমর ভাষণ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে জাতিকে দ্বিধাহীন চিত্তে জীবনপাত করতে চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

তারপর এসেছে ২৫ মার্চের কালরাত। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির অদম্য বাসনাকে হত্যা করতে ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের ‘অপারেশন সার্চ লাইট।’ ইতিহাসের নৃসংশতম গণহত্যা। সেই কালরাতের অব্যবহিত পরই এ ভূখন্ডের  মানুষের হাজার বছরের পূর্ব ইতিহাস এবং সামনের অনাগত কালের মহত্তম দিন ২৬ মার্চ এসেছে। বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

আরও একটি মহৎ দিন আছে এই মার্চ মাসে। ১৭ মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। আবার এই মার্চেই জাতীয় প্যারেড গ্রাউডে ৪৩তম স্বাধীনতা দিবসে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ গাইবে দেশবাসী। এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার রেকর্ড সৃষ্টি শুধু নয়, ’৭১-এর পরাজিত যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা আজও যাদের আছে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শুভক্ষণ রচিত হবে ২৬ মার্চে। এখন এই মার্চ মাসেই বাংলাদেশ আয়োজন করছে টি২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপ।

কি অপার দুঃখ, কি অসহ্য বেদনা, অপমান ও পরিতাপের কথা এই মার্চ, এই স্বাধীনতা দিবস, এই জাতীয় সঙ্গীত, অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই ক্ষণ আমাদের মহত্তম সব অর্জন ও অহঙ্কারকে চরম উপহাস করতে, মলিন করতে, প্রশ্নবিদ্ধ করতে তিন কোটি টাকার ভিক্ষা পাত্র নিয়ে এসেছে ইসলামী ব্যাংক। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, এই অর্থ প্রত্যাখ্যান করা হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেছেন, অর্থ নেয়া হয়নি। ইসলামী ব্যাংক ঔদ্ধত্যভরে সে কথার জবাব দিয়েছে। ২৬ মার্চে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার অনুষ্ঠানে তাদের অর্থায়নের কথা তারা প্রচার করেছে। উদীচী, গণজাগরণ মঞ্চ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা এই অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যয় হলে অনুষ্ঠানটি বয়কট করা হবে। তাদের এই দাবি কোনভাবেই অন্যায্য নয়। এটা আমাদের সবার প্রাণের দাবি। অতীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের দিয়ে আমাদের নানাভাবে অপমান করেছে। রাষ্ট্র প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার, অর্থ ব্যবস্থা, সামাজিক সংগঠন সর্বত্র তাদের পুনর্বাসন করেছে। কিন্তু এখন ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে শুধু নয়, ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। আর এই সময়ে, এই গৌরবময় মার্চ মাসেই কিনা আমাদের এই অপমান!

বঙ্গবন্ধু কন্যা দুঃসময়ের কান্ডারী। গভীর অমানিশায় আমাদের আশার প্রদীপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত নিবেদন ২৫ মার্চের মধ্যেই একটি পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে ভারমুক্ত করুন। চূড়ান্ত অপমানের হাত থেকে রক্ষা করুন। ঐ ভিক্ষামুষ্টি ফিরিয়ে দিন। 

জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের সংযোগের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। মনে পড়ছে, এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পর্যন্ত সংসদে এই ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক জঙ্গী অর্থায়নের কথা প্রকাশ করেছিলেন। গণজাগরণের এক অন্যতম সেøাগান ছিল ‘ই’ তে ইসলামী ব্যাংক- নিষিদ্ধ কর। আমরা ক্ষুব্ধ ও আশাহত হয়েছিলাম যখন মহাজোট সরকারের আমলে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনে অর্থায়ন ও প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ইসলামী ব্যাংককে। তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সে প্রতিবাদের ভাষা ও মর্মবাণী পড়তে পারেননি লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার আয়োজক নীতিনির্ধারকরা। তাই দ্বিতীয়বারের মতো এই মার্চ মাসে কোটি কোটি মানুষের গালে চপেটাঘাত। আমরা তা গ্রহণ করতে পারি না। গভীর পরিতাপের কথা এই নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রয়েছে। কোন্ বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইসলামী ব্যাংকের ভিক্ষামুষ্টি নিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার আয়োজনের কথা ভাবছে। 

বাংলাদেশের বহু ব্যাংক অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে এই আয়োজনকে সফল করতে। ইসলামী ব্যাংকের তিন কোটি টাকা ছাড়া এই আয়োজন সফল হবে না তাও কি আমাদের মানতে হবে? সেনাবাহিনীতে গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারের আনুকূল্যে। আমরা দেখেছি গোলাম আযমের বিচার কাজ চলাকালে ঐ নরাধম পুত্রের ঔদ্ধত্য। কোন অনুশোচনা, পিতার পাপের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান সে নেয়নি। এখন সে অবস্থা নেই। জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত ইসলামী ব্যাংকের পয়সা জাতীয় সঙ্গীত গাইবার এমন মহৎ অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যয় হতে কেন দেবে সেনাবাহিনী?

২০১৩ সালের মার্চ মাসে আমার জীবনের একটি মহৎ ক্ষণ উপস্থিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অমর ভাষণের ওপর স্মারক বক্তৃতা প্রদানের বিরল সম্মান দেয়া হয়েছিল আমাকে। ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ’ শিরোনামের স্মারক বক্তৃতাটি লিখে ফেলি। ওসমানী মিলনায়তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বক্তৃতা প্রদানের পূর্বেই আমার অনুরোধে তিনি আমাকে মূল্যবান সময় দিয়েছিলেন। খসড়া ভাষণটি তাঁকে শুনিয়েছিলাম। জাতির জনকের ৭ই মার্চের অমর ভাষণের মর্মবাণীর সঙ্গে শাহবাগে নতুন প্রজন্মের জাতীয় পুনর্জাগরণের সেতুবন্ধন রচনা ছিল ঐ স্মারক বক্তৃতার মূল উপজীব্য। বঙ্গবন্ধু কন্যার নজর তা এড়ায়নি। পরবর্তী সময়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খার  প্রতিফলন আমরা দেখেছি। আমি নিশ্চিত জানি আগামী ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে নতুন প্রজন্ম যেভাবে অপমানিত বোধ করছে, এখনও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারবর্গ ইসলামী ব্যাংকের অর্থ প্রত্যাখ্যান করার যে প্রবল আকুতি জানাচ্ছে তাকে পূর্ণসম্মান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি জানাবেন। ২৬ মার্চের পূর্বেই এই প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা এবং জঙ্গী-জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নেয়ার ঘোষণাটি আপনার কাছ থেকে আমরা চাই।


আমরা চাই নবীন-প্রবীণ-শিশু, পরিবার-পরিজন সবাই মিলে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। আমাদের চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলার’ অমৃতগাঁথা এক মহান সুর লহড়ীর সৃষ্টি করবে। অনুরণিত করবে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীকে। সেই আত্মমর্যাদাবোধ, মানবিক আবেগ, ভালবাসা ক্ষমার অযোগ্য নিকৃষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের অর্থ সাম্রাজ্যের প্রতিভু ইসলামী ব্যাংকের কাছে নতজানু হতে দেবেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment