সমাজ প্রগতির সংগ্রামে নিবেদিত প্রতিটি মানুষের প্রতি এ অন্ধ মৃত সমাজের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা-অন্ধকারের শক্তির মুখোশ উন্মোচন করে দৃষ্টির ভেতরে বাইরে প্রতিটি সর্বনাশ ঠেকানোর মানবিক প্রয়াস মাত্র!
Sunday, January 8, 2017
মা, তুমি কেমন আছ?- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মা, তুমি কেমন আছ?
আমার পোষা বেড়াল খুনচু
সে কেমন আছে?
সে রাত্তিরে কার
পাশে শোয়?
দুপুরে যেন আলি সাহেবদের
বাগানে না যায়।
মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?
তুলি কে আমার
ডুরে শাড়িটা পর়তে বোলো।
আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই
করে নেয়।
তুলি কে কত মেরেছি! আর
কোনদিন মারবো না।
আমি ভালো আছি। আমার জন্য
চিন্তা কোরো না
মা, তোমাদের ঘরের
চালে নতুন খর দিয়েছো?
এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব
তরফদার বাবুদের
পুকুরটা কি ভেসে গেছে?
কালু-ভুলুরা মাছ
পেয়েছে কিছু?
একবার মেঘের ডাক
শুনে কৈ মাছ উঠে এসেছিল
ডাঙায়
আমি আম গাছ তলায়
দুটো কৈ মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা?
মনে আছে আলি সাহেবের
বাগানের সেই নারকোল?
চুরি করে আনিনি!
মাটিতে পড়েছিল, কেউ
দেখেনি
নারকোল বড়ার সে স্বাদ
এখনো মুখে লেগে আছে।
আলি সাহেবের ভাই মিজান
আমাকে খুব আদর করতো।
বাবা একদিন
দেখতে পেয়ে চেলা কাঠ
দিয়ে
পিটিয়েছিল আমাকে।
আমার
কি দোষ,
কেউ আদর
করলে আমি না বলতে পারি?
আমার পিঠে এখনো সে দাগ
আছে।
আলি সাহেবদের বাগানে আর
কোনদিন যাইনি।
আমি আর কোনো বাগানেই
যাই না
সেই দাগটায় হাত
বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে।
বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়
আমি ভালো আছি, খুব
ভালো আছি
বাবা যেনো আমার জন্য একটুও
না ভাবে।
তুলি কি এখনো ভুতের ভয় পায়,
মা?
তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলাবউ
দেখেছিলাম
সেই থেকে তুলির ফিটের
ব্যারাম শুরু হলো
দাদা সেই
কলা গাছটা কেটে ফেললো
আমি কিন্তু ভয় পাই নি,
তুলি কে কত খেপিয়েছি......
আমার আবার মাঝরাত্রে
সেই কলা বউ
দেখতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, ভালো কথা,
দাদা কোনো কাজ
পেয়েছে?
নকুলবাবু যে বলেছিল,
বহরমপুরে নিয়ে যাবে
দাদাকে বোলো আমি ওর
উপরে রাগ করিনি
রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড়
কষ্ট
আমার শরীরে আর রাগ নেই,
আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না
মা, আমি রোজ দোকানের
খাবার খাই, পটল ভাজাও খাই
হোটেলে কিন্তু কখনো শাক
রান্না হয় না|
পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি
তুলে আনতাম কলমি শাক
কি ভালো, কি ভালো,
বিনা পয়সায়
কোনোদিন আর কলমি শাক
আমার ভাগ্যে জুটবে না|
জোর হাওয়া দিলে তাল
গাছের পাতা শরশর করে
ঠিক বৃষ্টির মত শব্দ হয়।
এই ভাদ্দর মাসে তাল
পাকে ডিব ডিব করে তাল
পড়ে।
বাড়ির তাল গাছ
দুটো আছে তো?
কালু তালের বড়া বড়
ভালবাসে, একদিন
বানিয়ে দিও
তেলের খুব দাম জানি! তবু
একদিন দিও
আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ-
হাজার টাকা পেয়েছিলে
তা দিয়ে একটা গরু
কেনা হয়েছে তো?
সেই গরুটা ভালো দুধ দেয়?
আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও
অনেক ভালো
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের
সুসার হয়
গরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ
হয়!
বাড়িতে কন্যা সন্তান
থাকলে কত জ্বালা!
দু'বেলা ভাত দাও রে,
শাড়ি দাও রে,
বিয়ের জোগাড় করো রে-
হাবলু, মিজান, শ্রীধর দের
থাবা থেকে
মেয়েকে বাঁচাও রে।
আমি কি বুঝি না? সব বুঝি|
কেন আমায়
বিক্রি করে দিলে তাও
তো বুঝি
সে জন্যই তো আমার
কোনো রাগ নেই, অভিমান
নেই।
আমি তো ভালোই আছি,
খেয়ে পরে আছি।
তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর
সারিয়ে নিও ঠিকঠাক।
কালু-ভুলু কে ইস্কুলে পাঠিও|
তুলিকে ব্রজেন ডাক্তারের
ওষুধ খাইও।
তুমি একটা শাড়ি কিনো,
বাবার জন্য একটা ধুতি
দাদার একটা ঘড়ির সখ,
তা কি ও টাকায় কুলোবে?
আমি কিছু টাকা জমিয়েছি,
সোনার দুল গড়িয়েছি।
একদিন কি হলো জানো মা?
আকাশে খুব মেঘ জমে ছিল,
দিনের বেলায়
ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
মনটা হঠাত কেমন কেমন
করে উঠলো-
দুপুরবেলা চুপি চুপি বেরিয়ে
ট্রেনে চেপে বসলাম
স্টেশনে নেমে দেখি একটা
মাত্র সাইকেল রিক্শা!
খুব ইচ্ছে হলো একবার
বাড়িটা দেখে আসি।
রথতলার মোড়ে আসতেই
কারা যেন চেঁচিয়ে উঠলো-
কে যায়? কে যায়?
দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা-
আমাকে বললো, হারামজাদী,
কেন ফিরে এসেছিস?
আমি ভয় পেয়ে বললাম,
ফিরে আসিনি গো, থাকতেও
আসিনি
একবার শুধু দেখতে এসেছি
হাবুল বলল,
এটা একটা বেবুশ্যে মাগী
কী করে জানলো বলো তো
তা কি আমার
গায়ে লেখা আছে?
আর একটা ছেলে, চিনি না,
বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের
বদনাম!
হাবুল রিকশাওয়ালা কে চোখ
রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা
আমি বললাম, দাদা,
আমি মায়ের জন্য
ক’টা টাকা এনেছি
আর তুলির জন্য...
দাদা টেনে একটা চড়
কষালো আমার গালে।
আমাকে বিক্রির টাকা হকের
টাকা
আর আমার রোজগারের
টাকা নোংরা টাকা
দাদা সেই পাপের
টাকা ছোঁবে না,
ছিনিয়ে নিল শ্রীধর
আমাকে ও দূর দূর
করে তাড়িয়ে দিল।
আমি তবু দাদার ওপর রাগ
করিনি
দাদা তো ঠিকই করেছে,
আমি তো আর দাদার বোন নই,
তোমার মেয়ে নই, তুলির
দিদি নই
আমার
টাকা নিলে তোমাদের
সংসারের অকল্যাণ হবে
না, না আমি চাই
তোমরা সবাই ভালো থাকো
গরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ
দুটো ভালো থাকুক
পুকুরে মাছ হোক, ক্ষেতে ধান
হোক,
ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক
আর কোনোদিন ঐ গ্রাম
অপবিত্র করতে যাবো না
আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল
রঙের মশারি,
দোরগোড়ায় পাপোশ আছে,
দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি
আলমারি ভর্তি কাচের
গেলাস।
বনবন করে পাখা ঘোরে।
সাবান মেখে রোজ চান করি
এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত
ঘেউ ঘেউ করে
তাহলেই বুঝছো, কেমন
আরামে আছি আমি?
আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু
তুমি আমার মা
তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে
আমি আর মা পাবো কোথায়?
সেইজন্যই
তোমাকে চিঠি লিখছি, মা
তোমার কাছে একটা খুব
অনুরোধ আছে
তুলিকে একটু যত্ন করো, ও
বেচারি বড় দুর্বল।
যতই অভাব হোক, তবু
তুলিকে তোমরা...
তোমার পায়ে পড়ি মা,
তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো,
তুলিকেও যেন আমার মতন 'আরামের জীবনে' না পাঠায়
যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিও|
ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার,
একজন নিজের মানুষ।
আর যদি কোনোরকমই ওর
বিয়ে দিতে না পারো?
ওকে বলো গলায়
দড়ি দিয়ে মরতে
মরলে ও বেঁচে যাবে......
যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে-স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত
দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
আমার দিকে ও মুখ ফিরাও ।
কাছ থেকে চিনতে নারি, কোন্ দিকে যে কী নেহারি,
তুমি আমার হৃদ্বিহারী হৃদয়-পানে হাসিয়া চাও।
বলো আমায় বলো কথা, গায়ে আমার পরশ করো।
দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় তুমি তুলে ধরো।
যা বুঝি সব ভুল বুজি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে-
হাসি মিছে, কান্না মিছে-সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।-
।
আমার দিকে ও মুখ ফিরাও ।
কাছ থেকে চিনতে নারি, কোন্ দিকে যে কী নেহারি,
তুমি আমার হৃদ্বিহারী হৃদয়-পানে হাসিয়া চাও।
বলো আমায় বলো কথা, গায়ে আমার পরশ করো।
দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় তুমি তুলে ধরো।
যা বুঝি সব ভুল বুজি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে-
হাসি মিছে, কান্না মিছে-সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।-
।
Subscribe to:
Posts (Atom)