Sunday, November 15, 2015

আরও সুসংহত ও সুস্থির অর্থনীতির প্রত্যাশায়-ড. আতিউর রহমান


জানুয়ারী ১, ২০১৫
বছরের শেষ দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের অর্থনীতির একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। সংক্ষিপ্ত বলে তাতে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়নি। তাই এই কলামে আরও সুবিস্তারিতভাবে গেল বছরের অর্থনৈতিক চালচিত্র এবং আগামী বছরের সম্ভাবনার কথা বলতে চাই।

২০১৩ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে। সে বছরের প্রায় পুরো সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ জন্যে ২০১৪এর বড় অংশ জুড়ে মন্থর বিনিয়োগ ছিল আলোচিত বিষয়। এসব কারণে বছরের শুরুতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রশ্নে কিছুটা অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করা যায়। অর্থনীতির সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বাস্তবসম্মত নানা ধরনের বিনিয়োগবান্ধব পদক্ষেপ। তবে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক সুস্থিতির প্রভাবে বছর শেষে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতির সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বাস্তবসম্মত বিনিয়োগবান্ধব পদক্ষেপ

অর্থনীতির সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বাস্তবসম্মত বিনিয়োগবান্ধব পদক্ষেপ

আর্থিক খাতের অধিকাংশ সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও সব মিলিয়ে ২০১৪ সাল ছিল মিশ্র ফলাফলের বছর। সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালেও বাংলাদেশ ব্যাংক বিচক্ষণ মুদ্রানীতি গ্রহণ করে।

পাশাপাশি অব্যাহত থাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রম। ফলে প্রবৃদ্ধির ভিত্তিভূমি হয় প্রসারিত– যা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য। জনগোষ্ঠীর সবাইকে জাতীয় উৎপাদনে সম্পৃক্ত করা এবং দরিদ্রের আর্থিক ক্ষমতায়নই হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য। অর্থনীতি এর সুফল ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে। গেল বছরের শেষ দিকে বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির ধারা জোরালোভাবে ফিরে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এসেছে নব উদ্যম। ভোক্তা ও ব্যবসায়িক আস্থায় এসেছে নতুন গতি। তার ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ লেগেছে আমদানি ও রপ্তানিতে। বেড়েছে রেমিট্যান্স। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড।

আরও লক্ষ্যণীয় ছিল ঋণের সুদের হার ও মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি। যদিও এই নিম্নগতি ছিল ধীর, তবু ক্রমাগত মূল্যহ্রাস ভোগ ও বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহে যথেষ্ট সতর্ক অবস্থানে ছিল বলেই প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সন্তোষজনক সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। জীবনের আয়ুষ্কাল, দারিদ্র্যের হার, মাথাপিছু আয়, প্রকৃত মজুরির মতো অনেক সূচকেই চোখে পড়েছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

সামষ্টিক অর্থনীতি

অর্থবছর ২০০৯-এ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫.১৪ শতাংশ, সেখানে অর্থবছর ২০১৪-এ ৬.১২ শতাংশসহ গত পাঁচ অর্থবছরে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.১৪ শতাংশ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় থাকলে ২০১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশ ওপরে থাকবে বলে আশা করা যায়।
জনগোষ্ঠীর সবাইকে জাতীয় উৎপাদনে সম্পৃক্ত করা ও দরিদ্রের আর্থিক ক্ষমতায়নই অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য

জনগোষ্ঠীর সবাইকে জাতীয় উৎপাদনে সম্পৃক্ত করা ও দরিদ্রের আর্থিক ক্ষমতায়নই অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য

মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। জুন ২০১৩ শেষে গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৭ শতাংশ, সেখানে জুন ২০১৪ শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৭.৪ শতাংশ। আর নভেম্বর ২০১৪ শেষে আরও কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭.১ শতাংশ।

অর্থবছর ২০০৯-এ মোট আমদানি ব্যয় হয়েছিল প্রায় তেইশ বিলিয়ন ডলার। সেখানে গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় সাঁইত্রিশ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে আমদানি বৃদ্ধির হার দশ ভাগের ওপর থাকবে বলে ধারণা করা যায়। বছরের শেষভাগে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন উপকরণাদি আমদানির ঊর্ধ্বমুখী ধারা সামনের মাসগুলোতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি জোরদার করার শক্ত পাটাতন তৈরি করছে। হালে এলসি খোলা ও এলসি মেটানো দুই-ই বাড়ছে। চলতি হিসাবে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিলেও তা একটি উদীয়মান অর্থনীতির জন্যে স্বাভাবিক।

অর্থবছর ২০০৯-এ মোট রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ষোল বিলিয়ন ডলার। সেখানে গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ত্রিশ বিলিয়ন ডলার। তবে রপ্তানি বৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরে খানিকটা মৃদু হবে বলে অনুমান করা যায়। মন্দা-পরবর্তী ইউরোপ ও আমেরিকার দুর্বল চাহিদা এর মূল কারণ।
২০১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশ ওপরে থাকবে বলে আশা করা যায়

২০১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশ ওপরে থাকবে বলে আশা করা যায়

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিও বেশ লক্ষ্যণীয়। অর্থবছর ২০০৯-এ রেমিট্যান্স এসেছিল দশ বিলিয়ন ডলার। সেখানে গত অর্থবছরে এসেছে চৌদ্দ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ অর্থবছর এ সময়ে রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। ২০১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও দশ শতাংশের ওপর থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ার প্রভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বেড়ে চলেছে। দেশের তেতাল্লিশ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এই মজুদ বাইশ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে– যা দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

টাকার মূল্যমান এ বছরও স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল। ২০১৪এর ডিসেম্বরের শেষে বিনিময় হার ছিল ডলার প্রতি প্রায় আটাত্তর টাকা।

জনগণের প্রকৃত আয় বাড়ায় গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৯০ ডলার। গত ছয় বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। একজন শ্রমজীবী এখন একদিনের মজুরি দিয়ে ১০-১১ কেজি চাল কিনতে পারে। ছয় বছর আগেও বড়জোর তিন কেজি কিনতে পারত। তিন কেজি চাল হলেই তাদের দিন চলে যায়। ফলে বর্তমানে বাকি অর্থ দিয়ে তারা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে। সামগ্রিকভাবে বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মান।

ব্যাংকিং খাত

গত পাঁচ বছরে ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি বড় অংশ মূলধনে স্থানান্তর হবার কারণে ব্যাংকিং খাতের মূলধন-ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর ২০১৪ প্রান্তিকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের প্রায় এগার শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ শেষে ব্যাংকগুলোর সংরক্ষিত মূলধন ছিল একুশ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর ২০১৪ শেষে দাঁড়ায় পঁয়ষট্টি হাজার কোটি টাকা।
টাকার মূল্যমান এ বছরও স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল

টাকার মূল্যমান এ বছরও স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল

২০০৮ সালে ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ১০.৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর ২০১৪ প্রান্তিকে শ্রেণীকৃত ঋণের হার দাঁড়ায় ১১.৬ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২.৭৯ শতাংশ। ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিংয়ের নীতিমালা বিশ্বমানে উন্নীত করা, গুণমানের ঋণ প্রদান ও ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার প্রভাবে শ্রেণিকৃত ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে আরও মনোযোগী হতে ক্রমাগত নির্দেশ দেওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী নীতি প্রণয়নের কারণে ২০১৪এর শেষ প্রান্তিকে শ্রেণিকৃত ঋণের হার কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকেও বেশ খানিকটা চাপ নিতে হচ্ছে। এ দিকটায় বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো রকম ছাড় দেবে না। অবশ্যই ব্যাংকগুলোকে সর্বক্ষণ গুণমানের ঋণ দেবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নিয়ম-নীতি সংস্কার করে হয়তো ভালো গ্রাহকদের কিছুটা সুবিধা দেওয়া হতে পারে। কিন্তু মন্দ গ্রাহকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে দ্বিধা করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থায়ন সুলভ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহারও ধীরে ধীরে কমে আসছে। অক্টোবর ২০১৪ শেষে ঋণের গড় সুদহার ছিল সাড়ে বার শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ কম। আমানতের সুদহারের চেয়ে ঋণের সুদহার অধিকমাত্রায় কমায় আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড কমে অক্টোবর ২০১৪ শেষে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্ট।

অক্টোবর ২০১৪ শেষে বেসরকারি খাতে প্রকৃত ঋণপ্রবাহ বেড়েছে বার শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এগার শতাংশ। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বৈদেশিক উৎস থেকে আসা বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ২০১৪তে বৈদেশিক ঋণ অনুমোদন করা হয় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫৬ শতাংশ বেশি।

অক্টোবর ২০১৪ শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য (ট্রেজারি বিল, বন্ডে বিনিয়োগসহ) ছিল প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অলস তারল্য ছিল মাত্র তিন হাজার তিনশ কোটি টাকা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে তারল্য চাপ কিছুটা বেড়েছে। ফলে পুরো বছর কলমানি সুদের হার কম থাকলেও বছরের শেষ দিকে কলমানি সুদের হার কিছুটা বেড়েছে।

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ কলমানি সুদের গড় হার ছিল ৮.৩ শতাংশ। অক্টোবর ২০১৪এর শেষে আমানত ১৩ শতাংশ বেড়ে ৬ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা জিডিপি’র প্রায় ষাট ভাগ। এটি ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থার পরিচায়ক।
একজন শ্রমজীবী এখন একদিনের মজুরি দিয়ে ১০-১১ কেজি চাল কিনতে পারে

একজন শ্রমজীবী এখন একদিনের মজুরি দিয়ে ১০-১১ কেজি চাল কিনতে পারে

সরকার এখন ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে কম হারে ঋণ নিচ্ছে যা রাজস্ব ক্ষমতায়নের প্রতিফলক। অক্টোবর ২০১৪ শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারি খাতে প্রকৃত ঋণ বেড়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল সতের শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২,৮০৯ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চুয়াল্লিশ শতাংশ বেশি।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি

বাংলাদেশ ব্যাংক গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৪তেও সামাজিক দায়বোধ প্রণোদিত অর্থায়ন বিশেষ করে কৃষি, এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন বাড়ানোর কৌশল অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি গ্রহণ করে নিম্নআয়ের মানুষদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম। এর ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে. যা প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।

২০১৪এর সেপ্টেম্বর শেষে দেশে মোট ব্যাংক শাখার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮,৮৪৯টি, যার সাতান্ন ভাগই পল্লী শাখা। গত পাঁচ বছরে ব্যাংক শাখা বেড়েছে প্রায় সতের শতাংশ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় কৃষকদের ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফল ভোগকারী হতদরিদ্র মানুষ, অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, গার্মেন্টস শ্রমিক সব মিলে এসব ব্যাংক হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১.৪৩ কোটি, যার প্রায় সত্তর ভাগ হিসাবই কৃষকদের।

এ বছর ভাগ্যবিড়ম্বিত কর্মজীবী পথশিশুদের নামেও ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষক ও অসহায় মানুষদের ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব সচল রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করে। ৩১টি ব্যাংক এ তহবিলের সুবিধা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ‘স্কুল ব্যাংকিং’ এর আওতায় স্কুল ছাত্রছাত্রী ব্যাংক হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় আট লাখ এবং এসব হিসাবে জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১২ কোটি টাকা।

অর্থবছর ২০০৯-এ কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছিল নয় হাজার তিনশ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ষোল হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষিঋণ বছরে গড়ে প্রায় ১২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আগে বর্গাচাষিরা ব্যাংক ঋণ পেত না। এ উপেক্ষিত বর্গাচাষিদের সহজ শর্তে কৃষিঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে ৫০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় গত পাঁচ বছরে ৯ লাখ ৩৮ হাজার বর্গাচাষিকে দেড় হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে।
ভাগ্যবিড়ম্বিত কর্মজীবী পথশিশুদের নামেও ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে

ভাগ্যবিড়ম্বিত কর্মজীবী পথশিশুদের নামেও ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে

নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই খাতে অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত বাইশ লাখ উদ্যোক্তাকে তিন লাখ চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকা এসএমই ঋণ দিয়েছে– যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তা পাঁচ শতাংশ। নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে এ বছর ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এসএমই খাতের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখে বানানো হয়েছে ‘নারী উদ্যোক্তা তহবিল’।

এসএমই খাতে গত পাঁচ বছরে দেশে আড়াই লাখের বেশি নতুন উদ্যোক্তাকে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে এ খাতে আমরা পেয়েছি পনের লাখের মতো নতুন কর্মসংস্থান।

কম খরচে ও দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছে টাকা পাঠানোর জন্যে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঘটেছে এক বিপ্লব। মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব দ্বিগুণ বেড়ে ২০১৪ এর নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ। উনিশটি ব্যাংক ৫ লাখ ১৯ হাজার এজেন্টের মাধ্যমে এ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শহরের কর্মজীবী মানুষ মোবাইলের মাধ্যমে গ্রামে তাদের পরিবার-পরিজনদের কাছে টাকা পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গড়ে প্রতিদিন তিনশ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বছর ‘অ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন পলিসি পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছে।

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থবছর ২০১০-এ প্রথম ‘গ্রিন ব্যাংকিং’ ধারণা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়নযোগ্য খাতে ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল চালু করে। এ তহবিল থেকে নভেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ১৬৪ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপনে এডিবি’র অর্থায়নে ৪০০ কোটি টাকার আরেকটি তহবিল গঠন করা হয়।

দেশের আনাচে কানাচে ব্যাংকের অনুরূপ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে ২০১৪তে ‘এজেন্ট ব্যাংকিং’ নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ৫টি ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
কৃষিঋণ বছরে গড়ে প্রায় ১২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে

কৃষিঋণ বছরে গড়ে প্রায় ১২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে

বাংলাদেশ ব্যাংক সিএসআর কর্মকাণ্ডে (সামাজিক দায়বদ্ধতা) সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সিএসআর খাতে ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলোর ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি টাকা, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে আটগুণ বেড়ে তা ৪৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালায় সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা ও ২০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে। সিএসআর ব্যয়ের নামে কোনো ব্যাংক জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক গত অর্থবছরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করে।

প্রযুক্তি প্রসারণ ও বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সহজীকরণ

সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেকে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও করেছে ডিজিটাইজড। বর্তমানে প্রায় নব্বই শতাংশ ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। অনলাইন সিআইবি সেবা, অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ ও ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক চালুর পর ব্যাংকিং লেনদেনে গতি বাড়াতে ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)’ সিস্টেম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।

ই-ব্যাংকিং ও ই-কমার্স প্রসারেও সহযোগিতা করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ভেতরে দুই হাজারেরও বেশি ই-কমার্স ঠিকানা কাজ করছে। অনলাইন কেনাকাটার দ্রুত প্রসারে অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। বিদেশে ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয়, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যবসায়িক প্রয়োজন ইত্যাদির জন্য পূর্বানুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতা প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন বিদেশি নাগরিক ও অনিবাসী বাংলাদেশিরা অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোতে সহজেই বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খুলতে ও পরিচালনা করতে পারেন।

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার দেড় বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশী পেশাজীবী বা বৈজ্ঞানিক সংস্থার সদস্য ফি, বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিভিন্ন ফি, হোটেল বুকিং এবং অনলাইনে সফট্ওয়্যার, অ্যাপস, ই-বুকসহ অন্যান্য পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধ সহজ করা হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডধারী না হয়েও ‘ভারচুয়াল কার্ড’ ব্যবহার করে সাধারণ জনগণও বিদেশে এরূপ ফি অনলাইনে পরিশোধ করতে পারছেন।
এসএমই খাতের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখে বানানো হয়েছে ‘নারী উদ্যোক্তা তহবিল’

এসএমই খাতের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখে বানানো হয়েছে ‘নারী উদ্যোক্তা তহবিল’

নজরদারি জোরদারকরণ

ব্যাংকিং খাতের আর্থিক জালিয়াতি বন্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারসহ নজরদারি আরো জোরদার করেছে– যাতে অনুরূপ ব্যাংকিং অনিয়মের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রাসঙ্গিক ড্যাশবোর্ড চালু করে নজরদারির গুণমানে ব্যাপক উন্নতি আনা হয়েছে।

সর্বোপরি, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উন্নয়নমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা- দেশে আর্থিক খাতের সুস্থিতি বৃদ্ধিতে কাজ করছে। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী মন্দা ও জাতীয় নানা বাধার মাঝেও বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ বছরসহ গত ছয় বছর ধরে বেশ সাফল্যের ধারাতেই রয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘স্থিতিশীল’ ও আর্থিক খাতের পরিস্থিতিকে ‘সুদৃঢ়’ বলে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে।

২০১৪এর শেষ পর্বে অভ্যন্তরীণ চাহিদার যে নতুন প্রণোদনা সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ অর্থবছরে ৬.৫ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে না। তবে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকবে। এর কারণ ত্রিবিধ: সরকারি নতুন বেতন কাঠামো, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় তেলের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা ও চাহিদাতাড়িত ঊর্ধ্বচাপ। এগুলো মাথায় রেখেই বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতি সাজাবে– যাতে ২০১৫ এর অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার ৬.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অর্জন করা সম্ভব হয়।

গেল বছরে অবকাঠামো ও রাজস্ব আহরণের গতি আরও বাড়ানোর সুযোগ ছিল। এ দুটো দিকে ২০১৫তে জোর নজর দিতে হবে। তেলের দাম কমে যাবার ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্যে বরাদ্দ রাজস্বে ঘাটতি কিছুটা কমবে। তাই বলে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বরং রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে হবে আরও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে। গভীর সমুদ্র বন্দর, চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, মেট্রোরেলসহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে চাই বাড়তি রাজস্ব। এনবিআর-কে ডিজিটাইজ করে, বাড়তি জনসম্পদ দিয়ে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রাজস্ব আহরণের মাত্রা ও গতি বাড়াতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

নজর দিতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন ও বড় বড় শহরের ট্রাফিক মোকাবেলার দিকে। কারণ প্রতিটি বড় শহর একটি উদীয়মান অর্থনীতির জন্যে একটি একটি ‘প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র’ হিসেবে কাজ করে।
বিশ্বব্যাপী মন্দা ও জাতীয় নানা বাধার মাঝেও বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ছয় বছর ধরে সাফল্যের ধারাতেই রয়েছে

বিশ্বব্যাপী মন্দা ও জাতীয় নানা বাধার মাঝেও বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ছয় বছর ধরে সাফল্যের ধারাতেই রয়েছে

উপরন্তু, আর্থিক খাতে সুশাসন ও ঋণ-শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিনিয়োগ আস্থা চাঙ্গা করবে। এরই মধ্যে সংশোধিত ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের বলে প্রধান নির্বাহী অপসারণ এবং পাশাপাশি দক্ষদের সুরক্ষা প্রদান এবং পর্ষদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসবই করা হয়েছে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাড়ানোর লক্ষ্যে।

নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে ২০১৫এর জন্যে আর্থিক খাতের অন্যতম লক্ষ্য। আর তা করা হচ্ছে বলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়ছে। এর সঙ্গে বহির্বাণিজ্যের প্রসার যেভাবে ঘটছে তাতে মনে হয় নতুন এই বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। তাছাড়া, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করে সবার জন্য সমৃদ্ধি অর্জনের পথে সরকারের দূরদর্শী দিক-নির্দেশনা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে অগ্রযাত্রার সহায়ক ভূমিকা পালনে বাংলাদেশ ব্যাংক সক্রিয় রয়েছে এবং সদা সক্রিয় থাকবে।

বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শত বাধা বিপত্তিতেও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর বুদ্ধিমত্তা। একেই বলে সহনশক্তি বা রেজিলিয়েন্স। জাতি হিসেবে এটিই আমাদের বড় শক্তি। এর প্রমাণ আমরা অতীতে বহুবার পেয়েছি। বিশৃঙ্খল ২০১৩এর পরেও বিশ্বব্যাপী উৎকণ্ঠা ও নেতিবাচক মন্তব্য অসার প্রমাণ করে বাংলাদেশ ২০১৪ অর্থবছরে ৬.১ ভাগের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির এই ধারা সারাবিশ্বে দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে।

আমার বিশ্বাস, ২০১৫ সালে আমাদের অর্থনীতি আরও সুসংহত হবে। আরও সুস্থির হবে। শুভ নববর্ষ।

Sunday, November 8, 2015

ঘাতক কাঁটা তুলতে হবে -সুমি খান



মশাল যদি নিভেও যায়-
বুকের ভেতর জ্বলা আগুন
এই মশালে জ্বেলে যাই !
রাজীব -অভি- নিলয়- দীপন
নতুন সকাল ডেকে যায়
 ঘাতক কাঁটা তুলতে হবে -
তোদেরকে আজ বলে যাই!!

(সকাল ৮টা ১০ মিনিট)
৯ নভেম্বর, ২০১৫

Saturday, November 7, 2015

আমরা নিশ্চয়ই নন্দলাল হতে চাই না-, সাহসে ভর করে চলতে হবে-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

_hasinaসংলাপে বসতে চান খালেদা। এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, "যেদিন খালেদা জিয়া বলবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনিও চান,সেদিন সংলাপে বসবো। কারণ, এই ঘাতকেরা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে,গণহত্যা করেছে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ যখন সুখে আছে তখনই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এগুলো আর্টিফিসিয়ালি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এমন না। ইমামবারাতে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের কাছে বেশকিছু তথ্য এসেছে। এসব ব্যাপারে অর্থায়ন ও নির্দেশনা আমরা খুঁজে দেখছি। তিনি বলেন, আমরা বেতন বৃদ্ধি করলাম। মাথাপিছু আয় ৬০০ ডলার থেকে ১৪০০ তে উন্নীত করেছি।

বিএনপির জাতীয় ঐক্যমতের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতি করলেও আমি মানুষ। কাউকে যদি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে আপনি কী তার কাছে যাবেন। কেউ যদি ফোনে ঝারি মারে তাহলে কী আপনি কথা বলবেন? আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি তাকে (খালেদা জিয়া) ফোন করি। তার ছেলে মারা গেলো, আমি গেলাম তিনি আমাকে ঢুকতে দিলেন না। একজন খুনির সঙ্গে আমাকে বসতে হবে। যার হাত দিয়ে মানুষ খুন হয় তার সঙ্গে বসার ইচ্ছে নেই। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সদ্য সমাপ্ত নেদারল্যান্ড সফরের অর্জন ও সফলতা নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। তিনদিনের সফর শেষে গত শুক্রবার বিকালে ঢাকায় ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন,  বাংলাদেশে আইএস আছে। এটা যদি স্বীকার করানো যায় তবে বাংলাদেশের উপর  হামলে পড়তে সুবিধা হবে। অনেকে এই ধরনের চিন্তা করছে। বাংলাদেশ অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এই স্বীকৃতি আদায় করতে পারে তাহলে কী হবে ভাবতে পারেন। সিরিয়া, পাকিস্তানের মতো আমাদের সর্বনাশ করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আমি ভেবে পাইনা ,একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করছে। সারা  বিশ্বে এটা হচ্ছে। কেন এটা হবে?প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন,  এর পেছনে কারা? সুতাটা কার হাতে?’
নেদারল্যান্ডের সাথে চুক্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘ডেল্টা প্ল্যান অনেক আগেই গ্রহণ করেছি। তবে চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে কাজ করা হচ্ছে, সেটাই  বড় কথা। আমাদের আছে ১২শ' নদী। আরো ছোট ছোট নদীগুলোকে ড্রেজিং করার আওতায় আনতে হবে। আমাদের সম্ভাবনা নেদারল্যান্ডস এর চেয়ে  বেশী বলে মনে করি। আমরা যে বিশাল সমুদ্রসীমা পেয়েছি , সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।’তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা চলমান থাকবে। অনেক পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেদারল্যান্ডস এর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ ও আন্তরিক। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সহযোগিতার জন্য তাকে অনুরোধ করি। উল্লেখ্য, ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের আমন্ত্রণে গত মঙ্গলবার এই সফরে যান প্রধানমন্ত্রী। এ সফরে ইউরোপের দেশটির সঙ্গে চারটি চুক্তি সই হয়েছে।
গণভবনে এই সাংবাদিক সম্মেলনে  প্রধানমন্ত্রীকে এটিএন বাংলার বার্তাপ্রধান জ.ই.মামুন বললেন," আপনি রাষ্ট্রের প্রধান আপনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং এর সাফল্যে আমরা গর্ব বোধ করি। কিন্তু একের পর এক হুমকি এবং হত্যার কারণে আমরা 'অনিরাপদ' বোধ করছি। আমার পুলিশ 'অনিরাপদ 'বোধ করে।  " প্রধানমন্ত্রী এর জবাবে দৃঢ়তার সাথে বললেন,   কথায় বলে, 'বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়'- দেখছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে হরতাল ও আহ্বান করা হয়েছে। এই চক্রান্তের অংশ প্রকাশক, সাংবাদিকদের হুমকি। নিরাপত্তা আমরা দিচ্ছি;তা দিয়ে যাবো। তবে জানেন তো, সব তালিকার শীর্ষে আমি আছি। এখন নাহয় প্রধানমন্ত্রী , তাই নিরাপত্তা আছে । একসময়ে তো  আমার থাকার বাড়ি ছিলনা, চলাফেরা করার গাড়ি ছিল না; জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ১৯৮১ সালে দেশে এসেছি। সে সময়ে আমাকে বলা হয়েছিলো, আমি  এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথে আমাকে গুলি করে ফেলে দেয়া হবে;পরোয়া করিনি। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ, সেক্যুলার দেশ। এখানে সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা নিরাপত্তা দেবার চেষ্টা করছি, জানেন। কারা একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের চিহ্ণিত করে রুখে দাঁড়াতে জনগণকে সচেতন করুন। আমরা সেক্যুলার ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি। আমি একটা ধর্ম পালন করি। আমার এ ধর্ম নিয়ে যদি কেউ বিকৃত লেখা লিখে, তাদের লাগবেই । সতর্ক করা হয়েছে, কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন লেখা লিখবেন না। কেউ ধর্ম না মানলে তার ব্যাপার। অন্যের ধর্মে আঘাত দিতে পারেন না। বিকৃত লেখা এক ধরণের বিকৃতি ;বিকৃত মানসিকতা। আমি খোলামেলা কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সব ধর্মকে সম্মান করি। গীর্জা, মসজিদ, প্যাগোডাতে গেছি। আমার ধর্মপালনে কোন ব্যাঘাত এতে হয়নি।
সকল ধর্মের প্রতি সম্মান রাখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেক্যুলারিজম মানে অন্যকে আঘাত দেয়া নয়, অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো। ষড়যন্ত্র করে পুলিশকে মারা হচ্ছে। পুলিশ কনস্টেবল ইব্রাহিমকে মারার পর জানা গেলো আশুরার সময়ে কী নাশকতার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আপনার নিরাপত্তা রাষ্ট্র যেমন দেবে, নিজেকে ও সচেতন হতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই নন্দলাল হতে চাই না, (হেসে)"নন্দলালা একদা করিলো পণ, যে করেই হোক্, রাখিবো এই জীবন!" প্রশ্ন -আপনাকে 'লেডি হিটলার ' বলেছেন খালেদা জিয়া লন্ডনে বসে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য!-" এএই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায় , তিনি কী করছেন ? আর যে মন্তব্য তিনি করলেন, সেটাই যদি হবে, তাহলে আর সংলাপে বসতে চান কেন? আমি বুঝতে পারি না , এতো দুর্নীতি , এতো হত্যা, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ, ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, তার পর ও তার (খালেদা জিয়া) প্রতি  এতো 'দুর্বলতা' কেন? এদের হাতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী নিহত হয়েছে। কক্সবাজারে হত্যা করে এসিড ঢেলে দিয়েছে, যাতে মুখ চেনা না যায়। এ নিয়ে কারো যেন কোন বক্তব্য নেই। আওয়ামী লীগের লোক মারা গেলে আমরাই কাঁদি, কোন জ্ঞানী গুণীর কান্নাকাটি নেই, আমরা ই কাঁদি। অনেকে দলে  যোগ দেয় খুন করার জন্যে। জামাত বিএনপি কোন ভালো কাজ করে নি, দলে অনেক লোক আছে নতুন করে এদের দরকার নেই। এরা দলে এসেই কোন খুন করে প্রচার করে 'আওয়ামী লীগ খুন করেছে'। আমি জামাত-বিএনপি কে দলে নেবার বিরোধী। প্রকাশক, লেখক দের হত্যা করছে এরাই । সাহসে ভর করে চলতে হবে। আ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে। মানিলন্ডারিং করে এতো টাকা হয়েছে ওদের (জামাত-বিএনপি) !আ্যামনেষ্টি টাকার বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলছে। কে কী বলছে, তাতে কিছু আসে যায় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা !বেলা ১২টা ১০ থেকে ১২টা ৪২ মিনিটপর্যন্ত এ সংবাদ সম্মেলনে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

Sunday, October 18, 2015

ছোট্ট আমি তুমি


দিক ভেসেছে
কূল ভেসেছে
নিদ টুটেছে
ডাগর চোখের পাতায়-
মিঠে প্রেম
আর
মিঠে ভালোবাসায়-
কবে কখন কোন জনমে -
বৃষ্টি খেলার
নৌকা ভেলায়
শিউলি ফুলের
ঝরে পড়ায়
শেষ বিকেলের
কনে দেখা আলোয়-
শেকলের বন্ধনে
বন্দীত্বের শৃঙ্খলে-




রাত ১১টা
১৮ অক্টোবর , ২০০৫

 

Monday, September 14, 2015

আইএস-এর টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ?-সুমি খান

বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস বা আইসিস) সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক আইএস-এর সঙ্গে জড়িত বলে দাবি পুলিশের৷ সামিউন ওরফে ইবনে হামদান নামের এই তরুণকে গোয়েন্দারা গ্রেপ্তার করেন রবিবার রাতে৷ তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন এবং জঙ্গি তত্‍পরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ সম্বলিত কিছু কাগজ-পত্রও উদ্ধার করা হয়েছে৷ জানা গেছে, সামিউনকে গ্রেপ্তার করা হয় এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া হাফিজুর রহমান নামে আরেকজনের তথ্যের ভিত্তিতে৷ তার তথ্যমতে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন বাংলাদেশে আইএস-এর তত্‍পরতা জোরদার করার কাজ করছিল৷

গত কয়েক সপ্তাহে আইএস-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ৷ গত বুধবার ঢাকা থেকে জঙ্গি তত্‍পরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. আসিফ আদনান ও মো. ফজলে এলাহী তানজিল নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এদের মধ্যে আদনান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক বিচারপতির ছেলে এবং তানজিলের মা যুগ্ম সচিব৷ তারা নাকি ‘জিহাদে' অংশ নিতে তুরস্ক ও সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল৷


 গত কয়েক সপ্তাহে আইএস-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ
গোয়েন্দারা গত ১৯শে সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-র ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদসহ সাতজনকে আটক করেন৷ তারাও আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল বলে গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমকে জানান গোয়েন্দারা৷

মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে আইএস-এর অনুসারীদের তত্‍পরতা তাদের নজরে আসছে৷ কোণঠাসা হয়ে যাওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা ইরাক এবং সিরিয়ার ঘটনায় এখন নতুন করে আইএস-এর দিকে ঝুকছে৷ তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে৷''
তিনি জানান, ‘‘এর আগে আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বা যোগাযোগের চেষ্টা করছেন এমন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে৷ আর রবিবার আইএস-এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে আটক করা হলো৷''

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, ‘‘আটক সামিউনের কাছ থেকে তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট, এটিএম কার্ড এবং ৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে৷ তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে, সে সিরিয়ায় আইএস-এর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছে৷ তার মোবাইল ফোনের এসএমএস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে৷''
মাসুদুর রহমান জানান, ‘‘এর আগে আটক হওয়া দু'জন জঙ্গি তাদের জানিয়েছেন সামিউন বাংলাদেশে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে আসে৷ আইএস-এর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্যই সে বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করে৷ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই সে এখানকার জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে৷''

তিনি জানান, ‘‘সামিউনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসবাদ করা হবে৷ আর তখনই জানা যাবে আইএস বাংলাদেশে আদৌ কোনো শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছে কিনা৷''

Saturday, August 29, 2015

আলবদররা কী করেছিল?-মুনতাসির মামুন

হবে কী হবে না? হ্যামলেটের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো-‘টুবি অর নট টু বি’। মুজাহিদের দন্ডের দু’একদিন আগে থেকে এ প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছিল বিভিন্ন মহলে। উন্নয়নের ধাক্কায় যখন রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত, মানুষ ঘর্মাক্ত ও বিরক্ত তখনও এ প্রশ্ন ছিল অনেকের মুখে। আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন অনেকে, যেন আমি সবজান্তা। আমি পরে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এ উদ্বেগ কেন সবার মাঝে? মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের দণ্ড হওয়ার পর আপীল বিভাগে গেলে কেন এ প্রশ্ন ওঠে? এর অর্থ মানুষের সম্পূর্ণ আস্থা নেই। না থাকার কারণ কি? কারণ, পূর্ববর্তী কয়েকটি রায়ে ইতিহাস অমান্য করে দণ্ড হ্রাস বা মওকুফ। আইন দিয়ে ইতিহাস ঠেকানো কেউ পছন্দ করেনি একমাত্র জামায়াত-বিএনপি ছাড়া। এ বিষয়টি আইনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার ভেবে দেখা উচিত। পদে গেলে পদ এক সময় সবাইকে হারাতে হয়। তখন? উচ্চ আদালতের অনেক বিচারককে প্রকাশ্যে কেন দেখা যায় না পদ হারানোর পর। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতিই আছেন কয়েকজন। সাম্প্রতিককালে একমাত্র বিচারপতি খায়রুল হক-ই দিব্যি হেসে খেলে অবসরোত্তর জীবন যাপন করছেন। কেন?
এসব প্রশ্ন আরও তীক্ষè হয়েছিল বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীকে এই বেঞ্চে না রাখার কারণে। তার ভক্তের সংখ্যা যেমন প্রচুর, তাকে অপছন্দ করেন এমন সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তার অবিচল পক্ষপাত অনেককে বিচলিত করে।
 এখানেই প্রশ্ন আসে আইন ও ইতিহাস নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে বিচারের সব পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি আইন ও ইতিহাসকে পর্যুদস্ত করছে কিনা তা নিয়ে। সে আলোচনা পরে।

‘যুদ্ধাপরাধ আবার কী? বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই।’ ২০০১ সালে মুজাহিদ এ রকম ঔদ্ধত্যভরেই কথা বলতেন। তার দাম্ভিকতা ঔদ্ধত্য কখনই কেউ পছন্দ করেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে একমাত্র সাকাচৌ-ই এ বিষয়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। মুজাহিদকে আমার সব সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে ঠা-া মাথার ও ধূর্ত মনে হয়েছে। অবশ্য, বলতে পারেন এ ধরনের অপরাধীরা ঠা-া মাথার না হলে এত হত্যাকা- বা ধর্ষণ কিভাবে করেছিলেন? খালেদা জিয়া মুজাহিদকে খুব পছন্দ করতেন। কখনও নির্বাচনে না জিতলেও খালেদা ২০০১ সালে মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। একটি বিষয় লক্ষণীয়, খালেদা জামায়াতের যে দু’জনকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন নিজামী ও মুজাহিদ তারা দু’জনই ছিলেন ১৯৭১ সালে আলবদর কমান্ডার ও উপ-কমান্ডার। রক্তের প্রতি খালেদার এক অদম্য আসক্তি আছে। তার প্রমাণ ২০০১-৬ ও ২০১৩-১৪ সালের ঘটনাবলি। কত মানুষ যে পুড়িয়েছেন তিনি! রক্তের প্রতি আসক্তির কারণেই ঐ দু’জনকে মন্ত্রী করেছিলেন। মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হয়ে সারাদেশে সরকারী টাকায় জামায়াতী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করেছিলেন। আজ যে বিতর্ক উঠছে বিএনপি জামায়াত ছাড়বে কিনা তার উত্তর- না। আমরা ইতিহাস না জেনে বিতর্ক করি। জিয়াউর রহমান খুনীদের মাঠে এনেছিলেন তাদের ত্যাগ করার জন্য নয়, তার গুন্ডাবাহিনী হিসেবে কাজ করার জন্য। জামায়াত বিএনপির গুণ্ডা বাহিনী হিসেবে কাজ করবে, আর গডমাদার তাকে প্রটেকশন দেবেন। এটি বাস্তব ও সাধারণ সত্য।

 আলবদর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭১ সালে তার বাহিনী নিয়ে প্রথমে অসম পরে দিল্লী জয় করতে চেয়েছিলেন। কেন পারেননি সে প্রসঙ্গ পরে। পালিয়েছিলেন নেপাল, তারপর পাকিস্তান। আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমানের আমলে ফিরে আসেন দেশে। জেনারেল জিয়ার স্ত্রীর আমলে মন্ত্রী। ট্রাইব্যুনালে বিচারের সময় দেখেছি কাঠের বেষ্টনীতে বসে। এত উত্থান পতন একজনের জীবনে খুব কমই আসে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা যখন রায় পড়ছিলেন তখন মনে হয়েছিল এই আলবদর কমান্ডারকে ১৯৭১ সালে আমরা বলতাম আজরাইল।
 মুজাহিদের পুরো পরিবার রাজাকার। তার পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে মানুষজন হত্যা, লুটপাট করেছেন। তার পুত্র পৃথিবীর ইতিহাসে হিংস্রতম একটি বদর বাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন। বদর বাহিনী যা করেছে তার জন্য মৃত্যুদন্ডও যথেষ্ট শাস্তি নয়।

 ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বদর বাহিনীর সৃষ্টি হয়। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয় আলবদর বাহিনীতে। এর বাইরেও যে কিছু লোকজন আলবদর বাহিনীতে যোগ দেয়নি তা নয়। ইসলামী ছাত্রসংঘের (সারা পাকিস্তান) প্রধান মতিউর রহমান নিজামী নিযুক্ত হন আলবদর বাহিনীর প্রধান। মুজাহিদ ছাত্র সংঘের হোমরা চোমরা ছিলেন। ১৯৭১ সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হন, সে হিসেবে আলবদরদের উপকমান্ডার। বস্তুত মাঠে মুজাহিদের দাপটই ছিল বেশি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ করা হয়েছিল। আসলে এত অভিযোগের দরকার ছিল না। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ও নেতৃত্বদানের কারণেই তিনি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতেন। আলবদর নেতা হিসেবে হত্যার পরিকল্পনা পন্থা সবই তার নির্দেশে হতো। মুজাহিদের মতো হিংস্র মানুষ খুব কমই দেখা মেলে। তার সেই হিংস্রতা বয়সের কারণেও হ্রাস পায়নি। তার অবয়ব দেখলেই তা অনুমান করা যায়।
 প্রত্যেক আলবদরই যুদ্ধাপরাধী। তারা ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী শক্তি, তবে সরাসরি অধীনস্থ। তারা কখনও কখনও স্বাধীনভাবে কাজ করলেও পাকিস্তানী সেনা কমান্ডের অনুমতি ছাড়া সাধারণত কাজ করতে পারত না। তাদের প্রশিক্ষণ, বেতন, অস্ত্রশস্ত্র সব পাকিস্তানী বাহিনীই যোগাত। সুতরাং ১৯৭১ সালের খুন, ধর্ষণ, হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির দায়দায়িত্ব তাদের ওপরও বর্তায়। পাকিস্তান বাহিনীর ওপর নির্ভরতা ও তাদের হয়ে কাজ করার প্রমাণ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। মনসুর খালেদের বইয়ের একটি অধ্যায় আছে ‘আলবদরদের অবদান’। তিনি বিভিন্ন সাক্ষাতকার, পত্রপত্রিকা থেকে আলবদর সম্পর্কে পাকিস্তানীদের বিবৃতি, বক্তৃতা সঙ্কলন করেন।
 এসব পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততাই তুলে ধরে এবং এগুলো যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ।

 মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বেসামরিক প্রশাসনের দেখাশোনাও তিনি করতেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তিনি দায়ী এ কথা অনেকেই বলেছেন। আমি ও মহিউদ্দিন আহমদ যখন তার সাক্ষাতকার নিই রাওয়ালপিন্ডিতে, তখন তিনি ১৯৭১ সালের গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, (১৯৯৮) আমাকে যে রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবকিছু ছিল নিয়াজীর নিয়ন্ত্রণে। তিনি এর কিছুই জানেন না। ৯-১০ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়-
‘শুনুন, জেনারেল শামসের ছিলেন পিলখানার দায়িত্বে। তিনি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি জানান, আমাদেরকে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সাধারণত আমাদের কোন বৈঠক হয় না। জেনারেল শামসেরকে বললাম, ঠিক আছে যাব। পিলখানায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সেখানে দেখলাম কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে কেন? তিনি বললেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে আমরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাচ্ছি, সে জন্যই গাড়িগুলো এখানে। তারপর বললেন, কয়েকজন লোককে গ্রেফতার করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললেন, কথাটা নিয়াজীকেই তুমি জিজ্ঞেস কর। এতে তোমার মত কি? আমি বললাম, স্যার, এখন কাউকে গ্রেফতারের সময় নয়, বরং এখন কত লোক আমাদের সঙ্গে আছে সেটিই দেখার বিষয়।’

এই যে গ্রেফতার ও গাড়িগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এখানেই ইঙ্গিত আছে আলবদরদের। আলবদররা তখন বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে মানুষ তুলে নিচ্ছে। এ গাড়িগুলো আলবদরদের দেয়া হতো মানুষজনকে তুলে নেয়ার জন্য।

 আমাকে যখন জেনারেল ফরমান এ কথাগুলো বলেন, তখন বোধহয় তিনি ভুলে গেয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে দৈনিক জং ও দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াক্তে এক সাক্ষাতকারে তিনি কি বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আলবদর ও আলশামসের কার্যকলাপের আমি প্রত্যক্ষ দর্শক। এই দুটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলায় তাদের জান কুরবান করেছিল।’

জেনারেল নিয়াজী কিন্তু ব্যাপারটা অস্বীকার করেননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন (১৯৯৮) ‘আলবদর, আলশামস আমারই সৃষ্টি। এ প্রক্রিয়াটি আমি শুরু করি মে মাস থেকে। ওরা সরাসরি আমার কমান্ডে ছিল।’

২১ মে ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর যাত্রা শুরু। যে মেজর রিয়াজ এদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি মনসুরকে জানিয়েছিলেন- ‘তারা বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের অখ-তা ও প্রতিরক্ষাকে ঈমানের অংশ ও দ্বীনের দাবি বলে মনে করতেন। ’
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের নাম আমাদের পরিচিত। ঢাকায় ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন। বইও লিখেছেন। ‘ম্যায়নে ঢাকা ডুবতে দেখা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, ‘আলবদর আলশামস ও রাজাকাররা পাকিস্তানের জন্য তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। যে কোন আদেশ তারা সম্পূর্ণভাবে পালন করত।’

ভাল বলেছেন আলবদরদের সুপার বস আবুল আলা মওদুদী। ১৯৭৩ সালে করাচীর দৈনিক জসরত পত্রিকায় তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে তখন আলবদররা পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে কাজ করছিল। আর যখন পাকিস্তানী বাহিনী দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় বাহিনীর গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন এই তরুণরা পাক বাহিনীর পুরোপুরি সহযোগিতা করে। এমনকি সেনাবাহিনীর সাফল্য এই তরুণদের ওপর নির্ভর করেই অর্জিত হচ্ছিল। কেননা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তা-ঘাট ও ভাষা জানত না বা চিনত না। ওই সময়ে এই তরুণরা ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারা ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসী হামলা প্রতিহত করার জন্য স্বদেশী বাহিনীকে পূর্ণরূপে সাহায্য করে। তারা প্রচুর কুরবানী স্বীকার করে। এরাই ছিল সেই নওজোয়ান যারা পাক বাহিনীর অগ্রপথিক ছিল। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৫ হাজার ওই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে শহীদ হয়েছেন আর যারা জীবিত রয়ে গেছেন তারা আপন বাঙালি ভাইদের হাতে এখন শহীদ হচ্ছেন।’

৫০০০ আলবদর নিহত হলে তো আমরা বেঁচে যেতাম। নিহতের সংখ্যা অনেক কম। আর বাংলাদেশ হওয়ার পর তাদের কোথায় নিধন করা হয়েছে? হয়নি। তবে, ধরে নিতে হবে পাকিস্তানীরা বিশেষ করে পাকিস্তানের জেনারেল ও ‘মৌলানা’রা মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত।

 মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত যাদের বিচার হয়েছে তাদের অধিকাংশই আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারণ, তখন তারা তরুণ হিসেবে ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন। আর পুরো ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয়েছিল আলবদরে। মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আলবদর প্রধান, মুজাহিদ উপ-প্রধান, কামারুজ্জামান ছিলেন শেরপুরের কমান্ডার। নয়াদিগন্ত পত্রিকার মালিক মীর কাসিম ছিলেন চট্টগ্রামের, কাদের মোল্লা ছিলেন মিরপুরের।
 সশস্ত্র আলবদররা রাজাকার, শান্তি কমিটি থেকেও ছিল বেশি সংগঠিত,অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও বেশি হিংস্র। বস্তুত, যুদ্ধাপরাধী যতজন গ্রেফতার হয়েছেন তার মধ্যে মুজাহিদ ছিলেন সবচেয়ে হিংস্র। ১৯৭১ সালে তিনি বলেছিলেন- ‘পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ পৃথিবীতে হিন্দুস্থানের কোন মানচিত্র স্বীকার করে না। ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর কাফেলা দিল্লীতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রসংঘের একটি কর্মীও বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।
 এখন থেকে দেশের কোন পাঠাগার, গ্রন্থাগার, পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র বা দোকানে পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী কোন পুস্তক রাখা চলিবে না। কোন স্থান, গ্রন্থাগার ও দোকানে পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিবিরোধী পুস্তক দেখা গেলে তা আগুনে পোড়ানো হবে।’

আগে যে বলেছি, আলবদরের সর্বোচ্চ শাস্তিও যথেষ্ট নয় তার একটি কারণ আছে। একজন মানুষ আরেকজনকে খুন করতে পারে গুলি করে, ছুরিকাঘাত করে ও নানাভাবে। কিন্তু ঢাকার আলবদররা মুজাহিদের নির্দেশে সাত মসজিদ রোডের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে মানুষজনকে জড়ো করত এবং নানাবিধ অত্যাচার করত, তারপর হত্যা করত বিচিত্র সব উপায়ে। আজ অনেক তরুণ যখন জামায়াতের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে তখন বলতে ইচ্ছে হয় এদের পিতা-মাতাকে মুজাহিদদের হাতে তুলে দিলে কেমন হয়? বা বিএনপির যেসব তরুণ জামায়াতের তরুণদের সঙ্গে গলাগলি করে গাড়ি পোড়ায়, পুলিশ হত্যা করে তাদের বা তাদের পিতা-মাতাকে আলবদরদের হাতে তুলে দিলে বা তাদের হাতে মৃত্যু হলে তারা জামায়াত সমর্থন করত?

আলবদররা কী করেছিল? এ প্রশ্ন শুনে অনেকে বলতে পারেন সবাই যা জানে সে বিষয়ে প্রশ্নের তাৎপর্য কী? আলবদর পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের দমনে। এ কারণে, একদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে গেরিলা/সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অন্যদিকে, নিরীহ বাঙালিদের বাড়িঘর লুট করেছে, হত্যা করেছে ও ধর্ষণ করেছে। এথনিক ক্লিনজিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু, আলবদর আরেকটি কাজ করেছে। তা হলো, সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবী/পেশাজীবীদের হত্যা করেছে। আলবদর বাহিনী গঠন হওয়ার পর থেকেই এ হত্যাকা- পরিচালিত হয়েছে, তবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অপহরণ ও হত্যাকা- তুঙ্গে ওঠে। সারা বাংলাদেশে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যা করা হয় পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে। অপহরণের পর নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার চালানো হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আলবদর হোক, রাজাকার হোক, মানুষ কি মানুষের ওপর এমন অত্যাচার করতে পারে? ১৯৭১-৭২ সালের দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলো দেখলে আলবদরদের নিষ্ঠুরতার অনেক খবর জানা যাবে।
 রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমি যা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, আলবদরদের নৃশংসতার প্রতীক। দুয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক- ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা।...’

 ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা । মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই, কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা.. মেয়েটি সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।...
‘মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি ফলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যস্থ কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোক যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’

 ‘ঢাকার রায়েরবাজারের বধ্যভূমি দেখে এসে এই প্রতিবেদন লিখেছিলেন অধ্যাপিকা হামিদা রহমান। হামিদা রহমান ডা. ফজলে রাব্বীর লাশ দেখে লিখেছিলেন-‘ডা. রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা, জল্লাদ বাহিনী বুকের ভিতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তাঁর হৃৎপি-টা ছিঁড়ে ফেলেছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে দেহটা পড়ে আছে। পাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। রাব্বী সাহেবের পা দুখানা তখনও জ্বলজ্বল করে তাজা মানুষের সাক্ষ্য দিচ্ছে। নাক, মুখ কিছুই অক্ষত ছিল না। দস্যু হায়েনার নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত।... সামনে চেয়ে দেখি, নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নয় একেবারে বারো/তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে।’

মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বলেছিলেন ‘হানাদার পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদররা পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের হেড কোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোঝাই চোখ। এ দেশের মানুষের চোখ। আলবদরের খুনীরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।’ [দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯.১.১৯৭২] উল্লেখ্য, ডা. আলীম চৌধুরীর চোখ আলবদররা উৎপাটন করেছিল।

মওলানা তর্কবাগীশ আরও বলেছিলেন, ‘খুনীদের নামে এই বাহিনীর নাম দেয়া হলো আলবদর বাহিনী। এ কি কোন মনঃপূত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সঙ্গে কি কোন সংযোগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? হানাদারদের সহযোগী এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়। এরা হলো জালেম।’

 আলবদর কমান্ডার মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে ট্রাইব্যুনাল। রায়ে এটি সর্বোচ্চ শাস্তি হলেও ৭১-এ তার অপরাধের পরিধি এতই ব্যাপক ছিল যে, কেবল ফাঁসিই তার জন্য যথেষ্ট নয়-সাংবাদিক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন- ‘ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যার অনেক কাহিনী পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ওই পিশাচরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন্ পাশবিকতার উল্লাস?

... সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকত, এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না, আর মানুষ কেন, কোন প্রাণীই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?... শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি, ভুল বললাম মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকায় মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়?’
আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’ [দৈনিক পূর্বদেশ, ৮.১.১৯৭২]
আলী আকবর টাবী দৈনিক আজাদ উদ্ধৃত করে লিখেছেন, গ্রেফতারকৃত এক আলবদর স্বীকার করেছিল- ‘আর এক সপ্তাহ সময় পেলেই আলবদর বাহিনী সকল বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলত।’ 

'তুতো ভাই -তুতো বোন'- সুমি খান

'তুতো ভাই -তুতো বোন
 পিঠ চাপড়ানো,
ক্ষমতার পাছে পাছে
শুধু দৌড়ানো-
মুখোশটা সরালেই
আগে পরে 'তুতো'রা ই
লেন দেনে মদ -নারী-
নাচানাচি-বেশ !
বাহবা  বাহবা-
 বেশ বেশ বেশ!

খর্ব চিত্তে অর্থ বিত্তে
যতোই লুটোপোটি -
স্বচ্ছ চিত্তে ঘেন্না পিত্তে
 কেবল থুথু ছিটি!


দশদিক দেখিয়া বলি,
শোন পূণ্যবান
আবদেল মান্নানের কথা অমৃতসমান-
"সমান সমান না হলে কি লড়াই জমে আচ্ছা?
ও শুযোরের বাচ্চা!"

২৯ আগষ্ট ২০০৪
রাত ১১টা ১০ মিনিট

Monday, August 17, 2015

দাবি তাই একটাই-প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই - সুমি খান

পিতা মুজিব -
তুমি আমাদের পিতা-
তোমায় নমি বারংবার-
তোমায় স্মরি বারংবার-
তোমার কাছেই কেঁদে মরি বারংবার -
পিতা, দ্যাখো চেয়ে 
তোমার হাতে গড়া দেশের পবিত্র মাটিতে
  কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে  গুমরে মরে
শহীদের রক্তঋণ !
 
তুমি আমাদের পিতা-
কখনো কি ভেবেছিলে- এমন দিনও আসবে এ মুক্ত স্বদেশে ?

 যে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা রক্তস্নাত,
সে দেশে শহীদের সন্তানের কন্ঠরোধ করে নিক্ষিপ্ত হবে কারাগারে?
না, এ হয় না পিতা-
রক্তঋণের মুক্তি চাই পিতা!
মুক্তি দাও -মুক্তি চাই, পিতা -
আমার দাদা প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই!

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে  ১১ মাসের সংবিধানেও
আমাকেই সকল ক্ষমতার উৎস করেছিলে-
পিতা আমার -
১৫ আগষ্টের কালো রাতে তোমায় হত্যা করে খন্দকারের দল-
অধিকারহীন করেছে তোমার সন্তানদের-
আর তাই -
তোমার সন্তানেরা আজ ঠুঁটো জগন্নাথ-
ঢাল নেই তলোয়ার নেই -
নিধিরাম সর্দার  আমি
১৩ শহীদের বংশধর প্রবীর সিকদারের দুর্ভাগা ছোট বোন আমি !
আমার দাদা দাগী অপরাধী নন -
তবু তিনি নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে
তার এক মুহূর্ত আগেও পান নি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ-

রাষ্ট্র তুমি কার?
এমন কলংক যেন না হয় আবার!
রাষ্ট্র , এ দায় এড়াবে কী করে আর?

মুক্ত করো হে সবার সঙ্গে যুক্ত করো হে বন্ধ-
 ঘাতকের আঘাত বারবার যাকে প্রাণহীন করে দেয়!
আবার কী করে যেন মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসেন-
 তিনি-প্রবীর সিকদার
র্পর্বপুরুষের পবিত্র রক্ত- শহীদের রক্তে ভেজা মাটি ফিরিযে দেয় তার প্রাণ-
তিনি-প্রবীর সিকদার!

স্বাধীন দেশের এ মাটিতে
কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হলো এই প্রবীর সিকদারকে-

'অপরাধ' জানবার আগেই কারাগার? কিন্তু কেন, পিতা?
তোমার গড়ে দেয়া এ  রাষ্ট্র -
আত্মপক্ষ সমর্থনের তো সুযোগ দেবে, পিতা!!
জানি, তোমার গড়ে দেয়া রাষ্ট্র
তোমারি রক্তে
 হয়েছে  সিক্ত
এ রাষ্ট্র একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মাদের হাতে জিম্মি-
যে প্রতাত্মারা তোমাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নি -
তোমার প্রতিটি চিহ্ণ বিলীন করে দিতে চেয়েছে মূর্খের দল!
তারা জানেনা তুমি মিশে আছো প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে অন্তরে -
এই অপশক্তি বারবার  হত্যা করতে চেয়েছে তোমার কন্যা এ জাতির কান্ডারী শেখ হাসিনাকে -
আগষ্ট কে যেন ভীষণ ভয় তাদের !
আর তাই এই আগষ্টেই যেন তাদের তান্ডব সবচেয়ে বেশি!
দশকের পর দশক-অন্ধকারে ডুবিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম-নব তারুণ্যকে-

এই আগষ্টেই যারা  মুক্তবুদ্ধির গলা টিপে মারতে চায় -তারা কারা?
সেসব কাদের দোসর?

পিতা তুমি যে লোকেই থাকো-
হয়তো হাসছো-
সত্যি, তোমায় রক্ষা করতে পারে না যে জাতি,
সে জাতি নিজেদের রক্ষা করবে কী করে?
তোমাকে সপরিবারে হত্যা করে যে জাতি -তাষা করবে কী করে?
তোমার কন্যার কাঁধে গুরু দায়িত্ব-
ঘাতকদের একে একে বিচারের কাঠগড়ায় তুলে
রক্তঋণের দায় থেকে জাতিকে মুক্ত করতে
তোমার সুযোগ্য কন্যা  শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর!

যাঁর ত্যাগ এবং তিতিক্ষায় বিশ্বসভায় আজ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য  দৃষ্টান্ত!
কিন্তু এতো ভালো মনে হয় ভালো নয়!
হায়েনা দের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের ছায়া চারপাশে
তোমার সন্তানেরা এই বিষছায়া থেকে মুক্ত হতে পারে নি এখনো-
কখনো পারবে না হয়তো-
দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস-
নাগপাশে বন্দী প্রশাসন
মুক্তচিন্তা মুক্তিকামী মানুষকে শৃঙ্খলিত করার পথ নিয়েছে-
এ বড়ো সর্বনাশা পথ, পিতা
তুমি জানো!
তোমার সতর্কতায় নজর দেবার মতো সময় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নেই!
জাতিকে বিপন্ন করে
সকল শুভ কাজের সুফল পন্ড করার
নীল নক্সা কার্যকরে সক্রিয় নীল শক্তি !
সবকিছু নষ্টদের দখলে আজ, পিতা!

  কাকে আর বলি বলো তো?
তুমি বলো না,
রাষ্ট্র যদি সাংবিধানিক অধিকার সম্মান করে-
এমন কালাকানুন বাতিল করতে হবে -
যে আইন ঘাতকের বিচারের জন্যে সহায়ক মনে করে প্রণয়ন,
তা কেন নিরীহের উপর প্রয়োগ ?
এ কি নিপীড়ন নয়?

আর তাই আইনের এমন অপপ্রয়োগ-
 শুধু ঘাতককূলের সহায়ক-

দাবি তাই
একটাই
মুক্তি চাই
মুক্তি চাই!
প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই -
শহীদ পরিবারের  সন্তানের মুক্তি চাই  -

সন্তানেরা -অসহায় স্ত্রী পথ চেয়ে আছে-
চোখের জল বাধ মানে না!

'শোন শোন পিতা-
কহো কানে কানে ,শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা-
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে, রয়েছে বাঁচিয়ে , সদাই ভাবনা- যা কিছু পায়
হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা..."

শৃঙ্খলিত ইতিহাসের অট্টহাস -সুমি খান


নতুন আগষ্ট আসে!
 শৃঙ্খলিত ইতিহাস
অট্টহাসে!

একাত্তরের রক্তাক্ত ছুরি
মসনদ ঘিরে লুকোচুরি-
সে কোন্ মরীচিকায় বাড়ানো হাত !
টেনে নিলো কারাঘাত!

পিতা-কন্যার রক্তাক্ত সংগ্রামের ফসল
 ঘরে তোলে খন্দকারের দল -
হা!হতোস্মি !
ব্যাভিচারী অপশক্তি-
বিশ্বজয়ী বীর বাংলা
উন্নত শির তব
অধোনত ..পদাবনত....

দরোজায় কড়া নাড়ে আবারো   পঁচাত্তর
নিকষ কালো হাতের সারি.....
লাল সবুজ পতাকা খামচে ধরা
সেই পুরনো শকুন
 হায়েনার সাথে
ত্রস্ত উন্মত্ত
হার্মাদ !

কাতরে বেড়ানো সুখের মরীচিকার ফাঁদে
শৃঙ্খলিত তুমি আমি -
 শ্রাবণের অশ্রুধার
তুমি আমি একাকার-

রসুনের কোষ ঘিরে
হায়েনার উন্মত্ত উল্লাস
অপশক্তির পরাজয়ের আগষ্ট মাস-
 মীরজাফরের রক্তমাখা হাত
ধূলায় লুটিয়ে দেয়-
 লাল-সবুজের জয়নিশান
বিশ্বসভাজয়ী বাংলার বীরোচিত সম্মান- 
কন্টকশয্যা মোর
এ যে কারাগার ঘোর!

শৃঙ্খল ভেঙ্গে উন্মোচিত হোক-
খল নায়কের মুখোশধারী মুখ
মিথ্যাচারী ধ্বজাধারী
জগৎ বলে -'মিথ্যেবাদী , ধিক্ শতবার'-
আমরা আছি লাখো কোটি শহীদ পরিবার !

তাই তো জাগে স্বপ্নের অনন্ত প্রহর -
'জাগো বাহে..........কুন্ঠে সবাই .....'
পিতা তুমি আছো জানি -
মিছে তো নয়-
এখনো তোমারি বরাভয়ে-
তোমারি কন্যার জয়ে -
ফাঁসির দড়িতে ঝুলে ঘাতক শিরোমণিকূল-
আর তাই এখনো বিশ্বাস করি বিলকুল -
দিগ্বিজয়ী  নুরুলদিন হেঁকে যায়-
সত্যবচন হবে না কখনো নির্বাসন!!


সুমি খান ,সকাল ৯টা.১০, মঙ্গলবার ,১৮ আগষ্ট ,২০১৫

Wednesday, June 17, 2015

একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি বঙ্গবন্ধু : তথাকথিত সংবাদপত্রের কালো দিবস প্রসঙ্গ

আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া,বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০১৫

১৬ জুন। এই দিনটি আসলেই মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতির আজ্ঞাবহ একটি ক্ষুদ্র চিহ্নিত মহল ঘটা করে কালো দিবস পালন করে। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। তাদের ভাষায়, এই দিন নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চারটি পত্রিকা বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে হাজার হাজার সাংবাদিকদের বেকার করেছিলেন। যা একটি ডাহা মিথ্যাচার। জাতির পিতার মৃত্যুর পর তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের যে নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল এই তথাকথিত কালো দিবসটি ছিল তার অন্যতম। তৎকালীন বিএফইউজের সভাপতি আহম্মদ হুমায়ুন ও ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিবাহিনীর সহযোগী আনোয়ার জাহিদ ছিল এই কালো দিবস ঘোষণার অন্যতম হোতা। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক সন্ত্রাসকে খুশি করে নিজেদের আখের গোছানোই ছিল এই অপতৎপরতার মূল লক্ষ্য। তবে আমার সান্ত¡না দেশের সিংহভাগ সাংবাদিক এই অপকৌশলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, তারা বরং ২১ জুন দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন দিবস পালন করেন যেদিন বিএনপির লেলিয়ে দেয়া পুলিশবাহিনী জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকে নির্বিচারে শ্বেত সন্ত্রাস কায়েম করে এবং সাংবাদিকদের নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ অর্ধশত সংবাদকর্মীকে মারাত্মক জখম করে।
শুধু এই ক্ষুদ্র স্বার্থন্বেষী মহলই নয়, এই বিষয়টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত চক্র সেই ১৯৭৫-এর পর থেকেই মিথ্যাচারে লিপ্ত এবং বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। জাতীয় সংসদের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন হঠাৎ করে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। সরাসরি সংসদের ফ্লোর থেকে সাংবাদিক গ্যালারির প্রতি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের বয়স ৩১/৩২ বছরের বেশি নয়, আপনারা অনেকেই ইতিহাস জানেন না। আজ আপনারা এখানে বসে সাংবাদিকতা করতে পারতেন না, কারণ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে আর বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসে পত্রিকাগুলো মুক্ত করেন। এরপর বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করে। আপনারা ভুলে গেছেন শেখ মুজিব প্রায় ৭-৮ হাজার সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। আর বর্তমানে দেশের সাংবাদিকের সংখ্যা ৩০-৩২ হাজার। এ কৃতিত্ব বিএনপি ও শহীদ জিয়ার। বঙ্গবন্ধু চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বেকার করে পথে বসিয়েছিলেন। না। বিষয়টি এমন সরলীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। এটা কোনো মতেই তৎকালীন যা ঘটেছিল তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ নয়। এটা ডাঁহা মিথ্যাচার।
বঙ্গবন্ধুর সময়কার যে সব সাংবাদিক এখনো বেঁচে আছেন কিংবা বহুদিন বেঁচে ছিলেন তাদের স্নেহছায়ায় বসে যখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ শুনতাম তখন চোখ অশ্রæসজল হয়ে উঠতো। কোনো কোনো সিনিয়র রিপোর্টারের মুখে শুনেছি বঙ্গবন্ধু নিজের প্লেট থেকে নিজ হাতে মেখে সাংবাদিকদের খাইয়ে দিতেন। কারণ কোনো কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ভোজপূর্বে এমন বিশৃঙ্খলা হতো যে, কর্মরত সাংবাদিকদের ভিড় অতিক্রম করতে কষ্ট হতো এবং অনেক সময় পেটে নিদারুণ ক্ষুধার আগুন নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রেরণ করার দায়িত্ব পালন করতে হতো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ট্যুরে গেলে সাংবাদিকদের ঘুমানোর উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের আগে নিজে ঘুমাতে যেতেন না। এমনকি স্বাধীনতার পর বিপন্ন বাংলাদেশে যখন ব্যাংকে একটি কানাকড়িও নেই, সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে ডেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অর ঋণ দেয়ার জন্য লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান দুটির একটি হলো ‘ইত্তেফাক’ অন্যটি ‘সংবাদ’। অতএব, বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্র বন্ধ করে সাংবাদিকদের পথে বসিয়েছিলেন এমন বক্তব্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তবে যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা সত্যনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণিত হবে তিনি সংবাদপত্র বন্ধ করেননি এবং একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি।
১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু সরকার নিউজপেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স নামে যে আইন পাস করে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাসের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। অনেকেই বলে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু সরকার একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসন কায়েম করেছিল। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ রেখে অন্য সব দলের রাজনীতি বন্ধ করে দিলে একদলীয় শাসন বলা যেতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মূলত বাকশাল নামের একটি জাতীয় প্লাটফর্ম তৈরি করে তার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন এটি একেবারেই একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল লুটেরা ও ধনিক-বণিক নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন। এ জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ ছিল একটি অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলা, যা সাধারণ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে।
কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিউজ পেপার এনামেন্ট অর্ডিনেন্সটি জারি করেছিলেন? এ ব্যাপারে দৈনিক দিনকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় নিবেদিত সাংবাদিকদের নেতা এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের এককালের প্রেস উপদেষ্টা রিয়াজউদ্দিন আহমদ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংবাদপত্রের কালো দিবস পটভূমি ও ঘটনাপঞ্জি শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখার জন্য রিয়াজউদ্দিন সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যতদূর সম্ভব লেখক তার নিবন্ধে কোনো প্রকার মিথ্যাচার করেননি। তবে চতুর বণিকের মতো তিনি যা করেছেন তা হলো সত্য প্রকাশ না করা। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি প্রায় সত্যের কাছাকাছি এসেও শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। অথচ সত্য লিখলে তার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে করি না। বরং একজন সাংবাদিক হিসেবে জাতির কাছে তার যতটুকু দায়বদ্ধতা আছে তা কিছুটা হলেও পূরণ হতো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে জঘন্য মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে তার কিছুটা হলেও লাঘব হতো। অন্যদিকে যে সব ধড়িবাজ লোক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পোশাক জড়িয়ে বর্তমানে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন তাদের মুখোশ কিছুটা হলেও জাতির কাছে উন্মোচিত হতো। তবে এমন কাজটি রিয়াজ সাহেব কেনই বা করতে যাবেন?
রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে তৎকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। জুন মাসে অকস্মাৎ বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা। দেশে খাদ্যাভাব, মানুষের কাজ নেই, দ্রব্যমূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তিনি আরো লিখেছেন, ১৯৭৮-এর শেষ দিকে দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে শুরু করে। কঙ্কালসার মানুষে শহর ভর্তি। শোনা গেল একটি খাদ্যশস্য ভর্তি জাহাজ মধ্য সমুদ্র থেকে অন্য একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটি আসছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিউবার কাছে পাট বিক্রি করার অপরাধে এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তি। রিয়াজউদ্দিন আরো লিখেছেন, এ দুর্ভিক্ষের খবর সংবাদপত্রগুলো নির্ভয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ছাপতে শুরু করে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা মানুষ মানুষের বমি খাচ্ছে এমন ছবি ছেপেছে। ইত্তেফাকে ছাপা হয় বাসন্তি নামে এক মহিলার ছবি, কাপড়ের অভাবে যে মাছ ধরার জাল জড়িয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করেছিল। (যদিও পরবর্তী সময়ে জানা যায়, এটি ছিল একটি বানোয়াট ছবি)। এরপর তিনি আবার লিখেছেন, সোভিয়েত বিরোধী আন্তর্জাতিক মহল দুর্ভিক্ষের পর থেকে শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ শুরু করে। দেশের ভেতর জাসদ, সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা সাহেবরা গোপনে সরকারের ওপর প্রচণ্ড মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সরকারও মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যা, সঙ্গত কারণেই শাসক দলের লোকই মারা গেল বেশি।
জাতির জনক কেবলমাত্র দেশের মানচিত্র, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা বদলানোর জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। কিংবা দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যও তিনি তার গোটা যৌবনকাল কারাগারে কাটাননি। এটা চাইলে তিনি গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। এ কথা অবশ্য সবার জানা। রিয়াজউদ্দিন সাহেবের লেখাকেই যদি বস্তুনিষ্ঠ ধরা হয়, তবে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে দেশের এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে বাঁচানোর জন্য সামাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ বঙ্গবন্ধুর জন্য খোলা ছিল না। এ কারণেই তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এবার সংবাদপত্র বাতিলের বিষয়টিতে আসা যাক। জনাব রিয়াজউদ্দিন এক স্থানে লিখেছেন, এমন সময় আমরা সংবাদপত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা বলেন। এরপর রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু সেদিন জাতিসংঘ ও ইরাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে সব কথা বলেন, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। কিন্তু সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন সেদিন সাংবাদিকদের জন্য এবং সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল। তবে আমরা অনেকেই জানি সেদিন কী কী বিষয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রিয়াজউদ্দিন সাহেব ছাড়াও সেদিন বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতাদের মধ্যে নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানীসহ অন্য নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা দেশে তোদের (আদর করে করে বঙ্গবন্ধু এভাবেই সম্বোধন করতেন) মোট সাংবাদিক সংখ্যা কত? নেতারা বলেছিলেন ৭-৮শ’র মতো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার তো কমপক্ষে সারা দেশে ৮-১০ হাজার সাংবাদিক দরকার হবে এবং প্রতিটি সাংবাদিককে হতে হবে চিত্তবিত্তে, জ্ঞান গরিমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষিত, মার্জিত, মননশীল ও সুকুমার বৃত্তিতে যারা শ্রেষ্ঠ তারাই থাকবে এ মহান পেশায়। এ কথা শুনে সাংবাদিক নেতারা আবেগাপ্লুত চিত্তে বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বললেন, আমি চাই দেশে থাকবে প্রচুর সংখ্যক অর্থবহ সংবাদপত্র। উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইত্তেফাকে প্রকাশিত দেশ-বিদেশের সংবাদ পড়ে আমার দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না। তোমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে আমার বিশাল বাংলার গাঁও-গ্রামের কোনো খবর থাকে না। শোন, আমি ইতোমধ্যেই তোদের পেশার সিনিয়র লোকদের সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি আমূল বিপ্লব সাধন করতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমার সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো হবে-
এক. দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা ও ইংরেজিতে। এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা, যাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতি পাবে সঠিক পথনির্দেশক। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে থাকবে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার। দুই. প্রতিটি পেশার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেমন শ্রমিকদের জন্য শ্রমবার্তা, কৃষকদের জন্য কৃষিবার্তা, মহিলাদের জন্য মহিলাবার্তা, যুবকদের জন্য যুববার্তা, ছাত্রদের জন্য ছাত্রবার্তা, শিশুদের জন্য শিশুবার্তা প্রভৃতি। এ সব পত্রিকায় সংক্ষেপে জাতীয় বিশ্ব সংবাদ ছাপার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশার সব প্রকার সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোচনা থাকবে এসব পত্রিকায়। তিন. তোরা জানিস সংবাদ হলো পচনশীল দ্রব্য। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে সংগঠিত সংবাদ শহর বন্দর পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে আসতে পচন ধরে যায়, খবরের পাপড়ি ঝরে যায়, কলি যায় শুকিয়ে। তারপর পত্রিকা অফিসে যখন পৌঁছে তখন এডিটর সাহেব পাঠিয়ে দেন সংবাদ ডেস্কে। পান চিবাতে চিবাতে মফস্বল অডিটর সাহেব সেই শুকনো কলি ফেলে দেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আর যদি কখনো ছাপা হয় বড় জোর দুই তিন লাইন। গত আগস্টে শৈলক‚পায় স্বামীর প্রহারে স্ত্রীর মৃত্যু অথবা ভাণ্ডারিয়ায় স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা। কিন্তু আর কোনো সংবাদ নেই। আমি চাই দেশের ৬২টি জেলার সবকটিতে দৈনিক পত্রিকা থাকবে। বরিশাল বার্তা, চট্টগ্রাম বার্তা, রাজশাহী বার্তা, বগুড়া বার্তা, দিনাজপুর বার্তা প্রভৃতি। চার. প্রতিটি জেলার নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও থাকবে জাতীয় আদলে প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে আকর্ষণীয় বেতন ভাতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ. তাদের সঙ্গে এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা জাতীয় দৈনিক হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদ সংস্থা সম্পর্কেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ছয়. নির্বাচিত পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থা ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেখানে কর্মরত সব সাংবাদিক ও অন্য কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাবেন। এ জন্য সাংবাদিক কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন ভাতা নিয়ে আসবেন। সাত. চাকরিহীন সাংবাদিকদের নাম তালিকাভুক্ত এবং তাদের বেতন ভাতা নির্ধারণ করার জন্য তোদের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হবে।
উল্লেখ্য, রিয়াজ উদ্দিনের প্রবন্ধের ভাষায়, আমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ভয় নেই, যে সব কাগজ থাকবে না সে সব কাগজের সাংবাদিকরা সরকারি চাকরি পাবে। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ট্রেজারি থেকে ভাতা দেয়া হবে। একই নিবন্ধের অন্যত্র রিয়াজ ভাই লিখেছেন, ১৬ জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো। ঘোষণার নাম নিউজ পেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিনেন্স। এর আওতায় দেশে মাত্র ৪টি পত্রিকা থাকলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা আর বাংলাদেশ টাইম। যে সব কাগজ বন্ধ হলো সেগুলোর সব সাংবাদিক কর্মচারীদের চাকরি সরকারের হাতে ন্যস্ত হলো। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ভাতা দেয়ার বিধান রাখা হয়। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মো. খালেদ এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী। এবার আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক নেতাদের আলোচনায় ফিরে আসি। সাংবাদিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছিল তার কথা বলতে গিয়ে রিয়াজ সাহেব শুধু ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন সে কথা বলেই প্রসঙ্গটির ইতি টানেন। তিনি বেমালুম চেপে যান বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার কথা। সংবাদপত্রের সঙ্গে সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনেও যে বিপুল সংখ্যক মেধাবী সাংবাদিকের প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে ইউনিয়ন নেতারা আশ্বস্ত করেছিলেন এবং এই বলে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে যে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে সেখানে পূর্ণাঙ্গ স্নাতক ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স এবং প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, বিদেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবাদিক সৃষ্টি করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু নেতাদের এ সব সুপারিশ ত্বরিত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। বিশেষ করে সাংবাদিক নেতারা তৎকালীন সংবাদপত্র শিল্পে বিরাজমান করুণ অবস্থা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, হাতেগোনা ২/৪টি সংবাদপত্র ছাড়া কোথাও নিয়মিত বেতন ভাতা প্রদান করা হয় না। আলু-পটলের ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধান্ধায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে ব্লু্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সাংবাদিকদের একটি আইডি কার্ড ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয় না। অনেক গ্রামীণ সাংবাদিক কেবল কলাটা-মুলাটা নিয়ে এ মহান পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দেশের সব শ্রেণির সংবাদপত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এক বিরাট বিপ্লব সাধন করবে বলে সাংবাদিক নেতারা মত প্রকাশ করেন। এতে দেশের মেধাবী মুখের সন্ধান পাওয়া যাবে পত্রিকা অফিসগুলোতে। এ পরিকল্পনার জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানান। তারা এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালে যোগদানের আকাক্সক্ষাও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিনসহ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক বাকশালে যোগদানের জন্য আবেদন করেন।
আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার সুবাদে আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। একদিন তার বাসায় নৈশভোজের দাওয়াতে গিয়ে দেখি আমাদের প্রিয় ফয়েজ ভাই (ফয়েজ আহমদ) ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। কথায় কথায় সেদিন বন্ধ হওয়া পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের তালিকাসহ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনায় আসে। অধ্যাপক খালেদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এ তালিকা প্রস্তুতির প্রশ্নে কোনো প্রকার মতপার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনায় আনিনি। তদুপরি যারা মাত্র ৮০ থেকে ১১০ টাকা মাইনে পেতেন (অনিয়মিত), তালিকা প্রস্তুতকালে তাদের বেতন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লেখা হয়েছিল। গিয়াস কামালসহ আমরা সবাই একমত হলাম যে, টাকাটা যখন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় ট্রেজারি থেকে দেয়া হবে তখন থাক না একটু বেশি অঙ্কের হিসাব। যাই হোক সেই প্রস্তুত করা তালিকা হিসেবে দেশের সব সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারী সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাতের দিন পর্যন্ত দেশের সব সংবাদপত্রসেবী এ বেতন ভাতা ভোগ করেছেন।
সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস কামাল চৌধুরীর মুখে শুনেছিলাম যে, তারা একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, দেশ সদ্য স্বাধীন, অর্থনৈতিক সংকট, অভাব-অনটনে আপনার সরকার জর্জরিত, এ সময় কাজ না করে প্রতি মাসে ট্রেজারি থেকে বেতন আনতে অনেক সাংবাদিকের মনে হোঁচট লাগে, আপনি আমাদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করুন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে তাদের সামনেই নির্দেশ দিয়ে দিলেন- সব অফিসের শূন্যপদে সাংবাদিক নিয়োগ দাও। তাই হয়েছিলও। সদ্য স্বাধীন দেশে খাদ্য, শিপিং, ওয়াপদা, কাস্টমসহ বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে সাংবাদিকদের আত্মীকরণ করা হয়েছিল। কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো একজন রাষ্ট্রপ্রধানই বলতে পেরেছিলেন, একজন সাংবাদিকও বেকার থাকবে না। যতদিন চাকরি না হয় ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসবে। পৃথিবীর কোনো ধনতান্ত্রিক, সামাজতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান দেশের একটি গোটা পেশাজীবী সম্প্রদায়কে এভাবে ট্রেজারি থেকে বিনা কাজে বিনা চাকরিতে বেতন নিয়ে আসতে বলতে পারেননি। এই দুঃসাহস কেবল বঙ্গবন্ধু দেখাতে পেরেছিলেন। আর আজ কতিপয় ধান্ধাবাজ এ বলে মেকি ইতিহাস তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু সব সংবাদপত্র বন্ধ করে সব সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। মিথ্যাচারের অভিযোগে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে এবং সেদিন খুবই নিকটবর্তী।
আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া : সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাসস।

সুশাসন ছিল ব্রিটিশ আমলে ও সামরিক শাসনকালে ॥ নির্বাচিত সরকার তা ধ্বংস করেছে’ ?

নিউইয়র্কে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নয়া তত্ত্ব
তারিখ: ১০/০৬/২০১৫

আবদুল মালেক
উত্তর আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্ক নগরের বাংলাদেশী কমিউনিটি বছরজুড়ে মেতে থাকে নানা উৎসব-আনন্দে। আর নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ থেকে আগত সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র শিল্পীরা তাতে সঞ্চার করেছেন নতুনপ্রাণ। এছাড়া অনেক প্রবাসী আছেন যারা শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানাদির মুগ্ধ দর্শক হতে রাজি নন। সেইসঙ্গে তৃপ্ত হতে চান দেশের সম্মানিত প-িত মানুষের দর্শন লাভে ও তাদের মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শ্রবণ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ অনুষ্ঠান বা সম্মেলনে প্রায়ই লেখক, সাহিত্যিক ও গুণীজনদের শুভ পদার্পণ ঘটে থাকে।
 বিশ্বায়নের এই কালে বাংলাদেশও হাতের নাগালেই এসে গেছে। দুপুর ১২টা-১টার মধ্যে অনলাইনে আগাম দেশের খবরের কাগজ হাজির। রসগোল্লা আর ইলিশ মিলছে হয়ত কারও এলাকার মোড়ের দোকানেই। টিভির বাংলাদেশী চ্যানেলে অধিকাংশ বাংলাভাষী মানুষের গৃহে সকাল-সন্ধ্যা গান-নাটক-খবর চলছে। সেখানে নানা অনুষ্ঠান উপভোগের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই নামী-দামী ব্যক্তিদের দেখা ও বক্তব্য শোনার সুযোগ পাই। কিন্তু চর্মচক্ষুতে সেলিব্রেটিদের দেখা পাওয়া ও স্বকর্ণে তাদের বক্তব্য শুনতে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সেই সৌভাগ্য লাভ করতে গিয়ে কখনও দুর্ভাগ্যকেও বরণ করতে হয় বৈকি!
সম্প্রতি (২২-২৪ মে) মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউইয়র্কে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা হয়ে গেল। উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সবাই জানেন, তিনি সুদীর্ঘ সময় ধরে বই পড়া এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ার প্রশংসনীয় একটি আন্দোলন করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক সায়ীদ ছাড়া বইমেলার সুযোগ্য প্রধান অতিথি আর কেইবা হতে পারেন!
প্রবাসের অনুষ্ঠানে সাধারণত আলোচনাগুলো দুপুরে সেমিনার কক্ষের একান্তে এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ বিকেলের মঞ্চে হয়ে থাকে। এরপরই যাকে বলে উৎসবের প্রাইম টাইম। ওই সময়টিতে নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্য ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করে মানুষ। দেশ থেকে আগত প্রকাশনা সংস্থার স্টল থেকে বইপত্র, সঙ্গে নানাবিধ দেশী পণ্য কিনে, ঝালমুড়ি-চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে সন্ধ্যার পর শিশুদের হাত ধরে তখনই হলে প্রবেশ করে পরিবারগুলো।
 কিন্তু এ বছর আলোচনার প্রধান বক্তা অধ্যাপক আবু সায়ীদ, সঙ্গে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও কলকাতা থেকে আগত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো সম্মানীয় বক্তাদের কারণেই হয়ত কর্তৃপক্ষ প্রাইম টাইমের বিনোদনমূলক সময়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছিলেন তাঁদের। তাছাড়া প্রধান বক্তা কেবল একজন সুবক্তাই শুধু নন, মানুষ গড়ার কারিগরও বটে। মানব হৃদয়ের অন্ধকার দূর করার ব্রত নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। কিন্তু তাঁর দু’দিনব্যাপী বক্তব্য (প্রথম দিন বক্তৃতা ও দ্বিতীয় দিন প্রশ্নের উত্তর) শোনার সৌভাগ্যটি যে পরিণত হবে দুর্ভাগ্যে সেটি আমি ও অনেক প্রবাসী কল্পনাও করিনি।


 অবশ্য ইদানীং দেশের খবরের কাগজে তাঁর রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু কথা নজর কাড়ছিল। কিন্তু তিনি যে হাটুরে রাজনীতিকদের ভাষায় আমাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন সেটা ছিল ভাবনার অতীত। তিনি বললেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে। জাতীয় জীবনে আমাদের অবস্থা এখন মাৎস্যান্যায়ের মতো বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলছে। অধ্যাপক আবু সায়ীদ বক্তব্য রাখছিলেন বাংলাদেশের সুশাসন প্রসঙ্গে।
 যদিও দেশে তাঁর সঙ্গে কখনও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি, কিন্তু প্রবাসে এসে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ডালাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে বেশ কিছু বিদগ্ধজন ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একই মঞ্চে। বাইরেও হয়েছে নানা আলাপ-আলোচনা, কথা-গল্প, হাসি। পরবর্তীতে সাংবাদিকতার সুবাদেও নিউইয়র্কে অনেকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে, কথা হয়েছে। সেসব দিনে তাঁর চমৎকার সান্নিধ্যের কথা এখনও মনে পড়ে।
 কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তিনি যখন বললেন, বাংলা নামক দেশটিতে নাকি কখনই কোন সুশাসন ছিল না, কেবলব্রিটিশ রাজত্বের দিনগুলো ছাড়া, তখন হতচকিত না হয়ে উপায় ছিল না। গল্পচ্ছলে অধ্যাপক সায়ীদ বললেন, সে আমলে বাংলার বনে-জঙ্গলে যদি একটা ভূতও কোন মানুষকে তাড়া করত, আর সে যদি ছুটতে ছুটতে ব্রিটিশ রাজের তৈরি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠতে পারত, তবে পালানোর পথ পেত না সে ভূত। কারণ রাস্তায় ছিল ব্রিটিশের থানা পুলিশ! এরপর অবশ্য সকৌতুকে বললেন, যদিও পুলিশ কর্তাদের একটু ঘুষ-টুস খাবার সুযোগ তারা করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক আবু সায়ীদের মতো মানুষের মুখে এই নব ইতিহাস রচনা স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। নিউইয়র্কের প্রতিটি সাপ্তাহিকীতে তাঁর বক্তৃতার এমন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো কমবেশি খবর হয়েছে।


 সত্যি বলতে কি, আমি একজন বিজ্ঞ মানুষের মুখনিসৃত এমন বক্তৃতার সুরে বারংবার হতভম্ব হয়ে পড়ছিলাম। তাহলে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে ইতিহাস লেখাপড়া করেছিলাম তার পাতায় পাতায় কি সবই ভুল! দুনিয়াজুড়ে ব্রিটিশ রাজের অত্যাচার ও লুটতরাজের কথা তো দেশে দেশে ইতিহাসের অধ্যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তরুণ ব্যারিস্টার গান্ধীকে শুধু ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার যাত্রী হওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠি পেটার কাহিনী তো আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইতেই ছিল। অসংখ্য নির্যাতন-নিপীড়নের আরও অনেক ইতিহাস নিশ্চয়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুস্তকাদিতেও আছে। নেই কি জালিয়ানওয়ালাবাগে সমবেত নিরীহ মানুষের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের বর্বর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নাইটহুড' উপাধি ত্যাগ করার ইতিহাস? সে সময় নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনী, যা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীল দর্পণ’ নাটকে বর্ণনা করেছেন, সে নাটকের বইটিও কেন্দ্রে আছে বলে বিশ্বাস করি। আজ অবধি কোন ব্রিটিশ দালালও এসব মিথ্যে বলে দাবি করেনি। পুস্তকের সঙ্গে পুস্তক পাঠের জন্য আন্দোলনকারী শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদের এই মতামত কি এখানে সাংঘর্ষিক হচ্ছে না?

ব্রিটিশ জমানারই মানুষ আমাদের পিতা-প্রপিতামহ তাদের সময়ের পুলিশকুলের অত্যাচার সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমাদের কাছে দিয়ে গেছেন সেটা তো প্রবাদ বাক্যেই স্থান পেয়েছে! তাদের কাছ থেকেই শুনেছি, মাথায় লাল রঙের পাগড়ি পরতেন বলে তখন আমজনতার কাছে পুলিশের নাম ছিল লালপাগড়ি। বলাবাহুল্য, তারা ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে আসতেন আসামির সন্ধানে। কোন গ্রামের কোন দূর প্রান্তে ঘোড়ার খুরের শব্দের সঙ্গে লাল রং দেখা গেলেই প্রাণভয়ে নির্বিচারে মানুষ পালিয়ে শূন্য করত গ্রামের পর গ্রাম। কারণ দোষী হোক বা নির্দোষ হোক গ্রামবাসী কাউকে পাওয়া মাত্রই শুরু হতো বেদম প্রহার। হান্টার দিয়ে কমপক্ষে আঠারোটা ঘা না মেরে পুলিশ ছেড়ে দিত না। ওই সময়েই সে প্রবাদটা তৈরি হয়েছিল, যা আজও প্রচলিত ‘পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা!’
অধ্যাপক সাহেব কণ্ঠে মুগ্ধতা এনে নাটকীয়ভাবে আরও যোগ করলেন, কি সুসভ্য এই ব্রিটিশ জাতি, কি অতুলনীয়, কত প্রাচীন তাদের সভ্যতা! এই বক্তব্যের উত্তরে আমার বলতে ইচ্ছে করেছিল, বটেইতো বটেইতো- বিশ্বজুড়ে তারাই তো সত্যিকারভাবে মানবসভ্যতার ধারক এবং বাহক! কিন্তু ওই পুস্তকগুলোই বাঁধিয়েছে যত গোল। কারণ সেখানেই তো লেখা রয়েছে সুদূর আফ্রিকা থেকে কিভাবে জন্তুর মতো খাঁচায় পুরে কালো মানুষদের ধরে এনেছিল ব্রিটিশ বেনিয়া দল। জাহাজে করে দেশে দেশে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে কিভাবে ফুলে ফুলে বিকশিত হয়েছিল ব্রিটিশ অর্থনীতি তথা সিভিলাইজেসন! অধিকৃত দেশগুলোর যেখানে যত সম্পদ ছিল সবই লুট করে নিয়ে গেছে তারা। ভারতবর্ষ থেকে কোহিনূর মুকুট, ময়ূর সিংহাসনসহ যাবতীয় হীরামণিক্য আজও ভোগ করে চলেছে ব্রিটিশ রাজবংশ। তাদের হাতে মেসোপটেমিয়ার সুপ্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস আর লুটপাটের ঘটনা তো ঘটে গেল আমার-আপনার চোখের সামনেই। ক্যাকটাসের ফুলের মতো ব্রিটিশ জাতির নিঃসন্দেহে অনেক নয়নমনোহর দিক আছে। কিন্তু ফুলের নিচে ভয়ঙ্কর কাঁটাগুলো দুনিয়া এড়াবে কিভাবে?


বন্দনার পর্ব শেষ করে অধ্যাপক সাহেব এরপর শুরু করলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে, ‘ইংরেজ শাসনের অনেক ভাল দিক ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা সুশাসনের বেশ কিছু ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে যায়। ব্রিটিশরা যেটুকু সুশাসনের ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেটুকু ধ্বংস করে দিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে চলছে মোড়লি শাসন। এই পদ্ধতিতে দেশ চালাতে গিয়ে আমরা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সুশাসনের ব্যবস্থাগুলোও ধ্বংস করে দিয়েছি।’


জানার ইচ্ছা জাগে, পাকিস্তান সময়েও কি সেই ব্যবস্থা অক্ষত ছিল? আইয়ুব-ইয়াহিয়ার খানের সামরিক শাসন আমলেও? আর মোড়লি ব্যাপারটার মাথামুন্ডু আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সাংবাদিকতা পড়া বিদ্যায় কিছুতেই কুলিয়ে উঠছে না। আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে। সেসব প্রতিনিধি তথা মোড়লই তো জাতীয় সংসদে বসে রচনা করলেন দেশ শাসনের জন্য পবিত্র সংবিধান। এরপর রচিত নয়া সংবিধানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে। অবশ্য জ্ঞানী শিক্ষাবিদ প্রশ্নোত্তরে বলেই দিয়েছেন, ‘দেশ ধ্বংসের মূল কারণ আমাদের ওই সংবিধান এবং দুই দল।’ শেষে যদিও একটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করলেন, ‘সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট না দেয়ার ধারাটি পরবর্তীকালে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে,'এটাই দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা রয়েছি স্বৈরশাসনের মধ্যে। নব্বই সালের পর যে নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মধ্যে প্রবেশ করেছি এটা সামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে আরও ভয়াবহ।’ তিনি উষ্মার সঙ্গে বারবার বলেন, ‘একবার এ দল আসে, আরেকবার ও দল, হয় হাসিনা, নয় খালেদা।’
তিনি নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইলেন, ’৭৫ থেকে নব্বই পর্যন্ত অভ্যুত্থান, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জিয়া থেকে এরশাদ নামে যে সব শাসকের আবির্ভাব, গণতন্ত্রের চাইতে তাদের পদ্ধতি উত্তম! তাহলে সেই বন্দুকের নলই কি ক্ষমতার একমাত্র উৎস হবে দেশে।


 সেদিন অধ্যাপকের কাছ থেকে সুশাসন সম্পর্কে এমন সম্যক জ্ঞানলাভ করার পরও অদ্যাবধি কেন যেন আমার অজ্ঞানতা ঘোচেনি। সুশাসনের তত্ত্ব বা থিওরি কখনও সাধারণ মানুষও জানতে চায় না। একদিন এই ভূখন্ডের অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে চাওয়া ছিল লবণ দিয়ে একমুঠো ভাত। সেই কোন্ যুগে ঈশ্বরী পাটনী যে দেবীকে নদী পার করিয়ে দেয়ার আশীর্বাদ হিসেবে প্রার্থনা করেছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ যুগ-যুগান্তরব্যাপী এমনকি ব্রিটিশের মহাসুশাসনকালীনও সে স্বপ্নপূরণ ছিল কল্পনাবিলাস। বরং সেই ব্রিটিশ আমলের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের কাহিনী দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে ফিরেছে বারবার। অথচ আর কি আশ্চর্য, দরিদ্র শিশুর দুধ-ভাত খাওয়ার সেই আশীর্বাদ আজ গ্রামগঞ্জের দিকে দিকে। ক’দিন আগেই দেশের সংবাদপত্রে পড়লাম মঙ্গার জন্য বিখ্যাত রংপুরের গঙ্গাচড়া দিয়ে যেতে যেতে এক সাংবাদিক দেখছেন চারদিকে মাঠে মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে শত শত গরু-ছাগল। একদা হতদরিদ্র সুশীলার শিশুসহ গ্রামের অন্য শিশুরা স্বপ্নের দুধ-ভাত খেয়ে ভরে উঠছে স্বাস্থ্যে-আনন্দে! শিশুদের খাইয়ে অবশিষ্ট দুধ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে বহু নারী। এরকম আরও ভিন্ন ভিন্ন অভাবিত ঘটনাগুলো যখন ঘটে চলছে দেশের সর্বত্র অধ্যাপক আবু সায়ীদ সাহেবের ভাষায় ‘বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে।’

 

Tuesday, March 31, 2015

এই 'বোকা মানব' টি কে কারা হত্যা করলো? সুমি খান

"গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।" 'বোকা মানব' নামে একটি ব্লগে নিজের সম্পর্কে এভাবেই আত্মবিশ্লষণ করেছিলেন ওয়াশিকুর বাবু ।অভিজিতের হত্যা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো ।নিজের ফেসবুকে তাই বাবু কভার ফটো করছিলো, 'আমিই অভিজিৎ'
 
আত্মবিশ্লেষনে নিজের সম্পর্কে ব্লগে প্রকাশিত একটি লেখায় ক্ষণজন্মা ওয়াশিকুরের গভীর অনুধাবন ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছর বয়সের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
এখন প্রশ্ন , এই 'বোকা মানব' টি’কে কারা টার্গেট করলো?কারা এই ঘাতক?
 চট্টগ্রামের  দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার তফসির বিভাগের ছাত্র জেএমবি জঙ্গী জিকরুল্লাহ কে শনিবার রাজধানীতে আসতে কে  নির্দেশ দিয়েছিলো?  যে 'বড়ো ভাই' মাসুম  রবিবার বিকেলে হাতির ঝিলে তাহের ,আরিফুল এবং জিকরুল কে ডেকে তিনটি চাপাতি দেয়  এবং  ওয়াশিকুর বাবুর ছবি দেখিয়ে বাবুকে হত্যার 'ঈমানী দায়িত্ব'দেয়, তার প্রকুত পরিচয় কী?? এ প্রশ্ন খুঁজে ফিরছেন গোয়েন্দারা ।
নিহত ওয়াশিকুরের চোখ এবং মুখ বরাবর সমান্তরাল দুইটি কোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুখমন্ডলের দুইটি অংশ। পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা নিহত ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ, নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
 প্রশ্ন উঠেছে কেন এবং কোথা থেকে নিরীহ, শান্ত  তরুণ ওয়াশিকুরকে খুন করার নির্দেশ এসেছে ? যাঁকে হত্যা করা হলো, তিনি কোথায়, কী লিখেছেন? কিছুই জানা ছিল না খুনিদের।
‘ধর্মের অবমাননা’ করেছে এমন অভিযোগ এনে ওয়াশিকুর এর ছবি দেখিয়ে,তার বাসার পথ চিনিয়ে  তাকে হত্যা করার জন্যে ঘাতকদের হাতে চাপাতি তুলে দেয়া হয়েছে । আর সেটা দিয়ে কুপিয়ে নিরীহ এক তরুণকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিঃশঙ্ক চিত্তে  নির্বিঘ্নে  হত্যা করেছে তিন তরুণ। প্রথম চাপাতির কোপ দেয় তাহের। দ্বিতীয় চাপাতির কোপ দেয় জিকরুল।এর মধ্যে জনরোষের মুখে  আরিফুলের চাপাতি আর ব্যবহার করা হয়নি।দুই কোপেই ব্লগার ও অনলাইন লেখক ২৭ বছরের তরুণ ওয়াশিকুর রহমানের চোখ এবং মুখ বিভক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । ওয়াশিকুরকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া দু'জনের একজন জিকরুল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা হাজতে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে  একথা জানায়।
 
 টেলিভিশনের স্ক্রলে ওয়াশিকুর বাবু হত্যার সংবাদ জেনে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের অনেকে  ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে  উপস্থিত হয়েছেন । সোমবার দুপুর থেকে লাশ বাড়িতে নেয়া পর্যন্ত বসেছিলেন তাদের একজন ওয়াশিকুরের পাতানো বোন তামান্না সেতু । এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন,  তার শুক্র এবং শনিবার অফিস খোলা, ওয়াশিকুরের সেদিন আফিস বন্ধ। তাই অনেক;ইন দেখা হয় নি। ২৫ মার্চ শেষবারের মতো তার সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় ওয়াশিকুরের সাথে। সেদিন ওয়াশিকুর খুব বলছিলো, "দিদি, ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে খুব। আপনি কবে সময় দেবেন, আপনার সাথে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে অনেক ।" ভাই হারানোর শোকে  শোকাহত সেতু  বলেন," সেদিন কেন যেন কোন রিপ্লাই দেয়া হয় নি। আর কখনো আমার কাছে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চাইবে না বাবু, এটা কী করে ভাবা যায়? " তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর ফেসবুকে আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা ১০৩ পর্ব পর্যন্ত লিখেছেন। ওই লেখায়  ওয়াশিকুর বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যারা করে , তাদের  খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন । তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন, ‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে।  তামান্না সেতুর দু'চোখে জলের নীরব ধারা। বললেন,‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।
 
 হত্যার ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ী দীপিকার মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুরকে। জিকরুল্লাহ, আরিফুল এবং তাহের এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলচে ফুলশার্ট ও জিনস পরিহিত ওয়াশিকুর দীপিকার মোড়ের দিকে যেতেই গলির মধ্যে তিনজন লোকের মধ্যে দুজন তাকে অতর্কিতে কোপাতে শুরু করে। পাশেই কয়েকজন হিজড়া দাঁড়ানো ছিলো।কয়েকজন নারী সহ হিজড়ারা চিৎকার করতে থাকেন । 'কোপাইয়া মাইরা ফেললো, কোপাইয়া মাইরা ফেললোচিৎকার শুনে হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই চাপাতি ফেলে দৌড় দেয়। এ সময় হিজড়ারা ঘাতকদের পিছু ধাওয়া করে। এলাকার লোকজনও ধাওয়া করে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল টহল দিচ্ছিলো।তারাও দৌড়ে ধাওয়া করে। হিজড়ারা প্রথমেই জিকরুল্লাহকে ধরে ফেলে। এরপর জনতা ও পুলিশ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ব্যাগসহ আরিফুলকে ধরে ফেলে। খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁরা লাল পোশাক পরে হত্যা করতে যায়। জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিন্স, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেকটি গেঞ্জি ছিল। চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবি ছিল।  পোশাক বদলে সাধারণ মানুষের সাথে  মিশে যাওয়ার জন্য কৌশল করে দুই স্তরের পোশাক পরেছিলো তিন ঘাতক। ঘটনাস্থলে থাকা দু'জন হিজড়া, স্থানীয় ব্যক্তিরা ও পুলিশ ধাওয়া করে দু'জনকে ধরে ফেলে। ঘাতকদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর কোঠায়।
বিজ্ঞানগবেষক অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে  প্রত্যক্ষদর্শী  ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে  জামায়াত নেতা এবং জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের  প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ । মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৫ নভেম্বর ২০১৩ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়ির সামনে  একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর আনসার বাংলা সেভেননামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই সনাক্ত করতে পারে নি।
 
ওয়াশিকুর বাবুর তিন ঘাতকের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দু'জনের মধ্যে জিকরুল্লাহ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র ,আরিফুল রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানায়। জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। জিকরুল্লাহ কখনো ওয়াশিকুরকে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও জানে না। তাদের 'বড়ো ভাই'  মাসুম ভাইয়ের কথাতেই তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে।। তাঁরা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কোনো দল নাই।তাদের 'বড়ো ভাই' বা 'মাসুম ভাইয়ের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানে না বলে জিকরুল্লাহ।
 
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিকরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তার পূর্বপরিচিত মাসুম ভাইর কথামতো শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে এক মাদ্রাসায়  রাত কাটায়। রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে  ডেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার দিকনির্দেশনা দেয় তাদের মাসুম ভাই  জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাহের মিলে প্রথম বারের মতো তখন আলোচনা হয়। সহযোগী ঘাতক আরিফুল এবং  তাহেরকে চিনতোনা জিকরুল। হাতির ঝিলেই তাদের প্রথম দেখা। ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে মাসুম তাঁদের  বলে, এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছে, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাকে হত্যা করতে হবে। এরপর মাসুম তাদের নিয়ে হাতিরঝিলের কাছাকাছি দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেন।
 
ওয়াশিকুর কখন বাসা থেকে অফিসে যান, কোন্ দিক দিয়ে কীভাবে হামলা করা হবে, সেসব বুঝিয়ে দেয় 'মাসুম'। ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা চিনে নেয় ঘাতকেরা। মাসুম তাঁদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেয়।
 
'মাসুম' এর  নির্দেশনা অন্ধের মতো অনুসরণ করে  মাথায় সাদা টুপি পরে সোমবার সকালে তিন ঘাতক রাজধানীর দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেয়। ওয়াশিকুর অফিসে যাবার পথে  জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি বের করে কোপ দেয়। আরিফুল চাপাতি বের করার আগেই স্থানীয় মানুষ ধাওয়া দেয়। চাপাতিসহ ব্যাগ পিঠে ছুটে পালাবার সময়ে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সূর্যবার্তা টোয়েন্টিফোরকে বলেন,   ওয়াশিকুরের লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই হত্যার ধরনের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার হত্যার মিল রয়েছে মনে করছে পুলিশ ।
 
নিহত ওয়াশিকুর বাবু  লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের টিপু সুলতানের একমাত্র পুত্র। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ২০০০ সালে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে যায় । ওয়াশিকুর বাবু তার বাবার সাথেই থাকতো।২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন।তেজগাঁও কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক  করে  মতিঝিলে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি করতো। এই প্রতিষ্ঠানে ওয়াশিকুরের খালা চাকরি করতেন । তিনিই ওয়াশিকুর কে এই চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সামান্য বেতনের চাকুরে ওয়াশিকুর তার বাবার সাথে  দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে  ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন।। ওয়াশিকুরের অফিস যেতে দেরি দেখে ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকে ওয়াশিকুরের মোবাইলে ফোন করলে পুলিশ রিসিভ করে সেই ফোন। এর পর ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকেই বাবুর খালাকে ফোন করে বাবুর নিহত হবার সংবাদ জানায়। সেই সংবাদ শুনে আত্মীয় স্বজন মর্গে ছুটে আসেন। সোমবার সকালেই বাড়ি গেছেন ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান। ছেলে হত্যার সংবাদ শুনে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন টিপু সুলতান। এ কারণে তাঁর আর রাজধানীতে আসা সম্ভব হয়নি। একমাত্র পুত্রের প্রাণহীণ দেহ গ্রামে  নেবার জন্যে জামাতাকে রাজধানীতে পাঠিয়েছেন তিনি।