Friday, October 4, 2013

জামাত নিষিদ্ধ করতে হবে- এদেশে তাদের রাজনীতি করার কোন সুযোগ দিতে পারো না তোমরা- জামাত প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর পুত্র ফারুক মওদুদী



বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছে যে জামায়াতে ইসলামী, সেই দলটি স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও কীভাবে এ দেশে রাজনীতি করতে পারে? প্রশ্ন তুলেছেন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আ'লা মওদুদীর ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী। তিনি মনে করেন,জামাত নিষিদ্ধ করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। তোমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হামাত সহ চারটি দলকে নিষিদ্ধ করেছিলো। সেটাতে ফিরে যেতে হবে তোমাদের আবার।" তিনি ক্ষুব্ধ প্রশ্ন তোলেন," কিসের ভয় এতে?"
শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে ফারুক মওদুদী আরো বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সে দেশে জামায়াত সুবিধা করতে পারেনি। দলটি হাল ফিরে পায় ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময়। সামরিক সরকার দলটিকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করে। উর্দুভাষী ফারুক মওদুদী ইংরেজী ভাষা কে ঘেন্না করেন। ঘেন্না করেন ইংরেজ দের-যাদের ষড়যন্ত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় জঙ্গীবাদের জন্ম ।
ইসলামি চিন্তাবিদ ফারুক মওদুদী ঢাকায় বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে ‘ধর্ম ও রাজনীতি: দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক গণবক্তৃতা ও দুই দিনের সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি বলেন, উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর নয় সন্তানের কেউ-ই জামায়াতের রাজনীতিতে জড়াননি। তাদের পিতা নয় সন্তানের কাউকে মাদ্রাসায় পড়ান নি , জামায়াতের রাজনীতি থেকে ও দূরে থাকতে বলেছেন।
ফারুক মওদুদী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সুবিধাবাদী চরিত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ধর্মকেন্দ্রিক যত সহিংসতা হয়, সেখানে জামায়াতের কোনো নেতার সন্তান আছে বলে কি খবর পেয়েছেন? জামায়াতের নেতারা তাঁদের সন্তানদের কোনো বিপদের মুখে ফেলতে চান না। সব সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ।’ তিনি বলেন, পাকিস্তান স্বাধীন হোক, তা জামায়াতে ইসলামী চায়নি। মওদুদী পাকিস্তানের আন্দোলনকে ‘নাপাকিস্তান’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর বাংলাদেশ সৃষ্টিরও বিরোধিতা করে দলটি।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘তথাকথিত জিহাদের’ বিরোধিতা করেন ফরুক মওদুদী। তিনি কাশ্মীরে জিহাদ সংঘটনে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় এবং হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান জামায়াতের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।একাত্তরের আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন ফারুক মওদুদী। তিনি তখন একটি বিমান সংস্থায় কাজ করতেন। চাকরি সূত্রে থেকেছেন ঢাকা, যশোর ও চট্টগ্রামে। এর পর আর বাংলাদেশে আসা হয়নি তার।এবার বাংলাদেশে এসে তার অনেক ভালো রাগছে জললেন। রাস্তায় কোলকাতা-ঢাকা বাস থেকে বিস্ময়ে হতবাক ফারুক মওদুদী প্রশ্ন করেন, " কোলকাতা থেকে সরাসরি বাস ট্রেন চলাচল আছে তোমাদের?"
তিনি মনে করেন জামাত ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এতে ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ কে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী।

Wednesday, October 2, 2013

সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত চেহারা- রুখসানা কাজল


শরত মানেই পুজোর গন্ধ। আকাশ বাতাস কাশবন নদী ও মানুষ- শরত এলেই রঙিন হয়ে উঠে। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন দুর্গা পুজো আমাদের এক করে তুলে। দূর শহর থেকে আমাদের মন চলে যায় পাড়ার ম-পে ম-পে।
আমি জানতে চাই, হ্যাঁরে এবার পুজোর থিম কি হবে রে? মেলা বসবে তো? কোন্ যাত্রা পার্টি আসছে? কি কি বই হবে জানিস কিছু? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাইজ কিন্তু ভাল হওয়া চাই! আর গান? কলকাতার সব পুজোর গান যেন থাকে! ম-প সাজানোতে সাবেকির পাশে নতুনত্ব ও রাখিস। আর লাইট? মানে আলোকসজ্জা-দেখিস আমাদের পাড়া যেন ফার্স্ট হয়!
আমার এত এত আবেগি প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। মফস্বল শহরের সংবাদকর্মী ভাইটি উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছে অনেকক্ষণ। ওর মুখটা লাল। মুঠোফোনের গভীর কালো রঙে ডুবতে ডুবতে খুব আবছা করে জানায়: এবার আর পুজো হচ্ছে না দিদি। চমকে উঠি! আমার ঝলমলে শরত আকাশ মুহূর্ত মাত্র শ্রাবণের ঘন মেঘে ঢাকা পড়ে গেল।
যে ছোট্ট শহরটিতে আমার জন্ম, শরত এলেই যে শহরের হিন্দু-মুসলমান-খৃীষ্টান সবাই এই দুর্গা পুজোর মহাআনন্দ উৎসবে সব কিছু ভুলে মেতে ওঠে, এবার পুজো হচ্ছে না সে শহরে। আসছেন না সিংহ আরোহিনী মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। আসছেন না লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ। আসছে না মেলা, সার্কাস, নাগরদোলা, যাত্রাগান, গরম জিলেপি, পাঁপড়ভাজা, নানা রঙের নানা ঢংয়ের মাটির পুতুল। আমি মন খারাপের ঘোলা জলে হাবুডুবু খেয়ে জানতে চাইলাম: কেন রে? এবার কেন মূর্তি গড়া হবে না? ও বিষন্ন দুটি চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল আর তখনই সেলুলয়েডের ফিতায় ভেসে উঠল দৃশ্যপট। মুহুর্মুহু নিঃশব্দতার চড় আমাকে ফেলে দিল অমার্জনীয় এক লজ্জায়। আমিও স্তব্ধ বেদনাকে সঙ্গী করে বসে থাকলাম ভাইয়ের পাশে। আমাদের কষ্ট এক, বেদনা এক- শুধু লজ্জা এসে বলে গেল- আজ থেকে দিদি মুসলিম আর তার ভাইটি হিন্দু!
এমন নয় যে, আমরা এর আগেও এ রকম পরিস্থিতিতে পড়িনি। পড়েছি। ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু বার বার কেন এমন লজ্জাজনক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় আমাদের! কেন এই লজ্জা ঢাকতে বার বার বিচ্ছিন্ন হতে হয় আমাদের? কেন স্বভূমিতে আমরা বেঁচে থাকি মুখ ঢেকে, কেন কেউ কেউ স্বভূমি ছেড়ে চলে যায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে? ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসরত প্রতিটি হিন্দু-মুসলিম-খৃীষ্টান-শিখ-বৌদ্ধ ধর্মের নাগরিকই কেন এই একই বেদনায় রঞ্জিত হয় বার বারÑ কখনও না কখনও?
১৯৪৭-এর ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি স্মরণে এখনও শিউরে উঠে হিন্দু মুসলিম অনেকেই। ইতিহাস খুব জটিল পথে ধায় আর রাজনীতি পা ফেলে আরও স্বার্থপর আলো আঁধারের গোলোক পথে। ’৪৭-এর দেশ ভাগ কি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম জনগণ কখনও চেয়েছিল? কাদের স্বার্থে কেন হলো এই দেশ ভাগ? কেবলই ধর্মের জিরাফ এসে এঁকে দিল এক সীমারেখা আর আমরা ছিটকে গেলাম অখ- জন্মভূমির এ পারে, ও পারে!
দেশ ভাগ কেবল ধর্মীয় প্রভাবের ফলাফল নয়। এর পেছনে রয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক বোদ্ধা এবং প-িতদের স্বার্থপর চিন্তা ধারার এক জটিল মিথস্ক্রিয়া। হিন্দুর জন্য হিন্দু রাষ্ট্র, মুসলমানের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রÑ এই দ্বি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক এবং ধারক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মি. জিন্নাহ ব্যক্তিগত জীবনে কোন ধর্মগুরু ছিলেন না। এমন কি তিনি সরাসরি অনেক ধর্মীয় আচার-আচরণের ধারও ধারতেন না। মূলত তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাশ্চাত্য চাল-চলনে অভ্যস্ত তখনকার সমাজের একজন উঁচু তলার ব্যক্তি মাত্র। কংগ্রেসের তৎকালীন অনেক শীর্ষ নেতাও দেশ ভাগ নিয়ে আশ্চর্য নীরবতায় মৌনী ছিলেন। মূলত নেহেরু এবং জিন্নাহর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ, রাজনৈতিক অভিপ্সা, নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের অতি দাদাগিরি মনোভাব ক্রমাগত মুসলিম লীগের নেতাদের ইন্ধন ও উৎসাহ যুগিয়েছে নতুন নতুন রাজনৈতিক রণকৌশল নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরেও জিন্নাহ স্বতন্ত্র পাকিস্তানের কথা বলেননি। ১৯৬৯ সালে শিব রাও লিখেছেন যে, ১৯৩৭-এর নির্বাচনের অল্পকাল পরেই জিন্নাহ একটি প্রকাশ্য ঘোষণায় বলেন, ‘হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে একটি সম্মানজনক বোঝাপড়া হোক’ এই বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রকাশ্যে মহাত্মা গান্ধীর কাছে সাহায্যের আবেদন রাখেন। কিন্তু গান্ধী অসহায়ের মতো হতাশার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপারগতা প্রকাশ করেন। যদিও তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন, কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেসের নেতৃত্বে তখন আর তার কোন প্রভাব ছিল না বললেই চলে। নেহেরুর চিন্তা, পথ, ভাষা এমনকি বাচনভঙ্গিতেও অখ- ভারত রক্ষার কোন সম্মানজনক সহিষ্ণুতাও প্রকাশ পায়নি কখনও। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে নেহেরুর এক উগ্র মন্তব্য ভারতবর্ষের একই সূত্রে গ্রন্থিত অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসকে অভিন্ন পথের পরিবর্তে দুটি ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে দিয়েছিল। আত্মতৃপ্তি, রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয়, জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার স্বপ্নে অন্ধ হয়ে কংগ্রেস ভারতের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তার আজ্ঞাবহ দল হিসেবে ভাবতে শুরু করে। নেহেরু অত্যন্ত আত্মঅহঙ্কারে বলেছিলেন, ‘ভারতে এখন কেবল দুটি শক্তি আছে : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ- কংগ্রেস যার প্রতিনিধি। পাল্টা জবাবে জিন্নাহ বলেছিলেন, না, ভারতে তৃতীয় আরও একটি শক্তি আছে- আর তা হচ্ছে মুসলমানরা।
মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস নেতাদের এই রাজনৈতিক পাশা খেলায় ভারতবর্ষের জনগণ ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাণ গিয়েছে। মান গিয়েছে, জমি-জিরেত, ধন, সম্পদ গিয়েছে। আর হারিয়ে গিয়েছে কোটি মানুষের আজন্মের ঠিকানা- বদলে গেছে জননী জন্মভূমির পবিত্র মানচিত্র।
ভারতবর্ষের মাটিতে, নদীতে, আকাশে, বাতাসে, মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ। সেই বৃক্ষে ফুল হয়েছে, ফল ধরেছে, বীজ ছড়িয়ে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে। রাজনৈতিক নেতাদের চাপান-উতর রাজনীতির পাশা খেলায় ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যে ভুলই হোক না কেন সেই ভুলের কঠিন সুদ গুনতে হয়েছে ভারতবর্ষের সাধারণ হিন্দু-মুসলমান জনগণকে। আর সেই বিষবৃক্ষের ফলে এত বিদ্বেষ যে অনাদিকালের ধর্মনিরপেক্ষতার নিরাপদ ভূমিতে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয় ঐক্যকে খ-বিখ- করে দিয়েছে নিষ্ঠুরের মতো।
দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয় একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। সংবিধানে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল স্তম্ভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করলেও মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় হত্যা করা হয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বদলে যায় সংবিধান। বদলে যায় শাসক শ্রেণীর চরিত্র। তৈরি হয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মৌলবাদী এক গোষ্ঠী। রাজনীতিতে সক্রিয় এই শ্রেণী বাঙালীর সংস্কৃতির স্থানে প্রচলন ঘটাতে চায় আরবীয় সংস্কৃতি। বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে এরা বদ্ধপরিকর। তাই মাঝে মাঝেই ঘটে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সংখ্যালঘুর ঘর পুড়ছে, প্রাণ যাচ্ছে, লুট হয়ে যাচ্ছে মন্দির ও নারী। সেখানে পুজো হয় কি করে? কোন মেয়ে কি এ রকম বিপন্ন বাবা মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে সন্তানদের নিয়ে?
তাই এবার আর পুজো হবে না। সপ্তমী অষ্টমী নবমী জুড়ে দল বেঁধে আমাদের মতো মানুষদের ম-পে ম-পে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখা হবে না আর। দশমীর দুপুর থেকেই বিসর্জনের বেদনা এসে ছুঁয়ে দেবে না সব ধর্মের মায়েদের মন। পুজো মানেই তো ছুটি। বাবা মায়ের কাছে ক’দিনের জন্য বিবাহিত মেয়ের বেড়াতে আসা। সংসার জটিলতার ফাঁকে ভাবনাহীন নিটোল কয়েকটি দিন। কি চমৎকার একটি পারিবারিক মিলনের গল্প! অথচ সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত রঙে এমন মধুর একটি গল্পে আমরা কালি দিয়ে দিলাম!
কি আছে আমাদের সামনে?

এই রায়কে অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না - আবদুল গাফফার চৌধুরী


লিখতে বসেছিলাম অর্ধনোবেল জয়ী ড. ইউনূসের নবতর কা-কীর্তি নিয়ে। গত সপ্তাহে ‘চতুরঙ্গের’ লেখায় সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারের রায় ঘোষিত হলে খুব সকালে (লন্ডন সময়) লেখার টেবিলে লিখতে বসেই তা জানতে পারব, তা আগে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম লন্ডনের সকাল মানে ঢাকার দুপুর। সুতরাং রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে সকালেই সেটা জানার কোন অসুবিধা নেই। লেখার সাবজেক্ট তাই বদলাতে হলো।
যুদ্ধাপরাধ, হত্যা, গণহত্যাসংক্রান্ত তেইশটি অভিযোগ ছিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে। রায়ে বলা হয়েছে, তার মধ্যে নয়টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং তাঁকে মৃত্যুদন্দাদেশ দেয়া হয়েছে। এ রায়কে বেদনাক্রান্ত মনে অভিনন্দন জানাই। আমার অভিনন্দনকে বেদনাক্রান্ত আখ্যা দিলাম এ জন্য যে, এই পরিবারটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় অর্ধশতকের। আবার এ রায়কে অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না এ কারণে যে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর পিতা ফজলুর কাদের চৌধুরীর সঙ্গে মিলে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধগুলো করেছেন, তার বিচার ও দ- না হলে এ দেশের মাটি থেকে মানবতা শব্দটিই বিদায় নিত।
সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অসংখ্য গুরুতর অপরাধের মধ্যে কু-েশ্বরীর নূতন সিংহকে হত্যা মাত্র একটি। এ অসংখ্য অপরাধের জন্য সাকা চৌধুরী কখনও অনুতপ্ত হননি, বিবেকপীড়া অনুভব করেননি। বরং যে বঙ্গবন্ধু জেলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ফজলুল কাদের চৌধুরীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবার ও পুত্রদের প্রতি সস্নেহ অভিভাবকত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ঘাতকদের হাতে মর্র্মান্তিক মৃত্যুবরণের পর সাকা চৌধুরী সেই ঘাতক দলের সঙ্গে গিয়ে জুটেছিলেন।
তার পর গত প্রায় চার দশক ধরে রাজনীতি করার নামে তিনি যে একটার পর একটা নৃশংস কা- ঘটিয়েছেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন, আচার-আচরণে খিস্তি-খেউড়, অভব্যতা ও অশ্লীলতার পরিচয় দেখিয়েছেন, তার কোন তুলনা নেই। তিনি শুধু কর্মকান্ডে সন্ত্রাসী নন, বাক্য সন্ত্রাসীও। তাঁর জন্য এ চরম দ-াদেশের রায় শুনে তাঁর হাতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত অসংখ্য মানুষের পরিবার-পরিজন যে তাদের দীর্ঘকালের ঘোষিত শোক ও বেদনায় কিছুটা হলেও সান্ত¡না পাবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এ রায়ে দেশের মানুষের সঙ্গে আমিও সুখী। ঔঁংঃরপব যধং ফড়হবÑ ন্যায়বিচার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বেদনাসিক্ত। আমার এ পরস্পরবিরোধী মনোভাবের কারণ আমি ইতোমধ্যেই ব্যক্ত করেছি। এই পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘকালের। সাকা চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। যদিও তাঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল যোজনযোজন দূরের। এই দূরত্বকে অতিক্রম করে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে।
ছাত্রজীবনে (কলকাতায়) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যদিও দুজনের রাজনীতি বিপরীতমুখী হয়েছে; কিন্তু প্রাকযৌবনে দুজনেই ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ-রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের যুবনেতা। সেই সূত্রে দুজনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা। তাদের এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক ফজলুল কাদের চৌধুরী আইয়ুব খানের মন্ত্রী থাকাকালেও নষ্ট হয়নি।
আজ ভাবতেও অবাক লাগে, ’৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কোলাবরেটর এবং অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের নায়ক হিসেবে ফজলুল কাদের চৌধুরীর এবং তাঁর পুত্রের এমন চরম অধঃপতন ঘটতে পারে। চল্লিশের দশকে ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের একজন জাঁদরেল ছাত্রনেতা। মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হওয়ার আগে তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। চল্লিশের দশকের গোড়ায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ‘অন্ধকূপ হত্যার’ মিথ্যা অভিযোগে ব্রিটিশ শাসকদের নির্মিত হলওয়ে মনুমেন্ট ভাঙ্গার জন্য যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় বিরাট শোভাযাত্রা হয়, সেই শোভাযাত্রায় যে ক’জন মুষ্টিমেয় মুসলমান ছাত্র ছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজলুল কাদের চৌধুরী। কিশোর বঙ্গবন্ধু তখন চোখের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ছিলেন।
এই ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর অত্যন্ত কঠোর ও কর্কশ স্বভাব সত্ত্বেও আমাকে কেন ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন, তা আমি জানি না। তিনি যখন আইয়ুব আমলে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং কখনও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তখনও চাটগাঁয় এলে তিনি তাঁর টাইগার্স হিলের বাসায় আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি শেখ মুজিব এবং তাঁর ছয় দফার সমর্থক জেনেও কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। তাঁর সুউচ্চ হিল ভবনের ছাদে তখন দেখতাম তাঁর দুই পুত্র সালাউদ্দিন ও গিয়াসউদ্দিন খেলা করছেন।
আইয়ুব মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ফজলুল কাদের চৌধুরী যখন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের সময় ঢাকায় ইস্কাটনে নয় নম্বর দিলু রোডে অবস্থান করতেন, তখন প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত হতো। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেই পতেঙ্গার একগাদা লাল মিষ্টি তরমুজ নিয়ে আসতেন আমার স্ত্রীর জন্য। বলতেন, বৌমার জন্য এনেছি। আইয়ুব সরকারের হাতে তিনি নানাভাবে হেনস্থা হয়েছেন। বিস্ময়ের কথা এই যে, আইয়ুবের পতনের পর পতিত স্বৈরাচারী কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতির পদে বসান। তিনি ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় ফিরে এলে তাঁকে বলেছিলাম, এটা আপনি কী করলেন? ফজলুল কাদের চৌধুরী হেসে বলেছেন, ‘এখন আমি মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হয়েছি, শীঘ্রই পাকিস্তানেরও প্রেসিডেন্ট হব।’ আমার মনে হয়েছিল, তিনি রাজনৈতিক ফ্যান্টাসিতে ভুগছেন।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর মধ্যে ক্রুর এবং কোমল দুটো চরিত্রই ছিল। তাঁর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পিতার চরিত্রের শুধু ক্রুর দিকটা পেয়েছেন, কোমল দিকটা পাননি। পিতার মধ্যে যে ক্ষীণ দেশপ্রেম ছিল, সাকা চৌধুরীর মধ্যে তাঁর কণামাত্র নেই। নিজের কথাবার্তায় তিনি বহুবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর আনুগত্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি নয়; তাঁর অনুগত্য এখনও পাকিস্তানের প্রতি। অনেকে সন্দেহ করেন, তাঁর রাজনীতির সঙ্গে ‘পাকিস্তান কানেকশন’ যুক্ত, এমনকি আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও বিস্ময়ের কিছু নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সময়ে যে সব মন্তব্য করেছেন, তাতে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ ছাড়াও দেশদ্রোহিতার অভিযোগেও তাঁকে বিচারে সোপর্দ করা যেত।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল কয়েকজনকেই মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছেন। একজনকে (গোলাম আযম) দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
এই দন্ডিতেরা সকলেই ’৭১-এর ঘাতক দল জামায়াতের নেতা। এখন সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রাণদন্ডের আদেশ হওয়ায় বিএনপির একজন শীর্ষনেতা দন্ডাদেশ পেলেন। এই মামলাটির বৈশিষ্ট্য, জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালেই বিএনপির এক শীর্ষনেতা যুদ্ধাপরাধে দন্ডিত হলেন এবং তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটিরও সদস্য।
এখন এই দন্ডিত নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা না দিয়ে বিএনপি যদি এই দন্ডাদেশপ্রাপ্ত নেতার সমর্থনে হরতাল ডাকে, জামায়াতকে সঙ্গী করে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে, তাহলে বিএনপিকেও কি যুদ্ধাপরাধীদের দল বলে গণ্য করা যাবে না? আর সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করানোর অযোগ্য, তাহলে একই ক্যাটাগরিতে কি বিএনপিও পড়ে যাবে না? অবশ্য এটা আইনগত বিষয়। আইন বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে ভাল বলতে পারবেন।
রায়টি ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপি এখন পর্যন্ত (আমার এই লেখা যখন লিখছি) এ সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়, ঢাকায় হরতাল ডাকা ছাড়াই রাজপথে ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো শুরু করা দেখে। চট্টগ্রামে আজ (মঙ্গলবার) হরতাল ডাকা হয়েছে। ঢাকায় বিএনপির আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের যারা আজ বিচার করছে, বাংলার মাটিতে তাদের একদিন বিচার হবেই।’ এই মন্তব্য শুধু বিচারব্যবস্থার অবমাননা নয়, বিচারপতিদেরও হুমকি দেয়ার সমতুল্য। এই ধরনের আইনজীবীদের সম্পর্কে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা, তা আইনমন্ত্রীকে বিবেচনা করতে হবে।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত দ-াদেশ নিয়ে বিএনপি যদি রাজপথে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে এবং তাতে জামায়াত ও শিবির যোগ দেয়, তাহলে দেশের রাজনীতির চিত্রটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। রাজনীতির মাঠে একদিকে দেখা যাবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের শিবির। অন্যদিকে দেখা যাবে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- যারা সমর্থন করে সেই গণসমর্থিত গণতান্ত্রিক শিবির। সম্ভবত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েই বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চূড়ান্ত যুদ্ধটা হবে। এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগটা ক্রমশই কমে আসছে।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে এককালে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম এবং সাকা চৌধুরীদেরও তাদের কিশোর কাল থেকে অত্যন্ত কাছ থেকে চিনি, এ জন্যই আজ সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ-াদেশে ব্যথা অনুভব না করে পারছি না। কিন্তু তাকে দ- দেয়া ছিল মানবতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন। সুতরাং এই রায়কে মনের বেদনা সত্ত্বেও অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না। বিএনপি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি রোধ করতে পারেনি; ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-ও রোধ করতে পারবে না। মাঝখানে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিয়ে তারা দেশের মানুষের কাছে নিজেদের আসল চেহারা উন্মোচন করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনদানই যে দেশে যথাসময়ে একটি নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সকল খোয়াব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে এই সত্যটা তারা এখন বুঝতে পারছে না। -দৈনিক জনকন্ঠ