Saturday, December 7, 2013

আমার নারীরা : সমরজিৎ সিংহের দুঃসাহসী আত্মজীবনী

 

তিনি তখন টগবগে যুবক । ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, সুঠাম শরীর ।দুটি চোখে ঝলসে ওঠে বিদ্যুত ।শহরে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন তার বাবা । এক উকিলের বাড়িতেই থাকতেন সেখানে । পড়াশোনার চাইতে দুষ্টুমিই প্রধান আকর্ষণ । 


যাত্রাদলে ঢুকেও পড়লেন সেই কিশোর বয়সে । পঞ্চমমান থেকে পাশ করে হাইস্কুলে তখন । তাকে আর পায় কে ? পড়াশোনা লাটে ওঠে তার । উকিলবাড়ি থেকে ফেরত পাঠানো হলো বাড়িতে । তাতেও দমবার পাত্র নন তিনি । চাবাগানে যাত্রা হবে, শাহজাহান, তিনি হলেন ঔরঙ্গজের । এক কিশোরের ঐ অভিনয়ক্ষমতা দেখে ডাক পড়লো শহরেও । এভাবেই বড় হচ্ছিলেন তিনি ।



 তার এই উদ্দাম জীবন, বাউণ্ডুলেপনা দেখে. পূর্ণ যুবক হবার আগেই বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়া হলো তাকে । ধর্মনগরের রাগনার মেয়ে । জীবিকা নেই, বিয়ে করেছেন । প্রেমিকার সংখ্যাও কম নেই । দেখতে দেখতে এক ছেলের বাপও হয়ে গেলেন তিনি । সে সময় রাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী এসেছেন কৈলাসহর পরিদর্শনে । তিনি ছুটে গেলেন রাণী-দর্শনে । গেলে কি আর দেখা মেলে রাণীর ? 


অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন দেখা করার সুযোগ পেলেন, মন্ত্রী এই তরুণকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, খুব সংক্ষেপে তোমার কথা জানাবে । মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি । রাণী জিগ্যেস করলেন, 'কি চাও, যুবক ?' 'আমার দরিদ্র গ্রামে স্কুল নেই, আমি স্কুল স্থাপন করতে চাই রাজ অনুমতি ও অর্থ পেলে ।'  


চমকে উঠলেন রাণী । এরকম দাবি তো কেউ করেনি । তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ করলেন মন্ত্রীকে, 'মাসিক পনেরো টাকা বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করুন এই যুবককে ।' তারপর যুবকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'কি নাম তোমার ?' 'প্রফুল্ল । প্রফুল্ল কুমার সিংহ ।'


সারা গ্রাম মেতে উঠলো তার চাকুরি পাওয়ার খবরে । কী সাহস ! রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে কজনে পারে ? গ্রামে তার এই নায়কোচিত সম্মান তাকে যেমন দায়িত্ববোধ শেখালো, তেমনি করে তুললো রমণীমোহন । তার প্রেমিকার সংখ্যাও বেড়ে গেলো এক লাফে । 'প্রেমই জীবনের সব না'- একদিন, বয়োজ্যেষ্ঠ একজন একথা বোঝাবার পর, তিনি গ্রামের কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে চালু করলেন স্কুল , নিজের বাড়িতেই ।


 একজন দুজন করে বাড়তে লাগলো ছাত্র । বেতনও দু'তিনমাস পর আসতে শুরু করলো রাজকোষাগার থেকে । ততদিনে ভারত হয়ে গেছে স্বাধীন । ভাগ হয়ে গেলো দেশ । শোনা যাচ্ছে, রাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরাকে তুলে দেবেন ভারত সরকারের কাছে । কি হয়, কি হয়, অবস্থা তখন । অবশেষে ভারতে যোগ দিল ত্রিপুরা । 


তার কিছুদিন পর, এই গ্রামে এসে বসত করতে শুরু করলো এক পরিবার । কমলপুর থেকে এসেছে । সম্পন্ন পরিবার । লোকে বলাবলি করতে লাগলো, অপসরীর চাইতেও সুন্দর এক বউ আছে এই পরিবারে । একদিন পুকুর পাড়ে দেখেও ফেললো তাকে । সেই দেখাই কাল হলো তার । রূপের আগুনে ক্রমে পুড়তে লাগলেন প্রফুল্ল । একদিন রাতে তার বউ বলল, ঘরে যে একটা বউ আছে তোমার, সে খেয়াল আছে ? কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বুকে টেনে নিলেন বউকে । এই তো, সে আছে আমার বুকে । তারপর, মুখ নামিয়ে দিলেন নাভিতে । জিভ রাখলেন । হা হতোস্মি ! যে বউ তার সামান্য স্পর্শে গলে যেত, ঝর্ণা বইতে শুরু করে দিত তার, সে আজ অন্য চেহারায় । তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন । বললো, আমাকে স্পর্শ করবে না তুমি ।


সে রাতে ঘুম হলো না তার । বাইরে মাংকলে এসে, মানে বারান্দায় এসে একা কাটিয়ে দিলেন সারারাত । তার চোখে তখন ঐ দৃশ্য, স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপসরী তার ভিজে চুল শুকোচ্ছে রোদে । পিঠ বেয়ে, কোমর ছাপিয়ে, চুল নেমে এসেছে হাঁটুর দিকে । সকালের সূর্য এসে ঠিকরে পড়ছে তার শরীরে । অমরাবতীর যে কোনো সুন্দর দেবীকে হার মানিয়ে দেবে এই নারী । পাশের বাড়ির মঞ্জরিবৌদিকে জিগ্যেস করে জানলেন, সুন্দরীর নাম ললিতা । কমলপুর থেকে এসেছে তারা । একটা পরিবার কমলপুর থেকে এসেছে, জমিজমা কিনেছে. এটা তিনি জানতেন, কিন্তু এমন সুন্দরী বউ আছে, তা জানতেন না । সারারাত ললিতার কথাই ভাবলেন তিনি । একটার পর একটা সিগারেট করলেন ধ্বংস । তারপর স্থির করলেন, এটা অনুচিত । পরনারীর কথা ভাববেন কেন তিনি ? তাছাড়া, তিনি কখনো কোনো নারীকে তার দুর্বলতার কথা বলতে রাজি নন । এটা তার পৌরুষে বাঁধে । গিথানী এসেছিলো নিজে থেকেই । অবশ্য গিথানীর বিষয়টা ঠিক প্রেম নয়, শরীরের খেলা, যে খেলা নিজের বউ এর সঙ্গে ঠিক জমে না । তাতে রহস্য থাকে না, রোমাঞ্চ থাকে না, আলো-অন্ধকার থাকে না, শুধুই মনে হয় রুটিন ওয়ার্ক । গিথানী খেলাটা জানে এবং খেলতেও ভালোবাসে । গিথানী এখন কোথায় থাকে ? কেমন আছে ? তার হঠাত্‍ ইচ্ছে হলো, দু একদিনের মধ্যেই গিথানীর কাছে যেতে হবে । সকালে, কাছারিতে গিয়ে শুনলেন, রাণীর শাসন আর নেই । ত্রিপুরা ভারতে যোগ দিয়েছে দুমাস আগে । আর ভারত সরকার তার স্কুলঘর তৈরি করে দেবে খুব শীঘ্রই । রাণীর দেওয়া মাস্টারির বেতনও বাড়ানো হয়েছে পাঁচটাকা ।

বিধবা তিনি ভরযৌবনে । নৃত্য থেকে দূরে থেকে মন বসে না আর । মাঝখানে রাধামোহন এসেছি শিলঙ থেকে একবার । দশদিন থেকে গেছে একটানা । রাত কাটে একা, দিন যায় ক্ষেতিবারির তালাবিতে । মাঝে মালঠেপে, মানে, মণ্ডপে যান মা, তাও মঞ্জরীদি থাকলে । এই একজন আগলে রাখছে তাকে দিদির স্নেহ দিয়ে, অভিভাবিকার দায়িত্ব পালন করে । তিনিও এসেছেন সিলেটের মাধবপুর থেকে । মালঠেপে রথের পালি বা পালা, মেরার পালি এলে যান তিনি । তাতে সময় কাটে খানিকটা । আবার খারাপও লাগে যখন মাঙ্গলিক কোনো অনুষ্ঠানে নেওয়া হয় না তাকে । এই এক আশ্চর্য রীতি মনিপুরীদের । বিধবাদের অশুভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শাস্ত্র মেনে । এই অভিমান থেকে, একবার, ঠিক করলেন, বাড়িতেই নারায়ণসেবার আয়োজন করবেন । মঞ্জরীদিই ব্যবস্থা করে দিলেন সব । পুরোহিত থেকে ডাকুলা ইশালপা, পাঠক ও কথক থেকে গ্রামের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হলো । সন্ধ্যের পর এই অনুষ্ঠান । গুড় মাখানো খই, পায়েস আর ফলার মানে চিড়ে, খই ও কলা মিশিয়ে দুধ দিয়ে মাখা প্রসাদ । এই বিশাল আয়োজনের দেখাশোনা করছেন, একা, মঞ্জরীদিই । লোক আসতে লাগলো সন্ধ্যের পর থেকে । পুরোহিত এসে গেছেন তার আগেই । নারায়ণসেবা সাধারণ কাজ নয় । পুরোহিত বা পুরুতঠাকুরের সেখানে অনেক ভূমিকা । আমন্ত্রিতরা আসার পর শুরু হলো ভাগবত পাঠ । মনিপুরীদের কোনো অনুষ্ঠানে ভাগবত বা মহাভারত পাঠ জরুরি । নিদেনপক্ষে রামায়ণ । ভাগবত পাঠের পর কথক শুরু করলেন তার কথকতা । ভীমের সঙ্গীত শিক্ষাপর্ব এর বিষয় । মাংকলে বসে সব দেখছেন মা । মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে তুলসিতলার দিকে । পুরুতঠাকুর সেখানেই পূজা করছেন । আবার চোখ ফেরালেন কথকের দিকে । তখনই চোখ গেল অনিন্দ্যসুন্দর এক পুরুষের দিকে । তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছেন । চোখ ফিরিয়ে নিলেন মা । আবার সেদিকে তাকালেন । সেই দৃষ্টি । তাকে আমূল গ্রাস করে নিচ্ছে যেন । শরীরে হঠাত্‍ ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার । এ কিসের ঢেউ ? তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গিয়ে ভেতর ঘরে চলে গেলেন মা । মঞ্জরীদি, লোকটা কে ? ঐ যে, ঐ, ঐ... সেদিকে তাকিয়ে, হেসে ফেললেন মঞ্জরীদি । কে গো ? আগে তো দেখিনি কখনো । মঞ্জরীদি বললেন, অ, প্রফুল্লমাস্টর ! মেয়ে ফাঁসাতে ওস্তাদ । দেখো, তুমি আবার ফেঁসে যেও না !

বাহান্নর নির্বাচন লোকে তেমন করে অনুভব করতে পারেনি । দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, ত্রিপুরাও ভারতের সঙ্গে যোগ দিয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি । ফলে নির্বাচন ব্যাপারটা বোঝাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন পলিটিক্যাল লোকেরা । রাজশাসনে ভোটের কোনো বিষয় ছিলো না, হঠাত্‍ করে এসে ভোট মানুষকে হকচকিয়ে দিলো বা অস্বস্তিতে ফেলে দিলো তাদের । ভোটের দিন মা সকালেই চলে গেলেন ভোট দিতে চাবাগানের স্কুলে । খুব বেশি লোক নেই । একটা ভোট থেকে তাকে বলা হলো, বৌদি. আমাদের ভোট দেবেন । একটা স্লিপও ধরিয়ে দেওয়া হলো তাকে । ভোট দিয়ে, বেরিয়ে আসবেন, পা আর এগুচ্ছে না তার । থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন তিনি । লোকটা হাসছে । ঐ সর্বগ্রাসী চাহনী ! পাশ কাটিয়ে, চলে আসবেন, কানে গেলো, আফোট কয়েকটি কথা । আপনি স্বর্গের দেবী । ভুল করে এই পৃথিবীতে এসেছেন । এই সৌন্দর্য পৃথিবীর নয় । শিউরে উঠলো মা-র অন্তর । কোনোদিন তার বর তাকে এমন করে বলেনি । এই লোকটার কথার মধ্যে আশ্চর্য এক আকুলতা আছে, ঐ আকুলতা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে । মঞ্জরীদি পই পই করে সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রফুল্লমাস্টরের সংশ্রব থেকে দূরে থাকবে । যে কোনো সময় ফেঁসে যেতে পারো । মনে রেখো, দুই ছাওয়ালের বাপ সে । ঘরে দজ্জাল বউ আছে । মন দিয়ে তিনি শুনেছেন সব, কথা দিয়েছেনও, এই ভুল করবেন না তিনি । তাছাড়া, তিনি বিধবা । যদিও মনিপুরী সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত । আকছার বিয়ে হচ্ছে, সুখে ঘরকন্না করছেন অনেকেই । তারও তো শখ হয় কোনো পুরুষের বুকে মাথা রেখে রাত কাটাতে । দেহের জ্বালা আগে ততটা বুঝতেন না, এখন বোঝেন, টের পান, অনেক রাত কেটে যায় বিনিদ্র । মন আর মানে না তার । ভোটের দিন থেকে তিনি যেন পালটে যেতে লাগলেন, মন বসে না কোনো কাজে । প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর, গানটির মর্মকথা অনুভব করেন । সেদিন গুনগুন করে গাইছিলেনও তার দুতিনটি চরণ । গান শুনে, মঞ্জরীদি বললেন, ললিতা, তোমার মরণকাল এসে গেছে । আর বাঁচানো গেলো না বোধহয় ।

'চলো, আমরা পালাই !' 'কোথায় ?' মা তার স্বভাবভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন । 'আর আমরা পালাবো কেন ? ভালোবেসে কোনো দোষ করিনি আমরা !' 'তাহলে ? তাহলে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারবো না ?' আশ্চর্য এক সংশয়াচ্ছন্ন স্বর প্রফুল্লর গলায় । 


মনু নদীর এদিকটা এখন নির্জন । বিশাল আমবাগান পেরিয়ে কয়েকটা শালগাছ, ওপাশে মানে উত্তরে চাবাগানের কুলিদের বস্তি । লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে সপ্তাহে একদিন মা দেখা করেন তার এই পুরুষের সঙ্গে । বিকেল গড়িয়ে গেলে বস্তির লোকজন চলে আসতে পারে, ফলে, বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ নেই । 'একসঙ্গে থাকতে চাইলে আমাকে তোমার ঘরে সসম্মানে স্থান দিতে হবে । না হলে, এই সম্পর্ক অধরাই থেকে যাবে । বুঝবো, আমার কপালটাই এরকম ।' মা-র কণ্ঠে শান্ত অথচ দৃঢ় এই উচ্চারণ শুনে, চমকে উঠলেন প্রফুল্ল । 


এ যে গিথানী নয়, তা তিনি টের পেয়েছেন আগেই । ললিতা, খেলার সখি নয়, হতে চাইছেন জীবনের সঙ্গী । বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি । ছেলের মা কি মেনে নেবে আদৌ ? তবে লোভী, ঐ লোভের ফাঁদেই তাকে ফেলতে হবে যে করেই হোক । সমাজ আপত্তি করবে না, এধরণের বিয়ে প্রচলিতও । একসঙ্গে দুতিনটে বিয়েও করে মনিপুরী পুরুষরা । 


কৃষ্ণনাম সার যে সমাজের, কৃষ্ণই যাদের আরাধ্য, তাদের মন ঐ ষোড়শ গোপিনীর কাছে থাকবে না তো আর কোথায় থাকবে ? তিনি বললেন, 'আমাকে একটু সময় দাও, ললিতা ।' মা হাসলেন, সেই হাসি অপসৃয়মান সূর্যাস্তের ছায়ার মতো । তার জীবনে সুখ শব্দটি নেই । একজন এসেছে যাকে আঁকড়ে ধরে, নিয়তিকে বলতে পারেন, দেখো, আমিও সুখী হতে পারি । হায়, সে লোকটাও পিছিয়ে যেতে উদ্যোগী । একবছর হয়ে এলো, তাদের সম্পর্কের ঠিকানা হলো না কোনো । মঞ্জরীদি প্রায়শই বলেন, 'ফেঁসে যখন গেলেই, নিজের বোঝ বুঝে নিও । না হলে, সব কূল হারিয়ে একদিন পথে এসে দাঁড়াতে হবে তোমাকে ।'


বেশ রাত করেই কাছারি থেকে ফিরে এলেন প্রফুল্ল । গ্রামের অধিকাংশ লোকই, খেয়েদেয়ে, ঢুকে গেছে বিছানায় । সাইকেলে করে সরু পথ দিয়ে, ফিরতে ফিরতে, তিনি শুনলেন, মহাদেবের থানে কীর্তন চলছে । ভাবলেন, একবার ঘুরে এলে কেমন হয় ? তারপর, ভাবলেন, না, আজ থাক । গেলেই তো কল্কিতে টান দিতে ইচ্ছে করবে, গাঁজার নেশা বলে কথা ! মনিপুরী গ্রামগুলিতে গাঁজার আধিক্য বেশি, অন্য নেশা তুলনায় অনেক কম । 


পুরুষদের সন্ধ্যের পর বিনোদন বলতে তিনটি বিষয় উঠে আসে । প্রথমত, অবৈধ প্রেম । যেসকল পুরুষ ভীতু প্রজাতির, তারা গাঁজা খায়, কীর্তনের আসরে বসে বসে ঝিমোয় । এই নেশা দ্বিতীয় । তৃতীয়ত, জুয়া । তিন পাত্তি । নয় পাত্তি । এক পাত্তিও চলে চরম উত্তেজনার সময় । যেসকল পুরুষরা বেপরোয়া, তারা এই তিনটি নেশাই করে একসঙ্গে । তার দৌঁড় ঐ দুটি নেশাতেই, জুয়াটা ঠিক হজম হয় না । মহাদেবের থানের দিকে না গিয়ে তিনি রওনা দিলেন ঘরের দিকে । ললিতা নিশ্চয় না খেয়ে বসে থাকবে তার জন্য । কাল রাতে, উফফ, ললিতার ঐ সাড়া দেওয়া, পাগল করে তুলেছিলো তাকে । ছেলের মা প্রথম তিনটি রাত তাকে ছেড়ে দিয়েছে ললিতাকে নিয়ে যাখুশি করার জন্য । হাসি পেয়েছিলো তখন । 


তার মনে পড়ে গিয়েছিলো দ্রৌপদীকে পেতে পঞ্চপাণ্ডবের দিনভাগের কথা । যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে থাকবেন, অর্জুনের কোনো অধিকার থাকবে না দ্রৌপদীগমনে । এক্ষেত্রে তা নয় । তাকে তিনটি দিনই দেওয়া হয়েছে শুধু । অথচ কাল রাতের পর, প্রফুল্লর মনে হয়েছে, তিনদিনে হবে না, আরও সহস্র দিনের প্রয়োজন হবে । ফলে, রাতেই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন, কাছারিতে গিয়ে দরখাস্ত দেবেন, তাকে যেন বদলী করা হয় খুব শীঘ্রই । বদলী হলেই, কিছুদিন, একসঙ্গে, থাকতে পারবে ললিতা ও তিনি । ললিতাও খুশি হবে । 


কাছারিতে গিয়ে এই কাজটিই করলেন প্রথম, তারপর, মুহুরির সঙ্গে কথা বলে সম্পত্তি দান করার এক দলিল তৈরি করালেন স্টাম্প পেপারে । এটা করাতেই হয়ে গেলো দেরি । ঘরে ফিরে ফিরে, ছেলের মা'র সঙ্গে দু একটা মামুলি কথা বলে, ছোটো মেয়েটাকে আদর করে, চলে গেলেন ললিতার কাছে । 


তাকে দেখে প্রাণ ফিরে এল ললিতার । 'এত দেরি করলে কেন গো ? বলেও গেলে না যাবার আগে ! ভাগ্যিস, মা বলেছেন, নাহলে ভাবতাম, আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলে বুঝি !' তার জন্য নতুন বউয়ের এই আকুলতা, দেখে, সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো প্রফুল্লর । বললেন, 'পালাতে হলে, তোমাকে নিয়েই পালাবো ।' রাতে, বিছানায়, ললিতা যখন তার বরের বুকে মুখ ডোবালো, প্রফুল্ল বলে উঠলো, 'সই করতে জানো ?' 'উমমম, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ গো ! সইটই জানি না । তুমি বরং আমাকে শিখিয়ে দিও, মাস্টর ।' ললিতাকে অল্প সরিয়ে দিয়ে, প্রফুল্ল, বালিশের নিচ থেকে বের করে আনলেন মুহুরীকে দিয়ে লিখিয়ে আনা স্টাম্প পেপারগুলি । তারপর, খুব নিস্পৃহ গলায়, বললেন, 'এখানে টিপ ছাপ দাও ।


''টিপছাপ ?' ভালোবাসা ও শরীরের ঘোর ভেঙে গেলো মুহূর্তে, ছিটকে গিয়ে, সোজা হয়ে বসলেন ললিতা । 'ছাপ দেবো কেন ?' তার কণ্ঠে অচেনা এক সুর, সে সুরে সংশয় এবং দ্বিধাও । দ্বিধা এই কারণে, যে, ছাপ না দিলে, প্রফুল্ল আঘাত পাবে, তার ফল সুদূরপ্রসারী । তবু এই প্রশ্ন না করে পারলেন না । আবছা আলোয় প্রফুল্লর মুখ দেখা যাচ্ছে না, বিরক্ত হলো কি না বোঝার উপায় নেই । ঘরের ও প্রান্তে শ্বাশুড়ী যেন কেঁশে উঠলো । তিনি কি জেগে আছেন, এখনও ? কিছু বলতে চাইছেন তবে ? সামনে স্টাম্প পেপার, একদিকে তিনি, অপরদিকে প্রফুল্ল, তার দ্বিতীয় বর, প্রকৃত অর্থে তার প্রথম পুরুষ । স্টাম্প পেপার যেন পাশার ছক । এক অজানা ভয় নেমে এল তার শিরদাঁড়া বেয়ে । তারপরই, ভাবলেন, এসব অমূলক ভাবনা তার । দয়িতকে সন্দেহ করতে নেই, না হলে সংসার টেকে না । ঘরের ভেতর এক গুমোট হাওয়া যা মূলত অস্বস্তির । সেই অস্বস্তি দূর করার জন্যি তিনি পুনরায় বলে উঠলেন, 'এতে কি আমার মরণ লেখা আছে ? আমি তো তোমার হাতেই মরতে চাইছি গো, মাস্টর । তার আগে, একবার সন্তানের মুখ দেখতে চাই । একবার ।'


সতীনের কাঁটা যে কি, কতখানি তা ক্ষত করতে পারে হৃদয়কে, ছায়া জানতো না আগে । স্বামীকে হাতছাড়া করার চাইতে ঘরে এসে সতীন সহ স্বামী যদি থাকে তাহলে নিজের অধিকার কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে, ভেবছিলো প্রথমে । এ জন্য সায় দিয়েছিলো, পথ না পেয়ে । বলেছিলো, প্রথম তিনদিন থাকো তার সঙ্গেই । তা ছাড়া, যে কোনোদিন তার প্রসবকাল চলে আসবে । ন মাসের উপর চলছে তার । দেহ আর ভার নিতে পারছে না যেন । স্বামীর শরীরের খিদে যে কোনো পুরুষের চাইতে অনেক বেশি ।


দুই সন্তানের পর, আর চায়নি, তবুও তো তিন নম্বর এলো চলে । এই ধকল শরীর পারছে না নিতে । অথচ, তার স্বামী তা শুনতে নারাজ, বলে, কৈরেংখুলাকপাদের এটাই রীতি, তাদের রক্তে রয়েছে পূর্বপুরুষের উচ্ছৃংখলতা, বহু নারীগমনের বীজ । তুমি অপারগ হলে আমি তো আর আঙুল চুষে বসে থাকতে পারবো না ! এর পর আর কি বলা যেতে পারে তাকে ? 


ললিতাকে আনার পর, তিনদিনের স্থলে পনেরোদিন হয়ে গেছে, তার স্বামী মজে আছে নতুন শরীরের স্বাদে । মাঝে দু একবার এসে কথা বলেছে, খোঁজ নিয়েছে বাচ্চাদের । ঐটুকুই । ইদানিং স্কুল পর্যন্ত বন্ধ । তাহলে কি ললিতা কেড়ে নিচ্ছে তার স্বামীকে ? কেড়ে নেবার কথা ভাবলেই, শিউরে ওঠে সে । স্বামী কি তাকে ভুলে যাবে চিরতরে ? যদি ভুলে যায়, যদি যায়, এই বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে ? ললিতার সৌন্দর্য সর্বগ্রাসী । এ ঘরে যেদিন প্রথম পা রাখলো, সামনে যায়নি সে, জানালার এক পাট খুলে দেখেছিলো, দেখে, আঁতকে উঠেছিলো, আগুনসুন্দরী এসে পা রেখেছে এই ঘরে, তার মানে, এ ঘর, একদিন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে নির্ঘাত্‍ । কেউ বাঁচাতে পারবে না । স্বামীর সঙ্গে, এ নিয়ে, কথা বলা জরুরি খুব । 



আগে বাঁচাতে হবে এই ঘর, এই সংসার । কিন্তু কীভাবে একান্তে পাবে তাকে ? ছেলেকে ডাকলো সে, 'রণজিত্‍...' ছেলে, মানে পাঁচ ছবছরের এক বালক, বাপের স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবছরই । মেয়েটা হয়েছে, দুবছর পর, বালোয়াড়ি স্কুলে ভর্তি করানো হলেও, যেতে চায় না স্কুলে । সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ঘোরাঘুরি করে । ইদানিং নতুন মায়ের কাছেও যায়, ওখানে গিয়ে থাকে অনেকক্ষণ । দুই ছেলেমেয়েকেই বলে দিয়েছে, 'মা ডাকবি না ঐ ডাইনিটাকে ।' 'তাহলে কি বলে ডাকবো ?' ছেলে সরল মনে জানতে চেয়েছিলো । একটু ভেবে, বলেছিলো, 'মাসি । মাসিই ডাকবি তাকে ।' ছেলে এসে দাঁড়ালো তার সামনে । ফুটফুটে মুখ, এই মুখ দেখেও কি করে পারলো তার স্বামী আর একজনকে ঘরে এনে তুলতে ? এটা ঠিক, ললিতার সম্পত্তি যদি যোগ হয়ে যায় এ ঘরের সঙ্গে, তাহলে, তাদের আর্থিক ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে । পৈতৃকসূত্রে যা পেয়েছিলো তার স্বামী, উড়িয়ে দিয়েছে ভোগের পেছনে । এখন এক দ্রোণ জমিও নেই আর । স্বামীর এই স্বভাব শোধরাতে পারেনি সে । 


জমি স্থির মনে হলেও হাতবদল হতে সময় লাগে না । আর তার স্বামীর কাছে তো এসব পথের ধুলির সমান । 'মা, আমাকে ডেকেছো ?' সম্বিত্‍ ফিরে এল তার, তখনই, ব্যথা শুরু হয়ে গেলো তলপেটে । বুঝলো, তার সময় ঘনিয়ে এসেছে, মাঘকে ডাকাতে হবে, প্রসব করানোতে, জুড়ি নেই তার । কোনো রকমে বললো, 'তোমার বাবাকে ডাক দাও । তাড়াতাড়ি ।'

পর পর, কয়েকটি ঘটনা বিব্রত করে তুললো প্রফুল্লকে । 


প্রথমত, আর একটি সন্তান প্রসব করলো বড় বউ, যে সন্তান বেশিদিন বাঁচলো না. যদিও নাম রেখেছিলেন খুব ভেবেচিন্তে, অভিজিত্‍ । তাদের পূর্বপুরুষ পেটিকারার রাজবংশের শেষ রাজকুমার ছিলেন অভিজিত্‍, যিনি পিতৃহন্তারক বর্মাধিরাজকে হত্যা করে নিয়ে ছিলেন পিতৃহত্যার চরম প্রতিশোধ । অভিজিত্‍ মারা যাবার পর মনমরা হয়ে রইলেন কিছুদিন, স্কুল ভালো লাগে না, নারীসঙ্গ ভালো লাগে না, এমন কি গাঁজাও না । তবু, সন্ধ্যে হলে, চলে যান শিবের থানে । ত্রিনাথপূজা হয়, বুঁদ হয়ে থাকেন গাঁজার নেশায়, ঘরে ফিরে, চুপচাপ শুয়ে পড়েন নিজের বিছানায় । বড় বা ছোটো কোনো বউয়ের দিকে নজর থাকে না তখন । অথবা তারা আর টানতে পারে না তাকে ।


একদিন, ললিতা বলেই ফেললেন, 'বাসি হয়ে গেছি তোমার কাছে ?' 'এ কথা বলছো কেন ? দেখতে পাচ্ছো না, আমার মনের অবস্থা খুব সঙ্গীন ?' অদ্ভুত ম্লান এক গলায় বললেন তিনি । এ রকম ভেঙে পড়তে ললিতা কথনও দেখেননি প্রফুল্লকে । পুরুষ মানুষ যখন ভেঙে পড়ে, তখন তাকে টেনে তুলতে হয় পরম মমতায়, মা'র কথাটি মনে পড়ে গেলো ললিতার । তিনি বললেন, 'তোমার সকল যন্ত্রণার ভার আমাকে দাও । আমি তো আছিই তোমার পাশে, সুভদ্রা যেমন ছিলেন অর্জুনের পাশে ।' সুভদ্রা অর্জুনের গল্প তার শোনা বাবার মুখে, আর মেরার পালিতে কথকের মুখে । প্রফুল্ল তার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, এই নারী তার অচেনা, নারীও যে পুরুষের যন্ত্রণার ভার নিতে এগিয়ে আসতে পারে, জানা ছিলো না তার । তিনি কাছে টানলেন ললিতাকে । 


'পারবে ? আমার সকল যন্ত্রণার ভার নিতে পারবে ? সত্যি পারবে ?' সে রাতে, তিনি গেলেন ললিতার বিছানায় । ললিতার শরীরে মিশে যেতে যেতে বললেন, 'আমার কাছে কি চাও তুমি ?' ললিতা তখন আচ্ছন্ন এক ঘোরের মধ্যে, তার শরীরে ঢেউ এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে অনবরত, তার সুখমত্ত তিনি, আফোট উচ্চারণে বললেন, 'তোমাকে, তোমাকে, তোমাকে । আমার সন্তান হয়ে এসো আমারই গর্ভে ।'


শ্বাশুড়ী, অনেকক্ষণ ধরে, লক্ষ্য করছিলেন, বার বার, বিছানা থেকে উঠে গিয়ে, বমি করছে ললিতা । দুদিন ধরে শরীর খারাপ, কিছু খেতেও চাইছিলো না বউটা । পান ছেঁচে যাচ্ছিলেন বাঁশের চোঙে, সেটা থামিয়ে, ললিতার বিছানার কাছে চলে গেলেন । 'মেইপাকে (বৈদ্য) কি ডাকাবো ? মনে হচ্ছে, তোমার শরীর খারাপ হয়েছে আরও !' 'না, মা, থাক ।মেইপা লাগবে না, ঠিক হয়ে যাবে ।' ললিতার গলায় সংকোচ । 'ঝাল করে, তেঁতুল দিয়ে একটা পালটৈ খেলে, কেটে যাবে মুখের অরুচি । এজন্য মেইপা ডেকে কি লাভ ?' তবু, মন মানলো না শ্বাশুড়ীর, মেইপাকে ডাকালেন । বউটার এখানে কেউ নেই । মনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, দুতিন গ্রাম পার হয়ে, হেইজামপি বা ডলুগাঁও-এ তার জ্যাঠতুতো দাদা-দিদিরা থাকেন । কোনো খোঁজখবর রাখেন না এই বোনটির, তার হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য । এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি তারা । ফলে, তাকে দেখতে আসে না কেউ ।


এবাড়িতে বড়বউয়ের দাপট বেশি, আজ অবধি একটি কথাও বলেনি এসে । তবে ছোটোছেলের বউ মাঝে মাঝে আসে, দু একমিনিট কথা বলে । সেও তিনবছরের বাচ্চা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে এখন । সারাদিন একা পড়ে থাকে ললিতা । তার নিঃসঙ্গতার পাশে আর এক একাকিনী বউ, ঠাকুর মিলিয়েছেন ভালো । আশ্চর্য এক মায়া পড়ে গেছে বউটার প্রতি । এটা অনুভব করেন শ্বাশুড়ী । মেইপা এল বিকেলের দিকে, গ্রামেরই ছেলে, ভদ্র বলে লোকে ডাকে । মনিপুরীদের এই মেইপা অন্য বৈদ্যদের মতো নয়, তার কাজ কিছুটা আলাদা, নাড়ি দেখা ছাড়াও যে শরীরের জায়গায় ব্যথা বা ব্যাধি, সেখানে আঙুল দিয়ে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে, কখনও হাতের তালুর স্পর্শে ঐ ব্যথা সারিয়ে তোলে মেইপা । অষুধপত্র ব্যবহার করতে হয় না এজন্য । ব্যাধির গভীরতা বুঝে, প্রয়োজন হলে, চাপাল দেয় তারা । 


ভদ্রর, এবিষয়ে, বেশ নামডাক আছে এতদঞ্চলে । কালো ছিপছিপে চেহারা, বেশ তোতলা, প্রায় সময়ই তার সকল কথা থেকে যায় অসম্পূর্ণ । ভদ্র এসে, ললিতাকে দেখে নিয়ে, বললো, 'ইইইইননে...' মনিপুরীরা পিসিকে ইনে বলে সম্বোধন করে কখনও কখনও, কেউ কেউ পিহিও বলে ডাকে । 'এত অভিজ্ঞ আপনি, এই সামান্য ঘটনাও ধরতে পারেননি !' হো হো করে হেসে ওঠে ভদ্র । 'মানে ?' শ্বাশুড়ী খুব উদ্বিগ্ন । 'কি বলতে চাইছো তুমি ?' নিজে থেকে এগিয়ে এসে, সামনে রাখা পানের বাটা থেকে, চুনসুপারি আর এক টুকরো সাদা পাতা মিশিয়ে পান তৈরি করে মুখে দিলো ভদ্র । মনিপুরী বাড়িতে কেউ এলে চা নয়, আপ্যায়ণ করা হয় পান দিয়ে । পান তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেরও জরুরি অঙ্গ । যে কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয় পানসুপারি দিয়ে । কলা পাতাকে কেটে ছোটো ছোটো অর্ধচন্দ্র বানানো হয়, তাতে পানসুপারি, ফুল আর একটা টাকা রাখা হয় । একে পানাতাংখা বলে তারা । একজন লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই পানাতাংখা দিয়ে আসে । 


যারা গ্রহণ করবে, তারাই ঐ অনুষ্ঠানের অতিথি । হাসতে হাসতে, বাইরে গিয়ে, পানের পিক ফেলে এসে, ভদ্র বললো, 'আপনার বউমা এখন মা হতে যাচ্ছে ।' ললিতার কানেও গেলো এ কথাটা, শুনে, তার সারা শরীরে বয়ে গেলো এক অজানা শিহরণ । তাহলে মা হতে যাচ্ছেন তিনি ? মা হবেন তিনি ? দুহাত কপালে ঠেকিয়ে, প্রণাম করে, বললেন, 'মহাদেব, শেষপর্যন্ত মুখ তুলে চাইলে এই অভাগিনীর প্রতি ?'

ললিতা গর্ভবর্তী, এই খবর ছড়িয়ে পড়লো, বাতাসে বাতাসে । ভানুবিল থেকে, সব অভিমান ও রাগ ভুলে, চলে এলেন তার মা । রাগ হয়েছিলো, কেন না, ললিতার এই হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তিনি । সন্তানের বাবা, প্রথম পত্নী বর্তমান, এমন পুরুষকে পতি হিসবে বরণ কেন করবে তার মেয়ে ? এতে যে সংসার ছারখার হয়ে যেতে পারে, এটুকু জ্ঞান নেই ললিতার । দ্বিতীয়ত, বিয়ে করছে, এটুকু খবর মাকে জানাতে পারলো না সে ? প্রেমে পড়লে কি লোপ পেয়ে যায় হিতাহিত জ্ঞান ? এখন, লোকমুখে, তার সন্তানসম্ভবা হবার খবর পেয়ে, অভিমান চলে গেলো নিমেষে । 


চোরাই পথে তিনি চলে এলেন ইণ্ডিয়া । মাকে দেখে, খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো ললিতা । ভাবতেই পারেননি তিনি, মা এভাবে চলে আসতে পারেন, কেন না, তার বিয়ের কোনো খবর দেবার সুযোগ পাননি তিনি, সম্ভবও ছিলো না তার পক্ষে, এক ঘোরের মধ্যে ঘটে গেলো সব কিছু । মা দেখলেন মেয়েকে, শরীরটা ভারী হয়ে গেছে অল্প, গায়ের রঙ খুলে গেছে আরও, গর্ভচিহ্ন পরিস্ফুট । 'সুখী হয়েছ তো ?' সুখ কাকে বলে, জানি না, মা । 'তবে আমি ভীষণ খুশি । ভীষণ । আমার নারীজন্ম সার্থক হবে এবার ।' মাকে জড়িয়ে ধরে, ললিতা, এক শ্বাসে, বললো । 


শ্বাশুরীও, ততক্ষণে, এসে বসেছেন পাশে । বললেন, আপনার মেয়েকে বলে যাবেন, 'অতিরিক্ত খুশিতে নিজের শরীরের খেয়াল রাখার কথা যেন না ভোলে । খেতেই চায় না । অথচ এখনই তার খাবার সময় । পেটে আর একজন যে খিদেয় মরছে, সে কথা বলে বোঝাতে পারি না ।ছ'মাসে পড়লো, পেটের জন্য বেশি বেশি করে খাওয়া দরকার ।' তিনজনেই হেসে ওঠে একসঙ্গে । রাতে এসে প্রফুল্ল দেখলেন, শ্বাশুরী এসেছেন ভানুবিল থেকে । 


এই প্রথম ললিতার মাকে দেখা তার । দেখে, অবাক হয়ে গেলেন, এখনও এত রূপ ! বয়সের কোনো চিহ্ন নেই শরীরে । রোগাপাতলা চেহারা হলে কি হবে, চিকনাই বা জেল্লায়, রীতিমতো, পাল্লা দেবেন মেয়েকে । বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখতে কোথাও বাঁধলো তার, চোখ ফেরালেন ললিতার দিকে । বললেন, 'মামী এসেছেন, খবরটা কাউকে দিয়ে পাঠালে ডলুগাঁও গিয়ে হলেও মাছ কিনে আনতাম, অথবা পুকুর থেকে মাছ ধরাতাম ।' 'থাক, তোমার আর মুরোদ দেখাতে হবে না । মা সব ব্যবস্থা করিয়েছেন । বাবাধনকে দিয়ে মাছ ধরিয়েছেন, তিনসের ওজনের একটা কালিয়ারা ধরা হয়েছে । বড়ঘরে রান্না হচ্ছে সবার । কুসুমও গিয়ে সাহায্য করছে রান্নায় ।' ললিতার মুখে এ কথা শুনে, চমকে উঠলেন তিনি, বড় বউ আর বাবাধনের বউ কুসুম মিলে রাঁধছে সবার রান্না ! এ কি করে হয় ? ললিতার নাম পর্যন্ত যে শুনতে চায় না, সেই ছায়া আজ ললিতার মা এসেছে, বলে রাঁধছে, তাও কুসুম সহ ? 


ছায়ার মন কি দৈববলে পালটে গেল আজ ? না কি, সব ভূতুড়ে ব্যাপারস্যাপার ? বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি, বললেন, 'এ কি করে সম্ভব ? আজ কি সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠেছে ?' রাঁধবে না কেন জামাই ? ছায়া তো আমার পিসতুতো দাদার মেয়ে । দুই বোন এর পরিচয় ছিলো না এতদিন ।' ললিতার মার কথা শুনে, ভিরমি খাবার মত অবস্থা প্রফুল্লর । মনে মনে ভাবলেন, বাঁচলেন । দুই সতীনের টানাপোড়েনে পড়ে, তার সংসার করার সাধ চলে যাচ্ছিলো । ভাবছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কোথাও চলে যাবেন চিরজনমের মতো । যাওয়া আর হলো কই ?


আমার জন্মকে স্বাগত জানাবার জন্য চার মহিলা ছাড়া কেউ ছিলো না সেদিন । উলুধ্বনি মনিপুরী সমাজে নেই, তবু নব জাতকের আগমণে একটা খুশির হাওয়া বয়ে যায় চারদিকে । সে হাওয়াও ছিলো না সেদিন । বুধবার, ১২ জানুয়ারি, বাবা গিয়েছেন কাছাড়িতে এক জরুরি কাজে, তাছাড়া পানিচৌকি বাজার সেদিন, মনু নদীর পূবপাড়ে, কৈলাসহরের এটাই মূল বাজার । কাছাড়িতে গেলে, লোকে এখান থেকেই ভালোমন্দ আনে কিনে । শহরের বাজার, বলে, সব কিছুই মেলে এখানে । কাকা ছিলেন পেঁচাডহরে, শ্বশুরালয়ে । 


সারাদিন ঠাকুমার সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটিয়েছেন মা । দুপুরে, মানে. বারোটা নাগাদ, ভাত খেয়ে, বিছানায়, শুয়েছিলেন । শরীরটা এখন বেশ ভারি, চলতে ফিরতে কষ্ট না হলেও, আগের মত সহজে চলাফেরা করতে অসুবিধে হয় বেশ । ঠাকুমা প্রতিনিয়ত নজরে নজরে রেখেছেন মাকে । মাঝে মাঝে শাসনের সুরে বলেন, 'চলা ফেরা একটু আধটু না করলে জল জমে যাবে । এ সময় জল জমা ভালো নয়, ললিতা ।' ভেতরে ভেতরে একটা হিসাব রাখছিলেন তিনি । সে অনুযায়ী মাকে গাইড করছেনও । মা বিছানায় গড়াতে যাচ্ছেন, দেখে, বললেন, 'বেশিক্ষণ শোবে না । উঠে পড়বে তাড়াতাড়ি ।' মাথা নেড়ে, সম্মতি জানিয়ে, বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলেন মা । 


দশমিনিটও হয়নি, তিনি চলে গেলেন ঘুমের রাজ্যে । সেখানে, একটা ছোট্ট ছেলে, ফুটফুটে গায়ের রঙ, আদুল ঘা, হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে তার দিকে এগিয়ে এলো । ছেলেটির সঙ্গে কেউ নেই । মনে মানে ছেলেটির মায়ের উপর রেগে গেলেন তিনি । এ কি আক্কেল বাবা ! এই টুকু বাচ্চাকে একা ফেলে কেউ যায় না কি আক্কেলজ্ঞান নেই ? বাচ্চাটি এগিয়ে এসে বললো, তোমার কোলে আমাকে নেবে ? বাচ্চাটিকে কোলে নেবেন কি নেবেন না, ভাবছিলেন, তখনই দূর থেকে একটা ঢিল এসে যেন লাগলো তলপেটে এসে লাগলো, ব্যথায় কুঁকড়ে গেলেন মা । ঘুম ভেঙে গেলেও লক্ষ্য করলেন. তলপেটে খুব ব্যথা হচ্ছে । মনে হচ্ছে শরির নিংড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ । মা-র এই অস্পুট গোঙানি শুনে এগিয়ে এলেন, এবং মাকে দেখে, বুঝলেন, এ প্রসববেদনার ব্যথা । তাড়াতাড়ি বড় নাতিকে ডাকলেন, আর বললেন, 'যা, মাঘকে ডেকে নিয়ে আয় ।' মাঘ এসেই, ঘরের দরজা জানালা দিলেন বন্ধ করে, যাতে ছোটোরা কেউ এই দৃশ্য না দেখে । কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম জপছেন ঠাকুমা, আর মাঘ যা বলছেন, করছেন । 


ততক্ষণে, পাশের বাড়ির দুই বউ, রেবতী ও তারাবতীও এসেছেন চলে । তার আগে মাথাটা অল্প বের করেছি আমি, যেন এই সংসারটা কেমন, পরখ করে নিচ্ছি তা । দুই হাতে আমার মাথাটা ধরলেন মাঘ, তারাবতীকে বললেন, যোনিমুখ একটু মেলে ধরতে । এটা ঠিক, আমার আসার পথ সুগম ছিলো না ততটা, তারাবতী মাঘনির্দেশ পালন করতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি । টুপ করে চলে এলাম পৌষের প্রাকগোধূলির এই পৃথিবীতে, এসে অবাক হয়ে তাকাচ্ছি চারদিকে । কোনো কান্না নেই, বিমূঢ় আমি, রক্তভেজা চোখ খোলার চেষ্টা করছি, আর হাত পা ছুঁড়ছি মাঘর দুহাতের তালুতে থেকে । আমাকে দেখে ঠাকুমাই কথা বললেন প্রথম, অ' মা, ছেলেটা কাঁদছে না কেন ? 



বুঝতে পারলাম না, পৃথিবীতে এলে কেন কাঁদতে হয়, না কি, এ জগত শুধু কান্নার জন্যই ? আমার পিঠের নিচে, পাছার কাছে বেশ জোরে একটা থাপ্পড় মারলেন মাঘ । ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম আমি । 'এই তো কাঁদছে !' রেবতী যেন বলে উঠলেন । মুখটা দেখেছো ? অবিকল প্রফুল্ল, ঐ কানেল লতি, ঠোঁট, চোখ, প্রশস্ত কপাল, হুবহু প্রফুল্ল । কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন ঠাকুমা, তিনিই প্রথম মাঘর কাছ থেকে তার নাতিকে তুলে নিলেন বুকে । মা-র তখন সবে জ্ঞান ফিরছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছে শরীরে । কাঁপতে কাঁপতে জিগ্যেস করলেন, ছেলে, না, মেয়ে ? এসব কথার ফাঁকে আমাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে দিয়ে, একটা নতুন কাঁথায় মুড়ে আমাকে মা-র বুকের কাছে রেখে দিলেন মাঘ । মা একহাতে কাছে টেনে নিলেন আমাকে । সবাই ভুলে গেলো আমাকে মধু খাওয়াবার কথা ।



আমার নারীরা : ১৬

December 2, 2013 at 8:31pm

আমাকে পেয়ে মা খুব খুশি, যেন তার সাধনার ধন পেয়েছেন তিনি । সন্তানের জন্ম দিতে পারলেই নারীজন্মের সার্থকতা, মনে করেছিলেন মা । তিনি আজ সার্থক । জন্মের ষষ্ঠদিনে, সন্ধ্যায় নামাকরণ অনুষ্ঠান । বাবা জানালেন, নাম রাখবেন তিনি । দুদিন আগেই ভানুবিল থেকে চলে এসেছেন ছোটোমামা এবং দিদিমা । ষষ্ঠীতে মাতুলভূমিকাই মুখ্য । নামাকরণ পর্বও তার হাত দিয়ে হয় । আমি দেখলাম, মন্ত্র পাঠ করছেন পুরোহিত, ঘরের একদিকে লোকজন, মামা পুরোহিতনির্দেশ পালন করছেন । এসব আচারানুষ্ঠেনের মজার বিষয়টি হলো, তীরধনুক নিয়ে মামা প্রস্তুত হলেন মাটিতে এক হাঁট ভর দিয়ে । মন্ত্রপাঠ অনুসারে তিনি ঘরের চতুষ্কোণে নিক্ষেপ করলেন চারটি তীর । 


তারপর সোজা উপরে । হয় তো, আরও অনেকদিকে নিক্ষেপ করেছিলেন তীর, আমি দেখিনি । মা'র দুধ খেতে ব্যস্ত ছিলাম আমি । সব শেষ হয়ে গেলে, নামাকরণ পর্ব । বাবার ইচ্ছানুসারে, মামা আমার নাম রাখলেন সমরজিত্‍ । অর্জুনের আর এক নাম । পূর্বফালগুনী আমার জন্মনক্ষত্র, অর্জুনের জন্মনক্ষত্রও না কি পূর্বফালগুনী । রণজিত্‍, অভিজিত্‍ এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, অর্জুনের এই নামটাই বেছে নিলেন । তিনি কি তখন জানতেই, আমি জীবনে কথনও সমরজিত্‍ হতে পারবো না, হয়ে থাকবো পরাজিত । কানা ছেলের নামও শখ করে বাপ-মা রাখেন পদ্মলোচন । 


ঠাকুমা শুধু বললেন, অত বড় নাম আমি ডাকতে পারবো না । আমার এই নাতিকে ডাকবো, সোম । ঠাকুমার মনিপুরী উচ্চারণে এই নাম হয়ে উঠলো সম । ষষ্ঠীর অনুষ্ঠান শেষে খাওয়ার পালা । চিরাচরিত রীতি অনুসারে কাপক মানে খই, গুড় মাখানো, কলা বিলানো হলো অভ্যাগতদের মধ্যে । ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি মা'র কোলেই । আমাকে ঘিরে মা'র আনন্দ যেমন অন্তহীন ছিলো, দিদিমা ও ঠাকুমারও কম ছিল না সেই আনন্দ । কোনো কোনো রাতে বাবাকে পেতাম কাছে, বাবার বুকে চুপ করে শুয়ে থাকতাম আর পিট পিট করে তাকাতাম বাবার দিকে । ক্রমে বাবাকে যেন কম পেতে শুরু করলাম । ততদিনে, আমার জন্মের ছ'মাসের মাথায়, আমার এক ভাই হলো বড়মা'র ঘরে । তার আগে, আমার জন্মের পনেরো দিনের মাথায় কাকার ঘরেও এলো আর এক ভাই । ফলে, সারা বাড়িতে তিন বাচ্চাকে নিয়ে এক সোরগোলে পরিবেশ । 


আমি খুব কান্নাকাটি করতাম, চিত্‍কার করতাম, মেজাজও ছিলো একরোখা ও তিরিক্ষি । সামাল দিতে পারতেন মা, সামাল দিতেন ঠাকুমা । এভাবে বড় হতে থাকি আমি । এই বড় হওয়ার পেছনে মা যতখানি, আমার ঠাকুমারও ঠিক ততখানি ভূমিকা । একদিন বাবাকে বললেন, 'সমকে বালোয়াড়ি স্কুলে ভর্তি করাবে না ? ও যে বড় হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল আছে তোমার ?'


বালোয়াড়ি স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না আমার । তার চেয়ে, কালটুকে নিয়ে, বাড়ির পেছনের দিকে চলে যেতাম, একা একা । কখনও কখনও চলে যেতাম বটগাছের নিচে, শিবের থানে । মা ডেকে ডেকে মরতেন, পাগলিনীর মত খুঁজতেন আমাকে । খুঁজতে খুঁজতে, একদিন, আমাকে আবিষ্কার করলেন ঐ শিবের থানে । ঐটুকু বয়সে, একা, এই নির্জনতম স্থানে, কি করে চলে এলাম, ভেবে, চিত্‍কার করে কাঁদতে শুরু করলেন । ঘরে এনে, আমার পিঠে বসালেন দু'চার ঘা । আর আমিও হাত-পা ছুঁড়ে শুরু করি চিলে কান্না । ঠাকুমা এসে বাঁচালেন আমাকে । মা'কে বকলেন খুব, বললেন, 'দোষ তো তোমারই । চার বছরের ছেলে, তাকে নজরে নজরে রাখতে হয়, সে কাণ্ডজ্ঞান নেই কেন তোমার ? তবু তো শিবের থানে গেছ ! পুকুরে চলে গেলে কি হতো, ভেবে দেখেছো ?' আমাকে আদর করতে লাগলেন কোলে নিয়ে । 


বললেন, 'সম, আজ বালোয়াড়িতে যাও নাই কেন ?' 'আমার ওখানে ভালো লাগে না । আমি স্কুলে যাবো না ।' ঠাকুমাকে বললাম আমি । 'ঠিক আছে, যেও না । আমিও তো স্কুলে যাইনি কোনোদিন । তুমি শুধু আমার সঙ্গেই খেলাধূলা করো । কেমন ?' খুব খুশি আমি । মা বিরক্ত, বললেন, 'পড়াশোনা না করলে ও মানুষ হবে কি করে ? এভাবে লাই দেবেন না আপনি ।' ঠাকুমা হাসতেন । একদিন, বিকেলে, দেখলাম, বড়মার সঙ্গে ঝগড়া করছেন মা । দুজনের মধ্যে কথা বলতেও দেখিনি খুব একটা । মা বলছেন, 'তুমি এটা খুব খারাপ কাজ করেছো । 


শিলঙ থেকে আমার নামে ভাই পাঠিয়েছে, টাকা, তুমি তা নিতে গেলে কেন ?' পরে, জেনেছি, আমার জন্য মা'র নামে ৫০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন মামা মানি অর্ডার করে । বড় মা পোস্ট অফিসে গিয়ে মা'র হয়ে টিপসই দিয়ে টাকাটা নিয়েছেন । এটা অনেকদিনের আগের কথা । নতুন পোস্ট মাস্টার । আমাদের বাড়ির সঙ্গে ততটা পরিচিত হননি তিনি । তখন পূর্বপাকিস্তান থেকে এক পরিবার দু পরিবার করে বাঙালী আসতে শুরু করেছেন এগ্রামে । পোস্ট মাস্টার তাদের একজন । কি করে যে ওপার থেকে এসেই সরকারি চাকুরি পেয়ে যাচ্ছে লোকে, এ নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে তখন ।


ঘটনাটা প্রথমে জানতেন না মা । মামার চিঠিতেই প্রথম জানতে পারলেন । মামা লিখেছিলেন, পরম পূজনীয় দিদি, পর সমাচার এই যে, ভাগিনার ষষ্ঠীতে আসিতে পারি নাই । ইহাতে কষ্ট পাইয়াছি খুব । গত তিনবছর নানান ঝামেলা ছিলো । এক্ষণে ভাগিনার জন্যে মং ৫০০ টাকা পাঠাইলাম তোমার নামে । এই টাকা দিয়া ভাগিনার জন্য সোনার হার কিনিয়া দিও । ভাগিনাকে দেখিতে আসিব । তুমি কেমন আছ ? জামাইবাবুকে প্রণাম জানাইও । চিঠিটি মানি অর্ডারের তিন সপ্তাহ পরে আসে এবং নতুন পিওন অর্থাত্‍ হরিমোহন পিসেমশাই মা'কে পড়ে শোনান । তিনি মা'র এক ছোটোবোনের বর । পোস্টাপিসের এই চাকুরিতে ঢুকেছেন এক সপ্তাহও হয়নি । চিঠির বয়ান শুনে, অবাক হয়ে গেলেন মা । 


'রাধামোহন টাকা পাঠিয়েছে ?' 'হ্যাঁ, দিদি ।' 'আশ্চর্য ! আমি তো পাইনি !' ঠিকা আছে, দিদি, আমি খোঁজ নিয়ে কাল জানাচ্ছি ।' হরিমোহন পিসেমশাই পরদিন এসে জানালেন, তিনসপ্তাহ আগে, টাকাটা নেওয়া হয়েছে । যে নিয়েছ, তার চেহারার বর্ণনা পোস্টমাস্টার যা দিয়েছেন, তার সঙ্গে বড়মার মিল খুব বেশি । এখানেই থেমে নেই ঘটনাটা, সঙ্গে গিয়েছিলো বড়দা, যে মা'র খুব নেওটা, এবং আজই মাকে জানিয়েছে, বড়মা সত্যিই একদিন পোস্ট অফিসে গিয়েছিলো । কেন, তা জানে না বড়দা । এই ঝগড়া চলেছিলো অনেকদিন ধরে । এবং একে কেন্দ্র করে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গেলো দুই মা'র মধ্যে ।


আমাকে নিয়ে ঠাকুমার গর্বের অন্ত নেই । কেন এই গর্ব, তা জানি না । সবাইকে বলেছেন তিনি, তার নাতিনাতনীদের মধ্যে সম সেরা । 'আমার সমই বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে একদিন ।' অথচ পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না আমার একদম । আমার কেবল ভালো লাগে গল্প করতে আর গল্প শুনতে । 


ঠাকুমা আমাকে বলতেন, আমাদের বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ, একবার, পরী ধরে, ঘরে, পুষে রেখেছিলেন । অবাক হয়ে যাই, এও কি সম্ভব ? ঠাকুমা হাসতেন । বলতেন, 'তোমার ঐ পূর্বপুরুষ ঐ পরীর নাম রেখেছিলেন জ্যোত্‍স্না । তোমার দিদির নাম, ঐ কারণেই, তোমার বাবা রেখেছেন জ্যোত্‍স্না । ঐ পরীর ডানা লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি, তোমার ঐ ঠাকুরদার ঠাকুরদা । পরী কীভাবে ধরতে হয়, জানো ?' মাথা নাড়ি আমি । 'দল বেঁধে, পূবের ঐ মাঠে পরীরা আসে প্রতি পূর্ণিমা রাতে । ডানা খুলে তারা নাচে আর গায় সারারাত । একবার, তাদের একজনের ডানা লুকিয়ে ফেলেছিলেন তোমার ঐ ঠাকুরদা । ডানা না থাকলে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা থাকে না পরীর । সে আর ফিরে যেতে পারলো না । মাছ ধরার জাল ফেলে, তাকে ধরে ফেললেন তিনি ।' 'তারপর ?' শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আমার । পরীও ধরা যায় ? পরীকেও ঘরে পোষা যায় তবে ? ঠাকুমা বললেন, 'আর বলো না, সম, প্রতিদিন, পুকুর পাড়ে গিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে, কাঁদতো সেই পরী । তার কি আর এই জগত ভালো লাগে ? নিরুপায় সে । তাকে ঘরের সব কাজ করতে হতো । একদিন, ঘরের কাজ করতে গিয়ে, তার ডানা খুঁজে পায় পরী । সেদিনই ফিরে গেলো জ্যোত্‍স্না, যাবার আগে, অভিশাপ দিয়ে গেলো তোমার ঐ ঠাকুরদাকে । তোমার বংশের পুরুষরা বহুগামী হবে । নারীই হবে তাদের সর্বনাশের কারণ, নারীই তাদের পরিত্রাণকর্ত্রী ।' 'বহুগামী কি ঠাকুমা ?' ঠাকুমা হাসলেন, 'অনেক বউ যার থাকে তাকে বহুগামী বলে । তোমার বাবা বহুগামী ।' 'আর আমি ? আমিও কি বহুগামী হবো ঠাকুমা ? আমারও কি অনেকজন বউ থাকবে, ঠাকুমা ?' বলে উঠি আমি ।

ঠাকুমা আমাকে মাথায় তুলে ফেলছেন, বলে, মা'র দুশ্চিন্তার অন্ত নেই । ছেলেটা আর মানুষ হলো না তবে ! আমারও কোনো ইচ্ছে নেই মানুষ হবার । আমার শখ পরীদের নাচ দেখার আর তাদের সঙ্গী হবার । দিন আর রাত কাটে পরীদের চিন্তায় । তখন কি জানতাম, পরী চিরঅধরা । মা'র খুব ভয়, ছেলে পরীদের পাল্লায় পড়ে গেলে ফিরে আসবে না আর । তখন কি হবে ? এই তো, মোহনপুরের ঙৌবা অজার মেয়েটাকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পরীরা । যখন ফিরে এলো, সে আর এই জগতের কেউ নয় । লোকে বললো, পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা । পরীতে পেলে কি লোক পাগল হয়ে যায় ? তাহলে কি পাগল হয়ে যাবো আমিও ? ঠাকুমাকে জিগ্যেস করতে গিয়ে দেখি, গুরুচরণ ডাক্তার এসেছেন । খুব গম্ভীর তিনি । ঠাকুমার শিয়রে বসে মা । তিনিও গম্ভীর । বাবা পাশে দাঁড়িয়ে । বড়দা ফাইফরমাশ খাটছেন তাদের । বুঝতে পারলাম না, ঠাকুমার আসলে কি হয়েছে ? ঠাকুমার কি খুব খারাপ কিছু হয়েছে ? আমার, কেন জানি না, কান্না পেয়ে গেল হঠাত্‍ । দৌঁড়ে, পালিয়ে, চলে এলাম সেখান থেকে । মন চাইলো, চলে যাই শিবের থানে । সেখানে, শিবলিঙ্গকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগলাম হাউমাউ করে । এই কান্না অন্তরের গোপনতম স্থলে এতদিন ছিলো, বুঝতে পারিনি । কতক্ষণ কেঁদেছিলাম, জানি না, এটুকু টের পেলাম, এই কান্নার ভেতর, আমার কাঁধে যেন কার হাতের স্পর্শ । পিছন ফিরে, তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই । অথচ আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, কেউ যেন আমার কাঁধে রাখলো তার হাত । গা শিউরে উঠলো আমার । রাতে মা বললেন, তোমার ঠাকুমার শরীর খুব খারাপ । শুয়ে পড়ো । কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়লাম আমি, আর প্রার্থনা করতে লাগলাম, ঠাকুর, আমার ঠাকুরমাকে ভালো করে দাও । পরদিন, সকালে. ঘুম যখন ভাঙলো, ঘরভর্তি লোক । আমি, ভয়ে ভয়ে, ঠাকুমার কাছে গেলাম, দেখলাম. ডান হাত বাড়িয়ে তিনি আমাকে টেনে নিলেন । কথা বলতে পারছেন না, খুব কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস নিতেও যেন আর পারছেন না তেমন । মা কাঁদছেন অজোরে । বড়মা, কাকীমাও রয়েছেন । কাকাকে দেখলাম, বড়ো উদ্বিগ্ন । ঠাকুমা তবু প্রায় ফিস ফিস করে, ভাঙা ভাঙা শব্দে বললেন, সম, আমি থাকবো নারে ! তোমাকে বাঁচাতেই একদিন আসবে সে । আরও হয়তো বলতে চাইছিলেন তিনি । তার ডানহাতের হাতের তর্জনি উপরের দিকে উঠলো আর পড়ে গেলো নিচে । কিছু বুঝে উঠবার আগেই সারা ঘরে কান্নার রোল বয়ে গেলো ।

মনিপুরীদের পরলোকগমন দৃশ্য খুব সুন্দর । ঠাকুমাকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে আসা হলো তুলসীতলায় । তার আগে, সেখানে আস্ত এক কলাপাতা পেতে রাখা ছিলো, যাতে চিত করে শোয়ানো হলো তাকে । বাড়ির মহিলারা সবাই কাঁদছেন, কান্নার কোরাসের মাধুর্যই আলাদা । অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি আমি । মরে যাওয়া কাকে বলে, তখনও ঠিক করে জানি না । ওদিকে, কেউ যেন বাজালো সেলপঙ, অনেকটা মৃত্যুঘণ্টার মতো দেখতে এটা । বিশাল সাইজ, মাঝখানটা কিশোরী স্তনের মত, উঁচু, ঐ উঁচুস্থানেই হাতের চেটো ভাজ করে তা দিয়ে জোরে আঘাত করতে হয়, ঐ স্তনাকৃতিতে । এর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, তা শুনে, আশেপাশের লোকজন থেকে শুরু করে এলাকার সকলেই আসতে শুরু করে । কেউ হয়তো লাকড়ি নিয়ে, কেউ বাঁশ নিয়ে, যার যা সামর্থ তা নিয়ে আসে তারা । কৌমসমাজের এটাই রীতি, একের বিপদে সবাই এসে দাঁড়ায় পাশে । আনন্দেও থাকে এভাবে । আমরা ছোটরা এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছি, ব্যস্ততাও কম নেই আমাদের । বাঁশ দিয়ে পুরুষেরা নিমেষে তৈরি করে ফেললো, ঠাকুমার বিছানা । ইশালপা মানে গায়ক আর ডাকুলা অর্থাত্‍ মৃদঙ্গবাদক এসে গেছেন এর মধ্যে । কান্না বেড়ে গেলো যেন হঠাত্‍ করে । এইগা আসেননি এখনও । এইগা মানে পুরোহিত । মাকে দেখলাম, ঠাকুমার বুকের উপর, উপুঢ হয়ে, হাউমাউ করে কাঁদছেন, কোনোদিকে হুঁশ নেই তার । এইগা এলেন বেশ পরে । মুহূর্তে, শুরু হয়ে গেলো তত্‍পরতা । দুপুরের পরে ঠাকুমাকে তার ঐ বাঁশের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, চারজনে কাঁধে নিলেন তা । বাবা আর কাকা সামনে । দুজনের মুখ গম্ভীর । ইশালপা গান ধরলেন, মাথুরপর্ব । ঠাকুমা চললেন চার বেয়ারার কাঁধে ।

আমার নারীরা : ২১

December 8, 2013 at 8:36am

আরাং মানে বাড়ির সদর দরজা থেকে ঠাকুমাকে নিয়ে যখন বের হলেন সবাই, পাশে আমরা ছোটোরা । নদীর দিকে এই যাত্রা । শিবের থান পাবার আগে, কয়েকটা আমকাঁঠালের গাছ । সারিবদ্ধ ভাবে পথের পাশে দাঁড়িয়ে । সেখানে গিয়ে, কি মনে হলো আমার, ঠাকুমার পাশে পাশে, ভালুকের মত, চারপায়ে, হাঁটতে শুরু করলাম । মনে হলো, ঠাকুমা হাসছেন আমাকে দেখে । বললেন, 'আমার সম আজ সম সেজেছে ।' ঠাকুমার দিকে তাকালাম, এত উঁচুতে তিনি, দেখতে পেলাম না । বললেন, 'ওখান থেকে আমাকে দেখতে পাবে না । দেখতে হলে এসো, উপরে উঠে আমার কাছে চলে এসো ।' বলে, চুপ হয়ে গেলেন তিনি । মাথুরপর্বে রাধার বিরহ এখন চরমে । ইশালপা গাইছেন । সেদিকে মন নেই আমার । ঠাকুমা আবার মুখ খুললেন, 'না, সম । তোমাকে আসতে হবে না । তোমার এখন শুরুই হয়নি । থাকো । আর, শেষ মুহূর্তে, সে তো আসবেই ।' আর বলতে পারলেন না, তাকে এনে রাখা হলো নদীর পাড়ে । সেখানে আমাদের আগে লোক চলে এসেছে । একটা জায়গায় আড়াআড়িভাবে, ভুল বলা হলো, চতুর্ভজ তৈরি করে কাঠ রাখা হয়েছে, একটার পর একটা । ঠাকুমাকে শোয়ানো হলো সেখানেই । তারপর আবার চাপানো হলো কাঠ । মোট সাতটি স্তরে কাঠ চাপিয়ে রচনা করা হয় কু অর্থাত্‍ চিতা । বাবা আর কাকা এর চারদিকে ঘুরছেন আগুনের এক মশাল হাতে । আমার মন সেদিকে নেই, তাকিয়ে আছি ঠাকুমার দিকে । কাঠের আড়ালে তিনি । মৃত্যু কি একেই বলে ? এই কাঠের আড়ালে চলে যাওয়াকে ? এত গান, হৈ চৈ এর ভেতর, আমি অনুভব করছি, কোথাও কোনো শব্দ নেই, তরঙ্গ নেই । এই প্রথম আমার দুটি গাল, টের পেলাম, ভিজে যাচ্ছে নোনাজলে । কে একজন এসে আমাকে সরিয়ে দিলেন সেখান থেকে । আমার ভাইয়েরা নেমেছে নদীতে । হুটোপুটি খাচ্ছে জলে । ধীরে ধীরে আমিও নামলাম জলে । তখনই দেখলাম, ঐ চিতা হয়ে উঠলো আগুনের কুণ্ডলী । আমি চিত্‍কার করে উঠলাম, 'ঠাকুমা--' বড়দা এসে, জড়িয়ে ধরলো আমাকে । থর থর করে কাঁপছি আমি । সবাই নেমে আসছেন নদীতে । ডুব দিয়ে উঠে যাচ্ছেন পাড়ে । বাবাকে, দূর থেকে, দেখলাম, এক নিমেষে তাকিয়ে আছেন সেদিকে । কি দেখছেন বাবা ? চিতা নিভে এলে, ধীর পায়ে, বাবা আর কাকা মাটির কলসী দিয়ে জল এনে ঢাললেন চিতায় । ছাই আর আগুনের ধোঁয়া সেখানে, কোথাও আর দেখতে পেলাম না ঠাকুমাকে । ছাই হয়ে গেলেন তিনি ? মৃত্যু মানে ছাই হয়ে যাওয়া ? শ্মশান থেকে ফেরার পথে বাবা আমাকে কাছে টেনে নিলেন । অনেকদিন পর, তিনি আমাকে এভাবে কাছে নিলেন । বললেন, 'ঠাকুমা তোমাকে খুব আদর করতো, না ?' হ্যাঁ বা না, কিছু না বলে, পেছন দিকে ফিরে তাকালাম । ও মা ! চমকে উঠলাম আমি । এবং ভয়ও । 'বাবা !' ফিসফিস করে বললাম, 'দেখো, প্রেত !' বাবা ফিরে তাকালেন, ম্লান হেসে, বললেন, প্রেত নয় । 'ও তো সেনাচাউবা খুড়ো । শ্মশান বন্ধন করছেন । যাতে কোনো প্রেত বা অপদেবতা ঐ শ্মশানে এসে উত্‍পাত না করে । এটা আমাদের রীতি ।' মনে মনে বললাম, ঠাকুমা, ভয় পেও না । ভুতপ্রেত তোমাকে কিছু করতে পারবে না । সেনাচাউবাদাদু সব আয়োজন করে দিচ্ছেন তার ।

আমার নারীরা : ২২

December 9, 2013 at 9:51am

ঠাকুমার এই ঘটনার তিনমাস পর, এক সকালে, এই বাড়ি ছেড়ে, চলে যেতে হলো আমাদের । আশ্রয়দাত্রীই যেখানে নেই, সেখানে আমাদের রাখবে কে ? সকালে, উইলস কোম্পানির একটা জীপ গাড়িতে চড়ে বসলাম আমরা । গ্রামের পূবদিকে ধানক্ষেত, তারপর প্রধান সড়ক, কৈলাসহর থেকে চলে গেছে কুমারঘাটের দিকে, আসাম আগরতলা রোডে । গাড়ি স্টার্ট দিতেই বমি শুরু হয়ে গেলো আমার । সঙ্গে চিত্‍কার করে কান্না । সেই আমার প্রথম গাড়ি চড়া । পেট্রলের গন্ধে বেরিয়ে আসছে পেটের নাড়িভূড়ি । আমার চিত্‍কার শোনে কে ? বাবা মাকে কি যেন বললেন, মা আমাকে জল খেতে দিলেন । কাকস্য পরিবেদনা । ক্রমে বমি বাড়তেই লাগলো, যখন জলাই ছেড়ে গাড়ি পাহাড়ের ভেতর ঢুকলো, বমির মাত্রা এত বেড়ে গেলো, যে, বাধ্য হয়ে, থামাতে হলো গাড়ি । ড্রাইভার প্রচণ্ড বিরক্ত, মা লজ্জিত, বাবা নিরুত্তাপ । কুমারঘাট থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণে, আসাম আগরতলা রোডের উপর একটা ছোটো বাজারে এসে থামলো গাড়ি । জায়গাটার নাম বেতছড়া । বলরাম মামার বাড়ির পাশে একটা ঘরে এসে উঠলাম আমরা । টিলাভূমি । বাজারের সামান্য উত্তর থেকে যে কাঁচা রাস্তাটি চলে গেছে ডার্লং পাড়ার দিকে, তার শুরুতেই তিনবাড়ি পর, আমাদের এই নতুন বাসস্থান । পরে জেনেছিলাম, বাজারের পূবদিকে কয়েক কানি ধানী জমি কেনা হয়েছে আমাদের জন্য । যেহেতু বাবা বদলী হয়েছেন মশাউলী স্কুলে, এবং জলাই থেকে চাকুরি করা সম্ভব নয়, এ কারণেই এই বন্দোবস্ত । 


আমাদের বাড়ি টিলার উপরে, উত্তর দিকে, টিলার নিচে ছোটো এক পুকুর, যেখানে স্নান করতে হতো আমাদের । বলরাম মামার বড় মেয়ে ফাজা আমার সমবয়সী, হয়তো এক বছরের বড় হবে, ভাব করতে এলো আমার সঙ্গে । ছটফটে, মারকুটে ফাজাকে দিদি বলে ডাকতাম । তার সুযোগ নিতো হরদম, আমাকে শাসন করে । এই নতুন জায়গায় এসে, মা খুব খুশি । মনিপুরী, ডার্লং, কুকি, আর কয়েকঘর বাঙালী পূর্বপাকিস্তান থেকে চলে এসেছেন, দোকানপাট দিয়ে বসেছেন বাজারে । দিনকয়েক মনমরা থাকলেও ভালো লাগতে শুরু করলো আমার ।


পুকুরে স্নান করতে গেলে দেখতাম, এক পাল হরিণ এসেছে নেমে । জল খাচ্ছে কেউ, লুঙ্গার মত জমিটায় ঘাস খাচ্ছে কেউ । হরিণ দেখে আমি মুগ্ধ, বোধহয়, তারাও আমাকে দেখে অবাক । আমার দিকে ঘাড় তুলে তাকালো তারা । হয়তো ভাবছে, এ বাবা ! এই আজব লোকটা এলো কোথা থেকে ? আমি এগিয়ে যাবো কি না, ভাবছি, একটু ভয় যে নেই, তা নয়, বিশাল বিশাল শিং, ডালপালা মেলানো, শরীরে শাদা শাদা ফুটকি হালকা বাদামীর উপর । এক একটা গরুর উচ্চতা সমান বা তার বেশি । হঠাত্‍, কি একটা শব্দ হলো, হরিণগুলি লাফ দিয়ে চলে গেলো জঙ্গলের দিকে । তাদের ঐ পলায়নপর দৃশ্য দেখে হাততালি দিয়ে উঠলাম, একা একা । ক্রমে, তারা, এই হরিণেরা, বানরেরা নিত্য সহচর হয়ে উঠলো আমার ।


আমার নারীরা : ২৩

December 9, 2013 at 10:34pm


একদিন মা আমাকে একটা শ্লেট এনে দিয়ে বললেন, লিখতে শেখো । শাদা ধরণের একটা খড়িও তুলে দিলেন হাতে । বালোয়াড়ি স্কুলে অ আ ক খ শিখছিলাম, স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না, বলে, সেই শেখাটাও হলো না । এখন, হাতে খড়ি নিয়ে, বসে রইলাম চুপ করে । কি লিখবো আমি ? মন খারাপ হয়ে গেলো আমার । মাকে বললাম, 'আমাকে শিখিয়ে দাও তুমি ।' রান্নার আয়োজন করছিলেন তিনি, আমার কথা শুনে, ম্লান হাসলেন, বললেন, 'আমি তো লেখাপড়া করিনি, বাবা !' 'করোনি ? বাঃ ! তাহলে, আমিই বা করবো কেন ?' বেশ খুশি হয়ে বলে উঠলাম । খুশির আয়ু ক্ষণস্থায়ী । মা গম্ভীর গলায় বললেন, 'বাবা এলে সন্ধ্যেবেলা লেখা শিখে নেবে ।' 


বাবা, সেদিন, এলেন বেশ রাত করে । তার আগে, হুলুস্থল কাণ্ড ঘটে গেছে । গোয়ালঘর থেকে চিতাবাঘ এসে নিয়ে গেছে একটা গরু । ফাজাদিদের গরু, প্রথমবার গাভীন হয়েছিলো, কালো শরীরের উপর শাদা রঙ চাপানো । পাড়ার লোকজন এসে জড়ো হয়েছেন ততক্ষণে । কথা বলছেন, প্রত্যেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন বলরাম মামাকে । বাবা এলেন সেই সময় । কিছু উদ্বাস্তুকে এনে এই বেতছড়াতে বসিয়েছেন সরকার ।


 মূলত বন কেটে বসত গড়তে হয়েছে মানুষকে । কুকি ও ডালং রা, এর ফলে, খানিকটা হঠে গেলেও, বন্য পশুরা তাদের মতো স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে এই জঙ্গলে । মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করলেও চিতাবাঘ তার শিকারে ব্যস্ত । বলরাম মামাকে দেখলাম, ভেঙে পড়েছেন । বাবা হাত রাখলেন মামার কাঁধে, বললেন, 'যা গেছে, তা নিয়ে ভাবতে যেও না । বরং এখন থেকে আরও সতর্ক হও তোমরা ।


'আমার নারীরা : ২৪

December 11, 2013 at 3:13pm


গ্রামটির নাম বেতছড়া, পেছনে মনু নদী । পার হয়ে গেলে রাতাছড়া । এতদঞ্চলে ছোটো ছোটো পাহাড়ি স্রোতস্বিনীকে ছড়া বলা হয়ে থাকে । বেতছড়া গ্রামটিও হয়েছে এভাবে এক ছড়ার নামে । বাজার পেরিয়ে, আগরতলার দিকে তিন পা বাড়ালেই এই ছড়াটি । প্রস্থে ২৫ হাত হবে কি হবে না । মনু নদীতে গিয়ে মিশেছে এই ছড়াটি । একদিন, এই ছড়া পেরিয়ে, টিলার উপর বেতছড়া প্রাইমারি স্কুলে, আমাকে নিয়ে গেলেন মা । ভর্তি করিয়েও দিলেন । স্কুল দেখে আমার খুশির অন্ত নেই । 


বালোয়াড়ি স্কুলে মাঠ নেই, ছোটো ঘর, এখানে তা উলটো । টিলার উপর বিশাল মাঠ, মাঠ পেরিয়ে স্কুল । অনেকগুলি ঘর । আমার মত বাচ্চা অসংখ্য । পরদিন, মাকে প্রণাম করে, ফাজাদিদির সঙ্গে রওনা দিলাম স্কুলে । কয়েকটা বই সহ ঐ শ্লেট । বইগুলিও কোথা থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছেন মা । রোল কলের পর, মাস্টারমশাই ডাকলেন আমাকে । দীর্ঘকায়, পেটানো শরীর, আধপাকা চুল, তার প্রায় কালো রঙে জেল্লা এনে দিয়েছে । পরে জেনেছি, তিনি সুধীর স্যর । তার নামে অনেক কাহিনী । 


আমার অবাক লেগেছে একটি কাহিনী শুনে । কাহিনীটি নিখাদ সত্যি । এক্সিডেন্টে মারা যাবার ভয়ে কখনও তিনি চড়েন না গাড়ি । সবই করেন হেঁটে হেঁটে । এমন কি মাস শেষে বেতন আনতে কাছাড়িতে মানে সদর কৈলাসহরে ২৭ মাইল পথ হেঁটে যান প্রত্যেকবার । ফিরেও আসেন হেঁটে । ভয়ে ভয়ে, স্যরের সামনে গিয়ে হাজির হলাম আমি । 'বই এনেছো ?' গম্ভীর, বাজখাই গলা শুনে কেঁপে উঠলাম আমি । তাড়াতাড়ি, বইগুলি এনে দেখালাম স্যরকে । উলটে পালটে দেখলেন তিনি । তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, 'এসব বই কোত্থেকে এনেছো ? অচল সব বই ? যাও, এ দিয়ে চলবে না, বাবা মাকে বলো ।' অপমানে, লজ্জায়, মাথা নুইয়ে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি । আমার সকল ক্রোধ এখন মা'র প্রতি । 


তিনি কি জানতেন না এসব বই অচল ? কি করবো এখন ? কোথায় যাবো তাহলে ? ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না আর । তাহলে ? টিলা থেকে নেমে এলাম আমি । বেতছড়ার কাঠের পুলের উপর. রেলিঙ এ ভর দিয়ে, দাঁড়িয়ে রইলাম । ঝাঁপ দেবো তাহলে ? জলের দিকে তাকিয়ে আছি এক নিমেষে । হঠাত্‍, কি মনে হলো, জানি না, এক এক করে শ্লেট, বই ছুঁড়ে দিলাম বেতছড়ার জলে । ক্রোধ কি তাতে কমে ? শ্লেট ডুবে গেল জলে আর অচল বই ভেসে যাচ্ছে স্রোতে । ক্রমে জামা প্যাণ্ট খুলে ফেললাম । সেগুলিও ছুঁড়ে দিলাম জলে । মনে মনে বললাম, লেখাপড়ার পাঠ এখানেই শেষ হোক । আর স্কুলে নয় । পুলের নিচে, ধীরে ধীরে, নেমে গেলাম । সেখানে, একটা ছায়ায় বসে, কাঁদতে লাগলাম, একা একা । কতক্ষণ কেঁদেছি, জানি না, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুম ভাঙতেই, দেখি, একটা লোক, আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলছে, 'তুমি মাস্টরের পোলা, না ? অনঅ কিতা কররাই ? কিতা অইছে তোমার ?' কি করে লোকটাকে বলি, আমার অপমানের কথা ? 'চলঅ, ঘরঅ যাই ।' লোকটার কথায় হুঁশ ফিরলো আমার । শরীরে সুতো অবধি নেই, এই নেংটো উদোম গায়ে, কি করে বাজার পেরিয়ে যাবো ? মনে পড়লো, এতক্ষণে মা নিশ্চয় আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন বাজারে বা স্কুলে । ফাজাদিদিকেও হয় তো বকবেন । বাবা জানতে পারলে আস্ত রাখবেন না আমাকে । আমি উঠে দাঁড়ালাম । লোকটা তার কাঁধের গামছা দিয়ে বললো, 'পরঅ । না অইলে তোমার বতই দেখি লাইব লোকে ।'


আমার নারীরা : ২৫

December 12, 2013 at 4:11pm


শেষপর্যন্ত স্কুলে যাওয়া আসা শুরু হলো আমার । সে এক অনির্বচনীয় আনন্দ । সকাল হলেই, কখন স্কুলে যাবো, সে ভাবনাতেই ডুবে থাকতো মন । ফাজাদি, কোনোদিন, দেরি করলে, তাগাদা দিতাম । স্কুলে যাওয়া মানে, প্রেয়ারের আগে, আমগাছে উঠে দাপাদাপি । একদিন, একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন সুধীরস্যর । তাকে দেখে সব ছেলে লাফিয়ে নামতে গেলো দ্রুত । কে কার আগে নামবে, যেন তার এক কম্পিটিশন । সবাই নেমে যেতে পারলেও আমি পারলাম না, অনেকটা উপরে ছিলাম বলে । তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে, পা পিছলে, পড়ে গেলাম । পড়বি তো পড়, সুধীরস্যরের ঠিক মাথার উপরে পড়লাম । টাল সামলাতে না পেরে, সুধীরস্যরও উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে । তার পিঠে আমি । থুতনিটা ঢুকে গেলো ভেতরে । বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল গেলো থ্যাঁতলে । পরবর্তী ঘটনা কহতব্য নয় । 


সকল পিরিয়ড ক্লাস করতে দেওয়া হয়নি আমাকে । বাইরে, রোদে, একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো দণ্ডিত হিসেবে । সে আর এক অপমান । চোখে জল এসে পড়েছিলো লজ্জায়, অপমানে । ঘরে ফিরেও আর এক দফা শাস্তি । বাবা আস্ত এক মুলি বাঁশ ভাঙলেন আমার পিঠে । এক দুবার আটকাতে চেষ্টা করেছিলেন মা, পারলেন না । কেউ লক্ষ্য করলো না, আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল থ্যাঁতলে গেছে, নখ গেছে ফেটে, রক্তপাত তখনও বন্ধ হয়নি । মুলি বাঁশ ভেঙে যাবার পর ক্ষান্ত হলেন বাবা । মা অঝোরে কাঁদছেন ঘরের এক কোণে বসে । চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম । গায়ে ব্যথা । মাঝরাতে এলো প্রচণ্ড জ্বর । মনে হয়, জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকছিলাম আমি । হুঁশ ফিরে এলে, মাকে দেখলাম, আমার কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন তিনি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন । 


মাকে দেখে বড় মায়া হলো । পরদিন স্কুলে যেতে পারলাম না । বাজার থেকে এক ডাক্তারকে বলে মা ওষুধ নিয়ে এলেন নখের ওষুধ । বিকেলে এলেন সুধীরস্যর । বাবাকে বললেন, 'বড় চঞ্চল আপনার ছেলেটা । তা বলে আপনি আবার মারতে গেছেন কেন ? বেচারি...' বাবা কোনো জবাব দিলেন না । বললেন, দুষ্টদের দমন করতে হয় নিষ্ঠুর ভাবে । বাবার কথা শুনে কষ্ট পেলাম । আমি কি সত্যিই দুষ্ট ? সকল ছেলেই তো গাছে উঠেছিলো । তারা টাইমলি নেমে যেতে পারলো বলে দোষের ভাগিদার হলো না কেউ । হলাম আমি । 'হকল মাছে গু খায় চ্যাঙ মাছ দোষী '- আমার অবস্থা তাই । 


তো, এই ঘটনা অনেকখানি দমিয়ে দিলো আমাকে । এই ঘটনার এক মাস পরে এলো হাফইয়ার্লি পরীক্ষা । ক্লাস ফাইভের ছেলে কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে পরীক্ষার সীট পড়লো আমার । পরীক্ষার খাতায় কি লিখতে হবে, জানি না, ফলে, কলম উঠিয়ে চুপ করে বসে আছি । কলম মানে বাঁশ কেটে সরু ছ ইঞ্চি লম্বা এক টুকরো যার অগ্রভাগ সামান্য ধারালো । এই ধারালো অংশটিকে দোয়াতের কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে লিখতে হতো । আমি চুপ করে বসে আছি, দেখে, ফিস ফিস করে ধমক দিলেন কৃষ্ণমোহন । তাকে রাসনৃত্যে কৃষ্ণরূপে দেখেছি, উদুখলেও ঐ ভূমিকায়, রাখালনৃত্যেও সে কৃষ্ণ । ফলে সমীহ করতাম খুব । যদিও কলেজ পড়াকালীন আমার সহপাঠী হিসেবেই পেয়েছি তাকে । সম্ভবত, বড় ক্লাসে গাট্টা মেরে পড়ে থাকতে পারে । তার ধমক খেয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের দিকে তাকালাম । কোনোটাই মাথায় ঢুকছে না আমার । 


শেষপর্যন্ত কিছু না লিখে জমা দিই খাতা । এভাবেই হাফইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো । যেদিন শেষ হলো, ঘরে এসে, দেখি, ভানুবিল থেকে চলে এসেছেন দিদিমা । যে কয়দিন আমাদের কাছে ছিলেন, তিনি ছিলেন আমার পরিত্রাণকর্ত্রী এবং প্রশ্রয়দাত্রী । তিনি নাড়ু আর পিঠে বানাতেন আমার জন্য । বিস্কুটের টিন ভর্তি করে রেখে দিতেন আমার জন্য । দিন কাটছিলো, এভাবেই, পরম নিশ্চিন্তে । বাধ সাধলো পরীক্ষার রেজাল্ট । ক্লাসে, নাম ডেকে ডেকে খাতা দেওয়া হচ্ছিলো সবার । আমার নাম যখন এলো, সুধীরস্যর হেসে ফেললেন, বললেন, 'তুমি তো কোনো নম্বর পাওনি ।' শুনে, উত্‍কণ্ঠিত হয়ে পড়লাম । সে কি ! নম্বর না পেলে বাবা যে ঘরে ঢুকতে দেবেন না ! আমার অবস্থা দেখে, তিনি বললেন, 'চিন্তা করো না, দুটো হাঁসের ডিম পেয়েছো তুমি ।'


 হাঁসের ডিম শুনে, খুশিতে নেচে উঠলো প্রাণ । কাঁটার ভয়ে মাছ খেতে পারি না, খাই এই হাঁসের ডিম । এবং ডিম আমার বড়ো প্রিয় । ঘরে ফিরে, দূর থেকে, চিত্‍কার করে, মাকে বললাম, 'জানো, মা, পরীক্ষায় আমি দুটো হাঁসের ডিম পেয়েছি । একটা এখনই ভেজে দাও ।'



আমার নারীরা : ২৬

December 13, 2013 at 2:22pm


পরীক্ষার খাতায় অভিভাবকের সই দিতে গিয়ে, বাবার আক্কেল গুড়ুম । আমার কান ধরে, হিচড়ে নিয়ে গেলেন বিছানার কাছে । একটা দড়ি দিয়ে আমাকে বাঁধলেন শক্ত করে । তারপর, উঠোন থেকে নিয়ে এলেন একটা মুলিবাঁশ । থর থর করে কাঁপছেন মা । ভয়ে বাধা দেবার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি । এই চণ্ডাল রূপে বাবাকে দেখলেই আমার ভেতরে অন্য এক মানুষ জেগে ওঠে, যে কাউকে পরোয়া করে না । মারবেন তো, মারুন । এর বেশি কি আর করতে পারবেন তিনি ? সে রাতে, প্রচণ্ড মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম আমি । বলরাম মামা এসে না বাঁচালে, সে রাতই, বোধহয়, শেষরাত ছিলো আমার জীবনের । টানা এক সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলাম ঘরে । বাবা, বোধহয়, পুরোণো বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, ঘরে ছিলেন না এ কয়দিন । মা কাঁদলেন দিনরাত আমার শিয়রে বসে ।


মাঝে দুদিন ফাজাদিদি আর তার এক বন্ধু সত্যভামা এসেছিলো আমার খোঁজখবর নিতে । ক্যালেণ্ডারের দেবীর মত দেখতে সত্যভামা । আমার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো, 'এখন থেকে পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে তোমাকে । পারবে না ?' কোনো কথা না বলে, সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম আমি । এই ঘটনার পর থেকে বদলে যেতে লাগলাম ধীরে ধীরে । পড়াশোনা করি মন দিয়ে । খেলাধুলো খুব কম । 


বই হাতে নিলেই ভেসে ওঠে সত্যভামার মুখ । কানে বাজতে থাকে তার ঐ কথাগুলি । পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে তোমাকে । পারবে না ? রোজ একবার প্রতিজ্ঞা করি, আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবো । ফার্স্ট হবো । চান করতে যখন পুকুরে নামতাম, সাঁতার জানতাম না, মা পাশে থাকলেও, অনুভব করতাম, সত্যভামা আমার হাত ধরে অতিসাবধানে, নামিয়ে দিচ্ছে জলে, বলছে, পারবে তো ? বিকেলে, ঘরের পেছন দিকে যজ্ঞডুমুর গাছের নিচে বসে থাকি, একা । দূরে আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে হরিণের দল । একটা হরিণের বাচ্চা হঠাত্‍ দলছুট হয়ে চলে এলো আমার কাছে । কি সুন্দর চোখ, যেন অনন্তকালের মায়া আছে লেগে । মনে হলো, হরিণ নয়, সে আসলে সত্যভামা । এক ঘোরের মধ্যে দিনগুলি কাটতে লাগলো । বার্ষিক পরীক্ষাও হয়ে গেলো শেষ ।


 একদিন, ডার্লংপাড়া থেকে এলো মা'র এক বইনারি । মানে বন্ধু । পাহাড়ি মহিলাদের সঙ্গে সমতলের মহিলাদের এই বন্ধুত্বে তখন ছিলো উষ্ণতার স্পর্শ । তারা পাহাড় থেকে খাড়ায় করে নিয়ে আসতো জুমের ফসল, কুমড়ো, খাকরোল, কমলা. তিল আরও অনেক কিছু । বইনারি দিতো উপহার ।সমতলের বইনারি দিত শীতের কাপড় থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি । মা'র বইনারি আমাকে খুব আদর করলেন, গাল টিপে জিগ্যেস করলেন, 'তুমি কারে বিয়া করবা ?' দেরি করিনি, সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললাম, 'সত্যভামা । আমি সত্যভামাকে বিয়ে করবো ।' হি হি হি করে হেসে উঠলেন মা'র বইনারি । সঙ্গে মা, মামী আর পাড়ার এক মহিলা । ফাজাদিও কাছে ছিলো । 


'সত্যভামা কে ?' বইনারির প্রশ্নের জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগে মা বলে উঠলেন, 'আমাদের ফাজার বন্ধু । বড় ক্লাসে পড়ে ।' কথাটা চাউর হতে দেরি হলো না । বাতাসের আর কথার গতি না কি প্রায় সমান । সবাই ক্ষ্যাপাতে শুরু করলো আমাকে । আমার বন্ধুরা তো, সত্যভামাকে দেখলেই, বলে উঠতো, অউ তোমার বউ আইছন বে ! সঙ্গীন অবস্থা আমার । এই সময়, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার পাঁচদিন আগে, বাজার থেকে ঘরে ফিরছি, পথের বাঁকে, তার কয়েকজন বন্ধু সহ আমাকে ঘেরাও করলো সত্যভামা । চোখেমুখে প্রচণ্ড রাগ । বললো, 'তুমি না কি আমাকে বিয়ে করবে ?' আর একজন এগিয়ে এসে টিটকিরি দিয়ে বললো, 'ইশশ ! বিয়ে করার কত শখ ! বতই কেটে দিলে সব শখ উড়ে যাবে ।' আঁতকে উঠে দুইহাত দিয়ে প্যাণ্টের সামনেটা আগলে রাখার চেষ্টা করতে থাকি আমি । তখন জিপারের প্যাণ্ট ছিলো না । ইজের জাতীয় প্যাণ্ট, ফিতা দিয়ে বাঁধতে হতো । 'বতই' মানে লিঙ্গ কেটে ফেললে বাঁচবো কি করে ?  কাঁপতে থাকি আমি । সত্যভামা আমার চুলের মুঠি ধরে বাম গালে মারলো থাপ্পড় । 'আর কখনও যদি এসব কথা শুনি, সেদিন তোমার বতই কাটবোই কাটবো । মনে থাকবে তো ?' দলবল নিয়ে চলে গেলো সত্যভামা, আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম মাথা নিচু করে ।


 পাঁচদিন পর, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেলো, সুধীরস্যর বললেন, 'এর চাইতে ম্যাজিক আর কিছু হয় না । এবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে সমরজিত্‍, সব বিষয়ে একশো তে একশো পেয়ে ।' আমি তো জানি, ম্যাজিক তো আর কিছু নয়, সত্যভামা ।


আমার নারীরা : ২৭

December 15, 2013 at 12:14am


ক্লাস টু । ফার্স্ট বয় হলে শিক্ষকদের আদর বেড়ে যায়, তা প্রথম টের পেলাম সুধীরস্যরের যত্নে । তিনি এখন আলাদাভাবে আমার যত্ন নিতে লাগলেন । আর একজন, সোনাচাঁদ সিংহ, সম্পর্কে আমার দাদা, প্রায় আসতে লাগলেন আমাদের ঘরে । মা'র দূর সম্পর্কের ভাই তিনি । মা'কে ডাকেন পিসিমা । বাবা, একদিন, তাকে বললেন, 'সোনাই, তুমি তো গানের মানুষ, ছেলেটাকে গানটা ধরিয়ে দাও তো ! আমাদের বংশে কেউ নেই গানের । মাতুলবংশের ছিঁটেফোঁটা যদি পায়, তাহলে বর্তে যাবো ।' সোনাচাঁদ স্যর গান শেখাতে শুরু করলেন পরদিন থেকে । বাবা কোথা থেকে একটা হারমোনিয়ম আনলেন কিনে । বিকেলে এলেন সোনাচাঁদ স্যর । 


সরগম বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, 'আমার সঙ্গে গলা মেলাও ।' সা রে গা মা পর্যন্ত কোনোরকমে এগিয়ে গিয়ে পা-তে গলাটা গেলো আরেকদিকে । স্যর গেলেন ঘাবড়ে । 'কি হলো, গলা এরকম করছো কেন ?' সেদিন যত কসরত্‍ করছি, তত বিগড়ে যাচ্ছে গলা । হতাশ হয়ে, তিনি মা'কে বললেন, 'পিসিমা, আমাদের কূলে এমন গলা তো আর কারও নেই ! কোনো রকমেই বাগে আনা যাচ্ছে না !' কথাটা তীব্র ভাবে আমার অন্তরে এসে লাগলো । আমার গলায় সুর নেই, বললেই পারতেন, এভাবে তির্যক কথা বলার কি দরকার ছিলো ? কোনো কথা না বলে, উঠে গেলাম সেখান থেকে । বাইরে যাবো, তখনই, পাড়া জুড়ে চিত্‍কার, 'বাঘ পড়েছে, বাঘ পড়েছে !' ভয়ে, দ্রুত ফিরে এলাম ঘরে । বাঘের উত্‍পাত ইদানিং বেড়ে গেছে খুব । গরু ছাগল নিয়ে যাচ্ছে রোজ একটা দুটো করে । মনিপুরীরা ছাগল পালে না, গরু আছে তাদের । পাশের শব্দকর পাড়ার লোকরা ছাগল পালে বেশি । ও পাড়ায় থাকে ধীরু, আমার সহপাঠী, আমাকে ভীষণ ভালোবাসে । কুতকুতে কালো, কোলাব্যাঙের মত গায়ের চামড়া, ঘামাচিভর্তি, বন্ধুরা মেশে না কেউ । আমিই তার সঙ্গে চলাফেরা করি, মিশি । মা'কে বললাম, 'ধীরুদের পাড়া থেকে চিত্‍কারটা এলো, না ? ধীরুর ছাগল নিয়ে যায়নি তো ?' আমার উত্‍কণ্ঠা দেখে, মা বললেন, 'কাল জেনে নিও । আজ আর একটু গান শিখে নাও ।' মাথা নাড়লাম আমি । 'গান শিখবো না, মা । ও আমার দ্বারা হবে না ।' আমার সঙ্গীতচর্চা অংকুরেই শেষ হয়ে গেলো । দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবা বললেন, 'পরীর অভিশাপ মিথ্যে হবার নয় । আমাদের বংশে সঙ্গীতের প্রবেশ আর হবে না ।' 'পরী কে, পিসেমশাই ?' 


সোনাচাঁদ স্যর জানতে চাইলেন । বাবা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ইলেকশন তো আসছে, 'তোমার কি মনে হয় নেহেরু আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন ?' সোনাচাঁদ স্যর বললেন 'নেহেরু ছাড়া আর কে হবে প্রধানমন্ত্রী ? কংগ্রেসে নেহেরুর বিকল্প আর আছে না কি ?' এসব আলাপ বুঝি না আমি । ভোট কি, তাও জানি না । ফলে, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম । 


তবু আমার কানে এলো, বাবা বলছেন, 'গোকুলদা, বোধহয়, জিতে যাবেন । পাহাড়িরা একচেটিয়া তাকেই দেবে ভোট । বাঙালীরা অবশ্য বিরোধিতা করছে । তাদের দোষ নেই. সকলেই উদ্বাস্তু । শচীন সিংয়ের দিকে ঝুঁকে আছে তারা । পায়ের নিচে মাটি পেতে কংগ্রেসকেই দেবে ভোট । তারপরও গোকুলদা জিতে যাবেন ।' গোকুলদা মানে গোকুল সিংহ, মনিপুরীরা চেনে গোকুলকীর্তনী বলে । মা'র এক দিদির বর । মনিপুরী সমাজের অশিক্ষা. কুসংস্কার দূর করার জন্য জাগরণী গান গেয়ে বেড়ান ত্রিপুরা থেকে কাছাড়, কাছাড় থেকে ভানুগাছ । কম্যুনিস্ট পার্টি করেন, পার্টি নাকি তাকে দাঁড় করিয়েছে ভোটে । 


কাস্তে ধানের শীষ আমাদের ঘরে অতিপরিচিত গোকুলমেসোর দৌলতে । বাড়ি রাতাছড়া । ভোট আসছে, বাজারে, পাড়ায়, ঘরে ঘরে, এনিয়ে আলোচনা চলছে খুব । সবই বড়দের মধ্যে । এই আলোচনায় আমাদের স্থান নেই ।


আমার নারীরা : ২৮

December 15, 2013 at 11:28pm


১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই পার্লামেন্ট ইলেকশন হয়ে গেলো । এটা তৃতীয় লোকসভা নির্বাচন । কংগ্রেস তিনশোর উপরে আসন পেয়ে গঠন করে সরকার । আর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে ডাঙ্গের নেতৃত্বে উঠে আসে কম্যুনিস্ট দল । ২৯টি আসন সেবার পেয়েছিল কম্যুনিস্ট পার্টি । একই সঙ্গে কি ত্রিপুরার ইউনিয়ন টেরিটোরিয়াল ইলেকশনও হয়েছিলো ? আমার খেয়াল নেই । কেবল মনে আছে, বেতছড়া স্কুলে বুথকেন্দ্র, এই কেন্দ্রে আপ্যায়ণের ভার পড়লো মা'র উপর । রাজনীতির জন্য নয়, কম্যুনিস্ট দলের প্রার্থী গোকুল সিংহের শ্যালিকা হিসেবে তাকে দেওয়া হয়েছিলো এই ভার । 


খুব সকালবেলায় সেদ্ধভাত খেয়ে আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন মা । বুথকেন্দ্রে, ততক্ষণে, এসে পড়েছে পার্টির লোকজন । আমাকে একটা বিস্কুটের টিনের উপর বসে থাকতে বলা হলো । ভোট দিতে যারা আসবে, তাদের তিনচারটে করে বিস্কুট দিতে । চা দেবেন আর একজন । বিস্কুট মানে রাধা বিস্কুট, এতদঞ্চলে ব্রিটানিয়ার আবির্ভাব হয়নি তখনও । আমার দায়িত্ব পালন করছিলাম বেশ সুন্দর । জীবনের প্রথম দায়িত্ব বলে কথা । যাদেরকেই বিস্কুট দিচ্ছি, দেবার পর, আমিও দু একটা খেয়ে নিচ্ছি বিস্কুট । দুপুরের পর, দেখা গেলো, পাঁচটা বিস্কুটের টিন খতম । কেউ একজন ছুটলেন রাণার দোকান থেকে আরও বিস্কুট আনতে । আর আমার তখন পেটের ভেতর আনচান । শ্বাস নিতে পারছি না, কষ্ট হচ্ছে খুব । 


উদ্বিগ্ন মা পার্টির লোকদের বললেন, 'রাজার এই অবস্থায় ডাক্তার দেখাতে হবে । আপনারা রাগ করবেন না ।' খাবার দেখলে আমার এই কাঙালপণার কথা ততদিনে গৃহবিদিত । সেবছরই, গরমের ছুটিতে, জলাই থেকে বাবা এনেছিলেন বাড়ির গাছের কাঁঠাল । উচ্চতায় দুই হাতের উপর । পাশেও কম নয় । এই কাঁঠাল, একবার ঘর থেকে বেরুতে, একবার ঢুকতে, একবার মা'র সামনে, একবার আড়ালে, একটা দুটো করে কোষ বা রোয়া খেতে খেতে, দেখি, কাঁঠাল প্রায় শেষের পথে । সন্ধ্যের দিকে, টের পেলাম, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার । হাঁসফাঁস করছি । দাঁড়াতে পারছি না, বসতে পারছি না, শুতে পারছিনা । রাতাছড়া থেকে আমার এক কাকা এসেছেন, মা বললেন, 'কাকাকে গিয়ে প্রণাম করো ।' হায়, প্রণাম করার শক্তিও নেই আমার । 'কি হলো ? কানে যাচ্ছে না আমার কথা ?' বিরক্ত হয়ে মা আমাকে নিতে এসে দেখলেন, আমার চোখমুখ বিকৃত, কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে চোখের মনি, জিভে আসছে বেরিয়ে । ভয় পেয়ে গেলেন মা । 'কি হয়েছে তোমার ? এরকম করছো কেন ?' কোনো রকমে তর্জনিসংকেত করে বললাম, 'কাঁঠাল ।' কাঁঠালের দিকে তাকিয়ে মা অনুধাবন করলেন বিষয়ের গভীরতা । তিনি, তাড়াতাড়ি, একটা চাঁপাকলা খেতে দিলেন আমাকে । সেটা খেতে গিয়ে বমি করে ফেললাম আমি । ঘরে এসে বাবা দেখলেন আমার এই অবস্থা । তিনি বকলেন মাকে ।


তারপর বাজার থেকে ডাক্তার ডেকে আনলেন । কোয়াক ডাক্তার, সে আমলে প্রাইমারি হেলথ সেন্টারও নেই । ইঞ্জেকশন দিলেন ডাক্তার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ । আমার কথা থাক । গোকুল মেসোর কথা বলি । বাবার কথা মিলে গেলো, ইলেকশনে জিতে গেলেন মেসো । ঐ বিজয় নিয়ে উল্লসিত ডার্লংকূল, কুকিগণ, মনিপুরী ও কয়েকজন বাঙালী মিলে বেতছড়া বাজারে মিছিল বেরুলো । মেসো চলে গেলেন আগরতলা । কয়েকদিন পর, স্কুল থেকে ফিরে এসে, দেখি, মা কাঁদছেন হাউমাউ করে, বাবা বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন একদিকে । উঠোনে লোকজনের ভিড় । ফাজাদিই জানালো, 'তোমার গোকুল মেসো মারা গেছেন ।'


আমার নারীরা : ২৯

December 16, 2013 at 6:47pm


গোকুল মেসো আর নেই, এই খবর ছড়িয়ে পড়লো বাতাসের আগে আগে । ভোর হতে না হতেই, দেখা গেলো, কাতারে কাতারে লোক নেমে আসছে পাহাড় থেকে । বেতছড়া বাজারে এসে প্রতীক্ষা করছে সবাই, কখন আসবে গোকুল মেসোর মরদেহ । প্রতীক্ষার পাশাপাশি নানাজনের নানা কথায় মুখর হয়ে উঠলো বাজার এলাকা । কেউ কেউ হয়তো কাঁদছেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । মা-র পাশে পাশে আমি । একজন বললেন, 'কংগ্রেসই না কি ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে গোকুলকীর্তনীকে । সত্যি ?' 'কংগ্রেস ? তারা মারবে কেন ?' পাশের লোকটা পালটা জানতে চাইলো । 'তা জানি না । তবে বিরোধীদের একটি সীট না কমলে, কংগ্রেস সরকার গড়তে পারতো না । সবাই বলছে তা ।' প্রথম লোকটির কথার মাঝখানে তৃতীয় আর একজন বলে ওঠে, 'আমি শুনলাম, আর এক কথা ।' বাকিরা লোকটাকে ঘিরে ধরলো কথা শোনার জন্য ।


লোকটা ফিসফিস করে বললো, 'কংগ্রেসের কাছে গোকুলকীর্তনী নিজেকে বিক্রি করেছিলো । সেই আত্মগ্লানিতে দিশাহারা হয়ে আত্মহত্যা করছে গোকুলকীর্তনী ।' লোকটার মুখের দিকে তাকালাম, সম্ভবত, বেতছড়ার কেউ না, তার চোখেমুখে ঘৃণা উঠেছে ফুটে । এত ঘৃণা কেন লোকটার ? নিজেকে কিভাবে বিক্রি করলেন গোকুলমেসো । রোদ যত চড়ছে, মানুষের ভীড় তত বেশি বেশি করে আসছে । তিল ধারণের ঠাঁই নেই বেতছড়া বাজারে । শেষপর্যন গাড়ি এলো গোকুলমেসোর মরদেহ নিয়ে । সবাই বিস্ময়ে দেখলো, মরদেহ ঢাকা আছে ভারতের জাতীয় পতাকা দিয়ে । আর চারদিক দিয়ে রব উঠলো, ছিঃ ছিঃ ছিঃ ! গোকুলকীর্তনী নিজেকে কংগ্রেসের কাছে বেচে দিয়ে অপমান করেছে আমাদের ।


কে একজন বোঝাবার চেষ্টা করলো, পারলো না, যেভাবে লোকজোয়ার নেমে এসেছিলো, তরঙ্গের পর তরঙ্গ, তা, নিমেষে, উধাও হয়ে গেলো । সুনসান বাজার, গাড়ি থেকে মরদেহ নামাবার লোক পর্যন্ত নেই আর, আত্মীয়স্বজন ছাড়া । বাবাকে দেখলাম, কয়েকজনকে নিয়ে নামাচ্ছেন মরদেহ । আর বলছেন, এইসব মূর্খরা কবে যে বুঝতে পারবে, জনপ্রতিনিধিকে শেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে সরকার জাতীয় পতাকা দিয়ে মরদেহ ঢেকে । বুঝলো না, কংগ্রেসের পতাকা আর জাতীয় পতাকা এক নয় । সন্ধ্যের আগে, দাহপর্ব শেষ করে, ঘরে ফিরে এলেন বাবা । তার আগে বাজার থেকে চলে এসেছিলাম আমরা । সেদিন আর ঘরে রান্না হয়নি । আত্মীয়বিয়োগ শোক এত গভীর গভীরতম, ক্ষুধা পর্যন্ত টের পায়নি আমি । বাবা ফিরে এলে, বাবার দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে, মা বললেন, 'সব লোক ফিরে গেলো কেন, বলো তো ?' জলের গ্লাস নিয়ে, একটা চেয়ার টেনে, বসে, বাবা বললেন, 'কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছে, তোমার জামাইবাবু কমিউনিস্ট দল ছেড়ে যোগ দিয়েছে কংগ্রেসে । যারা এসেছিলো, সবাই তোমার জামাইবাবুর অনুগত, ভক্ত, কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক, সহজসরল লোক । তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে ।' 'জামাইবাবু কি সত্যি কংগ্রেসে চলে গিয়েছিলেন ?' বাবা ধীরে ধীরে বললেন, 'না, না । দল ছাড়েননি তিনি । মরদেহ জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে । এটা রীতি ।'


আমার নারীরা : ৩০

December 17, 2013 at 3:49pm


বিকেলে বাজারের পাশে এক চিলতে খালি জায়গায় আমাদের, প্রতিদিন, খেলার একটা ব্যবস্থা করে ফেললো ধীরু । এসব বিষয়ে ঐ অগ্রণী । খেলা মানে জাম্বুরা নিয়ে লাথালাথি অথবা দাঁড়িয়াবান্ধা অথবা হাডুডু । কোনো কোনোদিন গোল্রাছুট । দাঁড়িয়াবান্ধায় আমার জুড়ি ছিলো না কেউ । অন্য কোনো খেলায় আগ্রহ নেই আমার । মনে হতো, লাথালাথিও একটা খেলা না কি ? তবু যেতাম ধীরুর আগ্রহেই । আগেই বলেছি, ধীরুকে পছন্দ করতো না বাকি বন্ধুরা, বিশেষত, হা ডু ডু খেলায় তাকে ধরতে গেলে স্পর্শ করতে হবে, এই জন্য । তার গায়ের ঐ চামড়াই বিপদে ফেলেছে তাকে । একদিন, তাড়াতাড়ি, স্কুল থেকে ফিরেই, চলে গেলাম খেলতে । তার আগের দিন বাবা আমার জন্য এনে দিয়েছেন কাঠের চটি । অনেকখানি খড়মের মত দেখতে. তবে টায়ারের বেল্ট দেওয়া । ফলে, পায়ের আঙুলের ফাঁকে খড়মের ঐ লাটিম রেখে ব্যথা পাওয়ার সুযোগ নেই এতে । 


তখনও আমাদের কপালে চামড়ার চটি বা এখনকার হাওয়াই স্যাণ্ডেল পায়ে দেবার অনুমতি জোটেনি । খুশিতে ডগমগ আমি, সেই কাঠের চটি পায়ে দিয়ে গেলাম খেলতে । বাজারে পৌঁছবার আগে, হঠাত্‍, মনে হলো, এই চটি দেখলে আমাকে ক্ষ্যাপাতে পারে বন্ধুরা । সে আর এক ঝামেলা । তাড়াতাড়ি, রাস্তার পাশে, শিয়ালমুতুরীর এক ঝোঁপে লুকিয়ে ফেললাম আমার কাঠের চটি । লুকিয়ে রাখার আগে এবং পরে, চারদিকে তাকালাম । না, কেউ দেখেনি । নিশ্চিন্ত হয়ে, খেলতে গেলাম । সেদিন আর কোনো খেলা হয়নি, হলো, গোল্লাছুট । এই এক মজার খেলা । অবাধ স্বাধীনতাও আছে এতে । খেলতে খেলতে নামলো বৃষ্টি, অঝোরে । যে যেদিকে পারলো ছুটে গেলো, একা, আমি, রয়ে গেলাম সেখানে । আমার মন তখনও কাঠের চটিতেই । বৃষ্টি ভিজে ভিজে গেলাম চটির কাছে । ও মা ! শিয়ালমুতুরীর ঝোঁপে কাঠের চটি নেই । তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, এই ঝোঁপ, ঐ ঝোঁপ । না, কোথাও নেই । ভয়ে কাঁপছি, বাবার চেহারা উঠছে ভেসে । আবার ঐ মুলিবাঁশ আমার পিঠেই ভাঙবেন বাবা ! 


কি করবো, ঘরে ফিরে যাবো ? না কি...। না, কিছুই ভাবতে পারছি না আর । স্থানুবত্‍ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে । বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার আমার মুখ । কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না, খেয়াল হলো, আমাকে ঘিরে ধরেছে চাপা অন্ধকার । মেঘের আড়ালে তত প্রকট নয় জ্যোত্‍স্না । বৃষ্টিও গেছে থেমে । ধীরে ধীরে, পা বাড়ালাম ঘরের দিকে । আসাম-আগরতলা রোড থেকে ডানদিকে উঠে গেছে আমাদের ঘরের পথ । কাঁচা রাস্তা । দুমিনিট হেঁটে গিয়ে, রাস্তা বাঁক খেয়ে গেছে ডানদিকে, ঐ বাঁকের উলটোদিকে আমাদের ঘর । বাঁকের কাছে আসতেই, থমকে গেলাম ।


রাস্তার ডানপাশে, আমাদের ঘরের আরাঙের উলটোদিকে বসে আছে এক চিতাবাঘ । আমার দিকে তাকিয়ে আছে, জ্বল জ্বল করছে তার দুটি চোখ, যেন দুটি জ্বলন্ত মশাল । জিভ কি লক লক করছে ? আজ আমার কি হলো ? শেষ পর্যন্ত বাঘের পেটে চলে যাবো ? তবু ভালো, বাবার ঐ মুলিবাঁশ আমার পিঠে ভাঙবার বদলে বাঘের পেটে চলে যাওয়া ঢের ভালো । বাঘটা কি নড়ে উঠলো ? এবার তবে কি আমার ঘাড়েই লাফ দেবে ? থাবা বসাবে ঘাড়ে ? অতশত ভাববার সময় নেই, বাঘ লাফ দেবার আগেই, দু'চোখ বন্ধ করে, মরণ চিত্‍কার করে উঠলাম । মাআআআআআআ... আমার এই বিকট চিত্‍কারে কি হলো, জানি না, জ্ঞান হারাবার আগে, এটুকুই শুনলাম, বাঘের লাফের এক শব্দ । জ্ঞান ফিরে এলে দেখলাম, আমি শুয়ে আছি উঠোনে, আমাকে ঘিরে জনা দশেক লোক, আর আমার মুখের উপর ঝুঁকে কাঁদছেন আমার মা । 


কে একজন তখন বললো, 'ধীরুদের ঘর থেকে ছাগল নিয়ে গেছে বাঘটা ।' 'আমরা তো চিত্‍কার শুনে দৌঁড়ে এলাম, কোথাও পাইনি বাঘটাকে ।' 'পাবে কি করে ? বাঘ তখন ধীরুদের ঘরে !' এই সব কথার ফাঁকে, কেউ খেয়াল করলো না আমার কাঠের চটি হারিয়ে ফেলার ঘটনা । বাবার চণ্ডাল ক্রোধের হাত থেকে, সে রাতে, বেঁচে গেলাম বাঘের কল্যাণে ।


আমার নারীরা : ৩১

December 18, 2013 at 4:17pm


বিপদ কখন লাফ দিয়ে ঘাড়ে এসে পড়বে, তা কেউ জানে না । যখন আসে, হতচকিত মানুষ, প্রথমে দিশাহারা হয়ে ওঠে, কি করবে, কার কাছে যাবে, না বুঝে, বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে । আমার মা এরকম নন, বিপদ এলে, অনেকদিন দেখেছি, ধীরস্হির হয়ে যান তিনি । তবু আমাকে যখন বাজারের ঐ চিলতে জায়গায়, খেলার সময় পাগলা কুকুর এসে, আচম্বিতে, লাফ দিয়ে, আমার কোমরের উপর, বাঁদিকের কিডনিস্থলের কাছ থেকে এক টুকরো মাংস, দাঁতে করে, খাবলে নিলো, রক্ত পড়ছে, আতংকে ও ব্যথায় দিশাহারা আমি ছুটে গিয়ে, মা'র সামনে দাঁড়াতেই, তিনিও ঘাবড়ে গেলেন । ততক্ষণে, আরও তিনটে বাচ্চাকে কামড় দিয়েছে ঐ পাগলা কুকুর । সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে আতংক, কান্নাকাটির আওয়াজে মুখর তল্লাটের লোকরা কুকুরটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে হন্যে হয়ে । আমাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন মা । ঘরে বাবা নেই, তিনি গেছেন জলাইর বাড়িতে । মা'র কান্না শুনে ছুটে এলেন বলরাম মামা, বুইচা পিসির ঘরের লোকজন । একটা কচি পেঁপে কোথা থেকে এনে তার কষ জোর আমাকে খাওয়ালেন বলরাম মামা । বুইচা পিসি বাংলা সাবান দিয়ে ক্ষতস্হান ধুইয়ে দিয়ে বেঁধে দিলেন কাপড় দিয়ে । মা বোকার মত এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছেন ।


বিকেলের শেষে খবর এল ঐ পাগলা কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে লোকরা । রাতে জ্বর এলো আমার । অসহায় মা কাঁদতে কাঁদতেই একটা লেপ বৈশাখের এই গরমেই গায়ে জড়িয়ে দিলেন আমার । মা'কে যত দেখছি, অবাক হচ্ছি, তাকে এমন তো দেখিনি কখনও । পাগলা কুকুর কামড়ালে কি হয়, তখনও আমি জানি না কিছু । কি হয় ? মা'কে জিগ্যেস করতেই, তিনি আরও জোরে কাঁদতে লাগলেন । এক বিভীষিকার ভেতর দিয়ে কেটে গেলো সে রাত । পরদিন, বাবা এসে, সব শুনে, গম্ভীর হয়ে গেলেন । তারপর, কোনোকথা না বলে, চলে গেলেন বাজারের দিকে । জ্বর নেই, তবে সারা শরীরে অনুভব করছি আশ্চর্য এক ব্যথা । বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না । শুয়ে শুয়েই কাটাতে ইচ্ছে করছে । বাবা এলেন এক বুড়ো, শীর্ণকায় লোককে নিয়ে । 


'আমাকে দেখে লোকটা বললো, নাড়ির গতিক ভালো ঠেকছে না, মাষ্টর ! ওষুধে কাজ দেবে কি না জানি না, তবু দিলাম ।' লোকটার কথা শুনে, মা ছুটে গিয়ে বিছানায় লুকোলেন মুখ । কাঁদতে শুরু করলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । তিনদিন পরে, খবর পেলাম, আমার এক সঙ্গী মারা গেছে আগের রাতে । তার বুক থেকে, ঊরু থেকে, মাংস খাবলে নিয়েছিল পাগলা কুকুর । বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন । আমার জন্য সকালের খাবার নিয়ে এলো মা, খাবারের সঙ্গে জলের গেলাস দেখে, আঁতকে উঠলাম আমি । ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছি আমি । বাবা এলেন এগিয়ে । একটা শেকল দিয়ে দুই হাত দুই পা বাঁধলেন আমার । এমন নিষ্ঠুর আমার বাবা ? কেন ? কি করেছি আমি, যে আমাকে বেঁধে রাখবে তিনি ? মা ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলেন । আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে, ঘরের এক কোণে বেঁধে রাখলেন বাবা, গলায় আর এক শেকল পরিয়ে । ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার । ভীষণ । 


ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে, বাবার টুটি চেপে কামড়ে ধরি দাঁত দিয়ে । এমন বাবাকে কামড়ে খাওয়াই উচিত । পরদিন কি হয়েছিলো, আমি আর জানি না । মা পরে আমাকে বলেছেন, একের পর এক আমার বন্ধুরা মরে যাচ্ছে আর আমি উন্মাদ হয়ে উঠছিলাম । এতটাই উন্মাদ, বাবা আমাকে একদিন লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছেন । আমার মুখ দিয়ে কুঁই কুঁই আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোয়নি । নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি, আর অসহায় মা শিবঠাকুরের কাছে কান্নাকাটি করছেন তত বেশি । 'এত তাড়াতাড়ি যদি নিয়েই যাবে, ঠাকুর, তবে তাকে আমার কোল আলো করে দিলে কেন ? কেন ? কেন ?' বাবাও চুপ হয়ে গেছেন । আমাকে যারা দেখতে আসছেন, দূর থেকে দেখে, কোনো কথা না বলে, ফিরে যাচ্ছেন তারা । আর ক্রমে আমার চোখের দৃষ্টি ও ভাষা পালটে যেতে লাগলো । বাবা বুঝলেন, ঘনিয়ে আসছে সময় । 


পরদিনই, সকালে এলেন তিনি । তখনো বাবা ও মা'র ঘুম ভাঙেনি । তিনি এসে ডাকলেন, ললিতা, দরজা খোলো ।


আমার নারীরা : ৩২

December 19, 2013 at 3:11pm


ভোরের দিকে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিলেন মা । একটা জটাজুটধারী তার মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন হাত, আর বলছেন, 'ভেবো না, ললিতা, সব ঠিক আছে ।' ধড়ফড় করে উঠে পড়লেন তিনি, আবছা আলোয় দেখলেন চার পাশে, না, কেউ নেই । কোথায় গেলেন জটাজুটধারী ? এই তো, তার মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছিলেন হাত ! তাহলে ? বিছানা থেকে নামতে যাবেন, তখনই শুনলেন, কে যেন চাপাস্বরে ডাকছেন তাকে । কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন তিনি । হ্যাঁ, ঐ তো ডাকছেন, 'ললিতা, দরজা খোলো ।' আর কিছু না ভেবে, এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন মা । দেখলেন, সামনে, জীর্ণশীর্ণ এক পুরুষ, যাকে তিনি দেখেননি কখনও । 'আপনি ?' অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন মা । চোখে তখন স্বপ্নের আবেশ । 'আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি শ্যামকান্ত, মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার ছেলেকে নিয়ে যেতে ।' 


সহজ ও স্পষ্ট করে বললেন লোকটা । থতমত খেলেন মা । 'আমার ছেলেকে ? কেন ? কি দোষ করেছে ও ?' বললেন বটে, তারপরই, কেঁদে উঠলেন তিনি । 'আমার ছেলেকে আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেবো না । পাগলা কুকুরে কামড়েছে ওকে, এখন রীতিমত অসুস্থ । যদি মরতেই হয়, আমার কাছেই মরুক ।' মা'র কান্না শুনে এগিয়ে এলেন বাবা । বাবাকে দেখে, মা ভেঙে পড়লেন, কান্নায় । বললেন, 'দেখো. সমরজিত্‍ কে  নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি । আমি আমার ছেলেকে নিতে দেবো না ।' মা-কে থামিয়ে দিয়ে, বাবা লোকটার সঙ্গে কথা বললেন, নিভৃতে । তারপর মা'কে বললেন, 'ছেলেকে তুমি দিয়ে দাও । এতে ছেলের মঙ্গল হবে ।' ফ্যাল ফ্যাল করে মা তাকিয়ে রইলেন বাবার দিকে । লোকটা, এবার, মা-কে, জোর হাতে, বললেন, 'তোমার ছেলেকে আমার হাতে দিলে কল্যাণ হবে তার । আর যদি না দাও, ওকে বাঁচাতে পারবে না । ওর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে এসেছে । মহারাজ আমাকে বলে দিয়েছেন ওকে নিয়ে যেতে ।' এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন মা । বলরাম মামা থেকে শুরু করে পাড়ার সবাই এসেছেন চলে । আমাকে নিয়ে চলে গেলেন লোকটা রাতাছড়ার দিকে । ছ'মাস পরে, ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি । এই ছ'মাস কি হয়েছিলো, আমার জানা নেই । 


বিকেলে যখন ঘরে এলাম, মা খুশিতে আত্মহারা, চিত্‍কার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'ঠাকুর শিবরাত্রির এই সলতেটা নিভিয়ে দেবার চেষ্টা করো না আর ।' লোকটাকে প্রণাম করে বললেন, 'আপনি সাক্ষাত্‍ দেবদূত । সেদিন আপনি না এলে ছেলেকে চিরতরে হারাতাম আমি । আজ এখানে সেবা করলে খুশি হবো ।' লোকটা হাসলেন, বললেন, 'মহারাজের নিষেধ আছে । কারও ঘরে সেবাগ্রহণ আমাদের নিষিদ্ধ ।' সন্ধ্যেবেলা, আমাকে দেখতে এলেন গ্রামের লোকজন । এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা তারা কেউ দেখেনি । জলাতংক রোগী আবার বেঁচে আসতে পারে, তা তাদের কল্পনাতীত । ফলে, অনেকেই এসে ছুঁয়ে দেখছেন আমাকে । আবার ভয়ও পাচ্ছেন তারা । যদি আমি কামড়ে দিই, যদি খামচে দিই, তাহলেই তো সর্বনাশ । 


স্কুলে আমাকে আলাদা বেঞ্চে বসতে বলা হলো । খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার, এটা অপমান, জেনেও, কিছু করতে পারছি না, কেন না, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে আমাকে । একমাত্র ধীরু এসে জড়িয়ে ধরলো, বললো, 'তুমি ফিরে আসতে পেরেছো, এটা আমার পরম সৌভাগ্য ।'


আমার নারীরা : ৩২

December 19, 2013 at 3:11pm


ভোরের দিকে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিলেন মা । একটা জটাজুটধারী তার মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন হাত, আর বলছেন, 'ভেবো না, ললিতা, সব ঠিক আছে ।' ধড়ফড় করে উঠে পড়লেন তিনি, আবছা আলোয় দেখলেন চার পাশে, না, কেউ নেই । কোথায় গেলেন জটাজুটধারী ? এই তো, তার মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছিলেন হাত ! তাহলে ? বিছানা থেকে নামতে যাবেন, তখনই শুনলেন, কে যেন চাপাস্বরে ডাকছেন তাকে । কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন তিনি । হ্যাঁ, ঐ তো ডাকছেন, 'ললিতা, দরজা খোলো ।' আর কিছু না ভেবে, এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন মা । দেখলেন, সামনে, জীর্ণশীর্ণ এক পুরুষ, যাকে তিনি দেখেননি কখনও । 'আপনি ?' অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন মা । চোখে তখন স্বপ্নের আবেশ । 'আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি শ্যামকান্ত, মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার ছেলেকে নিয়ে যেতে ।' সহজ ও স্পষ্ট করে বললেন লোকটা । থতমত খেলেন মা । 'আমার ছেলেকে ? কেন ? কি দোষ করেছে ও ?' বললেন বটে, তারপরই, কেঁদে উঠলেন তিনি । 'আমার ছেলেকে আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেবো না । পাগলা কুকুরে কামড়েছে ওকে, এখন রীতিমত অসুস্থ । যদি মরতেই হয়, আমার কাছেই মরুক ।' মা'র কান্না শুনে এগিয়ে এলেন বাবা । বাবাকে দেখে, মা ভেঙে পড়লেন, কান্নায় । বললেন, 'দেখো. সমরজিত্‍কে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি । আমি আমার ছেলেকে নিতে দেবো না ।' মা-কে থামিয়ে দিয়ে, বাবা লোকটার সঙ্গে কথা বললেন, নিভৃতে । তারপর মা'কে বললেন, 'ছেলেকে তুমি দিয়ে দাও । এতে ছেলের মঙ্গল হবে ।' ফ্যাল ফ্যাল করে মা তাকিয়ে রইলেন বাবার দিকে । লোকটা, এবার, মা-কে, জোর হাতে, বললেন, 'তোমার ছেলেকে আমার হাতে দিলে কল্যাণ হবে তার । আর যদি না দাও, ওকে বাঁচাতে পারবে না । ওর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে এসেছে । মহারাজ আমাকে বলে দিয়েছেন ওকে নিয়ে যেতে ।' এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন মা । বলরাম মামা থেকে শুরু করে পাড়ার সবাই এসেছেন চলে । আমাকে নিয়ে চলে গেলেন লোকটা রাতাছড়ার দিকে । ছ'মাস পরে, ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি । এই ছ'মাস কি হয়েছিলো, আমার জানা নেই । বিকেলে যখন ঘরে এলাম, মা খুশিতে আত্মহারা, চিত্‍কার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'ঠাকুর শিবরাত্রির এই সলতেটা নিভিয়ে দেবার চেষ্টা করো না আর ।' লোকটাকে প্রণাম করে বললেন, 'আপনি সাক্ষাত্‍ দেবদূত । সেদিন আপনি না এলে ছেলেকে চিরতরে হারাতাম আমি । আজ এখানে সেবা করলে খুশি হবো ।' লোকটা হাসলেন, বললেন, 'মহারাজের নিষেধ আছে । কারও ঘরে সেবাগ্রহণ আমাদের নিষিদ্ধ ।' সন্ধ্যেবেলা, আমাকে দেখতে এলেন গ্রামের লোকজন । এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা তারা কেউ দেখেনি । জলাতংক রোগী আবার বেঁচে আসতে পারে, তা তাদের কল্পনাতীত । ফলে, অনেকেই এসে ছুঁয়ে দেখছেন আমাকে । আবার ভয়ও পাচ্ছেন তারা । যদি আমি কামড়ে দিই, যদি খামচে দিই, তাহলেই তো সর্বনাশ । স্কুলে আমাকে আলাদা বেঞ্চে বসতে বলা হলো । খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার, এটা অপমান, জেনেও, কিছু করতে পারছি না, কেন না, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে আমাকে । একমাত্র ধীরু এসে জড়িয়ে ধরলো, বললো, 'তুমি ফিরে আসতে পেরেছো, এটা আমার পরম সৌভাগ্য ।

'আমার নারীরা : ৩৩

December 19, 2013 at 10:41pm

পাগলা কুকুর কামড়াবার দু এক সপ্তাহ আগে, বাবা, একদিন, ঘরে ফিরে এসে, মা'কে বললেন, 'শোনো, নেফা সীমান্তে যুদ্ধ লেগে গেছে । তোমার ছোটো ভাইয়ের পোস্টিং তো নেফাবর্ডারেই ছিলো ? না, আর কোথাও ?' আকাশ থেকে পড়লেন মা ! 'যুদ্ধ ? কার সঙ্গে ?' বাবা বিরক্ত হলেন । এই একটা সমস্যা, যে, মা'কে সহজে বোঝানো যায় না কিছু । দেশবিদেশের খবরে আগ্রহ নেই মা'র । তিনি ব্যস্ত সংসার, পুত্র ও তার বাবাকে নিয়ে । এর বাইরে পাড়াপড়শি আর আত্মীয়স্বজন । যুদ্ধের খবরে তার আগ্রহ থাকার কথাও নয় । তবু বললেন, 'লক্ষ্মীকান্ত তো আসামের কোথাও থাকতো । ইটানগর, না, কি যেন নাম । কেন, তার কিছু হয়নি তো ?' সিগারেট ধরালেন বাবা, বললেন, 'ঐ ইটানগরের দিকে চীনাবাহিনী নেমে আসছে । নেহেরু দেশবাসীর কাছে সাহায্য চেয়েছেন, যার যা ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে ।' 'চীনারা তো, শুনেছি, মানুষ খায় !' আতংকিত হয়ে উঠলেন মা, বললেন, 'লক্ষ্মীকান্তকে খেয়ে ফেলবে না তো ? এখন কি হবে ?' ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি । বাবা এক ধমক দিয়ে কান্না থামালেন মা'র । 'রাধামোহনকে চিঠি লিখতে হবে কালই । সে শিলঙে থাকে, যদি কোনো খবর পেয়ে থাকে ।' পরদিন, রেণুদা, বলরাম মামার বড়ছেলে এসে জানালো, 'জানো, পিসি, কাল রাতে, অনেক ট্যাংক আগরতলার দিকে গেছে । রাণা সাহার দোকানের ছেলেটা দেখেছে ।' ট্যাংক যাবার প্রমাণও পাওয়া গেলো আসাম আগরতলা সড়কের উপর চাকার দাগ দেখে । এর মধ্যে খবর এলো, এসব ট্যাংকে করে মানুষখেকো সৈন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বর্ডারে । পাকিস্তানের সৈন্যদের জীবন্ত খাবার জন্য । বাজার থেকে শুরু করে সমগ্র গ্রামে এখন একটাই আলোচ্য বিষয়, ট্যাংক আর মানুষখেকো সৈন্য । এই সব আলাপের মধ্যে বুইচার বাড়ি থেকে খবর এলো, মেয়ে বা বউ দেখলেই মানুষখেকো সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায় তাদের । এই খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আতংকের ছায়া দেখা দিলো সারা গ্রামে । পুকুরে গিয়ে স্নান করাও বন্ধ হয়ে গেলো বেশির ভাগ মেয়ে ও বউয়ের । পুরুষদের কাছে বাবা বিষয়টা ভেঙে বললেন, যুদ্ধে সৈন্যদের সাহস ও উত্‍সাহ যোগাতে নারীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও দুই শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো প্রচুর নারী ও সুরা । যুদ্ধ নিয়ে বেতছড়া গ্রাম যখন আতংকগ্রস্ত, ত্রস্ত, রাধামোহন মামার চিঠি এলো শিলঙ থেকে । চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ছোটোমামা যুদ্ধে চলে গেছেন, তবে তার কোনো হদিশ বলতে পারছে না কেউ । এই চিঠি পেয়ে অসুস্হ হয়ে পড়লেন মা । খাওয়াদাওয়া নেই, কথাবার্তা বন্ধ, হয়ে উঠলেন নীরবতার দেবী । এক সময় থেমে গেলো যুদ্ধ, কে জিতলো, কে হারলো, কেউ জানে না । আকাশবাণীর খবর আর রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার খবর পরস্পর বিরোধী । ঢাকার রেডিও থেকে বলা হচ্ছে, যুদ্ধে হাজার হাজার ভারতীয় সেনা মারা গেছে । এই খবর শুনে মা'র অবস্থা আরও খারাপ । একদিন, দুপুরে, ডাকপিওন এসে দিলো ছোটোমামার চিঠি । ইনল্যাণ্ড লেটারের ঐ চিঠিতে ছোটোমামা লিখেছেন, পরম পূজনীয় দিদি, পর সমাচার এই যে, যুদ্ধ থামিয়াছে । আমি পাহাড়ের খাদে পড়িয়া চীনাদের হাত হইতে বাঁচিয়া গিয়াছি । না হইলে, প্রাণে বাঁচিতাম না । এক্ষণে ইটানগর ফিরিয়া আসিয়াছি । জামাইবাবুকে আমার প্রণাম জানাইও । ভাগিনাকে আদর । চিঠির কথা শুনিয়া, মা বাবাকে বললেন, মহাদেব পূজার আয়োজন করো । আমি মানত করেছিলাম লক্ষ্মীকান্তর জন্য । বাবা হাসলেন । বললেন, পরশু শুক্রবার, তাহলে মহাদের পূজা করছি । সোনাইর বাবাকে খবর দিও তুমি । মহাদেব পূজা হবে, শুনে, আমার খুশি আর দেখে কে ? আমার লোভ ফলারের প্রতি । ফলার মানে চিড়া, খই, লম্বী কলা আর দুধ ও গুড় মেখে হাপুসহুপুস করে খাওয়া ।


আমার নারীরা : ৩৪

December 20, 2013 at 6:50pm


একদিন, খুব সকালে, মা বললেন, 'চলো, আজ আমরা একটা জায়গায় যাবো । জামাপ্যাণ্ট পরে নাও, তাড়াতাড়ি ।' কোথায় যাবো, এই প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই, মা আঙালুরি আর ইনাফি পরে, বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে । আঙালুরি মনিপুরী মহিলাদের পরিধেয় । আর ইনাফি মূলত এক প্রকার ওড়না । সকালে কিছু খেতে দিলেন না, নিজেও খেলেন না কিছু । মনু নদী পেরিয়ে, রাতাছড়া হয়ে, কাঞ্চনবাড়ি পেরিয়ে, যে পাড়াটায় এলাম, এর আগে, কখনও আসিনি আমি ।


একটা ভাঙাচোরা ঘরের সামনে এসে, মা ডাকলেন, 'এইগা, ঘরে আছেন ?' মা-র গলা শুনে, এক মহিলা এলেন বেরিয়ে । 'ললিতা ! এসো, এসো, ঘরে এসো ।' বুঝলাম, মা-কে চেনেন তিনি বা মা এখানে অতিপরিচিত । এইগা মানে ঠাকুর, বলে, যাকে সম্বোধন করেছিলেন মা, তাকে দেখে অবাক হলাম আমি । এক সুদর্শন পুরুষ তিনি, তিলক কাটা কপালের নিচে দুই চোখ তার চির-অন্ধ । তিনি আমাকে তার সামনে পাতা এক কুশাসনে বসতে বললেন বজ্রাসনে । একদিকে, একটা ফুলের সাজিতে টগর গন্ধরাজ জাতীয় শাদা ফুল, অপর দিকে পূজার সরঞ্জাম । তিনি প্রথমে তার দেহশুদ্ধ করলেন মন্ত্রপূত জল দিয়ে, তারপর, সেই জল ছিটিয়ে দিলেন আমার সারা গায়ে । মা আর ঐ মহিলা একপাশে বসে বসে দেখছেন এই কর্মকাণ্ড । 


আমাকে বললেন, চোখ বন্ধ করে তিনটা ফুল হাতে নিতে । আমি ফুল নিলাম । চোখ খুলতে বললেন এবার । চোখ খুলে দেখি, মন্ত্র পড়তে পড়তে, তিনি মেঝেয় অনেকগুলি ঘর আঁকছেন, কোনোটা ত্রিভুজ, কোনোটা চতুর্ভুজ । আর ঘরগুলি ফুল আর তুলসিপাতায় দিচ্ছেন ভরিয়ে । মা-কে জিগ্যেস করলেন, 'গোত্রের নাম জানো, ললিতা ?' মা জবাব দিলেন, 'এইগা, ব্যাঘ্রপাদ ।' তারপর তিনি আমাকে আমার হাতের তিনটে ফুল তিনটা ঘরে রেখে দিতে বললেন । আমি রাখলাম তা রাখলাম তিনটা ত্রিভুজে । তখনই, আশ্চর্য হয়ে, লক্ষ্য করলাম, ঐ তিনটা ত্রিভুজ থেকে উঠে এল তিনটি মালা । এইগা  তা হাতে নিলেন । একি ভোজবাজি ? না কি মাদারীর খেল ? 


মালা এল কোথা থেকে ? তাও বিনে সুতোর মালা ? সেই মালা আমার গলায় পরাতে গেলেন তিনি । পারলেন না । একটি একটি ফুল ঝরে পড়ে গেলো মালা থেকে । দ্বিতীয় মালারও তথৈবচ অবস্থা । ফিক করে হেসে উঠলাম আমি । বিনে সুতোর মালা টিকবে কি করে ? এইগার ভোজবাজি তাহলে এখানেই খতম ? আমার অবাক হওয়ার তখনও অনেক বাকি । তৃতীয় মালাটি গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, 'ললিতা, এ ছেলেকে ধরে রাখতে পারবে না তুমি ।' মা বিগলিত, কাতরকণ্ঠে বললেন, 'এইগা, একটা উপায় করুন ।' এইগা এবার গম্ভীর । বললেন, 'তোমার ছেলে অভিশাপগ্রস্ত এক পুরুষ । তাকে ইহজনমে ভোগ করে যেতে হবে লাঞ্ছনা আর অপমান ।' 'সুখী হবে তো জীবনে ? না কি আমার মত অভাগাই থেকে যাবে সারাজীবন ?' এইগা যেন ধ্যানে বসলেন এবার । সারা ঘর জুড়ে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা । 


ধ্যান থেকে উঠে এসে, তিনি বললেন, 'ললিতা, তোমার ছেলের সুখভাগ্য নেই । চিরকালীন এক অস্থিরতা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । ধর্মে মতিহীন, এই বালকের মন অন্য জগতের দিকে । সে জগত আমাদের নয়, তোমাদের জগতের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই ।' দুতিন মিনিট চুপ করে থেকে তিনি পুনরায় বললেন, 'একটা কবচ দিচ্ছি, এটা যত্ন করে তাকে পরাবে । মনে হয় না, এটা সে রেখে দেবে চিরকাল । যেদিন এটা হারিয়ে যাবে, মনে রেখো, সেদিন থেকে সে হবে চরম একাকী । তার পাশে থাকবে না কেউ । স্ত্রী-পুত্র, স্বজন, বন্ধু, এমন কি তুমিও থাকবে না । বড়ো একা তোমার ছেলেটা । ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন ।' মা কাঁদতে লাগলেন, আর আমি, অসহায় ভাবে, তাকিয়ে রইলাম এই অন্ধ জ্যোতিষীর দিকে ।


আমার নারীরা : ৩৫

December 21, 2013 at 3:07pm


ঘটনাবহুল এই বালককালের অধিকাংশ কথাই এখন আর মনে নেই । যেমন মনে নেই, একদিন বাবার হাতে মার খেতে খেতে আমি চৌকির নিচে লুকিয়েও পার পাইনি । সেদিন কি অপরাধ করেছিলাম, কোনো রকমেই মনে করতে পারছি না । অথচ, সে রাতে, বাবার ঐ হিংস্রতা দেখে, ঘৃণা করেছিলাম তাকে । তিনি বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন আমাকে । অল্পে রক্ষা পেয়েছিলো আমার বাঁ-চোখ । একসময়, মনে হয়েছিলো, আমাকে, বোধহয়, জ্যান্ত মেরে ফেলবেন বাবা । সেদিন থেকে বাবাকে অপছন্দ করতে শুরু করলাম আমি । তিনি যেদিনগুলি এ বাড়িতে থাকেন না, মনে হতো, সে দিনগুলির চাইতে ভালো দিন আর নেই । বাবাও পছন্দ করতেন না আমাকে । ধীরে ধীরে, বঞ্চিত হতে শুরু করলাম পিতৃস্নেহ থেকে ।


এর মধ্যে শিলঙ থেকে মামা এলেন আমাদের বাড়িতে । তিনি দিদিমাকে নিয়ে যাবেন শিলঙ । মা গেলেন ভানুবিল, দিদিমাকে আনতে । সেসব দিনে বিনা পাসপোর্টে লোক যাতায়াত করতো বেশি । মা চলে যাবার পর, বাবা আর থাকলেন না এখানে । তিনি গেলেন জলাইর বাড়িতে । মামা আর আমি । 


আমকাঁঠালের ছুটি । মজা করেই কাটাচ্ছিলাম দিন । একদিন, ভোর রাতে, মামা আমাকে ডেকে তুললেন, 'সমরজিত্‍, ওঠো । ঝড় এসেছে ।' বিছানা থেকে নামলাম আমি । ঘরের মাঝখানে আলাদা এক চুল্লি থাকে প্রতিটি মনিপুরী ঘরেই । বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে যে স্থানটিকে ব্রহ্মস্থান বা অগ্নিস্থান বলা হয়, সেখানেই এই চুল্লি । চব্বিশ ঘণ্টা এই চুলায় আগুন থাকে, তুষের আগুন । মামা ও আমি সেখানে চলে এলাম । বাইরে শোঁ শোঁ করে বইছে ঝড় । মনে হচ্ছে হাতির গর্জন । কয়েকটা কাঁঠালবীচি ঐ তুষের আগুনে দিলেন মামা । কাঁঠালবীচি পোড়া নুন লংকা দিয়ে খেতে বেশ স্বাদ । এই গরমের দিনেও ঠাণ্ডা লাগছে বেশ । হঠাত্‍ দিকবিদিক কাঁপিয়ে, কড় কড় করে একটা আওয়াজ হলো । ভয়ে, চমকে উঠলাম আমি ।


মামা বললেন, 'খুব কাছেই বজ্রপাত হলো । ভয়ের কিছু নেই ।' ঝড়ের গতি কি বাড়লো ? সঙ্গে কি শিলাবৃষ্টিও ? আমাদের ঘরটা দুলে উঠলো যেন । মামা, এবার, চারদিকে তাকালেন । তারপর, আগুন থেকে কাঁঠালের বীচি বের করে বললেন, 'খাও । গতিক ভালো ঠেকছে না । হয় তো আজ আর খাওয়া না জুটতে পারে ।' কথা বলে শেষ করতে পারলেন না মামা, তার আগে, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লৈ আমাদের বাড়ি । ভুল বললাম. ভেঙে পড়েনি, বসে পড়লো হাতির মতো । চারচালা ঘরের উপরটাকে এতদঞ্চলে টুলি বলা হয়ে থাকে । আমরা দুজন ঐ টুলির ফাঁকে, অক্ষত । তুষের আগুন নিভিয়ে দিলেন মামা । বললেন, 'এটা থেকে আগুন ধরে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে । এবার, চলো, মনের সুখে কাঁঠালবীচি খাই ।' আমি, তখন, ভাবছি, মামা আমাকে ঐ সময় ডেকে না তুললে, চুলার পাশে না আনলে মরে যেতে পারতাম । যে বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম, ঘরের চাপে ভেঙে গেছে তাও । কাঁঠালবীচি ঐ সময় না পুড়লে, সারাদিন থাকতাম অনাহারে । মামা এসব কেমন করে জানলেন ? অবাক হয়ে তাকালাম মামার দিকে । ছিপছিপে চেহারা, লম্বা, ফর্সা, গালদুটিতে আপেলের রঙ, চোখ দুটিতে লেগে আছে মায়া । ঝড় থামলো সকাল নটা নাগাদ । 


ঘর থেকে বেরুবার উপায় নেই আমাদের । দু একবার বলরাম মামাকে ডাকলাম, কোনো উত্তর নেই । মামা একটা দা নিয়ে ঘরের টুলির একদিক কেটে ফেললেন তত্‍ক্ষণাত্‍ । সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা । ও মা ! চারদিক ফকফকে শাদা । কোনো গাছপালা, বাড়িঘর নেই, ঝড় এসে সমান করে দিয়ে গেছে সব । এত শিলাবৃষ্টি এর আগে দেখিনি আমি । হাঁটু অবধি বরফের শিলা । যেন খই ফুটে আছে বেতছড়া গ্রামে । আমাদের ঘরের পাশে কাঁঠাল গাছ উপড়ে নিয়ে ফেলেছে রাস্তার ওদিকে । বরফ দেখে আমার মন ভরে গেলো খুশিতে ! লাফিয়ে নামলাম বরফের উপর । পা রাখতে পারছি না, কন কনে ঠাণ্ডা । তবুও খুশির জোয়ারে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে । সব বাড়ি পড়ে গেছে মাটিতে । লোকজন বেরিয়ে আসছে সেসব ঘর থেকে । ফাজাদির সঙ্গে আমরা বরফ মাড়িয়ে গেলাম বাজার দেখতে । 


আসাম আগরতলা রোড তখন বরফঢাকা । বাজারের দোকানপাট সব ধুলিসাত্‍, মনে হলো, কে যেন ডজার চালিয়ে সমান করে দিয়ে গেছে । আর রাণা সাহার দোকানের বটগাছটা ? শিকড় উপরের দিকে ডালপালা মাটিতে যেন শীর্ষাসন করছে বটগাছ । ঝড়ের শক্তি কতখানি ভয়ংকর, তা অনুভব করলাম, সেই প্রথম । আমার হঠাত্‍ মনে পড়ে গেলো, হরিণগুলির কথা । যারা রোজ আমার স্নানের সময় পুকুরপাড়ে এসে আমাকে ঘিরে থাকতো, তাদের কিছু হয়নি তো ? বেঁচে আছে তো তারা ?

দিদিমাকে নিয়ে শিলঙ চলে গেলেন মামা । পরবর্তী ছ'মাসের কথা মুছে গেছে স্মৃতি থেকে । পাগলাকুকুরের ঐ কামড়ের পর কুকুরভীতি বেড়ে গেছে দশগুণ । 


ভাবছিলাম, একটা কুকুরছানা এনে ঘরে পালবো কি না । তার আগে কোথা থেকে মা নিয়ে এলেন এক বিড়ালছানা । ঘরে ইঁদুরের উত্‍পাত বেড়ে গেছে খুব । একরাতে, মার অমন সুন্দর চুলের গোছা ইঁদুরে কেঁটে ফেলার পর, রেগে গিয়ে বিড়ালছানা পুষতে গেলেন মা । সন্ধ্যের দিকে বিড়ালছানা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি, কোনো কথা না বলে, ঘরের মাঝখানে যে চুলাটা আছে তার পাশে গিয়ে বসলেন মা । আমাকে বললেন, 'ঝাড়ুটা নিয়ে এসো ।' বিড়াল আমার পছন্দের না, তবে, এটা খুব মিষ্টি চেহারার । ঝাড়ুটা নিয়ে বিড়ালছানার পিঠে মা এক ঘা দিলেন, আর বললেন, 'ঘরে খেয়ে বাইরে হেগো ।' তিন তিনবার এটা আওড়াতে আওড়াতে বিড়ালছানাটিকে প্রহার করলেন মা । পরে বললেন, বিড়ালকে পোষ মানাবার এটাই না কি অব্যর্থ মন্ত্র এবং দাওয়াই । কার কাছ থেকে যে এটা শিখে এসেছেন সরল মনে, আমার হাসি পেলো । 'এই, হাসছো কেন ?' মা হঠাত্‍ রেগে গেলেন । ইদানিং মা অল্প কথাতেই রেগে যাচ্ছেন, কেন তা বুঝতে পারছি না । 


বাবা এ বাড়িতে খুব কম থাকেন এখন । মশাউলিতে এক বাড়িতে থেকে স্কুল করছেন তিনি । সেখান থেকে শনিবার চলে যান জলাই । এটাই কি মা-র ক্রোধের কারণ ? তো, সে রাতে, ইঁদুরের দৌঁড়ঝাঁপ কমে গেলো যেন । রোজ তাদের ছোটাছুটি, কাটাকুটিতে ঘর থাকতো মুখর হয়ে । মাঝে মাঝে কিচিরমিচির করে হৈচৈ করতো ইঁদুরগুলি । বিড়ালছানা আসার ফলে, তারা যেন এক কদম গেছে পিছিয়ে । পরদিন, সকালে, দেখা গেলো, বিড়ালছানাটি ঘরের খেয়েছে বটে, তবে বাইরে হাগেনি । সে তার এই কর্মটি সেরেছে চুলার পাশেই । রেগে গিয়ে, মা বিড়ালছানাটিকে কয়েক ঘা লাগালেন ঝাড়ু দিয়ে । মা'র এই বিড়ালর্ব শেষ হবার আগেই, চলে এল আমার এনুয়্যাল পরীক্ষা । ছ'মাস স্কুলে যেতে পারিনি, ফলে, আমি আদৌ পরীক্ষায় বসতে পারবো কি না, সে নিয়েই সন্দিহান ছিলেন মাস্টারমশাইরা । পরীক্ষার দিন, ক্লাসরুমে ঢোকার মুখে, দেখলাম, সত্যভামা দাঁড়িয়ে আছে । আমাকে দেখে ঝটিতি এলো এগিয়ে । 'ভালো করে পরীক্ষা দিও । আর ফার্স্ট হলে তোমাকে একটা উপহার দেবো । মনে রেখো ।' বলে, যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই চলে গেলো দ্রুত ।এত আচম্বিতে ঘটনাটা ঘটলো, কিছুই না বুঝে, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । 


পরীক্ষা যথারীতি শেষ হলো একদিন । পরীক্ষার এ কয়দিনেও বাবা এলেন না ঘরে । মার সঙ্গে কিছু ঘটেছে কি ? মা-কে আগের মত হাসিখুশি দেখি না আর । শীত নেমেছে পরীক্ষার আগে থেকেই । এবার আর নতুন করে শীতের কাপড় কেনা হলো না আমার জন্য । তেলনুন ইত্যাদি কেনার জন্য তিনচার সের চাল দিয়ে মা আমাকে হাটবারে পাঠিয়ে দেন বাজারে । সের মানে এক কেজি থেকে সামান্য বেশি । সোয়া কেজির মতো । তখন মাত্র কিলোগ্রাম গ্রাম কিলোমিটার মিটার লিটার হচ্ছে চালু । ষোল আনাতে একটাকার বদলে একশ পয়সায় একটাকা । এসব হিসেব বেশ গণ্ডগোলের । তো, চারপাঁচ সের চাল বিক্রি করতে পারলে একটাকা বা পাঁচসিকি পাওয়া যেতো । তা দিয়ে তেল এক পোয়া, নুন আর এক হালি হাঁসের ডিম আনতাম । মনিপুরী বাড়িতে ডিমের প্রবেশ নিষেধ । আমাদের ঘরে ডিম ঢুকে গেছে লুকিয়ে । কাঁটার ভয়ে মাছ খাই না আমি, ফলে, ক্রমে প্রিয় হয়ে উঠেছে ডিম । একদিন, চাল নিয়ে বসেছি বাজারে, লোকজন কম, হঠাত্‍ রব উঠলো, আসছে আসছে, আর যে যেদিকে পারলো, পালাতে লাগালো । ব্যাপারটা কি, বুঝে ওঠার আগে, দেখলাম, সুনসান হয়ে গেলো হাট, আর আমি, একা, দাঁড়িয়ে আছি মেলে ধরা চালের সামনে ।


তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের ঘরের রাস্তা দিয়ে নামছে পঁচিশ-ত্রিশজন কুকি । নেংটো । হাতে এক একটা বর্শা, মাথায় পাখির পালক । মেয়েদেরও একই অবস্থা । তবে তাদের মাথায় পাহাড়ি খাড়া বা ঝুড়ি । হাতে, কনুইয়ের উপর হাড়ের বাজুবন্ধ, গলায় হাড়ের মালা । পরে, মা-র কাছ থেকে জেনেছি, তারা এখনও বস্ত্রের ব্যবহার শেখেনি । সপ্তাহে একদিন বাজারে আসে নুন আর কেরোসিন নিতে । আগে, মানুষ খেতো, কাঁচা । সেদিন পার হয়ে, তারা এখন নুনব্যবহার শিখেছে ।


আমার নারীরা : ৩৬

December 22, 2013 at 6:14pm


দিদিমাকে নিয়ে শিলঙ চলে গেলেন মামা । পরবর্তী ছ'মাসের কথা মুছে গেছে স্মৃতি থেকে । পাগলাকুকুরের ঐ কামড়ের পর কুকুরভীতি বেড়ে গেছে দশগুণ । ভাবছিলাম, একটা কুকুরছানা এনে ঘরে পালবো কি না । তার আগে কোথা থেকে মা নিয়ে এলেন এক বিড়ালছানা । ঘরে ইঁদুরের উত্‍পাত বেড়ে গেছে খুব । একরাতে, মা'র অমন সুন্দর চুলের গোছা ইঁদুরে কেটে ফেলার পর, রেগে গিয়ে বিড়ালছানা পুষতে গেলেন মা । সন্ধ্যের দিকে বিড়ালছানা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি, কোনো কথা না বলে, ঘরের মাঝখানে যে চুলাটা আছে তার পাশে গিয়ে বসলেন মা । আমাকে বললেন, 'ঝাড়ুটা নিয়ে এসো ।' বিড়াল আমার পছন্দের না, তবে, এটা খুব মিষ্টি চেহারার । ঝাড়ুটা নিয়ে বিড়ালছানার পিঠে মা এক ঘা দিলেন, আর বললেন, 'ঘরে খেয়ে বাইরে হেগো ।' তিন তিনবার এটা আওড়াতে আওড়াতে বিড়ালছানাটিকে প্রহার করলেন মা । পরে বললেন, বিড়ালকে পোষ মানাবার এটাই না কি অব্যর্থ মন্ত্র এবং দাওয়াই । কার কাছ থেকে যে এটা শিখে এসেছেন সরল মনে, আমার হাসি পেলো । 'এই, হাসছো কেন ?' মা হঠাত্‍ রেগে গেলেন । ইদানিং মা অল্প কথাতেই রেগে যাচ্ছেন, কেন তা বুঝতে পারছি না । 


বাবা এ বাড়িতে খুব কম থাকেন এখন । মশাউলিতে এক বাড়িতে থেকে স্কুল করছেন তিনি । সেখান থেকে শনিবার চলে যান জলাই । এটাই কি মা-র ক্রোধের কারণ ? তো, সে রাতে, ইঁদুরের দৌঁড়ঝাঁপ কমে গেলো যেন । রোজ তাদের ছোটাছুটি, কাটাকুটিতে ঘর থাকতো মুখর হয়ে । মাঝে মাঝে কিচিরমিচির করে হৈচৈ করতো ইঁদুরগুলি । বিড়ালছানা আসার ফলে, তারা যেন এক কদম গেছে পিছিয়ে । পরদিন, সকালে, দেখা গেলো, বিড়ালছানাটি ঘরের খেয়েছে বটে, তবে বাইরে হাগেনি । সে তার এই কর্মটি সেরেছে চুলার পাশেই । রেগে গিয়ে, মা বিড়ালছানাটিকে কয়েক ঘা লাগালেন ঝাড়ু দিয়ে । মা'র এই বিড়ালর্ব শেষ হবার আগেই, চলে এল আমার এনুয়্যাল পরীক্ষা । ছ'মাস স্কুলে যেতে পারিনি, ফলে, আমি আদৌ পরীক্ষায় বসতে পারবো কি না, সে নিয়েই সন্দিহান ছিলেন মাস্টারমশাইরা । পরীক্ষার দিন, ক্লাসরুমে ঢোকার মুখে, দেখলাম, সত্যভামা দাঁড়িয়ে আছে । আমাকে দেখে ঝটিতি এলো এগিয়ে । 'ভালো করে পরীক্ষা দিও । আর ফার্স্ট হলে তোমাকে একটা উপহার দেবো । মনে রেখো ।' বলে, যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই চলে গেলো দ্রুত ।এত আচম্বিতে ঘটনাটা ঘটলো, কিছুই না বুঝে, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । 


পরীক্ষা যথারীতি শেষ হলো একদিন । পরীক্ষার এ কয়দিনেও বাবা এলেন না ঘরে । মার সঙ্গে কিছু ঘটেছে কি ? মা-কে আগের মত হাসিখুশি দেখি না আর । শীত নেমেছে পরীক্ষার আগে থেকেই । এবার আর নতুন করে শীতের কাপড় কেনা হলো না আমার জন্য । তেলনুন ইত্যাদি কেনার জন্য তিনচার সের চাল দিয়ে মা আমাকে হাটবারে পাঠিয়ে দেন বাজারে । সের মানে এক কেজি থেকে সামান্য বেশি । সোয়া কেজির মতো । তখন মাত্র কিলোগ্রাম গ্রাম কিলোমিটার মিটার লিটার হচ্ছে চালু । ষোল আনাতে একটাকার বদলে একশ পয়সায় একটাকা । এসব হিসেব বেশ গণ্ডগোলের । 


তো, চারপাঁচ সের চাল বিক্রি করতে পারলে একটাকা বা পাঁচসিকি পাওয়া যেতো । তা দিয়ে তেল এক পোয়া, নুন আর এক হালি হাঁসের ডিম আনতাম । মনিপুরী বাড়িতে ডিমের প্রবেশ নিষেধ । আমাদের ঘরে ডিম ঢুকে গেছে লুকিয়ে । কাঁটার ভয়ে মাছ খাই না আমি, ফলে, ক্রমে প্রিয় হয়ে উঠেছে ডিম । একদিন, চাল নিয়ে বসেছি বাজারে, লোকজন কম, হঠাত্‍ রব উঠলো, আসছে আসছে, আর যে যেদিকে পারলো, পালাতে লাগালো । ব্যাপারটা কি, বুঝে ওঠার আগে, দেখলাম, সুনসান হয়ে গেলো হাট, আর আমি, একা, দাঁড়িয়ে আছি মেলে ধরা চালের সামনে । 


তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের ঘরের রাস্তা দিয়ে নামছে পঁচিশ-ত্রিশজন কুকি । নেংটো । হাতে এক একটা বর্শা, মাথায় পাখির পালক । মেয়েদেরও একই অবস্থা । তবে তাদের মাথায় পাহাড়ি খাড়া বা ঝুড়ি । হাতে, কনুইয়ের উপর হাড়ের বাজুবন্ধ, গলায় হাড়ের মালা । পরে, মা-র কাছ থেকে জেনেছি, তারা এখনও বস্ত্রের ব্যবহার শেখেনি । সপ্তাহে একদিন বাজারে আসে নুন আর কেরোসিন নিতে । আগে, মানুষ খেতো, কাঁচা । সেদিন পার হয়ে, তারা এখন নুনব্যবহার শিখেছে ।


আমার নারীরা : ৩৭

December 22, 2013 at 8:19pm


পরীক্ষার ফল বেরুলো ত্রিশ ডিসেম্বর । হ্যাঁ, আবার ফার্স্ট হয়েছি আমি, প্রতিটি বিষয়ে একশোতে একশো পেয়ে । ধীরু এসে ঝাপটে ধরলো আমাকে । আমার আনন্দে ওর আনন্দ । এক অদ্ভুত বন্ধু আমার । স্কুল থেকে বেরিয়ে আসছি, সত্যভামা এলো এগিয়ে । ও এবার ক্লাস সিক্স, আমি থ্রী । বললো, 'উপহার নেবে না তুমি ?' উপহারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম আমি, এমন কি, সত্যভামার কথাও । আমি হাসলাম, 'দেবে ? দিও, তোমার যখন ইচ্ছে হবে ।' বলে, চলে এলাম ধীরুকে নিয়ে । মা ভীষণ খুশি । রাতে আমার জন্য পায়েস করলেন, বিন্নি বা বীড়ণ চাল দিয়ে । আর উতং বাঁশে রান্না বীড়ণের ভাত । ডিমের ওমলেট, মাষকলাইয়ের ডাল । আর, হ্যাঁ, পাটিসাপটা পিঠে । বিছানায়, আমাকে ঘুম পাতিয়ে দিতে দিতে বললেন, 'বাবা, তাড়াতাড়ি বড় হও । আমাদের সামনে অনেক বড় দুর্যোগ আসছে । জানি না, সামাল দিতে পারবো কি না !' 


কি দুর্যোগ, কি হতে যাচ্ছে সামনে, ভাবতে ভাবতে, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি । পরদিন, সকালে, ঘুম ভাঙলো লোকজনের হৈচৈ, চিত্‍কার চেঁচামেচিতে । বাইরে এসে দেখি কুড়ি পঁচিশজন লোক জটলা বেঁধে আছে, মাঝখানে মা । পাশে বলরাম মামা । তিনিই বললেন, 'ঠিক আছে, বিচার হয়েছে, রায় হয়েছে পঞ্চায়েতের, তবু মানবিকতার কারণে, দিদিকে দু একমাস অন্তত সময় দাও তোমরা ।' আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুই, মা কি করেছে ? কিসের সময় তারা দেবে মা-কে ? ভিড়ের থেকে একটা লোক, মামাকে থামিয়ে দিয়ে, বললো, 'তোমার কথাই মানছি । এখন পৌষমাস । পৌষে বাড়ি ছাড়তে বলবো না ।


শীতকালটা যাক । আগামী বছর বৈশাখে ছাডতে হবে । এরপর একদিনও রেয়াত করবো না, বলে, রাখলাম । তোমার দিদি বাড়ি ছাড়লে পাকিস্তান থেকে আমার বোন আর তার জামাই আসবে থাকতে । কুলাউড়াতে তাদের থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে । বৈশাখেই ছেড়ে দেবেন তোমার দিদি । এই আমার শেষ কথা ।' এতক্ষণ, চুপ করে, মাথা নিচু করে, দাঁড়িয়েছিলেন মা, এবার মাথা তুলে, বলরাম মামাকে বললেন, ওদের বলে দাও, 'বৈশাখেই এ বাড়ি ছেড়ে দেবো আমি । এতটুকু দয়া করেছেন তারা, আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দাও তাদের ।' বলে, ঘরের ভেতর চলে এলেন মা । এসে, বিছানায় উপুড় হয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি । 


বৈশাখ নয়, শেষপর্যন্ত আষাঢ়েই ছাড়লাম এই বাড়ি । বাবা জমিজমাসহ এই ভিটে এবং আর যা যা আছে, সব বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন আমাদের পথে বসিয়ে দিয়ে ।


মা জানতেন, বেতছড়ার জমিজমাভিটে সব মা'র নামে রেজেস্ট্রি করা, পরচা থেকে দলিল সব কিছু মা'র নামে । কেন না, এসব কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন মা । প্রথমে বিশ্বাস করেননি, মোড়লকে বলে পঞ্চায়েতের বিচারও হলো, সবখানেই দেখা গেলো, কোনোটাই মার নামে নেই । সব নিজের নামেই করিয়েছিলেন বাবা । এভাবে ধোঁকা খাবেন, ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মা । মা'র সরলতার পুরো ফায়দা নিয়েছেন বাবা । আমার নিজেরই রাগ হলো খুব । মনে মনে বললাম, বড় হলে, বাবাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে । 


ক্রমে আষাঢ় মাস এলো । বৈশাখে কেন যে ছাড়লাম না, তা ভুলে গেছি । বেতছড়া ছাড়লাম আষাঢ়ে, রথের পালির একসপ্তাহ আগে । ছাড়ার আগের দিন, সকালে, রান্না করতে দিলেন না বলরাম মামা । বললেন, 'তোমরা দুজনে আমাদের ঘরে খেয়ে নিও ।' সারাদিন ধরে জিনিসপত্র গোছালেন মা । কি ফেলে যাবেন, কি নেবেন, ভাবতে ভাবতে, চলে গেলো দিন । বিকেল থেকে পাড়ার মহিলাদের ভিড় । মাকে তারা ভালোবাসতেন, খুব মিশুকে ছিলেন মা, ফলে, গ্রামে তার কদর ছিলো আলাদা । 


তাদের কথাবার্তায় বাবার প্রতি ঝরে পড়ছে তীব্র বিষ । সন্ধ্যের পর এলেন পুরুষরা । তারা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 'নিজের অধিকার ছাড়বে না, ললিতা । এ তোমার একার লড়াই নয়, এ তোমার ছেলের জন্যও লড়াই ।' পরদিন, সকালে, মা আর আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম সব হারিয়ে ।


আমার নারীরা : ৩৮

December 23, 2013 at 3:37pm


সকাল থেকে রাস্তায়, গাড়ির অপেক্ষা করছি । আকাশে রোদ থাকলেও, গতিক ভালো নয়, যে কোনো মুহূর্তে নেমে আসতে পারে বৃষ্টি । বেলা যত বাড়ছে, গরমও তত চেপে বসেছে । মা, একবার, আকাশের দিকে তাকালেন । চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ । সকাল থেকে একটি কথাও বলেননি তিনি । আহত বাঘিনীর মত ফুঁসছেন ক্রোধে । কয়েকটা গাড়ি চলে গেলেও, চাপতে পারিনি স্থান সংকুলানের অভাবে । এর মধ্যে দু একজন এসে কথা বলে গেলেন মা'র সঙ্গে । এগারোটা নাগাদ একটা জিপের পেছনে কোনোরকমে জায়গা হলো আমাদের । কুমারঘাট হয়ে জলাই পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেলো গাড়ির অভাবে । যখন জলাইর বাড়িতে পৌঁছলাম, বৃষ্টি নেমে গেছে জোরে, বাবা মাংকলে বসে কি যেন খাচ্ছেন, পাশে বড় মা । 


আমাদের দেখেই বড় মা চিত্‍কার করে উঠলো, 'ঐ খানকিটা যদি এঘরে আসে, তোমাকে বলে দিলাম, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে যাবো । এখনই ।' মা'কে দেখলাম, কোনো কথাই আজ আর গায়ে মাখছেন না, তিনি এগিয়ে গেলেন মাংকলের দিকে । সমস্ত শরীর ভেজা, চুল থেকে ঝরছে জল টপ টপ করে । তার পেছনে পেছনে আমি । বাবা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, 'কি করতে এসেছো এখানে ? তোমাকে বলিনি, যে, কোনোদিন এঘরে আসবে না তুমি ? এলে কেন ?' শান্ত অথচ আশ্চর্য এক অবশ করা গলায় মা বললেন, 'আসতে বাধ্য করেছো তুমি । জমিজমাভিটেমাটি ওভাবে, না বলে কয়ে, বিক্রি করে এলে কেন ?' 'এখান থেকে চলে যাও তুমি ।' হিস হিস করে বলে উঠলেন বাবা । 'এখানে তুমি থাকতে পারবে না ।' 'তাহলে কোথায় যাব, বলে দাও আমাকে ! তোমার ছেলেকে নিয়ে কি খাবো, তার ব্যবস্থা করে দাও । এটা তোমার কর্তব্য ।' বলতে বলতে, মা উঠে গেলেন মাংকলে । পেছনে আমি । 


মুহূর্তে, ঘটনাটা ঘটে গেলো । মা'র চুলের মুঠি ধরে বাবা হিড় হিড় করে, মাংকল থেকে, টেনে নামালেন মা'কে । বাবার হাত ধরে আটকাবার চেষ্টা করছিলাম আমি । এক হাতে এমন ধাক্কা দিলেন বাবা, ছিটকে গিয়ে পড়লাম উঠোনের একদিকে । কাদায় জলে মাখামাখি আমি, কোনোরকমে মাথা তুলে দেখি, মা'র ঘাড় ধরে, প্রচণ্ড জোরে মা'কে ধাক্কা দিলেন বাবা । টানাহ্যাঁচড়ায় মা'র শরীর থেকে খুলে গেছে আঙালুরি, ছিঁড়ে পড়ে গেছে ব্লাউজ, ইনাফিটা পড়ে আছে মাংকলেই । একবারে উদোম শরীরে ছিটকে পড়লেন মা, উঠোনের ঠিক মাঝখানে । এই দৃশ্য দেখতে পারছি না আমি । কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে, আবার উঠে দাঁড়ালেন মা, মনে হলো, তিনিই নগ্নচণ্ডী, জেগে উঠেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদে । আমার ভাই ও বোনেরা মাংকল থেকে, এ দৃশ্য দেখে, হাসছে । কাকাকাকীমা বেরিয়ে আসছেন না বড়ভাইয়ের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে । 


'তুমি ঘাড ধাক্কা দিয়ে আমাকে বের করে দিতে পারো, আমি যাবো না ।' মা এবার ফুঁসছেন । 'যেভাবে এনেছিলে, সেভাবেই রাখার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে ।' বাবা যেন আর সহ্য করতে পারছেন না, কোনো জবাব না দিয়ে, মাংকল থেকেই জোরে লাথি মারলেন মা'কে । 


উলটে পড়ে গেলেন মা । ভয়ে, চোখ বুঁজে ফেললাম আমি । মনে মনে প্রার্থনা করছি, কেউ একজন আসুক, কেউ একজন । এসে এই বিপদ থেকে বাঁচাক আমাদের । ভেতর থেকে বড়মা বলে উঠলেন, 'খানকিটা এখনো যায়নি ? ওকে বলো, এই শরীর নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালে খদ্দেরের অভাব হবে না ।' কারা যেন হেসে উঠলো এই কথায় । চোখ খুলতে পারছি না, এই চেহারায় মা'কে দেখতে চাইছি না আমি । মনে মনে বলছি, ঠাকুর, তুমি এসে বাঁচাও আমাদের ।


তখনই, পাশের বাড়ির সোনাদাদু এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে এলেন মা'র কাছে । একটা কাপড় এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'পড়ে নাও, বৌমা ।' চোখ খুলে দেখলাম, সোনাদাদু, অসহায়ের মত, তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে । তারপর, মা'কে বললেন, 'চলো, বৌমা, এই পাষণ্ডের ঘরে তোমাকে থাকতে দেবে না কেউ । এর নরকেও স্থান হবে না, আজ বলে রাখলাম ।'


আমার নারীরা : ৩৯

December 24, 2013 at 3:36pm


সেই রাত কাটলো সোনাদাদুর বাড়িতে । সে এক বিভীষিকাময় দিন গেছে, যা কোনোদিন কেউ মনে রাখতে চাইবে না, অথচ ঐ দিনটিই হানাবাড়ির মত জেগে থাকবে, একা, সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে । কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না মা, চোখের জল শুকিয়ে গেছে কয়েকমাস হলো, সেখানে অশ্রুর বদলে আগুনের ফুলকি । আমার খিদে পেয়েছিলো খুব, সোনাদাদুর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়লাম মাটিতে পাতা মাদুরের বিছানায়, পরে মা এলেন আমার সঙ্গে ঘুমোতে । সোনাদাদুর বাড়িতে তিনরাত্রি ছিলাম আমরা । তিনিই মা-র পক্ষে ডেকেছিলেন বিচারসভা, লাভ হয়নি, বাবার ভয়ে বিপক্ষে কোনো মত দেয়নি কেউ আর । ফলে, এই আশ্রয়, আমার জন্মগ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হলো আমাদের ।


কোথায় যাবো, মা, হয়তো, জানতেন, আমি জানতাম না, আমাকে কিছু বলেননি মা । ছোট, বলে, এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন আমাকে । বৃষ্টি সেই যে নেমেছে, আর থামার নাম নেই । এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরুলাম সোনাদাদুর আশ্রয় ছেড়ে । মা এগিয়ে গেলেন খেয়াঘাটের দিকে, অর্থাত্‍ পশ্চিমে, মনু নদীর দিকে । জলে টইটম্বুর নদী, বললে, ভুল হবে । আসলে ফুঁসছে নদী । যে কোনো মুহূর্তে পাড় ভেঙে ঢুকে যেতে পালে গ্রামে । জলোচ্ছ্বাস, কল্লোল দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি । খেয়াঘাটে এসে নৌকায় চড়ে বসলাম মা-র সঙ্গে । 


নৌকা যিনি চালাচ্ছেন, তিনিই মা-কে বললেন, 'তখন তোমাকে বলেছিলাম, বউদি, প্রফুল্ল মাস্টর খুব বাজে লোক । আমার কথা তো শুনলে না । এখন তার ফল ভোগ করছো ।' মা প্রথমে কোনো কথা বললেন না, তারপর, কয়েকমিনিট পর, বললেন 'আমি কি করতে পারতাম, কৃষ্ণকুমার । একসঙ্গে বাঘ আর কুমিরের হানা সামলাবার শক্তি ছিলো না আমার ! তা ছাড়া, ঘর না করলে কি করে বুঝতাম এতটা ?' নৌকা যাচ্ছে উজান বেয়ে, পাড় ঘেঁষে । জল আছড়ে পড়ছে পাড়ে এসে, যেন ক্রুদ্ধ কোনো নাগিনী তার সকল আক্রোশ ঢেলে দিচ্ছে নদীর পাড়ে ছোবল মেরে । দেখলাম, নদীর একটা পাড় ভেঙে পড়লো বিকট শব্দ করে । ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে জল, এসব থেকে বাঁকিয়ে, অতি সাবধানে, মাঝি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকাকে ।


মাঝির চেহারা পছন্দ হয়নি আমার, কালো, থ্যাবড়ানো চোয়াল, জামাটা অতি জীণ, ময়লা, চোখদুটিতে, মনে হলো, মাকড়সার জাল । আর হাসিটা ? গা গুলিয়ে যাচ্ছিলো আমার । নৌকা এবার অথৈ জলে, নদীর মাঝখানে, জলের তোড়ে ঘুরে যাচ্ছে আচমকা, বৈঠা শক্ত করে ধরেও টাল সামলাতে পারছে না মাঝি । আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন মা, আমি শুধু ভাবছি, এই ঘূর্ণিস্রোতে নৌকা যদি তলিয়ে যায়, যদি যায়, আমাদের কি হবে ? ভাবতে ভাবতে, আমার খুব বেঁচে থাকার শখ হলো । ফিসফিস করে মা-কে বললাম, 'আমরা বাঁচতে পারবো তো, মা ?' 'চোখ বন্ধ করে থাকো ।' সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন মা, তার আগেই, ভয়ে, বন্ধ করে ফেলেছিলাম চোখ । কতক্ষণ জানি না, মা বললেন, 'ওঠো, এবার নামতে হবে আমাদের ।' চোখ খুলে, দেখি, অপর পাড়ে চলে এসেছি আমরা, নৌকা ঘাটে এসে থেমেছে ভালো করেই । নামতে যাবো, তখনই, মা বললেন, 'প্রণাম করো, ইনি তোমার কাকা হন ।'


আমার নারীরা : ৪০

December 24, 2013 at 10:45pm


যে গ্রামে এসে, আমাদের আশ্রয় মিললো, সে গ্রামের নাম পেঁচারডহর । দূর সম্পর্কে আত্মীয় হলেও, কয়েকটি শর্ত রাখা হলো আমাদের সামনে, যার সব কটিই বিনা বাক্যে মেনে নিলেন মা । প্রথমত, তারা আমাকে চাইছিলেন না, তবু করুণাবশত তারা রাখলেন আমাকে, গৃহভৃত্য হিসেবে । রোজ তাদের চৌদ্দটা গরু, সাতটা মোষ চরাতে হবে । এর বাইরে বাড়ির সকল ফাইফরমাশ, যখন যা বলবে, আমাকেই করতে হবে তা । আর মা করবেন ঘরের যাবতীয় কাজ সহ ক্ষেতের কাজ, ধান রোপণ থেকে সব । বিনিময়ে দু'বেলা খাবার, আর থাকার জন্য একচালা একটি ঘর । বছরে একবার কাপড় । কেন যে এই সব শর্ত মেনে নিলেন মা, জানি না । হয়তো, মা পরবর্তী দিনগুলির কথা ভাবছিলেন, যা আমাকে বলতে চাইছিলেন না । তবু তো দু'বেলা খাবার জুটবে আমাদের । 


হায়, তখনও কি জানতাম, দু'বেলার একবেলা স্রেফ পান্তাভাত, তিনচারটে বালুচরী শুকনো লংকা, আধপোড়া, আর আর্ধেক সিদল পোড়া । ভাতে জল ঢেলে, নুন সহ ওসব মেখে, খেয়ে, ভোরবেলা, মা ও আমাকে বেরিয়ে পড়তে হতো কাজে । গরুমোষ নিয়ে আমি, আর বাড়ির কাজ তার আগে শেষ করে, চলে যেতেন ক্ষেতের কাজে । সারাদিন গরুমোষ চরিয়ে, ঘরে ফিরতাম সন্ধ্যের দিকে, ক্ষেত থেকে মা ফিরতেন তখন । খিদেয় পেট জ্বলতো, বলতে পারতাম না কাউকে, মা টের পেতেন, কিন্তু করার কিছু ছিলো না । রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তাম । আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে কোনো কোনোদিন মা বলতেন, 'খুব কষ্ট পাচ্ছো না ? আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো ।' তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, চুপ করে যেতেন তিনি । আর কোনোদিন স্কুলে পড়তে পারবো না, মা ? জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করলেও চুপ করে থাকতাম । 


এই সব কাজ করে স্কুলে যাবার সময় থাকে না আর । গরুমোষ চরাতে যেতাম, খালি গা, পরণে একটা গামছা মাত্র । এক সপ্তাহের মধ্যে শিখে গেলাম মোষের পিঠে চড়া, আর ঐ পিঠেই শুয়ে থাকা । খুবই শান্ত প্রাণী এই মোষ । পিঠে বসেই দেখতাম, ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে যাচ্ছে স্কুলে । আমারই কোনো স্কুল নেই । ভারী হয়ে উঠতো মন, ঝাপসা দেখতাম ঐ ছেলেমেয়েদের । স্কুলটা আমাদের বাড়ি থেকে খুব কাছে, তবে বেতছড়া স্কুলের মতন ততটা খোলামেলা জায়গা নেই, মাঠ নেই, মাঠের মাঝখানে বেদী করে আমগাছ নেই, একদিকে বটগাছ নেই । আছে এক চমত্‍কার ফুলের বাগান, যা দেখে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে পড়তে হয় স্কুলের সামনে । ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একসময়, কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম আমি, টের পেতাম না । কে যেন আমাকে বলতো, 'নামতা মুখস্থ করবে না, ও কাজ বোকারাই করে ।' চারদিকে তাকাতাম, কাউকে দেখতে পেতাম না তখন । গরুগুলি নদীর চরে ঘাস খেতে ব্যস্ত, দু একটা মোষ নেমে গেছে নদীতে । নামতার কথা ভুলে গিয়ে চিত্‍কার করতাম, যাতে মোষগুলি হারিয়ে না যায় । মোষ বা গরু হারিয়ে যাওয়া মানে আশ্রয়দাতার রোষ নজরে পড়া, সে বড় ভয়ংকর ব্যাপার । গলদঘর্ম হয়ে পড়তাম গরুমোষগুলি সামলাতে গিয়ে । দুপুরের পড়ে খিদেয় আর ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তাম মোষের পিঠেই । যে মোষের পিঠে বেশির ভাগ দিন চড়তাম, বলা ভালো, অপত্যস্নেহে সে-ই আমাকে রাখতো সামলে । না হলে যে কি বিপদ ঘটে যেতো এতদিনে ! 


বিকেলে নদীর চরে ছেলেরা আসতো খেলতে, দূর থেকে দেখতাম তাদের খেলা । কাছে যেতাম না সংকোচে । তাদের খেলা দেখে, মন চলে যেতো বেতছড়া বাজারে, ধীরুদের কাছে । এটুকু সময় ভুলে থাকতাম আমার খিদে, ক্লান্তি ও কষ্ট । একদিন, একটা ছেলে এগিয়ে এসে আমাকে জিগ্যেস করলো, 'তোমার নাম কি ? আমাদের গ্রামে আগে তোমাকে দেখিনি ।' ছেলেটি আমারই বয়সী, বললো, 'আমি নিরঞ্জন, বড়বাড়ির ছেলে ।' আমার নাম বললাম তাকে । কোথাও যেন মনে হলো, ছেলেটি অন্যদের মতো না এবং কাছে টানতে জানে । আর একদিন নিরঞ্জন বলে উঠলো, 'স্কুলে যাও না কেন ? যেতে ইচ্ছে করে না তোমার ?' কি জবাব দেবো তাকে ? আমার সব কথা কি বলা যায় কাউকে ? ফলে, চুপ করে, মাথা নিচু করে থাকলাম নিরঞ্জনের সামনে ।


আমার নারীরা : ৪১

December 25, 2013 at 11:34pm


আশ্রয়দাতার নাম মোহন, তার স্ত্রীই আমার দূর সম্পর্কের পিসি । থাম্পাল পিসি তিনি । তাদের দুই কন্যা, বড়জন পদ্মা, সুন্দরী এক যুবতী, ছোটজন লীলাবতী, ছিপছিপে বেতের মত চেহারা, শ্যামা সে । লীলাবতী হায়ার সেকেণ্ডারি ফেল, স্কুলে যায় না । লীলাবতীও তথৈবচ, বড়জনের অনুগামিনী । একজন বাইশ, আর একজন ঊনিশ । তাদের কারও সঙ্গে সদ্ভাব নেই আমার, সে সুযোগও নেই আমার । আমার দিন কাটে নদীর চরে, রাত কাটে ঘুমে । এর বাইরে তাদের সঙ্গে দেখা হলেও কথা হয় না বললেই চলে । মাঝে মাঝে থাম্পাল পিসি দু একটা কথা বলেন, ঐ টুকুই, পিসেমশাই তো একেবারেই না । রাতের খাবার শেষ হলে, বাসনপত্র ধুয়ে, ঘরের বাকি কাজ শেষ করে, মা আসেন বিছানায় । এই আমাদের রুটিন, আর এই রুটিন ক্রমে আমাকে করে তুলছে বিধ্বস্ত । মা'র প্রতি বাড়তে থাকে অক্ষম এক ক্রোধ, সেই ক্রোধ থেকে, একদিন, মা'কে বলি, 'কেন আমরা আমাদের ঘরে যাচ্ছি না, মা ? এখানে আমার আর ভালো লাগছে না থাকতে !' কোনো জবাব দেন না তিনি, চুপ করে, তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে, যেন তিনি আমাকে দেখেননি কোনোদিন । তারপর বলে ওঠেন, 'আমার কি ভালো লাগে এখানে থাকতে ?' 'তাহলে আছি কেন আমরা ?' পালটা প্রশ্ন করি আমি ।


'তোমার শিলঙের মামাকে চিঠি লিখেছি, সে এলে, একটা বন্দোবস্ত হবে । ততদিন একটু সবুর করো, বাবা ।' আমি স্বপ্ন দেখি, শিলঙের মামা এসেছেন, আমার জন্য একজুড়ো জুতো, খয়েরি ভেলভেটের লংপ্যাণ্ট আর জামা । আমরা ফিরে গেছি বেতছড়া, সেই পুরাণো বাড়িতে, যেখানে আমাদের উঠোনে এসে খেলা করছে হরিণশিশুরা । স্বপ্ন ভেঙে যায় মোহন পিসেমশাইয়ের চিত্‍কারে, 'বেলা হয়ে গেছে, সাহেবের ঘুম ভাঙেনি এখনও ।' ধড়ফড় করে উঠে পড়ি আমি, গরুমোষ নিয়ে বেরুতে হবে আমাকে, আর দেরি করা চলবে না । নদীর চরে এসে, একটা শিমূল গাছের নিচে বসে পড়ি, আজ আর মোষের পিঠে চাপলাম না । সকাল থেকে বিগড়ে গেছে মন, ভাবি, সব ছেড়ে পালিয়ে যাবো কি না ! মা হয়তো কাঁদবেন, একা একা, কারও কাছে বলতে পারবেন না কিছু । ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল করিনি আমি । যখন ঘুম ভাঙলো, তখন দুপুর পার হয়ে নেমে এসেছে বিকেল, নিরঞ্জনেরা এসে পড়েছে খেলতে । তাদের খেলার দিকে মন নেই আমার, কেন না, দুটি গরু আর একটি মোষের হিসাব পাচ্ছি না আর । গরুমোষ খুঁজে না পেলে, ফিরে গিয়ে মুখ দেখাবো কি করে ? সন্ধ্যে হয়ে এলো, তবু গরু দুটি আর মোষটাকে খুঁজে পেলাম না আমি


 অন্ধকার আসছে নেমে, এই অন্ধকারে, নদীর চরে, ভয় করতে লাগলো হঠাত্‍ । এই ভয়ের হাত থেকে নিস্তার নেই কোনো । তাড়াতাড়ি একটা মোষের পিঠে চড়ে বসলাম আমি । ঘরে ফিরে, গরুমোষের হিসাব মিলছে না, দেখে, ক্রোধে ফেটে পড়লেন মোহন পিসেমশাই । রাগে মুঠো করে ধরে ফেললেন আমার চুল, তারপর, এলোপাথারি চড়থাপ্পরঘুষি চালাতে লাগলেন অন্ধের মতো । মা আর থাম্পাল পিসি দৌঁড়ে এলেন পিসেমশাইয়ের চণ্ড ক্রোধ থেকে আমাকে বাঁচাতে । কে শোনে কার কথা ! হাতের সামনে তিনি পেলেন একটা কাঠের এক টুকরো, তা দিয়ে মারতে লাগলেন আমার পিঠে । প্রথম কাঠের টুকরো ভেঙে ফেললেন তিনি তাতেও ক্ষান্তি নেই তার. একটা মুলিবাঁশ দিয়ে, পুনয়ায়, শুরু করলেন পিটুনি । মার খেতে খেতে, লুটিয়ে পড়লাম উঠোনে ।


আমার নারীরা : ৪৩

December 26, 2013 at 3:33pm


নিষিদ্ধ জগতের ছায়া ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে, কোনো কাজেই মন নেই তখন । ঘটনার আকস্মিকতা আমাকে বিমূঢ় করে রেখেছিলো অনেকদিন, এড়িয়ে চলতাম লীলাবতীদিদিকে । বলা ভালো, ভয় পেতাম রীতিমতো, মনে হতো, পুনরায় খেতে আসবে আমাকে । এর মধ্যে আর এক ঘটনা ঘটে গেলো, সন্ধ্যের আগে, চর থেকে ফিরছি, গরুমোষ নিয়ে, পথে, মোষের পিঠ থেকে দেখলাম, কি যেন চকচক করছে ! নেমে এসে দেখি, একটা সিকি । নতুন, উজ্জ্বল । তীব্র লোভ কোথা থেকে এলো আমার ভেতরে এই সিকি দেখে । এক পয়সা পর্যন্ত হাতে আর পড়ে না এখন । ফলে সামলাতে পারলাম না নিজেকে । 


চারদিকে তাকালাম, কেউ নেই, কেউ দেখছে না আমাকে । টুক করে, ঝুঁকে পড়ে, তুলে নিলাম ঐ সিকি । ঘরে এসে, চাপা খুশিতে টগবগ করছি । অনেকদিন পর একটা সিকি ! ভাবলাম, এটা দিয়ে কি কিনতে পারি ? বারোমজা ? লিলি বিস্কুট ? না কি আর কিছু ? মুশকিল হলো, পেঁচারডহর গ্রামে কোনো বাজার বা হাট থাক, দোকান পর্যন্ত নেই । কিনবো কোথা থেকে ? রাতে সিকির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম । পরদিন, দুপুরের দিকে, নদীর চর থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এলেন মা । চোখেমুখে প্রচণ্ড রাগ, কেন রাগ, তার কিছুই বুঝলাম না । আমার ডান কান ধরে টেনে আনছেন তিনি, যেন আমার মাথা এখনই হাঁড়িকাঠে দেওয়া হবে । ঘরে এনে, জিগ্যেস করলেন, 'কবে থেকে চুরি করা শিখলে ? এই আমি তোমাকে শিখিয়েছি ? চুরি করা ?' বলে, একটা বাঁশের টুকরো দিয়ে মারতে শুরু করলেন আমাকে । 'আমি চুরি করিনি, মা !' আমার কথা ডুবে গেলো মা'র চিত্‍কারে । চারদিকে জমে গেছে লোকজন, সকলেই দর্শক, রণচণ্ডী আমার মা'কে থামাবার নেই কেউ । 'একটা সামান্য সিকির লোভ সামলাতে যে পারে না, তার বেঁচে থাকার দরকার নেই !' আমাকে টেনে নিয়ে আমগাছের গুড়িতে একটা রশি দিয়ে বাঁধলেন মা । তার শরীর থেকে রাগ ফেটে পড়ছে তখন । তারপর একটা কোথাল এনে ভিটের পাশে ফাঁকা ধানিজমিতে গর্ত করতে লাগলেন গজ গজ করে । আমার চোখেমুখে প্রচণ্ড আতংক, কোনোদিন একটা চড় পর্যন্ত মারেননি মা, আজ তিনিই আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন ! কি কুক্ষণে ঐ সিকিটা দেখেছিলাম, দেখলাম বলে, লোভ এল কেন আমার মনে ? কোনোদিন তো এই লোভ ছিলো না আমার ভেতরে । তাহলে ? দশটা অসুরের শক্তি নিয়ে গর্ত খুঁড়ে ফেললেন মা, তারপর ঐ গর্তে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন আমাকে । 


সেখানেই থেমে রইলেন না তিনি, এবার কোদাল দিয়ে মাটি চাপা দিতে শুরু করলেন আমাকে । 'যেমন বাপ, তেমন ছেলে ! পরধনলোভী ! একটা সিকি রাস্তায় দেখেছে, তার লোভ পর্যন্ত সামলাতে পারেনি ! বড় হলে তো ডাকাত হবে । মেয়ে দেখলেই হামলে পড়বে । তার আগে, মেরে ফেলা উচিত, তোমাকে জন্ম দেবার কলংক মুছে ফেলতে হবে আমাকে ।' গজ গজ করতে মাটি চাপা দিচ্ছেন আমাকে, আর আমি, তারস্বরে, চিত্‍কার করছি, বাঁচাও, বাঁচাও ! কে বাঁচাবে আমাকে ? সকলেই নীরবদর্শক, তাদের কাছে এর চাইতে উপভোগ্য দৃশ্য নেই আর কিছু । লীলাবতীদিদি ছুটে এসে মা'র হাত থেকে কোদাল কেড়ে নিতে চাইলো, পারলো না, মা'র এক ধাক্কায় ছিটকে গেলো পড়ে । আমার গলার স্বর হয়ে এসেছে ক্ষীণ, গলা পর্যন্ত মাটি চাপা আমি । অনেক বছর পরে দেখা আনারকলি সিনেমায় আনারকলিকেও এভাবে চাপা দেওয়া হয়নি মাটি । আর একটু পরেই, সম্পূর্ণ মাটি চাপা হয়ে মরে যাবো আমি, এই পৃথিবীর, আলো অন্ধকার, দেখবো না কিছুই । থুতনি পর্যন্ত মাটি যখন পড়ে গেছে, দেখলাম, স্কুলের হেডমাস্টারকে নিয়ে নিরঞ্জন দৌঁড়ে আসছে এদিকে । তড়িঘড়ি করে, হেডমাস্টার কোদাল কেড়ে নিলেন মার হাত থেকে, তারপর, সরিয়ে দিলেন মাকে । মাটি সরিয়ে তুলে আনলেন আমাকে । আর মাকে বললেন, 'আপনি মা, না, পিশাচিনী ? পিশাচিনীরও তো সন্তানস্নেহ আছে, আপনার তো তাও নেই ! ছিঃ !'


আমার নারীরা : ৪৪

December 27, 2013 at 10:14am


হেডমাস্টারের নাম ভবতোষ ভট্টাচার্য । ছোটখাটো, রোগাপাতলা, শ্যামবর্ণ এই মানুষটির ভেতরে ছিলো প্রচণ্ড তেজ । তাঁকে প্রথম দেখি স্কুলে । নদীর চর থেকে, গরুমোষ রেখে, একদিন ছুটে গিয়েছিলাম স্কুলে । রোজ ছেলেমেয়েদের দেখতাম, স্কুলে যাচ্ছে হাসতে হাসতে, ভীষণ কষ্ট হতো আমার, ইর্ষা করতাম ঐ ছেলেমেয়েদের । আর থাকতে না পেরে, ছুটে যাই, ঐ স্কুলে । শেষ হয়ে গেছে প্রার্থনাকাল, ফার্স্ট পিরিয়ড শুরু হয়েছে মাত্র, গেট ঠেলে, যখন ঢুকছি. একটা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি । 'কি চাই ?' আমি তখনও হাঁফাচ্ছিলাম দৌঁড়ে আসার কারণে, ঐ প্রশ্নের সামনে পড়ে, থতমত খেয়ে, দাঁড়িয়ে পড়ি । 'কাউকে দরকার বুঝি ?' তাঁর এই কথার পর, একটু যেন সাহস পেলাম, বললাম, 'আমি স্কুলে পড়তে চাই ।'


পড়বে ? 'তা, এই গামছা পরেই ?' তখনই, খেয়াল হলো, নদীর চর থেকে সোজা চলে এসেছি আমি, গামছা পরে, খালি গা, লজ্জায় মুখ নামালাম মাটির দিকে । 'তোমাকে তো আগে দেখিনি, কার বাড়িতে থাকো তুমি ?' পুনরায় জিগ্যেস করলেন তিনি । 'মোহনপিসেমশাইয়ের বাড়িতে ।' আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর । 'অ ! তা তোমার কে কে আছে ?' 'মা । আমার কেবল মা আছে । আর কেউ নেই ।' 'বাবা ?' মিথ্যে বললাম, 'আমার কোনো বাবা নেই !' তিনি চুপ হয়ে গেলেন, তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে । অনেকক্ষণ । তারপর, বললেন, 'ঠিক আছে । এখন যাও । তোমার মা'কে নিয়ে একদিন স্কুলে এসো ।' মাকে নিয়ে স্কুলে আর যেতে পারিনি, রাজি হননি মা, বললেন, 'পরের বাড়িতে থাকি । তোমাকে পড়াতে চাইলে তারা দেবেন কেন ? দেখছো না, কাজ না করলে, থাকতে দেবে না, বলেছে তারা ?' মা'র গলায় যেন বিষাদের সুর । সেই ঘটনার পর আজ তিনি আমার পরিত্রাতা, সাক্ষাত্‍ যমলোক থেকে আমাকে এনেছেন ফিরিয়ে । 


আমার গা থেকে মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে মোহনপিসেকে বললেন, 'আপনার লজ্জা করে না এমন একটা ছেলেকে চাকর বানিয়ে রেখেছেন, তাকে স্কুলে না পাঠিয়ে ?' 'আপনার শখ থাকলে আপনিই জিম্মা নিয়ে পড়ান । আমার অত শখ নেই ।' মোহনপিসের ক্রুদ্ধ জবাব । 'একে রাখতে গিয়ে কত গচ্চা যাচ্ছে, সে হিসেব তো জানা নেই আপনার । তার উপর আস্ত একটা চোর ।' 'আমি চুরি করিনি । ঐ সিকিটা পথে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ।' তীব্র প্রতিবাদ করি আমি । সব শেষে, মা বললেন, 'মাস্টরবাবু, আমার ছেলেকে আপনি নিয়ে যান, তাকে পড়ান, মানুষ করুন ।' হেডমাস্টার বললেন, 'ঠিক আছে, এই ছেলের দায়িত্ব আমার । আমি একে নিয়ে যাচ্ছি ।'


আমার নারীরা : ৪৫

December 28, 2013 at 9:14am


হেডমাস্টারের সঙ্গে চলে এলাম ঐ বড়বাড়িতে । কেন যে এই বাড়ির নাম বড়বাড়ি, তা জানি না, তবে, সামনে একটা বড় পুকুর, যার জল গাভীর চোথের মত কালো, ঐ জল দেখলেই ছমছম করে গা । চারদিকে সুপুরিগাছ, আর ফাঁকে ফাঁকে নারকেল গাছ । পশ্চিমদিকে, ঠিক মাঝখানে, একটা বড়ঘাট । আমাকে এনে হেডস্যার জলে নামিয়ে দিলেন, হাতে ধরিয়ে দিলেন হামাম সাবান আর একটা জলগামছা । আহা ! কতদিন পর সাবানের গন্ধ ! বেতছড়ায় আমাদের বাড়িতে আসতো জয় সাবান । তার গন্ধ আর একরকম । থাম্পালপিসিদের ঘরে সাবান জুটতো না, মা আমাকে ধানের খের বা খড় পুড়িয়ে ছাই করে, সে ছাই দিতেন । ঐ ছাই ভেজা শরীরে মেখে, তার পর, গামছা দিয়ে ঘষতে হয়, ময়লা আর শরীরে থাকে না তখন । জলে নামতে ভয় পাচ্ছি, দেখে, হেডমাস্টার বললেন, 'সাঁতার শেখোনি ?' মাথা নাড়লাম আমি । ঘাটের উপরে, নিরঞ্জন আর তার দিদি জয়ন্তী সহ খুড়তুতো বোনরা এই দৃশ্য দেখে হাসছে । হেডস্যার, নিজে, নেমে এলেন জলে, স্নান করালেন আমাকে । ভাত খেলাম নিরঞ্জনদের সঙ্গে প্রাণ ভরে । লক্ষ্য করলাম, বাঙালীদের প্রতিটি রান্নাই মনিপুরীদের থেকে আলাদা । 


মনিপুরীরা রসুনপেঁয়াজ খায় না, ডালে ফোঁড়ন হিসেবে দেয় নেন্নাম পাতা, তেল খুব কম খায় । তাদের খাবারে মশলা নেই বললেই চলে । এই বাড়িতে মকা মাছ মানে মৌরলা রান্না করেছে পেঁয়াজ দিয়ে চচ্চড়ি । মনিপুরীরা মকা মাছ রাঁধতো নির্ঘাত্‍ টম্যাটো দিয়ে, অথবা কচি আদাপাতা দিয়ে । এই দুটো রান্না আমার খুব প্রিয় । এ বাড়িতে চচ্চড়িটাও অন্যস্বাদের, ঝাঁঝালো, রসনা চমকে দেয় । প্রথমেই গরম ভাতের সঙ্গে দিলো কাঁচালংকা ঘি । ঘি খাবার প্রচলন বেতছড়ার বাড়িতে ছিলো না বললেই চলে, তবে মাঝে মাঝে খাইনি, তা নয়, খেয়েছি । বেগুন ভাজা, ডাল, একটা নিরামিষ তরকারি, মকামাছের চচ্চড়ি আর বোয়াল মাছের ঝোল । এত পদ একসঙ্গে কোনো মনিপুরী বাড়িতে হয় না, তবে তিন পদ থাকেই । ডালে নেন্নাম ছিলো না, বলে, একটু অসুবিধে যে হয়নি, তা বলবো না । নেন্নাম আমার ভীষণ প্রিয় । এটা পেঁয়াজের বিকল্প, রসুন পাতার মত দেখতে অথচ রসুন পাতা নয় । সেদিন বিকেলে হেডস্যার ডলুগাঁও বাজার থেকে কিনে এনে দিলেন দু জোড়া জামাপ্যাণ্ট, ঘরে পড়ার জন্য দুটো প্যাণ্ট, ইজের বলা হয় একে, ফিতে বেঁধে পরতে হয় এই ইজের আর সঙ্গে গেঞ্জি ।


আমার নারীরা : ৪৬

December 29, 2013 at 12:01am


পেঁচারডহর স্কুলে ভর্তি হলাম ক্লাস থ্রিতে । আমার এই আনন্দ দেখে কে ? রবিবার, মাকে খবরটা দিতে থাম্পাল পিসিদের ঘরে গেলাম, ঘরে কেউ নেই, একা, লীলাবতীদিদিই আছে । 'তুমি স্কুলে ভর্তি হয়েছো, বলে, শুনলাম । জানো, আমি খুব খুশি হয়েছি ।' আমাকে জড়িয়ে ধরে, বুকের কাছে আমার মাথা টেনে নিয়ে, আদর করতে লাগলো সে । লীলাবতীদিদির হাত থেকে বাঁচার জন্য বললাম, 'আমি যাই, মা এলে আবার আসবো ।' 'এত তাড়াতাড়ি তোমাকে যেতে দিলে তো ?' বলে, আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো ঘরের ভেতর । আমার ভয় করতে লাগলো এবার ।


সেই অন্ধকার, সেই বিছানায়, আমাকে জড়িয়ে ধরে, সরাসরি, শুয়ে পড়লো লীলাবতীদিদি, তারপর, চোখে মুখে ঘাড়ে চূমু খেতে লাগলো সে । প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছিলো, অথচ ভালোও লাগছিলো বেশ । এক দোটানার মধ্যে যখন ভেসে যাচ্ছিলাম, আমার জামাপ্যাণ্ট খুলে দিয়ে, অবাক কাণ্ড, লীলাবতী দিদি মুখে পুড়ে নিলো আমার নুংকু । আর আমার ডানহাত নিয়ে রাখলো তার দুই ঊরুর মাঝখানে । গরম থৈ থৈ জল । এ আমার কি হচ্ছে ? লীলাবতীদিদি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে ? এক ঘোরের ভেতর দিয়ে, আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, টের পেলাম, আমি যেন হয়ে গেছি এক ঢেঁকি, পাড় দিয়ে চলছি অনেকক্ষণ ধরে । লোপ পেয়ে যাচ্ছে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি, মনে হলো, এর চাইতে আর কোনো সুখ নেই আর । 


কতক্ষণ ঢেঁকি পাড় দিয়েছি, জানি না, হঠাত্‍ লক্ষ্য করলাম, আমি তার একটা বুক মুখে পুরে শুয়ে আছি লীলাবতীদিদির উপর । আমার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে পরম মমতায় । এই যাতায়াত ক্রমে বেড়ে যেতে লাগলো লীলাবতীদিদির আকর্ষণে । এরই মধ্যে, একদিন, থাম্পাল পিসিদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন মা । আমাকে বললেন, 'মন দিয়ে পড়াশোনা করো । যদি সুযোগ করতে পারি, তোমাকে নিয়ে যাবো ।' আমি থেকে গেলাম হেডমাস্টারের সঙ্গে । সন্ধ্যেবেলা আমাকে পড়ান তিনি, মূলত অংক আর ইংরাজি । আর ফাঁকে ফাঁকে লীলাবতীদিদির টানে, তার দেওয়া সময়ে ছুটে যাই ও বাড়িতে । 


এই যাতায়াতের পথে, একদিন, দেখা হলো থাম্পালপিসির সঙ্গে । আমাকে বললেন, 'ছিঃ ! তোমার লজ্জা করে না ? মনিপুরী হয়ে বাঙালী বাড়িতে থাকো, খাও ? জানো না, তোমার তো জাত চলে গেছে । এ বাড়িতে আর আসবে না । এলেও উঠোন থেকে মাংকলে আর উঠবে না কখনও । মনে থাকবে ?' আমার ভীষণ কান্না পেলো হঠাত্‍ । জাত চলে যাওয়া মনিপুরীদের খুব সহজ ব্যাপার, অমনিপুরী কোনো বাড়িতে ভাত খেলেই জাত আর থাকে না । সে এক ভয়ানক ব্যাপার । জাতিচ্যুতকে এই সমাজে কেউ ভালো চোখে দেখে না । থাম্পালপিসির কথায় ভয় পেলাম আমি । জাত চলে গেলে আমি কি করবো ? তাড়াতাড়ি, চলে এলাম হেডমাস্টারের ঘরে । কি করবো তাহলে ? চলে যাবো এই আশ্রয় ছেড়ে ? কোথায় যাবো তাহলে ? কোথায় যেতে পারি এখন ? কথাটা হেডমাস্টারের কাছে কি করে বলি ? যদি তিনি খারাপ পান, যদি তিনি আমাকে তিরস্কার করেন, তাহলে ? আমার পড়াশোনা, আনন্দ সব কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ! না, যা হবার হয়েছে, আগে জাত বাঁচাতে হবে আমার । একদিন, চুপি চুপি, কাউকে না বলে, হেডমাস্টারের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম আমি ।


আমার নারীরা : ৪৭

December 29, 2013 at 8:27pm


পেঁচারডহরে আমার আপন পিসি থাকতেন, তার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না তখন । ঐ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি, পথে, দেখা হলো, ঐ পিসেমশাইয়ের সঙ্গে। পরিচয় দিলেন তিনি নিজেই, বললেন, 'কোথায় যাচ্ছো ?' আমি কোনো কথা না বলে, মাথা নিচু করে, চুপ করে থাকলাম । 'পালাচ্ছো বুঝি ? ভালো করেছো । বেজাতের হাতে ভাত খেয়ে, তাদের সঙ্গে ঘর করে, জাত খুইয়েছো এর মধ্যে । এবার যদি ছেড়ে যেতে পারো, নিজে বাঁচবে, আমাদেরও বাঁচাবে !' নদী পার হয়ে, চলে এলাম আমাদের গ্রামে । এই প্রথম, একা একা, বিড়ালের বাচ্চার মত, পথ খুঁজে খুঁজে, চলে আসতে পারলাম । ভয় করছিলো খুব । মাঝি টাকা নিলো না, বরং বললো, 'চলো, আমাদের ঘরে যাই, বৌদি সেখানেই আছেন ।' অবাক হলাম, মা তাদের বাড়িতে আছেন, জেনে । পথে, তিনিই জানালেন, আজ পরগণার বিচার । 


'প্রফুল্লমাস্টার তোমাদের কী করে থাকার জায়গা দেয় না দেখবো আমরা ।' তার মানে, এখানে এসে মা লড়াই করছেন আমাদের অধিকার নিয়ে ! বিচারে যে কি হবে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম, মাঝিকাকার ঘরে । মা নেই, কিন্তু যাকে দেখলাম, তাতে চমকে গেলাম । মামা ! শিলঙ থেকে চলে এসেছেন মামা । ও মা, দিদিমাও এলেন ঘর থেকে বেরিয়ে । কবে এলেন তারা ? না এলে, জানতেই পারতাম না আমি । আমাকে জড়িয়ে ধরলেন দিদিমা, আর, কাঁদতে লাগলেন হাউমাউ করে । মনিপুরী মহিলাদের একটাই সম্বল, এই কান্না, তারা খুশিতেও কাঁদে. দুঃখেও কাঁদে । বিচারস্থলে যাবার ইচ্ছে ছিলো খুব, অনেক কথা বলার ছিলো আমার, এই কয়েকমাসে, বাবার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমে গেছে, আর আমিও বড় হয়ে গেছি যেন । বিচারপর্ব শেষ হতে তিনদিন লাগলো, এবং বাবা বাধ্য হলেন, আমাদের থাকার একটা জায়গা দিতে ।


তাতেই খুশি মা । বিচার শেষ হতেই, পাড়ার ছেলেরা, সোনাদাদুর বড়ছেলের নেতৃত্বে, যাকে আমরা খলইখুড়া বলে ডাকতাম, ছেলেরা সবাই মিলে, দুপুর থেকে, বাবাদের বাড়ির উঠোনের উত্তর দিকে, বানাতে লাগলেন ঘর । কেউ আনলেন বাঁশ, কেউ ছন । তাদের দেখে মনে হচ্ছিলো, পিকনিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন । রাতারাতি ঘর হয়ে গেলো, দুচালা ঘর, যার বেড়া দেওয়া হলো পাটকাঠি দিয়ে । মা মাটি দিয়ে বেড়াগুলি লেপতে লাগলেন । দরজাটিও আজব, বাঁশের দরজা । শেষ পর্যন্ত, আমাদের গৃহপ্রবেশ হলো সেই সন্ধ্যাতেই । 


চৌকি নেই, বলে, গৃহনির্মাণকারীরা তৈরি করে দিলেন মাচান । তিনচারটে কাঁথা দিলেন মা'র এক ননদ, কাকা দিলেন এলোমিনিয়ামের হাড়ি আর লোহার কড়াই, মামা কিনে আনলেন তিনটে থালা ও গেলাস । ছেলেরা মাকে ধরলো, তাদের খাওয়াতে হবে, এবং তা আজই । সোনাদাদু চালডাল দিলেন । মা রাঁধলেন আজব এক রান্না, মেকাভাত । ঝাউ ভাত এর চাইতে আরও ঝাউ, অনেকটা পায়েসের মতো, পায়েসে দুধ-চিনি থাকে, এটাতে কেবল নুন । কলাপাতা পেতে উঠোনে, সেই রাতে, কুপির আলোয়, মেকা ভাতের পিকনিক হলো আমাদের, যে পিকনিকে কাকা ও মামাও অংশগ্রহণ করলেন । হ্যাঁ, আমার বড়দাও যাবতীয় অনুশাসন ডিঙিয়ে এই পিকনিক খেতে পাতে বসে গেলো । সে রাতের ঐ অপার্থিব পিকনিক আমার সমগ্র জীবনের সেরা পিকনিক, অধিকার ছিনিয়ে আনার আনন্দ যে মিশে গিয়েছিলো এতে । আর বাবাদের ঘরের দরজা একবারের জন্যও খোলেনি সে রাতে ।


আমার নারীরা : ৪৮

December 30, 2013 at 4:42am


নতুন করে পথ শুরু হলো আমাদের, যে পথ মসৃণ ছিলো না কোনোরকমেই, কেন না, কোনোরকম মাসোহারা দিতেন না বাবা । তা ছাড়া, তিনি বদলী হয়ে গেলেন অমরপুরের তৈদুবাড়ি । ফলে, মাকে, দেখতাম, কাজ খুঁজতে হতো প্রায় সময়, কারও বাড়িতে ধান কুটে দেওয়া, কারও জমিতে ধান রুয়ানো, এসব করে কায়ক্লেশে, আমাদের দিন চলতে লাগলো । ঘরে, একা, থাকতাম আমি, কেউ মিশতে চাইতো না আমার সঙ্গে । আমার তখন সময় কাটতো শিবের থানে গিয়ে, গাছগাছালির সঙ্গে কথা বলে, কোনো কোনোদিন, কথা বলতাম নদীর সঙ্গে । নদীতে একা নামতে ভয় পেতাম, সাঁতার শিখিনি তখনও, আমি শুধু পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে দিয়ে পা নাচাতাম, আর ঢেউ এসে ঝাপট মারতো আমাকে । এ এক আশ্চর্য খেলা ছিল নদীর সঙ্গে । সারাদিন খাবার জুটতো না, রাতে ঐ মেকাভাত, কখনও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, জুটতো সিদল পোড়া, তার মানে পালটে । 


এক একদিন, নদী থেকে মা ধরে আনতেন কুচো চিংড়ি, সেদিন আমাদের ঘরে উত্‍সব । চলে আসতো খলই খুড়া, পাকুতিদাদা, মনিকাকা, মা'র হাতে খেতে । ক্রমে এই উত্‍সবে অংশগ্রহণকারী লোকের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগলো, মা'র খুশি তাতেই । এই উত্‍সব বাবাদের কারও পছন্দের ছিলো না, তবু মুখ ফুটে বলার সাহস ছিলো না কারও । কাকার নীরব সমর্থনও, মনে হয়, ছিলো আমাদের প্রতি । একদিন, ঘুরতে ঘুরতে, আমাদের পাশের চাবাগানে গিয়ে, উপস্থিত আমি । সোনামুখী চাবাগানের তখন যৌবনকাল । অবাক হয়ে, দূর থেকে দেখলাম চাবাগানের কলঘর, সেখান থেকে ধেয়ে আসছে আশ্চর্য এক গন্ধ । এই চাবাগানের পাশেই কাউলিকুড়া প্রাইমারী স্কুল ।


চাবাগানে পরিচয় হলো আমার বয়সী এক ছেলের সঙ্গে, কালো, অথচ ভীষণ সুন্দর । খুব সম্ভবত, তার নাম ছিলো অজিত, মুণ্ডা হলেও বাংলা বলতো সুন্দর । এই পরিচয়সূত্রে, মাঝে মাঝেই চলে যেতাম লেবারবস্তিতে । দেখতাম, লেবারদেরও শ্রেণীবিভাগ আছে, একদলের জন্য বাগান কতৃপক্ষ তৈরি করে দিতেন পায়রার খোপের মত ঘর, আর একদল থাকতো জমিজমা নিয়ে । অজিতের বাবা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর । দিন কাটছিলো এভাবেই, বিনা কাজে, বিনাস্কুলে । আশ্বিন মাসের প্রথমদিকে, একদিন, ঘরে বাবা নেই, তিনি আছেন তৈদুবাড়িতেই, কাকা ডেকে আনালেন গণক রমেশ আচার্যকে, যার ছেলে অমর আচার্য, পরে, আমার ক্লাসমেট হয়ে গিয়েছিলো । এলেন পুরোহিত ঠাকুর । তাদের সঙ্গে কথা বলে, দুর্গাপূজার ব্যবস্থা শুরু করেদিলেন । দুগাপূজা দেখিনি কখনও, এইবার দেখবো । বাবাদের বাড়ির এই পূজা দীর্ঘদিকয়েক বছর ধরে হয়ে আসছে, ঠাকুরদার বাবার আমল থেকে । রোজ গণকঠাকুরের পাশে গিয়ে দেখতাম, প্রতিমা নির্মাণ প্রণালী, খড় থেকে মাটি, মাটি থেকে রঙ ও চক্ষুদান ।


আমার নারীরা : ৪৯

December 30, 2013 at 11:29pm


পূজা এলো শেষপর্যন্ত । ষষ্ঠীর রাত থেকে ধুন্ধুমার কাণ্ড, পাড়ার লোকজন প্যাণ্ডেল বানানো থেকে সকল কাজে ব্যস্ত । কে কার কথা শোনে ! এসময় শত্রুতা বা মিত্রতা বলে কিছু থাকে না, সকলেই সমান । প্রতিরাতে কি কি অনুষ্ঠান হবে, ঠিক হয়ে গেলো তাও, তবে চাবাগানের অনুষ্ঠানসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে । চাবাগানের দুর্গাপূজার মজা আলাদা, সেখানে প্রতিরাতে যাত্রাপালা হবে রাত দশটা থেকে । ফলে, নৌকাবিলাস, শ্রীরাধার মানভঞ্জন বা রামলীলা এ বাড়িতে হবে বিকেল থেকে । সপ্তমীর দিন সকাল থেকে আসতে শুরু করলো লোকজন । মনিপুরীদের দুর্গাপূজায় অন্যরা এসে ঘট পূজা করতে পারে একই সাথে । এটা, বোধহয়, কৌমসমাজের লক্ষণ, মনিপুরী সমাজকাঠামো তৈরি হয়েছে এভাবেই । ফলে, প্রায় ষাটটা ঘট বসলো মূল পূজার সঙ্গে, এতে সুবিধা হলো বাবাদের, কেন না, যারাই ঘট বসিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই সঙ্গে এনেছেন সিধে, যা ভোগে লাগবে । 


চাল, ডাল, সবজি, কলা, নারকেল থেকে শুরু করে তেলমশলা, সব থাকে এই সিধেতে । দুপুরে বান্দারা বা ভাণ্ডারা খেতে বসলেন প্রায় তিনশজন লোক । এবং অতি অবশ্যই আমরা । এই বান্দারা রান্না করলেন মূল পুরোহিতের ঘরের লোকরা । আহা ! কতদিন পর ভালোমন্দ কিছু খেতে পারলাম আমরা ! প্রথমদিন ছিলো নৌকাবিলাস, দর্শক ঐ তিনশজন লোক, পালা দেখতে দেখতে কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন দর্শকলা । পালা শেষ হতে হতে পার হয়ে গেলো সন্ধ্যে । তারপর আরতি । ভারি সুন্দর এই আরতি । যুবকযুবতীরা মিলে করে এই আরতি, গান সহ, সে সময় পূজা করেন পুরোহিত । আমার মন সেদিকে নেই, কখন যাত্রা দেখতে যাবো, ছটফট করছি তার জন্য । প্রসাদ খেয়েই সোজা ছুট লাগাই চাবাগানের দিকে । সেবার যাত্রাপালা ছিলো অভিমন্যুবধ, বড় হয়ে, এই পালাতেই অভিনয় করেছি আমি নিজেই, অভিমন্যু সেজে । করুণ ও বীররসের পালাটির প্রতিও থেকে গেছে দুর্বলতা । 


দুঃখের বিষয়, শেষপর্যন্ত পুরো দেখতে পারিনি আমি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । তিনদিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো, বুঝতে পারিনি । যেটা হলো, পেঁচারডহরে আমার যে আপন পিসি থাকতো, তার মেয়েদের সঙ্গে পরিচয়, যার একজন, রেণুকা, আমার ছোটো, হয়ে উঠলো আমার নেওটা । দশমীর সকালে বিদায়ের পালা, বিসর্জনের পালাও । বিসর্জনের আগে পুনরায় আরতি, তারপর, ঐ ঘটগুলির সব নারকেল পুরোহিত ভাগ করেদিলেন যুবকযুবতীদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা স্বেচ্ছাসেবী বা সেবারির দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন, এটাই রীতি । নিজের জন্য তেমন কিছুই রাখলেন না পুরোহিত । রেণুকা তারা চলে যাবে, শুনে, বিষণ্ণ হয়ে গেলো আমার মন । মা-কে বললাম, 'ওকে যেতে দিও না । আর একটা দিন থেকে যেতে বলো তাদের ।' মা হাসলেন, কোনো কথা বললেন না । তারপর কি করলেন, জানি না. রেণুকা, একা, থেকে গেলো আমাদের ঘরে । আমার খুশি তখন কে দেখে আর ?


আমার নারীরা : ৫০

December 31, 2013 at 10:14pm


পূজা চলে যাবার পর, একদিন, কি মনে হলো, জানি না, দুপুরের দিকে, চাবাগানের স্কুলে গিয়ে দেখা করলাম হেডমাস্টারের সঙ্গে । তিনি মনিপুরী, ফলে, আমাদের ভাষায়, তাঁকে বোঝাতে অসুবিধে হলো না, যে, আমি পড়তে চাই । তিনি নিমরাজি হয়েও বললেন, 'ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ব্যতীত ভর্তি করাতে পারবো না তোমাকে । তবে, এনুয়্যাল পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেবো । তাতে পাশ করতে পারলে, ক্লাস ফোর-এ ভর্তি করাবো তোমাকে । এখন থেকে রোজ এসে ক্লাস করো । এ সুয়োগও দেবো তোমাকে ।' হাতে চাঁদ পেলাম যেন আমি, হেডমাস্টারের শর্তে রাজি হয়ে গেলাম । বইখাতা নেই, খালি হাতেই, যেতে শুরু করলাম স্কুলে । ক্লাসে, আমাকে বসতে দেওয়া হলো মেয়েদের সঙ্গে, কেন না, কোনো ছেলেই আমাকে তার পাশে বসতে দিতে রাজি হচ্ছিলো না । 


একটি মেয়ে, সন্ধ্যা রায়, পুতুলের মতো সুন্দর, আমার দিদিদের বয়সী হবে, বসতে দিলো তার পাশে । সকল অপমান হজম করা শিখে গেছি তার আগে, কোনো আপত্তি না জানিয়ে, একমাস, ক্লাস করলাম এভাবে । সন্ধ্যা খুব সহৃদয়া, আমাকে তার বই খাতা ব্যবহার করতে দিতো । একমাস পর পরীক্ষা এলো চলে । মা'কে পরীক্ষার ফি চার আনা দেবার কথা বললাম । মা'র মাথায় বাজ পড়লো যেন । চার আনা তখন অনেকখানি । তিন থেকে চারসের দুধ পাওয়া যায় এই চার আনায় । কোনো উপায় না পেয়ে, তার কানের ঝুমকা বিক্রি করে দিলেন পাঁচটাকায় । এতে লাভ হলো এটাই, আমার পরীক্ষার ফি দিয়ে, বাদ বাকি টাকা দিয়ে ধান কিনে. তা সেদ্ধ করে, কুটে, চাবাগানের লেবারদের কাছে চাল বিক্রির ব্যবসা শুরু করলেন তিনি । ফলে, অপরের ঘরে বা ক্ষেতে গিয়ে কাজ করার প্রয়োজন রইলো না আর ।


আমিও পরীক্ষা দিলাম ভালো করে । রেজাল্ট যখন বেরুলো, দেখা গেলো, একশো তে একশো না পেলেও, ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি আমি । হেডমাস্টার ভীষণ খুশি হয়ে আমাকে কিনে দিলেন জামাপ্যাণ্ট, ভর্তিও হয়ে গেলাম ক্লাস ফোরে । এখন আর সন্ধ্যার সঙ্গে বসতে হয় না আমার, বরং আমার জন্য ছেলেরা ফার্স্টবেঞ্চ খালি করে রাখে, প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে বসবে আমার সঙ্গে । আমার বইপত্র কিনে দিলেন একজন শিক্ষক, আমি মন দিলাম পড়াশোনায় । স্কুলে আসার সময়, ঘরে থাকতেন না মা, ধান সংগ্রহ করতে ব্যস্ত থাকতেন তিনি, ফলে, বেশির ভাগ দিনই, পান্তাভাত খেয়ে আসতাম স্কুলে । 


কোনো কোনোদিন ঘরে পান্তাভাতও থাকতো না, সেদিন না খেয়েই আসতাম স্কুলে । এরকম একদিন, খিদেয় শরীর কাঁপছিলো আমার, দীনেশ, আমার ক্লাসমেট, বললো, চলো, গরুর ডাক্তারের ঘরে খেয়ে নিই ভাত । স্কুলের পাশেই ছিলো, ঐ গরুর ডাক্তারের কোয়ার্টার ও অফিস, বাঙালী নন তিনি, দেববর্মা, আগরতলার আশেপাশে কোনো এক গ্রামে তার বাড়ি । তিনি একটা থালায় করে ভাত আর তরকারি দিলেন এনে । ক্ষিধের পেটে, সেই খাবার ছিলো অমৃত ।


 তরকারি মুখে দিয়েই থমকে গেলাম, এই রান্না আমাদের ঘরে হয়নি কখনও । দীনেশ বললো, খেয়ে নাও, এটা শুয়োরের মাংস । শুয়োর যে কি, তখনও জানি না আমি, প্রথমে, একটু অস্বস্তি হলেও, পরে সবটাই খেলাম । অতি উপাদেয়, মনে হলো, মনিপুরীরা এই অসাধারণ খাবার থেকে অযথা বঞ্চিত তাদের জাত্যাভিমান ও সংস্কারজনিত কারণে । বিকেলে, ঘরে ফিরলাম স্কুল থেকে । দেখি, আরাংয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কাকা, হাতে একটা বাঁশের লাঠি । বললেন, 'তুমি না কি মাংস খেয়েছো আজ ?' কি উত্তর দেবো আমি ? কাকা কি করে এই খবর পেলেন আমি ফেরার আগে ? কে এসে কাকাকে এই খবর দিলো ? এবার তিনি গর্জে উঠলেন, ছিঃ ছিঃ ! মনিপুরী হয়ে মাংস খেয়ে এসেছে ! বলে, কয়েক ঘা মারলেন আমার পিঠে । টু শব্দ করছি না আমি, চারপাশে জমে গেলো লোক এই তামাশা দেখতে । 


আমাকে মারতে মারতে বাঁশের ঐ লাঠিটাই ভেঙে ফেললেন কাকা, কান্না নয়, আমার ভেতরে তখন এক অসুরের ক্রোধ । তারপর, পুরুত ডেকে, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে ঢুকতে দিলেন বাড়ির চৌহদ্দিতে । সন্ধ্যের পর তলবের বাজার থেকে, ফিরে এসে, সমস্ত ঘটনা জানলেন মা । রাতে আমার পিঠে মালিশ করে দিতে দিতে মা বললেন, 'কি দরকার ছিলো ঐ সব ছাইপাশ খাবার ? জানো না, মনিপুরীদের সমাজে এসব অচল ?' কোনো জবাব দিলাম না আমি । পরদিন রবিবার. স্কুল ছুটি । সোমবার, স্কুলে গিয়েই আমার ক্লাসমেটদের জিগ্যেস করলাম, কারও বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে কি না । ব্রজেন্দ্র জানালো, তাদের ঘরে পাঁঠার মাংস হয়েছে । 


বিকেলে, তাদের ঘরে গিয়ে, পেট ভরে, পাঁঠার মাংস খেয়ে, ফিরে এলাম ঘরে । রাস্তা থেকে, পাড়া কাঁপিয়ে, চিত্‍কার করে বলে উঠলাম, কাকা, লাঠি নিয়ে এসো, আজ আমি পাঁঠার মাংস খেয়ে এসেছি । আর বামুন ডাকো, আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করাবে । আমার এই চিত্‍কারে বেরিয়ে এলো পাড়ার লোকজন, কাকা কাকীমা, বড়দা, সত্‍মা, আমার মা, সোনাদাদু সহ আরও অনেকে । কারও মুখে কোনো কথা নেই, মাথা উঁচু করে আমাদের পাটকাঠির ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি ।


আমার নারীরা : ৫১

January 1, 2014 at 3:53pm


বছরের প্রথম দিকেই আমার সমগ্র শরীরে দেখা দিলো লুকলুকি ফলের মতো গোটা । সেগুলির চিকিত্‍সা হলো বটে কবিরাজী আর হোমিও মতে, সুস্থও হয়ে উঠলাম বেশ, শরীর থেকে দাগ মুছে যেতে না যেতে আমি পডলাম কঠিন অসুখে । সে অসুখের নাম বলতে পারছেন না কেউ, কবিরাজ ফেল মারলেন, হোমিওপ্যাথ বিমূঢ় হয়ে বললেন, 'শহরে, হাসপাতালে নিতে হবে ।' ততদিনে চলত্‍শক্তিহীন আমি, পাটকাঠির মত হাত পা, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না । অসহায় মা আমাকে নিয়ে গেলেন কৈলাসহর হাসপাতালে, তিনদিন রেখে, তারাও বিদায় দিলেন আমাকে । বললেন, 'এখানে এই চিকিত্‍সা সম্ভব নয় ।' কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন মা । আমার অবস্থা কাহিল বললে খুব কম বলা হবে, বলা উচিত, মরণোন্মুখ প্রাণ নিয়ে টিকে আছি । 


সবাই জেনে গেছে, এই ছেলেটা ব্রহ্মপাপের ফল ভুগছে, মাংসভক্ষণ ব্রহ্মপাপের সমান । আরও কত পাপ করেছে, কে জানে ? পাপ কথাটির ছায়া আমাকেও গ্রাস করে নিচ্ছে ক্রমশ, লীলাবতী দিদির সঙ্গে শরীরের ঐ খেলা তো মহাপাপ, আমি সেই মহাপাপ করেছি । এই মহাপাপ তো লীলাবতীদিদির, সে আমাকে ঐ গোপন সুড়ঙ্গের পথে টেনে না নিলে, এই পাপ তো আমি করতাম না ! শয্যাশায়ী আমাকে ফেলে কাজে যেতেও পারছেন মা । মৃত্যুর ছায়ায় আচ্ছন্ন এই ঘরে, একদিন, গ্রামে, সিলেট থেকে এলেন আমাদের দূর সম্পর্কের এক মামা । ভদ্রমামা । তিনি না কি মন্ত্র জানেন, তন্ত্রসিদ্ধ । মা তাকে ডেকে নিয়ে আনলেন আমাকে দেখাতে । ভালো করে দেখে, তিনি চুপ হয়ে রইলেন অনেক্ষণ, তারপর, বললেন, 'ললিতা, এর উপর অপদেবতার ছায়া । যা না সরালে, একে বাঁচাতেও পারবে না তুমি ।' হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন মা । 'আমার ছেলেটাকে বাঁচাও, দাদা, ও ছাড়া যে এ দুনিয়াতে আমার আর কেউ নেই ।' 

ঠিক হলো, পরবর্তী অমাবস্যায় চাপাল দেবেন তিনি । চাপাল মানে অপদেবতার পূজা এবং ভোগ, তবে এটা অন্যান্য সাধারণ চাপালের মত নয় । সাধারণ যে নয়, তা টের পেলাম চাপালের দিন । মৃতদেহ যেভাবে তুলসিগাছের সামনে আস্ত এক লাতল কলাপাতার উপর রাখা হয়, আমাকেও রাখা হলো সেভাবে, তবে নগ্ন শরীরে । জ্বরে কাঁপছি ঠক ঠক করে, কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে, আমার পাশাপাশি আর একটা কলাগাছ কেটে এনে, সেই একই পদ্ধতিতে রাখা হলো । চারপাশে ভিড় করেছে গ্রামের লোকজন, এরকম চাপাল দেখেননি তারা । ইশালপা বা গায়ক, ডাকুলা বা মৃদঙ্গবাদক সহ এসেছেন পুরুতঠাকুরও । একটা কুলোয় করে তিল কলা সহ চালের গুড়ার পিণ্ড, সরষেদানা, ফুল, কলা ইত্যাদি সহ ভদ্রমামা চলে গেলেন বাড়ির চৌহদ্দির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণায়, যেখানে বরাকবাঁশের এক বিশাল ঝাড় । প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে, হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন তিনি, বললেন, 'রাগাগ অকরো ।' মানে, গান শুরী করো । সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে মৃদঙ্গ আর ইশালপা ধরলেন গান, আর ভদ্রমামা শুরু করলেন মন্ত্রপাঠ । 


আমার জ্ঞান কি লোপ পেয়ে যাচ্ছে, না কি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি আমি ? তিনি একই সঙ্গে আমার এবং কলাগাছটির গায়ে বুলিয়ে দিচ্ছেন হাত । হঠাত্‍, মনে হলো, তিনি. ফিসফিস করে, কাকে যেন বলছেন, 'চলে যা, বলছি, তোকে একমিনিট সময় দিলাম । না হলে, চিরকালের মত বন্দী করে রাখবো সরষে দানার ভেতরে ।' কথাটা কাকে বলছেন ভদ্রমামা ? কে যাবে চলে ? কোনোকিছুই ঠাহর করতে পারলাম না কোনো কিছুই, শুধু শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, 'কোথায় যাবি ? এই যে কলাগাছ, এটায় । এর প্রাণের সঙ্গে বিনিময় হবে তোমার । কি বললি ? রাজি ? তাহলে ঢুকে পড় কলাগাছের শরীরে, আর তার এক চিহ্ন রেখে দে । কি রাখবি ? কলাগাছটাকে নিচের দিকে দুমড়েমুচড়ে দে যেন ঝড়ে বিধ্বস্ত মনে হয় ।' তারপর, আর খেয়াল নেই আমার । যখন হুঁশ এলো, দেখছি, আমাকে চান করানো হচ্ছে, একই সঙ্গে কলাগাছটাকেও । চার কাঁধে যেভাবে ঠাকুমাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই দাহ করতে নিয়ে গেলো কলাগাছটাকে । আসলে, ঐ কলাগাছে চলে গেলো আমার জীবন, আর কলাগাছের জীবন নিয়ে থেকে গেলাম আমি । ভদ্রমামা, সন্ধ্যের পর, মা'কে বললেন, 'এ যাত্রা বেঁচে গেলো ছেলেটা কলাগাছের সঙ্গে প্রাণ বিনিময় করে । ললিতা, সাবধানে রেখো একে, কলাগাছের জীবন এর, মানুষের নয় ।'


আমার নারীরা : ৫২

January 2, 2014 at 2:59pm


সেরে উঠলেও, হাড় জিরজিরে হয়ে রইলাম এর পর থেকে, শরীর হয়ে উঠলো এক মস্ত বড় বোঝা । মে মাসে, সেবার, শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী মারা গেছেন, মানে চাচা নেহেরু । প্রধানমন্ত্রী শব্দটি চেনা হয়ে গেছে ততক্ষণে, যেহেতু স্কুলে আমাকেই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, আসলে তা ছাত্রদের সামলানোর কাজ । প্রেয়ারের আগে আধঘণ্টা সাফাই অভিযান চালাতে হতো যা পরিচালনা করার ভার আমার উপর । 


একদিন হেডমাস্টার বললেন, 'কাল মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহ আসছেন, তোমরা ছাত্রছাত্রীরা সবাই মিলে সংবর্ধনা দেবে ।' সংবর্ধনা যে কি বস্তু, তখনো জানি না তা । আর মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহ, জেনে, খুব খুশি আমার, তখনও জানি না, সকল সিংহই মনিপুরী নয় । ঘরে ফিরে মা'কে বললাম, তিনি আমার মতই অজ্ঞ, কে প্রধান কে মুখ্য, তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই তার, তিনি বরং খোঁজ রাখেন, সতীশ মুণ্ডার কাছ থেকে বাকি টাকা পাওয়া যাবে ঠিক কবে । ফলে, আমার অনুসন্ধিত্‍সা গেলো মাঠে মারা । পরদিন, তাড়াতাড়ি যেতে হলো স্কুলে, গেটের সামনে এক বিশাল তোড়ণ, তাতে লেখা, স্বাগত মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী । 


আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে এসেছেন প্রচুর লোকজন, আমাদেরও বলা হলো লাইন ধরে দাঁড়াতে, আমার হাতে থাকলে একটা দরখাস্ত, তাতে কি লেখা, তাও জানি না, তা তুলে দিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে । মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হলো ফুল ।


 দেখলাম, সমগ্র বিষয় সামাল দিচ্ছেন অবনী পাল, রাকেশ রায় প্রমুখরা, মনিপুরী আর চাবাগানের মজুররা আছে পেছনের সারিতে, এটা কেন, প্রশ্নটি মনে, একবার, এলেও, ভুলে গেলাম, কুমারঘাটের দিক থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় এবং পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রে এসে পড়ায়, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হলো চারপাশ । সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা, গাড়ি থেকে নামলেন মুখ্যমন্ত্রী, ধুতিপাঞ্জাবী পরিহিত, কপালে তিলক, দেখে, মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি । তাঁর হাতে তুলে দিলাম ঐ দরখাস্ত, মেয়েরা শুরু করলো পুষ্পবর্ষণ । এর ফাঁকে অবনী পাল ও রাকেশ রায় এগিয়ে কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ।তারপর, চলে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী ।আমাদের প্রত্যেকের হাতে দুটি করে তুলে দেওয়া হলো কমলা লজেন্স ।

 এখন ভাবি, রাজনৈতিক অভিসন্ধি রূপায়ণের স্বার্থে অবোধ ছাত্রদের ব্যবহার করার 'এই ট্যাডিশন' এখনও চলছে, যা অনুচিত বলে মনে হয় । মুখ্যমন্ত্রীকে ঐ দরখাস্তে কি লেখা হয়েছিল, আজও তা জানতে পারিনি আমি । এই ঘটনার পর রাকেশ রায় বা অবনী পাল নয়, এলাকায় নেতা হিসেবে উঠে এলেন কানু ভট্টাচার্য যিনি পূর্বপাকিস্তান থেকে এপারে এসেছেন বছর গড়ায়নি । মূলত তারই হাত ধরে আমাদের গ্রামে শুরু হলো অনুপ্রবেশের বাড়াবাড়ি । বাবাকে, একদিন, দেখলাম, ক্ষোভ প্রকাশ করতে, বলছেন. 'শশিকাকাদের জায়গা দিয়ে আমার বাবা যে ভুল করেছিলেন, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে ।' এক পরিবার দুই পরিবার করে পূর্বপাকিস্তান, মূলত কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার, থেকে লোক আসতে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে ।


আমার নারীরা : ৫৩

January 4, 2014 at 9:08pm


১৯৬৪ সাল থেকে ভারতের পরিস্থিতিটাই পালটে যেতে শুরু করেছিলো । কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙ্গনরেখা স্পষ্ট হয়ে যায় সে বছরই অমৃত ডাঙ্গের এক চিঠিকে কেন্দ্র করে । সিপিআই থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠিত হলো সিপিএম যাদের চিহ্নিত করা হলো চীনপন্থী বলে । সিপিআইকে বলা হলো রুশপন্থী, কংগ্রেসের লেজুর । লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী । 


নেহেরুর দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস দেখা গেলো শাস্ত্রীর কাজকর্মে । এসব কথা আমি কিছুই জানতাম না, জানার বয়স আমার হয়নি তখনও । আমি ব্যস্ত ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার সুবাদে স্কুল থেকে পাওয়া বইগুলি পড়ে শেষ করতে । যে বইটি প্রথমেই হাতে নিলাম, তা ঐ ছোটদের রামায়ণ । বিকেলে, কাকাদের ঢেঁকিতে ধান কুটছেন মা, আমি এক পাশে একটা জলচৌকির উপর বইটা মেলে পড়তে লাগলাম । রাম এর জন্মকথা থেকে তাড়কারাক্ষসীবধ, হরধনুভঙ্গ, বিবাহ পর্যন্ত টানা পড়ে গেলাম । শ্বাস ফেলতে পারছি না, কাহিনীর স্রোতে, ঐ জটিল ঘূর্ণিতে ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ । যেন আমি চলে গেছি অযোধ্যায়, ঐ ত্রেতাযুগে, যেন আমি সকল ঘটনার একমাত্র সাক্ষী । মন্থরার কূটচালের ফাঁদে পড়ে দশরথ তার প্রথম পুত্র রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার অনুষ্ঠান রদ করে, তাকে চৌদ্দ বছরের বনবাসে পাঠালেন, টের পেলাম, অযোধ্যাবাসীর সঙ্গে আমিও কাঁদছি চিত্‍কার করে । 


আমার এই হঠাত্‍ কান্না শুনে ছুটে এলেন কাকা, ধান কুটবার কাজ ফেলে এলেন আমার কাছে । 'কি হয়েছে তোমার ? কাঁদছো কেন ?' হতভম্ব কাকা এবং মা একসঙ্গে জিগ্যেস করলেন । কি উত্তর দেবো আমি, আমার কান্না থামতেই চাইছে না, চোখের জলে ছোটদের রামায়ণ যাচ্ছে ভিজে । 'কি হয়েছে ? বলছো না কেন ?' আমার দুকাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বার বার জিগ্যেস করতে লাগলেন মা । কোনো রকমে তর্জনি বাড়িয়ে আমি দেখিয়ে দিলাম রামায়ণ, আর বললাম, 'রামকে বনবাসে...' শেষ করতে পারলাম না কথাটি. হো হো করে হেসে উঠলেন কাকা । বললেন, 'বৌদি, তোমার এই ছেলে বেদ এর বাইরে গো । আমাদের সঙ্গে তার কিছুই বনবে না, দেখছি । রাম বনবাসে যাচ্ছে, তাতেই কেঁদে আকুল ছেলেটা ! ঢং এর আর জায়গা পায়নি ।' বেদ মানে নিয়ম, এর বাইরে থেকে যাওয়ার অর্থই হলো নিয়মাতীত আমি । 


কাকার ঐ শ্লেষ বোঝার সামর্থ আমার তখন ছিলো না, মার কথা বলে লাভ নেই, তিনি পড়াশোনার বাইরে । কাকা যাই বলুন, এই ছোটদের রামায়ণ আমাকে নিয়ে গেলো আর এক জগতে, স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাঠের জগত যে কত বিশাল, তা টের পেতে শুরু করলাম তখন থেকেই । ঠাকুরমার ঝুলি, কাকাবাবুর কাণ্ড, আবোল তাবোল, পঞ্চতন্ত্র এবং হিতোপদেশের জগত হয়ে উঠলো আমার চারণভূমি ।

 স্কুলে প্রধানমন্ত্রী হবার সুবাদে চাবি থাকতো আমার কাছে, হেডমাস্টারের রুমে যে আলমারি ছিলো, তা থেকে আনতে লাগলাম ডমরুচরিত ও উপনিষদের কাহিনি ইত্যাদি বই । খেলাহীন শৈশব আমার, সেখানে এই বই হয়ে উঠলো আমার একান্ত সঙ্গী । মাঝে মাঝে, বিকেলের দিকে চলে যেতাম নদীর কাছে, বসে থাকতাম চুপ করে । পা নামাতে ভয় পেতাম, ঘড়িয়াল যদি কামড়ে দেয় আমার পা । নদী বলে উঠতো, 'এসো. আমার বুকে ঝাঁপ দাও ।' 'ভয় করে আমার ।' ঢেউ এসে আছড়ে পড়তো পায়ের নিচে । বুঝি, আমার কথা শুনে হাসছে নদী । 'বসে থেকো না ওভাবে । ভয় পাবার কিছু নেই । তুমি শুধু ঝাঁপ দাও আমার বুকে ।'


আমার নারীরা : ৫৪

January 5, 2014 at 5:04pm


খেলাবিহীন এই ছেলেবেলায় আমার সকল খেলার সঙ্গী তখন নদী, একটি আমগাছ, শিবের থানের ঐ বটগাছা আর গোলাপজাম গাছ, তখন কোথা থেকে এসে জুটে গেলো কালটু । নেড়ি কুকুর, বলে, সে তাচ্ছিল্যের পাত্র নয়, বরং বেশ আদুরে । ছায়ার মতো আমার সঙ্গে থাকে দিনরাত । এমন কি, স্কুলে গেলেও, ক্লাসরুমের দরজার সামনে বসে থাকে কালটু, জিভ মেলে মাথা নাড়াতে থাকে অনর্ঘল । একদিন, বিকেলের দিকে, শিবের থানের ঐ বটগাছের নিচে বসে আছি, কালটু দৌঁড়ে গিয়ে পাশের ডোবা থেকে খেয়ে এলো জল, তারদিকে তাকিয়ে আছি, তখনই বিনোদিনী এসে বসলো আমার পাশে । 


আমাদের পাড়ার মেয়ে, আমার থেকে চারপাঁচ বছরের বড় । চেহারা দেখলে, মনে হবে, আঠারো ঊনিশ বয়স । বললো, 'রোজ এখানে আসো বুঝি ? তোমাকে তো খেলার মাঠে দেখি না কখনও !' চুপ করে রইলাম আমি, কি উত্তর দেবো, বুঝতে পারিনি । অনেক কথা বলে গেলো বিনোদিনী, তার কোনো কথাই মগজে গেলো না আমার । যাবার আগে, হঠাত্‍, আমার দু'গালে চিমটি কেটে, বললো, 'তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে ।' বিনোদিনীও, এর পর থেকে, সঙ্গী হয়ে গেলো আমার ।


 বিকেল হলেই, স্কুল থেকে ফিরে, চলে আসি নদীর কাছে । সেদিন নদীর কি অভিমান, আমার সঙ্গে কথা বলতেই রাজি নয় সে । অনেক কাকুতিমিনতি করার পর, নদী এলো কাছে, বললো, 'তোমার এখন বিনোদিনী আছে, আমাকে আর কি দরকার ?' হেসে উঠলাম আমি । বললাম, 'না গো, বিনোদিনী আমার কেউ নয় । মা ছাড়া আমার বলতে তোমরা এই কয়েকজন, তুমি, ঐ বটগাছ, আম ও গোলাপজাম গাছ...' পাশে বসেছিলো কালটু, আমার কথার মাঝখানে ঘেউউউ করে উঠলো সে । বুঝলাম, তার নাম নিইনি বলে, তার এত রাগ ।


 আমি কালটুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, 'আর আছে এই কালটু ।' আহ্লাদে আমার গাল চেটে দিলো কালটু । পায়ের নিচে এসে জল ছিটিয়ে দিয়ে বললো নদী, 'তুমি তো আমাকে ফেলে যাবে একদিন । আমাকে ভুলে যাবে ।' তার গলার স্বর যেন ভারি হয়ে এলো । বললাম, 'তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি ? আমার যে যাবার জায়গা নেই !' সেদিন আমি কিছুই বুঝিনি নদীর ইশারা । অথচ তার কথাই সত্যি হয়ে উঠলো নির্মমভাবে, আমি তাকে ফেলে এসেছি অনেক দূরে, এসেছি বটে, সে এখনও আমার অন্তর জুড়ে । 

এরমধ্যে মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন খলইখুড়ো, যিনি ছিলেন আমাদের প্রকৃত হিতাকাঙ্খী । যাবার আগের দিন, রথের পালি ছিলো তাদের । পালি মানে পালা । 


রথোত্‍সব মনিপুরীদের আর এক জনপ্রিয় উত্‍সব । রথের দিন থেকে দশমীর শয়ন পর্য়ন্ত, প্রতি সন্ধ্যেবেলা, মালঠেপে অর্থাত্‍ মণ্ডপে গ্রামের কারও না কারও পালি থাকে, সেদিনের সন্ধ্যারতি সহ নাচগান এবং খিচুরি ভোজনের সকল খরচপাতি ঐ পরিবারের । খিচুরির লোভে প্রায় সন্ধ্যেবেলা যেতাম মালঠেপে । সেদিনও গেলাম, মালঠেপে পৌঁছতেই ছুটে এলো বিনোদিনী । 'আমার সঙ্গে একটু চলো, ঘরে একটা জিনিস ফেলে এসেছি ।' তার ঘরে গিয়ে, দেখি, কেউ নেই । দরজা খুলে, অন্ধকারে, আমাকে নিয়ে ঢুকলো ভেতরে । ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, ধরে ফেললো আমাকে । আর আমি তাকে ভর দিতে গিয়ে, অজান্তে, দুইহাতে ধরলাম তার দুটি পেয়ারায় । বিদ্যুততরঙ্গ বয়ে গেলো আমার শরীরে, ফিসফিস করে বিনোদিনী বললো, 'ভালো লাগছে তোমার ?' 


মুহূর্তে, আমার মনে পড়ে গেলো লীলাবতীদিদির কথা, আর দুই হাত সরিয়ে এনে সরে দাঁড়াতে গেলাম, ততক্ষণে বিনোদিনী আমার ইজেরের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ধরে ফেললো নুংকু । 'এ মা ! এ যে ছোটো চ্যাঙ মাছ ।' পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছি, সে চ্যাঙ মাছের মুখ খুলতে গেলো জোর করে । 'উফফ !' বলে, বসে পড়লাম আমি দু'হাতে চেপে । কি হলো তোমার ? আতংকিত বিনোদিনী তাড়াতাড়ি দেশলাই জ্বেলে, কুপি ধরিয়ে কাছে এলো । কুপির আলোয় দেখলাম, রক্ত ঝরছে লিঙ্গমুখ থেকে, বিনোদিনী জোর করে চামড়া ফোটাতে গিয়েছিলো, তাতেই শিরা ছিঁড়ে এই কাণ্ড । যন্ত্রণায় ছটফট করছি, বিনোদিনী কোথা থেকে কিছু পাতা এনে, তা ডলে, লাগিয়ে দিলো আমার নুংকুতে । লাগিয়ে দিয়ে চেপে ধরে রইলো অনেকক্ষণ, তারপর ফিসফিস করে বললো, 'খুব লাগছে, না ?'


আমার নারীরা : ৫৫

January 8, 2014 at 4:43pm


ছেলেবেলার কথা শেষ হবার নয় । এই বিনোদিনীর কথাও ভুলে যাবার কথা ছিলো আমার, কিন্তু ভুলতে পারিনি । যেমন ভুলতে পারিনি, আমার এক ছোটমাসির কথা । ছোটখাটো চেহারা, এখনকার আধুনিকারা স্লিম বলতে যা বোঝেন, প্রকৃত অর্থে তিনি তাই । 


জানতাম না, ছোটমাসির বিয়ে হয়েছে আমাদের গ্রামে । একদিন, তিনি আমাদের ঘরে এলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন মা, 'এই তোমার ছোটমাসি, প্রণাম করো ।' প্রণাম করবো কি, হাঁ করে তাকিয়ে আছি আমি তার দিকে, মা'র চেহারার সঙ্গে মিল যতখানি, অমিলও ততখানি । মা'র চুল কোমর ছাপিয়ে নেমে গেছে পায়ের দিকে, ছোটমাসির তা নয়, গায়ের রঙ মা'র চাইতে সামান্য ম্লান, মা'র নাক ঈষত্‍ মঙ্গোলিয়ন, ছোটমাসির টিকোলো । কিন্তু ঐ হাসিটা ? এত সুন্দর হাসতে পারেন তিনি, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় ।

 'কি হলো, প্রণাম করলে না এখনও ? শিষ্টাচার আর কত শেখাতে হবে তোমাকে ?' মা'র গলায় বিরক্তির ছাপ, আমি তাড়াহুড়ো করে প্রণাম করলাম । তিনি আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, 'মার খেয়াল রেখো, বাবা ।' এই ছোটমাসির বর হরিমোহন মারা গিয়েছিলেন বেরিবেরি রোগে । 


বেরিবেরি যে একটা রোগ, তা জানতে পারি সেবারই প্রথম, পা থেকে শুরু করে সমস্ত শরীরে জমে যায় জল, ফলে, হাত-পা -মুখ সব ফুলে যায় রোগীর । 

প্রথমে কবিরাজ, হোমিও, তারপর, চাপাল, কোনোটাতেই কাজ হলো না, দেখে, হরিমোহন মেসোকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের হাসপাতালে । সেখানেই মারা যান আমার মেসো । ছোট এক শিশুকে নিয়ে অকূলে পড়ে যান ছোটমাসি, তার পাশে রয়ে গেলেন মা । এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, মা পেলেন আর এক সঙ্গী তার, যার কাছে সুখদুঃখের সব কথা বলা যায় । সে বছর এনুয়েল পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে এই ছোটমাসিই আমাকে যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন । পরীক্ষাও দিই আমি । রেজাল্ট বেরুলে দেখা গেলো, তেমন ভালো হয়নি আমার ফল যদিও ক্লাসে ফার্স্টবয় এর আসনটা কোনোরকমে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম আমি । 


হেডমাস্টার মশাই আমাকে আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে খুব করে বকলেন, রেজাল্ট খারাপ করার জন্য । 

আমাকে শপথ করালেন তিনি, মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে আমার । এই শপথের পরিণাম যে কতদূর প্রসারিত, তা কি আর তখন অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমি ?


 বরং, পাকভারত যুদ্ধ নিয়ে ঐ বালকবয়সে মেতে উঠলাম, মূলত খলইখুড়ার চিঠি পড়ে সোনাদাদুকে শোনাতে গিয়ে । রাজস্থান সীমান্তে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে তাকে । বেঁচে, ফিরে আসতে পারবেন কি না, এই সংশয় প্রকাশ করে লিখেছেন খলইখুড়ো । 


আমার কৌতুহল যুদ্ধ নিয়ে, রেডিওর খবর শুনতে যাই পাড়ার নরেশকাকুদের বাড়ি, পড়াশোনা বাদ দিয়ে । 

রোজ পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ভাষণ শুনি, সে ভাষণে শরীরের সকল রোমরাজি কেঁপে ওঠে," জয় জোয়ান জয় কিষাণ !" বলে । স্কুলে গেলে মাস্টারমশাইদের সময় কাটে ঐ যুদ্ধ নিয়ে । এরই মধ্যে, হঠাৎ, একদিন, ঘরে এলেন খলইখুড়ো । আমরা সবাই অবাক, যুদ্ধ চলছে, অথচ তিনি ফিরে এলেন গ্রামে, এটা কি করে হলো !


আমার নারীরা : ৫৬

January 11, 2014 at 8:51am


খলইখুড়া ফিরে এলেন বটে, তাতে তার ঘরের লোকজন যত খুশি, তার চেয়ে বেশি খুশি মা । খলইখুড়াকে অতি স্নেহ করতেন মা, বিশেষত আমাদের ঘর বানিয়ে দেবার জন্য তার ঐ তত্‍পরতা কখনো ভোলার নয় ।


 সোনাদাদুর তবু সন্দেহ থেকে যায়, তিনি বলতে লাগলেন, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে, অথচ এই সময় সে এখানে এলো কি করে ? ডাল মে কুছ কালা হ্যায় । সোনাদাদুর কথা পাত্তা দিতে রাজি নয় কেউ, বরং সবাই আগ্রহী খলইখুড়ার কাছ থেকে যুদ্ধের বর্ণনা বিস্তারিত শুনতে । রাজস্থানের বর্ডারে যেতে হয়েছিলো খলইখুড়াকে, তিনি মূলত মিলিটারির গাড়িচালক, তার কাজ ছিলো গাড়ি করে যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ পৌঁছে দেওয়া । একদিন, ক্যাম্প থেকে, এভাবে রসদ নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, মাঝপথে দেখলেন, তাদের বাহিনী আক্রান্ত হয়ে পিছু হটেছে বিস্তর, রাস্তার মাঝখানে ভেঙে ফেলা হয়েছে সেতুগুলিকে, পাকিস্তানি সৈন্য তুমুলভাবে এগিয়ে আসছে । বিপদ ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ার আগে বিপদ মোকাবেলা করার এই পদ্ধতি প্রাচীন, তবু সেতু না ভেঙে দিলে পাকিস্তানিরা এসে পড়বেই সহজে, ফলে এসব করা ।


 খলইখুড়া দেখলেন, বিপদ সামনে, তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এক গমের ক্ষেতে রেখে দিলেন, যাতে কারও নজরে না পড়ে । তারপর, পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেন জনপদের দিকে, ঘুরতে ঘুরতে, এই ফিরে আসা । এটা কাপুরুষের লক্ষণ হলেও তার আর করার কিছু ছিলো না । যুদ্ধের বর্ণনা খলইখুড়ার মুখে শুনে আমরা রোমাঞ্চিত, মনে মনে, ট্যাংক নিয়ে আমিও এগিয়ে যাচ্ছি শত্রুশিবিরে হানা দিতে অথবা বোমারু বিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছি পাকিস্তানিদের উপরে ।

 জয় জওয়ান জয় কিষাণ, শাস্ত্রীজির এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ আমার বালকমন । এখন মনে হয়, প্রতিটি মানুষের ভেতর একজন যুদ্ধবাজ থাকে, যেভাবে থাকে এক সন্ন্যাসীও । বেশিদিন থাকতে পারলেন না খলইখুড়া, একদিন বিকেলে এলো পুলিশ, তাকে যুদ্ধপলাতক হিসেবে ধরে নিয়ে গেলো ।


 সোনাদাদু বললেন, 'এটা হবেই, আমি জানতাম । একটা কুলাঙ্গার আমার ঔরসে জন্ম নিয়েছে ।' তিনি যাই বলুন, আমার খুব কান্না পেলো । কান্না আড়াল করতে না পেরে, চলে গেলাম নদীর কাছে, আমার আগে আগে কালটু । 'কাঁদছো কেন ? তুমি জানো না, তুমি কাঁদলে আমি খুব কষ্ট পাই ।' নদী এগিয়ে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো ।

 বললাম, 'খলইখুড়াকে ধরে নিয়ে গেলো আজ ।' ছপাত্‍ ছপাত্‍ করে জল এসে লাগলো আমার পায়ে । নদী কি হাসছে ? 'না, হাসছি না । কর্তব্যে গাফিলতি করলে প্রত্যেককেই শাস্তি পেতে হয় । তোমার খলইখুড়া পালিয়ে এসে অন্যায় করেছিলেন, তার শাস্তি পেয়েছেন । তাতে বিচলিত হচ্ছো কেন ?' 'খলইখুড়াকে আমি ভালোবাসি । ভীষণ । তার যদি কিছু হয়ে যায়, যদি হয়...' 'সামান্য শাস্তি ছাড়া তার আর কিছু হবে না । ও নিয়ে ভেবো না তুমি ।' ঠিক বলছে তো নদী ? আমার ভেতরে তখন এক আশ্চর্য খুশির ঢেউ । কালটু কি বুঝলো, জানি না, সে ঘেউউউ করে উঠলো আর বালির উপরেই দিতে লাগলো গড়াগড়ি । সন্ধ্যে নেমে আসছে নদীর বুকে, চরে, চরাচরে । একটু আগে তিরতির করে নদীর জলে ডুবে গেছে সূর্য । ঐ ডুবে যাওয়ার দৃশ্য, এই নেমে আসা অন্ধকার, অদূরে ঐ আবছা খেয়াঘাট, বটগাছ, সব মিলিয়ে এ এক অপরূপ নিসর্গ । আমি ভুলে গেলাম ঘরে ফেরার কথা ।


আমার নারীরা : ৫৭

January 17, 2014 at 11:39pm


খলইখুড়াকে নিয়ে যাবার পর, দু একমাস কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি ভালো করে । মা কিছুই বলতেন আর, তিনি তখন তার চালের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত । যুদ্ধ থেমে যাবার পর, হঠাত্‍ করে শুরু হয়ে গেলো দুর্ভিক্ষ, প্রথমে টের পায়নি কেউ, সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া হতে লাগলো এমন ভাবে, মানুষের কেনার আর ক্ষমতা নেই । চালের ব্যবসায়, এই সুযোগে, অতিরিক্ত মুনাফা করতে লাগলেন মা, তবে তা বেশিদিনের জন্য নয়, কেন না, যারা ধান বিক্রি করতো, তারা বন্ধ করে দিলো তা ।


 অবনী পাল বা রাকেশ রায়দের বলে কয়ে মাঝে মাঝে দু একমণ ধান আনতেন কিনে, তা ব্যবসার জন্য সামান্য । বাজারে চাল নেই, হাহাকার চারদিকে, লোকে খেতে পারছে না । বাবা তখন বদলি হয়ে চলে গেছেন অম্পিনগর, লক্ষ্য করতাম, প্রায়দিনই উপোস থাকছে বড়ঘরের সদস্যরা । গ্রীষ্মকাল বলে, ততটা বোঝা যায়নি, কেন না, ভাতের বদলে কাঁঠাল দিয়ে অনেকেই দু একবেলা চালিয়ে দিচ্ছে ।

 যে কাঁঠাল দশপয়সা থাক, পাঁচ পয়সাতেও বিক্রি হতো না, তাও বিক্রি হতে লাগলো আধুলিতে । একদিন আমার এক সত্‍ভাই আমাকে বললো, দাদা, আজ একটু ভাত দেবে ? অবাক হলাম আমি, বললাম, 'ঘরে ভাত নেই ?' 'তিনদিন ধরে কিছু খাইনি । বাবার বেতনও আসেনি এমাসে । 


আমি আর কিছু ভাবিনি, আমার দুপুরের খাবারের থালা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, 'চুপচাপ ঘরে নিয়ে যাও । কেউ যেন না দেখে ।' সেদিন থেকে, প্রতিদুপুরে, আমার খাবারের থালা যাতে ভাত বেড়ে রেখে দিতো মা, তা তাদের ঘরে পাঠাতে লাগলাম, মা'কে লুকিয়ে । এদিকে, মা'র চালের ব্যবসাও পড়ে এলো, প্রথমত ধানের অভাবে, দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত বাকি পড়ে যাওয়ায় মূলধনও গেলো কমে । এক বিকেলে, স্কুল থেকে ফিরে এসে, দেখলাম, ঘরে ভাত নেই । অর্থাত্‍ রান্না হয়নি । 


একটু পরে মা এলো ব্যাগে কি একটা নিয়ে । এসে কোনো কথা না বলে, বাইরে, চুলো জ্বালিয়ে, হাড়িতে বসালো তা । 'ভাত রাঁধছো, মা ?' কৌতুহলবশত, জিগ্যেস করি মা'কে । 'ভাত নয়, এটা গম ।' ক্লাসে বন্ধুদের কাছে আগেই শুনেছি, তাদের বাড়িতেও ইদানিং রাতে গম খাওয়া হয় । দিনের বেলা গম খেতে আত্মসম্মানে বাঁধে, বলে, রাতে খাওয়ার এই চল । গম বসিয়েছেন অনেকক্ষণ হলো, তা আর সেদ্ধ হয়ে ভাতের মতো হচ্ছে না । ফুটছে ফুটছে । হাড়ির জল শুকিয়ে গেছে এক প্রস্থ, দ্বিতীয়বার জল দিয়েও তার আর যখন কোনো গতি হলো না, সেই আধসেদ্ধ গম পাতে বেড়ে দিলেন মা ।


 আমাদের গম খাওয়া শুরু এভাবেই । আশেপাশের সব গ্রাম থেকে শোনা যেত লাগলো, এভাবে গম খেতে গিয়ে পেটের রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ছে সবাই । 

এর মধ্যে রেশন বলে চালু হলো আমেরিকান চাল আর কেরোসিন । সেই চাল এত মোটা, দুর্গন্ধময়, যে লোকে তার বদলে বেছে নিলো গম কিন্তু পেটের রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে বসলো চারদিকে । সরকার মূলত অন্ধ ও বধির হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি ।


 গ্রীষ্ম পেরিয়ে তখন বর্ষার শেষ, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম । ত্রাণশিবির খুলতে এসে, সরকারি লোকেরা, প্রথম, জানতে পারলো, যে, এলাকার লোক গম খেতে জানে না । তারাই প্রথম শিখিয়ে দিলো কি করে গম ভাঙিয়ে তৈরি করতে হয় আটা, যা দেখতে অনেকটা চালের গুড়ির মতো, এবং এই আটা দিয়ে রুটি বানাবার পদ্ধতিও শিখিয়ে দিলো তারা । গ্রামের মানুষ শিখে গেলো কি করে খেতে হয় রুটি । তবু আমাদের ঘরে রুটি আর ঢুকলো না । মা বললেন, 'কম খাবো, তবু রুটি খাবো না ।'


আমার নারীরা : ৫৮

January 27, 2014 at 9:56pm


সেই গমপর্ব চলেছিলো অনেকদিন, তখনও ফুড ফর ওয়ার্ক চালু হয়নি এদেশে । দু'কেজি চাল, আর পাঁচ সিকে নগদ দেওয়া হতো এই ফুড ফর ওয়ার্কে । এটা অনেকটা এখনকার এনরেগার মত বিষয়, একটা কোদাল বা দা নিয়ে হাজিরা দিলেই হলো, চাল আর টাকা প্রাপ্য হয়ে গেলো । ফুড ফর ওয়ার্ক আসেনি, যুদ্ধের ছায়া দেশ জুড়ে, যা আমাদের এই গ্রামেও বিস্তৃত । অভাব আর অনটন নিত্যসঙ্গী গাঁয়ের লোকজনদের । এই ডামাঢোলের ভেতরে আমাদের এনুয়্যাল পরীক্ষা হয়ে গেলো আর আমি করলাম ফেল । এটা রেজাল্ট বেরুবার আগেই জেনে গেলাম আমি ।


 হেডমাস্টার মশাই আলাদা করে ডেকে পাঠালেন তাঁর চেম্বারে । ভয়ে, ত্রস্ত আমি ধীরে ধীরে ঢুকলাম স্যরের চেম্বারে । আর ভাবছি, কি করে ফেল করলাম আমি ? পরীক্ষার একদিন আগে আলমারি থেকে প্রশ্নপত্রগুলি বের করে দেখে নিয়েছিলাম সব । স্কুলের প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, বলে, চাবি থাকতো আমার কাছে । কোন আলমারিতে প্রশ্নপত্র রাখা আছে জানতাম আমি, স্কুল ছুটি হলে পর, একা, স্যরের রুমে ঢুকে, আলমারি খুলে সবকটি প্রশ্ন পড়ে নিই । একবার, দু'বার, তিনবার । উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছি আর পড়ছি, পড়ে মুখস্থ করার চেষ্টা করছি । কেন এটা করলাম, জানি না, পাঠ্যপুস্তকের সব আমার জানা, পড়া, তারপর এটার দরকার ছিলো না, তবু এই চুরিবিদ্যার লোভ সামলাতে পারলাম না । 


স্যর গম্ভীর গলায় বললেন, 'এসব ভুল তোমাকে কখনো করতে দেখিনি, কি হয়েছিলো তোমার, সত্যি করে বলবে ?' তিনি সবগুলি খাতা টেবিলে রাখলেন আমাকে দেখাবার জন্য । স্যরের কথা শেষ হবার আগে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি । 'আর কখনও এ কাজ করবো না, স্যর ।' কাঁদতে কাঁদতে বললাম । 'আমি চুরি করে সব প্রশ্ন আগেই আলমারি থেকে বের করে দেখে নিয়েছিলাম ।' 'য়্যাঃ ! কি বলছো তুমি ? মাই গড ! এটা করতে গেলে কেন ?' তিনি যতটা অবাক, তারচেয়ে বেশি বিরক্ত । তারপর বললেন, 'এই কারণে 'আরুণির উপাখ্যান' মুখস্থ লিখতে গিয়ে লিখেছো অন্য কবিতা । আমার বিদ্যালয় নিয়ে রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছো আমার গ্রাম । ল.সা.গুর স্থলে করেছো গ.সা.গু । আমি ভাবছিলাম, তোমার এত মাথা খারাপ হলো কি করে ?' তারপর, কিছুটা সময় চুপ করে থেকে, তিনি বলে উঠলেন, 'তোমার পাপের শাস্তি ঈশ্বর দিয়েছেন । এই দেখো, পাঁচ পেপারের সব কটিতে শূন্য পেয়েছো তুমি । আমি আর কি শাস্তি দেবো তোমাকে ? ঘরে যাও এখন ।' 


সে রাতে কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়লাম আমি, মা জানলে, আস্ত রাখবেন না । পরদিন স্কুলে গেলাম না, কি করে মুখ দেখাবো স্কুলে গিয়ে ? ভাবছি, চিরতরে এই গ্রাম ছেড়ে, সব ছেড়ে, পালিয়ে যাবো কোথাও ।

 মা সকালেই ধান কিনতে বেরিয়ে গেছেন, ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল । দুপুরের পরে, মা আসার আগে, চুপি চুপি, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি । 

হা হতোস্মি, পথে দেখা হয়ে গেলো, দীনেশ আর ব্রজেন্দ্রর সঙ্গে । বললো, 'স্কুলে যাসনি কেন ? হেডস্যর ডেকে পাঠিয়েছেন, চল, আমাদের সঙ্গে ।' আবার হেডস্যর ? আর কত শাস্তি পাবো আমি ? পালাতে চাইলাম, সব ছেড়ে, এখন শমন পাঠিয়েছেন হেডস্যর ! কি আর করি, তাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি স্কুলের দিকে ।


আমার নারীরা : ৫৯

February 3, 2014 at 11:39pm


হেডমাস্টারের রুমে ঢুকতেই, তিনি বলে উঠলেন, 'তোমার পরীক্ষা আবার নেবো আমরা । এডভাইসরি কমিটির সঙ্গে এ নিয়ে আলাপও হয়েছে । সবাই বলেছে, একটা সুযোগ দেওয়া দরকার তোমাকে ।' আমি আর কি করবো ? যে অপরাধ করেছি, তার জন্য অনুশোচনায় পুড়ে মরছি আমি । জানা বিষয়, পড়া বই, তারপরও কোন আক্কেলে প্রশ্নপত্র দেখতে গেলাম তা ? দেখার পর কি করে এই সামান্য ভুলগুলি করে বসলাম ? এক প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে আরেক প্রশ্নের উত্তর লিখলাম কি করে ? না কি কেউ আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিয়েছিলো তখন ? অপরাধের শাস্তি পাবার জন্য এটা হলো ? 'কি হলো ? পরীক্ষায় বসতে রাজি আছো তো ?' প্রায় ধমকের সুরে হেডমাস্টার বলে উঠলেন । আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ করলাম । 'গুড । এই স্পিরিটটাই তোমার কাছে আশা করেছিলাম আমি ।' 


পরদিন, হেডমাস্টারের রুমেই আমার পরীক্ষার ব্যবস্থা হলো । সামনে পেছনে চারদিকে আমাকে ঘিরে রইলেন এডভাইসরি কমিটির লোকরা । হাতে লেখা প্রশ্নগুলি সত্যিই অতিকঠিন, ভাগ্যিস, সমস্ত বই পড়া ছিলো আমার, না হলে আটকে যেতাম । সকল বিষয়ে পঞ্চাশ নম্বরের পরীক্ষা, একটু সময় লাগলেও সব দিলাম উত্তর । আমাকে সামনে রেখেই উত্তরপত্র পরীক্ষা করা হলো, এবং আশ্চর্য, বাংলা ছাড়া আর সকল বিষয়ে ফুলমার্কস পেয়ে গেলাম আমি । তবে, তার আগে, আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলেন হেডমাস্টার, যে আর কোনোদিন চুরি করে কিছু করবো না । পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো ৩১ ডিসেম্বর এবং আমি, অস্বস্তির কাঁটা বুকে নিয়ে, প্রথম হলাম আবার । এবার বড় স্কুলে ভর্তি হবার পালা, কেন না, এই স্কুলটা ছিলো প্রাইমারি এবং ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত । আমি, একা একা, ভর্তি হতে গেলাম শহরের নাম করা স্কুল আর কে আইয়ে । সেখানেও নানা ঝামেলা, ভর্তি পরীক্ষা দিতে হলো যে পরীক্ষায় প্রথম হলাম, ফলে, ভর্তি হবার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো আমার । বাদ সাধলেন আমার প্রাইমারি স্কুলের এডভাইসরি কমিটি, তারা এসে মাকে বললেন, 'এলাকার সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রটি যদি চলে যায় তাহলে স্কুল বড় করা হবে কি করে ?' কাউলিকুড়া স্কুলটিকে তখন সিনিয়র বেসিকে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে জোরকদমে । পূর্বপাকিস্তান থেকে সদ্য আসা রঞ্জু ভট্টাচার্যকে উঁচু ক্লাসের শিক্ষক করে এই প্রয়াস । 


এডভাইসরি কমিটির কথা ঠেলতে পারলেন না মা, কেন না, রাকেশ রায় ও অবনী পালরা এই কমিটির মুখ্য লোক, যাদের সহায়তা ব্যতীত মার চালের ব্যবসা হবার যো নেই । আমি সহ ক্লাস ফাইভ থেকে যারা প্রমোশন পেয়েছিলাম, সবাই থেকে গেলাম এই স্কুলে ।


 রঞ্জু ভট্টাচার্য সব বিষয় পড়াতেন, আমাদের কারও তার পড়ানো ভালো লাগতো না মোটেই । ক্লাসে মনোযোগ নেই আমাদের কারও । একদিন ভূপেন্দ্রকে দেখলাম পেছনের বেঞ্চিতে বসে প্যান্টের জিপ খুলে নুংকু নিয়ে কিসব করছে । ও পাশের বেঞ্চিতে বসে সন্ধ্যা এবং প্রভাসিনীরা তা দেখছে খুব মন দিয়ে । আমার শরীর শিউরে উঠলো এই দৃশ্য দেখে । পেচ্ছাপ করতে বেরিয়েছিলাম, ফিরে ঢুকতে গিয়ে, এই দৃশ্যের আকর্ষণে থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একমনে । ঘোর ভাঙলো, নতুন শিক্ষকের হুংকারে । 'এই, এই, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো ?'   

  

আমার নারীরা : ৬০

February 4, 2014 at 9:51pm


'কি করছিলে সেখানে দাঁড়িয়ে ?' ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায়, রঞ্জুস্যার ধমকে উঠলেন । ফর্সা, কার্তিকের মতো চেহারা, গলার আওয়াজ অদ্ভুত রকমের ফাটা ফাটা তার । সমস্ত ক্লাস, মুহূর্তে, নৈঃশব্দরচিত শ্মশান হয়ে গেলো যেন । মাথা নিচু করে রইলাম আমি । 'বেঞ্চে এসে বসো ।' কোনো কথা না বলে, আমার জায়গায় এসে বসলাম । বসলাম বটে, মন পড়ে রইলো ভূপেন্দ্রর ঐ দৃশ্যে । তিনদিন পরে, স্কুলে, একা পেয়ে, সন্ধ্যা আমাকে জিগ্যেস করলো, 'এই, সেদিন ভূপেন্দ্র কি করছিলো ? সত্যি করে বলো তো ?' থতমত খেয়ে বলে উঠলাম আমি, ' কই, কিছু না তো !' হেসে উঠলো সন্ধ্যা, বললো, 'মিথ্যা বলছো কেন ? আমি স্পষ্ট দেখলাম, প্যান্টের জিপ খুলে, ভূপেন্দ্র তার ওটা হাত দিয়ে নাড়াচ্ছিলো । এই, বলো না, এতে কি আরাম পাওয়া যায় ?' তারপর চারদিকে তাকিয়ে, ফিসফিস করে বলে উঠলো, 'এই, তোমার ওটা একবার দেখাবে আমাকে ? দেখাও না ?' আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে, খপ করে প্যান্টের উপর দিয়ে ধরে বসলো আমার নুংকু । শির শির করে উঠলো আমার গা । 'এই, অমন শক্ত হচ্ছে কেন ?' তার কথার দিকে আমার মন নেই, ভয়ে, আতংকে তাকাচ্ছি চারদিকে । এখনই এসে পড়বে অন্য ছাত্রছাত্রীরা, যদি কেউ দেখে ফেলে এই অবস্থায়, যদি দেখে, তাহলে, কেলেংকারি হবে । এই ভয় ছাপিয়ে এখন আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করছে আমারও । হিস হিস করে বললাম, 'সন্ধ্যা...' 'বেশ গরমরে । ধরতে বেশ ভালো লাগছে ।' কার যেন পায়ের শব্দ শুনছি, ঝটিতি সন্ধ্যার হাত ছাড়িয়ে, বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি । দেখলাম, দীনেশ ওরা আসছে, কাঁঠালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে । উফফ, অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম আজ । তখনই, পেছন থেকে এসে, সন্ধ্যা বললো, 'আর একদিন ভালো করে দেখাবে । ফাঁকি দিলে চলবে না ।' ফাঁকি আমার দিতে হয়নি, পরের মাসেই, বিয়ে হয়ে গেলো সন্ধ্যার, এক কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে । 


বিয়ের দিন স্কুল থেকে আমরা সবাই গিয়েছিলাম তার বাড়ি, আমাকে একা পেয়ে বলে উঠলো, 'বিয়ের পরে এসেও তোমার ওটা একবার দেখবো । সেদিন ভীষণ ভালো লেগেছিলো, সত্যি বলছি ।' এই সন্ধ্যার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমার । কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সে, আমিও তার খোঁজ রাখতে পারিনি কখনো, হয়তো আগ্রহ ছিলো না কোনো । 


আগ্রহ ছিলো না বটে, তবে বিদ্যুতরেখার মত এসে সন্ধ্যা আমার স্কুলজীবনকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো । সন্ধ্যা সত্যিই সুন্দরী ছিলো, বিয়ের সাজে অপরূপা মনে হয়েছিলো তাকে । স্লিম, দীর্ঘাঙ্গী, মরালগ্রীবা, অসাধারণ দুটি চোখ । বয়সে আমার চাইতে চারপাঁচবছরের বড় হলেও পড়তো আমার সঙ্গে আর আশ্চর্য এক সখ্যতা ছিলো তার সঙ্গে । সে সখ্যতা ঐ সময় দীনেশ ছাড়া আর কারও সাথে ছিলো না আমার । এই সন্ধ্যার কথাও ভুলে গেলাম একদিন, কেন না, ইতিমধ্যে, আমার জীবনে ঘটে গেলো আর একটি ঘটনা, যার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি । 


একদিন, বিকেলবেলা, স্কুল থেকে ফিরে এসে, শুনলাম, আমার মামা এসেছেন । আমার শিলঙের মামা যিনি অনেকদিন আমাদের কাছে আসেননি । মামা এসেছেন, আমাদের ঘরে নয়, পূর্ণচাঁদকাকুর বাড়িতে । খটকা লাগলেও, ছুটে গেলাম পূর্ণচাঁদকাকুদের বাড়ি । উঠোনভর্তি লোক, মহিলারাই বেশি, আমাকে দেখে, বলে উঠলো সবাই, 'এই তো, সমরজিত্‍ এসেছে ।' তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'যাও, মাংকলে যাও, তোমার মামা সেখানে আছেন ।'

 ভিড় ঠেলে, মাংকলে উঠে দেখলাম, একজন লোক, শ্বেতবস্ত্র পরিহিত, মুণ্ডিতমস্তক, শান্ত মুখশ্রী, মেঝেয় শয্যা পেতে শুয়ে আছেন, তার শিয়রে বসে রয়েছেন মা । আমাকে দেখে, মা বলে উঠলেন, এসেছো ? ভালো হয়েছে, 'তোমার মামাকে প্রণাম করো ।'


আমার নারীরা : ৬১

February 5, 2014 at 10:00pm


প্রণাম করার বিষয়টি, কেন জানি, আমার নাপছন্দ এবং পারতপক্ষে করিও না কখনও । ইতস্তত করছি, দেখে, প্রায় ধমকের সুরে, মা বললেন, 'তোমার মামাকে প্রণাম করো ।' যাকে দেখছি, তিনি আমার মামা বটে, তবু যেন মামা নন, এক বৈষ্ণব । ভাবছি, মামা আবার বৈষ্ণব হলেন কি করে ? তিনি কেতাদুরস্ত থাকতে ভালোবাসতেন, শিলঙে দরজি থেকে ছোটোখাটো কাপড়ের দোকান পর্যন্ত দিয়েছিলেন বড়বাজার এলাকায় । দিদিমাকে নিয়ে যাবার সময়, মা-কে এসব বলে গিয়েছিলেন । তার আগে অনেকবার এসেছেন বেতছড়া থাকাকালীন, মূলত বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতেই আসতেন মামা । মা আর দিদিমা মিলে কোনো পাত্রী পছন্দ করে, মামাকে খবর দিতেন, আর চলে আসতেন তিনি । 


পাত্রী দেখার শর্ত রাখতেন, অন্তত একমাস না হোক, দশ পনেরোদিন পাত্রীকে মামার সঙ্গে চলাফেরা করতে দিতে হবে । এই নিয়ম মনিপুরী সমাজে নেই, কিন্তু মামা শিলঙবাসী হিসেবে, এটা আদায় করে নিতেন । দশপনেরোদিন পাত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করে ফিরে যেতেন শিলঙ, বলতেন, গিয়ে তার মতামত জানাবেন । অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন মা, আর পোস্টকার্ডে, খুব সংক্ষিপ্ত মতামত পাঠাতেন মামা, পাত্রীর ডানচোখটা সামান্য ট্যাঁরা, তোমরা কি লক্ষ্য করো নাই ? এভাবে, একবার নাকটা বাজপাখির মত, হাতের আঙুলগুলি পুরুষের মত ইত্যাদি অজুহাত লিখে পাঠাতেন প্রতিবার পাত্রী দেখার পর ফিরে গিয়ে । শেষবার, লিখলেন, লক্ষ্য করেছো, মেয়েটা কোলাব্যাঙের মত থপথপ করে হাঁটে ? বিরক্ত হয়ে মা, চিঠি লিখিয়ে পাঠালেন, পর সমাচার এই যে, তোমার পাত্রী ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয় । শিলঙে কোনো পাত্রী পছন্দ করে থাকলে বিয়ে করতে পারো । তার আগে মা-কে লইয়া যাও । 


মা-র স্থির ধারণা ছিলো, মামা নির্ঘাত্‍ কোনো খাসিয়ারমণীর পাল্লায় পড়েছেন, নইলে, এত অজুহাত দেখাবেন কেন ? তো, একদিন, দিদিমাকে তিনি নিয়ে গেলেন শিলঙ, সেখানেই দেহ রাখলেন দিদিমা, খবর পেলেও মা যেতে পারলেন না দিদিমার শ্রাদ্ধে, তখন আমরা পেঁচারডহর, থাম্পাল পিসিদের ঘরে কাজ করছি । মনে পড়ে, সারারাত, মা কেঁদেছিলেন, একা একা । তারপর, একদিন, মা জানতে পারলেন, মামা তার কাপড়ের দোকান এবং অস্থাবর সব সম্পত্তি কোনো এক বিধবা বাঙালিনীকে দিয়ে চলে গেছেন শিলঙ ছেড়ে । কোথায় গেছেন কেউ জানে না । খাসিয়ারমণী নয়, মামা আসলে প্রেমে পড়েছিলেন এক বাঙালি বিধবার যার জন্য বিয়ে পর্যন্ত করা হয়নি তার । সেই মামা এখন ফিরে এসেছেন বৈষ্ণববেশে, যার আখড়া আছে বৃন্দাবনে, রাধাকুণ্ডে । মা-র ধমক খেয়ে প্রণামোদ্যত হতেই, মামা বললেন, 'থাক, থাক আর প্রণাম করতে হবে না । ভক্তি বিনা প্রণাম অর্থহীন ।' ভক্তি আমার সত্যিই নেই, কেন জানি না, এ বিষয়ে কোনো অনুভূতিই আমার নেই । মা শুধু বলতেন, তুমি একটা পাষণ্ড আমার গর্ভে এসেছিলে ! মামা আমাকে কাছে ডেকে বসালেন তার পায়ের কাছে, তারপর জিগ্যেস করলেন, 'কোন ক্লাসে পড়ো ?' 'সিক্স ।' খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার । আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, মা-কে বললেন, তোমার ছেলের কপালে অনেক ঝঞ্ঝাট আছে, সারাজীবন ভুগতে হবে তাকে ।


আমার নারীরা : ৬২

March 13, 2014 at 5:30pm


আমার কপালে কি আছে, তা টের পেতে শুরু করেছিলাম, বেতছড়া থেকে ফিরে আসার পর থেকে । নতুন আর কি হতে পারে ? গৃহভৃত্য হবার পর, আর কিছু বাকি থাকে মানুষের জীবনে ? বড় মামার ঐ কথায় আহত হলেও, সামলে নিলাম পরমুহূতেই । মামা আরও কিছুদিন থেকে গেলেন আমাদের গ্রামে, আমি আর ও মুখো হইনি । যদিও, প্রতিদিন, স্কুল থেকে ফিরে এসে, দেখতাম, ঘরে, থালায় ঠাকুরের ভোগ রেখে দিয়েছেন মা । সেই ভোগ, মামার স্বহস্তে রাঁধা, অমৃতসমান । মামা খুব ভালো রাঁধতেন, তা আগেই জানতাম, ঠাকুরের ভোগ খাবার পর, মনে হলো, অমৃত একেই বলে । একদিন, স্কুল থেকে ফেরার পথে. দেখা হয়ে গেলো মামার সঙ্গে । পাশ কাটিয়ে, চুপচাপ, সরে যেতে চাইলাম, পারলাম না, তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'লেখাপড়া কেমন হচ্ছে ?' মামার দিকে না তাকিয়ে, বললাম, 'ভালো ।' 'দিদি বলছিলেন, পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছো ?' কোনো জবাব দিলাম না আমি । এসব কথা উঠলে বোবা হয়ে যাই আমি, কোনো ভাষা খুঁজে পাই না তখন । 'তা, শরীরের ছিরি এরকম কেন ? ব্যায়াম করো ?' মাথা নারলাম আমি । না । ব্যায়াম থেকে অনেক দূরে আমি । কলাগাছের জীবনে কি ব্যায়াম থাকে ? খেলাধুলাই ভালো লাগে না আমার । তার চেয়ে গল্পের বই আমাকে টানে খুব বেশি, সে জগতে নিজেকে খুঁজে পাই । আংকল টমস কেবিন পড়ে শেষ করেছি মাত্র, জাতকের গল্প এনেছি ঘরে । 


এই জগত সকল কষ্ট থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে । 'শোনো, এখন থেকে ব্যায়াম ধরো । আমি তোমাকে শেখাবো । শরীরই আসল । দেহ সুস্হ থাকলে মনও থাকে সুস্হ । আর, হ্যাঁ, লাঠি খেলাও শিখিয়ে দেবো ।' মামা লাঠি খেলায় ওস্তাদ ছিলেন, এটা বলেছিলেন । মামার হাতে একটা লাঠি থাকলে পঞ্চাশজন লোক এসেও তার কাছে দাঁড়াতে পারতো না । মনে মনে ভাবলাম, এই লাঠি খেলাটাই শিখে নেবো আমি ।


আমার নারীরা : ৬৩

March 14, 2014 at 4:36pm


দুদিন পর, বিকেলে, নদীর চরে, মামা আমাকে নিয়ে গেলেন লাঠি খেলা শেখাতে । তার আগের দিন, ইমফল থেকে এসেছেন আমাদের এক কাকা, জ্যোতির্ময় সিংহ, মনিপুরী মৈতৈ ভাষাতেই কথা বলেন, আর ভাঙা ভাঙা বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষাতে কাজ চালিয়ে যান আমাদের সঙ্গে । বাবার দূর সম্পর্কের ভাই তিনি । চেহারাও বাবার মত । পরে, জেনেছি, মনিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষায় কথা বলা বারণ । কেন তা হয়েছে, এ নিয়ে নানা বিতর্ক । মৈতৈ আর বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীদের এই দুটি প্রধান গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ আজকের নয় । ষোড়শ শতাব্দীর বিশের দশকে রাজা খগেনবা মৈতৈভাষাকে রাজভাষা হিসেবে ঘোষণা করার পর, এই বিবাদ শুরু হয়ে যায় । তার আগে মনিপুরের রাজভাষা এবং লোকভাষা ছিলো লাইলোন যা রূপান্তরিত হয়ে চেহারা নিয়েছে আজকের এই বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষা ।


এই বিবাদ এর জের হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়াগণ রাজশক্তির হাতে নিপীড়িত হতে থাকেন । তবু দমিয়ে রাখা যায়নি তাদের । গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকে মনিপুর বিধানসভায় meitei = manipuri বলে এক প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী কৈরেং সিংহ । তারপর থেকে বিষ্ণুপ্রিয়াদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয় । কৈরেং সিংহ নিজে বিষ্ণুপ্রিয়া গোষ্ঠীর হয়েও একাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্ষমতার লোভে । ত্রিপুরার বিশালগড়ে এক জনসভায় তাকে এরজন্য ক্ষমা চাইতেও হয়েছিলো । তো, জ্যোতির্ময়কাকাও লাঠি খেলা খুব ভালো জানেন, সঙ্গে ম্যাজিক । ছনের চালে গামলা পেতে গরুর দুধ আনা থেকে দশটাকার নোটকে একশটাকার নোটে পরিবর্তিত করা তার কাছে বাঁ হাতের খেলা । তিনিও এলেন আমার লাঠি খেলা প্রশিক্ষণে । পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে মনু নদীর বুকে । আশ্চর্য এক সুন্দর বিকেল ।


হাওয়া আসছে নদীর জল থেকে । আমাকে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে, মামা দেখালেন, কিভাবে দাঁড়াতে হবে । মাথা ও কোমর, হাত ও পা এর অবস্থানও দেখিয়ে দিলেন তিনি । তারপর এক দু তিন চার এক দু তিন চার বলে শেখালেন পদচারণা । হায়, আমার মনে হলো, এর চাইতে রাখাল নাচ অনেক সোজা । এ যে অংকের কসরত্‍ । একটু হিসেবে হেরফের হলেই, পিঠে আর পায়ে এসে পড়ছে মামার হাতের কঞ্চির ঘা । একবার এত জোরে ঘা পড়লো, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম আমি । মনে হলো, মামা তার অপমানের সকল প্রতিশোধ নিচ্ছেন লাঠি খেলা শেখাবার নামে । আমি কাঁদতে শুরু করলাম ।



আমার নারীরা : 64


June 1, 2014 at 9:42pm


আমাদের স্কুলঘর ছিলো একটা টিলার উপর, পাশে, সমতলে, প্রাইমারি সেকশন । পূবে আর দক্ষিণে চাবাগান । মূলত চাবাগানের শ্রমিকদের জন্য এই স্কুল । পরবর্তী কালে, চাবাগানের দুপাশের দুই গ্রাম, দক্ষিণে জলাই আর উত্তরে কাউলিকুড়া । চাবাগানের নামটি আমার এত প্রিয়, যে, আমার গ্রাম জলাই-এর নাম না বলে, বলতাম, সোনামুখী । এমন সুন্দর চাবাগান খুব কম দেখেছি আমি ।

ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পাবার পর, লক্ষ্য করলাম, আমার শরীরে অনেক পরিবর্তন । এখন আর প্যান্ট খুলে আগের মত ঝাঁপ দিতে পারি না মনু নদীর বুকে । ক্লাসে প্রভাসিনীর বিশাল বুকের দিকে তাকিয়ে থাকি প্রায় সময় । মোটা, বেঁটে, কালো বলে, প্রভাসিনীর দিকে তাকিয়ে দেখতো না কেউ ।


নূপুর, যার ভালো নাম নিশীথ ভট্টাচার্য, চাবাগানের টিলাবাবুর ছেলে, আমার জিগরি দোস্ত । সে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে স্কুলে সদ্য ভর্তি হওয়া এক নাদুসনুদুস মেয়ে, কান্তির প্রেমে । প্রেম যে কি জিনিস, সেই প্রথম জানলাম । কান্তি ক্লাস সিক্স, অথচ দেখতে পূর্ণ যুবতী । কালো, সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ, রবিবাবু নির্ঘাত কান্তিকে দেখেই লিখেছিলেন । আমার ঈর্ষা হতো নূপুরকে, আবার ভালো লাগতো নূপূরের আনন্দ দেখে । নূপূরের প্রেমপত্র লিখে দিতাম আমি আমার সকল আবেগ মিশিয়ে । সে বয়সেই, বাঙলা ভালো লিখতাম, বলে, ক্লাসে আলাদা দাম পেতাম । নূপুর, এ কারণেই, তার প্রেমপত্র লিখতে দিত আমাকেই । এ ছাড়া আর একটা কারণ ছিলো, আমার হাতের লেখা ।


চিঠিতে, আমার মনের কথাই লিখতাম, আমার কামনা-বাসনার কথা, স্বপ্নের কথা লিখতাম । লিখে, আমিই চালান দিতাম তা । পড়ে দেখার সময় ছিলো না। নূপূরের । কেবল উত্তর এলে পড়ে দেখত সে ।

প্রায় ছ-মাস পর, কান্তি আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললো, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো, কই, কোনোদিন বলোনি তো !

মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা আমার । নূপূরের প্রতি ঈর্ষা ছিলো, বলে, কান্তিকে ভালোবাসবো, এটা ভাবিনি কখনও ।

কই, কিছু বললে না যে !

কান্তি--

হ্যাঁ, বলো, আমি তোমার মুখেই শুনতে চাইছি ।

নূপুর তোমাকে ভালোবাসে, আমি নই ।

না, মিথ্যে কথা আর বলো না । আমি সব জানি । ঐ চিঠিগুলো একটাও নূপুর লেখেনি, লিখেছো তুমিই । হাতের লেখাও তোমার । তোমার হৃদয়ের কথা সেগুলো ।

তোতলাতে থাকি আমি । কোনও রকমে তাকে বলি, বিশ্বাস করো, কান্তি, চিঠি লিখেছি নূপূরের কথায়, তার হয়ে । এখানে আমি আজ্ঞাবাহক ব্যতীত আর কিছুই নই ।


না, তুমি মিথ্যে বলছো, তুমি মিথ্যে বলছো । মৃগী রোগীর মত বিড়বিড় করতে করতে, দ্রুত ক্লাসে ফিরে গেলো কান্তি ।

কান্তির এই ঘটনা কোনওদিনই আমি বলতে পারিনি নূপুরকে । এটা কি বলা যায় কখনও ? যদিও পরদিন থেকে কান্তির ব্যবহার ছিলো আগের মত । কেবল নূপূরের সঙ্গে তার মেলামেশা কমে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে ।



আমার নারীরা : ৬৫


পুজোর ছুটির পর, আমাদের স্কুলে,এলেন দুই দিদিমনি । এই প্রথম, দিদিমনি দেখলাম স্কুলে । তাদের ঘিরে আমাদের কৌতুহল আর উৎসাহের সীমা নেই । একজন অপূর্ব সুন্দরী এবং তাকে ঘিরেই আমাদের ফিসফাস, চাপা উত্তেজনা। দ্বিতীয়জন পৃথুলা, শ্যামা এবং স্নেহময়ী । তাঁর অনেকগুলি ভাই, তাদের একজনের নাম সমরজিৎ,বলে, আমাকে স্নেহ করতেন একটু বেশি ।


দীপালি দিদিমনি আমাকে এনে দিতেন তার ভাইদের ব্যবহৃত এবং ফেলে দেওয়া জামাপ্যান্ট । আমার কাছে তা ছিলো পুজোর জামাকাপড় পাওয়ার মত । ঢাউস ঢাউস সেই প্যান্ট দড়ি দিয়ে বেঁধে পরতাম আমি । কোনো কোনোদিন বাড়ি থেকেআনতেন খাবার, টিফিনের সময় ডেকে তার কিছুটা দিতেন খেতে ।


নূপুরের ভাব অন্যরকম । স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রায়শ তাদের কোয়ার্টারে যেতেন টিফিনের সময় । ফলে, তার কাছে রাঙাদি হয়ে গেলেন দীপালি দিদিমনি । জয়ন্তী দিদিমনি হলেন ছোড়দি । জয়ন্তী দিদিমনি পড়াতেন বিজ্ঞান। পড়া দিয়েই উলের সোয়েটার বুনতে লেগে যেতেন । আমি তাঁর আঙুলের দিকে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকতাম । চাঁপা ফুলের কলির মত আঙুলগুলি খুব দ্রুত পাশ বদল করতো, আমার চোখের পলক ফেলার আগেই । আমার বিজ্ঞানপাঠ জয়ন্তী দিদিমনির আঙুল থেকে ক্রমে তাঁর বুকের দিকে এগুতে থাকে।

বহুদিন, রাতে, স্বপ্নের ভেতর সেই আঙুলগুলি ধরেছি আমি ।


একদিন, স্কুল ছুটির পর, নূপুর আমাকে বললো, কান্তি এখন আমাকে আর চিঠি দেয় না ।

কান্তি নূপুরকে আর পছন্দ করেনা, এটা জানতাম । কান্তিই বলেছিলো আমাকে । আমি তখন জয়ন্তী দিদিমনির বিজ্ঞানে মত্ত, কান্তির কথায় গুরুত্ব দিইনি খুব একটা । ফলে, নূপুরের কথার কোনো জবাব দিলাম না আমি ।

আমিও তাকে আর পাত্তা দেবো না  । তার ক্লাসের অনিমা একটা চিঠি দিয়েছে আমাকে । অনিমা অনেক বেশি সুন্দর । ঠিক বলিনি ?

অনিমা সুন্দর নাকের উপর ঐ মোটা তিল বাদ দিয়ে । নূপুর তাহলে অনিমার প্রেমে পড়েছে ? কান্তি জানে তো ?


আমি আর কি বলবো ? নিচু স্বরে বললাম, তোমার খুব পছন্দ বুঝি ?

হুমম । কাল স্কুলটাইমের আগে আসবে অনিমা । ক্লাসের চাবিটা আমাকে দিলে সুবিধে হবে । দেবে ?

আমার কাছে থাকতো স্কুলের চাবি। এখনও দপ্তরিবিহীন আমাদের স্কুল । ফলে, এই ব্যবস্থা করেছেন হেডমাস্টার ।

চাবি দিলাম নূপুরকে । মনে মনে বললাম, নূপুর সাবধানে ! স্কুলে অনেকেই চলে আসে তাড়াতাড়ি । এমনকি কান্তিদের দল আসে দশটা বাজার আগেই । সুতরাং ধরা পড়ার চান্স নব্বুই শতাংশ ।

চা-বাগানের কলঘর পেরিয়ে, একটা বাঁক, কাঠের ব্রীজ ঐ বাঁকে । দেখলাম, ক্লাস সিক্সের একটা ছেলের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কান্তি । 

ছেলেটা আমাকে দেখে সরে গেলো একদিকে ।

তোমার জন্য অপেক্ষা করছি ।

অবাক হবার পালা আমার । কান্তি কেন অপেক্ষা করবে আমার জন্য ? কান্তি আমার কেউ নয় ।

বললো, নূপুরের খবর জানো ? অনিমাকে পটিয়েছে সে । অনিমা সব বলেছে আমাকে ।

অনিমা বলেছে ?

হ্যাঁ । কাল নয়টা নাগাদ অনিমাকে স্কুলে যেতে বলেছে নূপুর ।

কেন ? না বোঝার ভান করি আমি ।

ন্যাকা । কেন, বোঝো না ? তা তুমি বুঝবে কেন ? ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া ছাড়া তো আর কিছুই বোঝো না !

 ক্রমশঃ