Sunday, November 22, 2020

মুজিবের পরিবারকে আশ্রয় দানে ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতবিরোধিতা- খুশবন্ত সিংকে জিয়া

 প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক, লেখক খুশবন্ত সিং ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। 

জিয়ার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল তার দেশে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাব সম্পর্কে।

    অনেক দেয়ালের ওপর স্লোগান লেখা -‘ভারতীয় কুকুর, হঠে যাও’, ‘বাংলাদেশের ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নাও’। 

    আমি জিয়ার কাছে জানতে চাই যে, তিনি তার দেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কোনো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারেন কিনা। 

    তিনি যা বললেন, তা হলো ভারত সরকার কর্তৃক বাঘা সিদ্দিকী ও শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান। 

আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য দায়ী একজনকেও কেন গ্রেফতার করা বা শাস্তি প্রদান করা হয়নি?

     আমার প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না; বরং অধৈর্যের মতো তার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি জানতাম, সাক্ষাৎকারের সময় শেষ হয়েছে।

সেই সন্ধ্যায় আমিই ছিলাম জিয়ার শেষ দর্শনার্থী।

জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত প্রকাশ না করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়ার বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্য উল্লেখ করেছেন খুশবন্ত সিং।

  তিনি যখন জানতে চান বঙ্গবন্ধুর কোনো ঘাতককে কেন গ্রেফতার করা বা শাস্তির বিধান করা হয়নি, তাঁর এ প্রশ্নের জবাবে কোনো মন্তব্য না করে জিয়া অস্থিরভাবে হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন বলে লিখেছেন খুশবন্ত সিং।

শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দু'জনের সঙ্গেই আমার অনেকবার সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার জানামতে শুধু বাঙালি মুসলিম হওয়া ছাড়া তাদের উভয়ের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। 

মুজিবের উচ্চতা ছিল একজন বাঙালির গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি, তাঁর ছিল শরীর মাংসল এবং পরনে থাকত ঢিলেঢালা পোশাক। জিয়া আকৃতিতে খাটো, তার শরীর হালকা-পাতলা হলেও গঠন চাবুকের মতো শক্ত। একবার তার দেহরক্ষী আমাকে বলেছিলেন, ‘তাঁর এক মুষ্টাঘাত কোনো মানুষকে বেহুঁশ করে ফেলতে পারে।’ 

মুজিব অত্যন্ত আন্তরিক, উষ্ণ-হৃদয়ের, বহির্মুখী এবং কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন; জিয়া সুদূরের, গম্ভীর এবং অল্প কথা বলেন। 

মুজিবের দফতর মুঘল আমলের প্রাচ্যদেশীয় দরবারের মতো : কয়েক ডজন মানুষ কার্পেটের ওপর, সোফা ও চেয়ারের ওপর ছড়িয়ে বসে থাকে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ একটির পর একটি টেলিফোন বাজে; তিনি ফোনে কথা বলার পাশাপাশি উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যিনিই তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তার সঙ্গে কথা বলছেন এবং তাঁর সামনে টেবিলে রাখা কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছেন। পুরো বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ।

 জিয়ার অফিস তার মতোই শীতল। ওয়েটিং রুমে তাঁর সচিব ও নিরাপত্তা কর্মীরা বিচক্ষণতার সঙ্গে আপনাকে মার্জিত কথাবার্তার মধ্যে ব্যস্ত রাখেন এবং তাদের সতর্ক দৃষ্টি খুঁজে ফিরে আপনার কাছে কোনো গোপন অস্ত্র আছে কিনা। 

 একসঙ্গে একজনের বেশি দর্শনার্থীকে তিনি স্বাগত জানান না এবং সময় মেনে চলেন স্টপওয়াচের মতো। 

 জিয়ার রুমে হুট করে অঘোষিতভাবে প্রবেশ করার সাহস কারও নেই। 

 কোনো টেলিফোনও বাজে না।

 আপনার প্রশ্নগুলো বাতাসে জমে থাকবে; 

 জিয়াউর রহমানের নির্দিষ্ট-পরিমিত উত্তর আপনার জমাট প্রশ্নগুলোকে গলাতে পারবে না।

 মুজিব আপনাকে আলিঙ্গন করবেন এবং দ্বিতীয় সাক্ষাতে আপনার তাঁর ‘পুরনো বন্ধু’ বলে সম্বোধন করবেন। 

 জিয়া তার শীতল হাতে আপনার সঙ্গে হাত মেলাবেন এবং চিনতে পারার স্বীকৃতি হিসেবে অস্পষ্ট, ম্লান হাসবেন। 

 মুজিব নিজের সম্পর্কে স্বয়ং তৃতীয় পুরুষে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছেন’, এবং আপনার কাছেও অনুরূপ সম্বোধন আশা করবেন। 

জিয়া কখনো তার মুখ খোলেন না, অথবা তার সঙ্গে কাউকে খুব ঘনিষ্ঠ হতে দেন না।

 তিনি সবসময় ‘মিস্টার’, ‘প্রেসিডেন্ট,’ ‘স্যার’ ছিলেন।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করার দুই বছর পর তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

 সামরিক একনায়কদের ব্যাপারে আমার আপত্তি ও নেতিবাচক মনোভাব ছিল এবং এমন একজনের প্রতি ভিন্ন ধরনের বিতৃষ্ণা ছিল, যিনি মুজিবের ঘাতকদের শাস্তি বিধান করার পরিবর্তে তাদের কূটনৈতিক দায়িত্বে ন্যস্ত করার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছিলেন। 

 তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে অতিবাহিত করা সপ্তাহে ঢাকার পরিবেশের যতটুকু দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তাতে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি।

  মাত্র কয়েক বছর আগেও যে এলোমেলো নগরীতে বিরাজ করছিল চরম বিশৃঙ্খলা, সেখানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় গড়ে ওঠা শপিং সেন্টার ও মার্কেটগুলো দেখে সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট লক্ষণ বোঝা যায়। 

  দেশটিতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ঢাকার বাইরে পল্লীগুলোকে আরও সবুজ, আরও পরিচ্ছন্ন এবং আমি আগে যেমন দেখেছি তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী মনে হয়েছে।

   আমি জিয়াকে একথা বলার পর তাকে অত্যন্ত সন্তুষ্ট মনে হয় এবং তিনি তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের সময় প্রলম্বিত করেন। 

  করিডোর দিয়ে আমার কয়েক গজ সামনে বিশালদেহী দু'জন দেহরক্ষীর অবস্থানের মাঝখান দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। 

 তখনই আমি লক্ষ্য করলাম যে আকৃতিতে তিনি কতটা খাটো ছিলেন- পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। জিয়া হাই-হিল জুতা পরতেন।

(খুশবন্ত সিং এর ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য রিডিকুলাস’ থেকে)