Monday, December 22, 2014

সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় মঙ্গলবার

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় জানা যাবে ২৩ ডিসেম্বর,২০১৪, মঙ্গলবার।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়ের মতো ১৬টি অভিযোগে অভিযুক্ত মুসলিম লীগের সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায় দিতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর এই রায় ঘোষণা করবে। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-  বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম।সাক্ষ্য, জেরা ও দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল।
 মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী পাঠান। সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং কায়সার বাহিনীর লোকেরা মাধবপুর বাজার এবং কৃষ্ণনগর গ্রামে ১৪ থেকে ১৫ জনকে হত্যা করে। ওইদিন বিকেলেই তিনি বাড়ির পূর্ব-উত্তর দিকের চার গোপাটে তার বাবাসহ আরো তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পাশের জমি থেকে মাটি আর ইট পাথর এনে বাবার লাশটি তিনি মাটিচাপা দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবার লাশের হাড়গোড় উঠিয়ে এনে পারিবারিক কবরস্থানে পুনরায় সমাহিত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষ্য গ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
মোহাম্মদ আলী পাঠান আদালতে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে মাওলানা আছাদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সিও অফিসের সামনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি। একই সাথে থানার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওইদিন মাধবপুরের জগদিশপুর উচ্চ বিদ্যালয়েও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। আর এ নিয়ে পরদিন কায়সার বাহিনীর লোকদের সঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের বাকবিতন্ডা হয়েছিল বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিলের পর যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল তখন আমরা জানতে পারলাম ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সৈয়দ কায়সার ছিলেন সেই শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য। মৌজপুরে থাকা অবস্থায় ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে খবর পাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও কায়সারের লোকেরা আমার পিতা ওহিদ উদ্দিন পাঠানসহ আরো অনেককে হত্যা করেছে। বাবাকে মেরে ফেলার পর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আব্দুল কুদ্দুস মাখন তাকে মাধবপুর থেকে আগরতলার কলেজ টিলায় নিয়ে যান। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাকে হাপানিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ট্রেনিং শেষে নভেম্বরে ১১নং সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫-২০ দিন পর ঢাকা থেকে মাধবপুরের বাড়িতে আসেন মোহাম্মদ আলী পাঠান। এলাকায় এসে মানুষের আহাজারি শুনতে পান। তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন কায়সার বাহিনী এবং পাকিস্তানী সেনারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বলেও তিনি তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন।সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষীকে সংক্ষিপ্ত জেরা করেন আসামীর আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার।
সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালাতেন। পরে স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি আত্মগোপন করেন।
 
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সারসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীএই। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে তিনি বিএনপিতে যাগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন।এরশাদের সময়ে তিনি যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন।

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টা থেকে ৩টার মধ্যে সৈয়দ কায়সার তার কায়সার বাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর থানা এলাকায় যায়। কায়সারের নির্দেশে ইসলামপুর থানার সামনে জনৈক শাহজাহান চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। একইদিনে একই থানাধীন কাজীবাড়ী এলাকায় নায়েব আলী নামে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজনকে নির্যাতন করা হয়। পরে কাজীবাড়ী এলাকার ১৫টি ঘরবাড়ি লুটপাটও অগ্নিসংযোগ করা হয়।এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বিকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে সৈয়দ মো. কায়সার তার কায়সার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানা এলাকায় মাধবপুর বাজারের পশ্চিম পাশে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায়। একইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারা বাজারে ১৫০টি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুটপাট করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কামিনী রায়, বিনোদ বিহারী মোদক, শচীন্দ্র রায়, হীরেন্দ্র রায়, রতি বাবু, অহিদ হোসেন পাঠানের সম্পত্তি আগুন দিয়ে ধ্বংস করে। এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিলহবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর বাজার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর গ্রামে হামলা চালায় সৈয়দ মো. কায়সার, তার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেখানে অন্তত ৫৫টি ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কায়সারের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অহিদ পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে গুলি করে হত্যা করে।এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটার মধ্যে আসামি সৈয়দ মো. কায়সার, তার ‘কায়সার বাহিনী’র ১০/১৫ জন সদস্য এবং ৩০/৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে মাধবপুর বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে হামলা চালায়। তাদের ছোড়া এলোপাতারি গুলিতে সাত্তার, বরকত আলীসহ ১৫জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। একইসঙ্গে দেড়শ থেকে দুইশ বাড়িঘর ও দোকানপাট লুটপাট করে পুড়িয়ে দেয় তারা।
এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের  ২৯ এপ্রিল দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, রেজাউল করিম, আব্দুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আব্দুল আলী ওরফে গ্যাদা উল্লাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
সাতজন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনার পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
দুইজন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনায় পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে  সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৭: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৮: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
এ ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আব্দুল আলীকে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এদিন আকরাম আলী চৌধুরী (বর্তমানে মৃত) নামে একজনকে জখমও করেন সৈয়দ কায়সার।
নয়জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনায় পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে  সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১০: এরপর ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় নির্যাতন।
এ ঘটনায় হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার নাসিরনগরের গোলাম রউফ মাস্টার ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এছাড়া গোলাম রউফ মাস্টারকে অপহরণ ও আটকের পর তার ওপর নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ আদায় করে তার বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এছাড়া একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। লুটপাটের পর ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১২: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী অগাস্টের মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
এ ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৩: ১৯৭১ সালের ১৮ অগাস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আব্দুস শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। অপহৃতদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৪: ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আব্দুল ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৫: অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৬: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
এ ঘটনায় গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 

Tuesday, December 16, 2014

যারা এনে দিলেন স্বাধীন দেশ আর জাতীয় পতাকা -বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম -সুমি খান

আজ মহান বিজয় দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম তাঁদের প্রতি যারা এনে দিলেন স্বাধীন দেশ আর জাতীয় পতাকা! প্রথমত: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান , তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -এ দেশের তিরিশ লাখ শহীদ, তিন লাখ ধর্ষিতা নারী  এবং কিংবদন্তী নেতা জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গান্ধী ,রুশ রাষ্ট্রনায়ক  ব্রেজনেভ!পরাজিত পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করার জন্যে মাইন পুঁতে রেখে গিয়েছিলো।সেসব মাইন তুলতে গিয়ে ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে পতেঙ্গা সৈকতে নিহত  হন রাশিয়ান নাবিক ইউরি র‍্যাডকিন। আহত হন অনেকে।নিহত আহত প্রত্যেকের প্রতি আমার হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই আজ। আমার বিনম্র সালাম ভারতীয় যোদ্ধা জেনারেল মানিকশ'সহ অসংখ্য ভারতসেনানী - যারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে ! বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষকে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে ত্রিপুরা এবং কোলকাতায় অন্ন বস্ত্র বাসস্থান দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন যাঁরা সেই মহামানবদের আমার সালাম। মুক্তিকামী জনতাকে সাথে নিয়ে ১৬ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাঙ্গালী পরাজিত করেছিলো পাকিস্তানী নরঘাতকদের!উইকিপিডিয়া থেকে দুই প্যারা তুলে দিলাম বন্ধু দের জন্যে।
The Indo-Pakistani War of 1971 was the direct military confrontation between India and Pakistan during the Bangladesh Liberation War in 1971. Indian, Bangladeshi and international sources consider the beginning of the war to have been Operation Chengiz Khan, when Pakistan launched pre-emptive air strikes on 11 Indian airbases on 3 December 1971, leading to India's entry into the war of independence in East Pakistan on the side of Bangladeshi nationalist forces, and the commencement of hostilities with West Pakistan.[19][20] Lasting just 13 days, it is considered to be one of the shortest wars in history.Historical events During the war of liberation in 1971, the freedom fighters (naval commandos) conducted a number of attacks from Chittagong port.Many foreign ships were damaged due to bomb explosions. Pakistan army, on the verge of their defeat, planted mines in the port area in order to deadlock the port. After 16 December 1971, the then Soviet Naval Forces came here to clear mines. Several Soviet marines were killed in this mine removal operation.
During the course of the war, Indian and Pakistani forces clashed on the eastern and western fronts. The war effectively came to an end after the Eastern Command of the Pakistani Armed Forces signed the Instrument of Surrender,[23] on 16 December 1971 in Dhaka, marking the liberation of the new nation of Bangladesh. East Pakistan had officially seceded from Pakistan on 26 March 1971.
 Between 90,000 and 93,000 members of the Pakistan Armed Forces including paramilitary personnel were taken as Prisoners of War by the Indian Army.[24][25] It is estimated that between 300,000 and 3,000,000 civilians were killed in Bangladesh.[26][27] As a result of the conflict, a further eight to ten million people fled the country at the time to seek refuge in neighbouring India.[28]

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী


Monday, December 15, 2014

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতী এবং পড়ার সুখ! -রুদ্রাক্ষ রহমান

পড়ার সুখে যাকে একবার পেয়ে বসে তার পক্ষে অন্য কিছু করা মোটেও সুখকর হয়ে ওঠে না। অবশ্য এটা মানতেই হয় পড়তে না জানলে, নিয়মিত পড়ার অভ্যাস না থাকলে ভালো কিছু আয়ত্বে করা যায় না। যে পড়েছে, সেই এগিয়ে গেছে তার সময় এবং তার সময়ের মানুষদের থেকে। নিজে না পড়লে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াবেন কী শিক্ষক!

বন্ধুদের আড্ডায় সেই প্রাণভোমরা হয়ে ওঠে যে একটু বেশি জানে। অন্যরকম জীবনের জন্যে তাই পড়াটা অন্তত জরুরি। আমাদের এই ভূখন্ডে এখন হেমন্ত চলছে। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে এখন নতুন ফসলের সমারোহ। পাকাধানের ছড়ার মৃদু-মন্দছন্দতোলা বাতাস এখন মাতিয়ে দিচ্ছে চারদিক। কৃষকরে মাঠ থেকে গোলায় উঠছে সোনার ধান। নতুন ধান আর পিঠার গন্ধে নবান্নের বাতাস এখন গ্রামের ঘরে ঘরে। রাতের আকাশ থেকে শিশির পড়া শুরু করেছে। শীতের আগমন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে গ্রামের প্রকৃতিতে। এমনি হেমন্ত আর দুরন্ত শীতের সকালে উঠানে খেজুরপাতার পাটি পেতে এদেশে পাঠের অভ্যাসটা তৈরি হয় সেই ছেলে বেলায়।

আর হেলে দুলে ছন্দপড়ার সময় থেকে সেই যে পাঠের আনন্দ তৈরি হয় বুকের ভেতর তা কোনওদিন তা ফুরিয়ে যায় না। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ অথবা ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়রা/ ফুলতুলিতে যাই’, অথবা ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে/ ছাতিম তলায় কে/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ সোনামনির বে’ দিয়ে সেই যে পড়ার শোনা তা গেঁথে যায় বুকের গভীর তলে। নানা কারণে হয়তো তা কিছু দিরে জন্যে চাপা পড়ে যায় তবে ফুরিয়ে যায় না চিরদিনের জন্যে। আর একটা বই পড়ার মধ্যে কেবল আনন্দই থাকে না, থাকে অনেক কিছু। ধরা যাক একটা উপন্যাস, সেখানে একটা সময় থাকে, কতগুলো চরিত্র থাকে। সব কেমন প্রাণময় হয়ে চলে আসে অন্য এক সময়ের পাঠকের সামনে।

 বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় এক নির্মাতার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক ‘পথের পাঁচালী’র জন্যেই তিনি অমর জায়গা করে নিয়েছেন কেবল বাংলা নয়, বিশ্ব সাহিত্য আসরে। সাদা-সিধে এই মানুষটি ছিলেন প্রকৃতির পূজারী। ‘ইছামতী’ নামে তার একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ৬ মাঘ ১৩৫৬ সালে। প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলিকাতা-১২। বইটার দাম ছিলো ৮ টাকা। ঠিক ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত বইটি ১৯৫০-৫১ সালের রবীন্দ্র পুরস্কার অর্জন করে নেয়। ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত ইছামতীর ঘটনাকাল আরও আগের, বাংলা ১২৭০, ইংরেজি ১৮৬৩। বিভূতি সেই কালের বর্ণনা করেছেন এভাবে‘১২৭০ সালের বন্যার জল সরে গিয়েছে সবে। পথ ঘাটে তখনও কাদা, মাঠে মাঠে জল জমে আছে। বিকেল বেলা ফিঙে পাখী বসে আচে বাব্লা গাছের ফুলে-ভর্তি ডালে।’ ৩৭৬ পৃষ্ঠার একটি বই পড়তে অনেক কষ্ট হয়, সময় বার করতে হয় আর মনোযোগেরও দাবি রাখে। তবে কথা হলো ওই যে, নেশা বা আনন্দ।

বিভূতিভূষণের লেখা পড়লে বোঝা যায় মাত্র ১০০ বছর বা তার কিছু আগে আমাদের গ্রাম বাংলার অবস্থা কেমন ছিলো। জাত-পাতের শেকলে আটকে পড়া সাধারণ হিন্দু পরিবারের কথা বাদ দিয়েই ব্রাক্ষণদের অর্থনৈতিক অবস্থাও যে ভালো ছিলো না তার ছবি ফুটে উঠেছে বিভূতির কলমের আঁচড়ে।

দেশে তখন চলছিলো ইংরেজ শাসন। তখন ইংরেজ সাহেবদের দেখলে সাধারণ মানুষ কেবল পথই ছেড়ে দিতো না, রীতিমত পালাত। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো এঅঞ্চলের কিছু মানুষ, তারা ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের অবস্থা ভালো করার জন্যে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতো, এমনকি খুনও। ইছামতীতে ইংরেজদের নীল চাষের সেই নিষ্ঠুর অধ্যায় ধরা পড়েছে ভেতর থেকে। আবার এই উপন্যাসে ইংরেজ এবং তাদের তাবেদার এদেশীয় দেওয়ানদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ফুঁসে ওঠার বর্ণনাও আছে। মোল্লাহাটির নীলকুঠির বড় সাহেব পথ দিয়ে যাবেন বলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, মাথায় মোট নিয়ে হাটে হাটে ঘুর বেড়ানো নালু পাল সব ফেলে রেখে ফসলের ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলো। কালক্রমে সেই নালু পাল যখন ওই এলাকাল সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে, আর নীলকুঠির আলো একটু একটু করে নিবতে থাকে, তখন সেই নালুর কাছেই বিক্রি করতে হয় ওই কুঠি।

 বাংলার পথে পথে, জনপদে ইংরেজ সাহেবরা তখন বাঙালি দেওয়ান আর সঙ্গে চাবুক নিয়ে ঘুরতো। সাহেবী চাবুকের তেজ আর আঘাত এমনি নিষ্ঠুর ছিলো যে মানুষ নাম দিয়েছিলো ‘শ্যামচাঁদ’। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের গায়ে সেই শ্যামচাঁদের ঘা পড়তো যখন-তখন, পান থেকে চুন খসলেই। কত কষ্ট, কত লাঞ্ছনা, অপমান আর সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের। ইংরেজ শাসনের পাঠ চুকেছে ১৯৪৭-এ। পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক দুঃশাসনকে আমরা পরাজিত করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। সুদীর্ঘকালের অভাবের ছায়া, উত্তরাধিকার তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ছেড়ে যায় নি। খুব বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র ৩৫ বছর আগেও আমি এই বাংলাদেশে পদ্মার তীরের মানুষদের কষ্ট দেখেছি। ভরা বর্ষায় অনেকের হাড়িতে ভাত জুটতো না। আলু শাকের সঙ্গে একটু চিংড়ি মাছের মিশেলে দুবেলার আহার হতো। অনেকে কেবল লবন দিয়ে আটা সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়েছে তখন।


 দিন কত বদলেছে! আমরাই বদলে দিয়েছি সব। এখন, এই বাংলাদেশে কারো ঘরে ভাতের অভাব আছে এমন কথা শোনা যায় না। ধনি-দরিদ্রের ব্যবধানের রেখাটা হয়তো আরও মোটা হয়েছে, হয়তো ‘মধ্যবিত্ত’ নামের অসাধারণ অহমের ঐতিহ্য আমরা হারিয়েছি, তাই বলে এখন আর কেউ ভাতের অভাবে মরছে না। আজ থেকে ৫০ বছর আগের বাংলাদেশ, ৪০ বছর আগের বাংলাদেশ এবং এসময়ের বাংলাদেশ নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ লিখেছেন, লিখছেন। এসব সময়, এসব সংগ্রামের কথা নিশ্চয়ই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা থাকবে। আগামী দিনের কোনও এক পাঠক পুরো বইয়ের পাতায় খুঁজে পাবে তার বাংলাদেশকে। যেমন আমি খুঁজে পেলাম ১৫১ বছর আগের বাংলাদেশকে ‘ইছামতী’র পাতায় পাতায়। অর্ধশতাব্দীরও আগে প্রকাশিত বই। সাবধানে ধরতে হয়, নইলে খুলে যায় সেলাই, খসে পড়তে চায় কাগজ! আর সময় যে কীভাবে বইয়ের পাতায় চুপটি করে বসে থাকে তার একটু প্রমাণ দেয়া যাক ইছামতী থেকে।
‘ গ্রামের সকলেই নালু পালকে ভালোবাসে। সকলেই তাকে ভালো ভালো কথা বলে গেল। শম্ভু রায়(রাজারাম রায়ের দূর সম্পর্কের ভাইপো, সে কলকাতায় আমুটি কোম্পানীর হৌসে নকলবিশ) বললে, চলো নালু, আমাদের সঙ্গে সোমবারে কলকাতা, উৎসব হচ্চে সামনের হপ্তাতে খুব আনন্দ হবে, দেখে আসবা রেলগাড়ি খুলেচে হাওড়া থেকে পেঁড়ো বর্ধমান পজ্জন্ত, দেখে আসবা
  রেলগাড়ি জানি। আমার মাল সেদিন এসেচে রেলগাড়িতে ওদিকের কোন জায়গা থেকে। আমার মুহুরী বলছিল।
দেখেচ?


 কলকাতায় গেলাম কবে যে দেখবো?
 চলো এবার দেখে আসবা।
ভয় করে, শুনিচি নাকি বেজায় চোর জুয়োচোরদের দেশ।’
তারপর নালুপাল স্ত্রী তুলসীকে নিয়ে কলকাতা দেখতে গিয়ে ভীষণ এক অভিজ্ঞতা পেলো। গড়ের মাঠে গিয়ে দেখল সাহেবরা বেত হাতে করে সামনের লোকদের মারতে মারতে নিজেরা বীরদর্পে চলে যাচ্ছে। ভয়ে লোকজন পথ ছেড়ে দিচ্ছে। নালু পালের স্ত্রীর গায়ে এক ঘা বেত লেগেছিল। বিভূতি বর্ণনা করছেন, ‘পেছনে চেয়ে দেখে দুজন সাহেব আর একজন মেম, দুই সাহেব বেত হাতে নিয়ে শুধু ডাইনে বায়ে মারতে মারতে চলেচে।… নালু পাল কলকাতায় বাজার করতে গিয়ে দেখল দুধের সের এক আনা ছ’ পয়সা। তাও খাঁটি দুধ নয়, জল মেশানো’। সেময়ের কলকাতার নিষ্ঠুরতা আর বাজারের চড়া পণ্যমূল্য দেখে নালু পাল অবাক হয়েছিলো। আর বিভূতির লেখায় পাওয়া গেলো কলকাতার দুধে তখনিই পানি মেশানোর ঘটনা। আর কলকাতার ঘি যে খাঁটি ছিলো না তার কথা আছে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জবানীতে।


 ইছামতী না পড়লে জানাই হতো না দেড়শ’ বছর আগে ইছামতী নদীর দুপারের মানুষের সেই জীবন কথা। আর যদি বিভূতিভূষণ না লিখতেন এই উপন্যাস তাহলে প্রকৃতি ফুটে উঠতো না এমনি করে। উপন্যাস শুরুর আগে একটু ভূমিকা আছে। সেখানে বলা হয়েছে‘ ইছামতীর যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশটুকুর রূপ সত্যিই এত চমৎকার, যারা দেখবার সুয়োগ পেয়েচেন, তারা জানেন। কিন্তু তারাই সবচেয়ে ভালো করে উপলব্ধি করবেন, যারা অনেকদিন ধরে বাস করচেন এ অঞ্চলে।’


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাছি, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বাদ দিলে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, তাদের গল্প তেমন করে ধরা পড়েনি আর কোনও উপন্যাসে।
 বিভূতিভূষণ ইছামতীর দুই তীরের মানুষগুলোকে দেখেছেন আপন করে। তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। পিতা সম্পর্কে বিভূতিপুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমার পিতৃদেব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির একনিষ্ঠ উপাসক হিসেবে বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যে অনন্য আসনের অধিকারী। বর্ষণক্ষান্ত শ্রাবণসন্ধ্যায় গ্রাম্য নদী ইছামতীর তীরে সারিবদ্ধ সাঁইবাবলা গাছ, ঘেঁটুফুলের কটুতিক্ত ঘ্রাণে ভারাক্রান্ত বসন্ত অপরাহ্নের মন্থর বাতাস, উদাস দ্বিপ্রহরে নির্জন বাঁশবনে বউ-কথা-কও পাখির ডাক, ধুলোয় ভরা পথের বাঁকে ফুটে থাকা অনাদৃত বুনোফুল এসমস্ত বিভূতিভূষণের সাহিত্য নিজের অনাড়ম্বর সারল্যের প্রভাবে জনচিত্তে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছে’। বিভূতিভূষণের ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প’-র( প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল, পত্রপুট, ৩৭/৯ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা) প্রারম্ভিকীতে আছে কথাগুলো।


 আর ইছামতীতে আছে অনেক মানুষের অনেক গাঁথা। উপন্যাসের এক সাহসী চরিত্রের নাম নিস্তারিণী। অনেক নিয়ম ভাঙা এই নারী তখনি স্বামীকে ঘরে রেখে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়ে, তার সঙ্গে জঙ্গলে অভিসারে বেরোয়। একা একা পথে বেরোয়, নদীতে নামে, আর নদীতে ডুব দিয়ে পেয়ে যায় এক অবাক ঝিনুক যার ভেতরে ছিলো একশ টাকার মুক্তো। এখন যার মূল্য লাখ টাকা। এই নিস্তারিণীর কণ্ঠে ইছামতী তীরের বউ-ঝিরা শুনে ভীষণ এক প্রেমের গান।


‘ভালবাসা কি কথার কথা সই
 মন যার মনে গাঁথা
 শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িত লতা
প্রাণ যার প্রাণে গাঁথা।’


আর বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতীর উপসংহারে লিখেন, ‘আজকার এই যে সঙ্গীত, জীবজগতের এইপবিত্র অনাহুত ধ্বনি আজ যেসব কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্চে পাঁচশত কি হাজার বছর পরে সেসব কণ্ঠ কোথায় মিলিয়ে যাবে! ইছামতীর জলের স্রোতে নতুন ইতিহাস লেখা হবে কালের বুকে।’


কালের বুকে অনেক কিছুই লেখা হবে, অনেক কিছুই হয়তো হবে না। আজকের এই সময়ের অনেক কিছুই হয়তো আগামীর মানুষরা জানবে না, তবে কিছু কিছু তো জানবে। তাই কাউকে না কাউকে কালের কথা, কালের গাথা লিখতে হয়, যেমন লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, কাজি নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে একালের হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শামসুর রাহমান। আর পাঠকের হাতে হাতে সেই লেখা পৌঁছে যাচ্ছে কাল থেকে মহাকালে।


 রুদ্রাক্ষ রহমানঃ গল্পকার

Sunday, December 7, 2014

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার :৯০তম জন্মদিনে প্রণতি

বাংলা গানের অবিস্মরণীয় জুটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং শিল্পী মান্না দে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তার সেই বিখ্যাত গান ‘শোন একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ...।’তার লেখা এ গান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে লক্ষ প্রাণে শিহরণ বইয়ে দিত। অনুপ্রেরণা যোগাত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিপাগল বাঙালির হৃদয়ে।
‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই।  ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। 
‘বধূয়া, এই মধুমাস বুঝিবা হলো বিফল’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো’ এমন শত শত গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- গানটি কালজয়ী হয়ে ওঠে সংগীতশিল্পী মান্না দের কণ্ঠে। গানটি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীতশিল্পী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ৫ ডিসেম্বর বরেণ্য এই গীতিকারের ছিল ৯০তম জন্মদিন। প্রণতি রইল তার প্রতি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সালে উল্লিখিত দিনটিতে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ। শৈশবে কলকাতা চলে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। থিতু হয়েছিলেন পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায়। এ সময় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। কিন্তু মনের গহীনে যিনি শিল্পীসত্তা বহন করে চলেছেন তিনি তো সুযোগ পেলে সেদিকেই মন দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পাবনার আরেক কৃতিমান সাহিত্যিক, গীতিকবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। কিন্তু গানের ফুল ভালো করে ফোটার আগেই ১৯৫১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা চলে যান। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। 

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শুধু যে দ্রোহের গান লিখেছেন তা তো নয়। প্রেম, বিরহ, মানবতা, বিজয়ের গানও লিখেছেন  তিনি। তার বহু গান এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এখনও বেজে ওঠে খ্যাতিমান শিল্পীদের কণ্ঠে। এরমধ্যে শিল্পী মান্না দের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। তার লেখা গান কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর কণ্ঠে অমরত্ব পেয়েছে। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, একি বেদনার মতো বেঁধেছি আবার হারানো দিন’- মান্না দের কণ্ঠে গৌরীবাবুর এই গানগুলো এখনও হৃদয়ে ঝড় তোলে অনেকের। এমন অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের বাণী তিনি লিখেছিলেন সে সময়। 
১৯৩৭ সাল। পাবনা শহরের গোপালপুর লাহিড়ী পাড়ার মৈত্রবাবুর নাতনি পদ্মার বিয়ে। বরযাত্রী কলকাতা থেকে এসেছে । বরযাত্রীর সঙ্গে ঢেঙ্গা-পটকা লিকলিকে একটি ছেলেকেও দেখা গেল। গায়ে তার অদ্ভুত জামা। জানা গেল জামাটির নাম ‘বড়ুয়া জামা’। তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার জামার আদলে বানানো। আরো জানা গেল ছেলেটি কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই ছেলেটিই  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ওরফে বাচ্চু মজুমদার। ‘বাচ্চু’ ছিল তার ডাক নাম। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। যদিও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার লেখা গান প্রথম রেকর্ড হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যায় প্রথম গান- ‘ আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো, ঘুমায় মেঘ তারা…।’

১৯৭২। স্বাধীন দেশ। ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার  ঢাকায় এলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই মনে পড়ল জন্মস্থানের কথা। ছুটে এলেন কৈশরের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা দেখতে। শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত গীতিকবিকে দেওয়া হলো সংবর্ধনা। সেদিন মঞ্চে ছিলেন সহপাঠী ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যক্ষ কবি আবদুল গনি। শচীন দেব বর্মনের হাতেই বাচ্চু মজুমদার থেকে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়। একে একে রচিত হতে থাকে কালজয়ী সব গান- ‘আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি, রুধিবে রাঙানো আমি তীর বেঁধা পাখি।’ 

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তিনি সংগীতে মন সপেছিলেন। গান লিখি দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’এ রকমই ছিল তখনকার সৃষ্টিশীল মানুষের মন ও মনন। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড আজও বাজে বাংলার কোনো না কোনো ঘরে।
-

Saturday, December 6, 2014

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয় আজ কেন বিপন্ন-কামাল লোহানী


শনিবার  ২৫ আগস্ট, ২০১২আমরা একজন সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের, দিন ক্ষণের। নিজেকে গর্বিত মনে হয় অমন দৃশ্যকে ভাষায় রূপান্তরিত করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সারা বিশ্বের অগণিত শ্রোতার কাছে বাংলার কিংবদন্তি নেতার স্বদেশ ফেরার কাহিনী তুলে ধরতে পেরেছিলাম। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সর্বতভাবে সহযোগিতা করেছিল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। আমেরিকা তো সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল। কিন্তু সেদিন যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দৃঢ় সংকল্প আর মুক্তিফৌজের অদম্য মনোবল মার্কিনী চক্রান্তকে সেদিন হতাশ করে দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ না করত তবে আমরা কি পারতাম মার্কিন চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? তবু যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে নিজেদের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছেড়ে না দিয়ে ইসরাইলের মতো যুদ্ধোন্মাদ দুষ্টক্ষতকে লেলিয়ে দিয়েছিল মুক্তিকামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৌশলে মার্কিনী চক্রের খবরদারির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা যেন লক্ষ্যে পেঁৗছতে না পারি এবং ওরা যেন নিজেদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপট দিয়ে নব্য রাষ্ট্রের ওপর খবরদারি করতে পারে তার জন্য কনফেডারেশন তত্ত্বক জাল বিছিয়েছিল '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন। মুক্তিকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে মার্কিনী পুতুলের ভূমিকায় কাজ করে আসছিলেন যে খোন্দকার মুশতাক সেই আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রবাসী সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবেই স্থানীয়ভাবে 'এজেন্ট' এর কাজ করে যাচ্ছিল। মার্কিনীদের হুকুম তামিল করাই ছিল তার কাজ। যে আমেরিকান স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে চলেছিলেন, তিনিই একদিন সফল হলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। 
একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় বাংলাদেশ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এ পর্যায়ে অতীব উদ্দীপনামূলক ঘটনা ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্ত স্বদেশে ফিরে এলেন পাকিস্তান জেল থেকে তখন তিনি সোজা লন্ডন হয়ে দিলি্লতে স্টপওভার করে চলে এলেন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের বিধ্বস্ত রাজধানী ঢাকায়। এই দিন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দোল্লাসের দিন। এই দিনেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বৃটিশ হাওয়াই জাহাজের সিঁড়িতে ফুলেল সংবর্ধনা জানালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর বুকে পড়ে অঝোরে আনন্দাশ্রু ঝরাতে থাকলেন। কিন্তু রানওয়েতে হুইল চেয়ারে অপেক্ষমান ছিলেন শেখ মুজিবের গণিত পিতা শেখ লুৎফর রহমান। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। পিতৃস্নেহে আপ্লুত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অবর্ণনীয় আবেগে পিতাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবারে ঝর ঝর করে ঝরতে থাকল বঙ্গবন্ধুর চোখের জল।
আমরা চারজন_ বাংলাদেশ বেতারের আমি এবং আমার যুদ্ধের সাথী ও স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক আশফাকুর রহমান খান ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে দিলি্ল থেকে এসেছিলেন আকাশবাণীর প্রধান সংবাদপাঠক ও ধারাভাষ্যকার সুরজিত সেন, হিন্দি সার্ভিসের সংবাদ পাঠক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার যশদেব সিং এবং কলকাতা আকাশবাণীর জনপ্রিয় সংবাদপাঠক ও আবৃত্তিকার দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তেজগাঁও বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের দোতলার পশ্চিম কোণার ছাদে দাঁড়িয়ে সরাসরি সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করছিলাম। ১৭ পৃষ্ঠার পর
গোটা বিমানবন্দরটাই আমাদের চোখের সামনে ভাসছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম সবই। তাই সেদিনের স্মৃতিবিজড়িত অপরূপ দৃশ্যাবলী আজও চোখে ভেসে ওঠে স্বপ্নের মতো। 
আমরা একজন সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের, দিন ক্ষণের। নিজেকে গর্বিত মনে হয় অমন দৃশ্যকে ভাষায় রূপান্তরিত করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সারা বিশ্বের অগণিত শ্রোতার কাছে বাংলার কিংবদন্তি নেতার স্বদেশ ফেরার কাহিনী তুলে ধরতে পেরেছিলাম। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
সেদিন ঢাকা শহরের যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা আগেও দেখেছিলাম বহুবার কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ একটি অনির্বচনীয় আনন্দাশ্রু চোখে উজ্জ্বল যে মুখচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম সব মানুষের মনে তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু হৃদয়ের ক্যানভাসে ছবিটি অাঁকা হয়ে গেছে, তা মুছে ফেলার নয়। চির জাগরুক থাকবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মানসিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করেছি জীবনভর কিন্তু যে কোনো গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির অসম উত্থানের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। যখন মুক্তিযুদ্ধ নামের সংগ্রামের নতুন পর্যায় শুরু হয়েছিল তখনো রাজনৈতিক সংকীর্ণ মানসিকতা লক্ষ্য করেছিলাম আওয়ামী ঘরানার মধ্যে। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক অকল্পনীয় জনপ্রিয় এবং অবিসংবাদিত যখন নেতৃত্ব। মনে করি সেই ১৯৪৯ সালের কথা। যখন জুন মাসে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তৎকালীন পাকিস্তানে পশ্চিমা জমিদার-জোতদারদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সাম্প্রদায়িক দল ছেড়ে শাসকশ্রেণী-মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রথম বিরোধী রাজনীতির পত্তন করেছিলেন। সৃষ্টি করলেন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। তাই পূর্ববঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে আছেন মওলানা ভাসানী। মনে হয় সেদিনের পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল খুবই কঠিন। কারণ তাদের ভিত্তি ছিল ধর্মান্ধতা আর পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে পূর্ববঙ্গের মুসলিম ভোট সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। সে কারণে ধর্মভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সফল হলেও যাদের হাতে ক্ষমতা গেল সেই মুসলিম লীগ ও তার নেতাদের বৈমাত্রেয় আচরণে দেশভাগের ক'দিনের মধ্যেই ওদের কপট চরিত্র প্রকাশ পেল। নতুন রাষ্ট্রের বিধি-বিধানে পূর্ববঙ্গকে উপেক্ষা-অবহেলার কুৎসিত এবং উদ্ভট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু হলো। প্রথমেই আঘাত নেমে এলো আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর, আমরা প্রতিরোধ করলাম জীবন বিসর্জন দিয়ে। সেই যে শুরু তার কিছুদিন পরেই মার্কিন আগ্রাসন যেন ক্রমেই বিষাক্ত দংশনে পরিণত হতে থাকল। পঞ্চাশের দশকেই ওরা পিস কোর নামধারণ করে ঢুকেছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে, ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক হিসেবে। শহরে-মফস্বলে, গ্রামেগঞ্জে ওরা ঢুকে যেতে লাগল, মানুষকে নানা কৌশলে প্রলুব্ধ করে। যেহেতু ইংরেজি শিক্ষাটা উপলক্ষ ছিল, তাই কেউ এর ভেতরে কোনো অসৎ মওকার সুযোগ আছে বলে ভাবত না। কিন্তু ওরা ঘুণ পোকার মতো কাটতে শুরু করে ক্ষতটাকে দগদগে করে ফেলল। এভাবেই ভিড়িয়ে ফেলেছিল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি করে কেন্দ্রের পাকিস্তান সরকারকে পুরোপুরি ঘায়েল করে ফেলেছিল। সেই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল সিয়াটা এবং সেন্টো চুক্তি। আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরার সব ফন্দি এঁটে ফেলেছিল।
এখানে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, ঢাকা শহরের আওয়ামী মুসলিম লীগের যে খুঁটি ছিল, তিনি হলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সংগঠনের প্রবল শক্তি তারই দক্ষতায় সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ইয়ার মোহাম্মদ খান মওলানা ভাসানীর ন্যাপের চলে যাওয়ায় আওয়ামীরা ঢাকার কুখ্যাত ধনাঢ্য গু-া বাদশাকে ক্ষেপিয়ে জনসভা ভাঙার জন্য লোক লাগিয়েছিল। প্রথমে ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু মওলানা ভাসানীর অগি্নবর্ষী বক্তৃতা সেদিন গুন্ডামিকে পরাভূত করে জনসভাকে সফল করতে সক্ষম হয়েছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগ কিন্তু 'মুসলিম' শব্দটি পরিহার করেছিল। কিন্তু মার্কিন প্রভূত্ব এবং সামরিক চুক্তিকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করতে সাহস পায়নি। কারণ মার্কিনীদের নাখোশ করার সাধ্যি ছিল না, তার কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখনো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এমনিভাবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটল। 

বিজয়ী আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর জাতীয় নেতৃত্বকে অস্বীকার করে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করে সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়েও পরাজিত পশ্চিমা রাজনীতির ক্ষমতা দখলের প্রতিভূ জুলফিকার আলী ভুট্টোর খপ্পরে পড়ে ঢাকায় ডাকা জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অকস্মাৎ বাতিল করে দেয়ায় বিক্ষুব্ধ পূর্ববাংলার বিস্তৃত জনপদ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ অগি্নগর্ভ হয়ে উঠেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এবং তখন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া তো দিয়েছিলেনই বরং তখন জনগণের প্রত্যাশা ছিল মুক্তির। লড়াই করেই জিততে হবে, এমনই ছিল মনোবাসনা। মনোবলে সুদৃঢ় পাহাড়ের মতন তখন জনগণের ঐক্য। কেউ তাকে পারবে না অবণত করতে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ দেশে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রত্যেকটি সংগ্রামের পেছনে কমিউনিস্ট পার্টি যে প্রকাশ্যে বা গোপনে থেকে সংগঠন গড়ে তোলা, মানুষকে সংগঠিত করা এবং বিশ্বের নানা দেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে পাঠ-অভিজ্ঞতা এবং আদর্শ চিন্তা করে নিজেদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল, সেই গণ-মানসিকতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রাণপণ যুদ্ধে। কিন্তু অবমূল্যায়িত হয়েছে ওই প্রবলশক্তির ও বলিষ্ঠ মানসিকতার মানুষ। পরে দেশমুক্তির পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের এমনকি তাজউদ্দিন আহমদের সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গঠিত সরকারের ন'মাসের মুক্তিযুদ্ধেকেও সঠিকভাবে বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করা হয়নি। সত্তরের পাকিস্তানি নির্বাচনের ফল দিয়েই পরবর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল। চরম দুঃখজনক ঘটনা, যে তাজউদ্দিন আহমদ দিনরাত্রি পরিশ্রম নয় কেবল, মেধা ও অধ্যবসায় দিয়ে ন'মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন মার্কিনী হুমকি ও ইসরাইলী প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সেই মহতী অধিনায়ককে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে প্রথম পরে অর্থমন্ত্রীত্ব থেকেও অপসারণ করা হয়েছিল, তিনি জেলে হত্যা হলেন তার মুক্তিযুদ্ধের সাথী মন্ত্রিসভার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের প্রাণ দিয়ে যে তিনি সঠিক পথেই চলেছিলেন। পরম পরিতাপের বিষয়, যে খোন্দকার মুশতাক আহমদ কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে বসে চক্রান্ত করে যাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই মুশতাককেই মন্ত্রিসভায় রেখেছিলেন। 
ধর্মনিরপেক্ষতার স্নোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছিলাম ১৯৭১-এ বিপুল রক্তখরচে সেই বাংলাদেশ আজ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জঙ্গি কার্যকলাপের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। এদের মদদদাতা ও সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াত-শিবির। যারা আলবদর, আল শামস গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে খুন করেছে এবং খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ, ব্যাপকভাবে ক্ষতিসাধন করেছে। এ অপশক্তি যাদের যুদ্ধাপরাধী বলে জানি, বর্তমানে যাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যাদের বিচার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। এ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া এবং মাদাম জিয়া তাদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন, তাই নয়, তিনি তাদের কাছে চেপে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে মন্ত্রীত্ব দিয়ে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ভজিয়ে রাখেন ক্ষমতায় যাওয়ার এবং থাকার উদ্দেশে।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে, নতুন আরেক চক্রান্ত অাঁটে মার্কিনীরা। তাতে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিয়ে ফেলে। লাহোরে অনুষ্ঠিত 'ইসলামী দেশগুলোর সম্মেলন'-এ বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত হন অনেকের বারণ সত্ত্বেও। ১৯৭৩ সালে যে দালাল আইন প্রণয়ন করে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, পরে তা সংশোধন করে অনেককে ছেড়ে দেয়ায় হত্যাকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে যায়। আর এরই সুযোগ করে জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দেন। এবং নিজের ক্ষমতালিপ্সা পূরণ করার পথটাকে সুগম করে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা অবহেলা করে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
জিয়া যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্যে পাঠান সেনা ও অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশিকিছু কি আশা করা যায়? কিন্তু তার লিজনম্র গৃহবধূ খালেদা যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের সাথেই বাস করেছিলেন, তিনি যখন ঘোমটা খুলে বিচারপতি সাত্তারকে দলীয় প্রধান পদ থেকে সরিয়ে নিজেই প্রধান হলেন তখন তিনি সংহার মূর্তি ধারণ করলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সারা দেশের সাধারণ মানুষ যখন, তখন তিনি ক্ষমতার দাপটে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এ দেশের মানুষ গণরায় দিলো মহাজোটের পক্ষে। বর্তমান সরকারের পবিত্র দায়িত্ব আর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের তাগিদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। ক্ষমতায় না থাকলে কী হবে, খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন এমনকি সংসদে না গিয়ে রাজপথকে উত্তপ্ত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিক্ষোভ, মানববন্ধন, রোডমার্চ, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, হরতাল কত কী করছেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে বিচারের উদ্যোগ নেয়ায় ধন্যবাদ জানাই।

শুধু বিচার করলেই তো হবে না ওদের শাস্তি কার্যকর করতে তো হবে। এত বছর বসে থেকে এখন যখন এই বিচার করছেন, তখন ভাবছি, আদৌ শেষ করার সুযোগ পাবেন কি?
details&feature=yes&type=single&pub_no=220&cat_id=1&menu_id=78&news_type_id=1&index=2&archiev=yes&arch_date=25-08-2012

Thursday, December 4, 2014

ভিঞ্চির পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র মোনালিসা ভিঞ্চির মা চিনা ক্রীতদাসী?

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র মোনালিসা আসলে কে? মুখে মৃদু হাসির এই নারী কে ছিলেন? যুগযুগ ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন শিল্প প্রেমীরা। কে ছিলেন মোনালিসা? ইতালিয়ান এক গবেষকের দাবী রহস্যময়ী  আদতে  এক চিনা ক্রীতদাসী ! এখানেই শেষ নয় অ্যাঞ্জেলো পারাতিকো নামে ওই গবেষকের দাবি  ছবির হাস্যময়ী শিল্পী লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির মা!
কারো মতে মোনালিসা লিওনার্দোর গুপ্ত প্রেমিকা। কেউবা বলেন তিনি নাকি এই জমিদার গৃহিণী। কারোর কারো মতে এ নাকি শিল্পীর নিজেরই পোট্রেট।এবার  নয়া এক তথ্য হাজির করেছেন ইতালির  এ গবেষক। নিজের সপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অ্যাঞ্জেলো পারাতিকো দাবি করেছেন ছবিতে মোনালিসার পিছনে ছবিটি একটি চাইনিজ ল্যান্ড স্কেপ, মোনালিসার মুখেও তিনি খুঁজে পেয়েছে চৈনিক আদল! আর শিল্পীর মাও ছিলেন প্রাচ্যের নারী। সে সেক্ষেত্রে তিনিই মোনালিসা হতে পারেন।

ধর্ষণে অভিযুক্ত বাঁকুড়ার হাউসস্টাফ গ্রেফতার:সংশয়-বিতর্ক-প্রশ্ন

অভিযুক্ত হাউসস্টাফ। ছবি: শুভ্র মিত্র


বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মূক-বধির তরুণীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে বরখাস্ত করল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বৃহস্পতিবার এই খবর জানিয়েছেন। অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। বুধবার রাত তিনটে নাগাদ বাঁকুড়া শহরের গোবিন্দনগরের এক লজে রামকৃষ্ণ সরকার নামে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে ধরা হয়। বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার সিজেএম চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য ধৃতকে ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিকে এ দিনই কাঁথির মূক ও বধির স্কুলের এক শিক্ষকের সাহায্যে বাঁকুড়া জেলা আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক (৫) সংযুক্তা সেনগুপ্তের কাছে ওই তরুণী গোপন জবানবন্দি দেন। পাশাপাশি এ দিন সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের সুপার রবীন্দ্রনাথ প্রধান, স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ প্রদ্যুৎ পান ও প্যাথলজিস্ট তড়িৎকান্তি পালকে নিয়ে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছে। পুলিশ-সূত্রের খবর, ‘নিরপেক্ষ’ জায়গায় পরীক্ষা করাতেই ধৃতকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে যাওয়া হল। প্রসঙ্গত, বুধবার তরুণীটিরও ডাক্তারি পরীক্ষা হয় এসএসকেএমে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অভিযুক্তকে গ্রেফতারে এত দেরি হল কেন? অভিযোগ জমা পড়ার পরে কেন গড়িয়ে গেল ছত্রিশ ঘণ্টা?
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও জানিয়েছেন, এত দেরিতে অভিযুক্তের মেডিক্যাল পরীক্ষা হলে প্রকৃত সত্য সামনে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট কমে যায়। বাঁকুড়া মেডিক্যালের সুপারের কাছে ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রটি মঙ্গলবার সকালে জমা পড়লেও বিকেল পর্যন্ত তিনি তা পুলিশকে দেননি। মেয়েটির বাবা সে দিন সন্ধ্যায় বাঁকুড়া থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করার পরে পুলিশ কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও শনাক্তকরণে ঢিলেমি চলছিল বলে অভিযোগ। বিভিন্ন মহলের অভিমত, সংবাদমাধ্যমের লাগাতার চাপের মুখেই রামকৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হয়েছে।



বস্তুত বাঁকুড়া মেডিক্যালের ঘটনাটিকে ঘিরে গোড়া থেকেই নানা সংশয়-বিতর্ক-প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। কী রকম?
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়ায় ততটা জোর না-দিলেও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ এখনও তদন্ত শুরুর ক্ষেত্রে প্রাথমিক মেডিক্যাল রিপোর্টকেই গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। এমনকী, ধর্ষণ হয়েছে না হয়নি, সে সম্পর্কে মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মতামত জানিয়ে দিচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অথচ সেই পরীক্ষা দ্রুত ও যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করায় পুলিশ-প্রশাসন কতটা তৎপর, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
যেমন থেকে গিয়েছে এসএসকেএমে মূক-বধির তরুণীটিকে পরীক্ষার সময়ে। সেখানে ফরেন্সিক, স্ত্রী-রোগ ও মনোরোগ বিভাগের ডাক্তারেরা হাজির ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মূক ও বধির তরুণীর বক্তব্য তাঁরা বুঝবেন কী করে? মেয়েটিই বা কী ভাবে ওঁদের জানাবেন তাঁর উপরে হওয়া শারীরিক নির্যাতনের কথা? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্তের মতে, “শুধু বিচারপতিকে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে থাকলেই হবে না। এ রকম ক্ষেত্রে ইশারায় মনোভাব বুঝতে পারেন, এমন বিশেষজ্ঞেরও মেডিক্যাল পরীক্ষার সময়ে হাজির থাকা জরুরি। না-হলে পরীক্ষা কার্যত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের পাশাপাশি তদন্তকারী অফিসারেরও এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে অভিযুক্ত পুরুষের ডাক্তারি পরীক্ষায় বিলম্ব নিয়েও। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি: পরিবারের তরফে অভিযোগ পাওয়ার পরে মঙ্গলবার সকালেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে চিহ্নিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও উদ্যোগী হতে হতো। অজয়বাবুও জানাচ্ছেন, “মহিলার মতো পুরুষের ক্ষেত্রেও যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করালে প্রমাণ মেলার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যত ঘণ্টা পেরোবে, সম্ভাবনা তত ফিকে হয়ে আসবে। আর তারই ফাঁক গলে রেহাই পেয়ে যাবে আসল অপরাধী।” সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, “মূক-বধির মেয়েটির বক্তব্য জানতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হল না কেন? মেয়েটির বক্তব্য ঠিকমতো বোঝাটা তো তদন্তেরই অঙ্গ! অভিযুক্ত চিকিৎসকের মেডিক্যাল পরীক্ষাতেই বা এত দেরি কেন?”
এই ‘দেরি’র প্রসঙ্গেই ‘সদিচ্ছা’র প্রশ্ন তুলে ধরেছেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। যাঁর বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনও মহিলা এই জাতীয় অভিযোগ জানানোমাত্র পুলিশ তাঁর জন্য আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করবে। কোন আইনজীবীরা এই ধরনের কাজে ইচ্ছুক, তাঁদের তালিকাও থানায় থাকার কথা। এ সব মানা হয় না বলেই মেডিক্যাল পরীক্ষাটুকু হতেও এত দেরি হয়ে যায়।” শাশ্বতীদেবীর অভিযোগ, ধর্ষণের ঘটনায় ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রামীণ হাসপাতাল স্তরে না-থাকায় মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। “মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য সব সময়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ লাগে না। স্ট্যান্ডার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস চালু থাকা উচিত। মহিলা থানা তৈরির বদলে প্রতি থানায় আলাদা ভাবে এক মহিলা অফিসারকে দায়িত্ব দিলেও মেয়েদের অস্বস্তি কমতে পারত।” বলছেন তিনি।
একই সঙ্গে শাশ্বতীদেবী-সুচিত্রাদেবীরা মনে করছেন, অভিযোগের ছত্রিশ ঘণ্টা পরে অভিযুক্তকে যে গ্রেফতার করা হল, সেটাও অনেকটা সংবাদমাধ্যমের চাপে পড়ে। বাঁকুড়া জেলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্তের কথায়, “ইদানীং এমন অপরাধ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যম তা টানা প্রচার করছে, এটা খুবই ইতিবাচক দিক।”উপরন্তু সুপ্রিম কোর্ট যখন বারবার ধর্ষিত মহিলার মানসিক চাপ (ট্রমা) কমাতে উদ্যোগী হতে বলছে, তখন নানা অজুহাতে তাঁর অভিযোগকে সন্দেহ করার প্রবণতা আদতে তাঁর উপরে চাপই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না কি?
সুচিত্রাদেবীর কথায় এ দিন সেই সংশয়েরই সুর। তাঁর আক্ষেপ, “বহু ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরার চেষ্টার বদলে কার্যত অভিযোগকারিণীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। খুবই অমানবিক। পুলিশ ও প্রশাসনকে জোড়হাতে অনুরোধ করছি, প্রথমেই সাজানো ঘটনা বলে দাগ না-মেরে তদন্তের কাজটা ঠিকঠাক করুন।”

       

Wednesday, November 26, 2014

মওলানা ভাসানী: হক কথার আড়ালে না হক বাণী-জাফর ওয়াজেদ

 আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকাল হতে সংগঠনটি বাংলার মানুষের হৃদয়াবেগে ঠাঁই পেতে শুরু করে। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় ভাসানী দলটি পরিত্যাগ করেন। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিনের পক্ষ সমর্থন প্রশ্নে দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন বলা হলেও নেপথ্য কারণ ছিল, নেতৃত্বের প্রশ্ন। ভাসানী যাকে সাধারণ সম্পাদক করতে চেয়েছিলেন, দলীয় অবস্থানগত কারণে তাকে তা করা যায়নি।

 এই প্রশ্নে মন কষাকষি থেকে বিরোধিতা মাত্রা পায়। এমনটাই মেলে পুরনো ইতিহাসের খেরো খাতায়। অথচ শোষিত মানুষের কন্ঠস্বর হবার কথা ছিল মওলানার। ‘মজলুম’ নেতার অনুসারীদের একটা অংশ জুলুমবাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে। থানা, ফাঁড়ি ও অস্ত্রলুট এবং গুপ্তহত্যার বিপরীতে ভাসানী ছিলেন নীরব, নির্বিকার। ভাসানী তার দলের সেক্রেটারি থেকে শেখ মুজিব নেতা হতে জননেতা এবং অবশেষে জাতির পিতা হলেন-ভাসানী তা মেনে নিতে পেরেছিলেন, এমনটা নয়। বরং এসব ঘটনার ব্যাপকতা বাড়ানোর পক্ষেই ছিল তার সব কর্মসাধনা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, হতশ্রী দরিদ্র দেশ কিন্তু তাকে টানেনি, পুনর্গঠন প্রশ্নে। বরং বিধ্বস্ত দেশকে আরো বিধ্বস্ত করে তোলায় ভাসানীর অবদান সর্বাপেক্ষা বেশী। আবেগতাড়িত মওলানা আবেগাপ্লুত বাঙালি জাতিকে হ্যামিলনের বংশীবাদক হিসেবে মুক্তির পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথ মাড়াননি। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার সম্মোহনী শক্তিধর ছিলেন। তাই স্বাধীনতার পথে, মুক্তির রথে ভাসানীকে সর্বাগ্রে দেখার কথা। কিন্তু তিনি ভিন্ন পথ ধরলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার দলের লোকজনের অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অধিকাংশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
 
মওলানা ভাসানী নিজে ভারতে অবস্থান করলেও তার দলের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও হয়নি। মূলতঃ দলের কাউকেও তিনি পাননি পাশে। তবে তার দলছুট সাবেক অনুসারীদের একটা অংশ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
 
ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী অধিকাংশ সময়ে হাসপাতালে কিংবা বিভিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসে কাটান ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ভারতের লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে ভিআইপি হিসেবে গণ্য করেন। তার থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার ভারত সরকার বহন করে। তাছাড়া হাত খরচের জন্য তাকে মাসিক দু’হাজার টাকা ভাতা দেয়া হতো। শুধু চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয় ৪৭ হাজার টাকা। (জ্যোতি সেনগুপ্ত : হিস্ট্রী অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ)।
 
১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হবার পর ভাসানী দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। মিসেস গান্ধী স্বহস্তে নগদ সাত হাজার টাকা একটি স্কার্ফে জড়িয়ে ভাসানীর হাতে তুলে দেন। ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যদানের জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। দেশে ফেরার পর তার ভরণ পোষণ কি করে চলবে, তিনি জানেন না। মিসেস গান্ধী তাকে বিমুখ করেননি। তার হাতে টাকার পুটুলি তুলে দেয়ার কথা মিসেস গান্ধী ১৯৭২ এর মার্চে ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তথ্যটি পান সাংবাদিক আবদুল মতিন জেনেভাতে। ঢাকায় ফিরে মওলানা ভারতীয় হাইকমিশনারকে তার বাড়ী তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪০ হাজার টাকা দেয়ার অনুরোধ করেন। বলাবাহুল্য তার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। (বাংলাদেশ ইন ব্লাড এন্ড টিয়ার্স: জ্যোতি সেনগুপ্ত)।
 
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশের পর ভাসানী তার দল ন্যাপকে পুনর্গঠন শুরু করেন। দলে হানাদারদের কোলাবরেটরও ছিল। এরপরই তিনি প্রকাশ করেন ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক টেবলয়েড আকারের পত্রিকা। রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত এক নতুন ভক্ত ইরফানুল বারীকে তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক করেন। পত্রিকাটিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার এবং ভারত ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বল্গাহীন প্রচারণা চলতে থাকে। চরম ভারতবিদ্বেষী এই পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে যে সব সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করে, তা জামাতে ইসলামীর প্রচারকাণ্ডের কার্বন কপি বলা যায়। ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং গুজবকে বেশ রসিয়ে চাতুরতার মোড়কে ছাপা হতো। ভারত ও রাশিয়ার সমালোচকদের উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করা হতো। তাদের বক্তৃতা বিবৃতি খবর হিসেবে ছাপিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আরেপিত নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়া হয়। জামাত, মুসলীম লীগসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ষাকবচে পরিণত হয় কাগজটি। সাম্প্রদায়িক উস্কানীদানেও প্রবৃত্ত হয়।

’হক কথা’ পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি অভিযোগ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। অভিযোগটি হলো- “কলকাতার রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের মোটর গাড়িতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের নিয়ে যাওয়া এসব মোটর গাড়িতে পূর্ব পাকিস্তানের ‘নম্বর প্লেট’ রয়ে গেছে।” তার অভিযোগ সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সরকারী ব্যাখ্যায় বলা হয়, ’পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরই বাংলাদেশের লোকজন তাদের নগদ সঞ্চয় স্থানান্তরযোগ্য সম্পত্তি ও কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের গাড়ী নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। কলকাতার পুলিশ বাংলাদেশের গাড়ীগুলোর জন্য একটি বিশেষ রেজিস্ট্রেশন নাম্বার (ডব্লিউ জে বি) দিয়েছিল। বাংলাদেশ মুক্ত হবার ক’দিনের মধ্যেই প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা এবং অন্যান্যরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করলে এসব যানবাহন ও ক্রমশ কলকাতা থেকে সরে যায়।’
’হক কথা’ পত্রিকাটি বাংলাদেশকে মুসলীম বাংলায় পরিণত করার পক্ষে জোরালো ভাষায় নিবন্ধও প্রকাশ করতো। ’হক কথা’র ভূমিকা ক্রমশ দেশ, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যায়। ১৯৭২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশবিরোধী অপপ্রচার সহ উস্কানিমূলক ভারত ও রুশ বিরোধী পত্রিকা ‘হক কথা’ নিষিদ্ধ করা হয়। দৈনিক বাংলার ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সংখ্যায় বলা হয়, ’রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে সরকার ‘হক কথা’, ‘মুখপত্র’ এবং ‘স্পোকসম্যান’ নামে তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে।
 
হক কথার অনুরূপ প্রোপাগাণ্ডা চালাতো এনায়েত উললাহ খানের সাপ্তাহিক ‘হলিডে’র প্রকাশনায় সরকার কোনো বাধা দেয় নি। ‘হক কথা’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পরই ভাসানী প্রকাশ করেন ‘হক বাণী’। না-হক সব লেখায় পরিপূর্ণ থাকতো পত্রিকাটি। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীকে বিব্রত করার জন্য ‘হক কথা’ থেকে ‘হক বাণী’ পত্রিকার মাধ্যমে ভাসানী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবকে ভারতের তল্পিবাহক বলে প্রমাণ করতে পারলে জনগণকে বোঝানো যাবে, বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনাত লাভ করে নি। ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশ। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল চীন। দু’দেশের মৈত্রী বন্ধন শিথিল করা গেলে চীনের উদ্দেশ্য সফল হবে-ভাসানী এই মনোভাব পোষণ করে অব্যাহত অপপ্রচার চালান। ১৯৬৩ সালে মাও সে তুং ভাসানীকে ভারত ও রাশিয়া সম্পর্কে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা তিনি ভোলেন নি। তারই প্রতিফলন তার পত্রিকাতেই রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য ভাসানী হক বাণীতে নেতাকে সরাসরি আক্রমণ না করে ইন্দিরা গান্ধীকে মুজিবের পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে দোষারোপ করার পথ বেছে নেন। সে সময় প্রচার ছিল, ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের প্রতি তার ক্ষোভের কারণ হল, তিনি ভারতের কাছ থেকে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্য আশা করেছিলেন, তা পাননি বলে ভাসানী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তার ‘হক কথা’ ও ‘হক বাণী’ পত্রিকার পাতায় পাতায় হিন্দু বিদ্বেষ প্রকটিত। পত্রিকাটি ক্রমশ বাংলাদেশকে মুসলীম বাংলা হিসেবে পরিণত করার জন্য নানা উস্কানিমুলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
 
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে খাদ্য বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশকীয় দ্রব্যসামগ্রী দুস্প্রাপ্যতার কারণে জনমনে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, কলকারখানা চালু করার পদক্ষেপ চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছিল। কিন্তু দেশী বিদেশী চক্রান্ত, একশ্রেণীর মজুতদার, মূনাফাখোর, অসাধু চোরাচালান গোষ্ঠীর কারসািজ এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য শ্রেণী গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ব্যবস্থা নানাভাবে বিঘিœত হয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তানী দালালদের অন্তর্ঘাত ও ধংসাত্মকমূলক কার্যকলাপে দেশে ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা। এসব কিছুর ফলে জনসমাজে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বস্তি, অসন্তোষ ও অস্থিরতা। দেশের এহেন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে মাওবাদী চরমপন্থী প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কার্যকলাপ। এসময় মওলানা ভাসানীর অসহযোগ ও সরকার বিরোধী উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা মাওবাদী ও উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী দালাল ও সংগঠনগুলোর উপরোক্ত কার্যকলাপ পরিচালনার সাহস ও শক্তি সঞ্চারে সহায়ক ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে।

চীনের অনুসারী সিরাজ সিকদারের ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ ‘স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত’ বলে উল্লেখ করে। ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ কায়েমের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়। হক, তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিণœ গণচীনমুখী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলও একইভাবে ভারত ও সোভিয়েত বিরোধী শ্লোগান দেয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের সংকল্প নিয়ে গোপন রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এদের অধিকাংশই হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয় এবং সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এই প্রস্তুতিরই অংশ হিসেবে তারা শুরু করেন (তাদের ভাষায়) ‘জাতীয় দুশমন’ খতমের অভিযান। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে ‘নতুন পতাকা ওড়াবার’ হুমকি দেন।
 
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় ২২ জানুয়ারি। আর তখন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে ডানপন্থী ও বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানের হানাদারদের সহযোগী দল জামাত, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামীও ভাসানীর নেতৃত্ব মেনে নেয়। আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে ভাসানীর নেতৃত্বে এক ডজনেরও বেশী দল-উপদল এবং গ্রুপ সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’। জাসদকে চেষ্টা করেও কমিটিতে ভুক্ত করা যায়নি। জাসদ তখন ’একলা চলো’ নীতি নিয়েছে।
ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে অপপ্রচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। অতীতের পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শাসক ও শোষকদের মতো তারাও ভারতবিরোধী প্রচারণা, ইসলামের দোহাই এবং সাম্প্রদায়িক জিগিরকেই বেছে নেয় আওয়ামী লীগকে খতম করার হাতিয়ার হিসেবে। এমন কি জাসদের কন্ঠেও ছিল একই সুর। ১৯৭৩ এর ১৪ এপ্রিল ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), শ্রমিক কৃষক সাম্যবাদী দলের সমন্বয়ে একটি ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে ৬ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার সংগ্রাম ও তৎপরতা পরিচালনার দৃঢ় সংকল্পও ব্যক্ত করা হয় এই ঘোষণায়। এরপর ২৩ এপ্রিল ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পল্টন ময়দানে যে জনসভা করে তাতে ভাসানী মুজিব সরকারকে উৎখাত এবং আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার দৃঢ় সকল্প ব্যক্ত করেন।
 
১৯৭৩ সালের ২ মে জাতিসংঘের মহাসচিব খাদ্যশস্য ঘাটতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানান। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৩টি জেলা বন্যা কবলিত হয়। ১২ মে বঙ্গবন্ধু বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ১৫ মে ৩ দফা দাবিতে ভাসানী অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৬ মে বঙ্গবন্ধু ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২২ মে ভাসানী বিরোধী দলীয় নেতাদের অনুরোধে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।
 
আগস্টে সারাদেশে মারাত্মক বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অগণিত মানুষ নিপতিত হয় সীমাহীন দুঃখ কষ্ট ও অভাব-অনটনের মধ্যে। এই অবস্থায় চৈনিকপন্থী উগ্রবাম ও স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত অন্তুর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে। জনগণের দুঃখ দুর্দশা তাদের মধ্যে কোনো রেখাপাত করেনি। থানা, ফাঁড়ি ও অস্ত্রলুটপাট অব্যাহত রাখে। সেই সঙ্গে গুপ্তহত্যা। উগ্রজামাতপন্থী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের এহেন সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে উৎকন্ঠিত ও আতংকগ্রস্ত তখন দেশের জনগণ। এহেন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে জনগণ আরো বেশী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ভাসানীর বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী বিভিন্ন উক্তি, বিবৃতি ও বক্তব্যে। ২৯ আগস্ট ভাসানীর ৩ দফা দাবির পক্ষে জনসমর্থন প্রদর্শনে তার অনুসারীরা সারা ঢাকা শহরে হরতাল পালন করে।
সারাদেশ জুড়ে অরাজকতা। তখন ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ, চরমপন্থী গলাকাটা দলগুলো এবং এসব দলের ছত্রছায়ায় হানাদারদের সহযোগী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা তাদের দৃষ্টিতে ‘ভারত-রাশিয়ার পুতুল সরকার’ উচ্ছেদের অভিন্ন লক্ষ্যেও নিজেদের মধ্যে ‘সংগ্রামের জন্য ঐক্য মোর্চা’ গড়ে তোলার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন।
 
২৭ জুন ১৯৭৪ তিনদিনের সফরে পাকি প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ঢাকায় আসেন। সফরসঙ্গী ছিল ১০৭ জন। তার ঢাকা আসার আগেই পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা বিভাগসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি অগ্রবর্তী দল আসে। তারা জামাত, নেজামে, পিডিপি, মুসলীম লীগ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রচুর উপঢৌকন ও অর্থকড়ি বিতরণ করে। এসব করা হয়েছিল যাতে ভুট্টো ভালো সংবর্ধনা পায়।
প্রচার ছিল যে, ভুট্টো ঢাকায় চীনপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। এর মধ্যে ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভুট্টো যেন কোনো অবস্থায় শেখ মুজিবের সঙ্গে সব বিষয়ে ফায়সালা না করে। ভুট্টো তা রক্ষা করে অমীমাংসিত বিষয়াদি ঝুলিয়ে রাখে। ভুট্টো ঢাকায় অবস্থানকালেই ২৯ জুন ভাসানীর নেতৃত্বে একটি গণমিছিল বঙ্গভবনের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়। অতপর মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রতিবাদে ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৯ জুন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে ভাসানীর নেতৃত্বে একটি জঙ্গি মিছিল বের করার চেষ্টা চালানো হলে পুলিশের হস্তক্ষেপে তা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ৩০ জুন রাতে ভাসানীকে মগবাজারের এক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইলের সন্তোষের বাড়িতে নিয়ে অন্তরীণ রাখা হয়। ভাসানী গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৬ দলীয় ঐক্যজোট ৫ জুলাই সারাদেশে হরতাল ডাকে ।কিন্তু সেদিন ঢাকায় কোনো হরতাল হয়নি। পিকেটারও দেখা যায়নি।
 
১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মন্দা চলছিল। সেই সঙ্গে দেশে মুদ্রাস্ফীতি এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দেশকে চরম সর্বনাশের কবলে গ্রাস থেকে উদ্ধারে ব্যস্ত তখন বঙ্গবন্ধু সরকার। বিরোধী দলগুলো তখন অবাধ গণতন্ত্রের সুযোগে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ‘জেহাদে’ অবতীর্ণ হয়। ভাসানীর ন্যাপ, মাওবাদী চরম উগ্রপন্থী এবং বিভিন্ন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল- এমন কি বিবৃতিদানকারী দলগুলোও সরকার বিরোধী অভিযানে সামিল হয়।
 
বেআইনী ঘোষিত স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি দালাল সংগঠনগুলোর সদস্য এবং সমাজ বিরোধীরাও সরকার বিরোধী এই অভিযানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগদান করে। নাশকতা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানিসহ ধংসাত্মক ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়। ভাসানী এই সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেননি। বরং আরো উস্কানি দিয়েছেন।হক কথা বলতে যেয়ে ভাসানী মূলতঃ দেশ জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।(চলবে)

Saturday, November 22, 2014

নজরুলের কবিতা

নারী

সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

কুলি মজুর

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান

স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্‌।
কোন্‌ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।



বিদ্রোহী
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর -
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর -
চির - উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না -
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

Wednesday, November 19, 2014

নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়েছে বাংলাদেশ:জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে





বিশ্বের তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়লেও  জবাবদিহিতার অভাবে প্রত্যাশিত সংসদীয় গণতন্ত্রের চিত্র বারবার বিঘিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৭ জন নারী ৬০ আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯ জন নারী সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী সহ ৪ জন  নারী পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।  কিন্তু ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ২৭ জন নারী সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে  নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন নারী এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ী হয়েছেন আরও ৮ জন।বর্তমান মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী সহ ২জন নারী মন্ত্রী ও ২ জন নারী প্রতিমন্ত্রী আছেন।এই বাস্তবতা বলে দেয়,নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর  দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল সেটি সেভাবে ধরে রাখা যায়নি।
তবে বর্তমান সংসদে একজন নারীকে স্পীকার হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে।তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ) এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে কৃতিত্বের সাথে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
এদেশে নারী আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন  জাতীয় সংসদে নারীর সক্রিয়, কার্যকর অংশগ্রহণকে ধরে রাখতে হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সুষ্ঠু কাঠামো প্রয়োজন, যাতে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে ও ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বারে বারে বলেছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটিকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত, দলীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল  না রেখে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনী বিধিবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ মন্ত্রী পরিষদ ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কমপক্ষে এক- তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান রাখতে হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানম।  

তিনি বলেন,রাজনৈতিক দলগুলোর আচার আচরণে চরম অসহিষ্ণুতার প্রকাশ পাচ্ছে যাতে সমগ্র দেশবাসীর  সাথে নারী সমাজও উদ্বিগ্ন।তার মতে,চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটিয়ে  দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সকল রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল ও সহিষ্ণু হতে হবে। গণতন্ত্রের বাস্তব চর্চা করতে হবে।পাশাপাশি সংসদ সহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আরো স্বাধীন, সৃজনশীল ভূমিকা পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ, দূর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আয়েশা খানম বলেন,গণতন্ত্র ও সুশাসনের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে স্থানীয় সরকার। কিন্তু  স্থানীয় সরকারের স্বাধীন ভূমিকা পালনে রাষ্ট্রীয় যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেখানেও যথেষ্ট সংকট বিদ্যামান।

মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় প্রকাশ,সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না।এই উপমহাদেশ সহ বিশ্বের সকল দেশের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকারকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকে প্রশাসন।
নারী নেত্রীরা বলেন,সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারে উপর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে, যেখানে স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীন ও স্ব-উদ্যোগে কাজ করবেন।

মহিলা পরিষদের গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এমনই একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নূরজাহান বেগম।এ বছরের জানুয়ারি মাসে  রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বর্বরতার শিকার হয়েছেন নূরজাহান বেগম। একইভাবে কুষ্টিয়ার গোপগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মাসউদ আহসান শিবলী ও তার সহযোগীরা সেই এলাকার নারী ইউপি সদস্য লাইলী খাতুনকে ঘরে আটকে রেখে প্রহার করে প্রচন্ড আহত করে।মাদারীপুর রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার সরস্বতী বাড়ৈকে সেই এলাকার চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছে।
এ প্রসঙ্গে নারী সংগঠক এবং গবেষক খুশি কবীর জনকন্ঠকে বলেন,এমন অনেক বাস্তব দৃষ্টান্তকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই।শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এসেও এখনো তৃণমূল থেকে রাজধানীর কেন্দ্র পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয় নারীকে তার মেধা এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে যোগ্য মর্যাদা দিতে।নারীর মেধা এবং শ্রমের মূল্যায়ন সমাজকে এগিয়ে নেয় অনেক দূর এ সত্য অনুধাবনে এখনো প্রস্তুত হয়নি আমাদের সমাজ। খুশি কবীর বলেন, অনেক যোেগ্যতা সম্পন্ন নারীকে এখনো পিছিয়ে রাখা হয়, যাতে নারী কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্বে না থাকে।

প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাই রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির বিষয়টি একই সঙ্গে ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হিসেবে সংযোজনের একমাত্র পন্থা হিসেবে সংসদে নারীর জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে কোটাপদ্ধতির প্রচলন একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হিসেবে গৃহীত। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নারীকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসতে হবে।
পৃথিবীর সব দেশে রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির ইস্যুটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির অংশ হলেও এযাবৎ রুয়ান্ডা ছাড়া কোনো দেশে এ নীতির বাস্তবায়ন হয়নি।যে কারণে বিশ্বগণতন্ত্রায়ণে নারীর প্রবেশ সাম্যতা,মর্যাদা ও প্রভাব কোথাও পুরুষের সমকক্ষ নয় এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই ক্ষমতার প্ল্য্যাাটফর্মে এ সক্ষমতাই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীকে ক্রমবর্ধমান হারে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার করেছে।কোটাপদ্ধতির মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণের দিকে যেতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে মাত্র ২৩টি দেশে সংসদে ৩০ শতাংশ বা তার ঊর্ধ্বে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং প্রতিটি দেশেই কোটাপদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি নারী-নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হওয়া পর্যন্ত কোটাব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশেই নারীর ন্যূনতম ৩০ শতাংশ আসনে নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা নেই।একমাত্র রুয়ান্ডার সংসদে নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।দীর্ঘকাল গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটি পার্লামেন্টে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর সুশাসনের কারণে পাঁচ বছরে মাথাপিছু গড় আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।ঐতিহাসিকভাবে পুরুষপ্রধান হবার কারণে রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় ভ’মিকা কার্যকর করতে বিভিন্ন দেশে যেসব কৌশল ও প্রক্রিয়া নেয়া হয়,তার মধ্যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার এবং আইন প্রণয়নের  মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নে নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু দেশও সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে।কারণ, অনেক ক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দলগুলো আইন রক্ষা করতে যে আসনে জেতার সম্ভাবনা নেই বা ‘নন-উইনেবল’ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেয় এমন দৃষ্টান্ত ও রয়েছে।কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে আসতে হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান-পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত করা হয়। ১৯৯০ সালে সংবিধান সংশোধন (দশম সংশোধন) করে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে ৩০টি নারী আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান রাখা হয়। ওই সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০০ সালে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের বিলুপ্তি ঘটে এবং সে সময় যারা সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদ হিসেবে যারা বহাল ছিলেন, তাদের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নারী নেত্রীরা সে সময় এই দাবি উত্থাপন করেন যে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন-ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে এবং ওই সব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়,যেহেতু সংসদে সংবিধান সংরক্ষণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সংখাগরিষ্ঠতা নেই, সেহেতু নারী আসন সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়াবার ক্ষমতাও তাদের নেই। ২০০০ সালে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংসদের নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোনো আসন ছিল না।২০০৪ সালের মে মাসে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের ৪৫টি নারী আসন আরো ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়।সেই বছরের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন নির্বাচনী বিল পাস হয়।একই সঙ্গে আগের ব্যবস্থা পাল্টে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রাপ্ত আসন অনুপাতে সংরক্ষিত মহিলা আসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়।ফলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের জন্যই নারী আসন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দলই সবগুলো আসন পেত।২০০৪ সালের ৮ ডিসেম্বর রাষ্টপতির অনুমোদনক্রমে গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনটি কার্যকর হয়।এ আইন অনুযায়ী আইনটি কার্যকর হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। পরে ২১ ডিসেম্বর রাষ্টপতির এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৪৫ দিনের বদলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রাখা হয়।সেই অধ্যাদেশটি ২০০৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি 'সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্বাচন সংশোধন আইন-২০০৫' নামের জাতীয় সংসদে পাস হয়।সংশোধিত সেই আইন অনুযায়ী ২০০৫ সালের ৭ মার্চের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা ছিল।কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। পরে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়।সেই নির্বাচনে জাতীয় সংসদে প্রাপ্ত সাধারণ আসন অনুপাতে আওয়ামী লীগের নয়টি আসন পাওয়ার কথা থাকলেও তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।বর্তমান সরকার আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার সাথে সাথে এদেশে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।তার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে একের পর এক আইন সংশোধন করে এগিয়ে নিচ্ছেন এই সমাজকে।কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী নারীরা তাদের দায়িত্বশীলতা কতোটা প্রমাণ করতে পেরেছে? এ প্রশ্নে এখনো সন্তোষজনক ভ’মিকা পালন করতে পারেন নি অধিকাংশ নারী জনপ্রতিনিধি।নারী সাংসদদের অনেকেই সংসদে অশালীন অরুচিকর এবং অসত্য বক্তব্য উপস্থাপন করে বিতর্কিত হয়েছেন।
সংসদে সংরক্ষিত আসনের কিছু নারী সাংসদের অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও অসত্য বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহান সংসদের মর্যাদা-ক্ষুন্ন হয়েছে।এর ফলে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে দাবি তুলেছিলেন,সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করা হোক।দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এজন্যে অনেকে তাদের রাজনৈতিক সহকর্মীদের হাততালিও পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের নারী সংগঠন গুলো দীর্ঘকাল ধরে দাবি করে আসছে সব রাজনৈতিক দলের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেবার জন্যে। সেই আইন যতক্ষণ প্রণীত না হচ্ছে,নারীর জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন হিসেবে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন রাখতে হবে এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে থাকতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও নারী নেত্রী সালমা খান।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নারী সাংসদরা কোন প্রশ্ন করেন না।নারী সাংসদদের কেউ কখনো সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন না বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার কতো? এই হার কমাতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তারা প্রশ্ন করেন না ব্র্যাকের জরীপে গ্রামীণ নারীরা ন্যাযবিচারের অভাব ও লিঙ্গবৈষম্য তাঁদের জীবনের প্রধান অন্তরায় বলে উল্লেখ করেছে কেন? এ ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা কখনো জানতে চান না।কোন নারী সাংসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন নি কেন সন্ত্রাসীর বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কিশোরী তরুণীদের এসিড ছুড়ে মারা হয়, হত্যা করা হয়? কেন তাঁরা সংসদে বিল উত্থাপন করেন না বিদ্যমান শ্রম আইনের সংশোধন করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেখানে ৭০ শতাংশ নারী কাজ করেন, সেখানে লিঙ্গভিত্তিক মজুরিবৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেবার জন্য। সে ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদদের দায়িত্বশীল ভ’মিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে কি তারা  অন্যায্য প্রাপ্তি লাভ করেছেন?তাই কি তারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন?
অর্থনীতিবিদ ও নারী নেত্রী সালমা খান বলেন, নারীকে সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসা প্রয়োজন।আসনের নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে ওই আসনে সরাসরি নির্বাচন ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক কালচারে তো দূরের কথা,বহু উন্নত দেশেও ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবারের হাতে গোনা দু-চারজন নারী ছাড়া মূলধারার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নারীর জন্য রাজনীতি হবে অপ্রবেশগম্য এবং সে ক্ষেত্রে আরও কয়েক শতাব্দী সম্পূর্ণ পুরুষশাসিত সমাজেই আমাদের বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই  আইন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাধ্য করা জরুরী মনে করছেন নারী নেত্রীরা।জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ মন্ত্রী পরিষদ ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কমপক্ষে এক- তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান রাখার ব্যাপারে নারী সংগঠন গুলো একমত হয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে এই দাবি তুলছেন।তবে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে গেছে,এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীদের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ### ১৯.১১.২০১৪