Saturday, March 16, 2013

বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই


চট্টগ্রাম: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভৌতবিজ্ঞানী ও প্রফেসর ইমিরেটাস ড. জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই। বিশ্ববরেণ্য এ শিক্ষাবিদ চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক ছিলেন।শুক্রবার রাত ১২টায় চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিজ্ঞানী জামাল নজরুল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।



ওই হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. নূরুল হক বলেন, ‘জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে গত বুধবার থেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। গত রাত ১২টার দিকে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর রাত আড়াইটার দিকে তার স্বজনেরা মরদেহ নগরীর সার্সন রোডে স্যারের বাসায় নিয়ে যান।’
১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ড. জামাল নজরুল ইসলাম ঝিনাইদহ সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তখন এই শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস ছিলেন। বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
চুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন,‘স্যার অসুস্থ শরীর নিয়ে গত ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।’
ড. জামাল নজরুল গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। বেশকিছু গাণিতিক সূত্র এবং জটিল গাণিতিক তত্ত্বের সহজ পন্থার উদ্ভাবক জামাল নজরুল মহাকাশের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। তার লেখা বেশকিছু বই অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ড. জামাল নজরুল ইসলাম একাধারে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।
ড. জামাল নজরুল প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনের পাশাপাশি পরিবেশসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বিজ্ঞানী ড.জামাল নজরুল ইসলামের মরদেহ শনিবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে।
মৃত্যুকালে জামাল নজরুল ইসলাম স্ত্রী ও দু’মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে সাদাফ পেশাগত জীবনে মাইক্রো বায়োলজিস্ট ও ঢাকায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে নার্গিস সাইকোলজিস্ট ও লন্ডনে কর্মরত। বর্তমানে সবাই চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন।
তার মৃত্যুতে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মৃত্যুর খবর শুনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা তার বাসায় ছুটে গেছেন।
শিক্ষাজীবন
জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়াশোনা করেন তিনি। কলকাতায় মডেল স্কুলের পর চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন। ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘ডাবল প্রমোশন’ দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
চট্টগ্রামের বিখ্যাত এ বিদ্যালয়ে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মূলত এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালবাসার সৃষ্টি হয়। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ‘ও লেভেল’ এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ‘এ লেভেল’ বোঝাতো।
উল্লেখ্য হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি ‍তাঁর ঝোঁক ও ভালবাসা তৈরি হয়।
লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান এবং সেখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন।
বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর সেখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক জামাল নজরুল কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ড. জামাল নজরুল বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
রচনাবলী
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তার গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে একাধিক বই লেখেন। এসব বই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর তা বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনুদিত হয়।
এছাড়া তার রোটেটিং ফিল্ড্‌স ইন জেনারেল রিলেটিভিটি গ্রন্থটি ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয়। একই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ। যা পরে স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত হয়।
তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণ বিবর এবং রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ।
এছাড়া ডব্লিউ বি বনোর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)।
পুরস্কার
বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হন। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেণ্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়।

Friday, March 15, 2013

আপনি কাপুরুষ বিধায় ত্বকীকে হত্যা করেছেন,যদি বীরপুরুষ হয়ে থাকেন আমাকে হত্যা করুন:শামীম ওসমানকে মেয়র ডা.আইভী


নারায়ণগঞ্জ: মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে দায়ী করেছেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী।


ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে পাঁচ দিনের টানা কর্মসূচির শেষদিন শুক্রবার বিকেলে শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে আয়োজিত গণজমায়েতে তারা এ অভিযোগ করেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট এ গণসমাবেশের আয়োজন করে।

তারা বলেছেন, “শামীম ওসমান নিজেকে কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছেন ত্বকীকে হত্যা করে। প্রশাসন যদি এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খুনিদের বের করতে না পারে তাহলে শামীম ওসমানকে বর্জন করা হবে।”

শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, “আপনি কাপুরুষ বিধায় ত্বকীকে হত্যা করেছেন। আপনি যদি বীরপুরুষ হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে হত্যা করুন। যদি খুনিদের ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো, নইলে আপনাকে বর্জন করা হবে।”

এর আগে আইভী যখন বক্তব্য শুরু করেন তখন স্লোগান ওঠে, “গডফাদারের আস্তানা, নারায়ণগঞ্জে রাখবো না।”

আইভী শহীদ মিনারে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে দেখে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের মানুষ আজ প্রতিহত করার প্রত্যয়ে মাঠে নেমেছেন। আজ সময় এসেছে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নেওয়ার। এই শহরে অনেক সিরিজ হত্যা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের মানুষকে স্তব্ধ করে দিতে অনেক খুন হয়েছে। কিন্তু আর মেনে নেওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন মুক্তি চায়।”

৩০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জবাসী অত্যাচার সহ্য করে আসছে উল্লেখ করে আইভী বলেন, “আমরা আর শিকলে বন্দি থাকতে চাই না। আমরা ত্বকীর মৃত্যুর পর এ অবস্থার মুক্তি চাই। আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে চাই।”

২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আইভীর কাছে পরাজিত হন সাবেক এমপি শামীম ওসমান। এ ঘটনাকে উল্লেখ করে আইভী বলেন, “আমি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কারণে আমি অপরাধী হতে পারি। ওই নির্বাচনে মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে কোন রক্তচক্ষুকে ভয় পায়নি। কিন্তু ত্বকীর মতো একজন মেধাবীকে হত্যা করে আপনি কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছেন। আপনাকে আমি নির্বাচনের পর আপনার সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তা না করে উল্টো হত্যার রাজনীতি শুরু করেছেন। আপনারা আওয়ামী লীগের নামের উপর ভর করে জুজুর ভয় দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জে ছড়ি ঘোরানোর ফায়দা লুটছেন। দলের দুঃসময়ে আপনারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে চাঁদাবাজীর টাকায় স্বর্গরাজ্যে বসবাস করেন আর আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতাকর্মীরা ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট করে।”

আইভী তার বক্তব্যে শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, “আপনি রফিউর রাব্বির মাত্র দশ গজ দূরে ট্রাকের উপর থেকে বক্তব্য দিয়েছেন ত্বকীকে আপনি খুন করেননি। আপনি জানেন ত্বকীকে কে খুন করেছে। আপনার অনেক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু আমাদের তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। আমাদের যোগাযোগ সাধারণ জনগণের সঙ্গে।”

আইভী বলেন, “আপনি বলছেন, আপনি ত্বকীকে খুন করেননি। আপনাকে তো কেউ বলেনি আপনি ত্বকীকে হত্যা করেছেন। আপনি নিজেকে বিশেষ মহল ভাবছেন কেন? আর আপনি যদি জেনে থাকেন কে ত্বকীকে হত্যা করেছে তাহলে তাকে ধরে এনে জনতার সামনে হাজির করুন। সেই খুনি যদি আমি হই বা আমার ভাই হয় বা আমার দলের কোন কর্মী হয় তাহলে তাকেও হাজির করুন। নইলে আমরা আপনাকে বর্জন করবো। আর যদি খুনিদের ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো।”


তিনি বলেন, “শামীম ওসমানের বাবা সামসুজ্জোহার সঙ্গে আমার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকার নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ থাকলেও তারা সন্ত্রাস করেনি। কিন্তু এখন আমরা সত্য কথা বলতে গেলে জামায়াত-শিবিরের তকমা লাগানো হচ্ছে।”

আইভী বলেন, “আপনারা নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে ভদ্র শিক্ষিতদের হাতে কলমের বদলে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন আপনাদের ৩ ভাইকে রক্ষা করতে। আপনাদের কারণে মেধাবী ছাত্র গোলাম সারোয়ার এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মাকসুদকে আপনারাই হত্যা করেছেন। নিয়াজুল এখন চেষ্টা করছে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে।”

রাব্বি আগে থেকেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাব্বি বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদ, রেলওয়ের স্থাপনা উচ্ছেদ, তেল-গ্যাস নিয়ে আন্দোলন করার কারণেই অনেকেই তার উপর ক্ষুব্ধ।”

আইভী আরও বলেন, “২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে যখন আমি দেশে ফিরে আসি, তখন অনেক বাঘ-সিংহ দেশে ছিল না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের কারণে আওয়ামী লীগের করুণ দশা ছিল, তখন এক সময়ে নারায়ণগঞ্জে রাজত্বকারী কেউ ছিল না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে আইভী বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ যখন আপনাকে গণরায় দিয়েছিল, তখন দেশে কোনো গডফাদার ছিল না। আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিচার কাজ শেষ হলে দেশবাসী আপনার পক্ষে আবারও গণরায় দেবে। নারায়ণগঞ্জকে কোনো জল্লাদের হাতে তুলে দেবেন না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ মুক্তভাবে নিশ্বাঃস নিতে চায়। আর যদি নারায়ণগঞ্জকে কোনো জল্লাদের হাতে তুলে দিতে হয়, তবে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন।”

তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, “আপনার প্রশাসনকে নির্দেশ দেন ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেন কোনো জজমিয়া নাটক না হয়। আমরা কোনো জজমিয়া নাটক দেখতে চাই না। নয়তো যেদিন সাধারণ মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নামবে তখন নারায়ণগঞ্জে কোনো জল্লাদ, কোনো গডফাদার রক্ষা পাবে না। কোনো টর্চার সেল নারায়ণগঞ্জে থাকবে না।”

এক ভাইয়ের প্রশ্রয়ে ত্বকীকে হত্যা: রাব্বি



ছেলে হত্যাকাণ্ডের পর আটদিন পর শুক্রবার প্রকাশ্যে সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ত্বকীর বাবা নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি রফিউর রাব্বি।

তিনি বলেন, “ত্বকী আমার ছেলে, মরে গেছে। নারায়ণগঞ্জে ত্বকীর বয়সের যতো তরুণ রয়েছে তারা সবাই আমার সন্তান। তাদের জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ত্বকী আমাকে দিয়ে গেছে। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করছে। আমরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি, ঠিক সেই সময় ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। তিন ভাইয়ের এক ভাইয়ের প্রশ্রয়ে ও একটি সংস্থার সহায়তায় খুনিদের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই এক ভাইকে ডেকে নিয়ে বলেছেন নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা নিয়ে বাড়াবাড়ি যেন না হয়। সেই ভাই বলেছেন, দুই-চারদিন হৈ চৈ হবে তারপর বন্ধ হয়ে যাবে।”

রাব্বি বলেন, “আমরা কোনোভাবেই মনে করি না ত্বকীকে জামায়াত-শিবির হত্যা করেছে। তাকে আমাদের সেই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হত্যা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। বাস ভাড়া বাড়ার ব্যাপারে যখন আমি আন্দোলন করি, তখন বাস মালিকরা র‌্যাবের কাছে একটি তালিকা দিয়েছিল তারা মাসে কতো টাকা নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানকে চাঁদা দেয়। আমি সেই তালিকা দেখিয়ে ডিসি অফিসে বলেছিলাম, এই চাঁদা যদি বন্ধ করা হয় তাহলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস ভাড়া ২২ টাকারও কম হবে।”

রাব্বি আরও বলেন, “নারায়ণগঞ্জে একটি টর্চার সেল আছে। সেই টর্চার সেলের আশে পাশে যারা থাকে তারা রাতে চিৎকারে শব্দ শুনতে পায়, গুলির শব্দ পায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে পুলিশ গোয়েন্দা জানে না সেই টর্চার সেলের কথা, শোনে না গুলি আর চিৎকারের শব্দ।”

শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে রাব্বি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আমাদের জামায়াতের দোসর বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতের দোসর কে, তা নারায়ণগঞ্জবাসীকে জানাতে হবে। এই পর্যন্ত জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আপনি কয়জন জামায়াত-শিবিরকে মেরেছেন তা নারায়ণগঞ্জের মানুষকে বলেন। আপনার শ্বশুর জামায়াতের সংগঠন সোসাইটির সভাপতি, যে মুজাহিদের সাথে কাজ করে। আমরা অসাম্প্রদায়িতার কথা বলি আপনি সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন। সিটি নির্বাচনের সময় আপনি হিন্দু মন্দিরে হামলা করে সংখ্যালঘুদের বুঝাতে চেয়েছেন শামীম ওসমানকে ভোট না দিলে নারায়ণগঞ্জে হিন্দুরা থাকতে পারবে না।”

তিনি আরও বলেন, “আপনারা আপনাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সন্ত্রাসী চাদাঁবাজি করিয়ে থাকেন। খুন করিয়ে থাকেন। আপনাদের তৈরি টর্চার সেলে আমাদের সন্তানদের টর্চার করে থাকেন। এসব আর হতে দেওয়া হবে না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ টর্চার সেলে হামলা চালিয়ে একটি ইঁট পর্যন্ত খুলে নিয়ে আসবে।”

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিকের সভাপতিত্বে গণজমায়েত সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণঞ্জ প্রেসকাবের সভাপতি কবি হালিম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ খেলাঘরের সভাপতি রথিন চক্রবর্তী, নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ ঘোষ বাবু, সাবেক সভাপতি ভবানি শংকর রায়, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির, জেলা কৃষকলীগের সভাপতি রোকনউদ্দিন আহম্মেদ, জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিখিল দাস, জেলা সিপিবি সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম, শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ, মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল, কাউন্সিলর অসিত বরুন বিশ্বাস, মনিরুজ্জামান, সাগর, সাবেক কমিশনার দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, রফিউর রাব্বির ছোট ভাই ওয়াহিদ রেজা।

এখানে উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ থেকে নিখোঁজ থাকে ত্বকী। এরপর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৯ মার্চ এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালিত হয়।

৫ দিনব্যাপি কর্মসূচির প্রথম দিন সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালায় ঘেরাও ও স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় শহীদ মিনারে নাগরিক শোকসভা, ১৩ মার্চ বুধবার দিনব্যাপি এলাকায় এলাকায় গণসংযোগ, ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


Tuesday, March 12, 2013

টার্গেটেড কিলিং জামায়াতের একাত্তরের চরিত্র ফিরিয়ে এনেছে :আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী



আবার একটি নৃশংস ও নির্মম হত্যাকাণ্ড। এবারও নিরীহ ও নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেল জামায়াতি খুনিদের হাতে। তাঁর নাম মিরাজ আহমেদ। পঞ্চাশের মতো বয়স। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর পরিচয় তিনি সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের সর্দার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে, তার একজন সাক্ষী। এই সাক্ষীকে হত্যা করা যায়নি। তাই আক্রোশ মেটানো হলো তাঁর ছোট ভাইকে হত্যা করে।

দুই দিন আগে নারায়ণগঞ্জেও তাই করা হয়েছে। প্রজন্ম চত্বরের এক ব্লগারের কিশোরপুত্র ত্বকীকে হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সভ্যজগতে এ ধরনের পাশবিক খুনখারাবির তুলনা খুঁজে পাওয়া সহজে যাবে না। প্রথমে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে চাপাতি ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, তারপর আরেক ব্লগার প্রতিভাবান তরুণ ইঞ্জিনিয়ার রাজীবকে একই পদ্ধতিতে হত্যা। তৃতীয় দফায় আরেক সংগঠকের অসাধারণ মেধাবী ছেলে কিশোর ত্বকীকে গলা টিপে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া। তারপর দেশের খ্যাতিমান সুরকার বুলবুলের ভাই মিরাজ আহমেদকে হত্যা একটি কথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, জামায়াতিরা (এবার সঙ্গে হিযবুত তাহ্‌রীরসহ তাদের সহযোগী দলগুলো) তাদের একাত্তরের ঘাতক চরিত্রে ফিরে গেছে।

একাত্তরে জামায়াতিরা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যায় সহযোগী হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত করা অসম্ভব জেনে দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এবারও তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিদানের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ প্রজন্ম চত্বরের বিশাল যুব-জনতার মোকাবিলা করতে না পেরে একদিকে শহরে-বন্দরে পকেট-সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং অন্যদিকে দেশের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা শুরু করেছে। কারণ এই তরুণ বুদ্ধিজীবীরাই প্রজন্ম চত্বরের প্রেরণা ও প্রাণ। জামায়াতিদের ধারণা, এই তরুণ ব্লগার তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা গেলে প্রজন্ম চত্বর ভীতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের সমাবেশ ভেঙে যাবে।

অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার পর পালের গোঁদা গোলাম আযমও যাতে একই দণ্ডাদেশ না পায় সে জন্য জামায়াতিরা পাগল হয়ে উঠেছে। এই মামলার সাক্ষীকে মেরে অথবা তাঁকে না পেলে তাঁর ভাই বা সন্তানকে হত্যা করে জামায়াতিরা যুদ্ধাপরাধ মামলার সব সাক্ষীর মনে ভয় ঢুকাতে চায়। যাতে তাঁরা ট্রাইব্যুনালে এই ঘাতক ও দালালদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেন অথবা সাক্ষ্য দিলেও তা প্রত্যাহার করেন। সন্দেহ নেই, দেশের প্রখ্যাত সুরকার ও গোলাম আযমের মামলায় তার বিরুদ্ধ-সাক্ষী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজ আহমেদকে হত্যা করা জামায়াতের পৈশাচিক হত্যার রাজনীতির আরেকটি প্রমাণ। সম্ভবত সুরকার বুলবুলকেও তারা হত্যার চেষ্টা করবে। গোলাম আযমের অপরাধের সব সাক্ষ্যপ্রমাণ তারা মুছে ফেলতে চায়।

সরকারের তাই উচিত, অবিলম্বে তাঁর এবং অন্য সব সাক্ষীকে কঠোর নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করা।
গোলাম আযমের মামলায় যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রায়ের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনের ওপর যেভাবে হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনি হুমকি সৃষ্টি করা হয়েছিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় তাঁর বিরুদ্ধের সাক্ষীদের ওপরও। সাঈদীর মামলায় বহু সাক্ষীকে একদিকে প্রলোভন দেখানো, অন্যদিকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। প্রচুর অর্থ ও অন্যান্য প্রলোভনে বশীভূত হয়ে কোনো কোনো সাক্ষী নাকি তাঁদের দেওয়া সাক্ষ্য পরে প্রত্যাহার করেছেন এবং জীবননাশের হুমকির মুখে কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার কোনো কোনো সাক্ষীর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এ ধরনের অভিযোগ জানতে পেরেছি।

১৯৭১ সালে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় শরিক হতে জামায়াত সাহস পেয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে। কিন্তু ২০১৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট যখন ক্ষমতায়, তখন জামায়াত সারা দেশে পকেট-সন্ত্রাস ও টার্গেটেড কিলিং চালানোর সাহস পায় কোথা থেকে? জবাবটি সবারই জানা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রথমে অপ্রকাশ্যে এবং এখন প্রকাশ্যে জামায়াতের সব ধরনের নাশকতামূলক কাজে সমর্থন ও সহায়তা দেওয়ায় তারা এখন শেষ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমি জামায়াতের এই হিংস্র জঙ্গিপনার নাম দিয়েছি, Jaamat's last ditch battle (জামায়াতের শেষ পরিখাযুদ্ধ)।

এই যুদ্ধের জন্য জামায়াত বহু দিন থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ বিশাল গণম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ধরেই নিয়েছিল ১৯৭১ সালের নরপশু যুদ্ধাপরাধীদের তারা বিচার ও দণ্ড থেকে বাঁচাতে পারবে না। এই বিচার ভণ্ডুল করার জন্য বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় থাকাকালে জামায়াত সৌদি অর্থ ও পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহায়তায় নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলে এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে মার্কিন হামলার মুখে পলাতক কিছু সংখ্যক তালেবানপন্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের দিয়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে (বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকেও) ক্যাডার রিক্রুট দ্বারা হিযবুত তাহ্‌রীর, জয়শ-ই মোহাম্মদী ইত্যাদি সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে। যেমন তারা করেছিল ১৯৭১ সালে আলবদর, আলশামস, রাজাকার ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী। বাংলাভাইয়ের মতো কিছু ঘাতক সন্ত্রাসীও তারা পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরি করেছিল।

বাংলাদেশে সাবেক বিএনপি সরকারের অভিভাবকত্বে পাকিস্তান থেকে পলাতক জঙ্গি দিয়ে বাংলাদেশেও তালেবান সৃষ্টি এবং তাদের অভ্যুত্থান ঘটানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকটি প্রভাবশালী কাগজ, যেমন 'ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ,' 'ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল', 'লা মান্তে' ইত্যাদিতে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই তালেবানি অভ্যুত্থানের বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
এই সতর্কবাণীতে কান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদীরা আছে, এ কথা বলায় শেখ হাসিনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন বলে অভিযোগ করেন এবং তাঁর সঙ্গে তখন কণ্ঠ মেলায় দুটি জাতীয় দৈনিকও। রবীন্দ্রনাথের 'ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থের দুই লাইনের একটি কবিতা হলো : 'যতোক্ষণ দূরে থাকি বিদ্যুতের আলো বলে মোর নাম রটে,/মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ বটে।'

বাংলাদেশেও প্রবলভাবে তালেবানি উপদ্রব দেখা না দেওয়া পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিএনপি (সঙ্গে সাঙ্গাত জামায়াতিরা) এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব নেই বলে বগল বাজিয়েছে। এর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌলবাদী সন্ত্রাস, শেখ হাসিনার সভায় বোমা পুঁতে রাখার ব্যাপারে হিযবুত তাহ্‌রীরের সংশ্লিষ্টতা, সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর বোমা হামলা, বাংলাভাই ও তার আরেক সন্ত্রাসী সহযোগীর ফাঁসি ইত্যাদির পর অস্বীকার করা গেল না বাংলাদেশে সন্ত্রাসী মৌলবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটি আছে এবং তারা বিএনপির কাঁধে চড়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য অপেক্ষারত।

২০০৭ সালে যদি এক-এগারোর আবির্ভাব না হতো, বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে বসে ১৯৯৬ সালের মতো আরেকটি জালিয়াতি নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জামায়াতিদের নিয়ে আবার ক্ষমতায় বসতে পারতেন।

তাহলে এবার প্রকৃত ক্ষমতা আর বিএনপির হাতে থাকত না, চলে যেত জামায়াতি পার্টনারদের হাতে। আমেরিকায় ভয়াবহ ড্রোন হামলার মুখে পলাতক পাকিস্তানি টেরোরিস্টরা বাংলাদেশে ঢুকে তাদের দ্বিতীয় শক্তিশালী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করত এ দেশটিতে। তাদের পশ্চাৎধাবন করে মার্কিন ড্রোন হামলা বাংলাদেশে এসেও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিশাল জয়লাভ এই সম্ভাব্য ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে।
ব্রিটেনের টোরি ও লেবার পার্টির মধ্যে এবং আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও গুরুতর রাজনৈতিক মতভেদ আছে। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য তারা আপৎকালীন সময়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও তার গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের জন্য জামায়াত বহিঃশত্রুর চেয়েও ভয়ানক এক শত্রু। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সত্যটা তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অন্তত এই একটা ইস্যুতে, অর্থাৎ বাংলাদেশে সন্ত্রাসী মৌলবাদ ও স্বাধীনতার শত্রুদের উল্লাস ঠেকানো এবং তাদের ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও শাস্তিদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকত এবং তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সীমাবদ্ধ থাকত নিজ নিজ রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে, তা হলে দেশে আজ এই ভয়ংকর অবস্থার উদ্ভব হতে পারত না। জামায়াতের পেছনে জনসমর্থন না থাকা এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার চলা সত্ত্বেও তারা দেশের নির্বাচিত সরকার, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন- সব কিছুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গৃহযুদ্ধের প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে মাঠে নামার এবং দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি ও টার্গেটেড কিলিং শুরু করতে সাহসী হয়েছে। বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এ সাহস তারা দেখাতে পারত না; আর আকস্মিকভাবে দেখালেও এত দিনে পেছনে হটতে বাধ্য হতো।

বিএনপির নেতা-নেত্রীদের জানা উচিত, তাঁরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতা করা হবে তাঁদের রাজনৈতিক ভূমিকা। বর্তমানে তাঁরা যা করছেন, তা সেই ভূমিকা নয়। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার নামে তাঁরা যা করছেন, তা রাষ্ট্রদ্রোহী ও স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামার ভূমিকা। তাঁদের এটা ভুল অথবা অপরাধ যাই হোক, এর মাশুল একদিন কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হবে।

পবিত্র কোরআনে আছে, মক্কা শহর যখন প্রবল পরাক্রান্ত বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল এবং মক্কাবাসী শহরটি রক্ষার কোনো উপায়ই দেখছিল না, তখন আল্লাহর নির্দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি হাজারে হাজারে তীক্ষ্ন ও ধারালো পাথরকণা ঠোঁটে নিয়ে মক্কার আকাশে জড়ো হয়েছিল। তাদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে আহত ও ভীত শত্রুরা পলায়ন করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আমি বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে জামায়াতিদের এই পূর্বপরিকল্পিত ও দীর্ঘ প্রস্তুতির হামলার সময় শাহবাগে আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠা যুব-জনতার বিশাল সমাবেশের প্রত্যেক নরনারী, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে বাংলাদেশ রক্ষার জন্য এই আবাবিল পাখি মনে করি। সরকার কঠোর ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকলে এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের প্রতিরোধেই জামায়াত ও স্বাধীনতার শত্রুদের অ্যাক্সিস তাদের সন্ত্রাস ও নৃশংস হত্যা-অভিযান ব্যর্থ হবে, যেমন তারা হয়েছে ১৯৭১ সালে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান বন্ধ করার জন্য জামায়াত প্রচণ্ড পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা মতো বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদী বি্লৎসক্রিগ (ঝটিকা আক্রমণ) শুরু করেছে, তা বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অথবা ব্যর্থ হতে যে চলেছে, তা এখন সম্পূর্ণ স্পষ্ট। জনসমর্থনের বদলে তারা এখন পাচ্ছে জনঘৃণা।
আন্দোলনের নামে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েই জামায়াত চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে গুপ্তহত্যা ও তরুণ বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করেছে। যেমন তারা করেছিল ১৯৭১ সালে পরাজিত হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের (১৬ ডিসেম্বর) দুই দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর তারিখ বুদ্ধিজীবী হত্যা দ্বারা। জামায়াত তার ১৯৭১ সালের ঘাতক চরিত্রে সম্পূর্ণভাবে ফিরে গেছে। হাসিনা সরকারকে এখানেই দারুণভাবে কঠোর হতে হবে। জামায়াতের কিলিং স্কোয়াডের প্রত্যেকটি নরপশুকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া এবং শাহবাগের তরুণ বুদ্ধিজীবী ব্লগার ও যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষীদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় করণীয়। রাজীব, ত্বকী, মিরাজের আত্মদান অবশ্যই বিফলে যাবে না। উৎসঃ কালের কন্ঠ

টার্গেটেড কিলিং জামায়াতের একাত্তরের চরিত্র ফিরিয়ে এনেছে :আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী



আবার একটি নৃশংস ও নির্মম হত্যাকাণ্ড। এবারও নিরীহ ও নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেল জামায়াতি খুনিদের হাতে। তাঁর নাম মিরাজ আহমেদ। পঞ্চাশের মতো বয়স। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর পরিচয় তিনি সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের সর্দার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে, তার একজন সাক্ষী। এই সাক্ষীকে হত্যা করা যায়নি। তাই আক্রোশ মেটানো হলো তাঁর ছোট ভাইকে হত্যা করে।

দুই দিন আগে নারায়ণগঞ্জেও তাই করা হয়েছে। প্রজন্ম চত্বরের এক ব্লগারের কিশোরপুত্র ত্বকীকে হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সভ্যজগতে এ ধরনের পাশবিক খুনখারাবির তুলনা খুঁজে পাওয়া সহজে যাবে না। প্রথমে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে চাপাতি ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, তারপর আরেক ব্লগার প্রতিভাবান তরুণ ইঞ্জিনিয়ার রাজীবকে একই পদ্ধতিতে হত্যা। তৃতীয় দফায় আরেক সংগঠকের অসাধারণ মেধাবী ছেলে কিশোর ত্বকীকে গলা টিপে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া। তারপর দেশের খ্যাতিমান সুরকার বুলবুলের ভাই মিরাজ আহমেদকে হত্যা একটি কথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, জামায়াতিরা (এবার সঙ্গে হিযবুত তাহ্‌রীরসহ তাদের সহযোগী দলগুলো) তাদের একাত্তরের ঘাতক চরিত্রে ফিরে গেছে।

একাত্তরে জামায়াতিরা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যায় সহযোগী হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত করা অসম্ভব জেনে দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এবারও তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিদানের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ প্রজন্ম চত্বরের বিশাল যুব-জনতার মোকাবিলা করতে না পেরে একদিকে শহরে-বন্দরে পকেট-সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং অন্যদিকে দেশের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা শুরু করেছে। কারণ এই তরুণ বুদ্ধিজীবীরাই প্রজন্ম চত্বরের প্রেরণা ও প্রাণ। জামায়াতিদের ধারণা, এই তরুণ ব্লগার তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা গেলে প্রজন্ম চত্বর ভীতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের সমাবেশ ভেঙে যাবে।

অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার পর পালের গোঁদা গোলাম আযমও যাতে একই দণ্ডাদেশ না পায় সে জন্য জামায়াতিরা পাগল হয়ে উঠেছে। এই মামলার সাক্ষীকে মেরে অথবা তাঁকে না পেলে তাঁর ভাই বা সন্তানকে হত্যা করে জামায়াতিরা যুদ্ধাপরাধ মামলার সব সাক্ষীর মনে ভয় ঢুকাতে চায়। যাতে তাঁরা ট্রাইব্যুনালে এই ঘাতক ও দালালদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেন অথবা সাক্ষ্য দিলেও তা প্রত্যাহার করেন। সন্দেহ নেই, দেশের প্রখ্যাত সুরকার ও গোলাম আযমের মামলায় তার বিরুদ্ধ-সাক্ষী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজ আহমেদকে হত্যা করা জামায়াতের পৈশাচিক হত্যার রাজনীতির আরেকটি প্রমাণ। সম্ভবত সুরকার বুলবুলকেও তারা হত্যার চেষ্টা করবে। গোলাম আযমের অপরাধের সব সাক্ষ্যপ্রমাণ তারা মুছে ফেলতে চায়।

সরকারের তাই উচিত, অবিলম্বে তাঁর এবং অন্য সব সাক্ষীকে কঠোর নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করা।
গোলাম আযমের মামলায় যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রায়ের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনের ওপর যেভাবে হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনি হুমকি সৃষ্টি করা হয়েছিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় তাঁর বিরুদ্ধের সাক্ষীদের ওপরও। সাঈদীর মামলায় বহু সাক্ষীকে একদিকে প্রলোভন দেখানো, অন্যদিকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। প্রচুর অর্থ ও অন্যান্য প্রলোভনে বশীভূত হয়ে কোনো কোনো সাক্ষী নাকি তাঁদের দেওয়া সাক্ষ্য পরে প্রত্যাহার করেছেন এবং জীবননাশের হুমকির মুখে কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার কোনো কোনো সাক্ষীর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এ ধরনের অভিযোগ জানতে পেরেছি।

১৯৭১ সালে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় শরিক হতে জামায়াত সাহস পেয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে। কিন্তু ২০১৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট যখন ক্ষমতায়, তখন জামায়াত সারা দেশে পকেট-সন্ত্রাস ও টার্গেটেড কিলিং চালানোর সাহস পায় কোথা থেকে? জবাবটি সবারই জানা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রথমে অপ্রকাশ্যে এবং এখন প্রকাশ্যে জামায়াতের সব ধরনের নাশকতামূলক কাজে সমর্থন ও সহায়তা দেওয়ায় তারা এখন শেষ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমি জামায়াতের এই হিংস্র জঙ্গিপনার নাম দিয়েছি, Jaamat's last ditch battle (জামায়াতের শেষ পরিখাযুদ্ধ)।

এই যুদ্ধের জন্য জামায়াত বহু দিন থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ বিশাল গণম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ধরেই নিয়েছিল ১৯৭১ সালের নরপশু যুদ্ধাপরাধীদের তারা বিচার ও দণ্ড থেকে বাঁচাতে পারবে না। এই বিচার ভণ্ডুল করার জন্য বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় থাকাকালে জামায়াত সৌদি অর্থ ও পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহায়তায় নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলে এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে মার্কিন হামলার মুখে পলাতক কিছু সংখ্যক তালেবানপন্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের দিয়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে (বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকেও) ক্যাডার রিক্রুট দ্বারা হিযবুত তাহ্‌রীর, জয়শ-ই মোহাম্মদী ইত্যাদি সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে। যেমন তারা করেছিল ১৯৭১ সালে আলবদর, আলশামস, রাজাকার ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী। বাংলাভাইয়ের মতো কিছু ঘাতক সন্ত্রাসীও তারা পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরি করেছিল।

বাংলাদেশে সাবেক বিএনপি সরকারের অভিভাবকত্বে পাকিস্তান থেকে পলাতক জঙ্গি দিয়ে বাংলাদেশেও তালেবান সৃষ্টি এবং তাদের অভ্যুত্থান ঘটানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকটি প্রভাবশালী কাগজ, যেমন 'ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ,' 'ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল', 'লা মান্তে' ইত্যাদিতে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই তালেবানি অভ্যুত্থানের বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
এই সতর্কবাণীতে কান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদীরা আছে, এ কথা বলায় শেখ হাসিনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন বলে অভিযোগ করেন এবং তাঁর সঙ্গে তখন কণ্ঠ মেলায় দুটি জাতীয় দৈনিকও। রবীন্দ্রনাথের 'ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থের দুই লাইনের একটি কবিতা হলো : 'যতোক্ষণ দূরে থাকি বিদ্যুতের আলো বলে মোর নাম রটে,/মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ বটে।'

বাংলাদেশেও প্রবলভাবে তালেবানি উপদ্রব দেখা না দেওয়া পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিএনপি (সঙ্গে সাঙ্গাত জামায়াতিরা) এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব নেই বলে বগল বাজিয়েছে। এর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌলবাদী সন্ত্রাস, শেখ হাসিনার সভায় বোমা পুঁতে রাখার ব্যাপারে হিযবুত তাহ্‌রীরের সংশ্লিষ্টতা, সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর বোমা হামলা, বাংলাভাই ও তার আরেক সন্ত্রাসী সহযোগীর ফাঁসি ইত্যাদির পর অস্বীকার করা গেল না বাংলাদেশে সন্ত্রাসী মৌলবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটি আছে এবং তারা বিএনপির কাঁধে চড়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য অপেক্ষারত।

২০০৭ সালে যদি এক-এগারোর আবির্ভাব না হতো, বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে বসে ১৯৯৬ সালের মতো আরেকটি জালিয়াতি নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জামায়াতিদের নিয়ে আবার ক্ষমতায় বসতে পারতেন।

তাহলে এবার প্রকৃত ক্ষমতা আর বিএনপির হাতে থাকত না, চলে যেত জামায়াতি পার্টনারদের হাতে। আমেরিকায় ভয়াবহ ড্রোন হামলার মুখে পলাতক পাকিস্তানি টেরোরিস্টরা বাংলাদেশে ঢুকে তাদের দ্বিতীয় শক্তিশালী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করত এ দেশটিতে। তাদের পশ্চাৎধাবন করে মার্কিন ড্রোন হামলা বাংলাদেশে এসেও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিশাল জয়লাভ এই সম্ভাব্য ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে।
ব্রিটেনের টোরি ও লেবার পার্টির মধ্যে এবং আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও গুরুতর রাজনৈতিক মতভেদ আছে। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য তারা আপৎকালীন সময়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও তার গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের জন্য জামায়াত বহিঃশত্রুর চেয়েও ভয়ানক এক শত্রু। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সত্যটা তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অন্তত এই একটা ইস্যুতে, অর্থাৎ বাংলাদেশে সন্ত্রাসী মৌলবাদ ও স্বাধীনতার শত্রুদের উল্লাস ঠেকানো এবং তাদের ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও শাস্তিদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকত এবং তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সীমাবদ্ধ থাকত নিজ নিজ রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে, তা হলে দেশে আজ এই ভয়ংকর অবস্থার উদ্ভব হতে পারত না। জামায়াতের পেছনে জনসমর্থন না থাকা এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার চলা সত্ত্বেও তারা দেশের নির্বাচিত সরকার, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন- সব কিছুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গৃহযুদ্ধের প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে মাঠে নামার এবং দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি ও টার্গেটেড কিলিং শুরু করতে সাহসী হয়েছে। বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এ সাহস তারা দেখাতে পারত না; আর আকস্মিকভাবে দেখালেও এত দিনে পেছনে হটতে বাধ্য হতো।

বিএনপির নেতা-নেত্রীদের জানা উচিত, তাঁরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতা করা হবে তাঁদের রাজনৈতিক ভূমিকা। বর্তমানে তাঁরা যা করছেন, তা সেই ভূমিকা নয়। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার নামে তাঁরা যা করছেন, তা রাষ্ট্রদ্রোহী ও স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামার ভূমিকা। তাঁদের এটা ভুল অথবা অপরাধ যাই হোক, এর মাশুল একদিন কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হবে।

পবিত্র কোরআনে আছে, মক্কা শহর যখন প্রবল পরাক্রান্ত বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল এবং মক্কাবাসী শহরটি রক্ষার কোনো উপায়ই দেখছিল না, তখন আল্লাহর নির্দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি হাজারে হাজারে তীক্ষ্ন ও ধারালো পাথরকণা ঠোঁটে নিয়ে মক্কার আকাশে জড়ো হয়েছিল। তাদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে আহত ও ভীত শত্রুরা পলায়ন করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আমি বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে জামায়াতিদের এই পূর্বপরিকল্পিত ও দীর্ঘ প্রস্তুতির হামলার সময় শাহবাগে আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠা যুব-জনতার বিশাল সমাবেশের প্রত্যেক নরনারী, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে বাংলাদেশ রক্ষার জন্য এই আবাবিল পাখি মনে করি। সরকার কঠোর ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকলে এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের প্রতিরোধেই জামায়াত ও স্বাধীনতার শত্রুদের অ্যাক্সিস তাদের সন্ত্রাস ও নৃশংস হত্যা-অভিযান ব্যর্থ হবে, যেমন তারা হয়েছে ১৯৭১ সালে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান বন্ধ করার জন্য জামায়াত প্রচণ্ড পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা মতো বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদী বি্লৎসক্রিগ (ঝটিকা আক্রমণ) শুরু করেছে, তা বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অথবা ব্যর্থ হতে যে চলেছে, তা এখন সম্পূর্ণ স্পষ্ট। জনসমর্থনের বদলে তারা এখন পাচ্ছে জনঘৃণা।
আন্দোলনের নামে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েই জামায়াত চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে গুপ্তহত্যা ও তরুণ বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করেছে। যেমন তারা করেছিল ১৯৭১ সালে পরাজিত হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের (১৬ ডিসেম্বর) দুই দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর তারিখ বুদ্ধিজীবী হত্যা দ্বারা। জামায়াত তার ১৯৭১ সালের ঘাতক চরিত্রে সম্পূর্ণভাবে ফিরে গেছে। হাসিনা সরকারকে এখানেই দারুণভাবে কঠোর হতে হবে। জামায়াতের কিলিং স্কোয়াডের প্রত্যেকটি নরপশুকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া এবং শাহবাগের তরুণ বুদ্ধিজীবী ব্লগার ও যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষীদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় করণীয়। রাজীব, ত্বকী, মিরাজের আত্মদান অবশ্যই বিফলে যাবে না। উৎসঃ কালের কন্ঠ

Monday, March 11, 2013

আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা মোবারকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন:জামিন বাতিল করে জেলে পাঠালো ট্রাইব্যুনাল



ঢাকা : ৭১এ মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনসহ ৫ ধরনের অভিযোগে হাজী মোবারকের জামিন বাতিল করে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযুক্ত মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করার পরে এই আদেশ দেন।তবে তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, মোবারক হোসেন স্বাধীনতার পর জামায়াতের রুকন ছিলেন। আখাউড়া থানার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে পরবর্তীত আওয়ামী লীগ যোগ দেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা।
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে তাকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আগামী ৪ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে (চার্জ) অভিযোগ গঠন করার জন্য দিন ধার্য করে দিয়েছেন আদালত।
প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন আজ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পর্যালোচনা করে এই আদেশ দিয়েছেন। আগামী ৪ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে বলে আদালত জানিয়েছেন।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন ,
১১ মার্চ পর্যন্ত তার জামিনের মেয়াদ ছিল আজ তার বিরুদ্ধে জামিন বাতিল করেন আদালত। আজ শুনানিতে তার আইনজীবী জামিন মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে তা খারিজ করেন আদালত। ট্রাইব্যুনালে মোবারকের পক্ষে শুনানী করেন অ্যাডভোকেট মহিবুর রহমান ও বিরোধীতা করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।
২৫ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত হত্যা,গণহত্যা, নির্যাতন, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের অভিযোগে ৩৩ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান।
মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন গ্রামবাসী আব্দুল খালেকের লাশ পাশ্ববর্তী খাল থেকে উদ্ধার করে। আরজিতে উল্লেখ করা হয়, যারা ডেকে নেয় তাদের মধ্যে আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামের মোবারক এবং জমশেদ মিয়া ছিল।নিহত আব্দুল খালেকের কন্যা খোদেজা বেগম ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাক্ষণবাড়িয়া চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। মোবারক হোসেন ১৩ মে ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে ৬ মাসের আগাম জামিন নেন।পরে ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর মোবারক হোসেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পন করলে আদালত তার জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠায় এবং মামলার নথিপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়।
পরে গত ৬ জুন আসামিপক্ষের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আপিল মোকাদ্দমা দায়ের করলে ট্রাইব্যুনাল এ মামলার নথিপত্র তলব করে। পরে তদন্তে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসে।
তার বিষয়ে ৬ মাস ৭দিন তদন্ত শেষে মোট ৪ ভলিয়মে ২৯৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থা জানায় মোবারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মোবারকের বিরুদ্ধে ২০১২সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত করেন কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী। তদন্তকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোবারকের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনসহ ৫ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে।তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের মধ্যে আখাউড়া থানাধীন টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে গণহত্যা, আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশু রঞ্জন দেবকে নির্যাতন, ছাতিয়ানা গ্রামের শহীদ আব্দুল খালেককে হত্যা, শ্যামপুর গ্রামের ২জনকে অপহরণ করে ১জনকে হত্যা এবং খরমপুর গ্রামের ১ জনকে আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৩ জনকে গণহত্যা, ২ জনকে হত্যা, ২ জনকে অপহরণসহ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এসব অভিযোগ ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হয়েছে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়।
১৯৭১ সালের একটি হত্যা মামলায় আটক ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানি হয় গত ১১ জুলাই। ওইদিন আসামীপক্ষ ও প্রসিকিউশন বিষয়টির ওপর শুনানি শেষে ১৬ জুলাই তাকে জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর কয়েক দফা তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।