Saturday, May 10, 2014

মৃত্যু তোর হোক্ দূরে নিশীথে নির্জনে: ফারিহার জন্যে শোকগাথা- সুমি খান



জন্ম হয়েছিল তোর সকলের কোলে        আনন্দকল্লোলে।


নীলাকাশ, আলো, ফুল, পাখি,        জননীর আঁখি,শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, 

শরতের শিশিরের কণা,  
প্রাণের প্রথম অভ্যর্থনা।  

      জন্ম সেই  এক নিমেষেই 

       অন্তহীন দান,
জন্ম সে যে গৃহমাঝে গৃহীরে আহ্বান।  

  মৃত্যু তোর হোক দূরে নিশীথে নির্জনে,

হোক সেই পথে যেথা সমুদ্রের তরঙ্গগর্জনে           
 গৃহহীন পথিকেরই    নৃত্যছন্দে
 নিত্যকাল বাজিতেছে ভেরী;

অজানা অরণ্যে যেথা উঠিতেছে উদাস মর্মর,   

 বিদেশের বিবাগী নির্ঝরবিদায়-
গানের তালে হাসিয়া বাজায় করতালি; 

 যেথায় অপরিচিত নক্ষত্রের আরতির থালি        চলিয়াছে অনন্তের মন্দির-সন্ধানে,পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে।


দুয়ার রহিবে খোলা; ধরিত্রীর সমুদ্র-পর্বতকেহ ডাকিবে না কাছে, সকলেই দেখাইবে পথ।    


    শিয়রে নিশীথরাত্রি রহিবে নির্বাক, 
            মৃত্যু সে যে পথিকের ডাক।
( 'মৃত্যুর আহ্বান'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)  



বসন্তের বাতাসটুকুর মতো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা ঢেউয়ের মতোন ভেসে - হাসিটুকু রেখে গেছে!!  শত শত ফুল ফুটিয়ে অনন্তলোকের নক্ষত্র হয়ে গেলো সবার আদরের ফারিহা  ! 


কবিগুরু যতোই বলে যান ,"পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে। " ফারিহার পিছু ফিরে চাহিবার সবকিছু রয়ে গেছে ! মা, বাবা, দাদীমা, আদরের ছোটবোন...খেলার সাথী সবাই তো আছে- শুধু চলে গেলো ফারিহা!সে কোন্ অনন্তের নক্ষত্রলোকে!


"সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর ,
সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর,কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল...."


আকাশের এক  ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের  শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!


কথায় বলে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী  বস্তু  'পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ'! বিশ্বকবির চিত্তের জোর ছিল,তাই তাঁর মাতা , স্ত্রী , তিন   সন্তান হারানোর শোক সয়ে ও জ্ঞানের সাধনা করে গেছেন  সেই কৈশোর থেকে একাশি বছর বয়স পর্যন্ত।  সেই  মানসিক জোর আজ  বড়ো প্রয়োজন  সদ্য সন্তানহারা  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু এবং ফারাহ দিবার।   


  সদ্য প্রয়াত  কিশোরী ফারিহার মা  ফারাহ দিবা একজন ব্যস্ত ব্যাংক কর্মকর্তা! সব ব্যস্ততা আজ থমকে গেছে!


প্রথম  সন্তান- অনেক স্বপ্নের , অনেক আকাঙ্খার ! প্রথম মা হতে গেলে অনেক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন মা'কে। একেবারে  যেন মৃত্যুর দুয়ার পার হয়ে আসা! ফারিহাকে জন্ম দেবার সেই কষ্ট নতুন করে যেন মায়ের বুকে বাজছে আজ!

 ১৭ বছরের প্রাণোচ্ছ্বল কন্যারত্নটি এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে 

গেলে, কী  থাকে আর মায়ের স্বান্তনা?

 ফারিহার 
জন্ম ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর । ১৯৯৭ সালে  চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী যাবার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দিবার বাবা-মা একসাথে প্রাণ হারান।ফারিহা তখন ৬ মাসের; দিবা তার বাবা-মাকে একসাথে হারালেন। এর কিছুদিন পরই দিবা তার অতি প্রিয় মেজো ভাই কে হারান। প্রিয়জন বিচ্ছেদের ঝড় এসে  আবার লুটে নিলো দিবার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বড়ো সন্তান ফারিহা জাহানকে!

ফারিহা যখন কথা বলতে শিখলো, দাদীমার ভাষাই যেন তার ভাষা। দাদীমার ভাই-বোন ভগ্নীপতি , যাদের যে নামে তিনি ডাকতেন, ছোট্ট ফারিহা ও একই সম্বোধন বা নাম ধরে ডাকতো তাদের সবাইকে।  শওকত আরা জাফরের একমাত্র বড়ো বোন রওশন আরা হাসনাত দম্পতি কে 'বড়ো আপা' আর 'দুলাভাই' সম্বোধনেই কথা বলতো ফারিহা।  দাদীমার ভাই দের ডাকতো সাদবাস, খোশবাস! দাদীমার ছোটবোন- ভগ্নিপতি  আল্লাদি- সাইফুদ্দিন ও ফারিহার কাছে 'আল্লাদি-সাইফুদ্দিন' ! তৃতীয় প্রজন্মের কেউ নাম ধরে  ডাকছে-এতে সবাই যেন অন্যরকম ভালোবাসা আর আন্তরিকতার ছোঁয়া পেতেন; একই সাথে  মজাও পেতেন! ফারিহার শেষ নিঃশ্বাসটুকুর সাথে তাকে ঘিরে সকলের সব স্বপ্ন আর ভালোবাসা যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।

৩ মে  ২০১৪,  শনিবার বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ  আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় উঠলো! 
দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।দুরন্ত কৈশোরের উন্মাদনায় ভুলে যায় নিজের অসুস্থতার কথা! পাশের বাড়ির খেলার সাথীকে নিয়ে ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। 

 সেদিন দিবার ব্যাংক বন্ধ।  ছুটির দিনে সন্তানদের সাথেই সময় কাটাতে চায় মা! মায়ের মন যেন 'কু'  ডাকে কোথাও!  দিবা বারণ করলেন কন্যাকে বাইরে যেতে! 


দুরন্ত কৈশোর কী আর মায়ের বারণ মানে!  ফারিহা জবাব দেয়,     " ছাদ থেকে কাপড় নিয়েই চলে আসবো আম্মু, একটু যাই? "      মা'কে দেয়া কথা রেখেছিলৌ ফারিহা । কাপড় তুলতে যেটুকু সময়, ততোটুকুই । বেশিক্ষণ ছাদে থাকে নি; ঘরে ফিরে আসে ফারিহা! 


তবু  আকাশ -বাতাস কাঁপানো সেই  ধুলিঝড়ে  এই পরিবারটির সব সুখের বার্তা যেন উড়িয়ে নিয়ে গেলো !! ফারিহার নির্মল কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়? 



এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা

 বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।

কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে

 সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো -  ইনহেলার, নেবুলাইজার- কোনটাই  কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে।


  নিঃশ্বাসের প্রবল কষ্ট থেকে একটু বাঁচার আকুতিতে অসহায় ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই 
কামরা থেকে ঐ কামরা... ..ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত -ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না,  আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!



খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!


  পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী-  সবার সামনেই  মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।


আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!" ফারিহার হাত ধরে তার পাশেই
 ছিল তাদের চার দশকের প্রতিবেশী শাহীন, তার ভাই হাসনাতসহ তাদের পরিবারের সবাই- যারা এই পরিবারের  রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের চেয়েও অনেক বেশি আপন, অনেক নিকটজন।  নেবুলাইজার ইনহেলার কাজ করছে না, হাসনাত স্যান্ডেল ছাড়াই ছুটে যায় নতুন ইনহেলার আনতে । রুদ্ধশ্বাসে ইনহেলার নিয়ে ফিরেও আসে হাসনাত। না , কিছুতেই কিছু কাজ করলো না শেষ মুহুর্তে!

অসহায় পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন। চিকিৎসক হয়েও অসহায় ভাবে কন্যাসমা ফারিহার মৃত্যু মেনে নিতে হলো তাকে।আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় জরুরী চিকিৎসা দেবার জন্যে কিছুই পাওয়া যায়নি সেদিন। গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি। 

চট্টগ্রামের সদরঘাট কালিবাড়ি মোড়ে জনসাধারণের চিকিৎসার জন্যে সম্প্রতি মেমন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ! কোন স্বাস্থ্যসেবাই নেই এখানে। সবই মিথ্যা ! ফারিহা কে কোলে নিয়ে অক্সিজেনের জন্যে এই হাসপাতালের তিনতলা পর্যন্ত ছুটে যেতে হয়েছে  পাপ্পু এবং অন্যদের ।  সেদিন পাওয়া যায়নি অক্সিজেন। এর পর গোলপাহাড়ের মোড়ে রয়েল হাসপাতালে চুটে গেলো তারা। ফারিহার খালু  ডা. লিয়াকত এই হাসপাতালের পরিচালক । পাপ্পু এই হাসপাতালেই দুইটি দোকান পরিচালনা করেন। কিন্তু না, এখানেও  ফারিহা কে  জরুরী চিকিৎসা দেয়া গেলো না। ডাক্তার মঈনুদ্দিনের মনে হলো,সামান্য জরুরী চিকিৎসা দেবার মতো কোন হাসপাতাল ও যেন চট্টগ্রামে নেই!

 ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা  শওকত আরা জাফরের চোখের দৃষ্টিই ছিল পৌত্রী  ফারিহা। ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিনি । রাতে  দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে  পত্রিকা পড়ে শোনানো,খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে  নজরদারী করা -সবকিছু ফারিহা আগ বাড়িয়েই করতো। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে শওকত আরা জাফরের  বুকে! চোখের জলে লাগলো জোয়ার, দুখের পারাবারে , ও চাঁদ!!





ফাইরুজের  নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কাটে না !! ফারিহার আদরের ছোট বোন  ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ!  ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপ্স পরে ছবি তুলেছে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!!  খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!


 অবিরল অশ্রুধারায়  ভেসে মায়ের মনে পড়ে  আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে   শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু,  দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!" এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা! ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার শুরুতেই  ফারিহার নামে একটা ডিপিএস করেছিলো দিবা। সেটা ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে। দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার  একদিন বিয়ে হবে, সেই সময়ে তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবা তার  সেভিংসের ও  নমিনি করেছিলো ফারিহাকে; প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে !


 সব  যেন আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! 

কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??


 দাদীমার শখ , তাই বড়োফুপুর মতো বাড়িতে বসেই গান শিখতো

  ফারিহা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাতে খড়ি হয় দাদীমার ইচ্ছেতেই।  দাদী 
বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে

 বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে ফারিহা  গড়ে 
তুলেছিলো নিজেকে!


 শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! 


ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে  ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের

 অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ

বিশালত্ব ছিল ' ফারিহা' নামের ক্ষণজন্মা কিশোরীটির অন্তরে!!যা   আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল! 

চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই পাড়ার মানুষগুলো ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মাঝে এই এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা ,তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। 


প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন  চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।কলা পাতায় রাখা পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল।

 রক্ষণশীল মা দিবার সংস্কারমনস্ক মন কোনভাবেই মেনে নিতে পারতো না  জনারন্যে ফারিহার এমন সহজ মিশে যাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে মায়ের বারণ বদলাতে পারেনি ফারিহার মুক্ত অসাম্প্রদায়িক  মানবিক জীবনাচার!! 

 ফারিহার এ মানবিক আচরণ সকলের অন্তরের একজন করে তুলেছিলো ফারিহাকে। যে কারণে ফারিহার আকস্মিক প্রয়াণ প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে! 

প্রতিবেশীদের আকুল কান্নার জল  অতলে ভাসিয়ে দেয় ফারিহার বাবা-মায়ের বেদনার্ত হৃদয়! তাদের অন্তরের শূণ্যতাকে যেন আরো শূন্য করে দেয়! 


পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই

 দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট

 থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। 

ফারিহা তার বাবার সহপাঠী পলিকে  পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে  ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো? আমাকে দিও কিন্তু!" 

পলি কয়েকদিন আগে এ্র্যাক্সিডেন্ট করে বেশ ব্যথা পায়। চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপী নিতে হয়। আর পলির   ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন ফারিহার কাছে চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো পলিকে । 

একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি পলিকে থেরাপী দিই, ফারিহা?" সেদিন  পলিকে থেরাপী দেবার পর দিবার অনভ্যস্ত হাতে প্রচন্ড ব্যথা হয় । মায়ের মন,!! ফারিহা কে  দিবা বলে, "একদিন থেরাপী দিয়েই আমার হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা,, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে  থেরাপি দিওনা।, তোমার অনেক কষ্ট হয়, ব্যথা বেড়ে যাবে !"  

ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে! " এমনই মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন চপলা কিশোরী ফারিহার মৃত্যু কী  করে  মেনে নেবে তার পলি ফুপু?!

এলাকার আরেক আদি বাসিন্দা 'হাজী সাহেব' এবং তার পরিবার।

 তাদের বড়ো বউ ফারিহার প্রিয় মিলি আন্টি। শেষ দিন টিতেই 
তার কাছে চুটে গিয়ে ফারিহা বলেছিলো, " মিলি আন্টি, তুমি কবে
 আমাকে চিকের বিরিয়ানী খাওয়াবা?"  জবাবে ফারিহার মিলি 
আন্টি দুষ্টুমি করে  বলেছিলেন," তুই আগে আমাকে পিৎজা 
খাওয়াবি কবে? তারপর তোকে বিরিয়ানী খাওয়াবো।" না, আর 
কখনো চিকেন বিরিয়ানী খেতে আসবে না ফারিহা! ফারিহার 
আকস্মিক প্রয়াণে শোক বিহ্বল  হলেও ,মিলি আন্টি  চিকেন 
বিরিয়ানি রান্না করে পাঠালেন। ফারিহার ছোট ফুপু ইসরাত
 জাহান কণা  তাৎক্ষণিকভাবে সেই চিকেন বিরিয়ানি ডেকচি সহ
 এতিম খানায় পাঠিয়ে দিলেন। অনাথ শিশুরা যদি খেয়ে খুশি হয়,
 নিশ্চয়ই ফারিহার আত্মা শান্তি পাবে!

এভাবেই আত্মার আত্মীয় হয়ে প্রতিবেশীদের সাথে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা- চপলা  কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হলো! 


রূঢ় এ  বাস্তবতা  এলাকার  আত্মার আত্মীয় - শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ কেউ  মেনে নিতে পারছেন না!! ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না!  প্রতিবেশীদের কাছে পূজার প্রসাদ বা তার প্রিয় নিরামিষ খাবার খেতে আসবে না!!

 সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে গলির ভেতরে বাইরে  কালো ব্যানার আর  ফারিহার জন্যে শোকের বাণীতে ছেয়ে গেছে।  যে কারো  চোখ জলে ভিজে যায়!


  মনে করিয়ে দেয়,  প্রাণের পরে চলে গেলো ,বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!   

 ২৮ এপ্রিল ২০১৪ তার জীবনের শেষবারের মতো একাদশ শ্রেনীর ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয় ফারিহা। এর পরের পরীক্ষার দিনগুলোতে তার নামের পাশে 'অনুপস্থিত' লেখা হলো, যা চিরস্থায়ী হয়ে গেলো। আর কোনদিন ফারিহা পরীক্ষার কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দেবে না!  ৫ মে তার একাদশ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। কথা ছিলো  পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে, আর  ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।

এসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্যই পড়ে রইলো।ফারিহার সহপাঠীরা  কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালো ব্যানার। 


মৃত্যু অমোঘ! তার কাছে সত্যিই  মানুষ বড়ো অসহায়!!


 অমরত্বের প্রত্যাশা কারো নেই । তবু এমন অকাল আর এমন আকস্মিক মৃত্যু কাঙ্খিত নয় কারো! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। যা মেনে নেয়া অসম্ভব ! 


  ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত এ  ব্যাংক কর্মকর্তা  কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচবার আকুল মিনতি !, নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও প্রাণপ্রিয়  ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে  ভীষণ বিপর্যস্ত! 

ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে  অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা  দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?

  ফারিহার ছোট ফুপা কাজী আদনান শিশুদের সাথে মিশে যান শিশুদের মতো হয়ে। ফারিহা- ফাইরুজ শৈশব থেকেই ফুপার কোলে পিঠে বড়ো হয়েছে পুপাতো বোন আইমান আতুশার সাথে সাথে। আরো ছিলো আইমান আতুশার ফুপাতো বোন শামা-ইয়ানা এবং সমবয়সী অন্যান্যরা। নিজের কন্যা না হয়েও কন্যা সমতুল্য ফারিহার এমন আকস্মিক মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না কাজী আদনান। 


আর প্রিয়তম পিতা -যাকে চোখে হারাতো ফারিহা? সেই পিতার বুকেই বারবার আছড়ে পড়েছে বাঁচবার আকুতি তে। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সদ্য সন্তান হারা পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু । শূন্যতার  জগদ্দল পাথর বুকে নিয়েও  
সবসময়ের মতোহাল্কা রসিকতা - তার বুকের ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা কখনোই পূরণ হবার নয়! তবু জীবন বয়ে যায় নিত্য, অনন্ত ধারায়!!

রবীন্দ্রনাথ  অমৃতের সন্তান ছিলেন- মৃত্যুশোককে  সহজে মেনে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তার!  কৈশোর থেকে মাতৃমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়  কবিগুরুর মৃত্যুশোক!  

ফারিহার  স্বজন- প্রিয়জনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি  তাঁর মা'কে হারান।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তাঁর খেলার সাথী ছিলেন।

 মৃত্যুশোকের  এই ধারাবাহিকতায়  রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার  কবিপত্মী মৃনালিনী দেবী  মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দু'মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্তার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি।  সেই সময়ে প্রচলিত অর্থে স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

 এভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনে পরপর  তিন সন্তান সহ ১৩ প্রিয়জন কে হারাতে হয় !  কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি আজ ।যাঁকে প্রিয়জন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

 দেড়শ' বছরের ও বেশি সময় পর আজকের দিনেও সদ্য সন্তানহারা শোক বিধ্বস্ত  মা ফারাহ দিবা এবং  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুসহ ফারিহার স্বজনদের মানসিক শক্তি ধরে রাখার প্রেরণা দেবে রবীন্দ্রনাথ!   

 সব শেষে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি। তাতে কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না!"
এভাবেই ফারিহার পরিবার এবং বান্ধবদের শক্তি দিক্ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!
১০ মে ২০১৪, শনিবার, রাত প্রথম প্রহর,  চট্টগ্রাম
রাত ২টা ৩৮ মি.

পঁচিশে বৈশাখ এবং অমৃতের সন্তান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কেচ অবলম্বনে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত কিশোর রবীন্দ্রনাথ 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃতের সন্তান ছিলেন- মৃত্যুশোককে  সহজে মেনে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর!  কৈশোরেই মাতৃমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়  কবিগুরুর মৃত্যুশোক! 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) বাংলার দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। 

রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩জন কাছের মানুষকে হারাতে হয় তাঁকে ! 

 কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন। 

  পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার  কবি পত্মী মৃনালিনী দেবী  মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ'-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷''

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷

 অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে  মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কবির মেজো মেয়ে রেণুকার মৃত্যু হয় ।

১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারী পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ 

এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ। 

১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কবির ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সীমাহীন আঘাত পান কবি। তবে ভেঙ্গে পড়েন নি কখনো। রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তাঁর জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলেকে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।

 রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !

আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।
জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷  জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!  লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে  শরৎ  টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''


১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷ 

১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷  শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷


আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷  আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''

Friday, May 9, 2014

প্রশ্নপত্র ফাঁস কী অপরাধ নয়? মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার পরিচিত মানুষেরা আমার এই লাগামছাড়া আশাবাদ দেখে খানিকটা কৌতুক অনুভব করেন। আমি তাতে কিছু মনে কির না। তার প্রথম কারণ এই আশাবাদের কারণে আমি অন্যদের থেকে অনেক বেশী আনন্দে দিন কাটাই। দ্বিতীয় কারণ আমার দীর্ঘজীবনে আমার বেশীরভাগ আশাবাদই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।


এই দেশ নিয়েও আমি সবসময়ে খুব আশাবাদী, আমরা নিজের চোখেই দেখছি দেশটি আর দারিদ্র্যে মুখথুবড়ে পড়া একটি দেশ নয়। দেশটির অর্থনীতি আগের থেকে অনেক বেশী শক্ত, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পাশের দেশের মানুষ থেকে আমাদের দেশের মানুষ অনেক দিক থেকেই বেশি শান্তিতে আছেন এরকম তথ্য আমি অমর্ত্য সেনের লেখা থেকে জেনেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের অর্থনীতি চালিয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকরা এবং খেতখামারের চাষীরা। আমাদের মত শিক্ষিত মানুষেরা এখনো দেশের অর্থনীতিতে সেরকম কিছু দিতে পারেনি। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে মোটেও নিরাশ নই। আমি সব সময়েই জোর গলায় বলি আমাদের দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীই হচ্ছে প্রায় তিন কোটি (কানাডার লোক সংখ্যার সমান!) আর এই ছাত্রছাত্রীরা ঠিকভাবে লেখাপড়া শিখে যখন খেটে খাওয়া মানুষজনের পাশে দাঁড়াবে তখন দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।


আমি অনেক জোর দিয়ে এই কথাটি বলতাম, কিন্তু গত সপ্তাহের পর থেকে এই কথাটি বলার আগে আমার বুক থেকে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে। গত সপ্তাহে আমি নিশ্চিত হয়েছি এই দেশে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়মিত ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের দেশের সরকার নিয়মিতভাবে সেটা অস্বীকার করে যাচ্ছে।


পরীক্ষা লেখাপড়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের মত দেশে পরীক্ষাটা আরো অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ সব ছাত্রছাত্রীই পরীক্ষায় ভালো করতে চায় তাই পরীক্ষাটি যদি খুব ভালোভাবে নেয়া যায় অর্থাৎ পরীক্ষা পদ্ধতিটি যদি সঠিক হয়, তাহলে এই পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করতে গিয়েই ছেলেমেয়েরা সবকিছু শিখে ফেলে। আমাদের যদি ভালো স্কুল না থাকে, ভালো শিক্ষক না থাকে, ভালো পাঠ্যই না থাকে- কিন্তু খুব চমৎকার একটা পরীক্ষা পদ্ধতি তাকে তাহলেও আমরা লেখাপড়ায় অনেক এগিয়ে যাব। দেশে যখন সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি এসেছে, আমরা তখন খুব খুশী হয়েছিলাম, মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ছাত্রছাত্রীদের আর মুখস্থ করতে হবে না। এখন কারা চিন্তা ভাবনা করে মাথা খাটিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে।

 আমি একটিবারও ভাবিনি আমার দেশের সরকার সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থা এই পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে থাকবে, তারা প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবে আর সেটি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ থাকবে না। এই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমি অনেক কাজ করেছি- এখন আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মন্ত্রণালয়টির দিকে তাকিয়ে থাকি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না যখন দেখি এই দেশের এতো বড় বিপর্যয় নিয়ে তাদের কোনো রকম প্রতিক্রিয়া নেই! 


শুধ যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া নেই তা নয়, পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও সেরকম প্রতিক্রিয়া নেই। আমি যে খবরের কাগজটি পড়ি সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবরটি ছাপা হয়নি, সম্পাদকীয় লেখা হয়নি, দেশের গুণীজন উপ-সম্পাদকীয় লিখেননি। 

টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাইনা তাই সেখানে কী হচ্ছে জানি না, কিন্তু ছোটখাটো বিষয়ের জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার মতামত নিতে চলে আসে। এবারে কেউ আসেনি।শুধুমাত্র একটি চ্যানেল আমার কাছে সেটি জানতে চেয়েছে। তাও সেটি ঘটেছে কারণ আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এবং পরীক্ষার প্রশ্ন পাশাপাশি বসিয়ে খবরের কাগজগুলোতে একটা লেখা লিখেছিলাম। এই কাজটুকুও আসলে আমার করার কথা নয়, এটি করার কথা সাংবাদিকদের। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াতে পুরো জাতি অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে থাকে এবং এটি আসলে এখন প্রচার করার মত কোনো খবর নয় বলে পত্রপত্রিকা বিশ্বাস করে থাকে তাহলে এর থেকে বড় বিপদে আমরা আগে কখনো পড়েছি বলে মনে হয় না।


নিজের চোখে ফাঁস হয়ে যাওয়া এইচএসসি-এর প্রশ্নপত্র দেখার পর আমি খোঁজ খবর নিয়েছি এরং আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি পি.এস.সি এবং জে.এস.সি-এর প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এই ছোট ছোট শিশুগুলোর মা-বাবা কিংবা শিক্ষক তাদের হাতে প্রশ্নগুলো তুলে দিয়ে তাদের সেটা পড়িয়েছে। শিশুগুলো সেগুলো পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে হুবহু সেগুলোই পরীক্ষায় এসেছে। তখন তাদের মনে বিস্ময় আতঙ্ক কিংবা ক্ষোভ জন্মেছে কী না জানি না।

 কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি এটি ছিল শিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি শেখানোর প্রথম পদক্ষেপ। একটি দুটি শিশু তাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অন্যায় করতে শিখে যেতে পারে, কিন্তু একটি রাষ্ট্র দেশের পুরো শিশু সমাজকে দুর্নীতি করতে শিখাতে পারে এটি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। 

আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘটনাগুলো স্বীকার করেনি। তাই এরকম কাজ যে অন্যায় বাংলাদেশের কেউ এখনো সেটা জানে না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে তারা এই দেশের আইনে এখনো অপরাধী নয়। অপরাধীর শাস্তি অনেক পরের ব্যাপার, কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করা যে অপরাধ এই সরকার এখনো সেই ঘোষণাটিও দেয়নি। সরকার যদি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেই বিষয়টি স্বীকারই না করে তাহলে এতো বড় একটা অপরাধ করার জন্যে কাউকে শাস্তি কীভাবে দেবে? 

যারা প্রশ্ন ফাঁস করার সাথে জড়িত, যারা এই দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া যাবে না-এর কারণটি কী আমি বুঝতে পারছি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি মনে করে থাকে একটা অন্যায় এবং অপরাধের বিষয় নিয়ে মুখ না খুললেই বিষয়টার কথা মানুষ ভুলে যাবে তাহলে তাদের মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে সেটি সত্যি নয়। এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এই ঘটনার কথা জানে বিশেষ করে যে সব তরুণ-তরুণী এই প্রশ্ন ফাঁসের কারণে হতাশায় ডুবে গেছে তাদের অভিশাপ থেকে কিন্তু কেউ মুক্তি পাবে না।
॥ ২ ॥আমার কাছে প্রথমবার যখন একটি মেয়ে ফোন করে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার কথা জানিয়েছে তখন তার কাছে আমি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো নিয়েছিলাম। পরীক্ষা হওয়ার পর সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটিও পাঠিয়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছাড়াও পরীক্ষার প্রশ্নটি দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম অন্য কারণে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রত্রছাত্রী যে পরীক্ষা দিচ্ছে সেই পরীক্ষার প্রশ্নটি এতো অযত্নে কেমন করে তৈরী করা হলো? প্রশ্নে যে জঘন্য ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এর চাইতে রুচিসম্মত সুন্দর ছবি আঁকার মত কেউ কী প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটিকে সাহায্য করার জন্যে নেই?

 সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে একটা সমস্যা সমাধান করার জন্য ধ্রুবগুলোর যে মানটুকু জানানো প্রয়োজন সেটি টাইপ করে লেখারও কেউ প্রয়োজন মনে করেনি, অত্যন্ত অবহেলার সাথে প্রায় দুর্বোধ্য হাতের লেখায় প্রশ্নপত্রে লিখে দেয়া হয়েছে। 

দেখেই বোঝা যায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, টাইপ বা ছাপার পুরো ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমি বিশ্বাস করতেই রাজী নই যে এতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে করা সম্ভব ছিল না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে যে চরম অবহেলা রয়েছে তার আরো অনেক প্রমাণ আছে। আমার কাছে অনেক ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করেছে, যারা ইংরেজী মাধ্যম পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের প্রশ্নে অনেক বড় বড় ভুল রয়েছে।

 পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নে এমন ভুল আছে তার কারণে উত্তরে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যেতে পারে। অবহেলা ছাড়াও আরো সমস্যা আছে। ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছে, জীববিজ্ঞান পরীক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ প্রশ্ন গাইড বই থেকে নেয়া হয়েছে। তারা আমার কাছে গাইড বইটির নামও উল্লেখ করে দিয়েছে।

 আমি সাংবাদিক নই, সাংবাদিক হলে তাদের অভিযোগটি যাচাই করে দেখতে পারতাম। এই মুহূর্তে আমার যাচাই করার সুযোগ নেই, কিন্তু এটি নিশ্চয়ই যাচাই করে দেখা সম্ভব। যদি দেখা যায় সত্যিই প্রশ্নগুলো গাইড বই থেকে নেয়া হয়েছে তাহলে কী সরাসরি যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? 

কেউ কী আমাকে বলতে পারবেন এই দেশের ইতিহাসে কতোবার কতো প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কিন্তু কখনো কী কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? হাতে হাতকড়া লাগিয়ে কখনো কী কোনো মানুষকে হাজতে নেয়া হয়েছে?


ফেসবুক নামক একটি বিশেষ সামাজিক নেটওয়াকিং-এর কারণে আজকাল ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন সবার মাঝে বিতরণ করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এই একটি দিকে বাংলাদেশ সত্যিকার ডিজিটাল যুগে পা দিয়েছে। মাঝে মাঝেই দেখতে পাই কমবয়সী তরুণেরা ফেসবুকে বেফাঁস কোনো কথা বলে দেওয়ার কারণে তারা পুলিশ কিংবা র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ছে, জেল খাটছে। কিন্তু ফেসবুক ব্যবহার করে প্রকাশ্যে যখন ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে বাণিজ্য করা হয় তখন কেন কখনো তাদের কাউকে ধরা হয় না? তারা কীভাবে সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়?


আমি কী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে খুব স্পষ্ট করে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? সত্যি কী প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে? যদি ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে সেটি কী অপরাধ? যদি আপরাধ হয়ে থাকে তাহলে সেই অপরাধীদের ধরার জন্যে কী কোনো মামলা করা হয়েছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, অনুগ্রহ করে আপনাদের কেউ কী আমার এই প্রশ্নটির উত্তর দেবেন?


॥ ৩ ॥প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি গত সপ্তাহে একটা ছোট লেখা লিখেছিলাম, তারপর অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করে কীভাবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা যায় সে সম্পর্কে নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন।


সত্যি কথা বলতে কী যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ব্যাপারটি সরকার স্বীকার করবে না, সেটাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তথ্যপ্রযুক্তির কোনো পদ্ধতিই আসলে কাজ করবে না।


সরকার যদি এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ঘটেছে সেটা ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করে নিয়ে অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করে তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতে শুরু করে তাহলে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না। এখন যে পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরী করা হয়, বিতরণ করা হয় সেই পদ্ধতিতেই প্রশ্ন ফাঁস হতে না দিয়ে পরীক্ষা নেয়া যাবে।

সত্যি কথাটি হচ্ছে প্রশ্ন আসলে ফাঁস হয় না, প্রশ্ন ফাঁস হতে দেয়া হয়।


॥ ৪ ॥এই দেশের ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে কয়দিন থেকে আমার মনটা খুব খারাপ। পি.এস.সি কিংবা জে.এস.সি পরীক্ষা দেয়া শিশুদের ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেয়া হয়। যারা বৃত্তি পেয়েছে তারা আমাকে চিঠি লিখে বলেছে, যদিও তারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু সবাই এখন তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নানা রকম কটূক্তি করেছে। যারা বৃত্তি পায়নি তাদের অনেকে আমাকে জানিয়েছে, তাদের থেকে খারাপ পরীক্ষা দিয়ে অনেকে বৃত্তি পেয়ে গেছে কারণ তাদের উপরের মহলে ধরাধরি করার লোক আছে।

 যেহেতু সাধারণের কাছে গোপন পরীক্ষায় পাওয়া আসল নম্বরের ভিত্তিতে এই বৃত্তি দেওয়া হয় তাই এই পুরো পদ্ধতিটাই আসলে ভয়ঙ্কর রকম অস্বচ্ছ! এই শিশুদের অভিযোগ সত্য নয়- এই কথাটি পর্যন্ত কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করে নম্বর তুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু সেই নম্বর দিয়ে একটা ছাত্র বা ছাত্রীর ভবিষ্যত নির্ধারণ করা হয় এবং কেউ কোনোদিন সেটা জানতে পারবে না, এতো বড় একটা অস্বচ্ছ ব্যাপার কীভাবে সবাই দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না।


যারা এইচ. এস. সি পরীক্ষা দিয়েছে তারা একটু বড় হয়েছে- এখন তাদের সেই বয়স যে বয়সে তারা দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করার আগেই তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে এবং সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার সেটি করছে তারাই যাদের স্বপ্ন দেখানোর কথা। যারা ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পেয়ে সেটা পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। (শুনেছি ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে লেখা পড়া করতে বসিয়ে মায়েরা ফেসবুক একাউন্ট তৈরী করে সেখান থেকে ছেলেমেয়েদের জন্যে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন বের করে এনেছেন)।

 ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা নিজেদের জন্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিয়ে অপরাধবোধটি কমানোর চেষ্টা করছে এবং সেটি হচ্ছে দুর্নীতি শেখার প্রথম ধাপ। এই ছেলেমেয়েগুলো কিন্তু নিজে থেকে দুর্নীতি করতে চায়নি তাদের জোর করে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।


যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ব্যবহার না করে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ভেতর এখন একই সাথে তীব্র হতাশা এবং ক্ষোভ। তাদের মুখে একটিই কথা- ‘ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়েই যদি সবাই পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পাবে তাহলে সারা বছর এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ে আমার কী লাভ? এইচ. এস. সি. পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে, তখন এই ছেলেমেয়েগুলো সবচেয়ে বেশী ক্ষকিগ্রস্ত হবে। আমরা তাদের সত্য এবং ন্যায়ের কথা বলি কিন্তু অসত্য আর অন্যায়কে লালন করি এতো বড় ভন্ডামির উদাহরণ কী আর কেউ দিতে পারবে?


শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় বড় হর্তা কর্তারা, সরকারের বড় বড় লোকজন খুব শান্তিতে থাকেন। ছোট ছোট শিশুরা, এই দেশের কিশোর-কিশোরীরা তরুণ-তরুণীরা তাদের ধারে কাছে যেতে পারে না। তারা পুলিশের প্রহরায় গাড়ী করে যান, তাদের চিঠি পড়তে হয় না, ই-মেইল দেখতে হয় না। এই শিশু-কিশোর-তরুণেরা কিন্তু আমার মত মানুষের কাছে আসতে পারে, যখন তীব্র ক্ষোভ নিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করে তখন আমি তাদের কী বলে সান্ত¡না দিব বুঝতে পারি না।তারপরও আমি তাদের সান্তনা দেবার চেষ্টা করি, আমি তাদের বোঝাই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবে। অন্যায়কে অন্যায় বলা হবে, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে মুছে ফেলে নূতন করে সবকিছু শুরু করা হবে। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা যে কাজটি করতে পারেনি নূতন প্রজন্ম নিশ্চয়ই সেই কাজটি করতে পারবে।


আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সবচেয় বড় শক্তি হচ্ছে এই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। দেশের সব মানুষের কাছে করজোরে অনুরোধ, তাদের অবহেলা করে ঠেলে ফেলে দেবেন না। তাদেরকে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বড় হতে দিন।

 ০৭.০৫.২০১৪

Thursday, May 8, 2014

ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা আজাদ -আর ফেরেন নি


এই ছবির মাঝখানের সুদর্শন যুবকটির নাম আজাদ

অত্যন্ত ধনী পরিবারের সন্তান  আজাদ!



মার্কেটে গেলে তখনকার দিনে এক ধাক্কায় ১০০০ টাকায় এলভিস প্রিসলির রেকর্ড কিনে আনতেন গান শোনার জন্য।

  শাফি ইমাম রুমীদের সাথে ক্র্যাক প্লাটুনের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেন আজাদ ।  পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আজাদ ধরা পড়ে। এবং তাঁকে বলা হয়, সে যদি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এবং অবস্থান বলে দেয়, তাহলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। 

আজাদের মা আজাদকে বলেন যত অত্যাচারই করুক না কেন বাবা কারও নাম বলিস না। মা কয়েকদিন পর আজাদের জন্য জেলে ভাত নিয়ে যান কারণ আজাদ ভাত খেতে চেয়ে ছিলো। সেই ভাত আর আজাদের খাওয়া হয়নি। আজাদ কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৫ বছর বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ওই ১৫ বছর আজাদের মা একবারে জন্যও ভাত খাননি। কখনো খাটে ঘুমাননি কারণ আজাদ বন্দি অবস্থায় মেঝেতে ঘুমাতো।




সবাইকে ছবিটি শেয়ার অথবা বন্ধুদেরকে ছবিটি ট্যাগ করে দেওয়া জন্য অনুরোধ করছি। কারণ নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি এই রকম লাখ লাখ আজাদ এবং আজাদের মায়ের মত মা থাকার কারণে। (Collected)

Tuesday, May 6, 2014

প্রাণের পরে চলে গেলো ফারিহা- বসন্তের বাতাসটুকুর মতো -- সুমি খান




 রবীন্দ্রনাথ  অমৃতের সন্তান ছিলেন- মৃত্যুশোককে  সহজে মেনে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তার!  কৈশোর থেকে তার মাতৃমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়  কবিগুরুর মৃত্যুশোক! 

এমন মানসিক জোর আজ  বড়ো প্রয়োজন  সদ্য সন্তান হারা  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু এবং ফারাহ দিবার।  


 আকাশের এক  ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের  শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!

ফারিহার মা দিবা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দশ মাস দশ দিন যে কষ্ট পায় একজন মা, ১৭ বছরের হতেই মেয়েটা চলে গেলে কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা?? ফারিহা যখন ৬ মাসের , দিবা তার বাবা-মা কে একসাথে হারায়। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারা মৃত্যুবরণ করেন।

৩ মে  ২০১৪, বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ ঝড় এলো আকাশ কাঁপিয়ে।পাশের বাড়ির খেলার সাথী  ফারিহাকে ডাকতে এলেই ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। প্রচন্ড ধুলিঝড়...কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়? 


দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো মেয়েটা। ইনহেলার, নেবুলাইজার কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে। 
বাঁচার আকুতিতে অসহায় আমাদের ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা...ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!

খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!  পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী  সবার সামনেই  মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।

আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!"  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন।কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো, গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি.! 


ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন  ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা  শওকত আরা জাফর।  তার চোখের দৃষ্টি ছিল পৌত্রী  ফারিহা। রাতে  দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে  পত্রিকা পড়ে শোনানো, খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে  নজরদারী করা -সবকিছু যেন ফারিহার করতে হবে। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে দাদীমার বুকে!


আদরের ছোট বোন  ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ!  ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপস পরে ছবি তুলে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! ফাইরুজের  নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কেটে যায়, খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!


 অবিরল অশ্রুধারায়  ভেসে মায়ের মনে পড়ে  আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে   শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু,  দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!"

 এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা!...একটা ডিপিএস ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে, দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবার সবকিছুতে নমিনি করেছিলো ফারিহাকে! প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে ! সব আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??

রবীন্দ্রসঙ্গীতশিখতো  ফারিহা। দাদিমা বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে গড়ে তুলেছিলো নিজেকে! 

শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে  ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ বিশালত্ব ছিল ফারিহা নামের কিশোরীটির অন্তরে!! যা  আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল! 

চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি  সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা।  সাম্প্রতিক সময়েও তরুণ দের মাঝে এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা , তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন  চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।  কলা পাতায় করে দেয়া পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল। 

পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। ফারিহার বাবার সহপাঠী পলিকে  পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে  ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো, আমাকে দিও কিন্তু!" পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো। একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি দিই থেরাপী। সেদিন প্রচন্ড হাতে ব্যথা হয় দিবার। মায়ের মন, ফারিহা কে বলে, " আমার একদিনেই হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে  থেরাপি দিওনা, তোমার অনেক কষ্ট হয়!"  ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে। সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে , গলির ভেতর কালো ব্যানার আর  ফারিহার জন্যে শোক চোখে পড়ার মতো ! মনে করিয়ে দেয় , মানুষের প্রাণের পরে চলে গেলো যে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!   

 ৫ মে তার একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো।কথা ছিলো  পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে। ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।ওসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্য পড়ে থাকলো।ফারিহার সহপাঠীরা তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালোরঙ ব্যানার। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়।

প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হবার রূঢ় বাস্তবতা  এলাকার যারা তার আত্মার আত্মীয় ছিল- শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ !! এদের কেউ  মেনে নিতে পারছেন না -ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না!  প্রতিবেশীদের   কাছে তার প্রিয় খাবার খেতে আসবে না!! !!

প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। বাঁচবার আকুল আকুতিতে পিতার বুকে আছড়ে পড়েছিলো ফারিহা! অসহায় পিতা  নিকটস্থ  হাসপাতালে ছুটে গেলেও  তাৎক্ষণিকভাবে  অক্সিজেন এবং জরুরী চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেড়ে নেয় দিবা-পাপ্পুর বুকের ধন , তাদের প্রথম সন্তান ফারিহাকে। ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচার আকুতি !, তার দুই কন্যা নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও  প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত!
 ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে  অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা  দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?

আর প্রিয়তম পিতা -যাকে চোখে হারাতো ফারিহা? সেই পিতার বুকেই বারবার আছড়ে পড়েছে বাঁচবার আকুতি তে। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সদস্য সন্তান হারা পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু । শূন্যতার  জগদ্দল পাথর বুকে হাল্কা রসিকতা , সবসময়ের মতো- তার বুকের ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা কখনোই পূরণ হবার নয়! তবু জীবন বয়ে যায় নিত্য, অনন্ত ধারায়!!


স্বজনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। 


 রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩ স্বজন কে হারাতে হয় !  কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন। 

  পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার মৃনালিনী দেবী  মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ'-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷''

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷

 অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে  মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ 

১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ 

এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ।

 রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলে কে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।

 রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !

আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।
জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷  জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!  লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে  শরৎ  টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''


১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷ 

১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷  শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷


আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷  আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''