Wednesday, November 26, 2014

মওলানা ভাসানী: হক কথার আড়ালে না হক বাণী-জাফর ওয়াজেদ

 আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকাল হতে সংগঠনটি বাংলার মানুষের হৃদয়াবেগে ঠাঁই পেতে শুরু করে। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় ভাসানী দলটি পরিত্যাগ করেন। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিনের পক্ষ সমর্থন প্রশ্নে দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন বলা হলেও নেপথ্য কারণ ছিল, নেতৃত্বের প্রশ্ন। ভাসানী যাকে সাধারণ সম্পাদক করতে চেয়েছিলেন, দলীয় অবস্থানগত কারণে তাকে তা করা যায়নি।

 এই প্রশ্নে মন কষাকষি থেকে বিরোধিতা মাত্রা পায়। এমনটাই মেলে পুরনো ইতিহাসের খেরো খাতায়। অথচ শোষিত মানুষের কন্ঠস্বর হবার কথা ছিল মওলানার। ‘মজলুম’ নেতার অনুসারীদের একটা অংশ জুলুমবাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে। থানা, ফাঁড়ি ও অস্ত্রলুট এবং গুপ্তহত্যার বিপরীতে ভাসানী ছিলেন নীরব, নির্বিকার। ভাসানী তার দলের সেক্রেটারি থেকে শেখ মুজিব নেতা হতে জননেতা এবং অবশেষে জাতির পিতা হলেন-ভাসানী তা মেনে নিতে পেরেছিলেন, এমনটা নয়। বরং এসব ঘটনার ব্যাপকতা বাড়ানোর পক্ষেই ছিল তার সব কর্মসাধনা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, হতশ্রী দরিদ্র দেশ কিন্তু তাকে টানেনি, পুনর্গঠন প্রশ্নে। বরং বিধ্বস্ত দেশকে আরো বিধ্বস্ত করে তোলায় ভাসানীর অবদান সর্বাপেক্ষা বেশী। আবেগতাড়িত মওলানা আবেগাপ্লুত বাঙালি জাতিকে হ্যামিলনের বংশীবাদক হিসেবে মুক্তির পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথ মাড়াননি। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার সম্মোহনী শক্তিধর ছিলেন। তাই স্বাধীনতার পথে, মুক্তির রথে ভাসানীকে সর্বাগ্রে দেখার কথা। কিন্তু তিনি ভিন্ন পথ ধরলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার দলের লোকজনের অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অধিকাংশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
 
মওলানা ভাসানী নিজে ভারতে অবস্থান করলেও তার দলের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও হয়নি। মূলতঃ দলের কাউকেও তিনি পাননি পাশে। তবে তার দলছুট সাবেক অনুসারীদের একটা অংশ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
 
ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী অধিকাংশ সময়ে হাসপাতালে কিংবা বিভিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসে কাটান ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ভারতের লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে ভিআইপি হিসেবে গণ্য করেন। তার থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার ভারত সরকার বহন করে। তাছাড়া হাত খরচের জন্য তাকে মাসিক দু’হাজার টাকা ভাতা দেয়া হতো। শুধু চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয় ৪৭ হাজার টাকা। (জ্যোতি সেনগুপ্ত : হিস্ট্রী অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ)।
 
১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হবার পর ভাসানী দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। মিসেস গান্ধী স্বহস্তে নগদ সাত হাজার টাকা একটি স্কার্ফে জড়িয়ে ভাসানীর হাতে তুলে দেন। ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যদানের জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। দেশে ফেরার পর তার ভরণ পোষণ কি করে চলবে, তিনি জানেন না। মিসেস গান্ধী তাকে বিমুখ করেননি। তার হাতে টাকার পুটুলি তুলে দেয়ার কথা মিসেস গান্ধী ১৯৭২ এর মার্চে ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তথ্যটি পান সাংবাদিক আবদুল মতিন জেনেভাতে। ঢাকায় ফিরে মওলানা ভারতীয় হাইকমিশনারকে তার বাড়ী তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪০ হাজার টাকা দেয়ার অনুরোধ করেন। বলাবাহুল্য তার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। (বাংলাদেশ ইন ব্লাড এন্ড টিয়ার্স: জ্যোতি সেনগুপ্ত)।
 
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশের পর ভাসানী তার দল ন্যাপকে পুনর্গঠন শুরু করেন। দলে হানাদারদের কোলাবরেটরও ছিল। এরপরই তিনি প্রকাশ করেন ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক টেবলয়েড আকারের পত্রিকা। রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত এক নতুন ভক্ত ইরফানুল বারীকে তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক করেন। পত্রিকাটিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার এবং ভারত ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বল্গাহীন প্রচারণা চলতে থাকে। চরম ভারতবিদ্বেষী এই পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে যে সব সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করে, তা জামাতে ইসলামীর প্রচারকাণ্ডের কার্বন কপি বলা যায়। ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং গুজবকে বেশ রসিয়ে চাতুরতার মোড়কে ছাপা হতো। ভারত ও রাশিয়ার সমালোচকদের উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করা হতো। তাদের বক্তৃতা বিবৃতি খবর হিসেবে ছাপিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আরেপিত নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়া হয়। জামাত, মুসলীম লীগসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ষাকবচে পরিণত হয় কাগজটি। সাম্প্রদায়িক উস্কানীদানেও প্রবৃত্ত হয়।

’হক কথা’ পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি অভিযোগ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। অভিযোগটি হলো- “কলকাতার রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের মোটর গাড়িতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের নিয়ে যাওয়া এসব মোটর গাড়িতে পূর্ব পাকিস্তানের ‘নম্বর প্লেট’ রয়ে গেছে।” তার অভিযোগ সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সরকারী ব্যাখ্যায় বলা হয়, ’পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরই বাংলাদেশের লোকজন তাদের নগদ সঞ্চয় স্থানান্তরযোগ্য সম্পত্তি ও কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের গাড়ী নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। কলকাতার পুলিশ বাংলাদেশের গাড়ীগুলোর জন্য একটি বিশেষ রেজিস্ট্রেশন নাম্বার (ডব্লিউ জে বি) দিয়েছিল। বাংলাদেশ মুক্ত হবার ক’দিনের মধ্যেই প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা এবং অন্যান্যরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করলে এসব যানবাহন ও ক্রমশ কলকাতা থেকে সরে যায়।’
’হক কথা’ পত্রিকাটি বাংলাদেশকে মুসলীম বাংলায় পরিণত করার পক্ষে জোরালো ভাষায় নিবন্ধও প্রকাশ করতো। ’হক কথা’র ভূমিকা ক্রমশ দেশ, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যায়। ১৯৭২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশবিরোধী অপপ্রচার সহ উস্কানিমূলক ভারত ও রুশ বিরোধী পত্রিকা ‘হক কথা’ নিষিদ্ধ করা হয়। দৈনিক বাংলার ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সংখ্যায় বলা হয়, ’রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে সরকার ‘হক কথা’, ‘মুখপত্র’ এবং ‘স্পোকসম্যান’ নামে তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে।
 
হক কথার অনুরূপ প্রোপাগাণ্ডা চালাতো এনায়েত উললাহ খানের সাপ্তাহিক ‘হলিডে’র প্রকাশনায় সরকার কোনো বাধা দেয় নি। ‘হক কথা’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পরই ভাসানী প্রকাশ করেন ‘হক বাণী’। না-হক সব লেখায় পরিপূর্ণ থাকতো পত্রিকাটি। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীকে বিব্রত করার জন্য ‘হক কথা’ থেকে ‘হক বাণী’ পত্রিকার মাধ্যমে ভাসানী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবকে ভারতের তল্পিবাহক বলে প্রমাণ করতে পারলে জনগণকে বোঝানো যাবে, বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনাত লাভ করে নি। ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশ। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল চীন। দু’দেশের মৈত্রী বন্ধন শিথিল করা গেলে চীনের উদ্দেশ্য সফল হবে-ভাসানী এই মনোভাব পোষণ করে অব্যাহত অপপ্রচার চালান। ১৯৬৩ সালে মাও সে তুং ভাসানীকে ভারত ও রাশিয়া সম্পর্কে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা তিনি ভোলেন নি। তারই প্রতিফলন তার পত্রিকাতেই রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য ভাসানী হক বাণীতে নেতাকে সরাসরি আক্রমণ না করে ইন্দিরা গান্ধীকে মুজিবের পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে দোষারোপ করার পথ বেছে নেন। সে সময় প্রচার ছিল, ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের প্রতি তার ক্ষোভের কারণ হল, তিনি ভারতের কাছ থেকে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্য আশা করেছিলেন, তা পাননি বলে ভাসানী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তার ‘হক কথা’ ও ‘হক বাণী’ পত্রিকার পাতায় পাতায় হিন্দু বিদ্বেষ প্রকটিত। পত্রিকাটি ক্রমশ বাংলাদেশকে মুসলীম বাংলা হিসেবে পরিণত করার জন্য নানা উস্কানিমুলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
 
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে খাদ্য বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশকীয় দ্রব্যসামগ্রী দুস্প্রাপ্যতার কারণে জনমনে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, কলকারখানা চালু করার পদক্ষেপ চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছিল। কিন্তু দেশী বিদেশী চক্রান্ত, একশ্রেণীর মজুতদার, মূনাফাখোর, অসাধু চোরাচালান গোষ্ঠীর কারসািজ এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য শ্রেণী গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ব্যবস্থা নানাভাবে বিঘিœত হয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তানী দালালদের অন্তর্ঘাত ও ধংসাত্মকমূলক কার্যকলাপে দেশে ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা। এসব কিছুর ফলে জনসমাজে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বস্তি, অসন্তোষ ও অস্থিরতা। দেশের এহেন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে মাওবাদী চরমপন্থী প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কার্যকলাপ। এসময় মওলানা ভাসানীর অসহযোগ ও সরকার বিরোধী উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা মাওবাদী ও উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী দালাল ও সংগঠনগুলোর উপরোক্ত কার্যকলাপ পরিচালনার সাহস ও শক্তি সঞ্চারে সহায়ক ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে।

চীনের অনুসারী সিরাজ সিকদারের ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ ‘স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত’ বলে উল্লেখ করে। ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ কায়েমের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়। হক, তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিণœ গণচীনমুখী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলও একইভাবে ভারত ও সোভিয়েত বিরোধী শ্লোগান দেয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের সংকল্প নিয়ে গোপন রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এদের অধিকাংশই হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয় এবং সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এই প্রস্তুতিরই অংশ হিসেবে তারা শুরু করেন (তাদের ভাষায়) ‘জাতীয় দুশমন’ খতমের অভিযান। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে ‘নতুন পতাকা ওড়াবার’ হুমকি দেন।
 
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় ২২ জানুয়ারি। আর তখন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে ডানপন্থী ও বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানের হানাদারদের সহযোগী দল জামাত, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামীও ভাসানীর নেতৃত্ব মেনে নেয়। আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে ভাসানীর নেতৃত্বে এক ডজনেরও বেশী দল-উপদল এবং গ্রুপ সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’। জাসদকে চেষ্টা করেও কমিটিতে ভুক্ত করা যায়নি। জাসদ তখন ’একলা চলো’ নীতি নিয়েছে।
ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে অপপ্রচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। অতীতের পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শাসক ও শোষকদের মতো তারাও ভারতবিরোধী প্রচারণা, ইসলামের দোহাই এবং সাম্প্রদায়িক জিগিরকেই বেছে নেয় আওয়ামী লীগকে খতম করার হাতিয়ার হিসেবে। এমন কি জাসদের কন্ঠেও ছিল একই সুর। ১৯৭৩ এর ১৪ এপ্রিল ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), শ্রমিক কৃষক সাম্যবাদী দলের সমন্বয়ে একটি ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে ৬ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার সংগ্রাম ও তৎপরতা পরিচালনার দৃঢ় সংকল্পও ব্যক্ত করা হয় এই ঘোষণায়। এরপর ২৩ এপ্রিল ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পল্টন ময়দানে যে জনসভা করে তাতে ভাসানী মুজিব সরকারকে উৎখাত এবং আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার দৃঢ় সকল্প ব্যক্ত করেন।
 
১৯৭৩ সালের ২ মে জাতিসংঘের মহাসচিব খাদ্যশস্য ঘাটতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানান। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৩টি জেলা বন্যা কবলিত হয়। ১২ মে বঙ্গবন্ধু বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ১৫ মে ৩ দফা দাবিতে ভাসানী অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৬ মে বঙ্গবন্ধু ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২২ মে ভাসানী বিরোধী দলীয় নেতাদের অনুরোধে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।
 
আগস্টে সারাদেশে মারাত্মক বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অগণিত মানুষ নিপতিত হয় সীমাহীন দুঃখ কষ্ট ও অভাব-অনটনের মধ্যে। এই অবস্থায় চৈনিকপন্থী উগ্রবাম ও স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত অন্তুর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে। জনগণের দুঃখ দুর্দশা তাদের মধ্যে কোনো রেখাপাত করেনি। থানা, ফাঁড়ি ও অস্ত্রলুটপাট অব্যাহত রাখে। সেই সঙ্গে গুপ্তহত্যা। উগ্রজামাতপন্থী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের এহেন সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে উৎকন্ঠিত ও আতংকগ্রস্ত তখন দেশের জনগণ। এহেন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে জনগণ আরো বেশী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ভাসানীর বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী বিভিন্ন উক্তি, বিবৃতি ও বক্তব্যে। ২৯ আগস্ট ভাসানীর ৩ দফা দাবির পক্ষে জনসমর্থন প্রদর্শনে তার অনুসারীরা সারা ঢাকা শহরে হরতাল পালন করে।
সারাদেশ জুড়ে অরাজকতা। তখন ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ, চরমপন্থী গলাকাটা দলগুলো এবং এসব দলের ছত্রছায়ায় হানাদারদের সহযোগী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা তাদের দৃষ্টিতে ‘ভারত-রাশিয়ার পুতুল সরকার’ উচ্ছেদের অভিন্ন লক্ষ্যেও নিজেদের মধ্যে ‘সংগ্রামের জন্য ঐক্য মোর্চা’ গড়ে তোলার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন।
 
২৭ জুন ১৯৭৪ তিনদিনের সফরে পাকি প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ঢাকায় আসেন। সফরসঙ্গী ছিল ১০৭ জন। তার ঢাকা আসার আগেই পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা বিভাগসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি অগ্রবর্তী দল আসে। তারা জামাত, নেজামে, পিডিপি, মুসলীম লীগ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রচুর উপঢৌকন ও অর্থকড়ি বিতরণ করে। এসব করা হয়েছিল যাতে ভুট্টো ভালো সংবর্ধনা পায়।
প্রচার ছিল যে, ভুট্টো ঢাকায় চীনপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। এর মধ্যে ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভুট্টো যেন কোনো অবস্থায় শেখ মুজিবের সঙ্গে সব বিষয়ে ফায়সালা না করে। ভুট্টো তা রক্ষা করে অমীমাংসিত বিষয়াদি ঝুলিয়ে রাখে। ভুট্টো ঢাকায় অবস্থানকালেই ২৯ জুন ভাসানীর নেতৃত্বে একটি গণমিছিল বঙ্গভবনের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়। অতপর মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রতিবাদে ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৯ জুন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে ভাসানীর নেতৃত্বে একটি জঙ্গি মিছিল বের করার চেষ্টা চালানো হলে পুলিশের হস্তক্ষেপে তা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ৩০ জুন রাতে ভাসানীকে মগবাজারের এক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইলের সন্তোষের বাড়িতে নিয়ে অন্তরীণ রাখা হয়। ভাসানী গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৬ দলীয় ঐক্যজোট ৫ জুলাই সারাদেশে হরতাল ডাকে ।কিন্তু সেদিন ঢাকায় কোনো হরতাল হয়নি। পিকেটারও দেখা যায়নি।
 
১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মন্দা চলছিল। সেই সঙ্গে দেশে মুদ্রাস্ফীতি এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দেশকে চরম সর্বনাশের কবলে গ্রাস থেকে উদ্ধারে ব্যস্ত তখন বঙ্গবন্ধু সরকার। বিরোধী দলগুলো তখন অবাধ গণতন্ত্রের সুযোগে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ‘জেহাদে’ অবতীর্ণ হয়। ভাসানীর ন্যাপ, মাওবাদী চরম উগ্রপন্থী এবং বিভিন্ন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল- এমন কি বিবৃতিদানকারী দলগুলোও সরকার বিরোধী অভিযানে সামিল হয়।
 
বেআইনী ঘোষিত স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি দালাল সংগঠনগুলোর সদস্য এবং সমাজ বিরোধীরাও সরকার বিরোধী এই অভিযানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগদান করে। নাশকতা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানিসহ ধংসাত্মক ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়। ভাসানী এই সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেননি। বরং আরো উস্কানি দিয়েছেন।হক কথা বলতে যেয়ে ভাসানী মূলতঃ দেশ জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।(চলবে)