Friday, July 4, 2014

বঙ্গবন্ধু ফেরাউন? বঙ্গবন্ধুকন্যা নাস্তিক? রাষ্ট্রপতি বটতলার উকিল? -মুনতাসীর মামুন

পত্রিকার মফস্বল পাতা অধিকাংশ পাঠকই এড়িয়ে যান। মফস্বল পাতা দূরে থাকুক, অধিকাংশ মানুষ তো পত্রিকাই পড়েন না। অধিকাংশ দেশেই তাই। তবে, একটি ব্যতিক্রম আছে। বাংলাদেশের বাইরে রাজনীতিবিদরা রুটিন করে পত্রিকা পড়েন এবং পত্রিকার মতামত গুরুত্বসহকারে নেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে জবাব দেন। আমাদের রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ পত্রিকা পড়েন না। গ্রাহ্যও করেন না। প্রবাসী এক বন্ধু জানালেন, এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, পত্রিকার উপসম্পাদকীয়গুলো তিনি পড়েন কিনা। অক্লেশে তিনি বলেছেন, পত্রিকাই তিনি পড়েন না, কারণ তিনি সময় পান না। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত পত্রিকা পড়েন, উপসম্পাদকীয়ও পছন্দ হলে পড়েন। এক ভোজসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ যখন আমাকে বললেন, তিনি জনকণ্ঠের জন্য অপেক্ষা করেন এবং আমার লেখা পড়েন। তখন আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি।

এত বড় ভনিতা করতে হলো বা হয়ে গেল একটি কারণে। দৈনিক জনকণ্ঠের ৩০ জুন মফস্বলের পাতায় বক্স করে গুরুত্ব দিয়ে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। এই সংবাদ হয়ত কারও কাছেই গুরুত্ব পাবে না। কিন্তু আমার শুধু নয়, আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়েছে সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষকদের মানসিকতা ইত্যাদি বোঝার জন্য। শুধু তাই নয়, এ সংবাদটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর গোচরে আনা শুধু উচিতই নয়, ব্যবস্থা নেয়াও কাম্য। এ সংবাদটি হয়ত আমারও চক্ষু এড়িয়ে যেত। কিন্তু রোজার প্রথম দিনেই শাহরিয়ার কবির ফোন করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমাকে শুধু সংবাদটি পড়ানো নয়, লিখতেও বাধ্য করেছেন। শুধু তাই নয়, হাশেম খান, রবিউল হুসাইন, স্বদেশ রায়, তারিক সুজাত, আহমেদ মাফুজুল হক প্রমুখ অনেকেরই দেখলাম এই সংবাদটি চোখে পড়েছে এবং একই অনুরোধ তাঁরা আমাকে করেছেন। সে কারণেই ‘আমাদের’ শব্দটি আগে ব্যবহার করেছি। আমি পত্রিকার ভাষ্যটিই যথাযথ মনে করেই এ ভাষ্যটি লিখছি।

নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির খুলনা ক্যাম্পাসে ঘটনাটি ঘটেছে। আমি জানতাম শাখা ক্যাম্পাস অবৈধ। এখন দেখছি আমার জানা ভুল। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস হয় না।
ওই শাখা ক্যাম্পাসের আইনের ছাত্র মোঃ নাঈম। সেখানে পড়ান রাজিব হাসনাত শাকিল নামের এক ব্যক্তি। পড়াতে গিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধ ও দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট শুধু নন স্বয়ং জাতির পিতা সম্পর্কে কটূক্তি করেন। নাঈম তার প্রতিবাদ করায় তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করা শুধু নয়, তাঁকে পেটানোরও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পুরো ঘটনাটি সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছে এবং জনকণ্ঠ ছাড়া আর কোন সংবাদপত্র সংবাদটি ছেপেছে বলে আমার মনে হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র মোঃ নাঈম জানান, ‘২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে দেওয়ানি কার্যবিধির ১০ ধারা পড়াতে গিয়ে শাকিল স্যার কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনাকে অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি বর্তমান সরকার অবৈধ ও প্রধানমন্ত্রীকে নাস্তিক আখ্যায়িত করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ফেরাউনের সঙ্গে তুলনা করে ১৫ আগস্টের ঘটনাকে স্বদেশ প্রেমের প্রতিচ্ছবি হিসেবে মন্তব্য করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে বটতলার উকিল বলে কটূক্তি করেন ওই শিক্ষক।’

ছাত্র ছাত্রসুলভ আচরণ না করলে শিক্ষকের অধিকার আছে ছাত্রকে ভর্ৎসনা করার। তেমনি, শিক্ষক শিক্ষকসুলভ আচরণ না করলে ছাত্রেরও অধিকার আছে তার প্রতিবাদ করার। এখানে দেখা যাচ্ছে- শাকিল নামের ব্যক্তিটির আচরণ শুধু অশিক্ষকসুলভ নয়, রাষ্ট্রবিরোধীও বটে। এই ব্যক্তিটির বক্তব্য জামায়াত-বিএনপি নেতাদের থেকেও কট্টর। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি এ ধরনের শিক্ষক নিযুক্ত করে এবং তার বক্তব্যের পক্ষ নেয় এ কারণে কি এটি জামায়াতের টাকায় পরিচালিত? বস্তুত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ঝোঁক আছে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির প্রতি- এ রকম একটি ধারণা বাইরে প্রচলিত। কারণ হিজবুত তাহরির, ছাত্রশিবির সদস্য যারা নাশকতার জন্যে গ্রেফতার হয়েছে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও মানে না এবং আদেশ না মানলে কোন শাস্তিও হয় না। কোন না কোন পর্যায়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ টাকা খাচ্ছে। না হলে, নির্দেশ না মানলে শাস্তি হবে না কেন?

শাকিল নামের ব্যক্তিটি যাঁর কারণে আজকে একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছে তাঁকে যখন ফেরাউন বলে আখ্যা দেয়া হয়, তখন তার মনমানসিকতা ও তার পরিবার সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। কত বড় হারামজাদা হলে জাতির জনক সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করা যায়! এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রী নাস্তিক! এই শব্দটির অর্থও সে জানে কিনা সন্দেহ। যাঁর ধর্মাচরণে এবং মাঝে মাঝে অতি ধর্মাচরণে এবং মাঝে মাঝে হেজাবিদের প্রশ্রয় দানের কারণে আমরাই যারপরনাই ক্ষুব্ধ হই তিনি কিনা নাস্তিক! রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর। নর্দার্নের কিনা জানি না। না হন নর্দার্নের, কিন্তু দেশের প্রথম নাগরিক তো তিনি। মির্জা ফখরুলও তো রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে এ রকম উক্তি করেন না। সব রকমের সভ্যতা ভব্যতাবিরোধী এই মনোভঙ্গী। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এ ধরনের মন্তব্য অনেকে করতেও পারেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে? ভারতে কিছুদিন আগেও ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করায় কটূক্তকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাকিল নামক ব্যক্তিটি ১৫ আগস্টের হত্যাকা-কে স্বদেশপ্রেম বলে আখ্যায়িত করেছেন। একজন শিক্ষক তো নৈতিকভাবে কোন হত্যাকা-ই সমর্থন করতে পারেন না। এই ব্যক্তিটি শুধু তাই নয়, কাদের মোল্লার ফাঁসিকে অবৈধ বলার অর্থ ট্রাইব্যুনাল বৈধ নয়, যা আদালত অবমাননার সমান। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।

কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। মোঃ নাঈম বলেন, শিক্ষক ‘শাকিলের কটূক্তিমূলক বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে তিনি ক্লাস বর্জন করেন। পরবর্তীতে ঘটনাটি ডিপার্টমেন্টের এ্যাডভাইজার, খুলনা ক্যাম্পাসের ইনচার্জ ও সহপাঠীদের জানান। এ্যাডভাইজার তাঁর কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো তাঁকে শাসিয়ে দেন। পরদিন ক্লাসে গেলে শিক্ষক শাকিল তাঁকে আওয়ামী লীগের চামচা বলতে থাকেন। কৌশলে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হয়।’

নাঈমের সংবাদ সম্মেলনের পর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সংবাদকর্মীরা বৈঠক করেন। সেখানে প্রেসক্লাবের ‘সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে তাঁর (নাঈমের) কাছ থেকে আন্ডার টেকেন চাওয়া হয়। এতে রাজি না হওয়ায় কয়েকজন বহিরাগত সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক দিয়ে তাঁকে জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়। একপর্যায়ে ইউনির্ভাসিটির স্টোর রুমে ডেকে নিয়ে জোর করে তাঁকে দিয়ে একটি সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয় খুলনা ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ।’

বিএনপি এরশাদ জামায়াত সামরিক শাসনে গত ৩০ বছরে এমন জেনারেশনের সৃষ্টি করা হয়েছে যারা শাকিলের মতো ধ্যান-ধারণাই পোষণ করে। এর কারণ হচ্ছে সামরিক শাসক বিএনপি-জামায়াত তাদের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কর্তব্য ছিল সে আধিপত্য ভেঙ্গে নিজেদের বা সঠিক ইতিহাসের আধিপত্য বিস্তার করা। দুঃখের বিষয়, বর্তমান সরকার যথাযথভাবে এই কাজটি করতে পারেনি, এ ধরনের কাজের দিক-নির্দেশনাও নেই, যারা স্বইচ্ছায় এসব কাজ করতে পারতেন তাঁরা মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের চেয়ে টু-পাইস কামানোতে ব্যস্ত। এই আধিপত্য বিস্তারের প্রথম ধাপ পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকে ইতিহাস বিকৃতি সংশোধন করেছে। এই ইতিহাস বিকৃতি ও সঠিক ইতিহাস জানার ওপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন। আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী, সচিব, মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন-অনুরোধ জানিয়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ পর্যায়ে প্রতিটি ছাত্রের জন্য ১০০ নম্বরের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসটি পাঠ্য করার। কেউ কর্ণপাত করেননি। তাদের অনীহার কারণ বোঝার ক্ষমতা আমার নেই কারণ তারা পদের অধিকারী। কিন্তু পদাধিকারী ব্যক্তিরাই তো যখন পদ পাননি তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যে পড়া উচিত তা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে শুনিনি। আগ্রহ দেখালে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগের কোন ঘাটতি থাকত বলে মনে হয় না। তাদের কাছে এ দাবিটি সামান্য। কিন্তু কখনও তাদের মনে হয়নি, এ রকম একটি জেনারেশন রেখে বা তৈরি করে জিডিপি বৃদ্ধি কোন কাজে আসবে না। এই অনুরোধটি শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর জন্য রেখেছেন এবং সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় প্রত্যেক সদস্য এ উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কারণ এতে কমপক্ষে ১০ লাখ ছাত্র প্রতিবছর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়বে এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা হবে। তবে, এটি কতটা কার্যকর হবে জানি না। কারণ খবর পেয়েছি, অনেক কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন- ২০১৭ সাল থেকে বিষয়টি কার্যকর হবে। ২০১৪ সালে যাঁরা ডিগ্রী ক্লাসে পড়ছেন, তাঁদের জন্য কার্যকর হবে না। অর্থাৎ, এটি পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতোও যথেষ্ট লোক আছে। তবে, এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্ব তো কর্তৃপক্ষের।

যে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম তা তুচ্ছ করে দেখার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য এ রকম মুখিয়ে আছেন অজস্র শিক্ষক। জামায়াত-বিএনপি মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এ চেষ্টা করবেই। এ প্রচেষ্টা প্রতিরোধ তো অবশ্যই করতে হবে।
আমি জানি না শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা সচিবের পত্রিকা পড়ার কোন সময় হয় কিনা। যদি হয়, তা হলে দাবি জানাব অবিলম্বে নর্দার্নের শাখা ক্যাম্পাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, সেই শিক্ষককে গ্রেফতার করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রটির সুরক্ষা দান।

খুলনা শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র-শিক্ষক, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মী আছেন কিনা আমি জানি না। কারণ যে শহরের প্রধান সড়কের নাম খান এ সবুর রোড- সে শহর সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা হতেই পারে। যদি এখনও ওই শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন থেকে থাকেন বিশেষ করে ছাত্ররা, তা হলে ওই কাম্পাস তাঁদের অবরোধ করা উচিত যতক্ষণ না কর্তৃপক্ষ করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত ও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না করে এবং ছাত্রটিকে সুরক্ষা দেয়। সরকার কী করবে না করবে তা নিয়ে মাথাব্যথার দরকার নেই, আমরা কী করতে পারি- সেটিই বিবেচ্য।