Thursday, August 9, 2012

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত নায়ক: মাহমুদুল বাসার




১৫ আগষ্ট, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে, সপরিজনে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের অন্যতম একটি ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড। বাংলাদেশের একদল বিভ্রান্ত সেনাসদস্য এই হত্যা সংঘটিত করেছে। এরা ছিলো ক্রীড়নক। দেশি-বিদেশি শক্তিশালী ষড়যন্তকারী একটি চক্র এই হত্যার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মাদী বেগ, তার অর্থ এই নয়, মোহাম্মাদী বেগই সিরাজ হত্যার আসল ব্যাক্তি। ঠিক তেমনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, মেজর নূর বঙ্গবন্ধু হত্যা-নাটকের মূল চরিত্র নয়।
সিরাজ হত্যার মূল পরিকল্পক ছিলো ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির প্রতিনিধি লর্ড ক্লাইভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক ছিলো মর্কিন প্রতিনিধি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার এবং তার দোসর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো।
এরা দুজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলেন। খুব অপমানিত হয়েছিলেন এরা। একটা শানিত অপমানিত বোধ থেকে কিসিঞ্জার ও ভূট্টো বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনক্শা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঁকা নজরে দেখতেন খন্দকার মোস্তাক এবং জিয়াউর রহমান। এর প্রমাণ ইতিহাসে আছে। দুজনই ছিলেন ক্ষমতা লিপসু, উচ্চাভিলাষী এবং ঘড়যন্ত্রকারী, এর প্রমাণও ইতিহাসে আছে।
মোস্তাক চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হতে তারপর মুজিব নগর সরকারের প্রদানমন্ত্রী হতে। পারেননি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতারে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তুমুল প্রতিবাদের মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর পর কলকাতা যেয়ে তিনি ড. আনিসুজ্জামানের কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ড. আনিসুজ্জামানের “আমার একাত্তর” বইতে তা লেখা আছে। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোস্তাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার যে চক্রন্ত করেছিলেন, এর সঙ্গে জিয়াউর রহমানও জড়িত ছিলেন। 
মোস্তাক এবং জিয়া দু’জনই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। একজন রাজনৈতিক অঙ্গনে বসে, অন্যজন সেনাবাহিনীর পরিমন্ডলে বসে। যতদিন বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন দ’জনই বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে নিখুঁত অভিনয় করেছেন। যাতে আঘাতটা ভেতর থেকে করতে পারেন।
ড. ওয়াজেদের বই পড়ে জানা যায় যে, মোস্তাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রবল তর্ক হয়েছে বাব্দশাল গঠন নিয়ে। তারপরও মোস্তাক তাজউদ্দিন, জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের মত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেননি। জিয়া বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তার “ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা” বইতে জানিয়েছেন যে, তিনি যখন প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার ডিক্টেশন নিতে যেতেন ৩২ নাম্বার ধানমন্ডিতে, তখন প্রায়ই দেখা হোত জিয়ার সঙ্গে, তিনিও নিয়মিত বঙ্গবন্ধু ভবনে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে জিয়াউর রহমান নতজানু হয়ে বঙ্গবন্ধুকে তোষামোদ করে কথা বলতেন। খামাখা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতেন, “আগে আমার বুকেগুলি লাগবে, তারপর বঙ্গবন্ধুর বুকে লাগবে”। (অধ্যাপক আবু সাইয়িদÑ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃ ফ্যাক্টস্ এ্যান্ড ডকুমেন্টস্)।
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা জিয়ার সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। তারা জিয়ার কাছে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের প্রস্তাব করেন। জিয়া বলেন, “আমি এ সবে থাকতে পারি না, তোমরা জুনিয়ররা এ সব করলে করতে পারো”। অর্থাৎ তোমরা এগিয়ে যাও; আমি আছি পেছনে।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক, দার্শনিক ও অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান (শফিক রহমানের পিতা) একটি বই লিখেছেন, নাম “শতব্দীর স্মৃতি”। সেখানে স্মৃতিচারণায় সাইদুর রহমান বলেছেন যে, ১৯৭৪ সালে তার ভায়রার বাসায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়। জিয়া তার কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাংঘাতিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও বিেেষাদগার করেন।
অথচ প্রজাতন্ত্রের সেবক হয়ে জাতির পিতার বিরুদ্ধে এবং সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে এমন ক্রদ্ধতা প্রকাশ করতে পারেন না। জিয়ার সৎ সাহস থাকলে তিনি চাকুরি থেকে পদত্যাগ  করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারতেন।
জিয়ার কুটিল চেহারা চেনার জন্য নিরন্তর গবেষণা করা উচিত। আমার বন্ধু সাংবাদিক স্বদেশ রায় একবার বলেছিলেন যে, তিনি “মেজর জেনারেল গনতন্ত্র” নাম দিয়ে জিয়াউর রহমানের ওপর বই লিখবেন। লিখেছেন কিনা জানিনা।
আপাতত মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম প্রণীত “লক্ষ প্রানের বিনিময়ে”, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের “ইতিহাসের ছায়াচছন্ন প্রহর ও বঙ্গবন্ধু” বই দুটো পড়লে জিয়ার আসল স্বরূপ চেনা যাবে। ইতিহাসের তিনি একজন খল নায়ক। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের উস্কানী দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর সেনা অভ্যন্তরে ফারুক ও রশীদদের ডিফেন্স দিয়েছিলেন। তখন সেনা বাহিনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মত নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠার বিপক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া জিয়া সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লবিং করে ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিলেন।
জিয়া ও মোস্তাক দুজনই মতলববাজ ও সম্প্রোদায়িক। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তারা বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি। তাই দেখা গেলো, জিয়া ১৫ আগষ্ট সকালে নির্বিকার ভাবে, উৎফুল্ল মনে সেভ করতে বসেছেন। খবর এলো রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘সো হোয়াটা।’ ঐদিন তিনি সেনা ছাউনিতে গিয়ে খুনী ফারুককে বললেন, ঋধৎঁয়ব পড়সব ঃড় সব ধহফ শরংং সব, ুড়ঁ যধাব ফড়হব ধ মৎবধঃ লড়ন, (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃ ফ্যাক্টস্ এ্যান্ড ডকুমেন্টস্)।
জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন তার পুরস্কার দিতে বঙ্গবন্ধু কর্পণ্য করেন নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। তাই তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান না বানিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহকে বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে তেম আমল দিতেন না। একবার বলেছিলেন “আমাদের জিয়া বড় মুক্তিযোদ্ধা, কেবল আমার বিরুদ্ধে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে।” অর্থাৎ জিয়ার চোখের ভাষা বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, তাই গুরুত্ব দিতেন না। এই ক্ষোভ জিয়ার মনে সাপের বিষের মত কাজ করেছিলো।
বঙ্গবন্ধু গবেষক, লন্ডন প্রবাসী লেখক আব্দুল মতিন “বিজয় দিবসের পর ও বঙ্গবন্ধ”ু বইতে দেখিয়েছেন, কেনো জেনারেল ওসমানী জিয়াকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের হস্তক্ষেপে তার মীমাংসা হয়। আব্দুল মতিন আরো জানিয়েছেন যে, জিয়া ভারতের কয়েকটি শরনার্থী শিবিরে ভারত সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছেন।
ধূর্ত, চতুর, উচ্চাভিলাষী জিয়া জেনারেল শফিউল্লাহ্র দৌর্বল্যেরও সুযোগ নেন।  ’৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে তিনি হযরত মাবিয়া ও স¤্রাট আওরঙ্গ জেবের মত দক্ষতার সঙ্গে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগান। কিছুদিন আগে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদড় ড. মুনতাসীর মামুন একটি কলামে বলেছেন, দেশে এখন ৫০% পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন আছে। 
এই কৃতিত্ব জিয়াউর রহমানের। পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন, আমেলা-আর্মি ও এলিটদের নিয়ে তিনি দল গঠন করেছেন। তিনি যেভাবে ১৯৭১ সালের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করেছেন তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে সম্ভব ছিলো না। তার রাজত্বে ফারুক রশীদরা “ফ্রিডুম পার্টি” নাম দিয়ে দলগঠন করে “কুড়াল” মার্কা নিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে রাজনীতি করেছে। এই আস্কারা জিয়াউর রহমান দিয়েছেন। এখনো তার স্ত্রী এবং তার দল যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে যাচ্ছেন। 
অনেকে বলেন, দুই নেত্রীর সমঝোতার দরকার। বেগম জিয়া যদি ১৫ আগষ্টের মত জাতীয় শোক দিবসে কাল্পনিক জন্মদিন পালন করেন তাহলে সমঝোতা হবে কেমন করে? এই আদর্শিক সংঘাত সহজে মিটবে বলে মনে হয় না।
১৯৭৮ সালে এক কলামে আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী বলেছিলেন, “জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যার পালের গোদা।”
গবেষকদের উচিত শুধু চোখের পানি না ফেলে এই পথে আরো গবেষণা করা।

মাহমুদুল বাসার প্রবোন্ধিক
গবেষক।