Sunday, December 7, 2014

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার :৯০তম জন্মদিনে প্রণতি

বাংলা গানের অবিস্মরণীয় জুটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং শিল্পী মান্না দে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তার সেই বিখ্যাত গান ‘শোন একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ...।’তার লেখা এ গান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে লক্ষ প্রাণে শিহরণ বইয়ে দিত। অনুপ্রেরণা যোগাত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিপাগল বাঙালির হৃদয়ে।
‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই।  ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। 
‘বধূয়া, এই মধুমাস বুঝিবা হলো বিফল’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো’ এমন শত শত গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- গানটি কালজয়ী হয়ে ওঠে সংগীতশিল্পী মান্না দের কণ্ঠে। গানটি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীতশিল্পী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ৫ ডিসেম্বর বরেণ্য এই গীতিকারের ছিল ৯০তম জন্মদিন। প্রণতি রইল তার প্রতি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সালে উল্লিখিত দিনটিতে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ। শৈশবে কলকাতা চলে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। থিতু হয়েছিলেন পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায়। এ সময় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। কিন্তু মনের গহীনে যিনি শিল্পীসত্তা বহন করে চলেছেন তিনি তো সুযোগ পেলে সেদিকেই মন দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পাবনার আরেক কৃতিমান সাহিত্যিক, গীতিকবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। কিন্তু গানের ফুল ভালো করে ফোটার আগেই ১৯৫১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা চলে যান। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। 

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শুধু যে দ্রোহের গান লিখেছেন তা তো নয়। প্রেম, বিরহ, মানবতা, বিজয়ের গানও লিখেছেন  তিনি। তার বহু গান এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এখনও বেজে ওঠে খ্যাতিমান শিল্পীদের কণ্ঠে। এরমধ্যে শিল্পী মান্না দের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। তার লেখা গান কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর কণ্ঠে অমরত্ব পেয়েছে। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, একি বেদনার মতো বেঁধেছি আবার হারানো দিন’- মান্না দের কণ্ঠে গৌরীবাবুর এই গানগুলো এখনও হৃদয়ে ঝড় তোলে অনেকের। এমন অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের বাণী তিনি লিখেছিলেন সে সময়। 
১৯৩৭ সাল। পাবনা শহরের গোপালপুর লাহিড়ী পাড়ার মৈত্রবাবুর নাতনি পদ্মার বিয়ে। বরযাত্রী কলকাতা থেকে এসেছে । বরযাত্রীর সঙ্গে ঢেঙ্গা-পটকা লিকলিকে একটি ছেলেকেও দেখা গেল। গায়ে তার অদ্ভুত জামা। জানা গেল জামাটির নাম ‘বড়ুয়া জামা’। তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার জামার আদলে বানানো। আরো জানা গেল ছেলেটি কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই ছেলেটিই  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ওরফে বাচ্চু মজুমদার। ‘বাচ্চু’ ছিল তার ডাক নাম। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। যদিও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার লেখা গান প্রথম রেকর্ড হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যায় প্রথম গান- ‘ আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো, ঘুমায় মেঘ তারা…।’

১৯৭২। স্বাধীন দেশ। ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার  ঢাকায় এলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই মনে পড়ল জন্মস্থানের কথা। ছুটে এলেন কৈশরের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা দেখতে। শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত গীতিকবিকে দেওয়া হলো সংবর্ধনা। সেদিন মঞ্চে ছিলেন সহপাঠী ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যক্ষ কবি আবদুল গনি। শচীন দেব বর্মনের হাতেই বাচ্চু মজুমদার থেকে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়। একে একে রচিত হতে থাকে কালজয়ী সব গান- ‘আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি, রুধিবে রাঙানো আমি তীর বেঁধা পাখি।’ 

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তিনি সংগীতে মন সপেছিলেন। গান লিখি দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’এ রকমই ছিল তখনকার সৃষ্টিশীল মানুষের মন ও মনন। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড আজও বাজে বাংলার কোনো না কোনো ঘরে।
-