Wednesday, June 28, 2017

কন্যার চোখে পিতা : চট্টলার প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাইফুদ্দিন খান

'আমার বাবা : একজন দার্শনিক, পথপ্রদর্শক ও একজন বন্ধু'

'ধর্ম যবে শঙ্খ রবে করিবে আহ্বান, নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিও প্রাণ - মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়' !

অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সংগ্রামের পীঠস্থান  বৃহত্তর চট্টগ্রামের সন্তান আমার বাবা ভাষা সৈনিক এবং আলবদরের নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খান প্রাণ কে পণ করে  নিজেকে জয় করতে পেরেছিলেন । জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ - আক্ষরিক অর্থেই সব 'কাজের কাজী'  ছিলেন আমার বাবা ।

পাকিস্তানবিরোধী  স্বাধিকার  আন্দোলনের 'দায়ে'  বারবার কারাভোগ করেন তিনি,  ১৯৫৮ সাল থেকে  ১৯৬২ একটানা চার বছরের বেশি কারাভোগ করেছিলেন বাবা। তখন বঙ্গবন্ধু ও একই কারাগারে বন্দী ছিলেন ।সব কাজেই তাঁর আগ্রহ ; ক্ষেত্র বিশেষে  যেন অতি আগ্রহই  ছিল আজন্ম। আর আকৈশোর আত্মগোপনে  থেকে অনিয়ম জীবনচারণ , ত্যাগের দীক্ষা , বারবার কারাজীবন আর নির্যাতন যেন তাঁকে  কৌতুহল আর সহনশীলতা  দিয়ে সব ধরণের কাজে দক্ষ করে সকল প্রলোভন থেকে মুক্ত করেছিলো ।
বাবা সম্পর্কে মাস্টার'দার সহযোগী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী লিখেছিলেন, ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি । সব রকমের সম্প্রদায়িকতা , কুসংস্কার, সংকীর্ণতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ ছিলেন । মানবতার সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবন।

কোন শীর্ষ নেতৃত্ব বা কোন পদ আর পদবী তাঁকে টানে নি কখনো। বরাবরই এ ধরণের প্রস্তাব বা প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে কঠিন সত্যকে ভালোবেসে বেছে নিয়েছেন ত্যাগ ও তিতিক্ষার জীবন। তিনি সাইফুদ্দিন খান। যিনি কখনো কোন লোভ বা প্রলোভনের কাছে হার মানেন নি।

শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাদের বাসায় এসেছেন  খেয়েছেন এবং পুলিশের চোখ এড়াতে আত্মগোপনে থেকেছেন মাওলানা ভাসানী, মতিয়া চৌধুরী, পূর্ণেন্দু দস্তিদারসহ অনেক খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ।
আমি কৈশোরে দেখেছি বিপ্লবী রবি নিয়োগী, কমরেড আব্দুস সালাম,  হেনা দাস, খাপড়া ওয়ার্ডের নির্যাতিত প্রখ্যাত রাজনৈতিক আমিনুল ইসলাম বাদশা, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, আহমেদুল কবির, বজলুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, পীর হাবিবুর রহমান,  বাবার আকৈশোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা ভাষা সৈনিক সাংবাদিক এ টি এম শামসুদ্দিন, বেলা নবী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, ডাঃ ফৌজিয়া মোসলেম, ডাঃ মাখদুমা নার্গিস রত্না, মালেকা বেগম, আয়েশা বেগম, এডলিন মালাকার, ডাঃ মালেকা বানু, রাশেদ কান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো সহ বাম প্রগতিশীল শীর্ষ নেতাদের প্রায় সকলকে । গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ১৯৭৪ সাল তেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আমাদের বাসায় থেকেছেন।  অনেক সহযোদ্ধার পড়ালেখা এবং ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহ করতেন বাবা। নিজে কখনো খুব একটা স্বচ্‌ছলতার মুখ দেখেন নি বললেই চলে। সামাজ সংসারের  এতো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংসারে টানাপোড়েন , ঋণের বোঝা আজীবন টেনে নিয়েছেন।

তাদের ভোরে ষ্টেশনে রিসিভ করে বাড়ি আনতেন, আবার পৌঁছে দিতেন বাবা । শখ করে  বাজার করে আনতেন কচুর লতি, নানান রকমের  শুঁটকি, লইট্টা মাছ , বাঁশ খরুল (Bamboo Shoots)  । কোন রান্না খুব পছন্দ হলে বাবা আবার বাজার থেকে কিনে তাদের সাথে করে দিয়ে দিতেন।ছিলেন চার পুরুষের পৈত্রিক জমিতে । বাড়িটির ছাদে চিলেকোঠায় একটি রুম করেছিলেন, তাঁর অবর্তমানেও যেন আত্মগোপনে থাকা নেতাদের আশ্রয় হয় এই বাড়িতে। এখন আর নেতাদের এসবের প্রয়োজন হয় না। ভাবতে অবাক লাগে ,  কী নিঃস্বার্থ, আন্তরিক  আর মধুর ছিল সেই সময়কার রাজনৈতিক নেতা -কর্মীদেরদের মধ্যেকার সম্পর্ক । সবই স্বপ্নের মতো মনে হয় এখন ।

সাইফুদ্দিন খানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি সমৃদ্ধ সমাজসচেতন পরিবারে । ২৫ বছরের ও বেশি সময় সরকারী উকিল ( Government Pleader –GP) জমিদার মৌলভি ফজলুর রহমান খানের কনিষ্ঠ পুত্র সাইফুদ্দিন খানের শৈশব - কৈশোর, ছাত্র জীবন খুবই বর্ণাঢ্য ছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সূতিকাগার পটিয়াতে কমিউনিষ্ট পার্টির অবন্থান অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। মাস্টার’দা সূর্যসেন , বীরকন্যা প্রীতিলতার পথ ধরে পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার জন্যে এবং শোষণহীন সমাজ গড়বার স্বপ্নে  সারাদেশে অনেক উচ্চশিক্ষিত  জমিদার এবং অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানেরা তাঁদের  তারুণ্য এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন । কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো , কমরেড আবদুস সালাম তাদের অন্যতম। সাইফুদ্দিন খান তাঁদেরই সহযোগী ছিলেন ।  কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরী লিখেছেন ষাটের দশকে   বাম প্রগতিশীল আন্দোলন আর স্বাধিকার আন্দোলনে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৩টি পিলারের একটি ছিলেন সাইফুদ্দিন খান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, আজিজুল ইসলাম খান চাচ্চু র ৫/৬ বছরের জুনিয়র ছিলেন বাবা।  সমসাময়িক বা সিনিয়র সহযোদ্ধাদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত, তাদের দেখলে খুব ভালো লাগে, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এই দেশের এই সমাজের মানুষের অনুপ্রেরণা এবং জীবন্ত কিংবদন্তি এই বিরল নেতৃত্বের অধিকারীরা যেন আরো অনেকদিন বেঁচে থাকেন । একই সাথে মনে মনে ভাবি আমার বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, মানসিক প্রশান্তি পেতেন ঘাতকদের বিচারপ্রক্রিয়া দেখে, নিশ্চিতভাবে তিনি নিজে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে !


১৯৬৪ সালের ২০শে ডিসেম্বর তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা ম্যাজিষ্ট্রেট জামাল আহমেদ সিদ্দিকীর আদরের কন্যার বিয়ে হলো আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা হোলটাইমার বিপ্লবী , জমিদার ফজলুর রহমান খানের পুত্র সাইফুদ্দিন খানের সঙ্গে।হোলটাইমার স্বামীর রোজগার ছিল না। তাই ১৯৬৯ সালেই পূবালী ব্যাংকে চাকরি নিতে হলো । ব্যাংকিং, মহিলা পরিষদ আর একেবারে  অচেনা বিপরীত পরিবেশে সংসার করে  পর পর তিনটি সন্তানকে জন্ম দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলেছেন। দেশমাতৃকার সংগ্রামে উৎসর্গ করলেন নিজেকেও।সেই কৈশোরে অফ হোয়াইট বেনারসী কাতান পরে এক একান্নবর্তী জমিদার বাড়ির বৌ হতে হলো তাঁকে। তবু প্রবল প্রতাপে বিনয় আর পরম ধৈর্যের সাথে আকৈশোর রাজনীতির বরপুত্র হোলটাইমার একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডালিম হোটেলের টর্চার সেলের বর্বর অত্যাচারে জীর্ণ চিররুগ্ন সাইফুদ্দিন খানের নিবিড় পরিচর্যা আর সেবা করে তাঁকে ২০০৭ পর্যন্ত জীবন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছেন  প্রতিটি সংকটে পাশে থেকে।

তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে আমাদের জন্ম । যেখানে ক্ষুধা -দারিদ্রের সাথে নিত্য বসবাস । দুর্ভাগা এই দেশটিতে মানবিক চেতনাবোধ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ - একথাটি  সেই শৈশব থেকে আমাদের বুঝতে  হয়েছে । দেশপ্রেম এবং সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার প্রতি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন বাবা । সবসময়ে সঙ্গে করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে এবং রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে গেলে নিয়ে যেতেন ।আগেই বলেছি আমাদের বাসায় আসতেন, থাকতেন অনেক রাজনৈতিক নেতা কর্মী বিপ্লবী । চট্টগ্রামের কোনো সভা সমাবেশের অতিথি ঢাকা থেকে আসা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাকভোরে বরণ করতে বাস অথবা রেল স্টেশনে চলে যেতেন বাবা।  ব্যাংকের চাকরি , মহিলা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতা নেত্রীদের জন্যে বাজার,  রান্না করে রাতে বিছানা গুছিয়ে জমজমাট আড্ডা বসাতেন মা নূরজাহান খান।

আমাদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল । বাবার ইচ্ছেতে আমরা তিন ভাইবোনই বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর কাছে পড়েছি । ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন বিনোদ দাদুর কাছে , বললেন 'দাদা আঁর মাইয়ারে অ'নর হাত'ত তুলি দিলাম'। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ছ'বছর বাংলা , ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র পড়েছি বিনোদ দাদুর কাছে । আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বারবার বুঝেছি আমার ভাষা এবং ব্যাকরণগত ভিত অনেকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক শক্ত করে দিয়েছেন বিনোদদাদু । আমার বাবার নৈতিক এবং আদর্শিক দৃঢ়তা এবং দূরদর্শিতার কারণেই এতোটুকু সম্ভব হয়েছে । আমাকে অনেক কাজ শেখাতে চেয়েছিলেন বাবা, আমি  বরাবরই প্রচন্ড ফাঁকিবাজ ।  তাই বাবার কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারিনি । আনন্দের বিষয় হচ্ছে বাবা এবং মায়ের সবরকমের মানবিক গুণ ও মেধা আমার দুই ভাই  অর্জন করেছে। তাদের পেশাগত ও সামাজিক জীবনে নীরবে, কিন্তু  নিরলস ভাবে  সেই গুণের প্রভাব বাস্তবায়ন করছে তারা নিরন্তর।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দেশমাতৃকার কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এগিয়ে নিতে অনেক কাজ করতে চেয়েছিলেন বাবা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়ে কালারপোলের চার বিপ্লবীর আত্মদানের স্মৃতিতে শহীদ মিনার নির্মাণ, আরোজ আলী মাতুব্বর স্মৃতি পাঠাগার গঠন সহ আরো কত কী । সবই যে অসমাপ্ত রয়ে গেলো । তাঁর আত্মস্মৃতি দিয়েও এদেশের এক সমৃদ্ধ এবং গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক ইতিহাস লিখে যেতে পারতেন, যা আর হয়নি !



সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে প্রচন্ড সাহসী আর দ্বিধাহীন সাইফুদ্দিন খান তাঁর  কৈশোরেই দীক্ষা নিয়েছিলেন মানবতা আর সাম্যের জয়গানে ।

মনে পড়ছে, আমার আব্বু কিভাবে মিশে যেতেন সাধারণ মানুষের কাতারে । কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়ে সাম্পানে করে বাড়ি যাওয়ার সময়ে আমাদের বাড়ির পারিবারিক  মাঝি মতলবের হাত থেকে বৈঠা নিয়ে মাঝনদীতে সাম্পান চালাতেন । পাশ দিয়ে ইঞ্জিন চালানো লঞ্চ গেলে সাম্পান প্রচন্ড দুলতো । মা ভয়ে তটস্থ হয়ে আমাদের তিন ভাইবোনকে একসাথে বুকের মাঝখানে জড়িয়ে ধরে দোয়াদরুদ পড়তে থাকতেন চিৎকার করে করে, আর বাবাকে বকতেন- বাবা ওদিকে  সাম্পানের বৈঠা হাতে হাসতে হাসতে কিছুটা এগিয়ে আবার মতলব মাঝির হাতে নৌকার বৈঠা  ফিরিয়ে দিতেন।

এত হালকা পাতলা শরীর, তবু পাহাড়ি ঢালে রিক্সা চালকের সাথে ঠেলে তুলতেন রিক্সা । আমাদের বাসার সামনের রাস্তা এ.সি দত্ত লেন আর কোতোয়ালি থেকে লালদিঘি জে এম সেন এভিনিউ র পাহাড়ি পথ, প্রচন্ড রোদে রিক্সা চালকের ঘাম ঝরছে, আব্বু রিক্সা থেকে নেমে পেছন থেকে ঠেলে ঠেলে তুলে দিতো রিক্সা । আব্বু অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত এমনি দেখেছি ।এখন আমার পুত্র অতুলন আর গহন এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে । ঢালু রাস্তায় তারা রিক্সাওয়ালাকে সাহায্য করে পেছন থেকে টেনে তুলে দেয়।

১৯৯৩  সালে  দৈনিক ভোরের কাগজের চট্টগ্রামের পাতা আলোকিত চট্টগ্রামে ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু  করার সুযোগ পেলাম। লেখার প্রথম বিষয় ছিল, চট্টগ্রামের একমাত্র এভিনিউ ' জে এম সেন এভিনিউ 'তে  যাত্রামোহন সেন এর নামে কোনো সাইনবোর্ড নেই । ব্যারিষ্টার যাত্রা মোহন সেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের মামলা পরিচালনা করেছেন, শ্রমিক আন্দোলনের মামলা পরিচালনা করে অনশনরত হাজার হাজার শ্রমিকের খাদ্য এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি হয়েও।তাঁর অবদান এই প্রজন্মের তেমন কেউই জানেনা। যা জানানো আমাদের দায়িত্ব । তাই আবুল মোমেন কে বলে এই আ্যাসাইনমেন্ট নিলাম।   এই রিপোর্ট করার সময়ে কোতোয়ালি থেকে লালদীঘির পশ্চিম পার পর্যন্ত পুরানো স্থায়ী বাসিন্দা বা দোকানদার খুঁজতে থাকি , যাদের স্মৃতিতে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে জে. এম. সেন এর এই অ্যাভেনিউ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস । আব্বু আমাকে সাথে নিয়ে কানুনগো এন্ড কোং, দিগম্বরী ফার্মেসী, জান অপটিক্যাল লিঃ, লালদীঘির পারের পেট্রোল পাম্প সহ এ রাস্তার যত পুরানো মানুষ আছে সবার কাছে যান । কী করে 'জে এম সেন' এর  সাইনবোর্ড শুধু লালদীঘির পশ্চিম পারে সীমাবদ্ধ রয়ে গেলো- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পাশে ছিলেন আমার আব্বু । এভাবে প্রতিটি দুরূহ কাজে আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার আর গাইড ছিলেন আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান ।

বাবার অপত্য স্নেহের অনেক স্মৃতি, নিশ্চয়ই একদিন সেসব নিয়ে লিখবো ।

আমার জীবনের একটি  অনাকাঙ্খিত এবং দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় জামায়াত বিএনপি শাসনামলে গ্রেফতার এবং ইন্টারোগেশন। ২৮ নভেম্বর ২০ ০ ৩ বৃহস্পতিবার বিকালে সাপ্তাহিক ২০০০ অফিস থেকে কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি রুহুল আমিন সিদ্দিকী আমাকে আটক করে নিয়ে গেলেন । আলেক্স আলীম  তিন তালার বারান্দা থেকে দেখলেন আমি পুলিশের গাড়িতে উঠে যাচ্ছি । আম্মু অফিস থেকে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন । আব্বু তখন বেডরুমে ঘুমাচ্ছিলেন ।আলীম আর আম্মুর চিৎকারে বাবা সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠলেন ঘুম থেকে। হাফ শার্ট আর লুঙ্গি পড়া অবস্থাতেই অসুস্থ শরীরে পুলিশের জিপের পেছন পেছন দৌড়ে উঠে গেলেন সিএমপির পাহাড়ে ।প্রচন্ড উদ্বেগ নিয়ে আকুল কণ্ঠে তৎকালীন এসিডিবি শফিকুর রহমানকে আব্বু প্রশ্ন করেছিলেন, 'আমার মেয়েটাকে কেন ধরে আনলেন ? আমি  তো পাকিস্তান আমলে অনেক জেল খেটেছি পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করার কারণে। এখন স্বাধীন দেশ। আমার মেয়ে কোন রাজনীতিও করে না। আমার মেয়ের বিরুদ্ধে আপনাদের কী অভিযোগ এভাবে ধরে আনলেন- বলবেন ?" কিছুই বলতে পারলেন না এ সি ডি বি শফিকুর রহমান । আমাকে নেয়া হলো কোতোয়ালি থানায়, আব্বু পেছন পেছন ছুটে গেলেন । ওখানে তাঁকে বেশিক্ষন থাকতে দেয়া হলোনা । তখন রোজার মাস । ইফতার আর রাতের খাবার নিয়ে গেলেন বাবা । তালেবান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে করতে জেরবার করা হলো আমাকে ইন্টারোগেশন সেলে। ইন্টারোগেশান সেলের মুখোমুখি করা হলো পরপর তিনবার । রাতে জয়েন্ট ইটারোগেশন সেলের মুখোমুখি করতে ঢাকায় নেবার কথা জানালো পুলিশ । অসহায় কিন্তু হাসিমুখে আমার বাবা আবার এক ব্যাগ কাপড় নিয়ে থানায় গেলেন তার কন্যার অনির্দিষ্ট কাল পুলিশি হেফাজতে থাকতে হলে সেই চিন্তা করে। ঢাকা থেকে মালেকা বেগম ফোন করে আম্মুকে বললেন, " নূরজাহান আপা, আপনি সুমির মা নন শুধু, এখন আপনি  মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা । থানায় কোনভাবেই একটা মেয়েকে রাতভর রেখে দিতে পারে না। আপনি কথা বলেন। " মা চলে গেলেন কোতোয়ালী থানায়। রাত ভর মা তানায় থাকলেন । আমাকে যে রুমে ইন্টারোগেশন করা হলো, দরজা খোলা রাখা হলো। দরজার বাইরে মা বসে আছেন। কী দুঃসহ সেসব প্রহর। আমার দুই শিশু সন্তান ঘরে বিনিদ্র প্রহর কাটাচ্ছিলো। আড়াই বছরের শিশু গহনের কুব জ্বর ছিল সেদিন। পুলিশের গাড়ির পেছন পেছন মা'কে খুঁজতে একলা চলে গিয়েছিলো অনেক দূর।  সুইপার কলোনীর হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন  গহনকে চিনে  এনে দিয়েছিলো বাসায় । নাহয় সেদিন আরো বড়ো কোন বিপর্যয় হয়তো দেখতে হতো ।

সন্তানদের প্রশ্নে আব্বু  বরাবরই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যেতেন।  আবেগজড়িত কণ্ঠে বলতেন ভাইয়ার জন্মের সময়  গলায় নাড়ি ( umbilical cord) প্যাচানো ছিল। এমন হলে নাকি অনেকে বলতো ক্ষুদিরামের পুনর্জন্ম হয়েছে । সেই গানের ভাষায়, 'তখন যদি না চিনতে পারিস মা , দেখবি গলায় ফাঁসি - এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' ! ভাইয়া ছাত্র ইউনিয়নে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল আন্দোলন সংগ্রামে সামনের সারিতেই ছিল। ১৯৮৪ সালের ২৪ জানুয়ারী ১১ দলের নেত্রী শেখ হাসিনার মিছিলে পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে গুলি চালালো পুলিশ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আহত হয়েছেন অনেকে।  নিহত হয়েছিলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ২১ জন নেতাকর্মী। কবি শাহীদ আনোয়ার তার রক্তমাখা শার্ট বদলে ভাইয়ার শার্ট আটোসাটো হলেও  পুলিশের থেকে বাঁচতে কোনরকমে  সেই শার্ট পরলেন আমাদের  বাসায় এসে। ভাইয়া তখনো ক্লাস এইটে পড়লেও  বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শাহীদ আনোয়ারকে নিয়ে ভ্যানগাড়িতে করে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলো।তখন বাইয়ার হাতে ৫০ টাকা ছিল, সেটাই খরচ করে শাহীদ ভাইয়ের প্রাথমিক  চিকিৎসা করিয়েছিলো ভাইয়া।
[caption id="attachment_13649" align="aligncenter" width="914"] পৌত্র শেহজাদ খানকে কোলে নিয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র সুবেহ খান, পুত্রবধু মালিহা খান , পৌত্রী মেহনাজ খান এবং স্ত্রী নূরজাহান খানের সঙ্গে সাইফুদ্দিন খান[/caption]

''ব্রিটিশ বিরোধী প্রয়াত বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী লিখেছিলেন, সাইফুদ্দিন খান কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমার অতি প্রিয় ও শুভাকাঙ্খী অনুজতুল্য সাইফুদ্দিন খান, জনাব আব্দুল্লাহ -আল-হারুণ চৌধুরী এবং আ্যাডভোকেট শফিউল আলম এই ৩ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমি নিজেও শোকাভিভূত ।এরা ছাত্র জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ও সমাজসেবায় নিবিড় ভাবে জড়িত ছিলেন। দেশের প্রগতি, সমৃদ্ধি ও দুঃস্থ আর্ত অভাবক্লিষ্ট জনসাধারণের মুখে হাসি ফুটাবার উদ্দেশ্যে উদার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। জনাব সাইফুদ্দিন খান সুরুচিপূর্ণ , সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় ভাই জনাব ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নূরজাহান খান প্রখ্যাত নারী নেত্রী । এদের প্রত্যেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । গত এপ্রিল মাসে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এবং হাসপাতালে অবস্থিত স্ত্রীকে আনার জন্যে আমার কোলকাতা যাবার আগের দিন জনাব সাইফুদ্দিন খান আমার বাসায় এসেছিলেন এবং একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। ১৯৩০ সালে কালারপুলের  জুলধা গ্রামে যুববিদ্রোহের সদস্য রজত সেন , দেবপ্রসাদ গুপ্ত, মনোরঞ্জন সেন প্রমুখের সঙ্গে পুলিশের গুলিতে নিহত বিপ্লবীদের স্মৃতি রক্ষার্থে মনে মনে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন । এবং আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবার অনুরোধ করেছিলেন । কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি বলাতে সেই পরিকল্পনাটি আর বাস্তবে রূপ নেয় নি। তাঁর এ অন্তিম বাসনা পূর্ণ হবে কিনা জানি না। মাত্র দু'দিন আগে তাঁর দেহাবসানের খবর পেয়ে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক নেতার অভাব অপূরণীয় ।..

এই মহান বিপ্লবীর অমর বাণীতে একাত্ম আমিও। চিরসংগ্রামী সাইফুদ্দিন খানের পরবর্তী প্রজন্মের দায়বদ্ধতায় হয়তো কখনো পূর্ণ হবে তাঁর অসমাপ্ত পরিকল্পনা-এমন আশাবাদ রইলো  আমার নিজেরও ।

একাত্তরের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলির টর্চার সেল ডালিম হোটেলে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান।সেই অপরাধে দায়ের করা ৪ নম্বর মামলায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আদালত (ICT) মীর কাশেম আলীকে সাজা দেয়। মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় কাশিমপুর কারাগারে। বাবা দেখে যেতে পারলেন না।

২০০৭ সালের ২৭ জুন, রাত ৮ টায় বাবার হাত ধরে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলেছিলাম, এ হাত আর কখনো ছাড়বো না ! ২৮ জুনের অন্ধকার সকাল আমার বাবাকে আমার পাশ থেকে অনেক দূর আকাশে নিয়ে গেলো ! মন্দির মসজিদে কতোজন বাবার জন্যে কতো প্রার্থনা করলেন - সব বৃথা হয়ে গেলো !

আজ লিখতে হচ্ছে বাবার স্মৃতি । নীরব চোখের জলে ভিজে লিখতে হচ্ছে অনেক কথার থেকে কিছু কথা । আমি স্কুলে থাকতেই ভাবতাম - কখনো যদি বই লিখি, বাবাকে উৎসর্গ করবো । লিখবো - যে আমাকে বুঝিয়েছিল স্বাধীনতা কাকে বলে । আমার কোনো কিছুতেই যার শাসন-বারণের বাড়াবাড়ি কখনো ছিলোনা, ছিল সীমাহীন প্রশ্রয় । তাই হয়তো বাধ্য হয়ে মা'কে তাঁর একমাত্র কন্যার প্রতি অনেক কঠিন, অনেক কঠোর হতে হয়েছে ।

২৭ জুন সন্ধ্যা থেকে আমার মা আর আমরা তিন ভাই বোন অপলক চোখে তাকিয়ে ছিলাম হার্টরেট মনিটরের দিকে । শেষ দিন আমি রক্ত দিলাম, পুরোটা যায়নি । তিন ভাই বোন ডাকলাম 'আব্বু - আব্বু '? একটু চোখ মেললো, তাকালো, দুচোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নীরব অশ্রুধারা ! বললাম ' আব্বু, তোমাকে ভালো হতেই হবে, তুমি না লড়াকু, সংগ্রামী, প্লিজ আব্বু আরেকটু চেষ্টা করো'! একই কথা যখন আরো দশদিন আগে বলতাম, ছোট্ট শিশুর মতো মাথা কাৎ করে সায় দিতো । যার ভাবার্থ - '' আচ্ছা, চেষ্টা করবো'! সেদিন কী অসহায় দৃষ্টি আব্বুর । অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতার কাছে কি অসহায় আত্মসমর্পণ ! দু'হাত দেখিয়ে বোঝালো 'তোমরা কি পারো কিছু করতে?  আমি যে আর পারছি না'! ২৮শে জুন ভোরে সূর্যোদয়ের  আগেই বাবা  আমাদের ছেড়ে অস্তপারে চলে গেলো ! রাতের চেয়েও অন্ধকার সকাল আমাদের ঘিরে ধরলো। সেই অন্ধকার যেন আজো আমায় তাড়া করে ফিরছে প্রতিনিয়ত। বাবাকে শুধু বলে যাই, তুমি কোন অনন্তলোকে হারিয়ে গেলে- এই আমি যে বড়ো একা হয়ে গেলাম -কোথাও কেউ নেই-যে পথ দেখিয়ে হাত ধরে নিয়ে যাবে অসীমের পানে।

তবু  প্রতিটি সংকটে মন বলে ,তোমাতে আমাতে একাকার হয়ে মিশে আছি দুর্লঙ্ঘেয় পাষাণ পেরিয়ে অসীমের পানে যাবো বলে-তোমার পানে চেয়ে গেয়ে উঠি বাবা- "তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে , যতো দূরে আমি ধাই-কোথাও দুঃখ-কোথাও মুত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় সে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই ।।
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে-
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই ।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই ...!"

সুমি খান, সম্পাদক সূর্যবার্তা অনলাইন ও মিডিয়া
সূর্যবার্তা নিউজ.কম য়ে প্রকাশিত

Tuesday, June 27, 2017

আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান- প্রাণপ্রাচুর্যের বরপুত্র

  আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান ।যিনি অসীম প্রাণপ্রাচুর্যের বরপুত্র ছিলেন । ১০টি বছর তিনি নেই । এ এক অসীম শূণ্যতা-কোথাও কেউ নেই যে এ শূণ্যতার কিছুমাত্র পূরণ করতে পারে ।
 বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী বাবাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, স্থিরপ্রতিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান লোক মৃত্যুতে মুহ্যমান হন না। তিনি নিজেও তাঁর প্রিয়তম পুত্রের ৩০ বছর বয়সের অকাল প্রয়াণে ও মুহ্যমান হন নি। রবীন্দ্রনাথ নজরুল সয়ে গেছেন সন্তান শোক। আমি এক অসহায় সন্তান। যার কোন রকম ক্ষমতা বা সাধ্যই নেই কিছু ধারণ করবার। সে তো কোন প্রজ্ঞাবান বা স্থির প্রতিজ্ঞ কেউ নয়, যে  সাইফুদ্দিন খানের মতো পিতার শূণ্যতা ১০ বছরে ভুলে যেতে পারি! বরং দিনে দিনে সেই শূন্যতা আর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের ব্যর্থতা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে বুকের ভেতর । আমার বাপ্পু ডা. কামাল এ খান এবং আমার বাবা এই দুই অসীম ব্যক্তিত্ববানের প্রয়াণের শূণ্যতা আমার চারপাশের কোথাও ন্যূনতম পূর্ণ হবার কোন সম্ভাবনা আর নেই। তবু আশায় থাকি কখনো হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের মেধা মনন ,ত্যাগ এবং তিতিক্ষার মাধ্যমে মুছে দেবে মানুষে মানুষে সকল বিভেদ। প্রতিষ্ঠিত করবে অসাম্প্রদায়িক সমাজ।

অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সংগ্রামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সন্তান আমার বাবা  ভাষা সৈনিক এবং আলবদরের নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খান ২০০৭ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ আমার চিরসংগ্রামী  বাবার প্রয়াণের এক দশক। আমি দেখতে পাই এখনো তাঁর কথা তৃণমূল কৃষিজীবি থেকে দালানের চার দেয়ালের ভেতরকার মানুষগুলো ও স্মরণ করেন শ্রদ্ধাভরে , অনেক ভালোবাসার সাথে , অনেক মিস করা থেকে। তাঁর আদরের ভাইপো ভাইঝি থেকে নাতি নাতনি- প্রত্যেকে।
আক্ষরিক অর্থেই জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ -সব পারতেন আমার বাবা। একেবারে শৈশব থেকে  মসজিদে আজান দেয়া থেকে অত্যাধুনিক ক্যামেরাতে ফটোগ্রাফি , সহযোদ্ধাদের পড়ালেখার জন্যে পিতার থেকে অর্থ সাহায্য নেয়া, কারাবন্দীদের জন্যে হাজার হাজার মাইল দূরের বাড়ি থেকে গোশত রান্না করে আনানো , ঘরের মেয়েদের জন্যে নৌকা বানিয়ে তাদের স্বাধীন ইচ্ছের বাস্তবায়ন  বিপন্ন মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করা অথবা দায়িত্বশীলদের  নিষ্ক্রিয়তার মুখে জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনায় বর্বরভাবে  নিহত নিরীহ ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদতের হত্যামামলা সামরিক আদালতে তুলে ঘাতক হারুণের বিচার নিশ্চিত করা -  জাল বুনা, মশারি সেলাই বেড কাভার সেলাই ,  ফার্নিচার তৈরি কাঠ মিস্ত্রীর কাজে সাহায্য করা রাজমিস্ত্রীর কাজে সাহায্য করা, কংক্রিট ভাঙ্গা... সাম্পান চালানো- কোন কিছুই বাবার জন্য 'অকাজ' ছিল না। শুধু পদ-পদবীর লোভে লোকদেখানো কিছু করা , আত্মপ্রচারণা বা মানুষকে জানানো -কোন হিপোক্রেসি -একমাত্র  'অকাজ' বা অন্যায় ছিল বাবার কাছে। 
 চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামে তাঁকে  স্মরণ করা হচ্ছে  পারিবারিক ভাবে অনাথদের নিয়ে সীমিত পরিসরে। তিনি  মানবতার কল্যাণে তাঁর চক্ষুদান করেন আশির দশকে। পরবর্তীতে নব্বইয়ের পর তিনি দেহদান করেন। যদিও  নোটারি পাবলিকের কাগজে স্বাক্ষর করার পরও তাঁর মৃত্যুর পর সেই অঙ্গিকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় তাঁর পরিবারের সদস্যরা, আমি নিজে ও ব্যর্থ হয়েছি, যার উপর বাবার অগাধ আস্থা ছিল । সব মিথ্যে হয়ে গেছে ।
 একাত্তরের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলির টর্চার সেল ডালিম হোটেলে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান।সেই অপরাধে দায়ের করা ৪ নম্বর মামলায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আদালত (ICT) মীর কাশেম আলীকে সাজা দেয়। মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় কাশিমপুর কারাগারে। বাবা দেখে যেতে পারলেন না।
 তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে তুলে আনতে হয় কিছু কথা। 
সাইফুদ্দিন খানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি সমৃদ্ধ সমাজসচেতন পরিবারে । ২৫  বছরের ও বেশি সময় সরকারী উকিল  ( Government Pleader –GP)  জমিদার মৌলভি  ফজলুর রহমান খানের কনিষ্ঠ পুত্র  সাইফুদ্দিন খানের শৈশব - কৈশোর, ছাত্র জীবন খুবই বর্ণাঢ্য ছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সূতিকাগার পটিয়াতে কমিউনিষ্ট পার্টির অবন্থান অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।  মাস্টার’দা সূর্যসেন , বীরকন্যা প্রীতিলতার পথ ধরে  পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার জন্যে এবং শোষণহীন সমাজ গড়বার  স্বপ্নে  অনেক জমিদার এবং  অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানেরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন । কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো , কমরেড আবদুস সালাম  তাদের অন্যতম। সাইফুদ্দিন খান তাঁদের ই সহযোগী ছিলেন ।

 কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের আইনের মেধাবী ছাত্র ফজলুর রহমান খান ব্যক্তিজীবনে অনেক ত্যাগী এবং সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। যে কারণে তিনি স্বেচ্ছায়  চট্টগ্রাম আদালতে না থেকে  পটিয়ার আদালতে জিপি’র দায়িত্ব পালন করেন।  তাঁর  সন্তানদের  সাথে সাথে গ্রামের সন্তানদেরও শিক্ষিত করার জন্যে গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ফজলুর রহমান খান। তবে নিজের নামে কখনো তিনি কিছু প্রতিষ্ঠা করেন নি। যে কারণে সাইফুদ্দিন খান তাঁর পিতার নামে শিক্ষা এবং সমাজহিতৈষিমূলক কিছু করবার পরিকল্পনা করেছিলেন , যা শেষ করে যেতে পারেন নি ।
জমিদার ফজলুর রহমান খান পশ্চিম পটিয়াতে  জনকল্যাণে হাসপাতাল,  সড়ক নির্মান করেছেন, অসংখ্য পুকুর ছিল বরউঠান গ্রামে, তাই জলাভাব কখনো ছিল না এখানে।  সাইফুদ্দিন খান এমন শিক্ষানুরাগী , সমাজহিতৈষী  জমিদার পিতার সন্তান হিসাবে বড়ো হয়ে মানবতার কল্যাণে কমিউনিজমে দীক্ষা নেন এবং  নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন প্রজাদের কাতারে। জমিদারের পুত্র হয়েও তেভাগা আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সেই বার্তা পৌছে দিয়েছেন প্রজাদের কাছে । তাদের অভাব অনুযোগে একাত্ম হয়ে তাদের সাথে নিয়েই স্বাধিকার আন্দোলন করেছেন।
সাইফুদ্দিন খানের অসমাপ্ত সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীতে জানা যায়,ফজলুর রহমান খানের পেশাগত সিনিয়র বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং আইনজীবি বিনোদ বিহারী নন্দীর পরামর্শে ফজলুর রহমান খান তাঁর বড়ো ভাইপো নুরুল আলম খানকে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন।পরবর্তীতে তিনি অন্যান্যদের সাথে নিয়ে পটিয়া আবদুস সোবহান রাহাত আলী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । নিজের সন্তানদের ও সেই স্কুলে পড়িয়েছেন তিনি।
 ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন । সব রকমের সম্প্রদায়িকতা , কুসংস্কার , সংকীর্ণতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ ছিলেন । মানবতার সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবন। কোন শীর্ষ নেতৃত্ব বা কোন  পদ আর পদবী তাঁকে টানে নি কখনো। বরাবরই এ ধরণের প্রস্তাব বা প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে গ্রহণ করেছেন ত্যাগ ও তিতিক্ষার জীবন। তিনি সাইফুদ্দিন খান। যিনি কখনো কোন লোভ বা প্রলোভনের কাছে হার মানেন নি।
 ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী লিখেছেন, সাইফুদ্দিন খান কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমার অতি প্রিয় ও শুভাকাঙ্খী অনুজতুল্য সাইফুদ্দিন খান, জনাব আব্দুল্লাহ -আল-হারুণ চৌধুরী এবং আ্যাডভোকেট শফিউল আলম এই ৩ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমি নিজেও শোকাভিভূত ।এরা  ছাত্র জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ও সমাজসেবায় নিবিড় ভাবে জড়িত ছিলেন।  দেশের প্রগতি, সমৃদ্ধি ও দুঃস্থ আর্ত অভাবক্লিষ্ট জনসাধারণের মুখে হাসি ফুটাবার উদ্দেশ্যে উদার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। জনাব সাইফুদ্দিন খান সুরুচিপূর্ণ , সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় বাই জনাব ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নূরজাহান খান প্রখ্যত নারী নেত্রী । এদের প্রত্যেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গত এপ্রিল মাসে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এবং হাসপাতালে অবস্থিত স্ত্রীকে আনার জন্যে আমার কোলকাতা যাবার আগের দিন জনাব সাইফুদ্দিন খান আমার বাসায় এসেছিলেন এবং একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। ১৯৩০ সালে কালারপুলের আনোয়ারার জুলধা গ্রামে যুববিদ্রোহের সদস্য রজত সেন , দেবপ্রসাদ গুপ্ত, মনোরঞ্জন সেন প্রমুখের সঙ্গে পুলিশের গুরিতে নিহত বিপ্লবীদের স্মৃতি রক্ষার্থে মনে মনে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন । এবং আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবার অনুরোধ করেছিলেন । কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি বলাতে সেই পরিকল্পনা টি আর বাস্তবে রূপ নেয় নি। তাঁর এ অন্তিম বাসনা পূর্ণ হবে কিনা জানি না। মাত্র দু'দিন আগে তাঁর দেহাবসানের খবর পেয়ে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক নেতার অভাব অপূরণীয় ।..
এই মহান বিপ্লবীর অমর বাণীতে একাত্ম আমরা ও। চিরসংগ্রামী সাইফুদ্দিন খানের পরবর্তী প্রজন্মের দায়বদ্ধতায় হয়তো কখনো পূর্ণ হবে তাঁর অসমাপ্ত পরিকল্পনা-এমন আশাবাদ রইলো ।

বাবার নাকি একটা ভেসপা ছিলো, যেটা দিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সব কাজ করতেন বাবা। আমি নাকি সেটাতে চড়ালে কাঁদতাম। আবার বেচে দেয়ার পর ও কেঁদেছি ।
সাইফুদ্দিন খানকে ভুলতে পারেন না   আজন্ম  যিনি পরিবারের কন্যা জায়া জননীদের  প্রাণের সাধকে বাস্তবতা ছুঁয়ে যেতে এগিয়ে গেছেন সবার আগে। পরিবারের কন্যাদের , পুত্রবধুদের সাধ  ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছিলেন, এক অর্থে স্বাধীনতার সংজ্ঞা শিখিয়েছিলেন আমার সেই ছোট্টবেলায় । 
বাবা  নিজের জীবন দিয়ে শিখিয়েছেন মানবতার সেবায়  কিভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয় ।  আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যেই সেটা কিছুটা আছে । তবে আমার দুই ভাইয়ের মধ্যে সেটা অনেক বেশি ,তাদের সবটা দিয়ে তারা মানবতার সেবা করে যায়। আমি কতোটা পারি জানি না, তবে অন্তর থেকে চেষ্টা করি কাজ করে যেতে, সেবা করে যেতে। আমার সন্তানদের ও  তাদের জীবনে আমার বাবার সেই শিক্ষা কাজে লাগাতে দেখি, মনে মনে প্রার্থনা করি, তারা যেন সারাজীবন এভাবেই নিজেদের উজাড় করে মানুষকে ভালোবেসে যায় । 
 বাবা তাঁর মনন , মেধা আর শ্রমে সেবা করে গেছেন নিরন্তর । সাথে নিয়ে গেছেন বিপ্লবীদের স্পর্শে -যারা দেশমাতৃকার কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের সোনালী যৌবন থেকে মৃত্যুর প্রহর পর্যন্ত।  সেসব জানিয়ে লিখবো একদিন , এমন ভাবছি সেই কবে থেকে, হচ্ছে না। আজ বাবাকে অনুভব করে কিছু কাজ করবার দিন । লিখবার ও দিন বটে। পর্যায়ক্রমে সবই করবো যদি এই দেহে প্রাণ আরো কিছুদিন থাকে।
সুমি খান, ২৮ জুন, ২০১৭ বেলা ৯টা