Wednesday, May 2, 2018

একজন সাহিত্যিক অশোক মিত্র - শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য


অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পেলেও, ডক্টর অশোক মিত্র মনেপ্রাণে সাহিত্যের মানুষ ছিলেন। একান্ত আলাপে বারবার বলেছেন যে উনি একজন ইকোনমিস্ট বাই মিসটেক। আরেক রকম পত্রিকায় সম্পাদনার সূত্রে ওনার সাহিত্যপ্রীতির কয়েকটা উদাহরণ পেয়েছিলাম। 


আরেক রকমে মার্ক্স ও সোভিয়েত নিয়ে আমার কয়েকটা লেখা ২০১৭ সালে কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। সেই নিয়ে একদিন অশোক বাবু স্নেহ-মিশ্রিত শাসন করেছিলেন। মূলত প্রগলভতার কারণেই। তারপর বললেন,
​​
"আপনাকে একটা অন্য কাজ দিচ্ছি। অনেক তো মার্ক্স নিয়ে লিখলেন। এবারে সাহিত্যে আসুন। দীনেশ দাশের 'এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে' কবিতাটার শিরোনাম  নিয়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকাতে দুই বিপরীত মতাদর্শের কবি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দেকে লিখতে বলেছিলেন।  ১৩৪৭ সনের কার্তিক সংখ্যাতে পিঠোপিঠি কবিতা দুইখানা বেরিয়েছিল। ওটা নিয়ে এখনকার পাঠক কী ভাবছে, সেটা আমি জানতে চাই। এখনো সোশালিস্ট রিয়ালিজম জিনিসটার সত্যিই কতখানি আবেদন আছে, বোঝা দরকার। আপনি কবিতা দুখানা নিয়ে লিখুন"। (উনি সকলকেই 'আপনি' বলতেন) 

দুইখানা ভুলে যাওয়া কবিতাকে আবার রিভাইভ করিয়ে পাঠকের অন্দরে নিয়ে আসা, এটা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল ডক্টর মিত্র-র সাহিত্যবোধ কতখানি আধুনিক। ওনার কাছ থেকে সেই সূত্রে এবং তার পরেও শব্দচয়ন সংক্রান্ত প্রচুর খুঁটিনাটি শেখা হয়েছিল। এর পরেও নানা লেখা লিখিয়েছেন। অন্নদাশংকর রায়ের কবিতা থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকার বামপন্থা, তাঁর আগ্রহ ছিল সজাগ। মাঝে মাঝেই ফোন করে বলতেন, "এটা নিয়ে লিখুন"। 

আরেক রকম সম্পাদনার সময়ে ওনার সঙ্গে একদিন বাড়িতে একটা হালকা বিতর্ক হয়েছিল। যে কবিতা লিখবে , সে কি রাজনীতি করবে না ? নাকি স্লোগান সর্বস্ব কবিতা লেখাটাই তার জীবনের নিয়তি? অশোক বাবুর মতামত ছিল, সুকান্ত ভট্টাচার্য্য বেঁচে থাকলে যদি সক্রিয় রাজনীতি করতেন, তাঁর কবিতা ঝুলে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, রাজনীতির ঘোর প্যাচ প্রকৃত শিল্পকে নষ্ট করে দেয়। এই দোষে আমাদের কমিউনিস্ট আন্দোলনের লিটারেচার ডুবেছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাহলে মায়াকভস্কি? অথবা অক্টাভিও পাজ? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, মায়াকভস্কি সক্রিয় রাজনীতি করেন নি। বুঝতেনও না। তারপর আঁদ্রে মালরোর উদাহরণ টানলেন। কনভিন্সড হতে পারিনি। সেই তর্কটার আর মুলতুবি হল না, জীবনের আর সবকিছুর মতই। 

শেষ দিন পর্যন্ত জীবনচর্যায়  ছিলেন আদ্যোপান্ত কমিউনিস্ট। বিশ্বাস করতেন এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে বুর্জোয়া পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে সেটা সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর, ঘনিষ্ট সহযোগিতা এবং মতভেদে পূর্ণ । কিন্তু তাঁর দৃঢ় মতামত ছিল যে  ভারতবর্ষে বামপন্থী আন্দোলনকে বিকশিত করতে গেলে সিপিআই(এম)-এর কোনও বিকল্প নেই। আন্তঃপার্টি মতাদর্শগত বিতর্কগুলি যখন বাইরে আসত, তাঁর অবস্থান  কখনো বাম দিক থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হয়নি। 

শেষ এডিট মিটিং ওনার বাড়িতে হয়েছিল, মার্চ মাসে। মিটিং-এর শেষে বলেছিলেন, "আমার বাড়িতে এটাই শেষ সম্পাদকীয় বৈঠক। সামনের সপ্তাহ থেকে আমি নার্সিং হোমে চলে যাচ্ছি। ফিরব কি না জানি না। আপনাদের সকলকে নমস্কার জানাচ্ছি"। 

আমরা এক এক করে বেরিয়ে আসছিলাম বইতে ঠাসা ঘর থেকে। শেষে ছিলাম আমি। একবার পেছন ফিরে দেখলাম, একটা রোগা বৃদ্ধ শরীর নিঝুম হয়ে বসে আছে। একলা। পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট। একটা বদলে যাওয়া আপোসকামী  পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ, নন-কনফরমিস্ট অবস্থানে অনড় থাকতে থাকতে যিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তাঁদের মত দানবদের যুগ আজ শেষ। এবার আসছে বামনদের রাজত্ব। ছায়া ক্রমে আসিতেছে। মৃত নগরীর অন্ধ রাজা অয়দিপাউসের এখন ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবার সময় আগত।