Saturday, November 22, 2014

নজরুলের কবিতা

নারী

সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

কুলি মজুর

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান

স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্‌।
কোন্‌ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।



বিদ্রোহী
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর -
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর -
চির - উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না -
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

Wednesday, November 19, 2014

নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়েছে বাংলাদেশ:জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে





বিশ্বের তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়লেও  জবাবদিহিতার অভাবে প্রত্যাশিত সংসদীয় গণতন্ত্রের চিত্র বারবার বিঘিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৭ জন নারী ৬০ আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯ জন নারী সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী সহ ৪ জন  নারী পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।  কিন্তু ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ২৭ জন নারী সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে  নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন নারী এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ী হয়েছেন আরও ৮ জন।বর্তমান মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী সহ ২জন নারী মন্ত্রী ও ২ জন নারী প্রতিমন্ত্রী আছেন।এই বাস্তবতা বলে দেয়,নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর  দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল সেটি সেভাবে ধরে রাখা যায়নি।
তবে বর্তমান সংসদে একজন নারীকে স্পীকার হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে।তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ) এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে কৃতিত্বের সাথে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
এদেশে নারী আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন  জাতীয় সংসদে নারীর সক্রিয়, কার্যকর অংশগ্রহণকে ধরে রাখতে হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সুষ্ঠু কাঠামো প্রয়োজন, যাতে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে ও ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বারে বারে বলেছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটিকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত, দলীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল  না রেখে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনী বিধিবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ মন্ত্রী পরিষদ ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কমপক্ষে এক- তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান রাখতে হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানম।  

তিনি বলেন,রাজনৈতিক দলগুলোর আচার আচরণে চরম অসহিষ্ণুতার প্রকাশ পাচ্ছে যাতে সমগ্র দেশবাসীর  সাথে নারী সমাজও উদ্বিগ্ন।তার মতে,চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটিয়ে  দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সকল রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল ও সহিষ্ণু হতে হবে। গণতন্ত্রের বাস্তব চর্চা করতে হবে।পাশাপাশি সংসদ সহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আরো স্বাধীন, সৃজনশীল ভূমিকা পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ, দূর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আয়েশা খানম বলেন,গণতন্ত্র ও সুশাসনের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে স্থানীয় সরকার। কিন্তু  স্থানীয় সরকারের স্বাধীন ভূমিকা পালনে রাষ্ট্রীয় যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেখানেও যথেষ্ট সংকট বিদ্যামান।

মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় প্রকাশ,সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না।এই উপমহাদেশ সহ বিশ্বের সকল দেশের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকারকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকে প্রশাসন।
নারী নেত্রীরা বলেন,সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারে উপর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে, যেখানে স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীন ও স্ব-উদ্যোগে কাজ করবেন।

মহিলা পরিষদের গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এমনই একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নূরজাহান বেগম।এ বছরের জানুয়ারি মাসে  রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বর্বরতার শিকার হয়েছেন নূরজাহান বেগম। একইভাবে কুষ্টিয়ার গোপগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মাসউদ আহসান শিবলী ও তার সহযোগীরা সেই এলাকার নারী ইউপি সদস্য লাইলী খাতুনকে ঘরে আটকে রেখে প্রহার করে প্রচন্ড আহত করে।মাদারীপুর রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার সরস্বতী বাড়ৈকে সেই এলাকার চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছে।
এ প্রসঙ্গে নারী সংগঠক এবং গবেষক খুশি কবীর জনকন্ঠকে বলেন,এমন অনেক বাস্তব দৃষ্টান্তকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই।শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এসেও এখনো তৃণমূল থেকে রাজধানীর কেন্দ্র পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয় নারীকে তার মেধা এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে যোগ্য মর্যাদা দিতে।নারীর মেধা এবং শ্রমের মূল্যায়ন সমাজকে এগিয়ে নেয় অনেক দূর এ সত্য অনুধাবনে এখনো প্রস্তুত হয়নি আমাদের সমাজ। খুশি কবীর বলেন, অনেক যোেগ্যতা সম্পন্ন নারীকে এখনো পিছিয়ে রাখা হয়, যাতে নারী কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্বে না থাকে।

প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাই রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির বিষয়টি একই সঙ্গে ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হিসেবে সংযোজনের একমাত্র পন্থা হিসেবে সংসদে নারীর জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে কোটাপদ্ধতির প্রচলন একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হিসেবে গৃহীত। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নারীকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসতে হবে।
পৃথিবীর সব দেশে রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির ইস্যুটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির অংশ হলেও এযাবৎ রুয়ান্ডা ছাড়া কোনো দেশে এ নীতির বাস্তবায়ন হয়নি।যে কারণে বিশ্বগণতন্ত্রায়ণে নারীর প্রবেশ সাম্যতা,মর্যাদা ও প্রভাব কোথাও পুরুষের সমকক্ষ নয় এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই ক্ষমতার প্ল্য্যাাটফর্মে এ সক্ষমতাই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীকে ক্রমবর্ধমান হারে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার করেছে।কোটাপদ্ধতির মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণের দিকে যেতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে মাত্র ২৩টি দেশে সংসদে ৩০ শতাংশ বা তার ঊর্ধ্বে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং প্রতিটি দেশেই কোটাপদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি নারী-নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হওয়া পর্যন্ত কোটাব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশেই নারীর ন্যূনতম ৩০ শতাংশ আসনে নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা নেই।একমাত্র রুয়ান্ডার সংসদে নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।দীর্ঘকাল গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটি পার্লামেন্টে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর সুশাসনের কারণে পাঁচ বছরে মাথাপিছু গড় আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।ঐতিহাসিকভাবে পুরুষপ্রধান হবার কারণে রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় ভ’মিকা কার্যকর করতে বিভিন্ন দেশে যেসব কৌশল ও প্রক্রিয়া নেয়া হয়,তার মধ্যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার এবং আইন প্রণয়নের  মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নে নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু দেশও সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে।কারণ, অনেক ক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দলগুলো আইন রক্ষা করতে যে আসনে জেতার সম্ভাবনা নেই বা ‘নন-উইনেবল’ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেয় এমন দৃষ্টান্ত ও রয়েছে।কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে আসতে হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান-পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত করা হয়। ১৯৯০ সালে সংবিধান সংশোধন (দশম সংশোধন) করে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে ৩০টি নারী আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান রাখা হয়। ওই সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০০ সালে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের বিলুপ্তি ঘটে এবং সে সময় যারা সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদ হিসেবে যারা বহাল ছিলেন, তাদের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নারী নেত্রীরা সে সময় এই দাবি উত্থাপন করেন যে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন-ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে এবং ওই সব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়,যেহেতু সংসদে সংবিধান সংরক্ষণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সংখাগরিষ্ঠতা নেই, সেহেতু নারী আসন সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়াবার ক্ষমতাও তাদের নেই। ২০০০ সালে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংসদের নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোনো আসন ছিল না।২০০৪ সালের মে মাসে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের ৪৫টি নারী আসন আরো ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়।সেই বছরের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন নির্বাচনী বিল পাস হয়।একই সঙ্গে আগের ব্যবস্থা পাল্টে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রাপ্ত আসন অনুপাতে সংরক্ষিত মহিলা আসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়।ফলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের জন্যই নারী আসন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দলই সবগুলো আসন পেত।২০০৪ সালের ৮ ডিসেম্বর রাষ্টপতির অনুমোদনক্রমে গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনটি কার্যকর হয়।এ আইন অনুযায়ী আইনটি কার্যকর হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। পরে ২১ ডিসেম্বর রাষ্টপতির এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৪৫ দিনের বদলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রাখা হয়।সেই অধ্যাদেশটি ২০০৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি 'সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্বাচন সংশোধন আইন-২০০৫' নামের জাতীয় সংসদে পাস হয়।সংশোধিত সেই আইন অনুযায়ী ২০০৫ সালের ৭ মার্চের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা ছিল।কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। পরে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়।সেই নির্বাচনে জাতীয় সংসদে প্রাপ্ত সাধারণ আসন অনুপাতে আওয়ামী লীগের নয়টি আসন পাওয়ার কথা থাকলেও তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।বর্তমান সরকার আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার সাথে সাথে এদেশে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।তার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে একের পর এক আইন সংশোধন করে এগিয়ে নিচ্ছেন এই সমাজকে।কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী নারীরা তাদের দায়িত্বশীলতা কতোটা প্রমাণ করতে পেরেছে? এ প্রশ্নে এখনো সন্তোষজনক ভ’মিকা পালন করতে পারেন নি অধিকাংশ নারী জনপ্রতিনিধি।নারী সাংসদদের অনেকেই সংসদে অশালীন অরুচিকর এবং অসত্য বক্তব্য উপস্থাপন করে বিতর্কিত হয়েছেন।
সংসদে সংরক্ষিত আসনের কিছু নারী সাংসদের অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও অসত্য বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহান সংসদের মর্যাদা-ক্ষুন্ন হয়েছে।এর ফলে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে দাবি তুলেছিলেন,সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করা হোক।দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এজন্যে অনেকে তাদের রাজনৈতিক সহকর্মীদের হাততালিও পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের নারী সংগঠন গুলো দীর্ঘকাল ধরে দাবি করে আসছে সব রাজনৈতিক দলের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেবার জন্যে। সেই আইন যতক্ষণ প্রণীত না হচ্ছে,নারীর জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন হিসেবে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন রাখতে হবে এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে থাকতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও নারী নেত্রী সালমা খান।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নারী সাংসদরা কোন প্রশ্ন করেন না।নারী সাংসদদের কেউ কখনো সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন না বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার কতো? এই হার কমাতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তারা প্রশ্ন করেন না ব্র্যাকের জরীপে গ্রামীণ নারীরা ন্যাযবিচারের অভাব ও লিঙ্গবৈষম্য তাঁদের জীবনের প্রধান অন্তরায় বলে উল্লেখ করেছে কেন? এ ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা কখনো জানতে চান না।কোন নারী সাংসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন নি কেন সন্ত্রাসীর বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কিশোরী তরুণীদের এসিড ছুড়ে মারা হয়, হত্যা করা হয়? কেন তাঁরা সংসদে বিল উত্থাপন করেন না বিদ্যমান শ্রম আইনের সংশোধন করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেখানে ৭০ শতাংশ নারী কাজ করেন, সেখানে লিঙ্গভিত্তিক মজুরিবৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেবার জন্য। সে ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদদের দায়িত্বশীল ভ’মিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে কি তারা  অন্যায্য প্রাপ্তি লাভ করেছেন?তাই কি তারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন?
অর্থনীতিবিদ ও নারী নেত্রী সালমা খান বলেন, নারীকে সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসা প্রয়োজন।আসনের নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে ওই আসনে সরাসরি নির্বাচন ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক কালচারে তো দূরের কথা,বহু উন্নত দেশেও ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবারের হাতে গোনা দু-চারজন নারী ছাড়া মূলধারার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নারীর জন্য রাজনীতি হবে অপ্রবেশগম্য এবং সে ক্ষেত্রে আরও কয়েক শতাব্দী সম্পূর্ণ পুরুষশাসিত সমাজেই আমাদের বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই  আইন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাধ্য করা জরুরী মনে করছেন নারী নেত্রীরা।জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ মন্ত্রী পরিষদ ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কমপক্ষে এক- তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান রাখার ব্যাপারে নারী সংগঠন গুলো একমত হয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে এই দাবি তুলছেন।তবে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে গেছে,এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীদের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ### ১৯.১১.২০১৪