Wednesday, May 15, 2013

একটি জনমত সমীক্ষা গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙায় : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


বুধবার, ১৫ মে ২০১৩, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২০

ঢাকার দৈনিক ‘প্রথম আলো’ গত শনিবার (১১ মে) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। যদিও জরিপটি ছিল ‘প্রথম আলোর’ অনলাইনের তিন নম্বর ‘সর্বাধিক পঠিত’ খবর; কিন্তু আমার নজর সেটি এড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর ত্রিমহাদেশীয় টেলিফোনের ধাক্কা। অর্থাৎ এশিয়া, ইউরোপ, এমনকি অস্ট্রেলিয়া থেকেও আমার বাঙালী বন্ধুদের টেলিফোনের পর টেলিফোন, একই জিজ্ঞাসা- ‘প্রথম আলোর’ জনমত জরিপ দেখেছেন? সত্যই কি দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এই অভিমত? তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?
বন্ধুদের বলেছি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল! খবরটা আগে পড়ি। দেশের জনমত যদি বিভ্রান্ত হয় তাহলে তো আমাদের ঠেকাবার উপায় নেই। তবে এই জনমত জরিপটা ‘প্রথম আলোর’।
সুতরাং হিসাব করে দেখতে হবে এই জরিপ কতটা সঠিক? বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ শেষ করে ‘প্রথম আলোর’ জনমত জরিপের খবরটি খুঁজতে হলো। আমার অনুজ প্রতিম সাংবাদিক (সাহিত্যিকও) সাজ্জাদ শরিফের মন্তব্যযুক্ত জরিপে বলা হয়েছে, জরিপটি করানো হয়েছে ওআরজি-কোয়েস্ট নামে একটি পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা দ্বারা। জরিপ চলেছে তিন হাজার মানুষের (দেশের লোকসংখ্যা ১৫ কোটির মতো) মধ্যে।
এই জরিপের ফলাফল হলো- (ক) তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ। (খ) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি মনে করে ৮১ ভাগ মানুষ। (গ) যাদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ (এখানে শতাংশের উল্লেখ নেই) জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। (ঘ) পঁচিশ ভাগ মানুষ মনে করে দেশের অবস্থা খারাপ এবং ৩৫ ভাগ মনে করে দেশ খারাপ অবস্থা পার করছে। (ঙ) দেশের এক-চতুর্থাংশ মাত্র (চার ভাগের এক ভাগ) শাহবাগের জাগরণ মঞ্চকে সমর্থন করে। অর্থাৎ তিন ভাগই সমর্থন করে না।
সাজ্জাদ শরিফের মুখবন্ধসহ জরিপটির রিপোর্ট পাঠ করার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই প্রবাদটি আমার মনে পড়েছে, ‘গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙায়।’ দেশের সকল মানুষকে নিরেট বোকা না ঠাওরালে কোন মিডিয়া এই ধরনের জরিপ প্রকাশ করতে পারে না। জরিপটির রিপোর্ট পাঠ করলেই বোঝা যায়, এটি বানোয়াট নয়, তবে ম্যানিপুলেটেড। আর ম্যানিপুলেটেড সাংবাদিকতায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান অদ্বিতীয়। কোন ব্যাপারে তিনি ধরা পড়লেই তওবা করেন অথবা মাফ চান। এক সময় তাঁর কাগজের সাপ্লিমেন্টে মৌলবাদীদের ক্রোধ জন্মায় এমন কার্টুন ছেপে দৌড়ে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে খতিবের কাছে তওবা করেছিলেন। আবার সম্প্রতি শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে একটি অশোভন গল্প ছেপে জনরোষের মুখে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন এবং শাহবাগ-সম্পর্কিত দু’টি গল্পই প্রত্যাহার করে নেন।
যদি দেখা যায়, গত শনিবারে প্রকাশিত জনমত ‘জরিপের রিপোর্টটিও ম্যানিপুলেটেড এবং তাতে তার পত্রিকায় পাঠকরা মারমুখো হয়। তাহলে তিনি যে করজোড়ে আবার পাঠকদের কাছে মাফ চাইবেন এবং অনলাইন ও পত্রিকা পাতা থেকে জরিপটি মুছে ফেলবেন তাতে সন্দেহ পোষণ না করাই ভাল। শনিবারের জরিপাটি প্রথম আলোর নিজস্ব জরিপও নয়। তারা একটি জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা ভাড়া করে জরিপটি চালিয়েছেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় এখন ‘ওপিনিয়ন পোল’ গ্রহণকারী বা জনমত জরিপের বহু পেশাদার সংস্থা আছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র তাদের ভাড়া করে থাকে।
এরা পেশাদার সংস্থা হলেও তাদের মধ্যে অনেক সংস্থা আছে, যারা তাদের ক্লায়েন্টদের ইচ্ছামতো জনমত জরিপের ফল তৈরি করে দেয়। ঢাকার ওআরজি-কোয়েস্ট এই ধরনের প্রতিষ্ঠান তা আমি বলছি না। কিন্তু ইউরোপে এই ধরনের বহু পেশাদার জনমত জরিপের সংস্থা আছে, যারা টাকা পেলে ক্লায়েন্টের পছন্দমতো জরিপের ফল তৈরি করে দিতে দ্বিধা করে না। ব্রিটেনের ‘সাচি এ্যান্ড সাচি’ এই ধরনের সংস্থা নয়। বরং একটি পেশাদারি বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা, যারা সুনামের সঙ্গে জনমত জরিপেরও কাজ করেন।
টনি ব্লেয়ার ব্রিটিশ লেবার পর্টির নেতা-নির্বাচিত হওয়ার পর যখন জন মেজরের নেতৃত্বাধীন টোরি সরকার সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির মুখোমুখি হয়, তখন টোরি বা কনজারভেটিড দল ‘সাচি এ্যান্ড সাচি’কে তাদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে সাহায্যের জন ভাড়া করে। তারা জনমত জরিপের কাজও চালায়। এই পেশাদারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাচি এ্যান্ড সাচি এমন অপেশাদারি ও অসাধু কাজ বলে বসে যে, সে জন্য টোরি পার্টি ও সাচি এ্যান্ড সাচি উভয়কেই ক্ষমা চাইতে হয়।
সাচি এ্যান্ড সাচির ওপিনিয়ন পোল ছিল- টোরি পার্টি বিপুল ভোটে নির্বাচনে জিতবে। তাতে আপত্তির কিছু ছিল না। জরিপের ফল অনেক সময় সঠিক হয় না। কিন্তু সাচি এ্যান্ড সাচি শুধু জনমত জরিপের বিভ্রান্তিকর ফল প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি; লেবারের নবনির্বাচিত নেতা টনি ব্লেয়ারের একটি ছবি পোস্টারে ছেপে তার চোখ দু’টিতে আগুনের ভাটা বসিয়ে নিচে ক্যাপশন দেয়া হয়- ডেঞ্জার সিগন্যাল। এই পোস্টার দেখে ব্রিটিশ জনমত এত ক্রুব্ধ হয় যে, টোরি পার্টিকে ক্ষমা চেয়ে এই পোস্টার প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য এই জনমত জরিপ অসত্য প্রমাণ করে সেবার নির্বাচনে লেবার পার্টি বিশাল জয়ের অধিকারী হয়। পরবর্তী দু’টি সাধারণ নির্বাচনেও তার জয় অব্যাহত ছিল।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার নিয়ম প্রবর্তনের উদ্দেশ্য মানুষকে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে প্রত্যক্ষ জনমত জরিপের ব্যবস্থাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগের তাদের সম্পর্কে ভোটদাতাদের মনোভাব আগাম জানতে চাইতেন এবং নির্বাচকম-লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কথা জেনে নিজেদের নীতিতে রদবদল ঘটাতেন। এই জনমত জরিপের পদ্ধতির স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোন মহলে কোন সন্দেহ ছিল না তখন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু আগে এই ওপিনিয়ন পোল বা জনমত সমীক্ষার ব্যবস্থাটি নিয়ে ম্যানিপুলেশন শুরু হয়। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদ ও ন্যাৎসিবাদের অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট নায়কেরা তাদের গণবিরোধী নীতি যে জনগণের অনুমোদনপ্রাপ্ত তা প্রমাণের জন্য কিছু অর্থলোভী এবং পেশাদার নামধারী জনমত জরিপকারী সংস্থাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই সময় ইউরোপে জনমত জরিপাকারী বহু অসাধু সংস্থা গড়ে ওঠে এবং এই জরিপের ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করতে শুরু করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে মুসোলিনী যখন সোস্যালিস্ট ছিলেন, তখন ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। সোস্যালিস্ট পার্টি ছাড়ায় পর তিনি যুদ্ধপন্থী হয়ে ওঠেন এবং তার পত্রিকায় জনমত জরিপের ম্যানিপুলেটেড রেজাল্ট প্রকাশ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আরেকটি যুদ্ধ চায়।
বর্তমানে ইউরোপেও জনমত জরিপের গুরুত্ব ও ক্রেডিবিলিটি বহুলাংশে ক্ষুণœ। কারণ, অনেক সময়েই দেখে গেছে, এসব জরিপে সঠিক জনমত প্রতিফলিত হয় না; বরং একশ্রেণীর জরিপকারীর কারসাজির পরিচয় পাওয়া যায়। বড় বড় মিডিয়া, যারা নিজেদের স্বার্থে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা নিজেরা অথবা ভাড়া করা জরিপ সংস্থার সাহায্যে এমন জরিপের ফল তৈরি করে ছাপায়, যাতে সঠিক জনমত প্রতিফলিত হয় না, বরং ওই বিগ মিডিয়া বা কোন বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। তাঁরা চান এই ধরনের ফল প্রকাশ দ্বারা জনমতকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণে কাজে লাগাতে।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকা গ্রুপ একটি অসাধারণ শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রুপ। (অবশ্য সম্প্রতি এক টেলিফোন হ্যাকিংয়ের কেলেঙ্কারিতে তাদের সুনাম ও শক্তি অনেকটাই খর্ব হয়েছে।) তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা ইচ্ছে করলে কোন দেশে কোন সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে তার পতন ঘটাতে পারে। কিন্তু হালে সকল দেশেই এক শ্রেণীর বিগ মিডিয়ার জনমত জরিপের কারসাজি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চোখ খুলে যাচ্ছে।
মাত্র কিছুদিন আগে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নতুন নেতার নির্বাচন হয়েছে। দু’ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বড় ভাই ডানপন্থী, ব্লেয়ারাইট বলে পরিচিত। অন্যদিকে ছোট ভাই এ্যাড মিলিব্যান্ড বামঘেঁষা এবং ব্লেয়ারবিরোধী বলে খ্যাত। সুতরাং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের শক্তিশালী মুখপাত্র রুপার্ট মারডোকের টাইমস গ্রুপের কাগজগুলোর দায়িত্ব ছিল এ্যাড মিলিব্যান্ড যাতে লেবার পার্টির নেতা হতে না পারেন, সে জন্য জোর প্রোপাগান্ডা শুরু করা। দিনের পর দিন জনমত জরিপের নামে খবর ছাপা হতে লাগল, কিছু শ্রমিক ইউনিয়ন ছাড়া এ্যাড মিলিব্যান্ডের পক্ষে লেবার পার্টির সাধারণ নেতাকর্মী, পার্লামেন্ট সদস্য কেউ নেই। তাঁর পরাজয় অনিবার্য। নির্বাচনের পর দেখা গেল এ্যাড মিলিব্যান্ড নির্বাচনজয়ী হয়ে লেবার পার্টির নতুন নেতা হয়েছেন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের পর হয়ত দেখা যাবে, তিনিই ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ভারতেও এই জনমত জরিপের খেলা দেখা গেছে। বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার যখন ক্ষমতায় এবং সাধারণ নির্বাচন আসন্ন, তখন দলের তৎকালীন দ্বিতীয় প্রধান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ নামে বিপুল অর্থ ব্যয়ে এক নির্বাচন অভিযান শুরু করেন। শুরু হয় প্রচার অভিযান এবং জনমত জরিপের খেলা। অসংখ্য জনমত জরিপ সংস্থা গজিয়ে ওঠে এবং তার অধিকাংশই বিজেপি ভাড়া করে। দিল্লী, মুম্বাই, এলাহাবাদ, কলকাতার অধিকাংশ বড় বড় সংবাদপত্রে জনমত জরিপ প্রকাশ করে দেখানো হয়, বিজেপি এই নির্বাচনে কংগ্রেসের চাইতে বহুগুণ এগিয়ে আছে। নির্বাচনে বিজেপির জয় অনিবার্য। নিজেদের দ্বারা ম্যানিপুলেটেড এই জনমত জরিপের ফল দেখে তাতে বিশ্বাসী হয়ে বিজেপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত সময়ের আগে এগিয়ে এনেছিল। সেই নির্বাচনের ফল আজ আর কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। কারণ, সেই নির্বাচনের পর কংগ্রেস এখনও দিল্লীর মসনদে আসীন।
জনমত জরিপের যে কোন সুষ্ঠু ও সৎ সংস্থা বর্তমান বিশ্বে নেই তা নয় কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো অর্থলোভী এবং অসাধু প্রতিষ্ঠান অনেক গড়ে উঠেছে এবং দেশে দেশে একশ্রেণীর রাজনৈতিক দল এবং বিগ মিডিয়া তাদের ব্যবহারও করছে। বাংলাদেশ এমনিতেই সব ব্যাপারে দুই নম্বরী কাজের দেশ। সুতরাং জনমত জরিপের নামে এ দেশেও দুই নম্বরী কাজ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
তবে জনমত জরিপের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধনবাদী বিশ্বে যে অর্থ ও কারসাজির খেলা চলে, তার তুলনায় বাংলাদেশে প্রথম আলো পত্রিকার খেলাধুলা অনেকটা বালকোচিত। নইলে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত সম্পর্কে জনগণের মনোভাব, দেশে ঐতিহাসিক যুব জাগরণের প্রতীক শাহবাগ মঞ্চ ইত্যাদি এক সঙ্গে এত স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে প্রথম আলোর তওবা সম্পাদক জনমত জরিপের নামে অতি চালাকির আশ্রয় গ্রহণে সাহসী হতেন না।
মতিউর রহমানের সাংবাদিক জীবনের ইতিবৃত্ত একটু খুঁজলেই তিনি কেন হঠাৎ দেশের এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে অনেক জামায়াতী প্রচারণাকে জনমত বলে চালাবার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এবং জামায়াতকে প্রোটেকশন দান এবং শাহবাগ মঞ্চ সম্পর্কে তাঁর এতটা প্রতিশোধস্পৃহা দেখানোর কারণ কি তাও বোঝা যাবে। তিনি নিজেকে অতি চালাক ভেবে আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন। শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের পরিণতি দেখে তাঁর কোন শিক্ষা হয়নি।
ধর্মীয় সন্ত্রাসে উস্কানি, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিরুদ্ধে অনবরত অসত্য ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণার দায়ে যখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকাটি এবং ‘দিগন্ত’ টেলিভশন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন সরকারী পদক্ষেপের সমর্থক এক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, দুটি মিডিয়াই সাংবাদিক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি করছিল। আমি তাকে বলেছি, এই দু’টি মিডিয়ার চাইতেও দেশ ও জাতির আরও বড় ক্ষতি করে চলেছে এমন একটি বাংলা দৈনিক আছে। কিন্তু সেটি সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ দৈনিকটির আবার ‘নিরপেক্ষ প্রগতিশীলতার’ মুখোশ আছে। এই পত্রিকাটিরই বহুরূপী সম্পাদক মতিউর রহমান। এককালে বাম অবতার ছিলেন। এখন কামিনীর কিনা জানি না, কিন্তু কাঞ্চনের অবতার।
ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই মহাদেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সবচাইতে বেশি ক্ষতি করেছে এককালে যারা বামপন্থী ছিলেন এমন লোকরাই। হিটলার এবং মুসোলিনীও প্রথম যৌবনে সোস্যালিস্ট ছিলেন। পরে ফ্যাসিস্ট হন। হিটলার তো জার্মান রাইখ (পার্লামেন্ট) পুড়িয়েছিলেন এক সাবেক কমিউনিস্টের দ্বারা। তারপর এই অগ্নিকা-ের দোষ জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ওপর চাপিয়ে দলটির ওপর নির্মম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন।
বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাজনীতির যতো ক্ষতি এ সাবেক বামেরা করেছে, তত ক্ষতি সাম্প্রদায়িক দলগুলো মিলিতভাবেও করতে পারেনি। সাংবাদিকতাতেও শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা প্রকাশ্য শত্রুতা দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক শিবির ও তার রাজনীতির যত ক্ষতি করতে পারছেন না, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি করছেন সাবেক বাম মতিউর রহমান এবং তার সম্পাদিত পত্রিকাটি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়। এ ব্যাপারে কেউ চাইলে অবশ্যই জনমত সমীক্ষা চালাতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সার্বজনীন দাবি এবং দৈব আশীর্বাদের মতো দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার জন্য ঠিক সময় ও সুযোগ বুঝে কোন দেশপ্র্রেমিক এবং সুস্থমনা সম্পাদক কি তার পত্রিকায় জনমত জরিপের ব্যবস্থা এবং তার ম্যানুপুলেটেড রেজাল্ট প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন?
এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন স্পেনে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে অগাস্টিন সোমস নামে এক সাবেক বাম সম্পাদক। তিনিও নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে তার পত্রিকায় জেনারেল ফ্রাঙ্কোর পক্ষে প্রচারণা চালাতেন। তিনিও স্পেনের মানুষ দুর্বল রাজতন্ত্র চায়, না ফ্রাঙ্কোর শক্তিশালী শাসন চায়-এই প্রশ্নে জনমত জরিপের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নব্বই শতাংশ মানুষ ফ্রাঙ্কোর শাসন চায় বলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছিলেন। পরে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, জনমত জরিপের রায়টি নিয়ে অগাস্টিন সোমস নিজে জালিয়াতি করেছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নামে ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা দখলে সহায়তা যুগিয়ে অগাস্টিন প্রচুর অর্থ ও বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছিলেন। তিনি অর্থের প্রলোভন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে স্পেনের তৎকালীন বহু বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিককে তার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করে তাদের দিয়ে নীতিভ্রষ্ট লেখা লিখিয়েছেন। বাংলাদেশেও মতিউর রহমান যা করছেন তা সম্ভবত এ অগানিস্টন সোমস এরই অনুকরণ। মতিউর রহমানের কুহকে মজে গিয়ে এবং তার মনের মতো লেখা লিখতে গিয়ে অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি ও কলমিস্ট বিতর্কিত হয়েছেন, আগের সুনাম হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে একমাত্র আমার বন্ধু প্রবীণ কলামিস্ট এ বিএম মূসাই সম্ভবত এখন পর্যন্ত টোগর বৈষ্ণবীর স্বামী না হয়েও টিকে থাকতে পেরেছেন। তিনি এখন অসুস্থ। আমি তার নিরাময় ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।
অগাস্টিন সোমসের শেষরক্ষা হয়নি। ফ্রাঙ্কো তাকে ব্যবহার করলেও বিশ্বাস করতেন না। তিনি যখন ধন সম্পত্তি প্রভাব প্রতিপত্তির চূড়ায়, তখন হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। তার কোন সন্ধান আর মেলেনি, এমন কি মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। অনেকের সন্দেহ, ফ্রাঙ্কোর গুপ্ত ঘাতকেরাই তাকে লাপাত্তা করেছিল। বাংলাদেশে মতিউর রহমানের এমন পরিণতি ঘটকু, তা আমি অবশ্যই কামনা করি না। বরং তার ধনশ্বৈর্য আরও বাড়ুক, জীবন আরও সমৃদ্ধ ও দীর্ঘ হোক এই কামনা করি। কেবল প্রার্থনা করি, মতিউর রহমানকে আল্লা সুুমতি দিন। তার “ওয়াছওয়াছা” থেকে বাংলার মানুষ যেন মুক্তি পায়।
বিএনপির দ্বারা প্রভাবিত পরিচালিত ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিণতি দেখার পর দেশের মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। যার ফলে যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রথম দাবি তুলেছিল। তারাই পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে সংসদে এ ব্যবস্থা বাতিল করে। সর্বোচ্চ আদালতও এই ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষেই ব্যয় দিয়েছে।
এতদসত্ত্বেও প্রচার ও প্রচারণার জোরে মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কফিনটিকে আবার কবর থেকে তুলে তাতে ভৌতিক প্রাণ সঞ্চারের প্রচেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত ছাড়া তথাকথিত সুশীল সমাজের যারা এই পদ্ধতির পক্ষের প্রধান প্রবক্তা, যেমন আকবর আলি খান, হোসেন জিল্লুর রহমান, সুলতানা কামাল এবং অনেকেই এক সময় ইয়াজউদ্দীনের হাতে নিহত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কফিন বহন করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বহন করতে ব্যর্থ হয়ে পালিয়েছিলেন। এখন আবার এদের কাঁধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রেতাত্মা কি করে ভর করেছে, তা বুঝতে পারছি না।
সে যাই হোক, আওয়ামী লীগের প্রচার শক্তি কম, তাই বিএনপি-জামায়াত এবং এই সুশীল সমাজের সমবেত প্রচারণায় এবং প্রথম আলোর মতো দশানন মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে একটা জনমত গড়ে উঠতে পারে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় এমন প্রচার পাগলেও বিশ্বাস করবে কি? মতিউর রহমান নিজেও বিশ্বাস করেন কি?
প্রথম কথা, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলে, তখন জনমত জরিপ ছাড়াই বোঝা গিয়েছিল, দেশের পঁচানব্বই ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চায়। তার প্রকাশ ঘটেছিল এই দাবির পক্ষে বিশাল গণজাগরণ, অসহযোগ আন্দোলন, জনতার মঞ্চ গঠন ইত্যাদির মধ্যে। এই গণবিস্ফোরণের মুখেই আপোসহীন নেত্রী খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল।
এবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবির পেছনে নব্বই ভাগ কেন, পঞ্চাশ ভাগ মানুষেরও সমর্থ থাকত, তাহলে হাসিনা সরকার এতদিন সে দাবি না মেনে ক্ষমতায় থাকতে পারতেন কি? জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশে সর্বাত্মক আন্দোলন, বিক্ষোভ, মিছিলের ডাক দেয়া এবং সর্বত্র সন্ত্রাস সৃষ্টি সত্ত্বেও দেশের মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ও অনাগ্রহী কেন? বিশাল বিশাল জনসমাবেশ ঘটিয়ে হেফাজতের ব্যানারে মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাকা অবরোধে নামিয়েও সরকারের পতন ঘটানো দূরের কথা, নিজেদেরই পালাতে হলো কেন? দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে দাবির পক্ষে, সে দাবি না মেনে কোন সরকারের পক্ষে একদিনও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব কি?
সরকারকে সন্ত্রাসী হেফাজতী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য বিএনপি ও জামায়াত তো দেশে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। অনেকটা প্রাচীন রোমে বারবারিয়ানদের হামলার মতো। তারা নাকি ছায়া মন্ত্রিসভাও গঠন করে ফেলেছিলেন। এত বিশাল ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও সফল হলো না কেন? ৫ মে রাতে এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে সরকারের লেগেছে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময়। তারপর বার বার হরতাল ডেকে বিএনপি ও জামায়াত লোক হাসিয়েছে মাত্র। কোথায় গেল নব্বই ভাগ মানুষের সমর্থন? মতিউর রহমানের কুর্তার আস্তিনের তলায় কি?
অনুরূপভাবে বলা চলে শাহবাগ চত্বরের বিশাল গণজাগরণের পেছনে যদি দেশের চার ভাগ মানুষের মাত্র এক ভাগের সমর্থন থাকে, তাহলে এই সমাবেশ ঢাকায় অর্ধ মাসের বেশি সময় টিকে থাকতে পারত কি? যে সমাবেশ কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের সমাবেশকেও টেক্কা দিয়েছে। যদি প্রথম আলোর এই দাবি সঠিক হতো, তাহলে এ গণজাগরণ মঞ্চকে হেয় করার জন্য এক প্রবীণ কথাশিল্পী এবং আরেকজন গল্প লেখিকার দ্বারা অশালীন গল্প লিখিয়ে এবং প্রকাশ করে গণরোষের ভয়ে মতিউর রহমানকে মাফ চাইতে হলো কেন? তার পাঠকেরাই কি ঢাকার রাস্তায় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রথম আলো পুড়িয়ে বহ্ন্যুৎসব করেনি?
মতিউর রহমানের রাগটা শাহবাগ মঞ্চের ওপর এখানেই। শাহবাগ মঞ্চের ঐতিহাসিক জাগরণের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ দ-ের দাবি আদায়ে সাফল্যের দরুন মতিউর রহমান তাদের খবর ছাপতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু খুশি ছিলেন না। তার জামায়াতপ্রীতির (পরে এ সম্পর্কে আলোচনায় আসছি) দরুন পরে এই গণজাগরণকে হেয় করার জন্য তার এক নারী কর্মীকে টার্গেট করে দু’টি গল্প লেখান এবং তা ছাপেন। সঠিক খবর কিনা জানি না, প্রথম আলোর ঘরের ভেতর থেকেই খবর পেয়েছি, মতিউর রহমান তার অনুগত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সাজ্জাদ শরিফের দ্বারা (ড. আনিসুজ্জামানের নাত জামাই অথবা ভাগ্নি জামাই) এই গল্প লেখানো ও ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। শাহবাগ মঞ্চের সমর্থকদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে ও গল্প দুটি প্রত্যাহার করে তারা পিঠ বাঁচান।
কিন্তু এই অপমানিত হওয়ার রাগ তাদের যায়নি। ফলে শাহবাগ মঞ্চের সমাবেশ আপাতত স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাদের জনপ্রিয়তার প্রশ্নটিকে অনাবশ্যকভাবে জনমত সমীক্ষায় টেনে আনা হয়েছে এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে একদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ হোক এটা দেশের অর্ধকের বেশি মানুষ চায় না এবং শাহবাগ মঞ্চের জনপ্রিয়তা নেই। দেশের চার ভাগ মানুষের মাত্র এক ভাগ তাদের সমর্থন করে। এ ধরনের মিথ্যাচার জামায়াত ও হেফাজত সমর্থক মিডিয়াগুলোও করার সাহস দেখায়নি। লক্ষ্য করার বিষয় শাহবাগ মঞ্চকে হেয় করার জন্য গল্প লেখানো ও ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যে অনুগত সাংবাদিকের দ্বারা, তাকেই আবার গত শনিবারের জনমত জরিপের (যার মধ্যে শাহবাগ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে) উপস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
প্রথম আলোর এই জনমত জরিপে আরও লক্ষ্য করার বিষয়, সাধারণত পত্রিকাগুলো দুটো কি বড়জোর তিনটি প্রশ্নে জরিপ চালায়। কিন্তু প্রথম আলো একেবারে পাঁচ ছয়টি প্রশ্ন এক সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। সব ক’টি প্রশ্ন লিডিংকোশ্চেন এবং সরকার ও গণতান্ত্রিক শিবিরকে হেয় করে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত চক্রকে বর্তমানের পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্ত করার অপচেষ্টা।
প্রথম আলোর জনমত জরিপে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি এটা নাকি দেশের ৮১ ভাগ লোক মনে করে। আর দেশের অর্ধেকের বেশি লোক জামায়াত নিষিদ্ধ হোক তা চায় না। কুমতি দ্বারা মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন না হলে কোন সুস্থ মতির সম্পাদকের দ্বারা জনমত জরিপের নামে এমন জালিয়াতি করা সম্ভব নয়।
আমি জানি না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপে এমনকি জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধের জন্য যখন নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ইউরোপের কোন দেশের কোন সংবাদপত্রই, দলীয় অথবা অদলীয়, নাৎসি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে জনমত জরিপের উদ্যোগ নিয়েছিল কিনা বা জনমত জরিপ করে এমন কথা প্রচার করেছিল কিনা যে, দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ নাৎসি বা ফ্যাসিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হোক তা চায় না।
বাংলাদেশে জামায়াতের নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কিনা সে সম্পর্কে প্রথম আলোর জনমত জরিপ ও তার ফল প্রকাশের পর বার্লিনে আমার এক জার্মান বন্ধুকে তার দেশে নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হলে কোন মিডিয়া জনমত জরিপ করেছিল কিনা টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘তুমি পাগল হয়েছ! নাৎসিরা গোটা মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ করেছে, তারপর জার্মানির একটি বালকও বলতে যাবে যে এই দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে আমি? জার্মানির কোন সংবাদপত্রের নাৎসি দলের প্রতি গোপন সহানুভূতি থাকলেও তাদের সমর্থনে একটি বাক্য উচ্চারণে কখনও সাহসী হয়নি। জনমত জরিপ করাত দূরের কথা। কারণ, তখন তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৬৮ বছর পরও এই বিধান বলবত রয়েছে। জার্মানিতে এখনও কেউ যদি শুধু ‘হাই হিটলার’ ধ্বনি তোলে, তাকেও গ্রেফতার করা হয়।’
এই নাৎসি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াত দলের কোন পার্থক্য নেই। একমাত্র ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান হওয়া ছাড়া জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধ নাৎসিদের সমতুল্য। নাৎসিরা তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুদ- হয়েছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের বিচার ও দ-াদেশের বিরুদ্ধে জার্মানি, ইতালি বা জাপানের গোপন ফ্যাসিস্ট সমর্থক দলগুলোও আন্দোলন করা দূরের কথা, কথা বলারও সাহস দেখায়নি। নাৎসি বা ফ্যাসিটদের সম্পর্কে জনমত জরিপের নামে তাদের পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে একথা প্রচারের মতো জাতিদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ভূমিকা নিতে কোন সংবাদপত্রই সাহসী হয়নি। অথবা তাদের বিবেক ও দেশপ্রেমে বেধেছে।
বাংলাদেশে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা এবং তার সম্পাদক মতিউর রহমানের এই বিবেক ও দেশপ্রেম এবং সৎ সাংবাদিকতাবোধ আছে কিনা সে প্রশ্নটি আজ আমি বিনা দ্বিধায় তুলছি। যদি তার মধ্যে বিবেক ও দেশপ্রেমের কণামাত্র থাকত তাহলে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, দেশের অসংখ্য মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার হোতা এবং সহযোগী একটি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দলের পক্ষে ভুয়া জনসমর্থন সংগ্রহে তাকে উৎসাহী হতে দেখা যেত না। তিনি এটাকে রাষ্ট্রদ্রোহ ও জাতিদ্রোহতুল্য অপরাধ মনে করতেন।
বাংলাদেশ এখন এক গভীর সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। ‘৭১ সালের মতো স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি মুখোমুখি। স্বাধীনতার বিপক্ষের শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতার বিপক্ষের শিবির এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকরা দেশময় যে ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু করেছিল। ৫ মে সরকার তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করতে না পারলে দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতো। এই সময় কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষে এই দুই শিবিরের মধ্যে নিরপেক্ষ সেজে অবস্থান গ্রহণের এবং এই চতুর ভূমিকার আড়ালে জনমত জরিপের নামে দেশবাসীর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এবং স্বাধীনতার বিপক্ষ শিবিরকে শক্তি সংগ্রহে সাহায্য যোগানোর কোন অবকাশ আছে কি?
অথচ মতিউর রহমান এবং প্রথম আলো পত্রিকা জাতির এই দুঃসময়ে এই বিভীষণের ভূমিকাটিই গ্রহণ করেছেন। দেশের একটি গণতান্ত্রিক সরকারের উদারতা অথবা দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আড়ালে মতিউর রহমান যা করে চলেছেন তা সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা নয়; তা অসৎ ও অপসাংবাদিকতা।
‘আমার দেশ’ পত্রিকার মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকতার নামে যে অপকর্মগুলো প্রকাশ্যে করেছেন, ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার মতিউর রহমান তার চাইতেও বড় বড় অপকর্ম করে চলেছেন সংগোপনে নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, ‘আমার দেশ’ পত্রিকাটির অনুপস্থিতিতে ‘প্রথম আলো’ তার স্থান দখল করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তাতে নেপথ্যের ‘প্রভুদের’ নির্দেশ পালন করা যাবে এবং সেই সঙ্গে ‘আমার দেশের’ সাকুলেশনও হাতিয়ে নেয়া যাবে। এখন ‘প্রথম আলোর’ মাস্টহেডের নিচে ‘আমার দেশ ইনকরপোরেটেড’ কথাটা লিখে দিলেই সঙ্গত হয়।
দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ জামায়াত নিষিদ্ধ হোক তা চায় না এ কথা সত্য হলে শহর থেকে সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এত মানববন্ধন করে রাস্তায় দাঁড়ায়? দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন না, তাঁরা সভা-সম্মেলন ডেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাতেন? জামায়াতের পালের গোঁদা গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হলে দেশে প্রলয়কা- ঘটবে বলা হয়েছিল’; কই, এই নরপশু গ্রেফতার হওয়ার পর গাছের একটি পাতাও নড়েছে কি? বিএনপির আঁচলের তলায় ঢুকে জামায়াতীদের দ্বারা ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য দেশময় সন্ত্রাসের যে বিভীষিকা সৃষ্টি করা হয়েছিল, হেফাজতীদের মাঠে নামানো হয়েছিল, তার পরিণতি কি হয়েছে? ভাংচুর, গাড়ি-বাড়ি পোড়ানো ছাড়া সিকি ভাগ জনসমর্থন নিয়েও একটি হরতাল ডেকে তা সফল করার ক্ষমতা জামায়াতের আছে কি?
একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থানে জামায়াত অবিচল থাকলে তাদের সঙ্গে বিরাট মতপার্থক্য সত্ত্বেও বলতাম, এই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত হবে না। কিন্তু জামায়াতের বর্তমান অবস্থান ও ভূমিকা তো একটি রাজনৈতিক দলের নয়। একটি সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী দলের ভূমিকা তার। যে দলের অতীত ও বর্তমান মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধে পূর্ণ। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও নেহরু সরকার সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ভূমিকার জন্য পঞ্চাশের দশকের সূচনায় কমিউনিস্ট পার্টিকে পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে বেআইনী ঘোষণা করেছিলেন। আবার এই নেহরু সরকারই পরে কমিউনিস্ট পার্টি সন্ত্রাস ত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এলে শুধু তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেননি, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরায় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসতেও দিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের তৎকালীন নেতার ডাঙ্গে ও রণদীভের নীতি এবং নেতৃত্ব বর্জন করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশেও জামায়াত অতীতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বর্জন করে, সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে আসুক না সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে। প্রতিপক্ষকে কাফের মুরতাদ আখ্যা না দিয়ে, তাদের গলা না কেটে, বাংলাভাইদের মতো সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসুক না। কে তাতে আপত্তি করবে? কিন্তু অতীতের যুদ্ধাপরাধের জন্য অপরাধী নেতাদের বর্জন না করে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে ধর্মের মুখোশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে তারা দেশ ও দেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তিতে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালাবেন, তা তো দেশদ্রোহিতা। কোন দেশদ্রোহী সন্ত্রাসী দলকে কোন গণতান্ত্রিক দেশও অবাধে তৎপরতা চালাতে দেয় কি? দেশের মানুষের অর্ধেকের বেশি জামায়াতকে পছন্দ করলে জামায়াতকে আন্দোলনের বদলে সন্ত্রাসের পথ, চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিতে হতো কি? নেতারা কিছু দলীয় ক্যাডার এবং ভাড়া করা বেকার তরুণকে ভাংচুরের জন্য রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজেরা পালিয়ে থাকতেন কি? মতিউর রহমান কাদের চশমা চোখে দিয়ে জামায়াতীদের নিষিদ্ধ করা সমর্থন করে না এমন অর্ধেকের বেশি মানুষ দেখতে পেয়েছেন তা জানি না। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘আমার দেশের’ ‘হঠাৎ সম্পাদকের’ চশমাটি তিনি ভাড়া করেছেন। কারণ, ওই সম্পাদক এখন কারাগারে।
ওই ভাড়া করা চশমার গুণেই কিনা জানি না, মতিউর রহমান তার শনিবারের (১১ মে) জনমত জরিপে আবিষ্কার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি এ কথা মনে করে দেশের ৮১ ভাগ মানুষ। এটা তওবা সম্পাদকের ইচ্ছাকৃত মতিভ্রম। হাসিনা সরকারের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি দেয়া অসম্ভব কাজ বলে দেশের একশ্রেণীর মানুষের, এমনকি একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মনে বদ্ধমূল ধারণা থাকলেও শেখ হাসিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করে শাস্তি দেয়ার চাইতেও বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দেয়া। অপরাধ করার পর ৪২ বছর ধরে এই অপরাধীরা সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিচার এড়াতে পেয়েছে। বিদেশে পলাতক অবস্থা থেকে দেশে ফিরতে পেরেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পুনর্প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এমন কি ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। ধর্মের নামে ধোঁকাবাজি এবং বিদেশী কালেকশনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশাল অর্থভা-ার গড়ে তুলেছে এবং তা সমাজের একশ্রেণী মাথাওয়ালা লোক ক্রয় ও প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করেছে।
এদের কেশাগ্র স্পর্শ করাও ছিল ঘোর বিপজ্জনক। দেশের অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি, বর্তমান মেয়াদে হাসিনা সরকার এই বিপজ্জনক কাজে হাত দিতে পারবেন। বাপের বেটি সেই অসমসাহসিক কাজে হাত দিয়েছেন। জামায়াতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ঘাতক ক্যাডারের সংখ্যা কম নয়। তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তিনি টলেননি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে এবং তাদের কয়েকজনের মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষিত হয়েছে। এই মৃত্যুদ-াদেশের খবরে ‘প্রথম আলো’ অফিসে হয়ত শোকের ছায়া নেমেছে। কিন্তু সারাদেশে উৎসবের প্লাবন বয়ে গেছে।
জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের অন্যান্য সমর্থকের হাতে এখন অঢেল অর্থ ও প্রতিপত্তি। তারা এই বিচারের মুখে নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে তা কেউ আশা করেনি। বিএনপির সমর্থনপুষ্ট হয়ে জামায়াত বিচার বানচাল ও সরকার উৎখাতের জন্য গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে। ভারতে গান্ধী হত্যার পর ঘাতক নাথুরাম গডসে আটক হলে এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। হিন্দু মহাসভা দলটি গান্ধী হত্যায় শুধু প্রকাশ্যে মিষ্টি বিতরণ করেনি। কয়েকটি বড় শহরে গডসের মুক্তি দাবি করে যানবাহন, সরকারী সম্পত্তি ভাংচুর শুরু করে। নেহরু সরকার এই পরিস্থিতির মুখে পড়ে হিন্দু মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নিষিদ্ধ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করে ভারতের জেলগুলো ভরে ফেলে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ নির্বিচার গুলিবর্ষণে দ্বিধা করেনি।
বাংলাদেশে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য ভারতের চাইতেও ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস শুরু করেছিল। দেশের মানুষই ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে দাবি তুলেছিল জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসিনা সরকারের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব, এই সরকার তার গণতান্ত্রিক শক্তিতে এতই আস্থাবান যে, জামায়াতকে এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। বরং রাজপথেই তাদের মোকাবেলা করেছে। যত মানুষ তাতে মারা গেছে, তার অধিকাংশই জামায়াতীদের সন্ত্রাসের কারণে নিহত হয়েছে। নিহত পুলিশের সংখ্যাও কম নয়। অতঃপর ৫ মে ছিল সরকারের সঙ্গে শাপলা চত্বরে জামায়াতী ও হেফাজতীদের চূড়ান্ত শোডাউনের দিন।
দেশে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল, এই শোডাউনে দেশে রক্তের বন্যা বইবে এমন কি সরকারের পতনও ঘটতে পারে। বেগম খালেদা জিয়া নাকি নতুন শাড়ি পরে অপেক্ষা করছিলেন, কখন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তার ডাক পড়ে। কিন্তু আধঘণ্টায় রণাঙ্গন সাফ। কেবলমাত্র এলাকার বাতি নিভিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েই পুলিশ এত বিশাল জঙ্গী সমাবেশ বানচাল করে দেয়। তুলনায় হতাহতের সংখ্যা এত কম যে, বিদেশী মিডিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর (সেনা বাহিনী ছাড়াই) এই বিস্ময়কর সাফল্যের প্রশংসা করেছে।
এই শোডাউনে পরাজিত জামায়াত-বিএনপিচক্র মুখরক্ষার জন্য প্রচার করা শুরু করে ৫ মের রাতে দু’ঘণ্টার অপারেশনে নাকি আড়াই হাজার লোক হত্যা করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠল, এই হত্যাকা-ের কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই কেন? এই হাজার হাজার লাশ কোথায় গেল? বিডিআর বিদ্রোহেও অসংখ্য লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। শাপলা চত্বরের লাশগুলো কোথায় গেল? শহরের ড্রেনে, নদী-নালায় একটি লাশও তো খুঁজে পাওয়া গেল না। কোন আত্মীয়স্বজনও তো নিহত বা নিখোঁজ আত্মীয়ের সন্ধানে এলেন না। তাহলে? বিএনপি এই গোয়েবলসীয় মিথ্যাটিকে কারও কাছেই বিশ্বাস করাতে পারেনি। বরং মিথ্যাটি প্রচার করতে গিয়ে বিএনপির এক নেতাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
৫ মের এই শোডাউনের পর পরই বিচার ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষণা করতে দেরি করেনি বা দ্বিধাও করেনি। তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কোথায় ব্যর্থ হলো? দেশ-বিদেশে যেখানে সরকারের দৃঢ়তা ও সাফল্য প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে প্রথম আলো সম্পাদকের চোখের কালো চশমায় ধরা পড়েছে, দেশের ৮১ ভাগ মানুষ মনে করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। মতিউর রহমান লোভে, স্বার্থে বা হাসিনাবিদ্বেষে মতিছন্ন হতে পারেন। কিন্তু দেশের ৮১ ভাগ মানুষের মতিছন্ন হওয়ার কোন কারণ ঘটেনি।
এই সিরিজের লেখাটি আজ এখানেই শেষ করছি। লেখাটি আমার ইচ্ছার বাইরে অনেক বড় হয়ে গেছে। নইলে মতিউর রহমানের এই জামায়াতপ্রীতি কেন এবং কবে থেকে শুরু তার আলোচনাও এখানে করতাম। তাঁর জামায়াত-কানেকশন ‘ভোরের কাগজের’ সম্পাদকের সময় থেকে। এই কানেকশনের কারণ কি তাও আমার জানতে বাকি থাকেনি। আগামী সপ্তাহে একটি স্বতন্ত্র নিবন্ধে তা আলোচনার আশা রইল।

লন্ডন : ১৬ মে বৃহস্পতিবার, ২০১৩ ॥

সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ

পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা:প্রকৌ. তাওহীদ হাসান



আমি পত্রিকায় লেখা লেখির জীবন শুরু করেছিলাম পুলিশকে নিয়ে লিখে। সাধারনত পুলিশের নামে যেসব লেখালেখি হয়, গতানুগতীক সেসব ধরনের লেখার বাইরে ছিল আমার লেখাটি। পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, সম্পাদক অনেক চিন্তা ভাবনা করে লেখাটি ছেপেছিলেন। শিরনাম ছিল “পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা”।
আমার একটি ধারনা থেকেই লেখাটি শুরু করা। সারা দেশের মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নির্ঘুম পুলিশই কিন্তু জনসাধারনের শান্তি-নিরাপত্তা-ঘুম নিশ্চিত করে। তাই তাদের প্রতিও আমাদের অল্প হলেও কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার।

সম্প্রতি পুলিশের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনা ঘটছে। প্রতিউত্তরে, পুলিশও জনগনকে ফুল দিয়েছে। আমার স্মরন শক্তিতে বাংলাদেশে ঘটনাটি প্রথম। বিশ্বের অন্যকোথাও ঘটেছে কিনা ঠিক জানা নেই। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর কোন দরকার নেই যে, আবারো প্রমানিত হল, পুলিশ জনগনের বন্ধু। আর অন্ধ লোকরাতো কোন দিনই চোখে দেখতে পাবে না।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্থান পাওয়ার মতই একটি ঘটনা এটি। পুলিশ কমিশনার নিজেও এই “স্যালুট টু পুলিশ” কর্মকান্ডের সাথে জড়িতদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এই কাজের যিনি উদ্দোগতা তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সিনিয়র। তার কাজের সাথে আমি স্বশরীরে যুক্ত হতে না পারলেও তিনি যেদিন থেকে যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন সবই আমি জানি। কিন্তু দূঃখ লাগে যখন শুনি এমন একটা কাজও অনেকে সহজে মেনে নিতে পারে নি। আমার ভয়ের জায়গাটা অন্য। এইসব লক্ষণতো ভালো না !
যে পুলিশ জনগনের সেবায় নিয়োজিত তাদের উপর ইদানিংকালে হামলা হচ্ছে। জিনিসটাকে কি হালকা ভাবে নেয়ার উপায় আছে? সামনের দিনে কি দেখতে হবে কে জানে, তবে এসব কর্মকান্ডের নমুনা কিন্তু ভালো নয় !
উদাহরন টেনে বলা যেতে পারে সবচেয়ে বেশি সারা জাগে এপ্রিলের শুরুতে রাজশাহীর ঘটনায়। রাজশাহীতে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা চালানো হয়। সে সময় ইট ও হেলমেট দিয়ে মাথায় আঘাত করে এসআই জাহাঙ্গীর আলমকে মারাত্মকভাবে আহত করার ঘটনা ঘটে। এ সময় এসআই জাহাঙ্গীর আলমের পিস্তলও কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অল্পের জন্য প্রানে বাচেঁন তিনি।
১৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের রাজনগরে পুলিশের উপর হামলা চলে। রাত ১০ টার দিকে কয়েকজন আসামী আটক করে থানায় নিয়ে আসার পথে পুলিশের উপর হামলা চালানো হয়। এসময়ে কয়েকজন পুলিশ আহত হন এবং পুলিশের ব্যবহৃত একটি গাড়িও ভাংচুর করা হয়েছিল। ঘটনাটি চিন্তা করতেই কেমন যেন লাগে !
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বরিশালের কাটপট্টি এলাকায় বেলা ১২ টার দিকে হরতালের সমর্থনে মিছিলের প্রস্ততিকালে পুলিশের উপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এতে পুলিশ সদস্য আহত হন।
এপ্রিল মাসের ১২ তারিখের দিকে। বৃহস্পতিবার ডাকা হরতালে পুলিশ কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড এলাকার আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা ঘেরাও করে রাখলে পুলিশের উপর ইট পাটকেল, ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে ৪ পুলিশ কনস্টেবল আহত হন।
এপ্রিল মাসে রাতে অন্ধকারেই কক্সবাজার শহরে মিছিল বের হয়েছিল। ওই সময় কক্সবাজার শহরের বাজার ঘাটা এলাকায় পুলিশের উপর গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয় কক্সবাজার সদর থানার এসআই জাকির সহ ৪ জন।
পুলিশের উপর ককটেল-গুলি। প্রতিরোধের সময় কি এখনো আসেনি ? এমনভাবে চলতে থাকলে, দেশের নিরাপত্তার কি অবস্থা হবে?
২১ মার্চ সকালে মহেশপুরে পুলিশের উপর হামলা হয়েছে।
পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে শ্যামপুর ইউনিয়নের গোপালনগর গ্রামে ।
রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, সিলেটে আধা বেলা হরতালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ঝটিকা মিছিল বের হয়েছিল। নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকায় পিকেটারদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
জানুয়ারি, ২০১৩। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল বাজারে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে যাতে ১০ পুলিশ সদস্য আহত হন।
হামলার স্বীকার হয়েছেন বেগমগঞ্জ সার্কেল এএসপি মো: মাহাবুবল আলম খানসহ ১৪ জন পুলিশ সদস্য, ঘটনাটি ফেব্রুয়ারি মাসের।
চট্রগ্রামে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নানকে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাটি অবশ্য গেল বছরের।
গেল বছরের শেষের দিকে, রোববার পিরোজপুরের জিয়ানগরে, জিয়ানগর থানার ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে।
পুলিশের উপর হামলার খুব অল্প কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা আরো নির্মম, ফলাফল ভয়াবহ। এই চক্রকে ঠেকানো দরকার বলে মনে করি। এদের এখনি রুখতে না পারলে, আইনের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভবনা নেই?
হ্যা এটা বলা হচ্ছে না, পুলিশ সবাই শ্বর্গীয় দূত। কিন্তু তাদের বিচার দায়িত্ব জনগনকে দেয়া হয়েছে এটাওতো কোথাও বলা হয়নি। পুলিশের উপর হামলা করে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। যা মেনে নেওয়া কষ্ট, প্রতিরোধ করা রীতিমত সময়ের চাহিদা না হলে বিপদ অবিশ্বম্ভাবি।

লেখক : প্রকৌশলী
tawheed555@gmail.com

Sunday, May 12, 2013

বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে নতুন কোনো ইসলামিক রিপাবলিকের পক্ষে কোনো মিডিয়াও থাকতে পারে: জাহিদ নেওয়াজ খান




বাংলাদেশে বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরই নিজস্ব নীতিমালা নেই। কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান, কিছুটা সাংবাদিকতার সহজ পাঠ আর কিছুটা সার্বজনীন যে নীতিমালা তাতেই চলে এখানকার গণমাধ্যম। বেশিরভাগ মিডিয়ারই যেখানে নিজস্ব নীতিমালা নেই, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মীর স্বাধীনতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়েও তাই নির্দেশনা থাকার প্রশ্ন উঠে না। পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো আরো বেশি কর্পোরেট হওয়ার আগে কিংবা এরকম কোনো নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত তাই বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা ‘ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে’ এক ধরণের স্বাধীনতা উপভোগ করে যেতে পারবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেরকম স্বাধীনতা তাদের এখন আছে।

এই স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে এই মুহূর্তে কিছুটা বিতর্ক চলছে। মজার ব্যাপার হলো, এই বিতর্ক যারা শুরু করেছেন, তারা নিজেরাও একটি পক্ষভুক্ত। কিন্তু তারা নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভিন্নমতের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে। সেক্ষেত্রে তারা একজন রিপোর্টারের রিপোর্ট কিংবা একজন নিউজ ম্যানেজারের আউটপুট বিবেচনায় না নিয়ে ওই রিপোর্টার কিংবা নিউজ ম্যানেজার ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে কিংবা অন্য কোনো মুক্তমত প্রকাশের মাধ্যমে কি বলেছেন, সেটাকেই সামনে নিয়ে আসছেন।
সহকর্মী নাজমুল আশরাফ তাই ফেসবুকেই লিখেছেন: “ইদানিং সাংবাদিকতার শিক্ষকের (?) প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। বিশেষ করে ফেসবুকে। কথায় কথায় তারা সাংবাদিকতা শেখান। সাংবাদিকতা কাকে বলে, কোনটা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, কোনটা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, নিরপেক্ষতা মানে কী, কে নিরপেক্ষ সাংবাদিক, কে দলীয় সাংবাদিক, সাংবাদিকদের কী করা উচিত, কী করা উচিত না, কোনটা হলুদ সাংবাদিকতা, কোনটা দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতা, আরো কত কত শিক্ষা... একটা শব্দও ঠিকমত লিখতে পারেন না, এমন ব্যক্তিও ফেসবুকে সাংবাদিকতার ক্লাস নিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ভাবি, ফেসবুকে যেখানে বিনে পয়সায় সাংবাদিকতা শেখা যাচ্ছে, সেখানে কি দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এতোগুলো বছর নষ্ট করার? এক শ্রেণীর ফেসবুকার তো সাংবাদিকদের সনদ দিতেও শুরু করেছেন। উপদেশও দিচ্ছেন, অমুক রহমানের মত সাংবাদিক হন, তমুক করিমের মত নিরপেক্ষ হন। ভাবছি, গীতি ম্যাডামকে বলবো, সাংবাদিকতা বিভাগটা এবার বন্ধ করে দেন।”

যাদেরকে নতুন করে সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব শেখানোর চেষ্টা চলছে, তারা কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ এর আগে যারা জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। শুধু পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নয়, সাধারণ বিচার-বিবেচনাবোধ আর কাণ্ডজ্ঞানের কারণেও তারা যখন মুক্ত মত প্রকাশের জায়গায় প্রধান দুই দলেরই সমালোচনা করে লেখালেখি করতেন, অথবা ফেসবুক-টুইটারে মতামত জানাতেন; দলীয় কর্মী বা সাংবাদিকদের কাছে তা পছন্দনীয় না হলেও তারা এই ভেবে সান্ত¦না পেতেন যে শুধু আমার দল না, প্রতিদ্বন্দ্বি দলেরও তিনি সমালোচক। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগে জনবিষ্ফোরণ থেকে যে গণজাগরণ মঞ্চ, এরপর সেই পেশাদার সাংবাদিকরা তাদের মত প্রকাশের জায়গায় বাংলাদেশের পক্ষে পরিস্কার অবস্থান নেওয়ায় সাংবাদিকদের দুই দলের একটির কাছে তারা হয়ে গেলেন অ্যাকটিভিস্ট, আর অন্য দলের কাছে এতোদিনে লাইনে আসা সাংবাদিক।

শুধু ব্যক্তি সাংবাদিকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব মতামত নয়, সামগ্রিকভাবেও মিডিয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। এখানেও মজার ব্যাপার হলো, যারা এই অভিযোগ করছেন তারা মিডিয়ার যে ছোট অংশ প্রতিদিন লিফলেটের মতো প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশন সংবাদের মূল অংশে প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের ব্যাপারে নীরব। তাদের সমস্ত অভিযোগ মিডিয়ার সেই বড় অংশের বিরুদ্ধে যারা সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা মেনেই আকার এবং সময়ের দিক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের আন্দোলনকে কিছুটা বেশি কাভারেজ দিলেও অন্যপক্ষের সব বক্তব্য এবং খবরই নিয়মিত প্রচার করছে। এর বড় প্রমাণ জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল। পুলিশের তোপের মুখে থাকা জামায়াত এবং ছাত্রশিবির এতোগুলো হরতালের একটিও কোনো সভা-সমাবেশ থেকে ডাকেনি। তাদের সব হরতালই আহ্বান করা হয়েছে হয় ফোন কল অথবা টেক্সট কিংবা ই-মেইল বা ফ্যাক্সে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশের কোন্ টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র সেই খবর প্রচার করেনি? অনেকেতো মনে করেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতায় হরতাল আহ্বানের খবর যে প্রচার পায়, তাতেই হরতাল অর্ধেক সফল। বাকি অর্ধেক হয়ে যায় নাশকতার আগে সাংবাদিকদের খবর দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধমে। এই ‘প্রি-অ্যারেঞ্জড’ নাশকতার খবরের প্রচার নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে আপাতত শুধু পেশাদারিত্ব নিয়ে যে বিতর্ক সেই প্রসঙ্গ।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধমের বড় অংশের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে পক্ষপাতিত্ব তা কি পেশাদারিত্ব বরবাদ হয়ে যাওয়ার সামিল? কেউ কেউ তাই মনে করছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, এখনকার বিতর্কটা আসলে মিডিয়ার আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে না। এই বিতর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তির মধ্যে যে চেতনার লড়াই সেই লড়াইকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো মতলববাজ এটাকে সাংবাদিকতার সাধারণ তুল্য-মূল্যে ফেলতে চাচ্ছেন।

তবে এই চেতনা বলতে শুধু ফখরুলিয়-আশরাফিয় কোনো স্লোগান নয়। এখানে চেতনা হচ্ছে সেইসব মৌলিক বিষয় যার ওপর জনমানস গড়ে উঠে। একটি দেশের জন্য যা একটি দর্শন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাও এরকম কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর গড়ে উঠেছে। তাই গণমাধ্যম যখন সেই দেশ এবং তার সমাজের আয়না, ওই আয়নায় তার মৌল দর্শন বা চেতনাও প্রতিফলিত হবে। সেই দর্শন যখন আঘাতপ্রাপ্ত হবে, প্রতিফলিত হবে সেটাও। এখনকার বিতর্ক সেই আঘাতকে কেন্দ্র করে। এই আঘাতটা যারা করছে, তারা বাংলাদেশের মৌল চেতনার ওপরই আঘাত করছে। এবং এটা তাদের আধা ঘোষিত যুদ্ধ। সুতরাং যে মিডিয়া বাংলাদেশের, সেই মিডিয়া ওই আধা ঘোষিত যুদ্ধটাকে বাংলাদেশের চোখ দিয়ে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সে দেখাটাকে যারা পক্ষপাতিত্ব মনে করেন তারা আসলে কোন্ দেশের সেই প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে।

এখানে এটাও মনে রাখা উচিত যে, বেসরকারি মিডিয়ার উপরও জনগণের পরোক্ষ মালিকানা আছে। কারণ শেষ পর্যন্ত তারাই এর পাঠক কিংবা দর্শক। একটি গণমাধ্যমকে তাই সেই গণমানুষের কথা মাথায় রাখতেই হয়। গণ বিষয়টাও বুঝতে হয় গণমাধ্যমকে। তবে সেই গণ না যেখানে অনেক লোক চাইলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মন্দির বা ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি মসজিদে হামলাকে উৎসাহিত করা হয়। কথিত বিশেষজ্ঞদের এটাও বুঝতে হবে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া একটি দেশের নাগরিক আর বাংলাদেশের নাগরিক একই কথা নয়। এই দেশটি আপনা-আপনি কিছু পাহাড়-সমুদ্র-নদী নিয়ে গঠিত হয়নি। এই দেশটির জন্ম ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস রক্তাক্ত। যদিও আবেদন করে কোনো দেশেই জন্ম নেওয়া সম্ভব না, তারপরও সেই রক্তাক্ত পথ ধরে জন্ম নেওয়া দেশে জন্ম নিলে, দেশটির জন্মের মৌল চেতনাকে ধারণ করতে হবে। এই চেতনাকে যারা ধারণ করছে না, তারা এখন বাংলাদেশের ভেতরে আরেকটি দেশের জন্য লড়াই করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে নতুন কোনো ইসলামিক রিপাবলিকের পক্ষে কোনো মিডিয়াও থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের মিডিয়া হিসেবে আপনি এখানে কথিত নিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশের ভেতর বাংলাদেশবিরোধী নতুন কোনো দেশের পক্ষে দাঁড়াবেন কি না সেই বিচার-বিবেচনাবোধ আপনার।

যে পশ্চিমাদের উদাহরণ দিয়ে নীতিবাগিশ নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়, তারাও, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র; আমাদের মতো পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই গেছে একসময়। সেসময় মিডিয়ারও পক্ষপাতিত্ব ছিলো স্পষ্ট। এখনও তারা তাদের স্বার্থে ঠিকই পক্ষপাতিত্ব দেখায়। ভিন্ন মতের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রে কি ওসামা দর্শন প্রচার সম্ভব অথবা মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি আরবে গণতন্ত্রের সংগ্রাম? এমনকি অভিযুক্ত বা কথিত না বলেই সরাসরি টেরোরিস্ট তকমা বসিয়ে দেয়/দিচ্ছে সেখানকার মিডিয়া। তাহলে বাংলাদেশ কেনো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সহ্য করবে?
সর্বশেষ ফটিকছড়ির ভুজপুরে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ আর ‘আল-কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগানে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় কয়েকজনকে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিভিতে দেখানো নিয়েও সুশীলিয় প্রশ্ন উঠেছে। যারা এই প্রশ্ন তুলেছেন, তারাই কিন্তু বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিওর রেফারেন্সে মধ্যরাতের আলোচনায় মুখে ফেনা তুলেছিলেন। তখনকার সেই ফুটেজে তাদের মনে হয়নি যে পশ্চিমাদের তৈরি করে দেওয়া সাংবাদিকতার নীতিমালা লংঘিত হচ্ছে। কিন্তু ফটিকছড়ির ফুটেজ দেখে সেই কথাই মনে হচ্ছে তাদের।

কেউ কেউ আবার ভোল পাল্টে এমন প্রশ্ন তুলেছেন, মিডিয়া এখন ফটিকছড়ির ঘটনায় যতোটা সোচ্চার, ছাত্রলীগের ‘বীর পুঙ্গবরা’ বিশ্বজিতকে খুন করে ফেলার পর ততোটা সোচ্চার ছিলো না। তাদের এই কথাও ঠিক না। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট, দু’ ধরণের মিডিয়াই ওই ইস্যুতে সোচ্চার ছিলো বলেই বিশ্বজিতের খুনীরা এখন গারদের ভেতরে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বজিত খুন হওয়ার পর তারা যতোটা সোচ্চার ছিলেন, অবশ্যই যে কোনো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ওইরকম জঘন্য ঘটনায় সোচ্চার হবেন, ফটিকছড়ির ঘটনার পর তারা কিন্তু একেবারেই চুপ।
শুরুতে ফেসবুক-টুইটার-ব্লগ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের যে কথা বলেছিলাম, সহকর্মী নাজমুল আশরাফ যে প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার নতুন নতুন শিক্ষক আবিষ্কার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন; একটা উদাহরণ দিলেই সেই শিক্ষকদের মান বোঝা যাবে। শাহবাগের গণজাগরণের পর থেকে আড়াই মাসে যখনই কোনো সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মত প্রকাশের মুক্ত জায়গায় কোনো নিজস্ব মতামত দিয়েছেন, অবধারিতভাবে দেখা গেছে সেখানে কেউ না কেউ সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে তাকে হলুদ সাংবাদিক বলেছেন, মিথ্যা রিপোর্ট বলেছেন। ওই বিশেষজ্ঞ যারা সংবাদ এবং মন্তব্য কিংবা সংবাদ বিশ্লেষণের পার্থক্যও বোঝেন না; তাদের নিয়ে বলার কিছুই নেই।

তবে সতর্ক থাকতে হবে ভয়ংকর আরেকটি গ্রুপ সম্পর্কে। সাংবাদিকতার নীতিমালা শেখানোর নামে এরা প্রথমে কিছু বাণী দেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর যুক্তিতে না পেরে নাস্তিক উপাধি দিয়ে বাঁশের কেল্লা সাইটে তালিকাভুক্ত করে ভুজপুরের পরিণতি বরণের প্রস্তুতি নেওয়ার হুমকি দিয়ে আপাতত বিদায় নেয়। তবে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করবে বারবার। বাংলাদেশের সৌভাগ্য এর নিয়ন্তারা ডান-বাম করলেও মূলধারার গণমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশের পক্ষেই আছে।পাদটীকা

সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানবিকতার পক্ষে যে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রশ্নেও গণমাধ্যমের সেই মানবিক অবস্থান নেওয়াটাই সৎ সাংবাদিকতা। এখানে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালার কথা বলে প্রশ্ন তুলে তারা আসলে সেই হেফাজতিদের মতো যারা ‘ডেকে নিয়ে শত শত মানুষ হত্যাকাণ্ডকে’ মতলবি স্বার্থে ‘আল্লাহর গজব’ বলে। তারা আসলে সেই জামায়াতিদের মতো যারা সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের শোকের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চলার সময়ও হরতাল (চট্টগ্রামসহ কয়েক জায়গায় ২৮ এপ্রিল) ডেকে প্রমাণ দেয় তাদের নাগরিকত্ব আসলে ভিন্ন।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এর মুখপত্র ‘যোগাযোগ’ এর বর্ষপূর্তি (মে ২০১৩) সংখ্যায় প্রকাশিত)।

জাহিদ নেওয়াজ খান : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই
znewaz@gmail.com