গত দু’সপ্তাহ ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারত-পাকিস্তান। কেবলমাত্র রাগ বা ক্ষোভ নয়, সকলেই চিন্তিত আক্রমণরত পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আর প্রসঙ্গত এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে, পাকিস্তানের কুখ্যাত আইএসআই (Inter-Services Intelligence)-এর সাবেক প্রধান হামিদ গুলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপচারিতার বিষয়টি।
সালটা ১৯৯৯। ওয়াশিংটন ডিসি-তে ব্লেয়ার হাউস চুক্তির কিছু পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয় জম্মু-কাশ্মীরের কার্গিল সেক্টরে হামলা থামাতে। ইসলামাবাদের (প্রথম ও একবারই গেছি ওখানে) আবাহাওয়ায় তখন হতাশা এবং ইতিবাচক, এই দু’ধরণের অনুভূতির মিশ্রণ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের তলব এবং আমেরিকার ভৎসনার মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের চুক্তিতে সাক্ষর করা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল ইসলামাবাদে, আবার একইসঙ্গে সেখানকার একাংশ আশান্বিত হতে শুরু করেছিলেন, ফের লাহোর বাস যাত্রা শুরু হবে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপিত হবে।
ভারতে তখন লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে এবং পাকিস্তানের তথাকথিত ‘ভারত বন্ধু’রা মনে করেছিলেন কংগ্রেস সেবারে সরকার গঠন করবে।
ভারতে তখন লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে এবং পাকিস্তানের তথাকথিত ‘ভারত বন্ধু’রা মনে করেছিলেন কংগ্রেস সেবারে সরকার গঠন করবে।
ইসালামাবাদ থেকেই আমি হামিদ গুলকে ফোন করলাম (ফোন নম্বরটা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এক বিদেশি সাংবাদিক) একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকারের জন্য। রাওয়ালপিন্ডিতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । কারণ, এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি ছিল না;আর কোনও সামরিক এলাকায় তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
অনেক পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, আমলা এবং সামরিক প্রধানদের বক্তব্য শুনেছি, যাঁরা অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারের অংশ নেন। শ্রোতারা তাঁদের বক্তব্য শুনতে পছন্দও করে।
অবশ্যই তাঁরা কখনও একপেশে বক্তব্য রাখেন না। আমার সৌভাগ্য যে হামিদ গুল এই গোষ্ঠীভুক্ত নন।
তিনি আমাকে যা বললেন এবং কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের জেহাদিদের সামনে যে উত্তেজক ভাষণ রাখেন তার মধ্যে খুব একটা ফারাক ছিল না।
অবশ্যই তাঁরা কখনও একপেশে বক্তব্য রাখেন না। আমার সৌভাগ্য যে হামিদ গুল এই গোষ্ঠীভুক্ত নন।
তিনি আমাকে যা বললেন এবং কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের জেহাদিদের সামনে যে উত্তেজক ভাষণ রাখেন তার মধ্যে খুব একটা ফারাক ছিল না।
ওই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কী করণীয় ছিল? হামিদ গুলের মতে, কার্গিল যুদ্ধ দেখিয়ে দিল এটাই পাকিস্তানের একমাত্র এবং দীর্ঘায়িত পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে ভারত কোনও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। অতীতেও পাকিস্তান আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছিল এবং ভারতকে বিভিন্ন সময় রক্তাক্ত করেছিল।
গুল এই মনোভাবকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে দিলেন তাঁর নিজের যুক্তিতে।
পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে ভারত কোনও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। অতীতেও পাকিস্তান আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছিল এবং ভারতকে বিভিন্ন সময় রক্তাক্ত করেছিল।
গুল এই মনোভাবকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে দিলেন তাঁর নিজের যুক্তিতে।
তাঁর মতে, পাকিস্তানকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভারতের ঐক্য যেন কোনওভাবেই সুরক্ষিত না থাকতে পারে।
আয়তনগতভাবে ভারত যে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে তা নষ্ট করতে হবে। ভারতের ভাঙন নিয়ে তাঁর এই কৌশলগত অবস্থান একজন ভারতীয় সংবাদিককে তিনি নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন।
আয়তনগতভাবে ভারত যে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে তা নষ্ট করতে হবে। ভারতের ভাঙন নিয়ে তাঁর এই কৌশলগত অবস্থান একজন ভারতীয় সংবাদিককে তিনি নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই পাকিস্তান তার বৃহৎ আয়তনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি নিয়ে বিচলিত। পাকিস্তানের নীতিপ্রণেতারা মনে করতেন, ভারতের একতা আসলে কৃত্রিম এবং অচিরেই ‘হিন্দু একতা’র কারণে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
দুর্ভাগ্যবশত ভারত টিকে গেছে।
কিন্তু পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ভেঙে পড়েছিল। আর তখন থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক আত্মসমর্পনের প্রতিশোধ নেওয়াটাই পাকিস্তানের কৌশলগত দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান সর্বদাই কাশ্মীরের জন্য লালায়িত ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর ভারতকে টুকরো টুকরো করা পাকিস্তানিদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত ভারত টিকে গেছে।
কিন্তু পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ভেঙে পড়েছিল। আর তখন থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক আত্মসমর্পনের প্রতিশোধ নেওয়াটাই পাকিস্তানের কৌশলগত দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান সর্বদাই কাশ্মীরের জন্য লালায়িত ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর ভারতকে টুকরো টুকরো করা পাকিস্তানিদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
ভারতে অল্প সংখ্যক নির্বোধ বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা মনে করেন, পুরো জম্মু-কাশ্মীর না হলেও নিদেনপক্ষে কাশ্মীর উপত্যকা পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। তাঁরা এও মনে করেন, এর ফলে সত্তর বছরের পুরনো বিবাদ মিটে যাবে সহজেই, আর প্রতিরক্ষা বাবদ একটা বড় খরচ বেঁচে যাবে, সেই অর্থ দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে কাজে লাগবে।
আমার মতে তাঁরা দু’দিক দিয়ে ভুল। প্রথমত, কাশ্মীর কোনওভাবেই পাকিস্তানের একমাত্র চাহিদা নয়।
এক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগের এক নেতার বক্তব্য মনে পড়ে যাচ্ছে। যিনি বলেছিলেন- কাশ্মীর হল ‘সাম্প্রতিক চাহিদা’।পাকিস্তানের বৃহত্তর উদ্দেশ্য হল ভারতকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া- অষ্টম শতাব্দীর খন্ডিত ভারতের ইতিহাস থেকে এই ভাবনার উদয় হয়েছে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।
দ্বিতীয়ত, এই ভারতভাগের তত্ত্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামি মতবাদের উন্মেষের জোরালো তাত্ত্বিক যোগ রয়েছে। ইসলামি আধুনিক মতবাদের ধারকরা আজ সংখ্যায় নগণ্য।
ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে একটি জনমত গড়ে উঠছে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারে বিশ্বাস করে।তাঁরা চায় চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যাতে এই উপমহাদেশে তাঁরা খলিফার স্বপ্নরাজ্য বানাতে পারে।
এক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগের এক নেতার বক্তব্য মনে পড়ে যাচ্ছে। যিনি বলেছিলেন- কাশ্মীর হল ‘সাম্প্রতিক চাহিদা’।পাকিস্তানের বৃহত্তর উদ্দেশ্য হল ভারতকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া- অষ্টম শতাব্দীর খন্ডিত ভারতের ইতিহাস থেকে এই ভাবনার উদয় হয়েছে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।
দ্বিতীয়ত, এই ভারতভাগের তত্ত্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামি মতবাদের উন্মেষের জোরালো তাত্ত্বিক যোগ রয়েছে। ইসলামি আধুনিক মতবাদের ধারকরা আজ সংখ্যায় নগণ্য।
ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে একটি জনমত গড়ে উঠছে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারে বিশ্বাস করে।তাঁরা চায় চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যাতে এই উপমহাদেশে তাঁরা খলিফার স্বপ্নরাজ্য বানাতে পারে।
ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দিয়ে চলেছে পাকিস্তান ।এই সন্ত্রাসবাদী হামলা এ দেশের বিচ্ছিন্নকারী শক্তিগুলিকে মদত দিচ্ছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।
এত প্ররোচনার মুখেও ভারত সরকার চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।কারণ, আন্তর্জাতিক মহলের সতর্ক বাণী ভারত জানে, তাই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশই সতর্কতা অবলম্বন করছে।
কিন্তু এই অসহায়ত্ব সাধারণ মানুষ মেনে নিতে রাজি নয় ।তারা ক্ষোভে ফুঁসছে। বিশেষ করে কাশ্মীরের একের পর এক সমস্যা এবং পাঠানকোট ও উরি হামলার পর।
এত প্ররোচনার মুখেও ভারত সরকার চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।কারণ, আন্তর্জাতিক মহলের সতর্ক বাণী ভারত জানে, তাই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশই সতর্কতা অবলম্বন করছে।
কিন্তু এই অসহায়ত্ব সাধারণ মানুষ মেনে নিতে রাজি নয় ।তারা ক্ষোভে ফুঁসছে। বিশেষ করে কাশ্মীরের একের পর এক সমস্যা এবং পাঠানকোট ও উরি হামলার পর।
কোনও সন্দেহ নেই এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষ নজরদারি এবং নিপুণ রাজনৈতিক কৌশলের প্রয়োজন হয়।
যদিও দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তাভাবনা থেকে দেখলে পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করা উচিত এবং তা শুধুমাত্র কূটনৈতিক ভাবে নয়।
১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত আস্থা রেখেছিল গণতান্ত্রিক, স্থায়ী এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের উপর। কারণ, ভারত চিরকালীন দ্বন্দ্বের অবসান চেয়েছিল। কিন্তু এখন এই ধারণা বদলে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
যদিও দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তাভাবনা থেকে দেখলে পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করা উচিত এবং তা শুধুমাত্র কূটনৈতিক ভাবে নয়।
১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত আস্থা রেখেছিল গণতান্ত্রিক, স্থায়ী এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের উপর। কারণ, ভারত চিরকালীন দ্বন্দ্বের অবসান চেয়েছিল। কিন্তু এখন এই ধারণা বদলে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
গুল তাঁর উগ্র চিন্তাভাবনা থেকে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ-এ পাকিস্তান কোন পথে যাবে। আদর্শগতভাবে দেখলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সমস্যা নিয়ে ভারতের মাথা ঘামানো উচিত নয়।
যখন পাকিস্তানের নিজের দেশের দর্শন’ই তাদের নিজেদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না, তখন ভারতের কি ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান’ এই তত্ত্বে আস্থা রাখা উচিত ? হামিদ গুল-তত্ত্ব ভারতও প্রয়োগ করতে পারে।
যখন পাকিস্তানের নিজের দেশের দর্শন’ই তাদের নিজেদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না, তখন ভারতের কি ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান’ এই তত্ত্বে আস্থা রাখা উচিত ? হামিদ গুল-তত্ত্ব ভারতও প্রয়োগ করতে পারে।