Wednesday, October 5, 2016

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, না কি সিন্ধ-বালোচিস্তানে ছায়াযুদ্ধ?-সুবীর ভৌমিক


Subir Bhoumik  with sumi khan and Adam Dawla at Dhaka
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’এর কৌশল কি সঠিক, না কি পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ, বালোচিস্তানে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা অনেক বেশি কার্যকরী হবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে বেশি করে আলোচনা প্রয়োজন।

কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী অঞ্চল উরিতে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেনাছাউনিতে ফিদায়েঁ হামলা চালিয়ে ১৭ জন ভারতীয় সেনা জওয়ানকে হত্যা করল, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হুমকির সুরে বলেন- ‘‘এর যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।’’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই ঘটনার জন্য দ্রুত পাকিস্তানকে দায়ী করে বলেন- ‘‘পাকিস্তান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।’’

মোদীর উপদেষ্টারা এবং মন্ত্রীসভার সদস্যরা পাকিস্তানে পাল্টা হামলা চালানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ’দের সঙ্গে বসে প্রাক্তন কূটনীতিবিদ ও মেজর জেনারেলরা আলোচনা করতে থাকেন। ভারতের পাকিস্তানের উপর পাল্টা হামলা চালানো উচিত হবে কি হবে না, এই বিষয়ে। যদিও তাঁরা সকলেই একমত যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের মদত যোগাচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে একের পর এক প্যানেল বসছে, গরম গরম আলোচনা চলছে। একটি চ্যানেলে প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ভারতকে নিজস্ব ফিদায়েঁ বাহিনী তৈরী করতে হবে’’। এই বক্তব্যে কট্টরপন্থী ভারতীয়রাও চমকে গিয়েছিলেন। জেনারেল রায়চৌধুরির বক্তব্যকে সেদিন টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্যরাও যেমন মেনে নেননি তেমনি পোড়খাওয়া কূটনীতিবীদরাও ওই বক্তব্যকে সমর্থন করেননি।

পাকিস্তান নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় এবং মাস দুয়েক আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থী বুরহান ওয়ানির মৃত্যু নিয়ে কাশ্মীর অগ্নীগর্ভ হয়ে ওঠায়, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে যে- ইসলামাবাদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া বৃথা।
 দিল্লি চাপ তৈরি করছে যদি আলোচনা করতেই হয়, তাহলে কেবল আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। 
এদিকে এই মুহুর্তে কাশ্মীরের মানুষের ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানও পরিষ্কার করে বলছে, আলোচনায় কাশ্মীর ইস্যুকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দে‍ওয়া ভাষণকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কেন নরেন্দ্র মোদী পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং বালোচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপন করলেন!
 ইন্দিরা গান্ধী থেকে মনমোহন সিং পর্যন্ত কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘসময় ধরে অশান্ত থাকা বালোচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থাগুলির যোগাযোগ রক্ষা করায় বিরোধিতা করেননি, কিন্তু তাঁরা কেউ প্রকাশ্যে এই বিষয়টি কখনও উত্থাপন করেননি। 
আর এখন অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো বালোচ ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই পরিষেবা মোবাইল অ্যাপস-এর মাধ্যমেও পাওয়া যাবে। 
বালোচ নেতা ব্রাহমদুগ বুগতি, যাঁর বাবা পারভেজ মুসারফের আমলে বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন, তিনি ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বসে নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান (বালোচিস্তানের ইস্যুগুলিকে উত্থাপন করার জন্য) এবং দেশে ও দেশের বাইরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সেনাবহিনীকে কাঠগড়ায় তোলেন। সম্প্রতি ভারতের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘে বালোচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপন করেন, আবার পাকিস্তান ভারতের কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তোলে।

অবাক হই না যখন, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রাক্তন অফিসার কুলভূষণ যাদবকে, পাক-সেনাবাহিনী আটক করে এবং বালোচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে মদত দেওয়ার জন্য ভারতকে দোষারোপ করে। 
ইসলামাবাদের অভিযোগ পাকিস্তানের সবচাইতে বড় প্রদেশ বালোচিস্তানে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানোর জন্য কুলভূষণ যাদবকে ভারত নিয়োগ করেছিল। যদিও ভারত এই অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বলে, কুলভূষণ বর্তমানে একজন ব্যবসায়ী, পাক-গুপ্তচরেরা ইরান থেকে তাঁকে অপহরণ করে এবং জোর করে তাঁকে ভারতের বিরুদ্ধে বলিয়ে নেয়। 
কাশ্মীর নিয়ে ভারত যতটা উদ্বিগ্ন, বালোচিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের ততটাই চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পাকিস্তানের এই প্রদেশটি কেবলমাত্র খনিজ সম্পদে সম্বৃদ্ধ নয়, এখানে রয়েছে সমুদ্র বন্দর গদর। চিন এই বন্দরটি নতুন করে সাজাচ্ছে। প্রস্তাবিত ৪৬বিলিয়ন ডলারের চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (CPEC) ক্ষেত্রে গদর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনের সিংকিয়াং প্রদেশের সঙ্গে গদর বন্দরের সংযোগ স্থাপন হলে আরবসাগরে ড্রাগনদের প্রবেশ সহজ হবে। ফলে এটি পাকিস্তানের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের মস্ত বড় ক্ষেত্র।
CPEC প্রকল্পের প্রস্তাবিত সড়কপথ।


কিন্তু বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রস্তাবিত এই করিডরটির বিরোধিতা করছে, তারা নিয়মিত প্রকল্প নির্মাণকারী পাকাস্তানী কর্মী, আধিকারিকদের উপর হামলা চালাচ্ছে। বিশেষ করে সড়ক নির্মাণকারীদের উপর, যারা CPEC-র সঙ্গে যুক্ত। পাকিস্তানের যে সংস্থাটি কাজটি করছে তারা ভারতের ‘বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন’-এর সমতুল্য একটি সংস্থা। ২০১৪ সাল থেকে (মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন যে বছর) বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় ৪৪জন কর্মী প্রাণ হারিয়েছে, ১০০জনের উপর কর্মী গুরুতরভাবে জখম হয়েছে। অধিকাংশ হামলা চালানো হয়েছে বালোচিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্ফারণ ঘটিয়ে। হ্যাঁ এই হামলাগুলি অবশ্যই উরিতে ভারতীয় সেনা ছাউনিতে ফিদায়েঁ হামলা বা গত জানুয়ারিতে পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার মতো উচ্চমার্গের নয়। কিন্তু এই হামলাগুলি পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর সরাসরি আঘাত হানছে। কাশ্মীর ভারতের কাছে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রদেশ নয়। ভরতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীরে বিক্ষোভ, আন্দোলনের মোকাবিলা করতে হচ্ছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে, যাতে পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ব ভুল প্রমানিত হয়। কাশ্মীরের বনজ সম্পদ ও পর্যটন অর্থনৈতিকভাবে ভারতের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বালোচিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বালোচিস্তানের হামলার খবর খুব একটা সংবাদমাধ্যমে আসে না, কারণ এই প্রদেশে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। তবে পাকিস্তান CPEC’র প্রকল্পটি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক এজেন্সিগুলি এই প্রকল্পে কর্মরতদের জন্য নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে চিনের কর্মীদের জন্য। পাকিস্তান সূত্রে খবর, CPEC প্রকল্পে কর্মরত ৭০৩৬ জন চিনা কর্মীর জন্য ১৪৫০৩ জন নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করেছে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু সামরিক এবং অসামরিক নিরাপত্তাবাহিনীকে নিয়ে কৌশল স্থির করতে বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগকে (SSD) যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। SSD’র নর্দান ডিভিশন (খুনজেরাব পাস থেকে রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত) সুরক্ষিত। কিন্তু সাউদার্ন ডিভিশন যেটা রাওয়ালপিন্ডি থেকে গদর পর্যন্ত বিস্তৃত সেখানে সমস্যা রয়েছে। পাকিস্তানের ঐতিহ্যশালী ‘ডন’ পত্রিকায় সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে লেখা হয়েছে- ‘‘এই ইস্যুগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে, CPEC’র প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময়সীমার উপর প্রভাব পরবে, যা গভীর চিন্তার বিষয়।’’

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়ার ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ায় কোনও নতুন ঘটনা নয়। উত্তর ঔপনিবেশিক সময় থেকে এই ঘটনা চলে আসছে। ভারতের কশ্মীর ভূখন্ডের দখল যেনতেন প্রকারে নেওয়ার মানসিকতা থেকে পাকিস্তান শুরু থেকেই জঙ্গি অনুপ্রবেশে মদত দিতে শুরু করে। ১৯৪৭-৪৮ এবং ১৯৬৫ সালে কাশ্মীরে বড় ধরনের জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটায় পাকিস্তান। ভারত মোক্ষম জবাব দেয় ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি গেরিলা বাহিনীকে মদত দেয় এবং সেনা অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করে। পরোক্ষভাবে আমেরিকার সম্মতিতে তিব্বতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ১৯৬৬ সাল নাগাদ ভারত আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দেয়। এর পাল্টা হিসাবে উত্তরপূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে চিন। প্রখ্যাত ভারতীয় গুপ্তচর বিশেষজ্ঞ বি রমন তাঁর লেখা ‘Kaoboys of R&AW’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, সিন্ধ প্রদেশের বিক্ষোভকে কিভাবে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ব্যবহার করেছে এবং তার পাল্টা হিসাবে পাকিস্তান কিভাবে পাঞ্জাবের খালিস্তান আন্দোলনকারীদের সাহায্য করেছিল। ১৯৭০-৮০ দশকে চট্টগ্রামের বুদ্ধধর্মালম্বী গেরিলা বাহিনী ‘শান্তি বাহিনী’কে মদত দেওয়ার পাল্টা হিসাবে বাংলাদেশ পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত এবং আশ্রয় দিতে শুরু করে। আর শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই’কে ভারতের মদত দে‍ওয়ার ঘটনাতো ইতিহাস।

এক বছর আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল পাকিস্তানকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘‘তোমরা মুম্বইয়ের মতো আরেকটি ঘটনা যদি ঘটাও, তাহলে তোমাদের বালোচিস্তান হারাতে হবে।’’ ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রাক্তন প্রধান সেই সময় কাজ করেছেন, যখন দিল্লি খরচ বাঁচানোর জন্য শত্রু দেশগুলির ভূখন্ডে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত যোগাত। পাকিস্তান পরমাণু হামলার যে হুমকি প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই মুহুর্তে ১৯৭১-এর কায়দায় চিরাচরিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব। আবার এখন যে আন্তঃসীমান্ত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-এর কথা বলা হচ্ছে, বারংবার এই পন্থা অবলম্বন করলে তার ফল হতে পারে ভয়ানক। বরং পাকিস্তানের গোলমেলে অঞ্চলগুলিতে (বালোচিস্তান, সিন্ধ, গিলগিট-বাল্টিস্তান) ভারত ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে গেলে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যু থেকে পিছু হটতে বাধ্য হবে।
লেখক- প্রবীণ সাংবাদিক BBC, " Insurgent Crossfire" (1996) বইটির লেখক।

No comments:

Post a Comment