Saturday, February 15, 2014

শ্যামার উপাখ্যান- সুমি খান

পদ্মা এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে।  জানালার বাইরে অপরূপ প্রকৃতি। মুগ্ধতার সুযোগ কৈ আর!পাশের সিটের ভদ্র্রলোক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। তমালের এতো বিরক্ত লাগছে, কিছু বলার নেই।
ট্রেনের গার্ড টিকেট চেক করতে এলেন। স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম ভেঙ্গে জাগতে হলো পাশের ভদ্রলোক কে। তমার মনে মনে শান্তি পেলো এই ভেবে, তার কর্ণকুহরে আর সশব্দে ইঞ্জিন চলবে না অন্তত!
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো ," শ্যামা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস্?"
সুলতা?? কে?
অনেকদিন পর এই নাম শুনলো তমাল। স্লাইড শটের মতো মনে পড়লো - শ্যামার কথা! কেমন আছে? এখন কোথায় আছে?  তমালের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেলো!
 বাবার বদলী সূত্রে চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতো তমালেরা। সেই দুরন্ত কৈশোরে  এলাকার পিটিআই প্রাইমারী স্কুলে একই ক্লাসে পড়তো তমাল আর শ্যামা।স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে অনেকের সাথে শ্যামাও একই পথে বাড়ি ফিরতো। ভীষণ  দুরন্ত ছিল শ্যামা। অকারণেই খুনসুটি হতো দু'জনের!
প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলো তমাল। শ্যামা ও চলে গেলো অপর্ণাচরণ স্কুলে। শ্যামার বাবা-মা তার স্কুলের কাছে নন্দনকাননে বাড়ি ভাড়া নিলেন।
একদিন  মুসলিম হাই স্কুলের পর্তুগীজ ভবনে আন্ত:স্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হলো। ক্লাস সেভেনে পড়তো তমাল। তবলা আর গানে ভালোই ছিল। আবৃত্তি, জারি গান আর ভাওয়াইয়া গানের প্রতিযোগী ছিল তমাল। নানান বিভাগে কলেজিয়েট স্কুলের সাথে খাস্তগীর স্কুল, অপর্ণাচরণ স্কুল, পোস্তারপার স্কুলের প্রতিযোগিতা।
হঠাৎ


Friday, February 14, 2014

কাশেম মোল্লার রেডিও- সালেক খোকন

১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায়। খুব কাছেই রূপপুর গ্রাম। গ্রামের প্রধান রাস্তার পাশে কড়ইতলীতে ছিল ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। দোকানির নাম কাশেম মোল্লা। গ্রামের মানুষ ভালোবেসে ডাকত ‘মোল্লা’ বলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রূপপুরের সবাই উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। দেশের খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তানে নেই সঠিক কোনো খবর। খবর শুধুই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে রেডিও ছিল না কারও কাছেই। কিন্তু কাশেম মোল্লার ছিল থ্রি ব্যান্ডের একটি ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় নিজের দোকানে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসির টানে দিনকে দিন তাঁর দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। আশপাশে বসে আরও কয়েকটি দোকান। সন্ধ্যা হলেই রূপপুর গ্রামের লোকজন একে অন্যকে বলেন, ‘চল, বিবিসি শুনতে যাই।’ বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে এভাবেই গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
ঈশ্বরদীর লালন শাহ সেতু হাইওয়ে থেকে কিলো খানেক ভেতরে বিবিসি বাজার। দোকানের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু সেখানে বাজারের প্রবর্তক কাশেমের দোকান খুঁজে পেলাম না।
খোঁজ করতে গিয়ে কথা হয় আশরাফ মালিথা ও রূপপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর আলীর সঙ্গে। মোল্লার চায়ের দোকানে বসে বিবিসির খবর শোনার স্মৃতি আজও তাঁদের কাছে জীবন্ত। তাঁরা জানালেন, পাকিস্তানিদের গাড়ির শব্দ পেলেই মোল্লার দোকান থেকে সবাই সরে পড়তেন। লুকিয়ে থাকতেন ঝোপঝাড় আর গাছের আড়ালে। সে সময় অনেকেই বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন।
 বিবিসি রেডিও এর একটি দলের সাথে কাশেম মোল্লা
বিবিসি রেডিও এর একটি দলের সাথে কাশেম মোল্লা
চা খেতে আসা নানা জনের নানা তথ্য থাকত কাশেমের কাছে। কখনো কখনো গোপনে ছদ্মবেশে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারাও। তাঁরাও জেনে নিতেন রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর।
কিন্তু কাশেম মোল্লা আছেন কোথায়? পাকশী রেলবাজারে তাঁর একটি মিষ্টির দোকানের কথা জেনে আমরা রওনা দিই সেদিকে।
ভাঙাচোরা একটি দোকান। এক কোণে ঝুলছে বড় একটি ছবি। ছবিতে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজন। দোকানে বসা তাঁর মেজ ছেলে আবদুস সামাদ। ছবি দেখিয়ে তিনি জানালেন, বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন’-এর প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিসের উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও উপস্থাপক দীপঙ্কর ঘোষ এবং সংবাদিক আতাউস সামাদ।
একসময় দোকানে আসেন কাশেম মোল্লা। বয়স সত্তরের অধিক। লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন। বিবিসি বাজার নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের আবদারেই কেনা হয় রেডিওটি। ভিড় জমাতেই তিনি সেটা নিয়ে যেতেন দোকানে। মানুষকে শোনাতেন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
একচিলতে হাসি দিয়ে কাশেম মোল্লা জানালেন, সে সময় বিবিসির খবর সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। দেরিতে এলও খবরপাঠকের কণ্ঠ শুনে ঠিক ঠিক বলতে পারতেন কার কণ্ঠ শুনছেন—সিরাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম, শ্যামল নাকি কমল বোসের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগের কথা। রাজাকারদের খবরের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় কাশেমের চায়ের দোকানটিতে। কাশেম মোল্লার ভাষায়, ‘‘পাকিস্তানি সেনারা আমারে হুংকার দিয়া অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়া বলে, তোম এধার আও, তোমহারা দোকান মে রেডিও বাজতা হায়, শাল্যে, তুমকো খতম কারদে গা, তুম রেডিও নিকালো।’ সেনাদের কথায় আমার তো জানে পানি নাই। ভেবেছিলাম, মাইরে ফেলবি। আমি কলেম, ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে, শুনালকে লেকে চলে যাতা হে।’
কাশেমের কথায় তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হাতের রোলার আর রাইফেলের বাঁট দিয়ে তারা কাশেমের ডান পায়ে আঘাত করতে থাকে। যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করে ওঠেন। সেই থেকে আজও তিনি ডান পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার মো. আবদুর রাজ্জাকের মতে, মোল্লা একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল রেডিও আর নানা সংবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন অন্য রকম এই মুক্তিযোদ্ধা। দিন কাটছে অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। টাকার অভাবে পায়ের চিকিৎসাও থেমে গেছে। বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস এলেই উপজেলায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে ঘটা করে। কিন্তু একজন কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখে না কেউ।
প্রথমআলো ২ জানুয়ারি ২০১২

নিজের আগুনে জ্বলতে শিখেছে মন্দাক্রান্তা- সুমি খান

০১
নীল যমুনার
জলের ঢেউয়ে
 দু'কূল এমন নিঃস্ব হলো!
০২
'ভালোবাসি' 'ভালোবাসি'
 যমুনার কূলে ভাঙ্গন -বানভাসি
 শুভংকরেরা জানে শুধু ভাসাতে দু'কূল
যাপিত সুখের কূল - শ্রমণে ব্যাকুল!!

০৩
  ভাসান দিতে যেতেই এমন
   করুণা হলো!!

০৪
 যে  কাঁদনে হিয়া আমারে কাঁদায়,
  সেই কাঁদনের জোয়ার ভাটা-
 তোমারে হাসায়-
যেদিন জেনেছি-
নষ্ট মেয়ের কাব্য সেদিন
নতুন করে রচনা করেছি-
ভাববাচ্যের ভাষায় আবার বলতে শিখেছি!!
০৫
মন্দাক্রান্তা দীপাবলী রাতে -
প্রদীপ ভাসায় সজল ছায়ায়-
অবদমনের অতৃপ্ততায়
তাড়িয়ে বেড়ায়-বিষন্নতায়!!

০৬
নিজের আগুনে জ্বলতে শিখেছে মন্দাক্রান্তা-
তপ্ত দুপুরে নিরুত্তাপে
তাপহীন সুখ অন্ধ জঠরে
কুরে কুরে খায় অষ্টপ্রহর-

০৭
সাগরের কূলে
 ফানুসের হাতে সঁপে দেয়া
 যতো আরব বাতাস!!
বসন্তের এই উতল  দুপুর
 ফাগুন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো
 ঝোড়োমেঘের মাতাল বাতাস এলোমেলো-
এলোমেলো-
(কবি কচি রেজার কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে)

Tuesday, February 11, 2014

খবরের কাগজে ধর্ষণের নির্মাণ - স্বাতী ভট্টাচার্য


আমহার্স্ট স্ট্রিটে রেপ যেন কোথায় হয়? খবর লিখতে লিখতে কম্পিউটারে চোখ রেখে ব্যস্ত গলায় এক সাংবাদিকের প্রশ্ন। শুনে চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাওয়ার দশা আশেপাশের সহকর্মীদের। এমন কোনও জায়গা আছে নাকি, অ্যাঁ? কলকাতার কোনও রাস্তায়? ক’সেকেন্ড পরে প্রায় একই সঙ্গে সবাই টের পেল, কথাটা ‘রেফ।’ তখন হাসির হুল্লোড়, ইস, কী বিচ্ছিরি ভুল। কিন্তু সবাই একসঙ্গে একই ভুল কথা শুনল কী করে? আরে, তাই তো শুনবে। আর কিছু শোনা যায় নাকি আজকাল? টিভি দেখো, কাগজ খোলো, রেপ ছাড়া যেন কিছু নেই। আত্মীয়-বন্ধুরা তেতো গলায় বলেন, “আর কি কিছু ঘটছে না দেশে?’ কারও গলায় ক্লান্তি, “সকালবেলা আর কাগজ খুলতে ইচ্ছে করে না।” এ দিকে কাগজের অফিসেও একই দশা। খবরের লিস্টি করার সময়ে একসঙ্গে কয়েক জন সাংবাদিক বলে ওঠেন, ‘আ-বার ধর্ষণ?’


এ খুব আশ্চর্য নয়। ধর্ষণের কদর্যতা, মেয়েটির আহত-সন্ত্রস্ত দশা, ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক নাটক, মনের উপর এগুলোর অভিঘাত কম নয়। ধারাবাহিক চাপ চলতে থাকলে মন পালাবার পথ খোঁজে। তাই হয়তো মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন সংবাদ-নির্মাতা, সংবাদ-পাঠক। ভাবছেন, আর কত উদ্বেগ দেখাব? কত ধিক্কার জানাব?


এই সংবাদ-ক্লান্তি সাংবাদিকদের কাছে একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। বলা চলে, উল্টো চ্যালেঞ্জ। বছর কুড়ি আগে মূলস্রোতের মিডিয়াতে মেয়েদের নির্যাতনকে ‘খবর’ করে তোলা-ই একটা লড়াই ছিল। আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ১৯৮০ সালে ভারতের মথুরা ধর্ষণকাণ্ডে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিবাদে যখন দিল্লি-বম্বে-কলকাতা তোলপাড়, তখনও গোটা বছরে দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলিতে এই নিয়ে সম্পাদকীয়ের সংখ্যা ছিল অকিঞ্চিৎকর। তখন প্রায়ই মেয়েদের উপর অত্যাচার নিয়ে লেখার দায়টা দিয়ে দেওয়া হত কোনও নারীবাদী অতিথি লেখককে। ভাবখানা ছিল, ‘কাগজে ওদের কথাও থাকুক।’ ধর্ষণ ছিল ‘সফট নিউজ,’ হাল্কা খবর, কাগজের গোড়ার পাতাগুলো থেকে একটু তফাতে, ‘মেয়েদের পাতা’ কিংবা সাপ্তাহিকীতে। আজ ধর্ষণের খবরের স্থান কোথায়, স্থান কতখানি, দিল্লি বা কামদুনির গণধর্ষণ কাণ্ডের পর তা স্পষ্ট।

এটা কী করে সম্ভব হল? মেয়ে সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে, সুপ্রিম কোর্ট নানা ভাল ভাল রায় দিয়েছে, এগুলো বাইরের কারণ। আসল কথা, ধর্ষণের খবরের নির্মাণ বদলানো গিয়েছে। সত্তর-আশির দশকের খবরের সঙ্গে আজকের খবর যদি তুলনা করা যায়, তা হলে দুটো তফাত স্পষ্ট হয়। এক, ধর্ষণকে ‘পারিবারিক কেলেঙ্কারি’ থেকে ‘প্রশাসনের সংকট’ করা গিয়েছে। ‘মেয়েদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়, তাই একটিও ধর্ষণ মানে সরকারের ব্যর্থতার জন্য সব মেয়ের সংকট,’ এ ভাবে খবর নির্মাণ হচ্ছে। তাই আজ প্রতিটি ধর্ষণই রাজনৈতিক ধর্ষণ। অভিযোগ হলেই ছুটে যাচ্ছেন নেতা, বিরোধী নেতা। বাম দলগুলো ব্রিগেডে যাওয়ার ডাক দিয়েছে, দাবির তালিকার শীর্ষে, “নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ...”। জ্যোতি বসু-অনিল বিশ্বাসের যুগে এটা ভাবা যেত?

আর দুই, ধর্ষণকে মেয়েদের ‘সম্মানহানি’ থেকে নিয়ে আসা গিয়েছে মেয়েদের ‘অধিকারভঙ্গে।’ ‘মেয়েটি যে-ই হোক, যেখানেই যাক, যেমন পোশাকই পরুক, তার শরীরের উপর অধিকার তারই,’ এ ভাবে খবর লেখা হয় এখন। আজ গ্রামের মেয়ে-বউরা পাড়ার মেয়ের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে মিছিল করেন, ধর্ষিতা কিশোরীকে স্কুলে ফেরাতে এগিয়ে আসেন শিক্ষকরা, কারণ এরা আর ধর্ষণকে মেয়েদের ‘লজ্জা’ বলে মানতে রাজি নন। বরং পাঠকরা উল্টো চাপ দেন মিডিয়াকে। সম্প্রতি হুগলির নালিকুলে একটি সভায় কলেজছাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছিল, কেন ধর্ষণের খবরের সঙ্গে লোগোতে দু-হাতে মুখ আড়াল করা মেয়ের ছবি ছাপেন? লজ্জার আছেটা কী?

অমনি এই পরিবর্তন হয়নি। দীর্ঘ দিন খবর ভাঙা-গড়ার কাজটা নীরবে করে গিয়েছেন অনেক রিপোর্টার, সাব-এডিটর। কখনও তর্ক জুড়ে, কখনও নিরুচ্চার বিশ্বাস থেকে ‘নতুন খবর’ তৈরি করেছেন। তাঁদের নিরন্তর নির্মাণের ফলেই ধর্ষণের প্রধান খবর হয়ে ওঠা আজ এত স্বাভাবিক। এত বাধাহীন।

অথচ এত জনের এত দিনের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বসেছে। ধর্ষণের খবর থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন পাঠক। কেন এমন হচ্ছে? সম্ভবত তার কারণ, ধর্ষণের খবরে একটা সাবেকিপনা রয়েই যাচ্ছে। একটা দ্বিমাত্রিক নির্মাণের বাইরে বেরোতে সাহস করছে না সাংবাদিকরা। তাঁদের খবরে ধর্ষণের এক দিকে অপরাধী, অন্য দিকে অপরাধের শিকার। একজনের তীব্র ইচ্ছা যৌনমিলনে, অন্যজন নিতান্ত অনিচ্ছুক। ধর্ষকের চরম শাস্তি ছাড়া কিছুই চাইবার নেই ধর্ষিতার। যেন ধর্ষণে কোনও জটিলতা নেই।

বসিরহাটের এক তরুণী দেখা করতে গিয়েছিল প্রেমিকের সঙ্গে। প্রেমিকের সঙ্গে নিভৃতে যাবার পরিকল্পনাই ছিল মনে হয়, কারণ তারা গিয়েছিল নদীর ধারে। কিন্তু তারপর প্রেমিকের বন্ধুরাও চড়াও হয়। পরদিন সকালে প্রেমিক ছেলেটি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আর একটি মেয়েকে বারাসতে পাওয়া গেল মাঠে, অচৈতন্য অবস্থায়। পার্টি করতে গিয়েছিল বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। খানাপিনার পর কী হয়েছিল, ঠিক মনে নেই তার। কিন্তু জিনসের প্যান্ট উল্টো পরা ছিল।

একটি ধর্ষিতা মেয়ের আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে গিয়ে ডাক্তার দেখেন, প্রায় সাত মাসের সন্তান তার গর্ভে। মেয়েটি জানায়, এ ক’মাস কথা বলেও বিয়ে পাকা হয়নি, তাই শেষমেশ ধর্ষণের অভিযোগ করেছে তার বাবা-মা।

ধর্ষণে অভিযুক্তকে বিয়ে করার দাবি নিয়ে আদালতে গিয়েছে মেয়েটি, এবং শেষ পর্যন্ত বিচারকের নির্দেশে বিয়ে হয়েছে জেলে বসে, এমন ঘটনার কথা বড় কম শোনা যায় না। মুর্শিদাবাদে তেমন এক মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, দুটি সন্তান হওয়ার পরেও যাকে শ্বশুরবাড়ি ঘরে নেয়নি। বিয়ে হতে পারে, পণ না দিয়ে ঢোকা যাবে না।


বাতিল খবর


সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের দ্বারা, সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় যারা ধর্ষিত হয়েছে, তাদের চাইতে এই মেয়েরা খুব কম বিপন্ন নয়। কিন্তু এদের ঘটনা সাদা-কালো নকশায় ধরা যায় না। অনেকে শুরু করেছে সম্মতি দিয়ে, কোনও এক সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে পরিস্থিতির উপর, সঙ্গীর উপর। কারও বা শুরু অসম্মতিতে, পরে সহমত তৈরি করে প্রতিকার পাওয়ার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি লাভপুরের গণনির্যাতনের ঘটনার পর এক আদিবাসী নেতা প্রশ্ন তুলেছিলেন, সালিশি কি কেবল আদিবাসীরাই করে? রাজনৈতিক দলগুলো করে না? প্রশ্নটায় দম আছে। মফস্সলের থানাগুলোতে বহু ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে কয়েক সপ্তাহ পার করে। কারণ, সালিশির চেষ্টা হয়েছে, ফয়সালা হয়নি। বর্ধমানের একটি ধর্ষণের সালিশির পর ক্ষতিপূরণের টাকা নেতারা আত্মসাৎ করলে অভিযোগ দায়ের করেন ধর্ষিতা মহিলার স্বামী। তত দিনে পেরিয়ে গিয়েছে এক মাস।

এক দিকে একান্ত অনিচ্ছায় মিলন, অন্য দিকে নিঃশর্ত শাস্তির দাবি, অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাতেই এই মডেল কাজ করে না। “ওঃ, ওদের তো সম্পর্ক ছিলই,” কিংবা, “এক মাস কী করছিল? তখনই বলেনি কেন?” এমনই আপত্তি থেকে সে খবরগুলো বাদ পড়ে যায়। বা দ্রুত চলে যায় আড়ালে। মানে, ধর্ষণের খবরে মানব-সম্পর্কের জটিলতার ঠাঁই নেই। সে সম্পর্ক হতে পারে নারীপুরুষের প্রেমের, কিংবা গৃহস্থ-প্রতিবেশী, কর্মী-নিয়োগকারী, সমর্থক-রাজনৈতিক দল, ছোট জনগোষ্ঠী-বৃহত্তর সমাজের। খবরে সেই সব প্রেক্ষিত মেলে না। অথচ ধর্ষণ কিন্তু এই সব সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যেই ঘটে। ধর্ষণের পরেও তার মধ্যে বাস করে দু’পক্ষই। অচেনা জায়গায়, অপরিচিত লোকের দ্বারা অত্যাচারের চাইতে তা কম ভয়ানক নয়। নন্দীগ্রামের গুলিচালনার পর পুরুষহীন গ্রামে টানা দু’দিন অত্যাচার হয়েছিল মেয়েদের উপর। পরে মেয়েরা আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন, ওই তো ওই বাড়ির লোক করেছে। ভোটের সংঘর্ষে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু গ্রামে গণনির্যাতন ঘটে। কিছু দিন পর আবার পাশাপাশি বাস করছেন পাড়াতুতো ভাইপোর সঙ্গে তার দ্বারা ধর্ষিতা কাকিমা। এ দলের মামার সঙ্গে ও দলের ভাগ্নী। কেমন সেই জীবন? কী ভাবে বেঁচে রয়েছেন তাঁরা?


মিডিয়া সে খবর নির্মাণ করতে শেখেনি আজও। সাংবাদিক জানে, মেয়েদের অসম্মতির অধিকার ভঙ্গ হলে খবর। কিন্তু মেয়েদের সম্মতির অধিকার? বিয়ের বাইরে মেয়েদের যৌনসম্পর্কে সম্মতির অধিকার আছে কি না, সে বিষয়ে সমাজ-সংবাদ এখনও ঝেড়ে কাশতে রাজি নয়। বাঘা নেত্রীরাও প্রশ্নটা এড়িয়ে যান। প্রেম, প্রতিশ্রুতি, আকর্ষণ, প্রতিহিংসা, হতাশা, লোলুপতার গল্পকে জায়গা দিলে মেয়েটির ‘অধিকারভঙ্গের’ নির্মাণ টিকবে কি না, প্রশাসনকে কী করে দায়ী করা যাবে, সেই উদ্বেগ থাকে সাংবাদিকের। অথচ খবরের নির্মাণে এগুলোকে আনতে না পারলে অধিকাংশ মানুষের খবর লেখা যায় না। যা এখনই অনেক ঘটছে, আরও বাড়বে, তা হল ‘date rape’। স্বেচ্ছায় একসঙ্গে বেরিয়ে, পরে মেয়েটির উপর নির্যাতন। মেয়েদের সম্মতির অধিকার স্বীকার না করে নিলে ওই কিশোরী-তরুণীরা গোড়াতেই বাদ পড়ে যাবে ধর্ষণের বাজার-চলতি সংজ্ঞা থেকে। ‘মেয়েগুলোরও দোষ আছে,’ গোছের ছেঁদো যুক্তিতে বাতিল হয়ে যাবে বহু খবর।

মেয়েদের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি বজায় রেখে ধর্ষণের খবরে সম্মতি, সহমতের প্রসঙ্গ কী করে আনা যাবে, আজ সাংবাদিকদের সেটাই চ্যালেঞ্জ। এখনও অবধি খবরের নির্মাণের কাঠামো নারীবাদী আন্দোলনের। সেই যুক্তি বলে, ধর্ষণ মূলত পুরুষের যৌনতার প্রকাশ নয়, ক্ষমতার প্রকাশ। সে কথা একশো বার সত্য। কিন্তু সেখানেই তো থেমে যাওয়া চলে না। সব মানুষের মধ্যেই কঙ্কাল থাকে, তা বলে কঙ্কালটাই মানুষ নয়। প্রায় যে কোনও নির্যাতনই ক্ষমতার অসাম্যের ফল। সেটা গোড়ার কথা। শেষ কথা নয়, কথার সবটাও নয়। ধর্ষণের খবর লিখতে হলে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে লেখার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা, দুটোই থাকতে হবে। আজ তা নেই বলেই সমাজ-সংসারে সম্পর্কের বিচিত্র সংকটকে ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছে না ধর্ষণের খবরে। কী ঘটছে, কেন ঘটছে, তার কোনও ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না সে সব খবর থেকে। ফলে, নিষ্প্রাণ, পলিটিক্যালি কারেক্ট খবর থেকে মুখ ফেরাচ্ছে কাগজের পাঠক।