Tuesday, October 28, 2014

যৌন নিগ্রহের শিকার ২৬ রেহানেহ জাব্বেরিকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাল ইরান সরকার



 ইরানের গোয়েন্দা দফতরের এজেন্ট মোর্তেজা আবদোলালি সরবন্দি ২০০৭-এ নিজের দফতরে ডেকে রেহানেহ জাব্বেরিকে ধর্ষণ করে । আত্মরক্ষায় রেহানেহ কাগজ কাটার ছুরি দিয়ে মোর্তেজাকে আঘাত করেন। ঘটনাস্থলে মারা যায় মোর্তেজা। 
আন্তর্জাতিক আবেদনে কর্ণপাত না করে যৌন নিগ্রহের শিকার ২৬ বছরের যুবতী রেহানেহ জাব্বেরিকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাল ইরান সরকার।
 আত্মরক্ষার দাবি উড়িয়ে  খুনের অভিযোগে রেহানেহকে  গ্রেফতার করা হয়। ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করে তেহরানের ফৌজদারি আদালত জানায়, ‘ঠান্ডা মাথায়’ মোর্তেজাকে খুন করার ফন্দি এঁটেছিলেন রেহানেহ।
২০০৯ সালে রেহানেহের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরব হয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। আত্মরক্ষা আর খুনের বিভেদ করতে ইরানের আদালতের অক্ষমতা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদও শুরু হয়। তদন্তে অস্বচ্ছতা এবং সাক্ষ্য প্রমাণের প্রতি আদালতের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে। ফেসবুক, টুইটারে রেহানেহের সমর্থনে শুরু হয় প্রচার। তা সত্ত্বেও ইরানের আদালতে বার বার খারিজ হয়ে যায় মানবাধিকার সংগঠনগুলির দায়ের করা রেহানেহের প্রাণভিক্ষার আবেদন। জেলে থাকাকালীন রেহানেহের উপর অত্যাচার এবং তাঁকে জোর করে খুনের দায় স্বীকার করতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ। রেহানেহের পাশে দাঁড়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার শাখা। গত এপ্রিলে ইরানের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার রক্ষা পর্ষদের প্রধান আহমেদ শাহিদ নতুন করে তদন্তের দাবি করেছিলেন। 
তবে ২০০৯ থেকে রেহানেহর ফাঁসির তারিখ ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়ায় আশার আলো দেখেছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলি। শেষরক্ষা হয়নি। শুক্রবার রেহানেহের মা সোলে পাকরাভনকে ফোন করে শেষ বারের মতো জেলবন্দি মেয়েকে দেখে যাওয়ার আর্জি জানানো হয়। শনিবার ভোরে রেহানেহকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
 রেহানেহকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর এই ঘটনায় সুর চড়িয়েছে ব্রিটেনের একটি মানবাধিকার সংগঠন। রেহানেহের গ্রেফতারির পর থেকেই ওই সংস্থা তাঁর পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত ওই সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর হাসিবা সাহারাওইর প্রশ্ন, “যে ঘটনার তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে, সেই অভিযুক্তকে কী ভাবে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হল?’’ ইরান সরকারকে তাঁর পরামর্শ, “এ ভাবে মানুষকে ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে বরং দেশের আইন বদলাক সরকার। খেয়াল রাখুক যাতে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক নিয়মগুলো একটু হলেও রক্ষা করা যায়।” রেহানহর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছে মার্কিন প্রশাসনও।   
গত সাত বছর ধরে সরকার আর আদালতের কাছে মেয়ের প্রাণভিক্ষা করে এসেছেন সোলে। মেয়ে যে আর কোনও দিন বাড়ি ফিরবে না, তা এখনও মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, “এর চেয়ে বরং গলায় দড়ি পরিয়ে আমাকে মেরে ফেলতো। মেয়েটাকে বাড়ি ফিরতে দিত!” কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “রেহানেহকে বাড়ি ফিরিয়ে দাও। আমার আর কিচ্ছু চাই না।”

Monday, October 27, 2014

সমাজ ও নারী ধর্ম ভিন্ন, উদ্দেশ্য অভিন্ন-উম্মে মুসলিমা

লন্ডন টাইমস-এর ইহুদি সম্পাদক ডানিয়েল ফিঙ্কেলেস্টাইন বলেছেন, ‘ইসরায়েল লবি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সুতরাং ইহুদিরাই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে।’ এমন যে ইহুদি জাতি যারা শিক্ষায়, সম্পদে, জ্ঞানে, ধূর্ততায় বিশ্বসেরা, তাদের মধ্যেও গোঁড়ামি রয়েছে। বলা হয় যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত গোঁড়ামিমুক্ত বা আলোকিত। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত নোবেল বিজয়ীদের শতকরা ২২ ভাগই ইহুদি। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি নৃশংস হতে তারা কসুর করে না। সবাই নয়, সব ধর্মের কট্টরেরাই নিষ্ঠুর। আর এ নিষ্ঠুরতার শিকার ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে বেশির ভাগই নারী। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্য গর্ভবতী নারী। কারণ, ইসরায়েলের বিশ্বাস, এসব নারী আরও সন্ত্রাসী জন্ম দিতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মৌলবাদী ইহুদি পুরুষেরা তাঁদের স্ত্রীর গর্ভে যত বেশি সন্তান নেওয়া যায় নিতে থাকেন। তাঁদের ধারণা, ইহুদিদের জনবল বাড়লে তারা পৃথিবী শাসনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারবে। তাই নারীরা যে শুধু যুদ্ধেরই বলি হচ্ছেন, তা-ই নয়, আপন ধর্মের বাতাবরণেও তাঁরা নিষ্পেষিত।

কট্টর ইহুদিদের দেখে এলাম কাছ থেকে। পুরুষদের কানের দুই পাশে কাঁধ অবধি ঝোলানো পেঁচিয়ে রাখা জন্মচুল। জন্মের পর থেকে কলিটুকু রেখে রেখে বড় করা হয়। বেশির ভাগের মাথায় হ্যাট, কালো পোশাক। স্বসম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। এমনভাবে পথ চলে, যেন তারা সব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রজেশ্বর। যেন নোংরা পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের। তাদের পরিচালিত দোকানে পণ্য কিনে টাকা বাড়িয়ে দিলে তারা হাতে নেয় না, টেবিলের ওপর রাখতে বলে। যদি হাতে অস্পৃশ্য ছোঁয়া লেগে যায়? সে দেশে পরিচিত-অপরিচিত বলে কথা নেই, চোখে চোখ পড়লেই সবাই মুচকি হেসে দেয়। কেউ হাসির জবাব হাসিতে না দিলে মনে মনে অভদ্র ভাবে। কট্টর ইহুদিদের নারী-পুরুষ কেউ এ আচরণ করেন না। তাদের নারীদের অবস্থা দেখে গোঁড়া মুসলিম নারীদের জন্য বেদনা কিছুটা লাঘব হলো। আমাদের নারীদের মাথা ঢাকতে বলা হয়, যাতে চুল না দেখা যায়। কিন্তু তাদের নারীদের বিয়ের দিন পুরো মাথা ন্যাড়া করে ফেলতে হয়। বিবাহিত জীবনে ঘনকৃষ্ণ কেশদামের আর স্ফুরণ ঘটতে দেওয়া হয় না। চুল দেখানো মানে নারীর অবমাননা। তবে কি তাঁরা নেড়াবেল হয়েই বাইরে যান? না। সামনাসামনি দেখলে জানা না থাকলে কেউ টের পাবেন না যে তাঁরা উইগ পরে আছেন। খোলা চুলের মাঝে নারীর মুখ আকর্ষণীয় দেখায় আর তাতে পুরুষ প্রলুব্ধ হন। ওটা করা যাবে না। কিন্তু উইগকে চুল বলেই বিভ্রম হয়। তাতে তাঁদের মুখ কম আকর্ষণীয় লাগে না। কিন্তু আসল চুল যে বের করে রাখেননি, তাতেই সান্ত্বনা খুঁজে নিচ্ছেন তাঁরা।


ছোটবেলায় আমার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়ি যেতাম। তাদের দেয়ালে টাঙানো নিনচোর গোপালের ছবিসংবলিত ক্যালেন্ডারের পাশে ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা নরকের ছবি, যেখানে একজন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য ছিল। তাঁর চুলগুলো বাঁকানো সাপ হয়ে কপালে-মুখে-বুকে ছড়িয়ে আছে। মাসিমা মানে আমার বন্ধুর মা বলতেন, ‘পৃথিবীতে যে মেয়ে মাথায় ঘোমটা না দিয়ে চলবে, নরকে গিয়ে তার চুল সাপ হয়ে তাকে কামড়াবে।’ কিন্তু পুড়িয়ে মারা হচ্ছে কেন? কারণ সে ছিল পাপী। রোমান ক্যাথলিক নারীরাও মাথা ঢেকে রাখেন। নানদের তো চুলের কণাটিও দেখা যায় না। মুসলিম দেশগুলোয় বিশেষ করে আরব দেশে হিজাব বাধ্যতামূলক। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও নারীরা মাথা ঢেকে রাখছেন। এমনকি স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য মুসলমান অভিবাসী নারীরা যে দেশেই বসবাস করছেন, সেখানেও শিরবস্ত্র ব্যবহার করছেন। আফগানিস্তানে তালেবানরা বলেই দিয়েছে যে নারীর ভোটাধিকার ধর্মসম্মত নয়, নারীর শিক্ষার প্রয়োজন নেই, নারী গাড়ি চালাতে পারবেন না, নারী আপাদমস্তক আবরিত হয়ে থাকবেন। নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন ‘বোকো হারাম’ নারীদের ইংরেজি শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মেয়েদের স্কুল থেকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রেখেছে। মুসলিম-খ্রিষ্টান-ইহুদি-বৌদ্ধনির্বিশেষে তাদের সবার মাথা ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
ধর্মের আলোচনার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু নারী, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন। যেন নারীকে দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই সব ধর্মের সৃষ্টি। অথচ ধর্ম পৃথিবীতে এসেছে আপামর মানুষের শান্তির জন্য। অথচ এ কথা কে না বোঝে যে ধর্ম এখনো গণতন্ত্রের হাতিয়ার। ভারতের মতো বিশাল গণতান্ত্রিক দেশে বিজেপির মতো কট্টর দল জয়ী হয়, ধর্মের কথা শুনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা আবার আসি আসি করছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বা দেশের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য যেসব নেতা-নেত্রী দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ধর্মের জিগির তোলেন। সারা বিশ্বে এ প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রাচীনকালে ধর্মীয় নেতারা দেশ চালাতেন। এখন দেশনেতারা সবাই ধর্মান্ধ। মাঝে উত্তরাধিকার বা গোলমালে অনেক দেশে নারীপ্রধান সরকার এসে গেলেও অদূর ভবিষ্যতে এ সংখ্যা কমবে বৈ বাড়বে না। নারীর বাড়বাড়ন্ত মেনে নিতে মোল্লাতন্ত্র অপারগ। ওদিকে যে হারে মোল্লাতন্ত্রের ইচ্ছা প্রতিফলনে নারীরা মরিয়া হয়ে উঠছেন, তাতে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে আর বাকি নেই। এসব নারী বুঝতে পারছেন না তাঁদের পুরুষতন্ত্র পাকাপোক্ত করার কাজে ব্যবহার করে তাঁদের অভাবনীয় শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়াই পুরুষকুলের উদ্দেশ্য।


সব ধর্মের কট্টরেরা নিজেদের ধর্মকেই সেরা ধর্ম ভাবে। আর এই সেরা ভাবনাটাই সবচেয়ে ভয়াবহ। তাদের কাছে অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষই অস্পৃশ্য। তাই ভূখণ্ডের দখল নিয়ে বাহ্যত দুই বা একাধিক দেশ/জাতি/গোষ্ঠীর মধ্যকার যে যুদ্ধ, তা মূলত দুটি ধর্মের/গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার যুদ্ধ, যেখানে ‘আমিই সেরা’—এ বোধটা আমৃত্যু একজন কট্টর যোদ্ধার অবলম্বন। আর যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন পুরুষ, নারীদের তাঁর অধীনে থাকতে হয়। না হলে নেতৃত্বদানের অপরাধে হয় নারীকে ডাইনি বা জোয়ান অব আর্কের মতো পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ই যদি হয় আশরাফুল মাখলুকাত, তাহলে একে অন্যের ওপর নেতাগিরি করাও তো ধর্মের বরখেলাপ, নাকি?


তাই দেখা যাচ্ছে, ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন হলেও এক জায়গায় সব ধর্মের গোঁড়ারা একমত, তা হচ্ছে নারীর প্রতি বিধিনিষেধ আরোপ। ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন হলেও সব ধর্মের অন্যতম লক্ষ্য যদি হয় এক, তাহলে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নারীর যুদ্ধও হোক অভিন্ন।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

একটি সংবাদপত্র, দুই সাংবাদিক এবং একজন সম্পাদক -মহিউদ্দিন আহমদ

অক্টোবর ২৭, ২০১৪
Mohiuddin Ahmed সংবাদপত্রটির নাম ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, সাংবাদিক দু’জনের নাম বব উডওয়ার্ড (Bob Woodward) এবং কার্ল বার্নস্টাইন (Carl Bernstein), আর সম্পাদকের নাম বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি (Benjamin C. Bradlee)। গত ২১ অক্টোবর তিরানব্বই বছর বয়সে বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর বাড়িতে মারা গিয়েছেন। আর তাঁর মৃত্যুর খবর দুনিয়ার সব দেশের গণমাধ্যমে, টিভি, রেডিও, পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গেই প্রচার পেয়েছে। সে সঙ্গে প্রচার পেয়েছে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকাটি এবং এই পত্রিকাটির তখনকার দুই তরুণ সাংবাদিক, বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইনের নামও। বস্তুত এই দুই সাংবাদিকের নামের দুটো আলাদা অংশ জোড়া দিয়ে দু’জন ‘উডস্টাইন’ নামেও সারা দুনিয়াতে তখন পরিচিত হয়ে উঠেন।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এমন দুনিয়াজোড়া নামডাকের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পতন ঘটিয়েছিল এই সংবাদপত্রটি। পত্রিকাটির এই দুই সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটির পর একটি ঘটনা ‘এক্সপোজ’, উন্মোচন করতে থাকেন। দুনিয়ার সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তির ক্ষমতার এমন অপব্যবহার তখন, ১৯৭৩-৭৪ সালে সারা দুনিয়াতেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর সেই দুই দুর্ধর্ষ তরুণ সাংবাদিক, কার্ল ও বব তাদের অফিসে, সেই সময়কার ছবি
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর সেই দুই দুর্ধর্ষ তরুণ সাংবাদিক, কার্ল ও বব তাদের অফিসে, সেই সময়কার ছবি
তার আগে, ১৯৭১এ ‘পেন্টাগন পেপার্স’ যৌথভাবে প্রকাশ করেও ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ নিক্সন প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ‘ডেনিয়েল এলসবার্গ’ নামের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর অনেকগুলো গোপন দলিল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে দিয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যেমন ছলচাতুরি চালিয়ে আসছিল, তার বর্ণনা ছিল এই ‘পেন্টাগন পেপার্স’এ। কিন্তু অনেক বেশি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছিল নিক্সন প্রশাসনের ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’।
‘ওয়ারটারগেট’ হচ্ছে ওয়াশিংটন শহরের একটি হোটেল। ১৯৬৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন নিয়ে রিচার্ড নিক্সন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিউবার্ট হামফ্রের বিপরীতে লড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৭২এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবালিকান পার্টি থেকে আবারও প্রার্থী হন তিনি। তাঁর বিপরীতে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে এইবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জর্জ ম্যাক্গভার্ন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে অফিস খোলা হয়েছিল ‘ওয়াটারগেট’ হোটেলে। এই হোটেলে ডেমোক্রেটিক পার্টি কী ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে, তা বের করে আনার জন্য কিছু সিঁধেল চোর ১৯৭২এর ১৭ জুন ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে ডেমোক্রেটিক পার্টির হেডকোয়ার্টারে ঢুকে পড়লে, হোটেলের সিকিউরিটি গার্ড ‘ফ্রাঙ্ক উইলস’এর হাতে ধরা পড়ে।
নিক্সন প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’র উ্ন্মোচন
নিক্সন প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’র উ্ন্মোচন
এই অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর যতসব ঘটনা উন্মোচিত হতে থাকে, তাতে এক পর্যায়ে দেখা গেল এমন অবৈধ কাজে প্রেসিডেন্ট নিক্সনেরও সম্মতি ছিল। আর তাতেই ক্ষোভে, আক্রোশে ফেটে পড়ল সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশটির লোকজন প্রশ্ন করতে থাকল, তাদের প্রেসিডেন্ট কী করে এমন একটি অবৈধ কাজ করতে পারেন? ধরা পড়ার পর নিক্সনের লোকজন বাঁচার জন্য একটির পর একটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকল; আর তাতে অপরাধের সংখ্যা এবং ‘সিরিয়াসনেস’ও আরও বাড়তে লাগল।
২.
প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২এর ৩ নভেম্বর নির্বাচনে প্রত্যাশিতভাবে আবারও জিতলেন ঠিকই; প্রথাগত শপথও নিলেন তিনি ১৯৭৩এর ২০ জানুয়ারি। ১৯৭২এ চীন সফরে গিয়ে সারা দুনিয়াকে চমকেও দিলেন। তাঁর প্রশাসনের বৈদেশিক নীতিতে আরও বেশ কতগুলো বড় বড় সাফল্যও ছিল। তাঁর আমলেই ১৯৬৯এর জুলাইতে চাঁদে দুই আমেরিকান অবতরণ করলেন। আবার তাঁর আমলেই ১৯৭৩এর অক্টোবরে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়, শেষও হয়।
কিন্তু দিন যতই যেতে থাকল, ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ রিচার্ড নিক্সনকে গ্রাস করল। ১৯৭৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে অভিশংসন বিল তোলা হল। ১৯৭৪এর জুলাই-আগস্টের দিকে যখন বুঝতে পারলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিশংসন মার্কিন কংগ্রেসে গৃহীত হতে যাচ্ছে, তখন চরম অবমাননা এড়াতে তিনি ১৯৭৪এর ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে পরদিন থেকে কার্যকর তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন।
রিচার্ড নিক্সন ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইসেন হাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ১৯৬০এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জন এফ কেনেডির কাছে পরাজিত হন। পরে কালিফোর্নিয়ার গভর্নর পদেও কালিফোর্নিয়ার বর্তমান গর্ভনর জেরি ব্রাউনের বাবা প্যাট ব্রাউনের কাছে পরাজিত হন। পরপর দুইবার পরাজিত হওয়ার পর মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছিল, রিচার্ড নিক্সনের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে।
কিন্তু সকল জ্যোতিষী এবং হস্তরেখা বিশারদকে ভুল প্রমাণ করে ১৯৬৮তে তাঁর দীর্ঘ প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট পদে জিতে আসেন নিক্সন। জিতে আসেন আবার ১৯৭২এ-ও। কিন্তু ধরে রাখতে পারেননি এই বিজয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-বিদ্বেষী এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই লোক এবং তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সরাসরি এবং খোলামেলাভাবেই আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন; খোলামেলাভাবেই পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ‘বাঙালির গণহত্যা’ সমর্থন করে গিয়েছিলেন।
৩.
এহেন নিক্সনকে হোয়াইট হাউজ থেকে তাড়ালেন ‘উডস্টাইন’ টিম। আর তাদের প্রবলভাবেই সমর্থন দিয়ে গেলেন পুরো দুটো বছর তাদের সম্পাদক বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলিকেও সমর্থন দিতে থাকলেন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর মালিক মিসেস ক্যাথরিন গ্রাহাম। মিসেস ক্যাথরিন গ্রাহামের স্বামী ফিল গ্রাহাম বেঞ্জামিন ব্র্যাডলিকে নির্বাহী সম্পাদক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। তবে ব্র্যাডলি এই পত্রিকায় আরও আগে থেকেই সাংবাদিকতা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে অবসর নেন ১৯৯২ সালে।
‘লিজেন্ডারি এডিটর’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া বেন ব্র্যাডলি দুই তরুণ সাংবাদিককে সব সমর্থন দিয়েছিলেন
‘লিজেন্ডারি এডিটর’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া বেন ব্র্যাডলি দুই তরুণ সাংবাদিককে সব সমর্থন দিয়েছিলেন
ব্র্যাডলি সম্পাদক থাকাকালে ১৯৮১তে তাঁর এই বিশ্ববিখ্যাত এবং বিশ্বনন্দিত পত্রিকা অন্য এক রিপোর্টারের কারণে সারা দুনিয়াতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র ভাষায় নিন্দিতও হয়েছিল। জ্যানেট কুক নামের এক আফ্রিকান আমেরিকান তরুণী রিপোর্টার ওয়াশিংটনের ‘জিমি’ নামের এক শিশুর মাদকাশক্তির উপর এক রিপোর্ট লিখে ‘পুলিৎজার’ পুরস্কার জিতে নেয়। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রের লোকজন শিশুটির চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি খুঁজেও এই শিশুকে পায় না।
তখন সন্দেহ জাগে, জ্যানেট কুক হয়তো পুরো ‘জিমিস ওয়ার্ল্ড’ স্টোরিটা ঘরে বসে, বানিয়ে বানিয়েই লিখেছে। কঠোর কঠোর সব প্রশ্নের মুখে জ্যানেট কুক তার অপরাধ স্বীকার করে। তারপর তাকে বরখাস্ত করা হয়। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি ফিরিয়ে দেন পুলিৎজার প্রাইজটি, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন ওয়াশিংটনের মেয়রের কাছে, ওয়াশিংটন সিটি কর্পোরেশনের লোকজনকে এমনভাবে হয়রানি হেনস্তা করার কারণে।
তারপরও বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির মৃত্যুর পর তাঁকে ‘লিজেন্ডারি এডিটর’ হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দুনিয়ার অনেকেই। শোক বার্তা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। গত বছর এই লিজেন্ডারি এডিটরকে হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’এ ভূষিত করেন ওবামা।
‘লিজেন্ডারি এডিটর’ বেন ব্র্যাডলি সাবেক ও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টদের (ক্লিনটন ও ওবামা) সঙ্গে, হোয়াইট হাউজে
‘লিজেন্ডারি এডিটর’ বেন ব্র্যাডলি সাবেক ও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টদের (ক্লিনটন ও ওবামা) সঙ্গে, হোয়াইট হাউজে
৪.
একজন নির্ভীক সম্পাদক এবং তাঁর দুই তরুণ সাংবাদিক সততা, দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে পতন ঘটিয়েছিলেন রিচার্ড নিক্সনের। অনেক হুমকি ভয়ভীতি ছিল তাঁদের প্রতি। কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করেননি তাঁরা। প্রফেশনের সর্বোচ্চ নীতিমালা অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সারা দুনিয়াতে সাংবাদিকদের ‘রোল মডেল’ হিসেবে নন্দিতও হয়েছেন।
বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইন যৌথভাবে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’ শিরোনামের বইতে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনাসমূহ এবং এই প্রসঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। পরে এই বইটির উপর ১৯৭৬এ নির্মিত হয় ১৩৮ মিনিটের আর এক বিশ্বনন্দিত ছবি, ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’। তাতে বব উডওয়ার্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রবার্ট রেডফোর্ড, কার্ল বার্নস্টাইনের ভূমিকায় ডাস্টিন হফম্যান; আর বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির ভূমিকায় জ্যাসন রবার্ডস।
‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান’ ছবিতে ডাস্টিন হফম্যান (কার্ল) ও রবার্ট রেডফোর্ড (বব)
‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান’ ছবিতে ডাস্টিন হফম্যান (কার্ল) ও রবার্ট রেডফোর্ড (বব)
এই ছবিটি সেই বছরের বেশ কতগুলো অস্কার পুরস্কারও জিতে নেয়। তার মধ্যে একটি ছিল ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর’এর। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির ভূমিকায় অভিনয় করে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন জ্যাসন রবার্ডস। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আরও অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয় ছবিটি। আমেরিকার ১০০টি শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায় এই ছবিটি আছে ৭৭ নম্বরে।
ছবিটিতে দেখা যায়, এই দুই তরুণ সাংবাদিক, ছোট একটি তথ্যের জন্য কতসব জায়গায় যাচ্ছেন, কত সব মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, কত কত ঘণ্টা ব্যয় করছেন।
বয়স তখন তাঁদের ত্রিশের নিচে। জীবিত অবস্থায়, তা-ও যখন তারা একেবারেই তরুণ, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এ তাঁদের দুনিয়াকাঁপানো সাংবাদিকতা নিয়ে নির্মিত ওই ছবিটি তাঁদের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি-সম্মান এনে দেয়। সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ সাংবাদিকের কাছে তাঁরা অনুসরণীয় মডেল হয়ে উঠেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বব উ্ডওয়ার্ড এখন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর এসোসিয়েট এডিটর; তবে কার্ল বার্নস্টাইন কয়েক বছর পর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর চাকরি ছেড়ে দেন। দুজনের বয়সই এখন সত্তরের কোঠায়।
সেদিনের সেই দুই তরুণ সাংবাদিক এখন প্রবীণ, বাঁয়ে কার্ল, ডানে বব
সেদিনের সেই দুই তরুণ সাংবাদিক এখন প্রবীণ, বাঁয়ে কার্ল, ডানে বব
বাংলাদেশে আমরা যখন এতসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি, আমি আশা করি না আমাদের কোনো সম্পাদক বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির মতো সাহস দেখাবেন বা ‘উডস্টাইন’ টিমের দুই সদস্যের মতো পরিশ্রমী এবং দায়িত্ব পালনে সচেতন থাকবেন। কিন্তু আমার ছোট প্রশ্নটি– আমাদের কয়জন সাংবাদিক বা সম্পাদক এদের উপর নির্মিত এই ছবিটি দেখেছেন?
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সরকার এবং বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা আদায়ে বিকল্প কোনো কার্যকর ব্যবস্থার অবর্তমানে, আমাদের গণমাধ্যমই এখনও আমাদের দেশের উপেক্ষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষজনের শেষ ভরসা। উদাহরণ দিচ্ছি, একজন দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালিয়ে কোনোভাবে জীবনধারণ করে চলেছেন। এই খবরটি আমি দেখি পত্রিকার পাতায় বা টিভির খবরে। কিন্তু যে মুক্তিযোদ্ধা রিকশাচালক এমন এক জীবন-মরণ সংগ্রামে কোনোভাবে বেঁচে আছেন, ঐ এলাকায় তাঁর তো আছেন একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য– শহর হলে ওয়ার্ড কমিশনার; তাঁর আছেন একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান– শহর হলে মেয়র; তারপর তাঁর আছেন একজন সংসদ সদস্য।
কিন্তু আজ এত বছরের গণতন্ত্রেও কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির এমন কোনো দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা রিকশাচালক বা যৌতুকের জন্য নির্যাতিতা মহিলার পক্ষে এতটুকু ভূমিকা পালনের খবর কোথাও পড়িনি, টিভিতে দেখিনি বা কারও কাছে শুনিওনি। খাসজমি, নদী-নালা, বনবাদাড় দখলদার আমাদের এইসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলীয় ক্যাডার, শালা-শালি-সম্বন্ধী, আত্মীয়-স্বজন তোষণে এবং অবৈধ ব্যবসায়-বাণিজ্যের তরক্কীতে বেশি আগ্রহী এবং ব্যস্ত থাকেন।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার অফিস
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার অফিস
ধর্ষিতা কোনো শিশু, কিশোরী বা নারীর পক্ষ নিয়ে সামান্য কিছু করতেও তো এদের দেখা যায় না। কোনো লঞ্চ বা স্টিমারডুবির পর ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া মৃতদের বিপন্ন আত্মীয়স্বজন, মা, বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী– এদের জন্য শুধু খাবার পানি সরবরাহ করতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা স্বেচ্ছাসেবক দলের কারও কোনো ভূমিকা তো আমি এই এত বছরে একবারও দেখ্লাম না।
কিন্তু এই ভূমিকাটা কাউকে না কাউকে তো পালন করতে হবে। এখানে, এই ‘ভ্যাকুয়ামে’ সাংবাদিকদের প্রবল উপস্থিতি এখনও মানুষজনকে কিছুটা হলেও ‘রিলিফ’ দেয়। আমাদের দেশের মানুষ বিপদে পড়লে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নয়, খোঁজে একজন সাংবাদিককে। তারা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে, বিক্ষোভ দেখায়, ভিতরে প্রেস কনফারেন্স করে, পত্রিকা অফিসে যায় তাদের দুঃখ-কষ্ট বর্ণনা, অত্যাচার-নির্যাতনের কথা জানাতে। আমাদের দেশের এমনসব মানুষ বিশ্বাস করে, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে অন্তত কিছুটা ‘রিলিফ’ পাওয়া যাবে। সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও তখন জনমতের চাপে পড়েন।
এই যে ঝালকাঠির লিমন নামের ছেলেটিকে ‘র‌্যাব’ গুলি করে পঙ্গু করে দিল, তা তো আমরা জানলাম পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওতে। তাকে যে মিথ্যা মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল, তা-ও তো পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওতে অব্যাহত অভিযানের কারণে। কিন্তু লিমন এবং তার মা’র এলাকায় তো একজন সংসদ সদস্যসহ অন্তত পাঁচ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। লিমনের জন্য তার এলাকার সংসদ সদস্য কি আদৌ কিছু করেছেন? তার নাম কি আমরা জানি? সেদিন নাটোরের বড়াইবাড়িতে যে ৩৬ জন নিরীহ মানুষ দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হল, ওখানকার সংসদ সদস্যের নাম কী? তিনি কি নিহত-আহত বাসযাত্রীদের জন্য কিছু করেছেন? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তার কি কোনো ভূমিকা আশা করা যায়?
এখানেই সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকদের কাছে আমার একটি নতুন প্রস্তাব। যখনই এমন স্টিমার-লঞ্চ, ট্রেন, বাসের দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটনাস্থলের এমপি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, স্থানীয় রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতা-উপনেতাদেরও আহত-নিহতদের জন্য তাদের কে কী করেছেন জিজ্ঞাসা করতে আপনাদের রিপোর্টারদের নির্দেশ দিন। আমাদের সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক এবং সম্পাদকরাই এইসব নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের দলের নেতা, উপনেতাদের জবাবদিহিতা আদায় করতে পারেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে খবরে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের বক্তব্য, মন্তব্য থাকে। কিন্তু থাকে না কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির।
ওয়াশিংটনের সেই বিখ্যাত ‘ওয়াটারগেট’ হোটেলের সম্মুখভাগ
ওয়াশিংটনের সেই বিখ্যাত ‘ওয়াটারগেট’ হোটেলের সম্মুখভাগ
বড়াইগ্রামে এতবড় একটি দুর্ঘটনা ঘটল, অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের ‘সর্দার’ নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের কোনো মন্তব্য কোনো পত্রিকায় বা টিভিতে দেখ্লাম না। অথচ ‘খানসেনা’দের এই ‘সর্দার’এর হুমকি, ধামকি, সন্ত্রাসের কারণে ‘খানসেনা’দের কোনো রকমের নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাচ্ছে না। বিআরটিসি বন্ধ করে দেওয়া এই ‘সর্দার’ শাজাহান খানের ঈমানের একটি অঙ্গ। তার ‘খানসেনা’রা এমনকি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রবক্তা ইলিয়াস কাঞ্চনকেও লাঞ্ছিত করেছে।
‘সর্দার’ শাজাহান খান একই সঙ্গে মন্ত্রী, সড়ক শ্রমিকদের ‘সর্দার’ এবং তিনি একজন বাসমালিকও। আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যতই ব্যবস্থা নিন না কেন, এককালের জাসদ সন্ত্রাসী ‘সর্দার’ শাজাহানের খানের ক্ষমতা এবং দাপট অনেক বেশি। ‘‘তিনি মন্ত্রিসভায় থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে কীভাবে’’– আজ আমাকে প্রশ্ন করলেন দেশের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। তাকেও এখন মন্ত্রিসভা থেকে তাড়ানো ‘ফরজ’ হয়ে পড়েছে।
যে দেশে সাগর-রুনি দম্পতির হত্যারহস্য দুই-আড়াই বছরে একটুও এগোয় না, সেই দেশে বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি বা বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইনের মতো ‘সাহস প্রদর্শন’ প্রত্যাশা করি না। আমাদের দেশের অনেক সাংবাদিক তো নিয়মিত বেতন-ভাতা বা নিয়োগপত্রই পায় না। সুতরাং তারা কেন এমনসব ঝুঁকি নেবে?
এমন সম্পাদক বা সাংবাদিক সারা দুনিয়াতেই-বা কয়জন আছেন? তারপরও বলি, সৎ সম্পাদক, সাংবাদিকরাই এখনও আমাদের দেশের মানুষজনের শেষ ভরসা।
‘শিউলীতলা’, উত্তরা; শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর। BD News 24.com

Sunday, October 26, 2014

‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’ - সুমি খান

অক্টোবর ২৬, ২০১৪

জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’ নামে একটি নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরি : ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা: বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও লতিফ সিদ্দিকীসহ চিহ্নিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নীরব হত্যার পরিকল্পনা: জামায়াত ‘মাদার এজেন্ট’

অক্টোবরের শেষে একুশে আগষ্টের মতো গ্রেনেড হামলা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিনাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হুজি


অক্টোবরের শেষে দেশে নীরব হত্যা , বোমা হামলা সহ বড়ো ধরণের নাশকতা করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিতে গিয়ে পাকিস্তানে তৈরি একটি সাবমেশিনগান  (এসএমজি) ,উচ্চমাত্রার ৫৫ প্রকারের বিষ্ফোরক , জেহাদী বই এবং  আল-কায়দা অনুসারী উগ্র জঙ্গী সংগঠন ‘আইএস’ এর মনোগ্রাম সহ  নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাত উল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) ‘র  চার জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।  জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ  তাদের  ‘মাদার এজেন্ট’ বলে জানান মহানগর গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম। আল কায়দা অনুসারী  উগ্র জঙ্গী মতবাদের সকল  ধর্ম ব্যবসায়ী দল জোটবদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে ‘আইএস‘  এর  সাথে এক হয়ে কয়েকটি জেহাদি টীম গঠন করে নাশকতার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানিয়েছে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ ’ নামের একটি সম্মিলিত জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম করার পরিকল্পনা নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
গোয়েন্দা হেফাজতে জঙ্গীরা জানায়, তাদের উদ্দেশ্য ছিলো অক্টোবর মাসের শেষে ২০০৪ সালের একুশে আগষ্টের মতো গ্রেনেড হামলা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিনাশ ঘটানো। একই সাথে আল-কায়দা  অনুসারী জঙ্গী সংগঠন আইএস  এর সাথে মিলে কয়েকটি জেহাদী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নীরব হত্যা এই চার জঙ্গি  ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম । তিনি  বলেন, "বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও লতিফ সিদ্দিকীসহ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের।" উল্লেখ্য সম্প্রতি হজ্জ এবং তাবলিগ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে রোষানলে পড়েছেন লতিফ সিদ্দিকী।
ঢাকা  মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং নগর বিশেষ শাখা(এসবি)‘র পাঁচটি দল বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীর উত্তরা, টিকাটুলি এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে মো. রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ (৩৪), মো. উমর ওরফে ফয়জুল ওরফে রবি (২৫), মো. নাদিম আহমেদ ওরফে সুমন (৩০) ও মো. সালাউদ্দিন আহমেদ (২৯) কে গ্রেপ্তার করে । বোমা তৈরি এবং উচ্চমাত্রার বিষ্ফোরক পদার্থ নিয়ে গবেষণা করার জন্যে তাদের তৈরি দুইটি ল্যাবরেটরির সন্ধান পাওয়া যায় নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা এবং রাজধানীর ওয়ারীতে। জঙ্গীরা জানিয়েছে বোমা তৈরি এবং জঙ্গীবাদ প্রচারণার জন্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎস ছাড়াও পাকিস্তান থেকে আসতো তাদের অর্থ।এই অর্থের যোগানদাতার সন্ধানে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা।

  উল্লেখ্য , ২০০৪ সালের  ২১শে আগষ্ট আ্ওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বর্তমান  প্রধানমস্ত্রী শেখ হাসিনা সহ অনেকেই  প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছিলেন। হুজি জঙ্গীদের ভাষায় সেই ‘অসমাপ্ত কাজ’  ‘সমাপ্ত ’ করতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ আ্ওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে বিনাশ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। আগষ্ট মাসেই নাশকতার উদ্দেশ্য থাকলেও  আগষ্টে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী তুলনামূলকবাবে বেশী সতর্ক থাকার কারণে অক্টোবর মাসে নাশকতা ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত হুজিএনতারা।
এই চারজঙ্গীর আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত বিষ্ফোরক দিয়ে তৈরি বোমা দিয়ে কোন বড়ো সমাবেশে হামলা করলে এর বিষ্ফোরণে কমপক্ষে ২৫ জন মানুষ একসাথে নিহত হতে পারে জানালেন বোমা বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দারা।  জামায়াত হুজি জঙ্গী জোটের তালিকা ডাটাবেজ করে রাখা হয়েছে , যাতে  পরবর্তীতে যে ‘মুজাহিদ‘ই দায়িত্ব নিক না কেন ,দলের নির্দেশনা  অনুসরণ করে যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারে, সেজন্যে হত্যা তালিকায়  দেশের গুরুত্বপূণ এবং সম্মানিত (ভিভিআইপি)  ব্যক্তিদের নাম , ঠিকানা , ফোন নম্বর , বাসার ঠিকানা , গাড়ির নম্বর লিপিবদ্ধ রাখা হয়েছে। পাকিস্তানে তৈরি সাবমেশিন গান(এসএমজি) কাশিমপুর কারাগারে বন্দী হুজি আধ্যাত্মিক গুরু আবু জাফরের বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছে এই চার জঙ্গীর নেতা রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ। জাফরের আত্মীয় পরিচয়ে তার আদালতে হাজিরার দিন এবং কাশিমপুর কারাগারে নিয়মিত দেখা করে কর্মপরিকল্পনা এবং নির্দেশনা নিয়েছেন তার ভাবশিষ্য এবং সন্তানতুল্য লালিত উমর ওরফে ফয়জুল, ওরফে  রবি।

গ্রেপ্তারকৃতরা হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য উল্লেখ করে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে মো. রফিক আহমেদ ওরফে  সাজিদ তাদের সংগঠক। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতো সাজিদ। রাজধানীর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র উমর দক্ষ বোমা কারিগর।  হুজি জঙ্গী উমর আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে  তার ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই কখনো  ফয়জুল কখনো রবি নামে পরিচিত করেছে নিজেকে। গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে জানান , বোমা বানানোতে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দক্ষ জঙ্গী ছিল বোমারু মিজান । উমরকে বোমা বানানো এবং জঙ্গীবাদে কাগজে কলমে এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষিত করেছে হুজি নেতা মওলানা আবু সাঈদ প্রকাশ আবু জাফর। এ কারণে উমর পুথিগত বিদ্যা এবং কারিগরি দিক দু’ভাবেই দক্ষ, যা বোমারু মিজানের ছিল না বলে জানালেন এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। কাশিমপুর কারাগারে বন্দী জেহাদী গুরু মওলানা আবু সাঈদ প্রকাশ আবু জাফর সন্তানের মতো লালন পালন করে তার ভাবশিষ্য হিসাবে গড়ে তুলেছেন হুজি জঙ্গী উমরকে। মওলানা আবু সাঈদ প্রকাশ আবু জাফর হরকাত উল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) আমীর  মুফতি হান্নানের ও আধ্যাত্মিক দীক্ষাগুরু।

  হুজির অন্য সদস্যরা বোমা তৈরিতে উমরের  কারিগরী এবং  পুথিগত দক্ষতা কাজে লাগায়। গ্রেফতারকৃত জঙ্গী নাদিম আহমেদ সুমন ও সালাউদ্দিন বোমা তৈরির সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ করতো। গ্রেপ্তার হওয়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের চার সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য দিয়েছে।
 সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ,জঙ্গীবিরোধী এই অভিযানের নির্দেশনা দেন গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (দক্ষিণ) এর অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর । জনকন্ঠকে জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান , নারায়ন গঞ্জের ফতুল্লা এই জঙ্গীদের জন্যে তুলনামূলক নিরাপদ ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত । তাই হুজি  জঙ্গীরা নারায়নগঞ্জের ফতুল্লার ধর্মগঞ্জে মালেক সরকারের বাড়ি ভাড়া নেয় ২০০৩ সালে । এখানেই দুই মাস আগে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে পদার্থবিদ্যার ছাত্র উমরের নির্দেশনায়  শক্তিশালী বোমা বানানোর প্রস্তুতি নেয়। ল্যাবরেটরিতে বিষ্ফোরক থেকে আত্মরক্ষার মাস্ক সহ প্রয়োজনীয় অনেক উপকরণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে রাজধানীর ওয়ারী থানার র‌্যাংকিন স্ট্রীটের ৬ তালা বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে আরেকটি ল্যাব তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হুজি জঙ্গীরা।
বোমা বানানোর জন্যে এই  বিপুল বিনিয়োগের নেপথ্যে দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার অর্থায়ন আছে বলে জানিয়েছে জঙ্গীরা। এ তথ্য যাচাই করা হচ্ছে বলে জানালেন গোয়েন্দারা।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহযোগিতায় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. রহমতউল্লাহ চৌধুরী, মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মাহমুদা আফরোজ লাকির নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের পাঁচটি দল বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গীদের অর্থের উৎস , সাংগঠনিক শক্তি এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন মনিরুল ইসলাম। শনিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়েএই সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (দক্ষিণ) এর অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর , মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান এবং এই গ্রেফতার অভিযানের সার্বিক তত্বাবধায়ক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতারকৃত ৪  হুজি জঙ্গীর বিরুদ্ধে ওয়ারী, উত্তরা (পশ্চিম) , এবং নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং বিষ্ফোরক উপাদানাবলী আইনে  মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ### ২৫.১০.২০১৪

নির্ঘুম স্বপ্নের দেশ থেকে স্বপ্নহীন ঘুমের দেশে একজন মিনার মাহমুদ-লুৎফর রহমান রিটন


গতকাল ছিল তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার সদ্য প্রকাশিত বই (চন্দ্রাবতী একাডেমী) "নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে'' থেকে মিনার মাহমুদ অংশটি এখানে তুলে দিলাম।
মিনার মাহমুদের মতো একজন লড়াকু মানুষ আত্মহত্যা করবেন এটা মানতে এখনো কষ্ট হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ‘আত্মহত্যা’ ব্যাপারটা যায় না। কী বর্ণাঢ্য একটা জীবন ছিলো তাঁর! য়্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এরকম বর্ণিল জীবন আমাদের প্রজন্মের আর কারো তো ছিলো না! বিশেষ কোনো একটি অভিধায় বিশেষায়িত করা যায় না তাঁকে। তাঁর চরিত্রের মধ্যে একই সঙ্গে দায়িত্বশীলতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতার অপূর্ব মিশেল ছিলো। যে কারণে মিনারকে আমার আনপ্রেডিক্টেবল মনে হতো সব সময়। আমাদের প্রজন্মে মিনার মাহমুদ ছিলেন কীর্তিমান এক রহস্যপুরুষ। যে রহস্যের সিংহভাগই চির অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেল। আমরা পরস্পরকে জানতাম। মিনার জানতেন আমি তাঁকে পছন্দ করি। আমিও জানতাম মিনার আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমরা কখনো একসঙ্গে কাজ করিনি। কেনো করিনি সেটাও একটা রহস্যই। মিনারের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিচিন্তা পত্রিকায় একবারও লিখিনি আমি। আমিও নিজের থেকে লিখিনি আবার মিনারও কখনো বলেননি লিখতে। অথচ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী তুমুল আন্দোলনে আমারও ব্যাপক প্রকাশ্য সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো! কিন্তু মিনার নির্মিত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার কিছু করা হয়নি। আমাদের মত ও পথ ভিন্ন ছিলো কিন্তু চেতনাগত কিছু দায়-এর ক্ষেত্রে চিন্তাগত একটা ঐক্যও ছিলো। সেই ঐক্যই আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধনকে অটুট রেখেছিলো।
অতীত এবং ভবিষ্যতকে অবলীলায় ইরেজ করে দিয়ে বর্তমানকে নিয়ে মেতে থাকার একটা বিরল ক্ষমতা ছিলো মিনারের। তাঁর চরিত্রে কোনো পিছুটান ছিলো না। যে কারণে টানা আঠারোটি বছর তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত সমস্তকিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পেরেছিলেন অনায়াসে। ২০০২ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মিনারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো নিউইয়র্কে। তখন, কথা বলে বুঝেছিলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের উত্থান-পতন কোনোকিছুই স্পর্শ করে না তাঁকে। --‘কী করে পারেন আপনি, মিনার?’ জানতে চাইলে মিনার আমাকে বলেছিলেন—‘আমি এখানে একজন গুহামানবের জীবন যাপন করছি। এই গুহার বাইরের জগত সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা আগ্রহ নেই।’
মিনারের সেই কথাকে আমি মোটেও কথার কথা হিশেবে নিইনি। নিউইয়র্কে তাঁর জীবন যাপন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আমার প্রতীতী জন্মেছিলো যে মিনার মিথ্যে বলছেন না। ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি তিনি তখন ‘এখন সময়’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করেন। বিনিময়ে বাড়ি ভাড়াটা পরিশোধ করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। আর ট্যাক্সি চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে মদে-ভাতে দিন চলে যায়। বলেছিলেন মিনার মাহমুদ। নিউইয়র্ক থেকে কানাডা চলে আসার আগে পুরো একটা দিন মিনার আমাকে তাঁর জীবনযাপন বা দিনযাপন দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। নির্ধারিত তারিখে এস্টোরিয়া এলাকা থেকে তিনি আমাকে সকালে গাড়িতে তুলবেন বললেও তিনি এসে হর্ণ বাজালেন দুপুর একটায়। --কিরে ভাই এই নাকি আপনার সকাল?
মিষ্টি হাসিতে আমার রাগ মুছে দিয়ে মিনার বলেছিলেন—‘সরি, আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার সকাল হয় দুপুরেই। প্রচুর মদ্যপান করে ভোরের দিকে ঘুমুতে যাই। ঘুম ভাঙে দুপুর একটার দিকে। আপনি তো আজ থাকবেন আমার সঙ্গে। দেখবেন। আজকে রাতের আসরে আমার একজন বান্ধবীও থাকবে, কোলকাতার মেয়ে। আপনার কথা বলেছি তাকে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে উন্মুখ আমার বান্ধবীটি।’
সেই দুপুরটা আমরা ঘুরে বেড়ালাম এখানে ওখানে। এক চক্কর পত্রিকা অফিসেও যেতে হবে তাঁকে। বললেন, ‘ঘন্টাখানেক কাটাতে হবে ওখানে। আপনার বোর লাগবে না তো?’
মিনারের জন্যে টোকিও থেকে কেনা দামি ব্র্যান্ডের ধুসর রঙের একটা শার্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। মজা করে বললেন—জাপানের ইয়েনে কেনা? বললাম—জ্বি জনাব।  
পত্রিকা অফিসে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতা হলো। পত্রিকাটির মালিক-সম্পাদক প্রবীন ভদ্রলোক (নাম সাম মিস্টার কাজী) আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। আমাকে এটা সেটা খাইয়ে সতেজ রাখলেন। চললো ম্যারাথন গল্প। এখানে দেখা হলো দৈনিক বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক আমার পূর্ব পরিচিত মঞ্জুর আহমদের সঙ্গে। তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। টেবিলের উল্টোদিকে বসে মিনার খসখস করে লিখে চলেছেন।
--‘কী লিখছেন?’
বললেন—‘একটা ধারাবাহিক লেখার এবারের কিস্তিটা। এই যে এগুলো দেখেন। ধারণা পাবেন কি লিখছি।’ বলে এখন সময় পত্রিকার একটা ফাইল আমার দিকে ঠেলে দিলেন মিনার।
দেখলাম স্বাদু গদ্যে প্রতি সপ্তাহে মিনার মাহমুদ লিখছেন তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে তাঁর ঘর-সংসার আর জীবন যাপনের আনন্দ-বেদনার আলো-অন্ধকার-বর্নিল-ধুসর কাব্য। ঝরঝরে স্মার্ট গদ্য। মিনার নতুন পর্বটি লিখে শেষ করতে করতেই আমার পড়া হয়ে গেলো ছ-সাতটা কিস্তি। বললাম—‘ভাইজান আপনার তো উচিৎ এই জিনিস বাংলাদেশের পত্রিকায় লেখা।’ মিনার বললেন—‘নাহ্‌, বাড়ি ভাড়াটা হালাল করতে লেখা। নাথিং সিরিয়াস।’              
এই মিনারের সঙ্গে আমার সামনাসামনি পরিচয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে, আশির দশকে। পরিচয়ের প্রথম দিনেই তিনি আমাকে বলেছিলেন তাঁর চোখে আমি নাকি একজন চৌকশ তরুণ। মিনার তখন নিজেই বিচিত্রার নবীন কিন্তু চৌকশ তরুণ রিপোর্টার। দুতিনটে রিপোর্ট লিখেই ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করা তরুণ সাংবাদিক।  মিনারের লেখা বিচিত্রার কভার স্টোরি কিংবা প্রতিবেদন পড়ার জন্যে মুখিয়ে থাকতাম। আহা কী অসাধারণ স্মার্ট একটা গদ্যভঙ্গি ছিলো মিনারের! একবার, বিচিত্রায় বর্ডারে চোরাচালান বিষয়ে মিনারের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘অপারেশন মংলা’ প্রকাশিত হবার পর সেটা ব্যাপক আলোড়ন তুললো। রাষ্ট্রপতি এরশাদ মিনারকে ডেকে পাঠালেন। তারপর হেলিকপ্টারে করে মিনারকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন সরেজমিনে দেখতে। এরপর থেকেই নাটকীয়তার শুরু। লোকজন নানা কথা বলে মিনারের নামে। মিনারের লাল চকচকে নতুন হোন্ডা দেখে নিন্দুকেরা গল্প বানায়। দৈনিক বাংলার মূল ফটক লাগোয়া পত্রিকা স্ট্যান্ডের সামনে এক দুপুরে হোন্ডায় বসা মিনার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেন, পত্রিকাবিক্রেতাকে টাকা দেবেন বলে। পাশে দাঁড়ানো আমি মিনারের মানিব্যাগে থরে থরে সাজানো একশ টাকার নোট দেখতে পাই। মিনার সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসেন। আমার সঙ্গে কথা শেষ হলে হোন্ডায় স্টার্ট দেন। দৈনিক বাংলার ছোটদের পাতা সাত ভাই চম্পায় নিয়মিত লেখালেখির সুবাদে আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই ওখানে যাই। নিয়মিত ঢুঁ মারি বিচিত্রায়। সবখানেই তরুণ রিপোর্টার মিনার মাহমুদ সম্পর্কে নানান কিসিমের ফিঁসফাঁস। মিনার নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছেন। বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গে খিটিমিটি লেগে গেলো মিনারের। বিচিত্রা ছেড়ে দিলেন মিনার, কিংবা তাঁকে ছেড়ে দিলো বিচিত্রা। এর কিছুকাল পরেই মিনারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো সাপ্তাহিক বিচিন্তা।বাংলাদেশের পত্রিকা জগতে ঘটে গেলো বিস্ফোরণ। বিচিন্তার পাঠকপ্রিয়তা এবং সার্কুলেশন বিচিত্রাকেও ছাড়িয়ে গেলো। দৈনিক বাংলা ভবনে তখন একদল সাংবাদিক এই কথা বলে নিজেরাই ব্যাপক বিনোদিত হতেন যে—মিনার মাহমুদ বিচিত্রা-র ‘বিচি’ নিয়ে সটকে পড়েছেন, শুধু ‘ত্রা’টা রক্ষা পেয়েছে!
বিচিন্তার একেকটা সংখ্যা বেরোয় আর পাঠক সেটা কেনে হুড়মুড়িয়ে। নাম না জানা অখ্যাত অজ্ঞাত মেধাবী তরুণদের দুর্ধর্ষ একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠলো বিচিন্তা। একেকটা লিকলিকে ছেলের দুঃসাহসী রিপোর্টিং-এ  দিশেহারা হয়ে উঠলো স্বৈরশাসক এরশাদ-সচিবালয়-প্রশাসন-বিভিন্ন সংস্থা এবং সেনাবাহিনি। অবশ্য সেনাবাহিনির একটা অংশ এবং কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এই পত্রিকাটিকে কৌশলে ব্যবহারও করেছে। মিনার তখন দু’হাতে হ্যান্ডশেক করে চলেছেন অজস্র বন্ধু এবং অজস্র শত্রুর সঙ্গে। একটি অষুধ কোম্পানির কোটিপটি মালিকের কোটিপতি স্ত্রী লতা হোসেন বিচিন্তার টাকার যোগান দিলেও মিনারকে তখন টাকা দিতে তৈরি ছিলো আরো অনেকেই। মিনারকে থামানো কিংবা হাত করার জন্যে কিংবা সমঝোতা করার জন্যে নানান সূত্রের লোকজন তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করতেন। মোলাকাতের স্থান হিশেবে শেরাটন ছিলো তাঁর প্রিয় ভ্যেনু। দুতিনটে মোলাকাতের খবর আমার পূর্বাহ্নেই জানা ছিলো। কিন্তু সহজে মিনারকে হাত করা যেতো না। তাক লাগানো অবিশ্বাস্য রকমের শর্ত জুড়ে দিতেন তিনি।
মিনারের মানে বিচিন্তার আক্রমনে সমাজের-রাষ্ট্রের অধিকাংশ সেক্টরই ছিলো খানিকটা দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে ব্যক্তির ভাবমূর্তি ভাঙার ক্ষেত্রে মিনারের দক্ষতা ছিলো ঈর্ষণীয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় কিংবা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব থেকে খুদে এবং বৃহৎ আমলা-ব্যবসায়ীরা কিঞ্চিত তটস্তই ছিলো বলা চলে। সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ মানুষগুলো ভালোমানুষী চেহারার আড়ালে কবে কখন কোথায় কী অঘটন ঘটিয়ে রেখেছিলো সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়ে কারো কারো মর্যাদাহানী ঘটিয়েছেন বিস্তর। বিষয়গুলোতে পত্রিকা পাঠকরা বিমলানন্দ লাভ করতো। মিনারের সোর্স নেটওয়ার্কিং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো যে কখনো কখনো স্টোরি স্বয়ং এসে উপস্থিত হতো তাঁর কাছে। কভার স্টোরির যাবতীয় মালমসলার প্রামাণিক ফাইল নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে যেতো মিনারের হাতে। এইসব ছেপে দিয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতেন তিনি প্রায়শই। এক পর্যায়ে রিপোর্টিং-এর ক্রিজে মিনার হয়ে উঠলেন অতিমাত্রায় দুর্বিনীত এবং ওভার কনফিডেন্ট ব্যাটসম্যান। প্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেয়া যে কোনো বলেই ছক্কা পেটানো শুরু করলেন। ফলে স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়া এবং উইকেট পতনও অনিবার্য হয়ে উঠলো। মিনারকে ফাঁদে ফেলে ইনিংস-এর সমাপ্তি টানতে তৎপর হচ্ছিলো দৃশ্যপটে অনুপস্থিত এক বা একাধিক অনুঘটক।
শেষদিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকেও মেরে বসলেন মিনার। ঋদ্ধি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এম এ হাসান নামের এক টাউট এসে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে এতোটাই বিভ্রান্ত করে ফেললো যে স্যার সেই টাউটের খপ্পড়ে পড়ে তার সঙ্গে একটা যৌথ প্রজেক্টে চুক্তি সাক্ষর করে বসলেন। প্রজেক্টটি  ছিলো বুক রিলেটেড। সেই টাউট বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং সায়ীদ স্যারের নাম ব্যবহার করে মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে কিছু টাকা হাতিয়ে নেবার তাল করেছিলো। বেশ কিছু মানুষ সেই টাউটের ফাঁদে পা দিয়েছিলো। এই বিষয়ে বিচিন্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। প্রতিবেদনে সায়ীদ স্যারের সারা জীবনের অর্জন সততা আর নিষ্ঠাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তাঁকে একজন ছদ্মবেশী অর্থগৃধ্নু প্রতারক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। তিলে তিলে গড়া সায়ীদ স্যারের ইমেজ ধুলোয় মিশিয়ে দিলো বিচিন্তা। পত্রিকাটি পড়ে স্যারকে দেখলাম মহা উত্তেজিত এবং ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ তিনি মিনারের ওপর। বললেন, এরকম একটা প্রতিবেদন ছাপার আগে আমাকে একবার ফোন করবে না? আমার বক্তব্য নেবে না? একতরফা এবং ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তিল তিল করে গড়ে তোলা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে চাইছে কেনো মিনার? স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। মামলা করবেন তিনি মিনার এবং বিচিন্তার বিরুদ্ধে। কিন্তু মিনারের মতো একতরফা কিছু করতে যাওয়ার আগে তিনি চাইলেন মিনারের মনোভাব জানতে। মিনারকে সতর্ক করতে। আমাকেই ভার দিলেন স্যার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্যার তখন সম্রাট আর আমি তাঁর ত্রয়োদশ পুত্র। বললেন যাও, ওকে বলো দুঃখ প্রকাশ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে আগামী সংখ্যায় আরেকটা প্রতিবেদন ছাপাতে। নইলে আমি মামলা করবো। ওকে জিজ্ঞেস করো মামলা করলে মিনার সেটা ফেস করতে পারবে কিনা। যথেষ্ট প্রমাণ ওর হাতে আছে কিনা।
আহমাদ মাযহারকে পেছনে বসিয়ে বিকেলেই আমি আমার লাল রঙের হোন্ডা ৮০ চালিয়ে পৌঁছে গেলাম মিনারের অফিসে, কাকরাইল রাজমনি সিনেমা হলের মোড় লাগোয়া ফরিদপুর ম্যানসনের পাশে একটা ছোট্ট দোতলা বিল্ডিং-এ। আমার হোন্ডাটা অফিসের পার্কিং এলাকায় পৌঁছুতেই দেখলাম কয়েকজন সঙ্গীসহ মিনার বেরুচ্ছেন। আমাদের দেখে থামলেন। হাসিমুখে কুশল বিনিময়ের পর ভদ্রতা প্রকাশ করে আবার অফিসে ফিরতে চাইলেন আমাদের সম্মানে। আমি বললাম, নারে ভাই। এখানেই বলি। পত্রিকার চলতি সংখ্যাটা পড়ে সায়ীদ স্যার খুবই কষ্ট পেয়েছেন। আপনি তো স্যারকে একেবারে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছেন ভাই। স্যারের সারা জীবনের মর্যাদাপূর্ণ ইমেজটা তো ধুলিস্যাত করে দিয়েছেন।
আমার কথায় মিটিমিটি হেসে মিনার বললেন, আপনার স্যারকে বাঁচাতে এসেছেন? প্রতারণা করার আগে স্যারের কি এটা ভাবা উচিৎ ছিলো না যে তিনি একদিন ধরা পড়ে যাবেন?
--কিন্তু স্যার তো বললেন এমন কোনো প্রতারণার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে জানাতে যে স্যার মামলা করবেন যদি আপনি দুঃখ প্রকাশ করে এবং ক্ষমা চেয়ে আগামী সংখ্যায় আরেকটি রিপোর্ট না ছাপেন।
অবজ্ঞার হাসি হেসে মিনার বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। আপনার স্যারকে বলেন দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে।
--আচ্ছা মিনার, আপনার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে তো? স্যার মামলা করলে ফেস করতে পারবেন তো?
--আমাকে নিয়া ভাইবেন না রিটন, হাতে প্রমাণ আছে বইলাই তো ছাপছি। যতোই চেষ্টা করেন আপনার স্যারের ভাবমূর্তি শ্যাষ।
হোন্ডায় স্টার্ট নিতে নিতে আমি বললাম, --স্যার তাহলে মামলাটা করুক। তাই তো?
মিনার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন—জ্বি। করুক।
পরের দিনই স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে রমনা থানায় গেলেন। মামলা হলো। মামলাটা করার পর থানার বারান্দায় একটু দাঁড়ালেন স্যার। তারপর গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন,--ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা! জীবনে কোনোদিন যা ভাবিনি তা-ই আমাকে করতে হলো! কিন্তু কি করবো কেন্দ্রকে তো বাঁচাতে হবে। তাই না?
আমি বললাম,-- জ্বি স্যার।
আমরা ফিরছি বাংলা মোটরের দিকে। স্যারকে মৃদু তিরস্কার করলাম—আপনি স্যার ঋদ্ধির অই বাটপারের সঙ্গে চুক্তিটা করতে গেলেন কেনো?
স্যার বললেন, তোমার কি মনে হয় আমার রক্ত পানি করে গড়ে তোলা একটা প্রতিষ্ঠানকে আমি কারো কাছে বিকিয়ে দেবো? কেন্দ্রে চলো তোমাকে দেখাই কি লেখা আছে সেই চুক্তিতে! ঋদ্ধির সঙ্গে আমাদের চুক্তি শুধুমাত্র বই বিক্রির। এখন,ঋদ্ধি নামের একটি প্রতিষ্ঠান দশজনের সঙ্গে দশ রকমের প্রতারণা করতে পারে। তার দায় কেন্দ্র কেনো নেবে? আমি কেনো নেবো? মিনারের মতো একজন মেধাবী ছেলে কী করে একটা বাটপারের প্রতারণার সঙ্গে কেন্দ্রকে জড়ালো? আমাকে জড়ালো? দেশের সেরা আইনজীবীদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এই মামলায় মিনারের জয়ী হবার সম্ভাবনা একেবারেই শুন্য।   
স্যারের সঙ্গে দেশের নানান ক্ষেত্রের নানান স্তরের বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের প্রায় সবারই আন্তরিক এবং ঘনিষ্ঠ  সম্পর্ক, যাঁরা সোসাইটিতে ম্যাটার করেন। কয়েকদিন পর স্যার আমাকে বললেন,--আমি মিনারের নামে মামলা করেছি বলে সবাই দেখি দারূণ খুশি। এতো এতো মানুষকে ক্ষেপিয়ে রেখেছে ও! সবাই খালি ওকে এইভাবে থাবা মেরে ধরতে চায় বলে স্যার তাঁর ডান হাতটা সামনের দিকে বিস্তার করে মুঠোটা বন্ধ করে দ্রুত সেটা পেছন দিকে টেনে নিয়ে দেখালেন বারকয়।
এই মামলার কিছুদিন পর স্যার এবং কেন্দ্র বিষয়ে তাঁর অনমনীয় অবস্থান থেকে পিছু হটতে শুরু করলেন মিনার। স্যারকে নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমা চাইতে রাজী হলেন। স্যার বললেন, ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে মানুষের চোখে পড়বে না এমন জায়গায় ক্ষমা চাইলে হবে না। ক্ষমা চাইতে হবে প্রচ্ছদে। বড় বড় হরফে। মিনার আমাকে ধরলেন—ভাই স্যারকে একটু বোঝান।
আমি মাযহার আর আমীরুল স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু স্যার কিছু বুঝতে বা মানতে রাজী নন। তাঁর ঐ এক কথা কভার পেজে ছাপতে হবে বড় বড় অক্ষরে।
বিভিন্ন পত্রিকায় আমার চাকরির অভিজ্ঞতাকে স্যার মূল্য দিতেন। অনেক বোঝালাম স্যারকে। অবিরাম চেষ্টার এক পর্যায়ে কভার পেজ থেকে সরে এলেন স্যার। তবে শর্ত দিলেন—প্রচ্ছদ ওল্টালেই ডানদিকের যে পৃষ্ঠাটা ওখানে ছাপতে হবে বড় করে।
মিনার রাজী। পরক্ষণেই স্যার জানালেন—মাত্র এক সংখ্যায় ওটা ছাপালে চলবে না। ছাপতে হবে পর পর চার সংখ্যায়। কারণ ড্যামেজিং রিপোর্টটা যারা পড়েছিলো তারা এই সংখ্যাটা কোনো কারণে নাও পড়তে পারে। সুতরাং ছাপতে হবে পরপর চার সংখ্যায়।
মিনার রাজী। কিন্তু স্যারের তাতেও মন ভরে না। বললেন—মিনার নিজের ভাষায় চালাকী করে ক্ষমা চাইলে হবে না। বক্তব্যটা আমি লিখে দেবো, ওটাই ছাপতে হবে। বক্স করে।
মিনার রাজী। স্যার একটা ড্রাফট রেডি করলেন। আমি বললাম—করেছেন কী স্যার! এতো কথা ছাপাতে গেলে তো স্যার পুরো পৃষ্ঠাই লেগে যাবে। তাতে এটাকে বিজ্ঞাপনের মতো মনে হবে। স্যার বললেন, পারলে কমাও।
আমি মাযহার আর আমীরুল লেগে পড়লাম ড্রাফট মেরামতে। আমরা তিনজন কেন্দ্রের কম্পিউটার সেকশন থেকে বারবার এডিট করা প্রিন্ট বের করি আর এডিট করি মানে বক্তব্য ঠিক রেখে আরেকটু কমাই। আরেকটু কমাই। এভাবে কমাতে কমাতে এক পর্যায়ে আমরা তিনজন একমত হই যে--হয়েছে! তারপর স্যারকে দেখাই। আমাদের সম্পাদনা দক্ষতা দেখে স্যার ইম্প্রেসড। বললেন ঠিক আছে।
বিচিন্তার পৃষ্ঠার মাপে প্রায় হাফ পেজ সাইজে মোটা রুলের একটা বক্সে একটা বড়সড় বোল্ড টাইপের শিরোনামসহ বডি টাইপের চেয়ে ঢের বড় টাইপে বক্তব্যটা কম্পোজ করে চারটে ট্রেসিং এবং কয়েকটা এ-ফোর আকারের ঝকঝকে শাদা কাগজে প্রিন্ট করে দিয়ে এলাম মিনারকে। মিনার আমাকে বললেন,--এটা তো ছাপবোই। তার আগে কেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্রের ছেলেমেয়েদের সামনে সরাসরি স্যারের কাছে একটু ক্ষমা চাইতে চাই। প্লিজ আপনি ব্যবস্থা করেন রিটন।
ইতোমধ্যে স্যারের বাড়িতে গিয়ে স্যারের কাছে একপ্রস্থ ক্ষমা প্রার্থনা করেও এসেছেন মিনার। এটা স্যারই আমাদের বলেছিলেন। স্যারকে বললাম যে মিনার কেন্দ্রে আসতে চায় একদিন। স্যার বললেন,-- ওর যেদিন খুশি আসতে বলো সন্ধ্যায়। মিনারের সঙ্গে কথা বললাম। তারিখ নির্ধারিত হলো। মিনার শুধু বললেন—অইদিন আপনিও থাইকেন। আমি বললাম-- শিওর।  
নির্ধারিত তারিখে সন্ধ্যায় মিনার এলেন বাংলা মোটরের গলিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেই সন্ধ্যায় কি একটা কর্মসূচীর কারণে কেন্দ্র ছিলো একঝাঁক ছেলেমেয়েতে ঠাঁসা। ছাদের উন্মুক্ত পরিসরে বড়সড় একটা গ্রুপের সঙ্গে স্যারের আলোচনা চলছে।
নিচতলায় আম গাছের নিচেই বসে ছিলাম আমি। মিনার এলেন। মুখোমুখি আরেকটি চেয়ারে তাঁকে বসিয়ে আমরা দুজনেই ধুমায়িত চায়ে চুমুক দিচ্ছি। কলেজ কর্মসূচির একটি ছেলে মিনারকে দেখে একটু এগিয়ে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে মিনারের উদ্দেশে অগ্নিবর্ষণ আরম্ভ করলো। মিনার মাথা নিচু করে বসে আছেন। হাসিহাসি মুখ। জবাব দিচ্ছেন না। একবার দুবার আমার দিকে তাকালেন শুধু। এক পর্যায়ে ছেলেটা লিমিট ক্রস করে ফেলতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম আমি—এতোই যদি মাস্তান তুমি তাহলে বিচিন্তা অফিসে গিয়ে হম্বিতম্বিটা করে এলে না কেনো? মিনারকে কেন্দ্রে পেয়েই বিপ্লবী হয়া উঠলা? মিনার মাহমুদ এখন আমার গেস্ট, স্যারের গেস্ট, কেন্দ্রের গেস্ট। তোমার মতোন এক দেড়শ পোলাপান মিনারের কথায় রোজ উঠে আর বহে। তারে দেখলে কি দুর্বল মনে হয় তোমার থিকা? মিনারের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা আছে তোমার? পারলে কেন্দ্রের বাইরে গিয়া মিনারের উপ্রে রোয়াব দেখাইও। কাইলকাই। ঠিকাছে?
আমার আচমকা মৌখিক আক্রমনে ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দের তীব্রতায় ছেলেটার উত্তেজনা ‘লেভেল জিরোতে’ নেমে এলো মুহূর্তেই। আর সেটা অবলোকন করে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কতিপয় অপেক্ষমান বিপ্লবীও লেজ গুটিয়ে নিলো। আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন মিনার চায়ে চুমুক দিতে দিতে। চোখে তাঁর কৃতজ্ঞতার উদ্ভাস।
এর আগেই মাযহার ছাদে চলে গেছে স্যারকে মিনারের আগমন সংবাদটা দিতে। একটু পরেই ফিরে এসে মাযহার বললো, চলো। স্যার যেতে বলেছেন। মিনারকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ছাদে প্রচুর ছেলেমেয়ে। স্যার বক্তৃতা করছিলেন। আমাদের দেখে স্যার তাঁর চলমান বক্তব্যের মধ্যিখানেই প্রিয় ছাত্র মিনার মাহমুদকে খুব সুন্দর ভাষা ও ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর মিনার খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রতিবেদনটি ছাপার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আগামী চার সংখ্যায় নাগাড়ে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটিও জানালেন খুবই স্মার্ট ভঙ্গিতে।
সেই ‘ক্ষমা বিজ্ঞপ্তি’সহ বিচিন্তার একেকটা সংখ্যা বেরোয় আর আমি দুর্দান্ত প্রাতপশালী একজন মিনার মাহমুদকে ক্রমশ বিলিয়মান হতে দেখি। একেকটা সংখ্যা মিনারের সাম্রাজ্যের পতন ধ্বনি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়। আমার জেনারেশনের একজন তুমুল শক্তিমান তরুণের এরকম পরাজয় আমাকে ব্যথিত করে।
এরপর খুব দ্রুত পালটে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সময় গড়াতে থাকে। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরের তিন তারিখে কাউকে কিছু না বলে রণাঙ্গণের ময়দানে যুদ্ধ অসম্পূর্ণ এবং সহযোদ্ধাদের অরক্ষিত রেখেই তাদের সাহসী জেনারেল মিনার মাহমুদ দেশ ছেড়েছেন আশ্চর্য গোপনীয়তায়।
মিনারের এই চলে যাওয়াটা আমাকে একটা গভীর মনোকষ্টের অন্ধকার কূপের ভেতরে নিক্ষেপ করলো। একটা গিলটি ফিলিংস আমাকে বারবার গ্রাস করতে উদ্ধত হলো। আমার কেবলি মনে হতে লাগলো যে তাঁর এই দেশান্তরী হবার পেছনে অন্যতম অনুঘটক আমিও। সায়ীদ স্যারকে একদিন বলেও ফেললাম আমার মানসিক বিপর্যয়ের বিষয়টা। আমি স্যারকে সরাসরি দায়িও করলাম। খুব ঠান্ডা মাথায় স্যার আমাকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারপ্রচেষ্টা চালালেন। বললেন, আমি নিজেও কিন্তু দায়ি নই রিটন। আজ হোক কাল হোক পালাতে তাকে হতোই। তোমাকে তো বলেছি এতো এতো মানুষকে সে ক্ষেপিয়ে রেখেছে। এদের অনেকেই পারলে মিনারকে খুন করে ফেলে। পালানোর জন্যে পথ খুঁজছিলো সে। চলে গিয়ে ভালোই করেছে মিনার। নইলে হয়তো এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ওকে ভোগ করতে হতো। তুমি নিজেকে খামোখা অপরাধী ভাবছো কেনো? সরাসরি শিক্ষক হয়েও  ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা তো করেছিলাম আমি। আমার যে কী রকম কষ্ট হয়েছে ওর জন্যে সেটা তো তুমি বুঝবে না।
স্যারের কথায় শান্তনা খুঁজে পাচ্ছিলাম কিন্তু মুক্তি পাচ্ছিলাম না। তবে স্যারের কথার মধ্যে তাঁর কণ্ঠস্বরে মিনারের জন্যে একজন ব্যথিত পিতার আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিন।
দীর্ঘদিন পর ২০০২-এর মার্চে নিউ ইয়র্কে দেখা হবার দিনটাতে একটি কফি শপে কফি পান করতে করতে সদ্য জাপান ফেরত আমি আমার গিলটি ফিলিংস-এর বিষয়টা মিনারকে বলেছিলাম। মিনার হাসতে হাসতে আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন—আরে ধুর! আপনার কেনো অপরাধী লাগবে নিজেকে! আপনি মোটেও দায়ি নন। আপনি তো এসেছিলেন আমাকে সতর্ক করতে। আর আমার দেশান্তরি হবার পেছনে সায়ীদ স্যারও দায়ী না।
দশ-বারো বছর ধরে আমার কাঁধে চেপে থাকা খুব ভারী একটা পাথর অপসারিত হলো মিনারের এই উচ্চারণে। দাঁড়িয়ে একটা কোলাকুলি টাইপ ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম—আসেন ভাই। বুকটা একটু হালকা করি।
সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকায় একজন টিভি অভিনেত্রীর বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে মিনার এক ঘন্টার একটা ট্যাক্সি খ্যাপ মারতে গেলেন। সময় মতো ফিরে এসে আমাকে ফের তুলে নিলেন গাড়িতে। ম্যানহাটনের উজ্জ্বল আলোর ঝকমকির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মিনার অজস্র কথা বলছিলেন। বলছিলেন তাঁর ছাহাবাদের কথা। নাম ধরে ধরে কে কোথায় কি করছেন জানতে চাইছিলেন আমার কাছে। সাধ্য অনুযায়ী তথ্য দিচ্ছিলাম তাঁকে। বললাম, আপনার একজন ছাহাবা তো এই নিউইয়র্কেই থাকে। বললেন, হ্যাঁ। সে ফিল্ম নিয়ে আছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। একই শহরে থাকলেও আমাদের দেখা হয় খুব কম। কালে ভদ্রে। টেলিফোনেও কথা হয় না। তারে দেখলে মজা পাইবেন। আগের গেটাপে নাই। ক্যাপ আর হ্যাটের তলায় ওর বিচিত্রা আর বিচিন্তার বরিশাইল্লা গোবেচারা ভাবটা পালাইছে!
আরেক ছাহাবার কথা বললেন খানিকটা গৌরব এবং ততোধিক ক্ষোভের সঙ্গে। গৌরব, কারণ সাংবাদিক হিশেবে তিনি বেশ নাম করেছেন। ক্ষোভ, কারণ সেই ছাহাবা নাকি অবিরাম তাঁর চরিত্রহনন করছেন। স্মৃতিকথা লিখবার ছলে নাকি মিনারের চরিত্রে কালীমা লেপন হয় এরকম ঘটনারই বয়ান করে চলেছেন। দুঃখ করে বললেন,--আমাকে নিয়ে লিখুক অসুবিধা নাই কিন্তু আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে এতো বেশি মাতামাতি করেছে যে আমি কষ্ট পেয়েছি। ওর কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত। ওর ঢাকায় থাকার সমস্ত দায়-দায়িত্ব কিন্তু আমিই নিয়েছিলাম।
একটা দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত হাসিতে গভীর গোপন বেদনাকে আড়াল করে মিনার বললেন,-- আমাকে ভিলেন বানিয়ে নিজে হিরো হচ্ছে, হোক। তাও তো কেউ একজন আমার কথা মনে রেখেছে!
বেশ অহংকারী কণ্ঠে খুব প্রশংসা করলেন আনিসুল হকের। মাসুক হেলালের অদ্ভুত অদ্ভুত পাগলামোর কাহিনি বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়লেন। মাসুকের কাছ থেকে শোনা আমার একটি দুটি হাস্যকর ঘটনারও বয়ান করলেন। মাসুক আর আমি একবার দুপুরে শান্তিনগরের এক রেস্টুরেন্টে পাঙ্গাস মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। খাওয়ার পর দেখা গেলো আমাদের দুজনার কারো পকেটেই টাকা নেই! মাসুককে ম্যানেজারের কাছে জমা রেখে সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি আমি কী ভাবে সামাল দিয়েছিলাম সেই কাহিনিও বিস্তারিত বললেন হাসতে হাসতে। ময়মনসিংহে সরকার জসীমদের আবাসিক হোটেলে সারারাত না ঘুমিয়ে আমার ও আমীরুল ইসলামের যৌথ পাগলামির ঘটনাও দেখলাম মিনারের জানা! মাসুকের প্রতি মিনারের গভীর মমতা প্রকাশ পাচ্ছিলো এইসব কাহিনির নিখুঁত বয়ানে।
‘বিচিন্তার জন্যে আমি কোনো লেখা দিইনি কিন্তু রক্ত দিয়েছিলাম।’ আচমকা আমার এরকম উচ্চারণে ম্যানহাটনের আলো উপচানো রাস্তায় সহসা থমকে দাঁড়ালেন মিনার,--বলেন কী!
--জ্বি স্যার। এরশাদের পতনের পর আপনাদের কাকরাইল অফিসে বিটিভির ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম ‘সৌরভে গৌরভে’ নামের অনুষ্ঠানে আপনার ইন্টারভিউ নেবার জন্যে। সেদিন আপনার অফিসে বিচিন্তার রক্তদান কর্মসূচি চলছিলো। আমি ঢোকামাত্রই আমাকে ধরে শুইয়ে দেয়া হয়েছিলো আপনার নেতৃত্বে। তারপর একব্যাগ রক্ত দিলাম না?
আমার কথায় হাসতে হাসতে দুহাতে পেট চেপে ধরে ম্যানহাটনের রাস্তায় প্রায় বসে পড়লেন মিনার—ওহ্‌ ম্যান...।
এর কয়েকদিন পরেই আমি কানাডা চলে এলাম। মিনার থেকে গেলেন নিউইয়র্কে, তাঁর গুহামানবের জীবনে। আমাদের আর দেখা হয় না। আমি নিজেও সাত বছর আটকে থাকলাম কানাডায়। দেশে ফিরতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার আমার পাসপোর্ট আটকে রাখে। ২০০৭-এ এক এগারোয় তত্তাবধায়ক আমলে পাসপোর্টটি ফিরে পেলাম নভেম্বরে। দেশে ফিরলাম। আহা স্বদেশ! প্রিয় স্বদেশ!
২০০৯-এ দেশে ফিরে এলেন মিনার মাহমুদ। ১৮ বছর পর তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সবার সঙ্গে দেখা করছেন। চ্যানেল আই-এর সিদ্ধেশ্বরী অফিসে এলেন সাগর ভাইয়ের কাছে। অনেক আড্ডা হয়েছিলো সেদিন। অনেক পরিকল্পনার কথা বললেন টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। সাগর ভাই আমীরুলকে ট্যাগ করে দিয়েছিলেন মিনারের আইডিয়াগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যে।
‘নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে’ নামে একটি বই লিখেছিলেন মিনার। ২০১০ সালের একুশের বইমেলায় এক বিকেলে মিনারের লাইভ ইন্টারভিউ নিলাম চ্যানেল আই-এর ‘বইমেলা সরাসরি’ অনুষ্ঠানে। আমার কণ্ঠে একজন বিখ্যাত সম্পাদক মিনার মাহমুদের লেখালেখি তাঁর কলাম উপন্যাস গদ্যভঙ্গীর অকুণ্ঠ প্রশংসা শুনে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসছিলেন তিনি। তাঁর আরও বই প্রকাশিত হওয়া উচিৎ, আমার এরকম কথার বিপরীতে মিনার বলেছিলেন—আমার কাছে আমার নিজের অকিঞ্চিৎকর এইসব লেখালেখি নিয়ে বই বের করাকে কাগজের অপচয় বলে মনে হয়। এরকম রিমকে রিম কাগজ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না!
২০১১ সালে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় বিচিন্তার নামে একটি স্টলের জন্যে আবেদন করেছিলেন মিনার। কিন্তু স্টল তাঁকে দেয়া হচ্ছিলো না। মিনারের কাছে ব্যাপারটা অসম্মানজনক ঠেকেছিলো। আমাকে বলেছিলেন তাঁর বেদনার কথা। এক দুপুরে মিনারকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে নিয়ে গেলাম। জামান ভাইকে নানান যুক্তিতে পরাস্ত করে এলাম। তিনি কথা দিলেন। পরের দিন মিনারকে বা বিচিন্তাকে একটি স্টল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিলো। খবরটা জানিয়ে মিনার খুব করে ধন্যবাদ দিয়ে একটা সুন্দর এসএমএস করেছিলেন আমাকে। কিন্তু পরে দেখা গেলো বরাদ্ধকৃত স্টলটি ছিলো রাস্তায়, খুব অগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। জামান ভাই খুব চাপের মধ্যে থাকেন এই সময়টায়। তাই তাঁকে আর বিরক্ত করিনি। তবে এটা সত্যি যে মিনারের প্রতি খুব একটা সুবিচার করা হয়নি। অবশ্য নতুন করে বেরুনো বিচিন্তা পত্রিকাটাও ছিলো খুবই নড়বড়ে। কোনো স্ট্যাণ্ডার্ডে পৌঁছুতে পারেনি পত্রিকাটা। পাঠকও গ্রহণ করেনি পত্রিকাটাকে। আসলে সময় আর প্রেক্ষাপট পালটে গিয়েছিলো। পালটে গিয়েছিলো দেশ দেশের মানুষ মধ্যবিত্তের রুচি আর চাহিদা। পালটে গিয়েছিলো তারুণ্যের ভাবচক্কর। মিনার ছিলেন আঠারো বছর আগের মিনার। কিন্তু মিনারের রেখে যাওয়া বাংলাদেশ আর আগের বাংলাদেশ ছিলো না। থাকবার কথাও না। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলেন না মিনার। ফলে প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি বা ধাক্কা খেলেন।

নতুন করে বিচিন্তা বের করতে গিয়ে মিনার তেমন ভালো হ্যান্ডস পেলেন না। তাঁর অতীতের এক ছাহাবা এসে যুক্ত হয়েছিলো তাঁর সঙ্গে। এই ছাহাবার ওপর নির্ভর করে মিনার সচলায়তন নামের একটা অনলাইন লেখক ফোরাম থেকে বেশ কিছু লেখা নিয়ে লেখকদের বিনা অনুমতিতেই ছেপে দিচ্ছিলেন। লেখকদের নাম সহ ছাপা হলেও তাঁদের কাছ থেকে কোনোরকম অনুমতি নেবার প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যাপারটা নিয়ে খুব বাজে ধরণের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলো। সচলায়তনের লেখকরা মিনারকে ধুয়ে দিলেন। মিনারকে এমনকি ‘লেখা চোর’ও বলা হলো। মিনার খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন সেই তরুণদের আচরণে। তাদের কাউকে কাউকে লেখক সম্মানি দিয়েও রেহাই পাননি মিনার। মিনারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের দিন, এ বছর, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে,  চ্যানেল আই-এর ছাদে এবং ছাদ থেকে নেমে পার্কিং লটে আমাদের দীর্ঘ আড্ডায় এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম আমি। কয়েক মিনিটেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে তাঁর সাবেক ছাহাবা তাঁকে ব্লগ লেখকদের সম্পর্কে আসল বিষয়টিই ক্লিয়ার করেনি। মিনার বললেন, আরে ভাই ব্লগ থেকে আমি তাঁদের লেখা যদি প্রিন্টেড পত্রিকায় তুলে ধরি তাহলে তাঁদের তো রাগ না করে বরং খুশি হওয়ার কথা! মূল ধারার পাঠকের কাছে পৌঁছে দিলাম তাঁদের লেখাগুলো।
আমি বললাম—‘মিনার, আপনি হয়তো জানেন না নতুন প্রজন্মের তরুণরা এবং যাঁরা ব্লগ লেখেন বা অনলাইন লেখক ফোরামে লেখালেখি করেন তাঁরা ছাপানো দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকাকে একেবারেই পোছেন না। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ব্লগেই লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এক্ষেত্রে তারা একেকজন রাজার মতো। সম্রাটের মতো। কাউকে তোয়াক্কা করেন না। এবং এরা প্রায় প্রত্যেকেই লেখকের অধিকার বিষয়ে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কেবলমাত্র লেখার সম্মানীই যথেষ্ঠ নয়।’ মিনার স্বীকার করলেন এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁকে সেভাবে বিষয়টা বোঝানো হয়�