Friday, March 28, 2014

বাংলাদেশের ২০ রাষ্ট্রপতির নাম ও তাদের মেয়াদকাল

আসুন জেনে নিন বাংলাদেশের ২০ রাষ্ট্রপতির নাম ও তাদের মেয়াদকাল-

১) শেখ মুজিবুর রহমান
(মেয়াদকাল ১৭-০৪-৭১ থেকে ১২-০১-৭২ ইং)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত)
(মেয়াদকাল ১৭-০৪-৭১ থেকে ০৯-০১-৭২ ইং)

২) বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
(মেয়াদকাল ১২-০১-৭২ থেকে ২৪-১২-৭৩ ইং)

৩) মোহাম্মদ উল্ল্যাহ
(মেয়াদকাল ২৪-১২-৭৩ থেকে ২৫-০১-৭৫ ইং)

৪) শেখ মুজিবুর রহমান
(মেয়াদকাল ২৫-০১-৭৫ থেকে ১৫-০৮-৭৫ ইং)

৫) খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ
(মেয়াদকাল ১৬-০৮-৭৫ থেকে ০৬-১১-৭৫ ইং)

৬) বিচারপতি এ এস এম সায়েম
(মেয়াদকাল ০৬-১১-৭৫ থেকে ২১-০৪-৭৭ ইং)

৭) জিয়াউর রহমান
(মেয়াদকাল ২১-০৪-৭৭ থেকে ৩০-০৫-৮১ ইং)
৮) বিচারপতি আবদুস সাত্তার
(মেয়াদকাল ৩০-০৫-৮১ থেকে ২৩-০৩-৮২ ইং)

০৯) বিচারপতি এ এফ এম আহসান উদ্দিন চৌধুরী
(মেয়াদকাল ২৪-০৩-৮২ থেকে ১০-১২-৮৩ ইং)

১০) হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ
(মেয়াদকাল ১০-১২-৮৩ থেকে ০৬-১২-৯০ ইং)

১১) বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ
(মেয়াদকাল ০৬-১২-৯০ থেকে ০৯-১০-৯০ ইং)

১২) আবদুর রহমান বিশ্বাস
(মেয়াদকাল ০৯-১০-৯১ থেকে ০৯-১০-৯৬ ইং)

১৩) বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ
(মেয়াদকাল ০৯-১০-৯৬ থেকে ১৪-১১-০১ ইং)

১৪) এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
(মেয়াদকাল ১৪-১১-০১ থেকে ২১-০৬-০২ ইং)

১৫) ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার (অস্থায়ী)
(মেয়াদকাল ২১-০৬-০২ থেকে ০৬-০৯-০২ ইং)

১৬) অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ
(মেয়াদকাল ০৬-০৯-০২ থেকে ১২-০২-০৯ ইং)

১৭) জিল্লুর রহমান
(মেয়াদকাল ১২-০২-০৯ থেকে ২০-০৩-১৩ ইং)

১৮) আবদুল হামিদ
(মেয়াদকাল ১৪-০৩-২০১৩ ইং থেকে বর্তমানে চলছে)।

Monday, March 24, 2014

২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হোক- মুনতাসীর মামুন



বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা। গত কয়েক দশক গণহত্যার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। শুধু বিদেশেই নয় স্বদেশেও। এর একটি কারণ, বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের নীরবতা এবং স্বদেশেও এ বিষয়ে আলোচনার অনীহা। যে কারণে, বাংলাদেশের গণহত্যায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়ে ছিলেন সে সম্পর্কেও বিতর্কের অবতারণা করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পগ্রোম বা ভিয়েতনামের মাইলাই নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হয়েছে। বসনিয়া, হার্র্জিগোভিনা, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা প্রভৃতি দেশের গণহত্যাও ব্যাপক আলোচিত এবং সেই সব আলোচনা ও বিতর্কের ফলে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে গণনা করা হচ্ছে এবং অপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আদালতও গঠিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে খুব বেশি একটা কেউ আলোচনা করতে চান না। এর কারণ খুঁজতে গেলে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি আলোচনা করতে হবে। 
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহ। তারা গণহত্যাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। স্বপ্নেও তারা ভাবেনি, লুঙ্গিপরা, থ্রি নট থ্রি সম্বল করে গরিব জীর্ণশীর্ণ মানুষগুলো জিততে পারবে। কিন্তু বাঙালীরা জিতেছিল। এই পরাজয় তাদের আত্মগরিমায় আঘাত করেছে। গণহত্যা যেহেতু অপরাধ এবং এ নিয়ে বেশি আলোচনা করলে আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ ও পাকিস্তান সমর্থনকারী দেশগুলোর ওপর গণহত্যার দায় বর্তায়। সে কারণে, গণহত্যা নিয়ে আলোচনা তারা করেনি।

অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের সেই গণহত্যাকারীদেরই ক্ষমতায় আনেন। সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে জিয়া-এরশাদ-খালেদা-নিজামী ২৫ বছরের ওপর প্রায় একাধিক্রমে বাংলাদেশ শাসন করেছে। গণহত্যা দূরে থাকুক তখন ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। 
বাংলাদেশে নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি প্রাধান্য পেল জাতীয় রাজনীতি তখন গণহত্যা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্যাতন ও নারী ধর্ষণের বিষয়টিও নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো। গণহত্যা বিষয়ে বলা হলো, শেখ মুজিবুর রহমান তো ইংরেজী তেমন জানতেন না। ইংরেজীতে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে থ্রি লাখকে থ্রি মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে চালু হয়ে গেল ত্রিশ লাখ বা থ্রি মিলিয়ন মারা গেছে। এটি কি সম্ভব? বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ‘বুদ্ধিজীবী’রা এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে উস্কে দিয়েছিলেন। 

বঙ্গবন্ধুর কথায় ত্রিশ লাখ শহীদের কথা চালু হয়নি। ত্রিশ লাখ শহীদের কথা প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদায়। এর পর অস্ট্রেলিয়া বেতার থেকেও খুব সম্ভব একই কথা বলা হয়েছিল। সেই থেকে গণহত্যায় ত্রিশ লাখের কথা বলা হয়।
নারী নির্যাতন নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর নাতনি শর্মিলা বসু বিতর্ক ছড়িয়ে দেন। ১৯৭১ সালে ও তার পর পাকিস্তানীরা যা বলতেন, শর্মিলাও একই কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন এবং মস্ত বই লিখে ‘প্রমাণ’ করার চেষ্টা করলেন যে, বাংলাদেশে মাত্র ৩০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেই অপমান। আসলে শর্মিলাদের মতো পাকিস্তানীমনাদের পাঞ্জাবী সৈনিকদের হাতে তুলে দিলে তারা বুঝতে পারত ধর্ষণ কী? ধর্ষণের অপমান আর্তি কী? ধর্ষণের যে সংখ্যা ১৯৭১ সালে বলা হতো এখন তা চার ভাগের এক ভাগে চলে এসেছে। 
এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আক্রান্ত হচ্ছে। এবং এর বিরুদ্ধে যথাযোগ্য উত্তর দেয়ার লোকের সংখ্যাও কমে গেছে। এ ছাড়া আমাদের মানসিকতায় বীরত্ব বড় ব্যাপার। গণহত্যা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা নয়। সে কারণে বলব, বাংলাদেশের গণহত্যা, নির্যাতন ও নারী ধর্ষণের যে ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছেÑ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মানসিকতা গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে পরে আবার আলোচনা করব। তবে, এই মানসিকতার সূত্রপাত নিয়ে প্রথম আলোচনা করা যাক। 
॥ ২ ॥
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতোমধ্যে সহস্রাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর অধিকাংশই স্মৃতিকথা, দিনলিপি, যুদ্ধের বিবরণ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের, অহঙ্কারের দিকটি যত আলোচিত হয়েছে সে মাত্রায় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচার, নারী নির্যাতন, গণহত্যার দিকগুলো রয়ে গেছে উপেক্ষিত।
আসলে বাঙালী ভালবাসে বীরত্বগাথা। এর একটি কারণ বোধহয়, ক্ষুদ্র এক ব-দ্বীপে তার বসবাস। মাত্র কিছুদিন হলো বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সে দেখেছে আশপাশে নির্যাতিত, গরিব, ক্ষুদ্র সব মানুষ। চিন্তুার জগতটাই তার ছোট। তাই সাহসী কাউকে দেখলেই সে চমৎকৃত হয়। সে সবসময় বীরের কথা বলতে চায়, যদি সে বীর হয় ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়ে চলিল’ -এর মতোও। এ যাবত প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বইপত্র দেখলে এ কথাটি আরও স্পষ্ট হবে। শুধু রণগাথা, বীরত্বের ব্যঞ্জনা। না, নির্যাতন, অত্যাচারের কথা তেমন নেই। এ ইঙ্গিতও নেই কোথাও যে, অত্যাচার ও বীরত্বও এই সূত্রে গাঁথা। মানুষ অত্যাচারিত হয়, নিপীড়িত হয়, বিদ্রোহ করে এবং তার পর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে লড়াই করে। মুক্তিযুদ্ধ কি তাই নয়? পাকিস্তানের কলোনির অধিবাসী হিসেবে বাঙালী অপমানিত, শোষিত হয়েছে, ১৯৭১-এর শুরু থেকে অত্যাচারিত হয়েছে, তারা রুখে দাঁড়িয়েছে অপমানের প্রতিশোধ নিতে। লড়াই করেছে বীরের মতো। তাই শুধু বীরত্ব যদি হয় ইতিহাসের গাথা তাহলে পটভূমিকা থাকে অস্পষ্ট, অজানা সেই বীরত্বের ব্যঞ্জনাও হারিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের গাথা কি কম রচিত হয়েছেÑ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান বা ইতিহাসে? কিন্তু বীরত্বের গাথা কতটুকু মনে রেখেছে বাঙালী? মনে রাখলেও রেখেছে খুব অস্পষ্টভাবে। স্পষ্টভাবে রাখলে তো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী রাজাকার হতো না। ‘আলবদর মাওলানা’ মান্নান (প্রয়াত) বা গোলাম আযম তো ১৯৭১ সালের পর প্রকাশ্যে ঘুরেফিরে বেড়াতে পারত না। কারণ, এই বীরত্বের পটভূমিকাটি সবসময় স্পষ্ট হয়নি, অনবরত বলা হয়নি এটি নতুন প্রজন্মের কাছে।

তাছাড়া বাঙালীর কন্ট্রাডিকশনের আরেকটি দিক উল্লেখ্য। বাঙালী আবার কোন বীরকে বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। প্রথম সুযোগে তাকে ধুলায় ফেলে দিতে বাঙালী কার্পণ্য করে না। এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুব কম জাতিরই আছে। কিন্তু বাঙালী যেহেতু মানুষ এবং মানুষ আর কিছু না হলেও অত্যাচার-অপমানের কথাটা মনে রাখে। বাঙালীরও তাই আর কিছু না হোক অত্যাচারের কথাটা মনে থেকেছে। গ্রামেগঞ্জে ঘুরলে এ কথাটা টের পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে উপন্যাস, গল্প থেকে কবিতা, প্রবন্ধ থেকে গান সবখানে কি বার বার ঘুরেফিরে আসে না হিটলারের সেই ক্রুর মুখ আর গুলির শব্দ। ইউরোপের শহরে-বন্দরে কি এখনও চোখে পড়ে না ফ্যাসিস্ট বা নাৎসিদের বীভৎসতার স্মারক? এর কারণ, সেখানে বীরত্বের গাথা যেমন রচিত হয়েছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে অত্যাচারের গাথাও এবং তা বর্ণিত হয়েছে প্রবলভাবে, জোরালোভাবে, যা এখনও মর্মমূল কাঁপিয়ে দেয়। যে কারণে এখনও অসীম ধৈর্যের সঙ্গে নির্মিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় অসামান্য সব চলচ্চিত্র। নির্মিত হয় ‘গণহত্যা’ জাদুঘর। জেনেশুনে ইউরোপ সে কথা মনে রেখেছিল যেÑ মানুষ সব ভুলতে পারে কিন্তু অত্যাচার-অপমানের কথা ভোলে না।

আমরা আবার অনেক সময় অত্যাচারকে মনে করি অপমান। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গড়নে এ ধরনের হীনম্মন্যতা সব সময় ছিল এবং আছে। উদাহরণ দেয়া যাক একজন শিক্ষককে পাঁচজন ছাত্র এসে পিটিয়ে গেল বা একজন তরুণীকে দু’জন মিলে ধর্ষণ করল, তাতে ঢি-ঢি পড়ে গেল। সমাজ এ সব ঘটনাকে ব্যক্তির অপমান হিসেবে চিহ্নিত করে লুকোতে চায়। ঘটনাটি উল্টো করে দেখি না-কেন? পাঁচজন একজনকে পেটাল, যাকে পেটাল তার অপমান হয় না, বরং ভীরুতা প্রমাণিত হয় পাঁচজনের এবং সেই ভীরুতা হলো অপমান। দু’জন এক তরুণীকে ধর্ষণ করলে তরুণীটি কেন অপমানিত হবে? অপমানিত হবে যারা তাকে রক্ষা করতে পারেনি, অর্থাৎ আশপাশের মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ। কারণ, তাদের ভীরুতার কারণেই তরুণীটি ধর্ষিত হয়েছে। অপমানিত হবে সে সব পরিবার, যে সব পরিবারে ধর্ষকরা বড় হয়েছে, কিন্তু মানুষ হয়নি। কারণ, সে সব পরিবার তাদের শেখায়নি সভ্য সমাজে কিভাবে বসবাস করতে হয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর অহঙ্কারের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মধ্যে আত্মশ্লাঘার সঞ্চার করে নিশ্চিতভাবে কিন্তু অপমানের বা নির্যাতনের ঘটনার আবেদনও কিছুমাত্র কম নয়। বরং অপমানের ঘটনা জাতির অনুভূতিতে যে গভীর ক্ষত এবং তা যে সংহতি গড়ে তুলতে পারে, তা গৌরবের আনন্দ দিয়ে সম্ভব নাও হতে পারে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত বা অনালোচিত বিষয়ের উপাত্ত সংগ্রহে মনোনিবেশ করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের কম আলোচিত দিকগুলোর একটি হচ্ছে গণহত্যা। পাকবাহিনী একাত্তরে শহর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামপর্যন্ত অগণিত গণহত্যা চালায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সব গণহত্যার শিকার নিম্নবর্ণের মানুষ যাদের পরিচয় পাওয়া যায় না। কারণ, তাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের উপযুক্ত মূল্যায়ন হয় না। ওয়াহিদুল হক ‘জাহানারা ইমাম স্মারক’ বক্তৃতায় যথার্থই বলেছেন যে স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ‘গণহত্যার চেতনা’ প্রধান, ‘গণহত্যাকে, ত্রিশ লাখের বলিকে প্রায় চার লাখ বাঙালী নারীর সম্ভ্রম আহূতিকে ভুলতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিছুই বাকি থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের আদিতে আরম্ভ এই দিনে গড় দশ হাজার বাঙালী নিধনের নিরন্তর মোচ্ছব, একে ভুলিয়ে দিয়েই আরম্ভ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎসাধন।...একমাত্র গণহত্যার চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিকষিত হেমে পরিণত করতে পারে।



এক সময় কোন একদিকে আযানের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কয়েকদিকে আযান শোনা গেল। মনে হলো আযানের এমন করুণ সুর- এত বিষণœ সুর আর কোনদিন শুনিনি। গোলাগুলির শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু বন্ধ ছিল মুহূর্তের জন্য মাত্র। আবার চলল গোলাগুলি পুরোদমে। ভোরের দিকে মাইকে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনলাম। তখন ভাবলাম বেলা হলে বোধ হয় এমন নির্বিচারে আর মারবে না। কিন্তু একটু ফর্সা হয়ে যেতেই দেখা গেল এখানে সেখানে পালিয়ে থাকা ছাত্রদের ধরে এনে গুলি করছে। যেন দেখতে না পায় আমাকে এ ভাবেই মাথা নিচু করে লেট্রিনের মধ্যে বসে রইলাম।
বেলা হলো। এক সময় আমার কাছাকাছি বারান্দায় অনেকের কথা শুনতে পেলাম। ছাত্ররা কথা বলছে তা নিশ্চিত হয়ে আমি লেট্রিনের দরজা খুলে বেরুলাম। বেরিয়েই দেখি সিঁড়ির মাথায় মেশিনগান তাক করে মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েকজন ছাত্র একটি লাশ ধরাধরি করে নামাবার চেষ্টা করছে। রাতে আমার মাথার কাছে দেয়ালের ওপাশে যে গোংগাচ্ছিল এটা তারই লাশ। এবং সে আর কেউ নয়, আমাদের হলের দারোয়ান সবার প্রিয় প্রিয়নাথ দা। তাঁকে দিয়ে মেশিনগানের মুখে সব পথ দেখে নিয়ে নামার মুহূর্তে এখানে গুলি করে রেখে গেছে। আমিও আর নিষ্কৃতি পেলাম না।
আমাকে ধরতে হয় লাশ। তিন তলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে একতলা এবং একতলার দক্ষিণ দিকের ভাঙ্গা গেট দিয়ে ব্যাংকের (এখন যেটা সুধীরের কেন্টিন; ওটা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান) উত্তর পাশে নিয়ে রাখলাম। আরো লাশ জড়ো করা হলো সেখানে। ওখানে আমাদের বসার নির্দেশ দিল একজন পাক সেনা।
তখন ছিলাম আমরা কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন মালী, লন্ড্রির কয়েকজন, দারোয়ান গয়ানাথের দুই ছেলে- শংকর ও তার বড় ভাই আর সবাই ছিল সুইপার। লাশগুলোর পাশ ঘিরে আমরা সবাই বসেছিলাম। সুইপারগুলো ওদের ভাষায় মিলিটারিদের কাছে অনুরোধ করছিল ওদের ছেড়ে দেবার জন্য। বলছিল ওরা বাঙালী নয়। সুতরাং ওদের কি দোষ? একজন মিলিটারি ওদের আলাদা হয়ে বসতে বলল। আমাদের কাছ থেকে ওদের নিয়ে কয়েকজন মিলিটারি সোজা উত্তর বাড়ির মাঠে চলে গেল। ভাবলাম ওদের ছেড়ে দেবে। আমাদের আবার লাশগুলো বহন করতে আদেশ দিল। লাশগুলো নিয়ে এসেমব্লির সামনের রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে গেটের বাইরে চলে গেলাম। গেটের বাইরে দক্ষিণ পাশে একটি বড় গাছের গোড়ায় জড়ো করলাম লাশগুলো। এই সময় আমাদের সঙ্গে প্রায় সমান সংখ্যক মিলিটারি ছিল। এবং তারা সবাই ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ওখানে গিয়ে মিলিটারিরা দাঁড়াল অনেক্ষণ। একজন সিগারেট বের করে দিল সবাইকে। আমাদের কেউ বসে, কেউ শুয়ে থাকল। আমিও কাত হয়ে ছিলাম গাছের শিকড়ের ওপর। এইখানে পাক সেনারা আমাদের উদ্দেশে বিশ্রী ও অকথ্য ভাষায় ক্রমাগত গালাগালি করছিল। যতটা বুঝতে পারছিলাম তাতে বুঝলাম, শালা বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেব, বল একবার শালার জয় বাংলা শেখ মুজিবকেও বাংলাদেশের স্বাধীন করিয়ে দেব। আরও নানা অশ্লীল গালাগালি দিচ্ছিল। এ সময় গাড়ির বহর রেসকোর্সের দিক থেকে এসে ওখানে থামল। আমাদের সঙ্গের মিলিটারির একজন সামনের একটি জীপের কাছে গেল। তাকে কিছু নির্দেশ দেয়া হলো। সেখান থেকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেল লাশ বয়ে আনতে। আমাদের অংশটিকে নিয়ে গেল ড. গুহ ঠাকুরতা যে কোয়ার্টারে থাকতেন সেই দিকে। সেই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির কাছে অনেক লাশ পড়েছিল, সিঁড়ির কাছে এনে গুলি করেছে বোঝা গেল। একটি লাশ দেখলাম সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মাথায় টুপি, পাতলা চেহারা। সেখান থেকে নিয়ে গেল দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় লাশ বয়ে আনতে। প্রতিটি তলায় ওরা খোঁজ নিচ্ছিল কোন জীবিত প্রাণী আছে কি না। আর খুঁজছিল দামী মালামাল, ঘড়ি, সোনা-দানা ইত্যাদি। চারতলায় একটি রুমে ঢুকতে পারছিল না কারণ রুমের দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। দরজা ওরা ভেঙ্গে ফেলল। ঢুকে কাউকে পাওয়া গেল না। কতকগুলো এলোমেলো কাপড় চোপড়, বিছানাপত্র ছাড়া কিছুই ছিল না সেখানে। একজনকে ছাদে উঠে কালো ও স্বাধীন বাংলার পতাকা নামাতে বলল। পতাকা নামিয়ে আনলে মিলিটারিদের একজন নিয়ে এলো সেগুলো। আমাদের নিচে নামতে বলল। নিচে নামলাম আমরা। সিঁড়ির কাছে লাশগুলো নিতে বলল। অনেক লাশ রাস্তায় আগেই জমা করা ছিল। বয়ে আনা লাশগুলোও জড়ো করলাম এ গুলোর লাশ পরে নিয়ে গেল। ঐ বিল্ডিংয়ের সামনের দোতলা বাংলো বাড়িটিতে (তখনকার এসএম হলের প্রভোস্টের বাড়ি) সামনে দিয়ে ঢুকতে না পেরে পেছন দিয়ে ঢুকলাম বাড়িতে। নিচতলার সব রুমেই খুঁজলাম। এলোমেলো কাপড় চোপড় স্যুটকেস, বাক্স, খোলা ফ্যান ছাড়া কিছুই দেখা গেল না সেখানে। মিলিটারিরা দামী জিনিসপত্র খুঁজে খুঁজে নিয়ে নিল। কোন লাশ কিংবা রক্তের দাগ ছিল না। ঐ দালানে নেমে আসলাম আমরা সবাই এবং জড়ো হলাম আবার লাশের কাছে। মিলিটারিরা কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা পোড়াল।
আমাদের আবার লাশ নিতে বলল। রাস্তা দিয়ে সোজা উত্তর দিকে অধ্যাপক গোবিন্দ দেবের বাসার সম্মুখ দিয়ে ইউওটিসি বিল্ডিংয়ের সামনে জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিকের ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে ঢুকতে বলল। হলের মেইন বিল্ডিংয়ের সামনে শহীদ মিনারের সংলগ্ন লাশগুলোর কাছে জড়ো করতে লাগলাম লাশগুলো। লাশ যখন নিচ্ছিলাম তখন দেখলাম ড. দেবের বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসছে সেলাইর মেশিন ও অন্যান্য ছোটখাটো মালপত্র। রাস্তার পাশে অনেক মিলিটারি ট্রাক যুদ্ধের বিভিন্ন সাজসরঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিববাড়ীর রাস্তার তিনমাথায় অনেক মর্টার চতুর্দিকে তাক করে রেখেছিল।
দু’জন তিনজন করে আমরা এক একটা লাশ বহন করছিলাম। কোন জায়গায় বসলে কিংবা ধীরে ধীরে হাঁটলে গুলি করার জন্য তেড়ে আসছিল। সব সময়ই আমরা সবাই গা ঘেঁষে বসছিলাম ও চলছিলাম।

কতগুলো লাশ এভাবে বহন করছি ঠিক মনে নেই। শেষ যে লাশটা টেনেছিলাম তা ছিল দারোয়ান সুনীলের। তার শরীর তখনও গরম ছিল। অবশ্য রৌদ্রে থাকার জন্যও হতে পারে। লাশ নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি যেতেই হঠাৎ কতগুলো মেয়েলোক চিৎকার করে উঠল। দেখি মাঠের দক্ষিণ দিকের বস্তিটির মেয়ে ছেলেরা মাঠের দিকে আসতে চাচ্ছে আর পাক সেনারা মেশিনগান নিয়ে ওদের তাড়াচ্ছে। সামনে চেয়ে দেখি সুইপারদের মাঠে এনে দাঁড় করিয়েছে গুলি করার জন্য। এই সুইপারদেরকেই ব্যাংকের কাছে আমাদের থেকে আলাদা করে এই মাঠে নিয়ে এসেছিল ওরা।

সুইপারদের গুলি করে মারছে আর ওই মেয়েছেলেরা চিৎকার করছে এবং ছুটে যেতে চাচ্ছে ওদিকে। বুঝলাম এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিল তাদেরও দাঁড় করিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন খুব জোরে জোরে শব্দ করে কোরানের আয়াত পড়ছিল। ব্যাংকের কাছে যখন বসেছিলাম তখন জেনেছি এই ছেলেটি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। কিশোরগঞ্জে ছিল তার বাড়ি। আগের দিন বিকালে আর এক বন্ধুসহ এসে উঠেছিল তার হলের এক বন্ধুর রুমে। গুলি করল তাদের সবাইকে। আমরা কোন রকমে দুজনে লাশটা টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। সামনেই দেখি ড. গোবিন্দ দেবের মৃতদেহ। ধুতিপরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত সারা শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সঙ্গে যে ছেলেটি লাশ টানছিল সে গোবিন্দ দেবের লাশটি দেখে বলল, দেবকেও মেরেছে। তবে আমাদের আর মরতে ভয় কি? কি ভেবে, আমি দেবের লাশের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সুনীলের লাশসহ শুয়ে পরলাম। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা তখন আমার ছিল না। চোখ বুজে পড়ে থেকে ভাবছিলাম এই বুঝি লাথি মেরে তুলে গুলি করবে। এক সময় ভাবছিলাম তবে কি আমাকে গুলি করছে, আমার তখন কোন অনুভূতি নেই। কি হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। এই মরার মতো অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারি না। এক সময় আমার মাথার কাছে ছেলেমেয়েদের ও বাচ্চাদের কান্না শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি সুইপার, দারোয়ান ও মহিলাদের বাচ্চারা ও মেয়েছেলেগুলো মৃত স্বামী কিংবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। তখনও অনেকে মরেনি। কেউ পানি চাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ পানি খাওয়াচ্ছে এই সময় দেখলাম এক একজন গুলি খেয়েও হামাগুড়ি দিয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে দেখি যেদিকে মিলিটারির গাড়ি ও অসংখ্য মিলিটারি ছিল সেদিকে কোন গাড়ি বা মিলিটারি নেই। চতুর্দিকে একনজর দেখে নিয়ে মেয়েছেলে ও বাচ্চাদের মধ্যে দিয়ে নুয়ে নুয়ে বস্তির মধ্যে গেলাম। প্রথমে গিয়ে ঢুকি চিৎকালীর ঘরে। চিৎকালী ঘরে ছিল না। এক মহিলা ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর কাছে পানি খেতে চাইলে সে একটি ঘটি দেখিয়ে দিল। পানি খেয়ে ওর ঘরে কোণে যে খাটে ছিল তার নিচে লুকিয়ে থাকতে চাইলাম। মহিলাটি আমাকে তক্ষুণি সরে যেতে বলল। তখন আমি বস্তির পাশের লেট্রিনে ঢুকে পড়ি।”
এবার ঐ সময়ের বিদেশী সংবাদপত্রের কিছু ভাষ্য উদ্ধৃত করছি। ১৯৭২ সালে ফজলুর রহমানের বাংলাদেশের গণহত্যা শীর্ষক বইয়ে উদ্ধৃতিগুলো অনুবাদ করা হয়েছিল।
[টাইম, ১২ এপ্রিল, ১৯৭১]
... কোন সন্দেহ নেই যে, এক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা যায়। এটা হচ্ছে একটা মারাত্মক রক্তপাত। সৈন্যরা ছিল নিষ্ঠুর পাষ- পাশ্চাত্যের এক কর্মচারী মর্মাহত হয়ে বলেছিলেন- এটা চেঙ্গিস খানের মতো কার্যকলাপ।
[লা এক্সপ্রেস, ১২ থেকে ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১]
একজন ইউরোপীয় প্রত্যাগমনকারী বলেন, ‘প্রত্যেক রাতে আমি ভারি মেশিনগান ও মর্টারের আওয়াজ শুনতাম। সেখানে পানি, বিদ্যুৎ কিছুই ছিল না। সৈন্যরা বাঙালীদের পিছনে পিছনে ছুটত এবং যাদের ধরতে পারত তাদের ট্যাঙ্কের পেছনে এমনভাবে বাঁধত যাতে তাদের মাথাগুলো মাটিতে আছড়াতে থাকে।’
[টাইম, ৩ মে, ১৯৭১]
সবচেয়ে বর্বরতম হত্যা সংঘটিত হয় শহরের পুরনো এলাকায়। সেখানে অনেক য়গা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। সৈন্যরা প্রত্যেক মহল্লার চারদিকে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে দেয় এবং হাউই ছুড়ে সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়; তারপর আগুনের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে যে- সমস্ত লোক পালাতে চেষ্টা করেছিল তাদের কচুকাটা করা হয়।
একজন বিদেশী শুনতে পান সৈন্যরা চেঁচিয়ে বলছে ‘ওরা বেরিয়ে আসছে, মারো হারামজাদাদের।’
খুব কম লোকই এই ধ্বংসলীলার হাত হতে রক্ষা পায়। পুরনো ঢাকা ২৫টি মহল্লায় ছড়িয়ে আছে যারা বেঁচে যায় তাদের ভয় দেখাবার জন্য সৈন্যরা তিনদিন পর্যন্ত গলিত লাশগুলো সরাতে অস্বীকার করে; অথচ ইসলাম ধর্মে রুহ্কে মুক্ত করার জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহ দাফন করার নির্দেশ রয়েছে।
ঘর-বাড়ি খানা-তল্লাশি করার সময় একজন যুবক সৈন্যদের তার সতেরো বছর বয়স্ক তরুণী বোনটিকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। ফলে সৈন্যরা তার চোখের সামনে তার বোনকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন ডাক্তার কর্নেল আবদুল হাইকে তার পরিবারের কাছে শেষবারের মতো একবার ফোন করার সুযোগ দেয়া হয়। আর তার এক ঘণ্টা পরই বাড়িতে তার লাশ পাঠানো হয়।
যে বুড়ো লোকটি কারফিউ উপেক্ষা করে জুমার নামাজকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল তাকে মসজিদে ঢোকার পথে গুলি করে মারা হয়।
[স্টেট্স্ম্যান, ১৩ মে, ১৯৭১]
শকুনগুলো বেশি খাওয়ায় উড়তে না পেরে গঙ্গার তীরে ভয়াবহ তৃপ্তিতে বসে আছে। মার্চ মাস থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি নিহত পাকিস্তানীদের তারা খাদ্য হিসেবে পেয়েছে।
চট্টগ্রাম যাওয়ার পথের দুধারে বাঙালী-অধ্যুষিত পুরো এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভেঙ্গে চুরে ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হয়।
[সানডে টাইমস, ২০ জুন, ১৯৭১]
কার্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের পরাজিত করার জন্য ঢাকায় অবস্থিত সামরিক শাসকগোষ্ঠী একটি দ্বি-মাত্রিক সাঁড়াশি নীতি উদ্ভাবন করে। প্রথমত, সমস্ত সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পপতিদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। দ্বিতীয়ত, যদি কাউকে প্রচ্ছন্নভাবে বিপজ্জনক মনে করা হয় তবে তাকে সরিয়ে ফেলা হয়। ইতোমধ্যেই সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ শিক্ষক, সাংবাদিক ও অন্যান্য প্রবাবশালী বাঙালীদের গ্রেফতার ও জেরা করতে শুরু করেছে। যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন অথবা এর সমর্থক সেইসব সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। সাদা, ধূসর ও কালো। সাদাদের ছেড়ে দেয়া হবে। ধূসর তালিকাভুক্ত লোকদের চাকরি যাবে কিংবা হয়ত জেলও হতে পারে, আর কালো তালিকাভুক্তদের গুলি করে মারা হবে।
সরকারী চাকুরেদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ৩৬ জন জেলা শাসক ও মহকুমা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে ...
পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী বাঙালীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তার প্রচুর বিবরণ থাকা উচিত ছিল যাতে ভবিষ্যতে নাগরিকরা বুঝতে পারে বাংলাদেশবিরোধীরা কী রকম প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সে রকম প্রচুর বিবরণ নেই। কিছু খ-চিত্র পাওয়া যাবে শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, মন্টু খানের হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন, রশীদ হায়দার সম্পাদিত একাত্তরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং আতোয়ার রহমান সম্পাদিত একাত্তরের কড়চায়। শাহরিয়ার তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় অত্যাচারের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে লিখেছেন- তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ; দলিলপত্রের ১৬ খ-ের মাত্র একখ- (১৯৭৭) ‘গণহত্যা, শরণার্থী শিবির ও প্রাসঙ্গিক ঘটনা’ নিয়ে। এরপর যেসব বিবরণ বেরিয়েছে তার অধিকাংশের সূত্র এই অষ্টম খ- যদিও পরবর্তী প্রায় বিবরণে এই সূত্রের উল্লেখ নেই। 
“নির্বিচার গণহত্যার ভেতরে ক্ষেত্রবিশেষে অগ্রাধিকারেরও একটি বিষয় ছিল। পাকিস্তানীরা তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল-১. আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের, ২. কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের, ৩. মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীদের, ৪. নারী পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায়কে এবং ৫. ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের।”
তবে সবসময় যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে হত্যা করা হয়েছিল, তা নয়। প্রথমদিকে এবং পরেও প্রথমে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। তারপর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাড়ি থেকে তুলে এনে হত্যা করা হয়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি হত্যার আগে নির্যাতনের কিছু কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে, তবে সামান্য। শাহরিয়ার নির্যাতনের বিভিন্ন বিবরণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর চিহ্নিত মাধ্যমগুলো হলো-

“নির্যাতনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যরা গ্রহণ করত তা হচ্ছে-১. অশ্লীল ভাষায় গালাগাল, তৎসঙ্গে চামড়া ফেটে না বেরুনো পর্যন্ত শারীরিক প্রহার, ২. পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, তৎসঙ্গে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার, ৩. উলঙ্গ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উন্মুক্ত স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা, ৪. সিগারেটের আগুন দিয়ে সারা শরীরে ছ্যাঁকা দেয়া, ৫. হাত ও পায়ের নখ ও মাথার ভেতর মোটা সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়া, ৬. মলদ্বারের ভেতর সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া এবং বরফখন্ড ঢুকিয়ে দেয়া, ৭. চিমটে দিয়ে হাত ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, ৮. দড়িতে পা বেঁধে ঝুলিয়ে মাথা গরম পানিতে বার বার ডোবানো, ৯. হাত-পা বেঁধে বস্তায় পুরে উত্তপ্ত রোদে ফেলে রাখা, ১০. রক্তাক্ত ক্ষতে লবণ ও মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়া, ১১. নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর বরফের সø্যাবের ওপর ফেলে রাখা, ১২. মলদ্বারে লোহার রড ঢুকিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়া, ১৩. পানি চাইলে মুখে প্রস্রাব করে দেয়া, ১৪. অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন চোখের ওপর চড়া আলোর বাল্ব জ্বেলে ঘুমোতে না দেয়া, ১৫. শরীরের স্পর্শকাতর অংশে বৈদ্যুতিক শক প্রয়োগ প্রভৃতি।”










(চলবে)

শ্রাবনের ধারার মতো ~~~ Rabindra shangeet

কী যে কষ্টের সব দিন

 ২৪ মার্চ ২০১৪  রাত ৮টা ৪৮ মিনিট

বৃষ্টি  র ঝাপটা এসে কখন যে ভিজিয়ে দিলো টের পায়নি বিজিতা।
বৈশাখ  আসবার আগেই ঝড়?
সাদা গোলাপের লতানো ঝাড়টা ঝড়ের দোলায় নুয়ে পড়েছে।
কী যে কষ্টের সব দিন
শহরটা কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে
শিরিষের ডাল টা দুলে গেলো সামনে
বলে গেলো, আচ্ছা,  বারবার জানান দিয়ে যায়
 আমার পারিপার্শ্বিকতা আমায় কোনভাবেই চাইছে না-কিন্তু আমি যে নিজে থেকে সরে যেতে পারছি না -
কী করণীয় বলতে পারো?
বিজিতি চমকে তাকায়-
কিছু বুঝে উঠবার আগেই  দখিন হাওয়ার তুমুল তান্ডবে সব যেন লন্ডভন্ড হয়ে যায়


বীরাঙ্গনা রাসমণি র পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের!




বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
মৃত্যুই ভালো ভেবে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেন
একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। হাওরে 'আফাল' (উত্তাল ঢেউয়ের উন্মাদনা), সঙ্গে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের আতঙ্ক। ভয়ে কম্পমান হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন। চোখের সামনে উজাড় হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। হাওরের পানিতে ভেসে যাচ্ছে লাশ আর লাশ। সব মিলিয়ে বিভীষিকার কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদ ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম। এমনই একদিনের কোনো এক রাতে খুব গোপনে বিয়ে হয়ে যায় মিঠামইন সদরের মেয়ে রাসমণি চক্রবর্তীর। বর মিঠামইনের কাটাখাল ইউনিয়নের ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রামের কালিকান্ত চক্রবর্তী। ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবা রামলোচন পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশের কেওয়ারজোড় গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
রাসমণির বিয়ের ঠিক চার দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নৌকাযোগে গিয়ে পুরো ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রাম ঘিরে ফেলে। তাদের সহযোগিতা করে কেওয়ারজোড় গ্রামের দালাল সাহেব আলী, তার ছেলে 'কুখ্যাত' রাজাকার কমান্ডার কোরবান আলী, মাওলানা আবু তাহের, ঘাগড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মৌলভী (ইদু মোল্লা), সোলায়মান, খুর্শিদ, মতি মিয়া, আবদুল হকসহ আরো বেশকিছু স্থানীয় রাজাকার।
শত ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের প্রায় সবাই দরিদ্র জেলে। তবে দু-একজনের আছে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রামের সব বাড়িঘর একে একে পুড়িয়ে দিয়ে লুটতরাজের উৎসবে মেতে ওঠে। শুধু তাই নয়, গ্রাম থেকে প্রায় ৭৫ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন নববিবাহিত রাসমণি, তাঁর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও।
সেই ভয়াল দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতির কথা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বর্ণনা করলেন রাসমণি। 'আমাকে আর আমার শাশুড়িকে একটি নৌকায় তোলা হয়। সেখানে আরো অনেক নারী ছিল। দেখলাম, আমার স্বামীসহ অন্যদের আরেকটি নৌকায় তোলা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্বামীকে গুলি করে জলে ফেলে দেয় ওরা। স্বামীর ফুফাতো ভাই ক্ষিতিষ ও ক্ষিতিনকে একই কায়দায় হত্যা করে তারা। আমরা তখন ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লেও মুখে কোনো শব্দ করতে পারছিলাম না। সহ্য করতে না পেরে যারা শব্দ করে কাঁদছিল, তাদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়। মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটা শিশুকে পানিতে ছুড়ে মারতে দেখলাম। শ্বশুরকে নৌকা চালানোর দায়িত্ব দেওয়ায় তাঁকে মারা হয়নি।'
রাসমণি বলেন, 'এভাবে পথে অনেককে গুলি করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে আমোদফুর্তিতে মেতে ওঠে ওরা। যারা জীবিত ছিল তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইটনার আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে অল্পবয়স্ক মেয়েদের আলাদা করে অন্যদের পরের দিন ইটনা সদরসংলগ্ন ওয়্যারলেস অফিসে স্থাপন করা রাজাকার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইটনা আর্মি ক্যাম্পে রাতে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়। সবার ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।'

সম্ভ্রম হারিয়েও অসীম সাহস ও নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে প্রাণে বেঁচে আসা বীরাঙ্গনা রাসমণির বয়স এখনো ৬০ পার হয়নি। মিঠামইন সদরের সরকারহাটিতে ছোট ভাই দরিদ্র দেবরাজ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে আছেন তিনি। শরীরে অসুখ-বিসুখ বাসা বেঁধেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। জোটে না ভালো খাবার। একাত্তরের ভয়াল স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলতে পারেন না তিনি। নির্ঘুম রাতে ওই সব দিনের স্মৃতি আওড়ে কেবল প্রলাপ বকেন। ছোট ভাই দেবরাজ বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার সর্বস্বান্ত বোনের জন্য কেউ কিছু করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কত কিছু করছে, কিন্তু আমার বোনের পাত (বাসন) শূন্যই রয়ে গেল।'

রাসমণি বলে চলেন, "সন্ধ্যার দিকে তাঁকেসহ কমবয়সী নারীদের আর্মি ক্যাম্পের কয়েকটি কক্ষে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ক্ষুুধা-তৃষ্ণায় কাতর নারীদের একটু পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ভেতরে গিয়ে দেখি, সেখানে ক্ষতবিক্ষত আরো অনেক নারী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কেউ কেউ 'একটু জল দাও, জল দাও' বলে ক্ষীণকণ্ঠে কাতরাচ্ছে। নির্যাতনে মারাত্মক আহত কারো আবার কথা বলারও শক্তি ছিল না। পুরো মেঝে রক্তে ভাসছে। গভীর রাতে কয়েকজন সৈন্য এসে আমাকে নিয়ে যায়।"

রাসমণি বলেন, 'দুই-আড়াই ঘণ্টা পর রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে আবার রেখে যায় আগের ঘরে। মাথায় চিন্তা আসে, ওরা তো নির্যাতন করে মেরেই ফেলবে। এ জীবনের চেয়ে নিজেই মরে যাওয়া ভালো। কিছুটা শক্তি ফিরে পেলে ওই ঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেই। সারা রাত হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে ইটনার উদ্ধারগাঁও গ্রামের পাড়ে কোনো রকমে উঠি। তখন ভোর হয়ে গেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিলাম, অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এ গ্রামের দুজন মুসলমান নারী আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদের সেবা ও সহায়তায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি।'

রাসমণি বলেন, 'ওই সময় মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কারো কোনো খোঁজ নেই। কে কোথায় আছে জানা ছিল না। পরে লোকজনের সহযোগিতায় কয়েক দিন পর ছত্রিশ গ্রামে ফিরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখা পাই। কিন্তু বিরান গ্রামে বসবাস করার কোনো উপায় ছিল না। এর কয়েক দিন পর বাবা আমাকে দেখতে যান। বাবা আমাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আমিও বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কত দিন পর একটু আদর পেলাম।'

রাসমণির ছোট ভাই দেবরাজ চক্রবর্তী ছোট একটি ভাঙা ঘরে স্ত্রী, সন্তান ও বোনকে নিয়ে থাকেন। তিনি গ্রামে গ্রামে পান-সুপারি ফেরি করে বেচেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। আর্থিক অনটনের কারণে বোনের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেন না। দেবরাজ বলেন, 'বোন রাসমণি আর বিয়ে করেননি। শ্বশুরও শেষ পর্যন্ত তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। স্বামীর সহায়সম্পত্তি থাকলেও কিছুই দেওয়া হয়নি তাঁকে। নিঃস্ব অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। এর মধ্যে বাবাও মারা যান। আমরা তখন ছোট। আমার বোন নেমে পড়েন আরেক যুদ্ধে। মাঠে-ঘাটে ধান কুড়িয়ে, সবজি সংগ্রহ করে, নদীতে মাছ ধরে নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। আমি কেন, দেশও তো আমার বোনের কাছে ঋণী। কিন্তু দেশ তাঁর দায়িত্ব পালন করেনি।'

মিঠামইন বাজারের হোমিও চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাস হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তিনি জানান, হাওর এলাকার বহু গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। হাওর এলাকা দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে যাতায়াত করত। তাই হাওরের প্রতি পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিশেষ নজর ছিল। আর যেহেতু হিন্দু নিধনই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই হাওরের গ্রামগুলোতে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ছিল মাত্রাতিরিক্ত।

জানা গেছে, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাসমণিরও ডাক পড়ে। ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একাত্তরে অসামান্য অবদানের জন্য 'মুক্তিযোদ্ধা নারী' হিসেবে রাসমণি সম্মাননা পান। এর আগে ২০০৮ সালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা হিসেবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মিঠামইন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সদ্য প্রয়াত রফিকুল আলম রতন ব্যক্তিগতভাবে রাসমণিকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এ টাকাও বন্ধ হয়ে গেছে।

রাসমণি আক্ষেপ করে বলেন, 'রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আমার প্রতিবেশী। তিনি স্পিকার থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা করে আমার দুর্দশার কথা বলে কিছু একটা করার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি এখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। হয়তো মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার কথা ভুলে গেছেন।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'দেখি, অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও আজ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। অনেকে অনেক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।'

১৯৭৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে রাসমণিকে নগদ এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাসমণিকে প্রশংসা ও শুভেচ্ছাপত্র দেন। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত সেই প্রশংসাপত্রটি আজও যত্ন করে ঘরে রেখে দিয়েছেন রাসমণি। এটাই তাঁর একমাত্র গর্বের ধন।

মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে ১৯৬৯ এর একুশে উদযাপন- অনালোকিত ইতিহাস



।।অনালোকিত ইতিহাস।।
জাফর ওয়াজেদ
পাকিস্হানযুগে অমর একুশের উপর কোন অনুষ্ঠান ১৯৬৯এর আগে হয় নি টেলিভিশনে-বেতারে।।
১৯৬৫সালে আইউবখান তার আত্মপ্রচারের জন্য টিভি চালু করেন।তবে ঢাকাতে ঠিভিতে যারা
যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন বাঙ্গালীসংস্কৃতি প্রতিস্ঠার কারিগর।১৯৬৯সালে যখন দেশজুড়ে
আন্দোলন তুঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে-তখন টিভি প্রযোজক মুস্তাফা মনোয়ার টিভি কর্তৃপক্ষকে 
চাপ দেন-একুশের উপর অনুষ্ঠান করার --নতুবা গণরোষের শিকার হতে হবে।
পাকিস্হান টিভি কর্তৃপক্ষ গড়িমসির পর তা মেনে নেয় । তবে শর্ত দেয় যে,"শহীদ দিবস" কথাটি 
ব্যবহার করা যাবে না।প্রস্তুতি নেওয়া হয়।অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া বাঙলাবিভাাগের
শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করার।শান্তিনিকেতনে প্রথম মুসলমান কবিগুরুর ছাত্র সুরকার আবদুল আহাদ
"হাজার বছরের বাংলাগান"-কয়েকদিন ধরে প্রশিক্ষণ দেন।
২০ফেব্রুয়ারী।সারাদেশ উত্তাল। গণ অভ্যূত্থানের মুখে দেশ।সারাদিন কারফিউ।টিভির একজন কর্মকর্তা
মাইক্র্রোবাস নিয়ে রফিকুল স্যারকে তুলে নেয়। অনেকগুলো কারফিউপাস দিয়ে ছেলেমেয়েদের তাদের বাড়ি থেকে
তোলা হয়। সারারাতধরে ভিটিআর হয়।খাওয়ানোর ব্যবস্হা অনুষ্ঠানের পরিকল্পক প্রযোজক মুস্তাফামনোয়ার আগেই করে রাখেন ।পরদিন ২১ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল।

একাত্তরের বীরযোদ্ধা সবার প্রিয় মন্টুভাই  মুস্তাফা মনোয়ারের ওই অনুষ্ঠান গণ উত্থানে প্রেরণা যেমন জোগায়
তেমন একুশের অধিকার অর্জন করেছিলো। সেদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা জীবিত--তবে ইতিহাসের এই অংশটুকু তারা না লেখায় অনালোকিত থেকে যায়।

সেই কালো রাত


 বেলা ১২টা- বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিট , শুক্রবার ,২৪ জানুয়ারী ২০১৪ , উত্তরা

যাচ্ছো কোথায়?
তোমার আমার হিসেব আছে -
একটু দাঁড়াও-

না মেটানো হিসেব গুলো
সুদ- আসলে অনেক হলো!
 সামনে তাকাও-
অস্ত্র-বোমার পথ এড়িয়ে
সৎ সাহসে বিচার মেনে  
শাস্তিটি নাও মাথা পেতে!

 পিতার বুকে বুলেট ছুঁড়ে
রাতদুপুরের নিরবতার বক্ষ চিরে
চার নেতাকে জেলে পুরে হত্যা করে 
ফেলে নিলে  বাহাত্তরের পবিত্র সেই সংবিধান-
পিতা -মাতা-  ভগ্নি -ভ্রাতার রক্ত ধারায়
 বুকের ভেতর অগ্নি শপথ নিত্য জাগায়
সেই কালো রাত  - অন্ধকারে অগ্নিস্নান !!
--------------------------------------------------------

  নীল জোছনায়
চাঁদ সুরুজের আকাশ আমার 
লাল সবুজের  বাতাস আমার
রাত্রি নিঝুম নীরবতায়-
সাগর জলের ঢেউয়ের খেলায়-
আমার ই থাক্ আমার আকাশ- বাতাস -
বারে বারে হায়নার দল কেন রে  হাত বাড়াস্??

 বীর বাঙ্গালীর পিছন থেকে ছুরি মেরে 
পালিয়ে যাবি বারে বারে?
আর হবেনা -
 পাপের ভাঁড় যে পূর্ণ হলো! একটু খানি দাঁড়াস্!
---------------------------------------------------------------------------

এই মাটিতে ঠায় দাঁড়িয়ে
লক্ষ  মানুষ এই পতাকা আজ মেলেছে মাথার উপর -
 পিতার রক্তে রাঙ্গা মাটির লাল সবুজের রক্ত শপথ 
ডাক দিয়ে যায়- 
লাল সবুজের জমিন জুড়ে রক্তে ভাসা  পিতার কবর
হাঁক দিয়ে যায় -
নুরুলদিনের এই বাংলায়
"জাগো বাহে ----
কুন্ঠে  সবাই? "
----------------------------------------------------------------------------------------

রাজীব - দীপের রক্তে জ্বলে 
আগুন হলো তরুণেরা-

রাত দুপুরে ঋষিপাড়ায় বীরাঙ্গনা মা বোনেরা 
শাঁখা সিঁদুর অশ্রুজলে সিক্ত হলো 
রক্তস্নানে রিক্ত হলো- 
এই বাংলায়-
তুই রাজাকার যাবি কোথায়?
থামতে হবে এবার তোদের-

 রাজাকারের বশংবদের টোপর পরে 
 বীর সেনাদের খতম করে
  হাওয়ার উপর বসত গড়ে- 
খুব বেড়েছিস্!

আলাউদ্দিন -আয়াত আলী খাঁ 
বিসমিল্লাহ খাঁ - আল্লারাখার
এই বাংলায় 
রবিশংকর  জর্জ হ্যারিসন  চৌরাসিয়া
এই অবেলায় ঘা মেরে তাই
জাগিয়ে গেলেন !! 
---------------------------------------------------------------------------------------------



''কবুল বলো- কন্যা তুমি কবুল বলো?''
রক্তগোলাপ -বেলির মালায় সাজিয়ে রাখা 
 দোলনা ছিল-
করুণ সুরে সানাই ছিলো-
 কতো নববধু সেই  কালো রাতে বাসর হারালো! 

না-পাকিদের পা-চাটা কুকুরের দল
লাল- সবুজে এফোঁড় ওফোঁড় বুলেট ছুঁড়ে
জলপাই রং জীপে চড়ে 
আম্মার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছিস্ রুমীদের-
সারা দেশ যেন
পাহাড়তলী -মীরপুরের ঐ বধ্যভূমি!

মইনুদ্দিন আশরাফ -  আর কসাই কাদের
সাকা - কাশেম- ম-নিজামী গোলামদের
দেখানো পথে নববধু - বীরাঙ্গনার  টুকরা টুকরা নগ্ন দেহ
পাকি সেনার ক্যাম্পের ছাদে ঝুলে থাকে-
   বাংলার নারীদের পবিত্র শরীর খুবলে রক্ত চুষে  ব্যবচ্ছেদ করে 
  চাঁদ-তারা টুপি -দাড়ির ছদ্মবেশী পাকি শকুন!!
  
 রাজাকার আলবদর শেয়ালেরা লুটে নিলো  গীর্জা মন্দির
চন্দ্র তারা জলপাই রং পতাকাতে 
গো-আযম আর  ম-নিজামীর  চেক লুঙ্গি  অট্টহাসি-
চোখে কালো কাপড় পিছমোড়া করে বাঁধা দু'হাত
 নিষ্প্রান  শহীদুল্লাহ কায়সার, মেহেরুননেসা , সেলিনা পারভীন-
না  -শিলালিপি মুছে নি-
লাল সবুজের পতাকাতে 
জেগে আছে বীরদর্পে-

 যুদ্ধবাজ আর বোমাবাজের কোলে বসে
 ভ্রষ্ট ভ্রুণের নষ্ট বীজের সন্ত্রাস আর পেট্রোল বোম
 হাজার তিনেক প্রাণ কেড়েছে '১৩ সালের শেষ প্রহরে-

আমার মায়ের আঁচল আবার রক্তে ভেসে গেলো-
বিষন্ন দিন  শেষ বিকেলে  আবার এলোমেলো-

 রক্তবানে ভেসে গেছে ভুল রমনীর ছল!
 কোন্ মেজরের ছাউনী  থেকে ঘন্টাধ্বনি বল্?
কী ভেবেছিস্ জারজ খুনির দল? 
জলপাই রং ড্রামের ভেতর-
জন্ম তোদের হয়;
 বীর বাঙ্গালীর নয় !!

ইস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁড়ে
বুদ্ধ-যিশু -ভগবানের
খোদার আসন-আরশ ছুঁয়ে 
বলেছিলাম ধিক্!
 জ্যান্ত কবর হবে  তোদের 
 এই মাটিতে  ঠিক!!

 সাকা- গিকা- মুজাহিদ-সাঈদী 
কামারুজ্জামান- গোলাম আর 
কাশেম-মওদুদী
কসাই কাদের পথ দেখালো-
তোদের সে পথ এগিয়ে এলো 
লাখো শহীদের রক্তধারায় 
 এবার জাতির জিৎ!

বীর শহীদের রক্তধারায় 
রক্তমাখা ছুরির শানে কবর খুঁড়েছিলি -
পবিত্র এই মাতৃভূমে
বীর জনতার মনের জোরে
ফাঁসির দড়ি গলায় পরে 
সেই কবরে এবার তোদের ঠাঁই!

এমন ও দিন আসবে
 যেদিন  বীর বাঙ্গালী বলবে -
" জারজ তোরা খুনি কসাই-
কবরে ঠাঁই নাই-
এ পবিত্র বাংলায়!"
 সাগর ডেকে বলবে,"তোদের
জলে ও ঠাঁই নাই!"
মর্ রে কুলাঙ্গার-
 মায়ের ঘাতক হয়ে তোরা 
হইলি  রে ছারখার!"

Sunday, March 23, 2014

মা -বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত

মানুষের জীবনে মৃত্যু হঠাৎই আসেন। আমাদের জীবনটা যেন একটানা বলে যাওয়া বিরামহীন বাক্যের মত। অনর্গল কথার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে। সেই বয়ে যাওয়ার মধ্যে কেবলমাত্র যতি চিহ্নের সঠিক প্রয়োগ যেমন সেই সব কথার সঠিক অর্থ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় তেমনি আমাদের অনন্ত চলার এই জীবনে মৃত্যুই সেই যতি চিহ্ন। সবার অলক্ষ্যে সে এসে দাঁড়ায়, আর প্রতিবার জীবনের অর্থকে আমরা নূতন ভাবে বুঝি।  এই যে থামা, মুহুর্তের জন্য পিছনে ফেরা, সেই বিরাম আমাদের চলা কে দেয় অন্য এক অর্থ, জীবনকে সে তাঁর প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিতে এনে দাঁড় করায় আমাদের সামনে। আমরা চলার পথে হঠাৎ দাঁড়িয়ে দেখি কোন পথ পেরিয়ে এলেম, কোন পথ আছে সামনে। দূর থেকে দুরান্তরে মেলি আমাদের দৃষ্টি। কত ছায়া পড়ে তাতে। মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা, রাগ দুঃখ, হতাশা, আশা, নিরাশা, উদ্বেগ, উত্তেজনা, চাওয়া পাওয়া… কতই না আলো ছায়ার খেলা সেখানে।

বাক্যে যতিচিহ্নের অবস্থানের প্রকারভেদে যেমন বাক্যের অর্থের পরিবর্তন হয়, শব্দের প্রয়োগের তারতম্য ঘটে, তেমনি মৃত্যুর আকস্মিকতা ও আমাদের চলার পথে তাঁর আগমনের ক্ষণ ও অবস্থান আমাদের জীবনের অর্থকেই দেয় পাল্টে। চলার পথের প্রারম্ভেই যদি অকস্মাৎ পড়ে অমোঘ সেই যতি চিহ্ন, তবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আক্ষেপ থেকে যায় অনেক। অকালে শেষ হয় কত প্রতিভা, ঝরে পড়ে কত আশা আকাঙ্খার মুকুল। পথ চলার আগেই শেষ হল যাত্রা। পড়ে রইল কত পথ। মন তখন বলে, “জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা”।
 আবার চলার পথে শেষের বেলায় সেই অনিবার্য যতিচিহ্নের আগমন পথশ্রমে ক্লান্ত পথিককে হয়তো দেয় এক চির শান্তির প্রলেপ। পরিশ্রান্ত আমরা শেষ বেলার পড়ন্ত মেদুর আলোয় দেখি ফেলে আসা এক অন্য আলোছায়ায় মাখানো মায়াবী জীবন।

যিনি চলে গেলেন তাঁর চলার পথে মৃত্যুর আগমন, পূর্ণচ্ছেদ এর যতিচিহ্ন স্বরূপ। কিন্তু আমরা যারা থেকে যাই, তাঁদের কাছে সেই আগমন বার্তা অর্ধচ্ছেদের মত। আমরা থামি, মুহুর্তের জন্য। কেউ বা থমকে দাঁড়ান। চলার পথে আসে এক নূতন মোড়। পথ যায় ঘুরে। অকস্মাৎ পরম নির্ভরতার সঙ্গী হারিয়ে লক্ষ্য হারায় চলা, সে চলে একা দিশেহারা। তবুও আমাদের চলতে হয়। অনন্ত চলাই জীবনের ধর্ম। গন্তব্য বলে তো কিছু নেই। চলো… চলো আলোর পথ যাত্রী। মুহুর্তের জন্য মৃত্যু যেন সেই প্রচন্ড চলার থেকে আমাদের ছিটকে এনে পথের পাশে স্থিতু হতে সাহায্য করে। আমরা চোখের পলকে চারপাশ দেখি। কোথাও তো কিছু কম দেখি না। প্রবল বেগে চলেছে জীবন।

আমরা যখনি জন্মগ্রহণ করি এই জগৎ-সংসারের সাথে এক প্রীতির সম্পর্কের সূচনা হয় সেই মুহুর্ত থেকে। চাওয়া পাওয়া প্রয়োজন, অপ্রয়োজন এরকম অনেক সরু সুতোয়, এক সুতো’র সাথে আরেক সুতোয় সূক্ষ্ম এক গিঁট বেঁধে বেঁধে বোনা সেই সম্পর্ক-জাল। যতই বয়স বাড়ে সেই সম্পর্কের জালে আমরা জড়িয়ে, সেই জালের উপর ভর করে ভেসে থাকি। এই এক একটি গিঁট এক একটি সম্পর্ক। মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে সেই জীবনের সুতোয় ছেদ ঘটায়। পরম নির্ভরের সেই ভাসমান জাল থেকে খুলে যায় এক একটি গিঁট। ঢিলে হয়ে আসে জাল। আমরা অবলম্বন হারিয়ে অসহায় বোধ করি।

নানা কিসিমের সুতোয় বোনা এই সম্পর্কের জালের ঠিক মাঝখানে কেন্দ্রে থাকে এক বিশেষ রেশমি সুতো, সেই সুতোয় ভর করেই আমাদের এই জীবনের জাল বোনা হয়। এই রেশমি সুতোয় আমাদের জীবনের প্রথম সম্পর্কের গিঁটটি বেঁধে দেন আমাদের মা। এই সুতোই আমাদের মায়ের সাথে যোগসুত্র। সেই হল আমাদের নাড়ির টান। যতদিন মা বেঁচে থাকেন ততদিন সেই টান তাঁর সন্তান সন্ততীদের প্রতি থেকে যায় সেই সুক্ষ্ম রেশমি সুতো’র মতই। যেদিন মা শরীরে আমাদের ছেড়ে চলে যান, সেই দিন আমরা বুঝতে পারি আমাদের চারপাশে আবিষ্ট সেই জীবন-জালের ভর কেন্দ্রে এক আমূল পরিবর্তন হল। প্রধান শিকড় ছিন্ন হলে যেমন যে কোনো উদ্ভিদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে ওঠে তেমনি সেই নাড়ির টানে ছেদ পড়লে আমরা এক অসহায় বিপন্নতার সম্মুখীন হই। ছিন্ন মূল আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠি।

জীবনের চলার পথে ভোরে বা শেষ বেলায় যে বেলাতেই মা চলে যান না কেন তাঁর অনুপস্থিতির এক বিপুল অসহায়ত্ব বোধ আমাদের গ্রাস করে প্রবল ভাবে। নিজের সন্তানের মধ্যে সেই রেশমি সুতো’র যে টুকরো মা রেখে গেলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা তখন আকুল হয়ে আঁকড়ে ধরি সেই দ্রুত বিলীয়মান সেই ছিন্ন টুকরোকে, হাতড়ে বেড়াই তাকে স্পর্শ করবার জন্য।

এই সঙ্কট কালে মায়ের পুত্র ও কন্যা সন্তানের মধ্যে যেন অবস্থানের এক বিপুল পার্থক্য আছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মা তাঁর মাতৃত্বের বোধ, যা তিনি তাঁর মায়ের থেকে আহরণ করেছিলেন তাই তাঁর কন্যা সন্তানের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের জন্য প্রবাহিত করে দেন। মা যতদিন থাকেন সেই মাতৃত্ব বোধ যেন কিছু সুপ্তই থেকে যায় মায়ের কন্যা সন্তানের মাঝে। মাকে হারিয়ে কন্যা সন্তান যেন নিজেই মাতৃত্বের আরেক রূপে আবির্ভূত হন। মা যাদের ছেড়ে চলে গেলেন, বাবা, ভাই বোন বা পরিবারের অন্য সবার প্রতি তাঁর এক অন্য দায়িত্ব স্নেহ ভালবাসা অধিকার জন্মায়। মা হারানোর সেই চরম সঙ্কট যেন কন্যা সন্তানের মধ্যে জন্ম দেয় এক অন্যমাপের আত্মবিশ্বাসের। মা’ই নিজে হাতে গড়ে দিয়ে যান সেই প্রতিমা। কেবল নিজে সরে গিয়ে যেন নিজের কন্যার মধ্য দিয়ে নিজেকেই উন্মোচিত করেন নূতন রূপে। তাই মাকে হারিয়ে নিজের মধ্যে মাতৃত্ব বোধের এক স্বাভাবিক উন্মোচনের ফলে মায়ের কন্যা সন্তান তাই তাঁর অসহায়ত্বের আধাঁরের মধ্যেও এক আশ্বাসের আলো দেখান। অবশ্যই এ কথা তখনিই খাটে যখন পরিণত বয়সে মা চলে যান। অবেলার ডাক পুত্র কন্যা আত্মীয় স্বজন নির্বিশেষে সবার কাছেই এক রকমের নিঃসহায় বিপর্যয়।

কিন্তু মায়ের পুত্র সন্তানের অসহায়ত্বের যেন কোনো শেষ নেই। মাতৃগর্ভ থেকেই সে তাঁর যে জীবনরস মায়ের থেকে আহরণ করতে শুরু করেছিল, জন্মের পর নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হলেও সেই প্রথম ক্ষণ থেকে সে কেবল মাকে আকঁড়েই ধরতে শিখেছে। যত সে আঁকড়ে ধরেছে মাকে মা’ও সমান ভাবে কেবলি অক্লেষে টেনে ধরে জড়িয়ে রেখেছেন। নির্ভর করেছেন। মা চলে যাওয়াতে সেই নাড়ির টান সেই পরম নির্ভরের সুক্ষ্ম রেশমি সুতো’র বাঁধন যখন চিরকালের জন্য ছিন্ন হয়ে যায় তখন তাঁর বোধ হয় এই জগৎ সংসারের সাথে সমস্ত সম্পর্কের যে প্রদীপ শিখাটি জ্বলছিল তা বুঝি নিভে গেল। মা কে হারিয়ে তাঁর পুত্র সন্তান তাই বিপুল এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে বোধ করে সে বুঝি প্রকৃতই অনাথ হল। মাতৃবিয়োগের যতিচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে তাই প্রথমবার নিজেদের অবস্থান কে কন্যা সন্তান যে পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করেন, পুত্র সন্তানকে বোধ হয় এক অন্য পরিপ্রেক্ষিতে তা বিচার করতে হয়। এতদিন আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল মা’ই বিরাজ করতেন। তাই এখন তাঁর অভাবে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় অন্য আরেক প্রেক্ষিতে – প্রকৃতির দিকে। সেখানে চলেছে এক বিচ্ছেদহীন বিরামহীন খেলা। কিছুর কমতি নেই। কোনো খামতি নেই, অসঙ্গতি নেই সেথায়।  প্রকৃতির বুকে দেখি সেখানে সেই রেশমি সুতো, যার স্পর্শে আমাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন মা, সেই সুতোয় বোনা এক অনন্ত অবিচ্ছেদ্য জাল বিছানো রয়েছে। নিজের ছন্দে আনন্দে অবলীলায় সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণ। একিই ছন্দে ধ্বংস হচ্ছে প্রাণের। নিয়ত প্রাণের এই সৃষ্টি ও ধ্বংস চলেছে এক স্বাভাবিক ছন্দে। কোনও সঙ্কট নেই, অপূর্ণতা নেই বিলাপ নেই, আক্ষেপ নেই। এই আসা যাওয়ার খেলার মধ্যে কেবল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রাণের এক উচ্ছল অনন্ত চলমান প্রকাশ। সেই প্রকাশের দ্যুতি আমাদের বুকে চমক দিয়ে বোঝায় আমাদের মা এই অনন্ত প্রাণের প্রকাশের এক অংশ মাত্র। নিজের শরীর নিংড়ে তিনি আমাদের সৃষ্টি করে, প্রতিষ্ঠা করেছেন, যুক্ত করেছেন এই প্রাণের চলার পথে। আমাদের যোগ সৃষ্টি করেছেন মূল প্রাণের ধারার সাথে। মা যদি না যেতেন, চিরকাল থাকতেন তবে তো আমাদের মা’র আসল পরিচয় আমরা পেতামই না। তাঁর উপস্থিতি এত বিরাট এত বিপুল এত তীব্র যে তিনি থেকে গেলে বুঝতামই না, আমার মা আসলে প্রকৃতিতে বিরাজমান বিশ্বমাতৃ শক্তিরই এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির মূহুর্ত থেকে প্রতি মুহুর্তে প্রতি প্রাণে প্রতি জীবে মা নিশঃব্দে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, প্রাণ সৃষ্টি করে তাকে পালন করে প্রাণের এই অনন্ত চলাকেই অব্যাহত রেখেছেন তিনি। কাজ শেষে স্বাভাবিক ভাবেই মিশে যাচ্ছেন সেই বৃহৎ মাতৃ শক্তিতে।  তাই তাঁর বিদায়ের মুহুর্তে আজ দাঁড়িয়ে নিজের বিচ্ছেদের অপূর্ণতা কে বড় না করে দেখে যদি এই প্রাণের আনন্দের মাঝে মায়ের মিলনের সাথে নিজের মন কে মেলাতে সচেষ্ট হই, তবে এই চরম বিচ্ছেদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর থেকে উত্তরীত হয়ে আমরা পাব এক প্রকৃত পূর্ণতার আস্বাদ।

(আজ থেকে ৯ বছর আগে আমার শাশুড়ি মায়ের চলে যাবার পর এই লেখা লিখে ছিলাম। এর পরে আমার নিজের মা কেও হারিয়েছি। সম্প্রতি আমার সহপাঠী ভাস্করের মা চলে গেলেন। খেলা ভাঙ্গার খেলতে মাসিমা চলে গেলেন, সাথে আমাদের ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার একটা বিরাট সময় হারিয়ে গেল।)

সঙ্গের ছবিটি পাবলো পিকাসো’র আঁকা মা ও ছেলে ১৯২২

হিন্দুরা আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক', কিন্তু প্রাপ্তি কি? শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।



বাংলাদেশে হিন্দুদের বলা হয় আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক'।
ঘটনাও তাই। হিন্দুরা এ যাবতকাল আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক'-ই ছিলো এবং আছে। এর অবশ্য কারণও আছে। উপায় কি, অন্য কাকে ভোট দেবে? বাদবাকী সবাই তো 'পাকিস্তান জিন্দবাদ'  মার্কা দল, যারা হিন্দুদের মানুষই মনে করেনা, কথায় কথায় বলে, এটা মুসলমানের দেশ; হিন্দুদের স্থান ভারতে। প্রকাশ্যে হিন্দুদের বিরুদ্বে বিষোদগার আমরা বহু দেখেছি। আওয়ামী লীগ ভেতরে যাই করুক না কেন ওপরে অন্তত: ভালো মানুষি দেখায়। সুতারং হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেনা তো কাকে দেবে?

ভোট ব্যাঙ্কের সুবিধা হয়তো আছে; অসুবিধাও আছে. হিন্দুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক বলেই প্রাপ্তি কম। সন্ত্রাস বা স্বাধীনতার বিরোধীতা করা সত্বেও জামাতের ৩% ভোট নিয়ে তারা দর কষাকষি করে; জাপা ৭% ভোট নিয়ে এমনকি বিরোধী দলীয় নেতাও হন। আর কমবেশী ১২-১৬% ভোট নিয়ে হিন্দুদের শুধু প্রতিমন্ত্রী বা নেপালের রাষ্ট্রদূত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ প্রতিটি নির্বাচনের আগে পরে বা বিভিন্ন সময়ে খেসারত দিতে হয় হিন্দুদেরই। সম্ভবত: ২০১৩ সালে মন্ত্রী বীরেন শিকদার নিউইয়র্কে এসেছিলেন, তখন তিনি এমপি। এক সভায় তিনি বলেছিলেন, শুধু সমর্থন করা নয়, হিন্দুদের উচিত সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ করা। বিভিন্ন কমিটিতে স্থান করে নেয়া এবং নিজেদের অধিকারের কথা বলা। এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু প্রায়শ: বলেন, 'আমাকে তো মুসলমানরা ভোট দিয়ে জেতায়; তারা যদি আমাকে জেতাতে পারে তবে হিন্দুদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার প্রতিও তাদের সমর্থন থাকবে। মন্ত্রী বীরেন শিকদারের কথায় সেদিনও একমত ছিলাম, আজো একমত আছি। হিন্দুদের শুধু ভোট ব্যাঙ্ক থাকলেই চলবে না; দলে সক্রিয় হতে হবে। ভেতরে, বাইরে অধিকারের কথা বলতে হবে।

হিন্দুরা এখন পর্যন্ত যা পাচ্ছে, তা বকশিশ। হিসাবের পাওনা পেতে হলে হিন্দুদের দলের ভেতরে থেকেই তা পেতে হবে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বলছি কেন? প্রথাগতভাবে হিন্দুরা আওয়ামী লীগ বা বামঘেষা দলগুলোর সাথে জড়িত। এর অন্যতম কারণ, ঐসব দলগুলো অন্তত: অসম্প্রাদায়িকতার কথা বলে, পালন করে কি করেনা সেটা ভিন্ন কথা, বলে তো? বিএনপি-জামাত সাম্প্রদায়িক দল; এদের বক্তব্য রাষ্ট্র পর্যায়ে ধর্ম কায়েম করা। ধর্ম কায়েম মানে হলো পাকিস্তান, বা ইরান, আফগানিস্থান অর্থাৎ 'সংখ্যালঘু, গেট আউট'। হিন্দুদের দলে টানতে হলে বিএনপিকে এর নীতি পাল্টাতে হবে, নইলে দু'একজন গয়েশ্বরকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সুতরাং হিন্দুদের আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে হবে। তবে শুধু ভোট ব্যাংক হিসাবেই নয়; কিছুটা বোঝাপড়া করে এবং সেটা সম্ভব দলের ভেতরে সক্রিয় থেকে।

কেউ এখন স্বীকার করুন বা না করুন, হিন্দুদের মনে রাখতে হবে ৭৫-এর পর জগন্নাথ হলই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে ধরে রেখেছিলো। জুলফিকার আলী ভুট্রো বাংলাদেশ এলে তার গাড়িতে যে পাকিস্তান বিরোধী লিফলেটটি দেয়া হয়েছিলো অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনারেল জিয়াকে যে ছাত্র ধাক্কা মেরেছিলো সেও জগন্নাথ হলের। অসম্প্রদায়িক মুসলমানদের সমর্থনেই এসব সম্ভব হয়েছিলো। হিন্দুদের অধিকারের কথা উঠলে প্রগতিশীল মুসলমানদের সমর্থনেই তা আদায় হবে। বিএনপি-জামাতের বিরুদ্বে তো হিন্দুরা আছেই; এমনকি আওয়ামী লীগ অত্যাচার করলে তার বিরুদ্বেও সোচ্চার হতে হবে। মনে আছে ২০০৩ সালে আমি জেনভায় সংখ্যালঘুদের এক সভায় বক্তব্য রাখি। জেনেভাতে ক'জন আর হিন্দু, উপস্থিত মানুষজনের ৮০%ই ছিলো মুসলমান, সব দলের। স্থানীয় নেতারা যখন বক্তব্য দিলেন, তখন তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, বন্ধু মুসলমানদের মনে যাতে সামান্য আঁচর না লাগে। অবাক হলাম। তাই আমার বক্তব্যের শুরুতেই আমি বললাম, 'আমি যা বলবো, তাতে যদি আমার বন্ধু রশিদভাই(ঐসময়কার আওয়ামী লীগ সভাপতি) মনে দু:খ পান তবে বুঝবো তিনি আমার বন্ধু নন, কারণ আমার কথা, আমার দু:খ, আমাকে বলতে হবে। আমি শুরুই করেছিলাম একথা বলে যে, এবার (২০০১) হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচারের স্ট্রীমরোল চলেছিলো তখন আওয়ামী লীগ হিন্দুদের পাশে ছিলনা (অবশ্য আওয়ামী লীগও তখন অত্যাচারিত)। একই কথা জননেত্রী শেখ হাসিনা যুক্ত্ররাস্ট এলে তাকেও বলেছিলাম; তিনি মানেননি। যুক্ত্ররাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাকে দিয়ে তা প্রত্যাহারও করিয়েছিলেন, তবে বলেছিলাম, আমি প্রত্যাহার করলেও হিন্দুদের মন থেকে তা প্রতাহৃত হয়ে যাবেনা। কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, উনি আমেরিকায় থেকে লম্বা লম্বা কথা বলছেন। হয়তো কিছুটা তাই, তবে আমার জোরটা ওখানে নয়; আমার জোর আমি জন্ম থেকে আওয়ামী লীগ করি, আমার অধিকার কম কিসে? এমনকি এজন্যে সুরঞ্জিত্দাকে পর্যন্ত ঠাট্টা করে বলেছি, 'দাদা, আপনি আওয়ামী লীগে জয়েন করেছেন, আমি আজন্ম আওয়ামী লীগ।' আমার এমন সব কথাবার্তার পরও কিন্তু রশিদভাই আজো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু; শেখ হাসিনা আমার নেত্রী বা সুরঞ্জিত্দা আমার দাদা।

আমার এক বন্ধুকে একবার ইউরোপে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, অত্যাচার তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপি সবাই করে, তবু হিন্দুরা আওয়ামী লীগের পিছনে, এর কারণ কি? তিনি বলেন, অন্যান্য অনেক কারণ আছে; তবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের তফাতটা হলো, দুজনেরই লক্ষ্য হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িটা দখল করা; বিএনপি সেটা করবে গায়ের জোরে; আর আওয়ামী লীগ চুপি চুপি বলবে, বাবু, থাকতে তো পারবেন না; বাড়িটা আমাকে দিয়ে গেলে আমি ভালো দাম দেবো, এবং আপনাকে নিরাপদে বর্ডার পার করার ব্যবস্থা করে দেবো। হিন্দুর কাছে শেষের প্রস্তাবটা সহনীয়, অনিচ্ছা সত্বেও তাকে তাতেই রাজি হতে হয়। ভোটের ব্যাপারটাও তাই। বিএনপি-কে ভোট দিলেও বিএনপি বিশ্বাস করেনা। তাই মন্দের ভালো আওয়ামী লীগকেই  হিন্দুরা ভোটটি দেয়।

হিন্দুরা ধর্মনিরপেক্ষতা চায়। বিএনপি তাতে বিশ্বাস করেনা। আওয়ামী লীগ মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, কাজ করে উল্টো। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর কথা না-ই বা বললাম। প্রফেসর আবুল বারাকাতের হিসাব মত, শত্রু সম্পত্তির ৭০% আওয়ামী লীগারদের দখলে। অর্পিত সম্পত্তি'র সুরাহা আজো হয়নি।  পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামেই কেবল হয়েছে, কাজে কিছুই হয়নি। ১৯৭২ সালে অষ্টমী পূজার দিন সারাদেশে একসাথে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙ্গা হয়; সেইধারা আজো চলছে; এপর্যন্ত কেউ বিচারের মুখোমুখি হননি বা কেউ শাস্তি পাননি। আমার এলাকার এমপি দীপুমনি পররাস্ট্রমন্ত্রী হয়ে এলে তাকে বলেছিলাম, ৪৫বছর আমরা শত্রুসম্পত্তি আইনের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছি। উনি বলেছিলেন, দাদা, ৪৫ বছর হয়ে গেছে? আসলে পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার শুরু হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তা কখনো তা থেমে থাকেনি; এবং তা আজো কমবেশি চলছে, কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে, কখনো বেসরকারিভাবে। ২০০১-এর তান্ডব হয়তো এখন নাই, কিন্তু অত্যাচার তো থেমে নেই। অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে, দিয়ে লাভ নেই। এবার আওয়ামী লীগের আমলেও সমানে অত্যাচার হয়েছে বা হচ্ছে। তারপরও ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনে হিন্দুরা ভোট দিতে গেছে এবং আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছে। বারবার ভোট দিয়ে, বারবার অত্যাচারিত হয়েও হিন্দুরা প্রশ্ন করছে, এজন্যে কি আমরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেই?

আসলে হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, কারণ অন্যরা কখনো ভোট নেয়ার চেষ্টা করেনি। ২০০৮-এ প্রথম বারের মত হিন্দুরা শান্তিতে ভোট দিতে পেরেছে। বলা বাহুল্য, সব ভোট আওয়ামী লীগ পেয়েছে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে হলে ১০০% হিন্দু ভোট চাই। এমনকি, ২০০৮-এও একথা সত্য। হিসাবটা এরকম, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮% ভোট; বিএনপি ৩২%। হিন্দুভোট ছিলো ১৬%। সুতারং ৪৮-১৬=৩২%। তাই, হিন্দু ভোট না পেলে এমন বিজয় অর্জন আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। যদিও ২০০৮-এর কথা ভিন্ন। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগকে ১০০% হিন্দু ভোট চাই-ই। বিএনপি যদি ৫-১০% শতাংশ হিন্দু ভোট নিতে পারে, তবে ফলাফল উল্টে যেতে বাধ্য। হিসাব করলে দেখা যাবে, যদি ২০০৮-এর মত ভোট হয়; তাতে অন্তত: ১০০সীটে হিন্দুরা যার পক্ষে যাবে, তিনিই জিতবেন। কারণ, এখন সংসদ প্রার্থীরা জেতেন ৮/১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। হিন্দু ভোট সেখানে নিয়ামক ভুমিকা পালন করতে পারে। আবারো বলছি, ভোট সুষ্ঠু হলেই কেবল সেটা সম্ভব। বিএনপি-জামাত এ হিসাবটা জানে, তাই তারা হিন্দু খেদাতে চায়। আওয়ামী লীগ জানলেও মানেনা। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে অতীতে কখনো হিন্দুরা শান্তিতে ভোট দিতে পারেনি। প্রতিটি নির্বাচনের পর অকারণে হিন্দুরা নির্যাতিত হয়েছে। সেটা আওয়ামী লীগ জিতলেও হয়েছে; বিএনপি জিতলেও হয়েছে। জানুয়ারীর নির্বাচনের পরও হয়েছে। প্রশাসন অন্যের ওপর দাযিত্ব চাপিয়ে তার কর্তব্য শেষ করেছে।

'গিভ এন্ড টেক' রাজনীতির নিয়ম। হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক থেকেও শুধুই 'গিভ' করেছে। 'টেক' করার সুযোগ কখনো পায়নি বা নেয়ার চেষ্টাও করেনি। জাতীয় পর্যায়ে হিন্দু নেত্রিত্ব নাই, বা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলার লোক নাই; থাকলে ''গিভ এন্ড টেক' রাজনীতি শুরু হতে পারতো। গণতন্ত্র বা সমষ্টির নেত্রিত্ব চালু থাকলে রাজনৈতিক দর কষাকষির সুবিধা থাকে। এটা দোষের কিছু নয়। সুভাষ বসু বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।' হিন্দুরাও বলতে পারবেন, 'তোমরা আমদের অধিকার দাও, আমরা তোমাদের ভোট দেবো।' অনেকে বলেন, 'হিন্দুর কাছে যাহা আওয়ামী লীগ, তাহাই বিএনপি হওয়া উচিত'; আমি তাতে একমত নই। তবে কিছু অর্জনই যদি না থাকে তবে, ভোট ব্যাঙ্ক থেকে লাভ কি, এমন ভোটের মূল্য কেউ দেয়না, আওয়ামী লীগই বা দেবে কেন?

নিউইয়র্ক, ২২শে মার্চ ২০১৪।