Monday, March 24, 2014

বীরাঙ্গনা রাসমণি র পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের!




বীরঙ্গনার বিপর্যয়গাথা
মৃত্যুই ভালো ভেবে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেন
একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। হাওরে 'আফাল' (উত্তাল ঢেউয়ের উন্মাদনা), সঙ্গে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের আতঙ্ক। ভয়ে কম্পমান হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন। চোখের সামনে উজাড় হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। হাওরের পানিতে ভেসে যাচ্ছে লাশ আর লাশ। সব মিলিয়ে বিভীষিকার কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদ ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম। এমনই একদিনের কোনো এক রাতে খুব গোপনে বিয়ে হয়ে যায় মিঠামইন সদরের মেয়ে রাসমণি চক্রবর্তীর। বর মিঠামইনের কাটাখাল ইউনিয়নের ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রামের কালিকান্ত চক্রবর্তী। ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবা রামলোচন পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশের কেওয়ারজোড় গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
রাসমণির বিয়ের ঠিক চার দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নৌকাযোগে গিয়ে পুরো ছত্রিশ-ঢালারগাঁও গ্রাম ঘিরে ফেলে। তাদের সহযোগিতা করে কেওয়ারজোড় গ্রামের দালাল সাহেব আলী, তার ছেলে 'কুখ্যাত' রাজাকার কমান্ডার কোরবান আলী, মাওলানা আবু তাহের, ঘাগড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মৌলভী (ইদু মোল্লা), সোলায়মান, খুর্শিদ, মতি মিয়া, আবদুল হকসহ আরো বেশকিছু স্থানীয় রাজাকার।
শত ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের প্রায় সবাই দরিদ্র জেলে। তবে দু-একজনের আছে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রামের সব বাড়িঘর একে একে পুড়িয়ে দিয়ে লুটতরাজের উৎসবে মেতে ওঠে। শুধু তাই নয়, গ্রাম থেকে প্রায় ৭৫ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন নববিবাহিত রাসমণি, তাঁর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও।
সেই ভয়াল দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতির কথা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বর্ণনা করলেন রাসমণি। 'আমাকে আর আমার শাশুড়িকে একটি নৌকায় তোলা হয়। সেখানে আরো অনেক নারী ছিল। দেখলাম, আমার স্বামীসহ অন্যদের আরেকটি নৌকায় তোলা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্বামীকে গুলি করে জলে ফেলে দেয় ওরা। স্বামীর ফুফাতো ভাই ক্ষিতিষ ও ক্ষিতিনকে একই কায়দায় হত্যা করে তারা। আমরা তখন ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লেও মুখে কোনো শব্দ করতে পারছিলাম না। সহ্য করতে না পেরে যারা শব্দ করে কাঁদছিল, তাদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়। মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটা শিশুকে পানিতে ছুড়ে মারতে দেখলাম। শ্বশুরকে নৌকা চালানোর দায়িত্ব দেওয়ায় তাঁকে মারা হয়নি।'
রাসমণি বলেন, 'এভাবে পথে অনেককে গুলি করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে আমোদফুর্তিতে মেতে ওঠে ওরা। যারা জীবিত ছিল তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইটনার আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে অল্পবয়স্ক মেয়েদের আলাদা করে অন্যদের পরের দিন ইটনা সদরসংলগ্ন ওয়্যারলেস অফিসে স্থাপন করা রাজাকার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইটনা আর্মি ক্যাম্পে রাতে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়। সবার ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।'

সম্ভ্রম হারিয়েও অসীম সাহস ও নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে প্রাণে বেঁচে আসা বীরাঙ্গনা রাসমণির বয়স এখনো ৬০ পার হয়নি। মিঠামইন সদরের সরকারহাটিতে ছোট ভাই দরিদ্র দেবরাজ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে আছেন তিনি। শরীরে অসুখ-বিসুখ বাসা বেঁধেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। জোটে না ভালো খাবার। একাত্তরের ভয়াল স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলতে পারেন না তিনি। নির্ঘুম রাতে ওই সব দিনের স্মৃতি আওড়ে কেবল প্রলাপ বকেন। ছোট ভাই দেবরাজ বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার সর্বস্বান্ত বোনের জন্য কেউ কিছু করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কত কিছু করছে, কিন্তু আমার বোনের পাত (বাসন) শূন্যই রয়ে গেল।'

রাসমণি বলে চলেন, "সন্ধ্যার দিকে তাঁকেসহ কমবয়সী নারীদের আর্মি ক্যাম্পের কয়েকটি কক্ষে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ক্ষুুধা-তৃষ্ণায় কাতর নারীদের একটু পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ভেতরে গিয়ে দেখি, সেখানে ক্ষতবিক্ষত আরো অনেক নারী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কেউ কেউ 'একটু জল দাও, জল দাও' বলে ক্ষীণকণ্ঠে কাতরাচ্ছে। নির্যাতনে মারাত্মক আহত কারো আবার কথা বলারও শক্তি ছিল না। পুরো মেঝে রক্তে ভাসছে। গভীর রাতে কয়েকজন সৈন্য এসে আমাকে নিয়ে যায়।"

রাসমণি বলেন, 'দুই-আড়াই ঘণ্টা পর রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে আবার রেখে যায় আগের ঘরে। মাথায় চিন্তা আসে, ওরা তো নির্যাতন করে মেরেই ফেলবে। এ জীবনের চেয়ে নিজেই মরে যাওয়া ভালো। কিছুটা শক্তি ফিরে পেলে ওই ঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে হাওরের পানিতে ঝাঁপ দেই। সারা রাত হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে ইটনার উদ্ধারগাঁও গ্রামের পাড়ে কোনো রকমে উঠি। তখন ভোর হয়ে গেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিলাম, অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এ গ্রামের দুজন মুসলমান নারী আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদের সেবা ও সহায়তায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি।'

রাসমণি বলেন, 'ওই সময় মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কারো কোনো খোঁজ নেই। কে কোথায় আছে জানা ছিল না। পরে লোকজনের সহযোগিতায় কয়েক দিন পর ছত্রিশ গ্রামে ফিরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখা পাই। কিন্তু বিরান গ্রামে বসবাস করার কোনো উপায় ছিল না। এর কয়েক দিন পর বাবা আমাকে দেখতে যান। বাবা আমাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আমিও বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কত দিন পর একটু আদর পেলাম।'

রাসমণির ছোট ভাই দেবরাজ চক্রবর্তী ছোট একটি ভাঙা ঘরে স্ত্রী, সন্তান ও বোনকে নিয়ে থাকেন। তিনি গ্রামে গ্রামে পান-সুপারি ফেরি করে বেচেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। আর্থিক অনটনের কারণে বোনের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেন না। দেবরাজ বলেন, 'বোন রাসমণি আর বিয়ে করেননি। শ্বশুরও শেষ পর্যন্ত তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। স্বামীর সহায়সম্পত্তি থাকলেও কিছুই দেওয়া হয়নি তাঁকে। নিঃস্ব অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। এর মধ্যে বাবাও মারা যান। আমরা তখন ছোট। আমার বোন নেমে পড়েন আরেক যুদ্ধে। মাঠে-ঘাটে ধান কুড়িয়ে, সবজি সংগ্রহ করে, নদীতে মাছ ধরে নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। আমি কেন, দেশও তো আমার বোনের কাছে ঋণী। কিন্তু দেশ তাঁর দায়িত্ব পালন করেনি।'

মিঠামইন বাজারের হোমিও চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাস হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তিনি জানান, হাওর এলাকার বহু গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। হাওর এলাকা দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে যাতায়াত করত। তাই হাওরের প্রতি পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিশেষ নজর ছিল। আর যেহেতু হিন্দু নিধনই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই হাওরের গ্রামগুলোতে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ছিল মাত্রাতিরিক্ত।

জানা গেছে, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাসমণিরও ডাক পড়ে। ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একাত্তরে অসামান্য অবদানের জন্য 'মুক্তিযোদ্ধা নারী' হিসেবে রাসমণি সম্মাননা পান। এর আগে ২০০৮ সালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা হিসেবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মিঠামইন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সদ্য প্রয়াত রফিকুল আলম রতন ব্যক্তিগতভাবে রাসমণিকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এ টাকাও বন্ধ হয়ে গেছে।

রাসমণি আক্ষেপ করে বলেন, 'রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আমার প্রতিবেশী। তিনি স্পিকার থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা করে আমার দুর্দশার কথা বলে কিছু একটা করার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি এখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। হয়তো মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার কথা ভুলে গেছেন।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'দেখি, অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও আজ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। অনেকে অনেক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।'

১৯৭৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে রাসমণিকে নগদ এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাসমণিকে প্রশংসা ও শুভেচ্ছাপত্র দেন। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত সেই প্রশংসাপত্রটি আজও যত্ন করে ঘরে রেখে দিয়েছেন রাসমণি। এটাই তাঁর একমাত্র গর্বের ধন।

No comments:

Post a Comment