Sunday, March 23, 2014

হিন্দুরা আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক', কিন্তু প্রাপ্তি কি? শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।



বাংলাদেশে হিন্দুদের বলা হয় আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক'।
ঘটনাও তাই। হিন্দুরা এ যাবতকাল আওয়ামী লীগের 'ভোট ব্যাঙ্ক'-ই ছিলো এবং আছে। এর অবশ্য কারণও আছে। উপায় কি, অন্য কাকে ভোট দেবে? বাদবাকী সবাই তো 'পাকিস্তান জিন্দবাদ'  মার্কা দল, যারা হিন্দুদের মানুষই মনে করেনা, কথায় কথায় বলে, এটা মুসলমানের দেশ; হিন্দুদের স্থান ভারতে। প্রকাশ্যে হিন্দুদের বিরুদ্বে বিষোদগার আমরা বহু দেখেছি। আওয়ামী লীগ ভেতরে যাই করুক না কেন ওপরে অন্তত: ভালো মানুষি দেখায়। সুতারং হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেনা তো কাকে দেবে?

ভোট ব্যাঙ্কের সুবিধা হয়তো আছে; অসুবিধাও আছে. হিন্দুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক বলেই প্রাপ্তি কম। সন্ত্রাস বা স্বাধীনতার বিরোধীতা করা সত্বেও জামাতের ৩% ভোট নিয়ে তারা দর কষাকষি করে; জাপা ৭% ভোট নিয়ে এমনকি বিরোধী দলীয় নেতাও হন। আর কমবেশী ১২-১৬% ভোট নিয়ে হিন্দুদের শুধু প্রতিমন্ত্রী বা নেপালের রাষ্ট্রদূত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ প্রতিটি নির্বাচনের আগে পরে বা বিভিন্ন সময়ে খেসারত দিতে হয় হিন্দুদেরই। সম্ভবত: ২০১৩ সালে মন্ত্রী বীরেন শিকদার নিউইয়র্কে এসেছিলেন, তখন তিনি এমপি। এক সভায় তিনি বলেছিলেন, শুধু সমর্থন করা নয়, হিন্দুদের উচিত সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ করা। বিভিন্ন কমিটিতে স্থান করে নেয়া এবং নিজেদের অধিকারের কথা বলা। এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু প্রায়শ: বলেন, 'আমাকে তো মুসলমানরা ভোট দিয়ে জেতায়; তারা যদি আমাকে জেতাতে পারে তবে হিন্দুদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার প্রতিও তাদের সমর্থন থাকবে। মন্ত্রী বীরেন শিকদারের কথায় সেদিনও একমত ছিলাম, আজো একমত আছি। হিন্দুদের শুধু ভোট ব্যাঙ্ক থাকলেই চলবে না; দলে সক্রিয় হতে হবে। ভেতরে, বাইরে অধিকারের কথা বলতে হবে।

হিন্দুরা এখন পর্যন্ত যা পাচ্ছে, তা বকশিশ। হিসাবের পাওনা পেতে হলে হিন্দুদের দলের ভেতরে থেকেই তা পেতে হবে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বলছি কেন? প্রথাগতভাবে হিন্দুরা আওয়ামী লীগ বা বামঘেষা দলগুলোর সাথে জড়িত। এর অন্যতম কারণ, ঐসব দলগুলো অন্তত: অসম্প্রাদায়িকতার কথা বলে, পালন করে কি করেনা সেটা ভিন্ন কথা, বলে তো? বিএনপি-জামাত সাম্প্রদায়িক দল; এদের বক্তব্য রাষ্ট্র পর্যায়ে ধর্ম কায়েম করা। ধর্ম কায়েম মানে হলো পাকিস্তান, বা ইরান, আফগানিস্থান অর্থাৎ 'সংখ্যালঘু, গেট আউট'। হিন্দুদের দলে টানতে হলে বিএনপিকে এর নীতি পাল্টাতে হবে, নইলে দু'একজন গয়েশ্বরকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সুতরাং হিন্দুদের আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে হবে। তবে শুধু ভোট ব্যাংক হিসাবেই নয়; কিছুটা বোঝাপড়া করে এবং সেটা সম্ভব দলের ভেতরে সক্রিয় থেকে।

কেউ এখন স্বীকার করুন বা না করুন, হিন্দুদের মনে রাখতে হবে ৭৫-এর পর জগন্নাথ হলই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে ধরে রেখেছিলো। জুলফিকার আলী ভুট্রো বাংলাদেশ এলে তার গাড়িতে যে পাকিস্তান বিরোধী লিফলেটটি দেয়া হয়েছিলো অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনারেল জিয়াকে যে ছাত্র ধাক্কা মেরেছিলো সেও জগন্নাথ হলের। অসম্প্রদায়িক মুসলমানদের সমর্থনেই এসব সম্ভব হয়েছিলো। হিন্দুদের অধিকারের কথা উঠলে প্রগতিশীল মুসলমানদের সমর্থনেই তা আদায় হবে। বিএনপি-জামাতের বিরুদ্বে তো হিন্দুরা আছেই; এমনকি আওয়ামী লীগ অত্যাচার করলে তার বিরুদ্বেও সোচ্চার হতে হবে। মনে আছে ২০০৩ সালে আমি জেনভায় সংখ্যালঘুদের এক সভায় বক্তব্য রাখি। জেনেভাতে ক'জন আর হিন্দু, উপস্থিত মানুষজনের ৮০%ই ছিলো মুসলমান, সব দলের। স্থানীয় নেতারা যখন বক্তব্য দিলেন, তখন তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, বন্ধু মুসলমানদের মনে যাতে সামান্য আঁচর না লাগে। অবাক হলাম। তাই আমার বক্তব্যের শুরুতেই আমি বললাম, 'আমি যা বলবো, তাতে যদি আমার বন্ধু রশিদভাই(ঐসময়কার আওয়ামী লীগ সভাপতি) মনে দু:খ পান তবে বুঝবো তিনি আমার বন্ধু নন, কারণ আমার কথা, আমার দু:খ, আমাকে বলতে হবে। আমি শুরুই করেছিলাম একথা বলে যে, এবার (২০০১) হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচারের স্ট্রীমরোল চলেছিলো তখন আওয়ামী লীগ হিন্দুদের পাশে ছিলনা (অবশ্য আওয়ামী লীগও তখন অত্যাচারিত)। একই কথা জননেত্রী শেখ হাসিনা যুক্ত্ররাস্ট এলে তাকেও বলেছিলাম; তিনি মানেননি। যুক্ত্ররাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাকে দিয়ে তা প্রত্যাহারও করিয়েছিলেন, তবে বলেছিলাম, আমি প্রত্যাহার করলেও হিন্দুদের মন থেকে তা প্রতাহৃত হয়ে যাবেনা। কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, উনি আমেরিকায় থেকে লম্বা লম্বা কথা বলছেন। হয়তো কিছুটা তাই, তবে আমার জোরটা ওখানে নয়; আমার জোর আমি জন্ম থেকে আওয়ামী লীগ করি, আমার অধিকার কম কিসে? এমনকি এজন্যে সুরঞ্জিত্দাকে পর্যন্ত ঠাট্টা করে বলেছি, 'দাদা, আপনি আওয়ামী লীগে জয়েন করেছেন, আমি আজন্ম আওয়ামী লীগ।' আমার এমন সব কথাবার্তার পরও কিন্তু রশিদভাই আজো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু; শেখ হাসিনা আমার নেত্রী বা সুরঞ্জিত্দা আমার দাদা।

আমার এক বন্ধুকে একবার ইউরোপে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, অত্যাচার তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপি সবাই করে, তবু হিন্দুরা আওয়ামী লীগের পিছনে, এর কারণ কি? তিনি বলেন, অন্যান্য অনেক কারণ আছে; তবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের তফাতটা হলো, দুজনেরই লক্ষ্য হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িটা দখল করা; বিএনপি সেটা করবে গায়ের জোরে; আর আওয়ামী লীগ চুপি চুপি বলবে, বাবু, থাকতে তো পারবেন না; বাড়িটা আমাকে দিয়ে গেলে আমি ভালো দাম দেবো, এবং আপনাকে নিরাপদে বর্ডার পার করার ব্যবস্থা করে দেবো। হিন্দুর কাছে শেষের প্রস্তাবটা সহনীয়, অনিচ্ছা সত্বেও তাকে তাতেই রাজি হতে হয়। ভোটের ব্যাপারটাও তাই। বিএনপি-কে ভোট দিলেও বিএনপি বিশ্বাস করেনা। তাই মন্দের ভালো আওয়ামী লীগকেই  হিন্দুরা ভোটটি দেয়।

হিন্দুরা ধর্মনিরপেক্ষতা চায়। বিএনপি তাতে বিশ্বাস করেনা। আওয়ামী লীগ মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, কাজ করে উল্টো। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর কথা না-ই বা বললাম। প্রফেসর আবুল বারাকাতের হিসাব মত, শত্রু সম্পত্তির ৭০% আওয়ামী লীগারদের দখলে। অর্পিত সম্পত্তি'র সুরাহা আজো হয়নি।  পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামেই কেবল হয়েছে, কাজে কিছুই হয়নি। ১৯৭২ সালে অষ্টমী পূজার দিন সারাদেশে একসাথে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙ্গা হয়; সেইধারা আজো চলছে; এপর্যন্ত কেউ বিচারের মুখোমুখি হননি বা কেউ শাস্তি পাননি। আমার এলাকার এমপি দীপুমনি পররাস্ট্রমন্ত্রী হয়ে এলে তাকে বলেছিলাম, ৪৫বছর আমরা শত্রুসম্পত্তি আইনের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছি। উনি বলেছিলেন, দাদা, ৪৫ বছর হয়ে গেছে? আসলে পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার শুরু হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তা কখনো তা থেমে থাকেনি; এবং তা আজো কমবেশি চলছে, কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে, কখনো বেসরকারিভাবে। ২০০১-এর তান্ডব হয়তো এখন নাই, কিন্তু অত্যাচার তো থেমে নেই। অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে, দিয়ে লাভ নেই। এবার আওয়ামী লীগের আমলেও সমানে অত্যাচার হয়েছে বা হচ্ছে। তারপরও ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনে হিন্দুরা ভোট দিতে গেছে এবং আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছে। বারবার ভোট দিয়ে, বারবার অত্যাচারিত হয়েও হিন্দুরা প্রশ্ন করছে, এজন্যে কি আমরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেই?

আসলে হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, কারণ অন্যরা কখনো ভোট নেয়ার চেষ্টা করেনি। ২০০৮-এ প্রথম বারের মত হিন্দুরা শান্তিতে ভোট দিতে পেরেছে। বলা বাহুল্য, সব ভোট আওয়ামী লীগ পেয়েছে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে হলে ১০০% হিন্দু ভোট চাই। এমনকি, ২০০৮-এও একথা সত্য। হিসাবটা এরকম, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮% ভোট; বিএনপি ৩২%। হিন্দুভোট ছিলো ১৬%। সুতারং ৪৮-১৬=৩২%। তাই, হিন্দু ভোট না পেলে এমন বিজয় অর্জন আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। যদিও ২০০৮-এর কথা ভিন্ন। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগকে ১০০% হিন্দু ভোট চাই-ই। বিএনপি যদি ৫-১০% শতাংশ হিন্দু ভোট নিতে পারে, তবে ফলাফল উল্টে যেতে বাধ্য। হিসাব করলে দেখা যাবে, যদি ২০০৮-এর মত ভোট হয়; তাতে অন্তত: ১০০সীটে হিন্দুরা যার পক্ষে যাবে, তিনিই জিতবেন। কারণ, এখন সংসদ প্রার্থীরা জেতেন ৮/১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। হিন্দু ভোট সেখানে নিয়ামক ভুমিকা পালন করতে পারে। আবারো বলছি, ভোট সুষ্ঠু হলেই কেবল সেটা সম্ভব। বিএনপি-জামাত এ হিসাবটা জানে, তাই তারা হিন্দু খেদাতে চায়। আওয়ামী লীগ জানলেও মানেনা। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে অতীতে কখনো হিন্দুরা শান্তিতে ভোট দিতে পারেনি। প্রতিটি নির্বাচনের পর অকারণে হিন্দুরা নির্যাতিত হয়েছে। সেটা আওয়ামী লীগ জিতলেও হয়েছে; বিএনপি জিতলেও হয়েছে। জানুয়ারীর নির্বাচনের পরও হয়েছে। প্রশাসন অন্যের ওপর দাযিত্ব চাপিয়ে তার কর্তব্য শেষ করেছে।

'গিভ এন্ড টেক' রাজনীতির নিয়ম। হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক থেকেও শুধুই 'গিভ' করেছে। 'টেক' করার সুযোগ কখনো পায়নি বা নেয়ার চেষ্টাও করেনি। জাতীয় পর্যায়ে হিন্দু নেত্রিত্ব নাই, বা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলার লোক নাই; থাকলে ''গিভ এন্ড টেক' রাজনীতি শুরু হতে পারতো। গণতন্ত্র বা সমষ্টির নেত্রিত্ব চালু থাকলে রাজনৈতিক দর কষাকষির সুবিধা থাকে। এটা দোষের কিছু নয়। সুভাষ বসু বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।' হিন্দুরাও বলতে পারবেন, 'তোমরা আমদের অধিকার দাও, আমরা তোমাদের ভোট দেবো।' অনেকে বলেন, 'হিন্দুর কাছে যাহা আওয়ামী লীগ, তাহাই বিএনপি হওয়া উচিত'; আমি তাতে একমত নই। তবে কিছু অর্জনই যদি না থাকে তবে, ভোট ব্যাঙ্ক থেকে লাভ কি, এমন ভোটের মূল্য কেউ দেয়না, আওয়ামী লীগই বা দেবে কেন?

নিউইয়র্ক, ২২শে মার্চ ২০১৪।




No comments:

Post a Comment