Saturday, May 4, 2013

১০৪তম জন্মদিবসে সেলাম বীরকন্যা প্রীতিলতা :২২ বছরের অগ্নিঝরা জীবনের বীরোচিত অধ্যায়-সুমি খান

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার  এর আজ ১০৪ তম জন্মদিন। ১৯১১ সালের ৫  মে চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ বিরোধী  আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা প্রীতিলতা এক সফল অভিযানের মাধ্যমে ইউরোপীয়ান ক্লাব  আক্রমনের পর গুলিবিদ্ধ হলে দলীয় নীতি অনুযায়ী পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে  আত্মাহুতি দেন ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর । ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার জন্মদিবসে সূর্যবার্তা ২৪.কম এর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
"কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে? ঁআর কেঁদোনা মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিও। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইবো।" মায়ের কাছে এই ছিল প্রীতিলতার শেষ চিঠি। ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈ ছিল তাঁর আদর্শ। তার নামে কন্যার নাম রাণী রাখেন প্রীতিলতার মা।
মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, এর জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলামনা। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইলো।  মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম..."
প্রীতিলতার বাড়িতে এক আলাপচারিতা প্রসঙ্গে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ১৯৩০ সালে লিখেছেন, “কথা হচ্ছিল, পাঁঠা কাটতে পারব কি না। আমি বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় পারব, আমার মোটেই ভয় করে না’। প্রীতি উত্তর দিয়েছিল ‘ভয়ের প্রশ্ন না, কিন্তু আমি পারব না নিরীহ একটা জীবকে হত্যা করতে’।একজন তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল ‘কী, দেশের স্বাধীনতার জন্যও তুমি অহিংস উপায়ে সংগ্রাম করতে চাও?’ আমার মনে পড়ে প্রীতির স্পষ্ট জবাব, ‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, প্রাণ নিতে মোটেই মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না।’”
"কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হবো । সেই সময়ে ঝাঁসীর রানীর জীবনী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা 'অকুতোভয় বিপ্লবী' হিসাবে দেখা শুরু করলাম।" এভাবেই স্বপ্নের কথা লিখেছেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ।
চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে তিনি এ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত ।
১৯২৬ সালে তিনি সংস্কৃতকলা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অঙ্কের নম্বর খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরী মঞ্চে পরিবেশন করেন। পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তাঁর বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারনে বিয়ে তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের, পটিয়ার ধলঘাটে বীরকন্যা প্রীতিলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ২০০৫ সনের ২২ শে ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠিত প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির স্থিরচিত্র।
আই.এ. বা উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন প্রীতিলতা । এ কলেজ়ের ছাত্রী নিবাসের মাসিক থাকা খাওয়ার খরচ ছিল ১০ টাকা । এর মধ্যে কলেজের বেতন ও হয়ে যেত। এ কারনে অল্প বেতনের চাকুরে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে আই.এ. পড়তে ঢাকায় পাঠান।
১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত ভাবে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বিএ পড়তে যান। বেথুন কলেজে মেয়েদের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক ও তৈরী হয়েছিল।
কোলকাতার বানারসী ঘোষ স্ট্রীটের হোস্টেলের ছাদে বসে প্রীতিলতার বাশীঁ বাজানো উপভোগ করত কলেজের মেয়েরা। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভাল ফলাফল করতেন।  তিনি দর্শনে অনার্স করতে চেয়েছিলেন ।বিপ্পবের সাথে যুক্ত হবার কারনে তাঁর অনার্স পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন।
কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাঁদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
প্রীতিলতার সার্টিফিকেট


ঊষা'দি এবং পূর্ণেন্দু'দা
প্রীতিলতা তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন  বিপ্লবীদের আস্তানায় পুলিশ হানা দেয়। পুলিশের সাথে সম্মুখযুদ্ধের পর গ্রেফতার হন মাস্টার'দা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে ডাকাতি মামলা দায়ের করা হয় । এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ডা. খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রী প্রীতিলতা তার প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিত অনেক কিছু জানতে পারেন। ঊষা'দি “ঝাঁসীর রাণী” বইটি পড়তে দেন প্রীতিলতা কে। ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাইয়ের জীবনী  প্রীতির মনে গভীর রেখাপাত করে।
১৯২৪ সালে 'বেঙ্গল অর্ডিনান্স' নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদেরকে অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হতো। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকটাত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেনীর ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন “দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” আর “কানাইলাল”।
এই সমস্ত গ্রন্থ প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। প্রীতিলতা তাঁর দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিলো।
লীলা রায় ও দীপালী সঙ্ঘ
ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। এই দলটি প্পকাশ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরী করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের “দীপালী সঙ্ঘ” নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। গোপনে তাঁরা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ও করত।
ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমা'দির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গডে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি”।
১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নারী সম্মেলন করবার কোন পরিকল্পনা তখনও ছিলো না ।র্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন।মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাঁদের দুজনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সূর্য সেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হয়। ১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই.এ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এটি “চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ” নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবীদলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। প্রীতিলতা লিখেছিলেন “পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম”।
ক্যাবলা'দা এবং গুণু পিসি
১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে আসেন। দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। যুব বিদ্রোহের পর তিনি মধ্য কলকাতায় বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসির (গুণু পিসি) বাসায় আশ্রয় নেন। প্রীতিলতা ঐ বাসায় গিয়ে দাদার সঙ্গে প্রায় দেখা করতেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে মনোরঞ্জন রায় (ক্যাবলা’দা নামে পরিচিত) নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করেন। যুব বিদ্রোহের পর পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং কারাগারে বন্দী নেতাদের সাথে আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনের সাথে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ হত। তাঁরা তখন আরো হামলার পরিকল্পনা করছিল। সূর্য সেন প্রেসিডেন্সী কলেজের কেমিষ্ট্রির ছাত্র মনোরঞ্জন রায়কে গান-কটন এবং বোমা তৈরীর নির্দেশ দেন। তিনি এসব সংগ্রহ করে পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা গুণু পিসির বাসায় রাখতেন।
প্রীতিলতার ভিটেবাড়ির ধ্বংসাবশেষ
এ বাসায় বসে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, রেণুকা রায়, কমলা চ্যাটার্জী প্রমুখ বহু গোপন বৈঠক করেন এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর মাষ্টারদার প্রেরিত ইস্তেহার সাইক্লোষ্টাইলে ছাপিয়ে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বিতরন করেন।
মনোরঞ্জন রায়ের সাথে প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্তের পরিচয়ের পর তিনি বুঝতে পারেন যে এই মেয়ে দুটিই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবী কাজ করতে সক্ষম হবে। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশের নজরদারী এড়িয়ে মনোরঞ্জন রায় কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম এসে সূর্য সেনের হাতে গান-কটন এবং বোমা তুলে দেন। এসময় তিনি জেলে থাকা বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে চিঠির আদান প্রদান এবং কলকাতা থেকে বিস্ফোরক বহন করে আনার বিপদ সম্পর্কে মাষ্টারদার দৃষ্টি আকর্ষন করেন। শহর আর গ্রামের যুবক বয়সীরা পুলিশের চোখে সবচেয়ে বড় সন্দেহভাজন। এ অবস্থায় সূর্য সেন নারী বিপ্লবীদের এসব কাজের দায়িত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারন তখনো গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েদের সন্দেহ করতো না। মাষ্টারদার অনুমতি পাওয়ার পর নারীদের বিপ্লবের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মুখোমুখি প্রীতিলতা
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে টি জে ক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য মাষ্টার’দা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে মনোনীত করলেন।
পরিকল্পনা অনু্যায়ী ১৯৩০ সালের দোসরা ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তাঁরা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালায় । কিন্তু ভুল করে তাঁরা মিঃ ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনই পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময়ের কিছু বোমা কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে যান।
তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হবার কারণে কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসনদন্ড দেয়া হয়।
আলিপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যুদন্ডের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সাথে চট্টগ্রাম থেকে  আত্নীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলী জেলে ছেলের সাথে দেখা করতে গেলে গোপনে তিনি প্রীতিলতাকে লেখা চিঠিটা তাঁর হাতে দেন। গুনু পিসির উপদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা মৃত্যুপ্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে “অমিতা দাস” ছদ্মনামে “কাজিন” পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন।
জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে তিনি প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। এ সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন “তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচল ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদী মন এবং প্রগাঢ় উপলব্ধি বোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশী কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।” ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসী হয়। এ ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে।
প্রীতিলতার ভাষায় “রামকৃষ্ণদা'র ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।”
দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সময়ের অবসানঃ মাষ্টারদা'র সাথে সাক্ষাত
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসীর পর আরো প্রায় নয় মাসের মতো প্রীতিলতাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয় বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়িতে এসে দেখেন তাঁর পিতার চাকরি নেই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যাক্তিত্ব অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তখন নন্দনকাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, (বর্তমানে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।
স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেট পড়ানো এবং মা'কে সাংসারিক কাজে সাহায্য করে প্রীতিলতার দিন কাটছিল।
কিন্তু তিনি লিখেছেন, “১৯৩২ সালে বি এ পরীক্ষার পর 'মাষ্টারদা'র সাথে দেখা করবোই ' এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম ।” বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে বলেন। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বিএস সি ক্লাসে ভর্তি হন। সেসময়ে প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদা'র দেখা হয়।
১৯৩১ সালে এই গোপন সাক্ষাতের সময় আত্মগোপনে থাকা মাষ্টারদা'র সাথে ছিলেন বিপ্লবী নির্মল সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী এবং কালীকিংকর দে। মাষ্টার'দা ঐ সাক্ষাতের সময় কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কিত খোঁজ খবর জানতে চান। এরমধ্যে একবার মাষ্টারদা'র সংগঠন চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দিল।
প্রীতিলতার বাবা সংসারের খরচ চালানোর জন্য মাসিক বেতনের পুরো টাকাটা প্রীতিলতার হাতে দিতেন। তিনি ঐ টাকাটা সংগঠনের কাজে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তা নিতে কল্পনা দত্ত আপত্তি করেন। প্রীতিলতা কেঁদে বলেন “গরিব দেখে আমাদের টাকা নিতে চান না? আমি যে নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পারবো, তার প্রমাণ করার সুযোগও কি আমায় দেবেন না?”
প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারনে কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট কুটিরে তাঁর সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে সেই সাক্ষাতে নির্মল সেন পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে, সেটা প্রীতিলতার কাছে জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারবো ।”
যুব বিদ্রোহের পর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মাষ্টার'দা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কারনে প্রীতিলতার সাথে সে রাতে তাঁর দেখা হয়নি। প্রীতিলতার সাথে এই সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে মাষ্টারদা লিখেছেন “অল্প কয়েকদিন পরেই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হতেই নির্মলবাবু আমায় বললো, " আমি রাণীকে (প্রীতিলতার ডাক নাম) কথা দিয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করাব, সে এক সপ্তাহের জন্য যে কোন জায়গায় আসতে রাজ়ী আছে।" রামকৃষ্ণের সঙ্গে সে ফাঁসীর আগে দেখা করেছে শুনেই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল। তার দেখা করার ব্যাকুলতা শুনে রাজী হলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে (মে মাসের শেষের দিকে) তাকে আনার ব্যবস্থা করলাম”।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তার দেখা হও্য়ার ইতিবৃত্ত, রামকৃষ্ণের প্রতি তার শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় দু'ঘন্টার মতো মাষ্টারদা'র সাথে কথা বলেন। মাষ্টারদা আরো লিখেছেন “তার action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে”।
তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র triggering এবং targeting এর উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন।
বিপ্লবী কর্মকান্ড -ধলঘাটে সংঘর্ষ
ধলঘাট সংঘর্ষের স্থানে নিহত বিপ্লবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ


পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নির্মিত শহীদ মিনারের গায়ে মার্বেল পাথরের স্মৃতিফলক।## এই ছবিটি চট্টগ্রাম এর পটিয়া থানার ধলঘাটে অবস্থিত ১৯৭০ সালে নির্মিত প্রীতিলতা ও অর্ধেন্দু দস্তিদার স্মরনে শহীদ মিনার এর স্থিরচিত্র । অর্ধেন্দু দস্তিদারের বড় ভাই পূর্ণেন্দু দস্তিদার এই শহীদ মিনার নির্মান করেন। এটি প্রীতিলতার জন্মস্থানের সন্মূখে নির্মান করা হয়। এই ছবিটি ধারন করার সময় শহীদ মিনারটিতে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।




১৯৩২ সাল--চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গেপ্তার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা নুতন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাষ্টার'দা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী বিপ্লবী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়ি।
পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রাম ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার চেষ্টা করত। সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিল ঐ ক্যাম্প থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। বিপ্লবীদের কাছে ঐ বাড়ির গোপন নাম ছিল “আশ্রম”।
বিধবা সাবিত্রী দেবী এক ছেলে এবং বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে ঐ বাড়িতে থাকতেন। বিপ্লবীদের কাছে তিনি ছিলেন “সাবিত্রী মাসিমা”।
এই আশ্রমে বসে সূর্য সেন এবং নির্মল সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সাক্ষাত করতেন এবং আলোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। অনেক সময় এই বাড়িতেই তাঁরা দেশ বিদেশের বিপ্লবীদের লেখা বই পড়ে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে সময় কাটাতেন।
১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড় বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদা'র পাঠানো এক ব্যক্তি প্রীতিলতাকে 'আশ্রমে' নিয়ে আসেন। প্রীতিলতা তাঁর মা'কে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলে চলে এসেছেন। মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তখন 'ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলা'র পলাতক আসামী তরুন বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা) অবস্থান করছিলেন।
১৩ জুন সন্ধ্যায় সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে। এর আগে মে মাসেই ইংরেজ প্রশাসন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০,০০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন। ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন খবরটা জানার পর ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পুরস্কার এবং পদোন্নতির লোভে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাতজন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনষ্টেবল নিয়ে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। তার একটু আগেই মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়িটার নীচতলার রান্নাঘরে ভাত খেতে বসেছিলেন। জ্বরের কারনে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাবার না খেয়ে উপরের ঘরে শুয়েছিলেন। মাষ্টারদা'র সাথে খেতে বসে অস্বস্তি বোধ করায় প্রীতিলতা দৌড়ে উপরে চলে যান। প্রীতিলতার লজ্জা দেখে নির্মল সেন খুব হাসছিলেন। এমন সময় মাষ্টারদা ঘরের ভিতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে বলেন “নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে”।
প্রীতিলতাকে নিচে নেমে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন মাষ্টার'দা ।
ততোক্ষনে সিপাহী এবং কনষ্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান।
“ঘরে আর কে আছে?” এ প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় পুলিশ । এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ হয় । ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলবার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের দুই গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরন করেন। গুলির শব্দ পাওয়ার পর পুলিশ চারিদিক থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়।
টাকা পয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টার'দা অন্ধকারের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এ সময়ে আমের শুকনো পাতায় পা পড়ার শব্দ পেয়ে আশেপাশে থাকা সিপাহীদের চালানো গুলিতে সবার আগে হাঁটতে থাকা অপুর্ব সেন মারা যান । মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানাভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল সেই বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন।
মাষ্টারদা'র জন্য রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরন লিখে ধলঘাটে এনেছিলেন প্রীতিলতা। সেই পান্ডুলিপি পুকুরের মধ্যে হারিয়ে গেলো। তাঁদেরকে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বলেন মাষ্টারদা। মণিলাল দত্ত তাদেরকে ধলঘাট হতে ছয় কিলোমিটার দূরে পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর কাছাঁকাছি একটা গ্রাম জৈষ্ট্যপুরায় নিয়ে যেতে মনস্থির করেন। পুলিশ হানা দিলে পাহাড় এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা যাবে অথবা নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যাওয়া যাবে।
অনেক প্রতিকূল পথ অতিক্রমের পর তাঁরা জৈষ্ট্যপুরা গ্রামে বিপ্লবীদের আরেকটা গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান। ঐ গুপ্ত আস্তানাটি বিপ্লবীদের কাছে “কুটির” নামে পরিচিত ছিল।  কুটিরে তখন আত্মগোপণে ছিলেন সুশীল দে, কালীকিংকর দে এবং মহেন্দ্র চৌধুরী। সূর্য সেন পরের দিন প্রীতিলতাকে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে সূর্য সেনের নির্দেশে মণিলাল প্রীতিলতার বাসায় পুলিশের নজরদারী আছে কিনা তা জানতে শহরে যান। “সব কিছু ঠিক আছে” জানার পর প্রীতিলতাকে বাড়ি গিয়ে স্কুল শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।
"চট্টগ্রামে সৈন্য ও বিপ্লবীদের সংঘর্য" শিরোনামে ধলঘাট সংঘর্ষের খবর ১৫ জুন ,১৯৩২  দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ঃ
"এইমাত্র সংবাদ আসিয়াছে যে, গতরাত্রে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার নিকটে বিপ্লবী ও সৈন্যদের এক সংঘর্য হইয়া গিয়াছে। ফলে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ও দুইজন বিপ্লবী নিহত হইয়াছেন। বিপ্লবীদের নিকট দুইটি রিভলবার ও গুলি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। নিহত বিপ্লবীদের একজনকে নির্মল সেন বলিয়া সনাক্ত করা হইয়াছে।"
আত্মগোপন
ধলঘাট সংঘর্ষের সে রাতেই গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যুর পর পুলিশের এস. আই মনোরঞ্জন বোস পটিয়ার মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে আরো ত্রিশজন সৈন্য এবং একটা লুইস গান নিয়ে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে ফিরে আসেন। লুইস গানের গুলিবর্ষণে বাড়িটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। সাবিত্রী দেবী এবং তাঁর পুত্র কণ্যাকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কণ্যা স্নেহলতার জবানবন্দিতে আরো তিন যুবক—দীনেশ দাশগুপ্ত, অজিত বিশ্বাস, এবং মনীন্দ্র দাশকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে সাবিত্রী দেবী, তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণ, এবং এই তিন যুবককে বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং সহায়তা করার দায়ে চার বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। ঘরে তল্লাশী চালিয়ে  রিভলবার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের দুইটা ছবি, পাশাপাশি দুইটা মেয়ের ছবি (যার মধ্যে একজন  প্রীতিলতা) সহ কিছু চিঠি এবং দুইটা বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। ধলঘাটে ছবি পাওয়ার পর ১৯শে জুন প্রীতিলতার বাসায় গিয়ে প্রীতিলতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ।২২ জুন এস.আই শৈলেন্দ্র সেনগুপ্ত এর নেতৃত্বে একটি দল ঐ বাড়িতে আরেক দফা তল্লাশি চালায়।
তাঁর নির্দেশে আশে পাশের সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। জঙ্গল এবং আশেপাশের পুকুরে তল্লাশীতে অনেক কাগজপত্র উদ্ধার করা হয় যা থেকে প্রমাণিত হয় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর আত্মগোপনে থেকে ও বিপ্লবীরা তাঁদের আদর্শের সাথে অভিন্ন বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া এবং সামরিক প্রশিক্ষন চালিয়ে যাচ্ছিল। তল্লাশি অভিযানে কাজিন পরিচয় দিয়ে অমিতা দাশের (প্রীতিলতার) আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাতের হাতে লেখা একটা বিবরন পাওয়া যায়। ঐ হাতের লেখার সাথে মেলানোর জন্য ৩০ জুন প্রীতিলতার বাসা থেকে পুলিশ তাঁর গানের একটা বই নিয়ে যায়। মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন।
৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করেন । ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার অনেক খোঁজ খবর করেও কন্যার কোন সন্ধান পাননি। ব্যর্থ হয়ে যখন থানায় খবরটা জানানো হল, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর যোগেন গুপ্ত আরেক নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্তের বাড়িতে যান ।
কল্পনা দত্ত সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন “আমাদের বাসায় এসে গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর  প্রীতিলতা সম্পর্কে বলেন, " এতো শান্তশিষ্ট নম্র মেয়ে ও, এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! ভাবতেও পারি না তার ভিতর এত কিছু আছে! আমাদের খুব ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে গেল।”
চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছু দিন কাটিয়ে প্রীতিলতা পড়ৈকড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিপ্লবীদের আরেক গোপন আস্তানা এই বাড়িটার সাংকেতিক নাম ছিল “কুন্তলা”। এই বাড়িতে তখন আত্মগোপনে ছিলেন মাষ্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার।
প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
“চট্টগ্রামের পলাতকা” শিরোনামের এই সংবাদে লেখা হয় “চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত”।
প্রীতিলতাকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ নোটিশটি ছিল এরকম-"Waddadar, whose photographs are published above. Photograph No.1 was taken 2 years ago when Miss Prithi was a student of the Dacca Eden Intermediate College and photograph No. 2 (sitting postures), which is a more recent one, was found at the time of search of one Apurba Sen alias Bhola (since deceased), in connection with Dhalghat shooting affray at Chittagong.
A Special “look-out” should be kept for her and when traced, the I.B., C.I.D., Bengal, Calcutta, should be informed by wire. A close, though unobtrusive, surveillance should at the same time be kept on her movements.
Description—Miss Prithi Waddadar, daughter of Jagabandhu Waddadar (Baidya by caste), of Dhalghat, Patiya and Jamalkhana, Chittagong town: age 20/21 (looks younger than her age); dark; medium build; short; ugly in appearance."
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ


ইউরোপিয়ান ক্লাবের সম্মুখের স্মৃতিফলক।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু 'গুড ফ্রাইডে' র কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ব্যাতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ঐ ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”।
সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো।
আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে। চট্টগ্রাম শহরের কাছে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় পেলেন।
১৯৩২ সালের ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয়ান ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন মাষ্টার'দা। এই অভিযানের দায়িত্ব নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলে মনস্থির করেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের সাতদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত । এ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়ান ক্লাব অভিযানে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর।
২৪ সেপ্টেম, ১৯৩২, প্রীতিলতা মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী পরলেন। চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রাবার সোলের জুতা।
ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পরানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তীর পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরা ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন ।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তাঁর গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখান। এর পরেই ক্লাবে আক্রমণ শুরু হয়।
সেদিন ছিল শনিবার। প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল।
তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায এবং রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারনে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করেন।
একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা আহত হয়।
পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করেন । পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করে পুলিশ । তাঁর মৃতদেহ তল্লাশীর পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, বিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না । পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল প্রীতিলতার মৃত্যুর কারণ।
প্রীতিলতার মৃত্যুর পর বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারী লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো একটা রিপোর্টে লেখেনঃ
"Pritilata had been closely associated with, if not actually the mistress of, the terrorist Biswas who was hanged for the murder of Inspector Tarini Mukherjee, and some reports indicate that she was the wife of Nirmal Sen who was killed while attempting to evade arrest of Dhalghat, where Captain Cameron fell."




প্রীতিলতার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, “প্রীতির বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রীতির মা গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে'।
তাঁদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখকে দুঃখ মনে করেননি। ধাত্রীর কাজ নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে নিয়েছেন, আজো তাঁদের সেভাবে চলছে। প্রীতির বাবা প্রীতির দুঃখ ভুলতে পারেননি। আমাকে দেখলেই তাঁর প্রীতির কথা মনে পড়ে যায়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন”।
মায়ের কাছে প্রীতিলতার শেষ পত্র
মাগো,
তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার যেন মনে হলো তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলি আমার নাম ধরে ডাকছো, আর তোমার অশ্রু-জলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে। মা, সত্যিই কি তুমি এত কাঁদছো? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না—তুমি আমায় ডেকে ডেকে হয়্ররান হয়ে চলে গেলে।
স্বপ্নে একবার তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম—তুমি তোমার আদরের মেয়ের আবদার রক্ষা করতে এসেছিলে! কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না। দু'চোখ মেলে কেবল তোমার অশ্রুজলই দেখলাম। তোমার চোখের জল মোছাতে এতটুকু চেষ্টা করলাম না।
মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো—তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পুর্ণ হবে না।
একটিবার তোমায় দেখে যেতে পারলাম না! সেজন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝোনা তুমি। তোমার কথা আমি এক মুহুর্তের জন্যও ভুলিনি মা। প্রতিনিয়তই তোমার আশির্বাদ প্রার্থনা করি।
আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে, তা আমি জানি। মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় বসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছো—“ওগো তোমরা আমার রাণীশূন্য রাজ্য দেখে যাও”।
তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিনরাত ভাসছে। তোমার এই কথাগুলো আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর তোলে।
মাগো, তুমি অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য-স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না?
কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!
তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?
আর কেঁদোনা মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিও। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইবো।
আমি যে তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে এসেছি মা। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। তুমি আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিতে চাইছো, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি। খাবারের থালা নিয়ে আমায় কত সাধাসাধিই না করেছো—আমি পিছন ফিরে চলে গেছি।
না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমাত উপায় নেই। আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
কি আশ্চর্য মা! তোমার রাণী এত নিষ্ঠুর হতে পারলো কি করে? ক্ষমা করো মা; আমায় তুমি ক্ষমা করো!
(আত্মাহুতির আগের রাতে প্রীতিলতা মায়ের উদ্দেশে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুবরণের পর মাষ্টার'দা এই পত্রটি প্রীতিলতার মায়ের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ।)