Saturday, April 6, 2019

৮০% দগ্ধ মাদ্রাসা ছাত্রী রাফি বাঁচতে চায়- নারী নেত্রীরা একাত্ম হবেন কি আজ?-সুমি খান

০৬ এপ্রিল, ২০১৯
শরীরের ৮০% দগ্ধ  নুসরাত জাহান রাফি (১৮) কে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন ডা. সামন্ত লাল সেন স্যার। রাফি শুধু একটি শব্দ বলেছে, ”আমাকে বাঁচান ।”
 রাফিকে বাঁচানোর চেষ্টার পাশাপাশি জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে রাফির গায়ে আগুন দিয়ে যারা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পেটোয়া বাহিনীর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে।
রাফির অপরাধ  গত ১৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলা তার কক্ষে  রাফীকে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে। সেই অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে আটক করেছে পুলিশ। সেই ঘটনার পর থেকে  শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানবন্ধন করেছে।  যৌন হয়রানির অভিযোগে আটক অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার অনুগত ছাত্ররা তার মুক্তির দাবিতে মানবন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে ।
ফেনী জেলার সোনাগাজীতে আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রে  নুসরাত জাহান রাফি (১৮) র গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্যান্ত  পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা  করেছে তার সহপাঠিরা। রাফির শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছে তার ভাই। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
ফেনী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আবু তাহের জানান,দগ্ধ ছাত্রীর শরীরের ৭০-৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ রাফীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
নুসরাত জাহান রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,শনিবার সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যায়।তখন অধ্যক্ষ সিরাজ্উদ্দৌলার নিয়ন্ত্রিত কয়েকজন শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ফুসলিয়ে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা নুসরাত জাহান রাফিকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরবর্তীতে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাফিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান। সেখানে ডা. সামন্তলাল সেনের তত্বাবধানে রাফির চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
ডা. সামন্তলাল সেন এই প্রতিবেদককে জানান, নুসরাত জাহান রাফির অবস্থা ভালো নয়, তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। নুসরাত জাহান রাফি ডা. সামন্ত লাল সেনকে শুধু একটি কথাই বলেছে, “আমাকে বাঁচান।!”  ডা. সামন্তলাল সেন এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন রাফিকে বাঁচানোর জন্যে। এদেশে বার্ণ ইউনিটের অনেক রোগীর জন্যে ডা.সামন্তলাল সেন ’ফেরেশতা’ বা ’দেবদূত’। তাঁর সাধ্যাতীত চেষ্টাতে সেরে উঠেছেন অনেকেই। আমরা রাফির সুস্থতার জন্যে প্রার্থনা করছি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একজন নেত্রীকে ফোন করে জানালাম রাফির শারীরিক অবস্থা । তিনি জানালেন , ”আজ আর সময় নেই।” আরো বললেন. কাল ভেবে দেখবেন কাউকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো যায় কিনা। বিস্ময়ে হতবাক হতে ভুলে গেছি আমি।
নুসরাত জাহান রাফির জন্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অথবা মাদ্রাসার শিক্ষক সমাজ বা ওলামা সমাজ কারো কি কোন দায়িত্ব নেই? নুসরাত জাহান রাফি আজ একটি প্রতীকি নাম ।
নুসরাত জাহান রাফি তার উপর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ‘দায়ে’ পরীক্ষার হলে জীবন্ত দগ্ধ হলো তার মাদ্রাসার ছাদে।
২০১৯ সালে এসে এ কোন মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হতে হলো রাফিকে। আমার দু’চোখে নীরব অশ্রুধারা। রাফি মাদ্রাসা ছাত্রী । ধর্ম কর্ম তো শতভাগ মেনেই চলেছিলো মেয়েটি। তাহলে কোন্ অপরাধে তাকে আজকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করালো তারই সহপাঠীবৃন্দ, যারা ইসলাম ধর্মের শিক্ষার্থী ? তাদের কি ধর্ম অধর্ম জ্ঞান আদৌ শেখানো হয়? কোন মানবিক শিক্ষা তাদের দেয়া হয় কিনা যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
সরকার মাদ্রাসার জন্যে দু’হাত তুলে সহযোগিতা করছেন। আজকের দিনে আবারো প্রমাণিত হলো তাদের  সুশিক্ষা, মানবিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে সবার আগে।
 রাফির সাথে যে বর্বরতা হয়েছে তার প্রতিবাদে কি মুখর হবেন না কেউ?
ফেণীতে যৌন নিপীড়নকারী অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন আর মিছিল যারা করছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক্ । আশা করি প্রতিবাদী নারী সমাজ মাঠে নামুক রাফির উপর বর্বরতার দায়ে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে।
সম্পাদক, সূর্যবার্তানিউজডটকম
সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট, শনিবার।

Monday, April 1, 2019

নারীর আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার কতো দূরে? -সুমি খান

নারীর জীবন-০০১

আমাদের দেশে এখনো নারীর সম্মান এবং আত্মসম্মান যেন খোলামকুচি। কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই যখন বিয়ে হয়ে যায়, সেটা প্রেমের বিয়ে হোক্ আর পরিবারের সিদ্ধান্তেই হোক্- সেই বিয়ে তার জীবনে যদি শান্তি এনে না দেয়, তখন পরিবারকে নিশ্চয়ই দায়িত্ব নিতে হবে মেয়েটির জীবনে কিছুটা অন্তত শান্তি আনার। তার জীবনে যদি অশান্তি ই অবধারিত সত্য হয়,সেই বিয়ে তার জীবনকে অশান্ত করে তুললে তাকে যে কোন অজুহাতে কেন বাধ্য করা হবে অস্থিতিশীল কোন বৈবাহিক সম্পর্কে জীবনভর বন্দী থাকতে? সন্তানদের সুস্থতার জন্যেই এখন বিশ্বের উন্নত দেশে ’সিঙ্গেল মাদার’ দের জন্যে রাষ্ট্র অনেক সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও সে ব্যাপারে ভাবতে হবে । বিয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্কের দায়িত্বশীলতা নিয়ে অনেকের মাঝে যে অজ্ঞতা এবং সংস্কার রয়ে গেছে, তার শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে যাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন। তালাকের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তালাককে এখন ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে।তালাকেরযৌক্তিক কারণ না থাকলে সাধারণতঃ একজন নারী তালাকের আবেদন করেন না।

জেন্ডার সেন্সেটাইজেশানের যুগে বৈবাহিক সম্পর্ক নারী পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আর। সমাজ বাস্তবতা অনেক আদি সংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছে। নারীর সাথে নারীর এবং পুরুষের সাথে পুরুষ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। প্রকৃতিগতভাবে তারা ভিন্ন জেন্ডারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে অক্ষম। সেই বাস্তবতায় একজন নারী তার বৈবাহিক সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থানে  না থাকলে সেই নারীর মা -বাবা এবং পরিবারের আন্তরিক ভূমিকা মেয়েটির মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। যা খুব কমই দেখা যায়। এ কারণে পরিবারের  দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাবে অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যায়।

সন্তানের কারণে অনেক সম্পর্কের ভাঙ্গন সাময়িক ভাবে ঠেকে থাকলেও নারীর দায়িত্বশীল ভূমিকাকে দিনের পর দিন দুর্বলতা মনে করে,যে পুরুষ, তার সাথে ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ মনে করার মতো অবাস্তব জগতে নারী রা অবস্থান করে না। নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, “সে যুগ হয়েছে বাসী-যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো নারীরা আছিলো দাসী!” তাই নারীরা এখন দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবার স্পর্ধা দেখাতে পারছে। পরিবার এবং অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবু যে সম্পর্ক রাখতে হলে নারীকে তার আত্মসম্মান হারাতে হয়, সেই সম্পর্ক ঘুচাতে বাধ্য হয় আজকের নারী। আর এ সমাজে তালাকপ্রাপ্তা নারীর প্রতি তার পরিবারের করুণা আর বঞ্চনা যে কতোটা দুঃসহ জীবন যাপনে তাকে বাধ্য করে , তা অনেক নারীই জানেন। তবু মানুষের মতো করে বাঁচবার প্রত্যয়ে বঞ্চিত অপমানিত জীবন থেকে মুক্তি চায় আজকের নারী।

আর এ কারণে ঢাকা শহরে এখন প্রতি ঘন্টায় একজন তালাক দিচ্ছে ( প্রথম আলো-২৭ আগষ্ট, ২০১৮) এ বাস্তবতায় অনেকেই ডিভোর্স কে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন না। সেটা তাদের সমস্যা। সমাজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ষাটের দশকেই পারিবারিক বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ।তবু আমাদের পরিবার গুলোতে এখনো ডিভোর্স বা তালাকের ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেন না অনেকে। কিন্তু কেন? পারিবারিক সংকটেে যদি পারস্পরিক সম্পর্ক সুরক্ষার চেষ্টা না থাকে, সেই পরিবারের মূল্য কী?  সেসব পরিবারে সন্তানদের জীবনেও অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। এ কারণেই সম্পর্ক ভাঙ্গে, দিনের পর দিন শূণ্যতায় ডুবে যায় নিঃসঙ্গ একাকী নারী।

এক দিন সেই শূণ্য জীবনে যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তার সঙ্কটে একাত্ম হয়ে কোন বন্ধু , সেটা যে কোন নারীর জীবনে পরম পাওয়া। তার পরিবারের জন্যেও তা পরম পাওয়া। গভীর সঙকট থেকে উত্তরণের পথে এই সুন্দর ক্ষণ খুব কম নারীর জীবনেই আসে। যে কোন পরিবারের জন্যেই বন্ধুর মতো প্রিয়জন পাওয়া অনেক বড়ো পাওয়া।এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমার মিতা এবং প্রিয় বন্ধু শাহনাজ সুমি, প্রিয় বন্ধু সঙ্গীতা নন্দী, প্রিয় মানুষ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিক শামীম আখতার  এবং আমার শ্রদ্ধাভাজন রুমানা নাহিদ সোবহান, নাজনীন পাপ্পু এবং আমার মাসীমা কোলকাতার বালিগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমিস্ট্রেস মমতা ঘোষ এর  সঙ্গে।

এঁদের সকলের বক্তব্য, নারীকে তার আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার থেকে চিরদিন বঞ্চিত রাখতে পারে না কোন সমাজ। মানসিক বা শারীরিক নিপীড়ন জীবনভর টেনে নিলে সেই নারী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে- সেই যুগ  বাসী হয়ে গেছে। যদিও তালাক বা ডিভোর্সাস চাইলে নারীকে এখনো অনেক পরিবারে হেনস্থা হতে হয়; তবু নারী বেরিয়ে আসছে তার আপন ভাগ্য জয় করবার মানসে। আমার মাসীমা মমতা ঘোষ কোলকাতার বালিগঞ্জ থাকেন। তিনি বললেন, ”কোলকাতায় এখন ডিভোর্স এবং পুনর্বিবাহ  খুবই পরিচিত ঘটনা। আমার ছোট ভাইয়ের ক্যান্সার। এই অসুস্থ শরীরেই তার ছেলের সাথে ডিভোর্স হওয়া মেয়েকে সেই মেয়ে( প্রাক্তন পুত্রবধু)র পছন্দের ছেলের সাথে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে।”

ঢাকাতেও এমন চিত্র সচরাচর দেখা যায় না বলা যায় না।তবে ঢাকার বাইরে এখনো ‘বিয়ে’ কে শান্তিপূর্ণ রাখতে কেউ পাশে না থাকলে ও বিয়েকে ‘জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’  হিসাবে মানতে অনেক মেয়েকে বাধ্য করা হয়। সেই সংস্কার থেকে যতোদিন বেরিয়ে আসবে না, আমাদের সমাজ ততোদিন অন্ধকারেই রয়ে যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারিবারিক শান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠা হবে না।
 বিকেল ৫টা, পয়লা এপ্রিল, ২০১৯ সাল, বসুন্ধরা, ঢাকা।
লেখক-সম্পাদক - সূর্যবার্তানিউজ.কম