Monday, April 1, 2019

নারীর আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার কতো দূরে? -সুমি খান

নারীর জীবন-০০১

আমাদের দেশে এখনো নারীর সম্মান এবং আত্মসম্মান যেন খোলামকুচি। কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই যখন বিয়ে হয়ে যায়, সেটা প্রেমের বিয়ে হোক্ আর পরিবারের সিদ্ধান্তেই হোক্- সেই বিয়ে তার জীবনে যদি শান্তি এনে না দেয়, তখন পরিবারকে নিশ্চয়ই দায়িত্ব নিতে হবে মেয়েটির জীবনে কিছুটা অন্তত শান্তি আনার। তার জীবনে যদি অশান্তি ই অবধারিত সত্য হয়,সেই বিয়ে তার জীবনকে অশান্ত করে তুললে তাকে যে কোন অজুহাতে কেন বাধ্য করা হবে অস্থিতিশীল কোন বৈবাহিক সম্পর্কে জীবনভর বন্দী থাকতে? সন্তানদের সুস্থতার জন্যেই এখন বিশ্বের উন্নত দেশে ’সিঙ্গেল মাদার’ দের জন্যে রাষ্ট্র অনেক সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও সে ব্যাপারে ভাবতে হবে । বিয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্কের দায়িত্বশীলতা নিয়ে অনেকের মাঝে যে অজ্ঞতা এবং সংস্কার রয়ে গেছে, তার শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে যাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন। তালাকের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তালাককে এখন ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে।তালাকেরযৌক্তিক কারণ না থাকলে সাধারণতঃ একজন নারী তালাকের আবেদন করেন না।

জেন্ডার সেন্সেটাইজেশানের যুগে বৈবাহিক সম্পর্ক নারী পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আর। সমাজ বাস্তবতা অনেক আদি সংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছে। নারীর সাথে নারীর এবং পুরুষের সাথে পুরুষ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। প্রকৃতিগতভাবে তারা ভিন্ন জেন্ডারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে অক্ষম। সেই বাস্তবতায় একজন নারী তার বৈবাহিক সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থানে  না থাকলে সেই নারীর মা -বাবা এবং পরিবারের আন্তরিক ভূমিকা মেয়েটির মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। যা খুব কমই দেখা যায়। এ কারণে পরিবারের  দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাবে অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যায়।

সন্তানের কারণে অনেক সম্পর্কের ভাঙ্গন সাময়িক ভাবে ঠেকে থাকলেও নারীর দায়িত্বশীল ভূমিকাকে দিনের পর দিন দুর্বলতা মনে করে,যে পুরুষ, তার সাথে ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ মনে করার মতো অবাস্তব জগতে নারী রা অবস্থান করে না। নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, “সে যুগ হয়েছে বাসী-যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো নারীরা আছিলো দাসী!” তাই নারীরা এখন দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবার স্পর্ধা দেখাতে পারছে। পরিবার এবং অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবু যে সম্পর্ক রাখতে হলে নারীকে তার আত্মসম্মান হারাতে হয়, সেই সম্পর্ক ঘুচাতে বাধ্য হয় আজকের নারী। আর এ সমাজে তালাকপ্রাপ্তা নারীর প্রতি তার পরিবারের করুণা আর বঞ্চনা যে কতোটা দুঃসহ জীবন যাপনে তাকে বাধ্য করে , তা অনেক নারীই জানেন। তবু মানুষের মতো করে বাঁচবার প্রত্যয়ে বঞ্চিত অপমানিত জীবন থেকে মুক্তি চায় আজকের নারী।

আর এ কারণে ঢাকা শহরে এখন প্রতি ঘন্টায় একজন তালাক দিচ্ছে ( প্রথম আলো-২৭ আগষ্ট, ২০১৮) এ বাস্তবতায় অনেকেই ডিভোর্স কে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন না। সেটা তাদের সমস্যা। সমাজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ষাটের দশকেই পারিবারিক বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ।তবু আমাদের পরিবার গুলোতে এখনো ডিভোর্স বা তালাকের ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেন না অনেকে। কিন্তু কেন? পারিবারিক সংকটেে যদি পারস্পরিক সম্পর্ক সুরক্ষার চেষ্টা না থাকে, সেই পরিবারের মূল্য কী?  সেসব পরিবারে সন্তানদের জীবনেও অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। এ কারণেই সম্পর্ক ভাঙ্গে, দিনের পর দিন শূণ্যতায় ডুবে যায় নিঃসঙ্গ একাকী নারী।

এক দিন সেই শূণ্য জীবনে যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তার সঙ্কটে একাত্ম হয়ে কোন বন্ধু , সেটা যে কোন নারীর জীবনে পরম পাওয়া। তার পরিবারের জন্যেও তা পরম পাওয়া। গভীর সঙকট থেকে উত্তরণের পথে এই সুন্দর ক্ষণ খুব কম নারীর জীবনেই আসে। যে কোন পরিবারের জন্যেই বন্ধুর মতো প্রিয়জন পাওয়া অনেক বড়ো পাওয়া।এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমার মিতা এবং প্রিয় বন্ধু শাহনাজ সুমি, প্রিয় বন্ধু সঙ্গীতা নন্দী, প্রিয় মানুষ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিক শামীম আখতার  এবং আমার শ্রদ্ধাভাজন রুমানা নাহিদ সোবহান, নাজনীন পাপ্পু এবং আমার মাসীমা কোলকাতার বালিগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমিস্ট্রেস মমতা ঘোষ এর  সঙ্গে।

এঁদের সকলের বক্তব্য, নারীকে তার আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার থেকে চিরদিন বঞ্চিত রাখতে পারে না কোন সমাজ। মানসিক বা শারীরিক নিপীড়ন জীবনভর টেনে নিলে সেই নারী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে- সেই যুগ  বাসী হয়ে গেছে। যদিও তালাক বা ডিভোর্সাস চাইলে নারীকে এখনো অনেক পরিবারে হেনস্থা হতে হয়; তবু নারী বেরিয়ে আসছে তার আপন ভাগ্য জয় করবার মানসে। আমার মাসীমা মমতা ঘোষ কোলকাতার বালিগঞ্জ থাকেন। তিনি বললেন, ”কোলকাতায় এখন ডিভোর্স এবং পুনর্বিবাহ  খুবই পরিচিত ঘটনা। আমার ছোট ভাইয়ের ক্যান্সার। এই অসুস্থ শরীরেই তার ছেলের সাথে ডিভোর্স হওয়া মেয়েকে সেই মেয়ে( প্রাক্তন পুত্রবধু)র পছন্দের ছেলের সাথে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে।”

ঢাকাতেও এমন চিত্র সচরাচর দেখা যায় না বলা যায় না।তবে ঢাকার বাইরে এখনো ‘বিয়ে’ কে শান্তিপূর্ণ রাখতে কেউ পাশে না থাকলে ও বিয়েকে ‘জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’  হিসাবে মানতে অনেক মেয়েকে বাধ্য করা হয়। সেই সংস্কার থেকে যতোদিন বেরিয়ে আসবে না, আমাদের সমাজ ততোদিন অন্ধকারেই রয়ে যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারিবারিক শান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠা হবে না।
 বিকেল ৫টা, পয়লা এপ্রিল, ২০১৯ সাল, বসুন্ধরা, ঢাকা।
লেখক-সম্পাদক - সূর্যবার্তানিউজ.কম

No comments:

Post a Comment