Monday, February 3, 2014

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ এমপিদের বিতর্ক: না-বলা কথা: শওগাত আলী সাগর

ফেব্রুয়ারী ৪, ২০১৪
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রেহমান চিশতি ব্রিটেনের কনজারভেটিভ দলীয় এমপি। সেদেশের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি যে দুটি আলোচনা বা বিতর্ক হয়ে গেল, দুটিতেই তিনি ছিলেন সোচ্চার। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বক্তৃতায় বারবারই পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে আনছিলেন তিনি।
১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ ‘ব্যাকবেঞ্চ এমপিদে’র বিতর্কে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্যের বৃত্তান্ত দিয়ে রেহমান চিশতি বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা বোঝাচ্ছিলেন। চলতি সপ্তাহের ওয়েস্ট মিনিস্টার হলের বিতর্কেও তিনি নতুন একটি নির্বাচনের জন্য সময়সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়ে সেটির পক্ষেও পাকিস্তানকেই উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন।

ব্রিটিশ এমপিদের কেউ কেউ ‘দ্রুত’ নির্বাচনের যে কথা বলছিলেন, সেটি রেহমান চিশতির মোটেও পছন্দ হয়নি। তিনি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের উদাহরণ টেনে সহকর্মী এমপিদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, পাকিস্তানে জিয়া যখন ক্ষমতা দখল করেন, তিনিও বলেছিলেন দ্রুতই গণতান্ত্রিক শক্তির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সেই ‘দ্রুত’ সময়টা আর দ্রুত যায়নি। বাংলাদেশেও নির্বাচনের একটা সময়সীমা নির্দিষ্ট করে না দিলে এই সরকার পাঁচ বছরের আগে কোনো নির্বাচন দেবে না।

তবে আলোচনায় রেহমান চিশতির ‘সময় নির্দিষ্ট’ করে দেওয়ার প্রস্তাবনাটি তেমন একটি গুরুত্ব পায়নি। বরং এমপিরা তাদের সীমানার মধ্যেই থেকেছেন পুরো আলোচনায়। তারা বলেছেন, নির্বাচনের সময়টা আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরই ঠিক করতে হবে, তারা কেবল সহায়কের ভূমিকাই পালন করতে পারেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দু’দফা আলোচনার খণ্ডিত অংশ মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে

ব্রিটেনে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং বাংলাদেশি নাগরিকের বাস। এমপিদের ভোটের জন্য এই বাংলাদেশিদের কাছে যেতে হয়। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের উদ্বেগের মাত্রাটা একটু বেশি। বাংলাদেশে ব্রিটেনের বিনিয়োগের পরিমাণও কম নয়। এদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে তাদের ব্যবসায়ও তার প্রতিক্রিয়া হয়। সেটি আবার তাদের সরকারেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সতর্ক থাকতেই হয়। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটিশ এমপিদের বিতর্কের আয়োজনে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই বেশি প্রভাবিত করেছে।

ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার ঘটনাটির অবশ্যই একটা তাৎপর্য আছে। তবে পশ্চিমের রাজনীতির ধরন-ধারন এবং মন্ত্রী-এমপিদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে যারা অবগত তারা জানেন, নিজ নির্বাচনী এলাকার নাগরিকদের অনুরোধে কিংবা মোটা অংকের অনুদানের বিনিময়েও পশ্চিমা এমপিরা নানা ইস্যু আলোচনার জন্য পার্লামেন্টে নিয়ে যান। বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দুটো আলোচনায় অংশগ্রহণকারী এমপিদেরই যথেষ্ট সংখ্যক বাংলাদেশি ভোটার আছে। সেটা তারা আলোচনায় উল্লেখও করেছেন। ফলে দুটো আলোচনার পেছনের প্রভাবক সম্পর্কে আমরা খানিকটা আন্দাজ করে নিতে পারি।

ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে ২৯ জানুয়ারির আলোচনার উদ্যোক্তা ছিলেন লেবার পার্টির এমপি গ্যাভিন শুকার। নির্বাচনের সময়সীমা বেঁধে দিতে রেহমান চিশতির চাপাচাপিকে শুকারই অনেকটা নাকচ করে দেন। তার মত হল, নির্বাচনের সময়সীমা আমরা চাপিয়ে দেব না, বরং সংশ্লিষ্ট পার্টিগুলোকেই আলোচনার মাধ্যমে সেটি ঠিক করতে হবে। সদস্যদের তিনি মনে করিয়ে দেন যে, ‘‘আমরা সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছি, কিন্তু বাংলাদেশ শিগগিরই একটি স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। আমরা যাই বলি বা করি না কেন, আমাদের উচিত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার আসন্ন ‘জানালা’টির দিকেই মনোযোগ দেওয়া। স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যদি আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি একটা আস্থা সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে সেটি পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে।’’

শুকারের এই বক্তব্য পছন্দ হয়নি রেহমান চিশতির। তিনি স্থানীয় নির্বাচনে যে বিএনপি অংশ নেবে তার নিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শুকার তাকে জানিয়ে দেন, বিএনপি বিবৃতি দিয়েই স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

গত মাসের ব্যাকবেঞ্চ এমপিদের আলোচনায়ও নতুন নির্বাচনের প্রশ্নটি উঠেছিল। সেখানেও সদস্যরা চমৎকার সব মতামত দিয়েছেন। কিন্তু সেই মতামতগুলো মিডিয়াতেই তেমনভাবে যায়নি। ১৬ জানুয়ারির আলোচনাটির গুরুত্ব হচ্ছে ওই আলোচনার আয়োজক ছিলেন বাংলাদেশ সংক্রান্ত ইউরোপীয় এমপিদের সংগঠন ‘অল পার্টি গ্রুপ ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান অ্যান মেইন। মিজ মেইন এমপিদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে তিনি শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়াসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটের শেকড় সম্পর্কেও তার ধারণা অনেক পরিষ্কার।

ব্যাকবেঞ্চ কমিটির আলোচনায় নতুন নির্বাচনের প্রশ্নটি সামনে এলে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলীয় এমপি মার্টিন হরহুড পরিষ্কারভাবে বলে দেন, বাংলাদেশের নির্বাচনটি কখন হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে, সেটি নির্ধারণের এখতিয়ার পুরোপুরি বাংলাদেশের। বাইরের তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই।

তবে লেবার এমপি জিম ফিটজপ্যাট্টিক নতুন নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দেন আলোচনায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি এই মুহুর্তে নতুন একটি নির্বাচনের কথা বলা হবে প্রিম্যাচ্যুরড। তাড়াহুড়ো করে আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করা হলে গত নির্বাচনে যারা সাবোটাজ করার চেষ্টা করেছে তাদের হাতই শক্তিশালী করা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করা, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে ঐকমত্যে পৌঁছুতে সহায়তা দেওয়া এবং নির্বাচনের পরিবেশে তৈরিতে সাহায্য করা।’’

জিমের মতে, আওয়ামী লীগ যদি পুরো পাঁচ বছর দেশ শাসন করে তবে সেটি হবে এখানে আমরা যে আলোচনা করছি সে স্পিরিটের পরিপন্থী। নির্বাচন হওয়ার মতো একটি পরিবেশে নিশ্চিত করাও কঠিন কাজ। তবে তিনি মনে করেন না যে পাঁচ বছর পরই আরেকটি নির্বাচন হতে হবে। আবার এক সপ্তাহ বা একমাসের মধ্যেই যে নির্বাচন হতে হবে সেটিও ঠিক না। এই মুহুর্তে একটি নির্বাচনের ডাক দেওয়া কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আলোচনায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যেমন সমালোচনা হয়েছে তেমনি কঠোর সমালোচনা হয়েছে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতারও। লিবারেল ডেমোক্র্যাট মার্টিন হরউড স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলটি পরিষ্কারভাবেই সহিংসতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে; বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মতো কতিপয় বিতর্কিত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে হবে। নির্বাচন বর্জন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখা এবং একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ডাক দেওয়া– একটি বিপজ্জনক প্রবণতা।

এমপিরা নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতারও সমালোচনা করেছেন
এমপিরা নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতারও সমালোচনা করেছেন
ব্যাকবেঞ্চ এমপিদের আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গটি জোরেসোরেই আলোচিত হয়েছে। রেহমান চিশতি ছাড়াও বেশ ক’জন এমপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু বিতর্কের উদ্যোক্তা ‘অল পার্টি গ্রপ ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান অ্যান মেইন সেই বক্তব্যগুলো তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেননি। তিনি বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেও ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।

অ্যান মেইন তার বক্তব্যে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি অসংখ্যবার অল পার্টি গ্রুপের বৈঠকে এবং গ্রুপের সঙ্গে অন্যদের বৈঠকেও আলোচিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল দুটি রাজনৈতিক দলের পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাস থেকে। ২০০৬ সালের নির্বাচনের সময় সেই সময়কার বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি করে। তারা অভিযোগ করে ক্ষমতাসীন বিএনপি তাদের নিজেদের সমর্থকদের দিয়ে সরকারের নানা জাযগায় বসিয়েছে যাতে তারা একটি প্রভাব বিস্তার করতে পারে।’’

তার মতে, ‘‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে একটি পারফেক্ট সিস্টেম ছিল না। সাংবিধানিকভাবেই এই পদ্ধতি বদলে ফেলার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের ছিল এবং তারা সেটিই করেছে। আমি স্বীকার করি, অনেকেই এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে যেহেতু দলটি ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়ে এসেছে, কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নেওয়া সিদ্ধান্তটি তাদের নির্বাচনী ম্যান্ডেটের মধ্যেই পড়ে।’’

ব্রিটেনরে পার্লামেন্টে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে দু’দফা আলোচনা নিয়ে অনেকের মধ্যেই অতিউৎসাহ তৈরি হয়েছে। সেই উৎসাহের আতিশয্যে বিতর্কের খণ্ডিত অংশ নিয়ে টকশোতে উচ্চকণ্ঠ হয়ে পড়েছেন তারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সব আলোচনায় আলোচকদের প্রায় সবাই সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অংশবিশেষই ব্যবহার করছেন। ১৬ জানুয়ারি ব্যাকবেঞ্চ এমপিদের বিতর্কের পর ঢাকার সরকারবিরোধী একটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল– ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে প্রস্তাব পাশ’। অথচ ওই আলোচনায় কোনো প্রস্তাবের ব্যাপার ছিল না, কোনো প্রস্তাব গৃহীতও হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম করতে গিয়ে পত্রিকাটি অসত্য তথ্য পরিবেশন করতেও দ্বিধা করেনি।

আবার ২৯ জানুয়ারি ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে বিতর্কের পর শীর্ষ একটি পত্রিকার শিরোনাম ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আবার বিতর্ক/নির্বাচন না ছিল অবাধ, না ছিল সুষ্ঠু’। পত্রিকাটি লিখেছে, “বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না ছিল অবাধ, না ছিল সুষ্ঠু। সে কারণে তা সঠিক বা যথার্থ হয়নি বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষণা করা উচিত। গত বুধবার রাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা বিতর্কে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।’’

দ্বিতীয় দফা বিতর্কে কি কোনো অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে? কোনো সর্বসম্মত ঘোষণা? বিটিশ পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে বিতর্কের যে ট্রান্সক্রিপ্ট দেওয়া আছে তা কিন্তু কোনো অভিমতের কথা বলে না। তাহলে?

ওয়েস্ট মিনিস্টার হলের বিতর্কের উদ্যোক্তা গ্যাভিন শুকারের প্রস্তাব ছিল এটি। তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে “বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না ছিল অবাধ, না ছিল সুষ্ঠু। সে কারণে তা সঠিক বা যথার্থ হয়নি’’ মর্মে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। এই প্রস্তাব নিয়ে পুরো বিতর্কে আর কেউ কোনো মন্তব্য করেননি।

তাহলে একজন এমপির বক্তব্য পুরো বিতর্কের অভিমত হয় কীভাবে? এমনকি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসনও তো এই বক্তব্যে সায় দেননি। তাহলে ১৬ জানুয়ারির আলোচনায় যে একজন এমপি বলেছেন, ‘এই মুহুর্তে একটি নির্বাচনের ডাক দেওয়া কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না’ সেটিকেও কি আমরা ব্রিটিশ সংসদের বিতর্কে অভিমত হিসেবে দেখব?

পার্লামেন্টের দুটো বিতর্কই হয়েছে পেছনের সারির এমপিদের উদ্যোগে। সেই বিতর্কে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের উন্নয়নের দিকে নজর রেখে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রীরা বক্তব্য রেখেছেন। কোনো কোনো এমপির আলোচনায় বিশেষ মতের প্রতি পক্ষপাত থাকলেও, সামগ্রিক আলোচনায় সহিংসতা, অস্থিতিশীলতাও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে অনেকেই এই বিতর্কের খণ্ডিত তথ্য উপস্থাপন করে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিতর্কে যখন বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যকার চলমান অবিশ্বাস দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অকার্যকর করে রেখেছে, যা একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রায় অলীক কল্পনা হয়ে উঠেছে’ তখন তো দল হিসেবেই কেবল নয়, জাতি হিসেবেই আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা।

শওগাত আলী সাগর: প্রথম আলোর সাবেক বিজনেস এডিটর, টরন্টো থেকে প্রকাশিত নতুনদেশ ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক।

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় এবং কার দায় কী?- মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী


ঠিক ১০ বছর আগের ঘটনা। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার জেটি ঘাটে বিপুল পরিমাণ আধুনিক মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি চালান আটকে দেওয়ার একটি পিলে চমকানো ঘটনা ঘটেছে। 'ধর্মের কল আপনা আপনিই বাজে'- বাংলার চিরায়ত এই প্রবাদটি ফলে গেল! এভাবে ফলার হয়তো কথা ছিল না। কেননা, এর সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ইচ্ছা, ইশারা এবং পরিকল্পনা যুক্ত ছিল। সুতরাং কারোরই টের পাওয়ার কিছু ছিল না। জানা বা বোঝারও কোনো সুযোগ ছিল না। তার পরও চালানটি ধরা পড়ে যায়।

এখানেই নিয়তি, কথা আসে। যেহেতু কাজটি বেআইনি, রাষ্ট্রীয় নর্মসবিরোধী- তাই সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে যারা এমন মারণাস্ত্র চালানে সহযোগিতা করেছিল, তাদের সবই করতে হয়েছিল লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে, অন্তরালে থেকে। যেহেতু চালানটি ছিল আকারে বিশাল, গন্তব্য বেশ দূরে, তাই সব চোখকে ম্যানেজ করা, ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। পরিকল্পনাকারীরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এত বিশাল এক খারাপ উদ্দেশ্য সাধন করার ব্যাপারে আস্থাশীল থাকতে পারে; কিন্তু যেহেতু বিষয়টি ছিল একটি গোপন পরিকল্পনা, তাই এর উপস্থিতি, রেখে যাওয়া চিহ্ন, পথচলা ইত্যাদি মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু এমন অপকর্মের হোতা ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল, এমন অপকর্ম করার কোনো 'যোগ্যতা' তাদের ছিল মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই জেটি ঘাটেই ঘটে গেল অভাবনীয় সেই ঘটনাটি।

 রাতের আঁধারে ঘটা ষড়যন্ত্র ফাঁস হতে শুরু করে। একটি টেলিফোন থেকে একটি অজ্ঞাত কল। ব্যক্তিটিও অজ্ঞাতই ছিলেন। কিন্তু পুলিশের কানে ফিসফিস শব্দও নাকি ভূমিকম্পের মতো সব কিছুকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। এখানেও ঘটল তা-ই। একটি-দুটি নয়, দশ-দশটি ট্রাকে এক হাজার ৪৬৩টি বাক্স ভর্তি অস্ত্র। এমন সব অস্ত্রের নামধাম যা মনে রাখাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। তবে ভড়কে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বললেও যেন কম বলা হবে।

এসব অস্ত্র দিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনীর বিদেশি বা যেকোনো আক্রমণকারী শক্তির সঙ্গে মোটামুটি একটি স্মরণীয় যুদ্ধ সংঘটিত করা সম্ভব। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পড়লে দীর্ঘমেয়াদি একটি রক্তঝরা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে জঙ্গিদের হাতে তা পড়লে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অবস্থা কী হতে পারত তা কি আমরা আদৌ কল্পনা করতে পেরেছি? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সে ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে চলে যেত, তা ভাবা উচিত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। এত অস্ত্র কোনো রাষ্ট্র তার সেনাবাহিনীর জন্য কিনতে গেলেও সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কয়েকবার। এর মূল্যমান যেমনি বড় অঙ্কের, তেমনি সামরিক গুরুত্বও অত্যধিক। তেমন একটি অস্ত্র চালান গোপনে ভিড়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি কারখানার ঘাটে। ভাবতেই মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা।

 ক্ষমতায় তখন ছিল এমন একটি সরকার- যারা কথায় কথায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একক দাবিদার বলে প্রচার করত, তাদের বিপক্ষে দলের হাতে নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া হয়! এত বড় অস্ত্র চালানটির নেপথ্যে ছিল আন্তর্জাতিক কোনো এক অপশক্তি, যা বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দিয়ে মদদ দিচ্ছিল, বাংলাদেশ সেই অপশক্তির ইচ্ছা পূরণে ব্যবহৃত হচ্ছিল! কী ভয়ানক আন্তর্জাতিক অপশক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ- হয়তোবা আগে থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে তেমনটি হয়েছিলও।

অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক একাধিক চক্র অতীতে কয়েকবার ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রের চালান পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে অন্তত দুই যুগ ধরে শান্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদান করেছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ভূ-রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পুরনো সেই অপশক্তিকে জীবিত বা সচল রাখার নীতি অব্যাহত ছিল, বাংলাদেশের একটি বিশেষ মহল সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মানসিকভাবেও একাত্ম ছিল- এমন অভিযোগও নতুন নয়, বেশ পুরনো। কিন্তু প্রমাণের অভাবে এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না অনেকের কাছেই। তবে ২০০১ সালের আগে ও পরে বাংলাদেশে যেভাবে জঙ্গিবাদী হামলা ও আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছিল, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে আন্তর্জাতিক কোনো একটি অপশক্তির আসর বাংলাদেশের ওপর ভালোভাবেই পড়েছে, গ্রেনেডসহ নানা মারণাস্ত্র বাংলাদেশে যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল তার প্রাপ্তির এ উৎস যতটা না দেশীয় জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, তার চেয়ে ঢের বেশি বিদেশি ওই সব মহল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ১৯৭১ সালে বিরোধিতা করেছিল, পরবর্তী সময়ে মেনে নিতে পারেনি। তবে তাদের আদর্শিক সহযোগী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও শক্তি এখানে নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পটপরিবর্তনসহ অনেক ঘটনাতেই দেশি-বিদেশি ওই সব মহল তৎপর ছিল, সেটিও অজানা ছিল না।
 তবে ২০০১-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একাত্তরের বিপরীত ধারায় চলে যায়, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পায়- এটি বেশ স্পষ্ট হচ্ছিল। বেশ কটি অস্ত্র চালান এই ভূমির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে, বগুড়ার কাহালুতে তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এর একটি বড় ধরনের প্রমাণ বহন করে। সেই অস্ত্রের চালানটি এভাবে প্রমাণ রেখে যাওয়ার পরও তৎকালীন সরকার কী চমৎকারভাবে চালানটি ধামাপাচা দিতে সক্ষম হয়।

চেষ্টা করেছিল দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিকেও ধামাপাচা দেওয়ার। স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের খবর শুনে কিছু বলেননি বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসায় এখন অনেক কিছুই দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের বিষয় পরদিন কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। এই মামলা দুটির ভাগ্য তখন যেভাবে নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলে মামলা এবং এত অস্ত্রের কথা অনেক আগেই হয়তো দেশবাসীকে ভুলে যেতে হতো। হয়তো অন্য কোনো জজ মিয়া নাটিকার কথা শুনে হাস্যরস উপভোগ করে সন্তুষ্ট হতে হতো! তিন বছর মামলাটি প্রায় তেমনই রূপ নিতে যাচ্ছিল। জনমনে তখন নানা সন্দেহ ও হতাশা সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। তবে ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নিলে মামলাটির মোড় ঘুরতে থাকে, বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন ভয়ানক সব তথ্য, যা আমাদের জন্য গ্লানিকর মনে হতে থাকে। মামলাটি ২০১১ সালের পর থেকে নতুন মাত্রা পেতে থাকে। তখন অবশ্য একধরনের শঙ্কাও তৈরি হতে থাকে এমন যে এর রায়টি আদৌ কোনো দিন আলোর মুখ দেখতে পাবে কি না। অবশেষে গত ৩০ জানুয়ারি বহুল প্রতীক্ষিত এই মামলার রায়টি জাতি জানতে পেরেছে। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড, একই সঙ্গে তাদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অস্ত্র আইনে করা মামলায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৮ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।

এই রায়ে বিগত জোট সরকারের দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তথা মতিউর রহমান নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের হতবাক করেছে। বেরিয়ে এসেছে সেই কালো বিড়ালের চেহারাটি, যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এত বড় অবৈধ অস্ত্র চালান পাঠাতে সাহায্য করেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে বেদনার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। যাঁরা সংবিধান রক্ষা করার শপথ নেন, যাঁরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁরা যদি গোপনে এমন ভয়ানক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, তাহলে তাঁদের রাজনীতির বাহ্যিক ও ভেতরগত চরিত্রের মধ্যে কত বড় ফারাক আছে, তা হাতেনাতে পাওয়ার এবং দেখার সুযোগ এই রায় থেকে পাওয়া গেছে।

 যতই এখন কেউ কেউ রায়টিকে 'রাজনৈতিক' বলে মন্তব্য করছেন, ভিন্নভাবে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁরাই দেশের রাজনীতির চেহারাটি এমন দ্বিবর্ণিক বা বিবর্ণিক করতে ভূমিকা রাখছেন বললে মনে হয় খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে যাবে। আমরা জানি না, উচ্চ আদালতে এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কত বছরে হবে, কেমন হবে। তবে আমরা আশা করব, দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনাটি আমাদের জাতীয় জীবনের শেষ গ্লানিকর ঘটনা হিসেবেই শেষ হবে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা দলমত-নির্বিশেষে সবাই একাত্ম হব, আমাদের ভূখণ্ড আর কোনো ষড়যন্ত্রকারী মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যবহৃত হওয়ার সামান্যতম সুযোগ পাবে না। আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও জাতিগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে সহাবস্থান করব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, মৈত্রীই আমাদের পথ চলার নীতি, কোনো ষড়যন্ত্রের কাছেই হার না মানা। দেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক সেই শক্তির নেতৃত্ব প্রদানই নিশ্চিত হবে- এমনটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

এবার বৃক্ষ নিধনকারী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হোক :কাওসার রহমান

এবার বৃক্ষ নিধনের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করা দরকার। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। তাই বৃক্ষ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা ও শাস্তির দাবি উঠেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতার অংশ হিসেবে জামায়াত-শিবির সারাদেশে বৃক্ষ নিধনের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা সারাদেশে ৬০ হাজারেরও বেশি গাছ নিধন করেছে। এর মধ্যে শুধু বন বিভাগেরই রয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি গাছ। সড়ক অবরোধের নামে দেশের ১০টি জেলার প্রধান সড়কের পাশে এসব ছায়াবৃক্ষ ধ্বংস করেছে জামায়াত-শিবির। এই ২০ হাজার গাছের সঙ্গে আরও কাটা গেছে লাখখানেক গাছের লতাগুল্ম ও বড় গাছের ডালপালা। আর্থিক হিসাবে এতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন সাইজের এই গাছ কাটার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে। 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছর সারাদেশে নিধন হয়েছে ৬৩ হাজার ৯০০ বৃক্ষ। বৃক্ষ নিধনের শীর্ষে রয়েছে নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজার জেলা। এসব জেলায় বৃক্ষ নিধন হয়েছে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত। এতে সারাদেশের পরিবেশগত আর্থিক ক্ষতি ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আন্দোলনের নামে এই বিপুল পরিমাণ বৃক্ষ নিধনের ক্ষতি পরবর্তী ২০ বছরেও পূরণ সম্ভব হবে না। কারণ, ২০-২৫ বছর বয়সী একটি বৃক্ষ নিধন হলে সেটির ক্ষতি পূরণ হতে ২০ থেকে ২৫ বছরই সময় লাগবে। এর আগে কোনভাবেই এই ক্ষতি পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। 
২০১৩ সাল আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি দুঃস্বপ্নের বছর। এ বছর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন করেছে। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে রাস্তার পাশের। এ গাছগুলোর মালিক বাংলাদেশ বন অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, এলজিইডি ও এনজিওরা। এর মধ্যে সামাজিক বনায়নেরও প্রচুর গাছ রয়েছে। সামাজিক বনায়নের এ সকল গাছ কাটার ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের দরিদ্র মানুষ। তারা তাদের অংশীদার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সর্বশেষ জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা বৃক্ষ নিধনের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যশোরে। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার খবর প্রচার হওয়ার পর পরই জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা যশোর-খুলনা মহাসড়কের চাউলিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের বিভিন্ন ধরনের গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দেয়। যশোর-খুলনা মহাসড়কের অন্তত ৩ কিলোমিটার এলাকায় গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। এছাড়াও সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধে কেশবপুর-বকুলতলা, কেশবপুর-কাটাখালী, কেশবপুর-চিংড়া, কেশবপুর-সাগরদাঁড়ি, যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশ থেকে হরতাল অবরোধের সমর্থকরা নানা প্রজাতির শত শত বৃক্ষ কেটে সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। 
জামায়াতের সহিংসতার নতুন তিন কৌশলের একটি হচ্ছে বৃক্ষ নিধন। গত ৫ মে ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশ থেকে এই বৃক্ষ নিধনের কাজ শুরু হয়। ওই সময়ে এক রাতের ব্যবধানে মতিঝিলের অতি চেনা শাপলা চত্বর অচেনা হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনকারীদের তা-বে। পল্টন মোড়ের প্রীতম হোটেলের সামনে থেকে বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের অন্তত শতাধিক গাছ কাটা হয়েছিল যার মধ্যে অনেক পুরনো দিনের গাছও ছিল। 
বাংলাদেশ বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূস আলী বলেন, ‘আন্দোলনের নামে সারাদেশে বৃক্ষ নিধনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সারাদেশে কাটা হয়েছে ৬০ হাজারেও বেশি বিভিন্ন ধরনের গাছ। এসব গাছ কাটার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে’। 
সারাদেশে গাছ নিধনের ফলে দেশের আর্থিক ও পরিবেশগত দুই ধরনের ক্ষতিই হয়েছে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে। এতে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন ও টর্নেডোর সংখ্যা। গাছপালা তার ডালপালার মাধ্যমে এ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাকে কমিয়ে দেয়। বাতাসের গতিবেশ সীমিত করে। এতে জীবন ও সম্পদহানি অনেক কম হয়। 
ভারসাম্যমূলক প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য দেশের মোট ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। সে ক্ষেত্রে সরকারী হিসেবে বাংলাদেশে বনভূমি পরিমাণ ১৭ শতাংশ। যেখানে তিনটি গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে লাগানো হচ্ছে একটি গাছ। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে ব্যাপক হারে নির্বিকার বৃক্ষ নিধনের ঘটনা ঘটছে। ফলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ নেমে এসেছে ৩.৬ শতাংশ। তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর আবহাওয়ায়। দিনের বেলা দুঃসহ গরম আর রাতে প্রচ- শীত অনুভূত হচ্ছে। আর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতার অন্যতম কারণ এই অকাতরে বৃক্ষ নিধন।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুই পাশে বিশাল যে রেইনট্রিগুলো এত দিন প্রকৃতির কোলে পর্যটকদের স্বাগত জানিয়ে আসছিল, সেগুলোর একটা বড় অংশ এখন আর নেই। ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ওই গাছগুলোর ছায়ায় প্রাণ জুড়াত পথচারীরা। পাখপাখালির আশ্রয়ও ছিল তারা। সে গাছগুলো কেটে ফেলেছে জামায়াত-শিবির। বাংলাদেশে গাছের ওপর আঘাত করে ঠিক যেন জীবন-জীবিকার ওপরই আঘাত করা হলো। প্রকৃতিবিদরা একে রাজনীতির নামে প্রকৃতির প্রতি প্রতিহিংসার এক নিকৃষ্ট নজির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 
ব্যাপক হারে এই গাছ কাটতে বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক করাত ব্যবহার করা হয়েছে। হাতে বহনযোগ্য ও দ্রুত গাছ কাটা যায় এমন করাত সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। বিশেষ করে টেকনাফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন এলাকায় এই করাত গাছচোরেরা ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে চীনের তৈরি এই করাতগুলো বাংলাদেশে ঢুকেছে। আসলে সড়ক অবরোধের জন্য এই ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবির আগেই এমন বিপুলসংখ্যক করাত সংগ্রহ করেছে।
হাতে বহনযোগ্য তিন থেকে নয় ফুট পর্যন্ত লম্বা যান্ত্রিক এই করাত দিয়ে একজন মানুষ ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে একটি গাছ কেটে ফেলতে পারে। এই ধরনের করাতের সামনের দিকে একটি ধারালো ব্লেড থাকে, যা রাবারের বেল্টের মাধ্যমে সচল হয়। সাধারণত বনের গাছ দ্রুত কাটতে গাছচোরেরা এটি ব্যবহার করে থাকে।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রাজশাহী জেলার প্রধান সড়কের গাছ নির্বিচারে কেটে অবরোধ করেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে নোয়াখালী জেলায়। সেখানে প্রায় আট হাজার গাছ নিধন করা হয়। এই গাছগুলোর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারই ছোট গাছ। বাকিগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, সাতক্ষীরা জেলা শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশের প্রায় তিন হাজার গাছ কাটা হয়। সাতক্ষীরার আশাশুনি সড়ক, কলারোয়া সড়ক ও সাতক্ষীরা-খুলনা প্রধান সড়কের দুই পাশে আকাশমণি, বেলজিয়াম, মেনজিয়াম, রেইনট্রি ও কড়ইগাছের শোভাও এতে ধ্বংস হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগের বয়সও ১০ থেকে ১৫ বছর।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও লোহাগাড়ায় প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এগুলো প্রায় সবই পুরনো গাছ। কক্সবাজারে প্রায় ২০০ এবং বাকি সাতটি জেলায় প্রায় তিন হাজার গাছ ধ্বংস করা হয়। কক্সবাজারের গাছগুলো দেশের অন্যতম পুরনো। স্থানীয় করাতকল মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, এ রকম একেকটি গাছের দাম প্রায় এক লাখ টাকা। আর ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী গাছের দাম স্থান ও প্রকৃতিভেদে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
নিধনের শিকার গাছের বেশিরভাগই সামাজিক বনায়নের আওতায় গ্রামের গরিব মানুষ সরকারের সহায়তায় রোপণ করেছিল। গ্রামের গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই গাছ লাগানো হয়েছিল। গ্রামবাসী বছরের পর বছর গাছগুলোর পরিচর্যা ও পাহারা দিয়ে আসছিল। সামাজিক বনায়নের এসব গাছ নিলামে বিক্রি করার পর পরিচর্যাকারী গরিব মানুষদের মোট দামের ৫৫ ভাগ পাওয়ার কথা ছিল। অবৈধভাবে গাছ কাটার ঘটনায় সারাদেশে ৫৬টি মামলাও হয়েছিল। কিন্তু বৃক্ষশত্রুদের শেষ পর্যন্ত আইনে শাস্তি হয়নি। 
চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের কৈয়ারপুল এলাকার বন বিভাগের উপকারভোগীদের সভাপতি সামছুল আলম মামুন বলেন, ‘আমরা বহু টাকা খরচ করে বাগানটি করেছি। এখানে সরকারের অংশ সামান্য আর পুরো অংশটাই আমাদের উপকারভোগীদের। অথচ গাছগুলো কেটে কেটে আমাদেরই ক্ষতি করা হয়েছে’।
গাছপালা পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। মানবজীবনে বৃক্ষের ভূমিকা সীমাহীন। গাছপালা ছাড়া এই পৃথিবীই অচল। পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম জাগরণ বৃক্ষ। বৃক্ষ পৃথিবীকে সুন্দর ও শোভন করেছে। শুধু তা-ই নয়, বৃক্ষই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। তাই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গাছপালার জুড়ি নেই। বৃক্ষ ও বনভূমি বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছাপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। বৃক্ষ মাটির ক্ষয় রোধ করে উর্বরাশক্তি বাড়ায়। ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে। মোটকথা গাছপালা না থাকলে পরিবেশ হয়ে উঠত আরও উষ্ণ। পৃথিবী হয়ে উঠত মরুভূমি। এর ফলে মানুষের অস্তিত্ব হতো বিপন্ন। মোট কথা বৃক্ষ ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয় ।
আমরা জানি পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু যদি বলা হয়, বৃক্ষের অপর নাম জীবন তাহলে অনেকের কাছেই তা অবাক লাগতে পারে। পানি ব্যতীত কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না, এটা সত্যি। কিন্তু সেই পানির প্রধান দুটি উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ অক্সিজেন সরবরাহ করে বৃক্ষ। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা পাই বৃক্ষ হতে। কোন কারণে বিশ্ব যদি কয়েক দিনের জন্য পানিশূন্য হয়ে যায় তাহলেও অনেক প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ এবং অন্য কোন প্রাণী এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রাণী জগতের টিকে থাকার জন্য বৃক্ষের উপস্থিতি কতটা অনিবার্য।
জামায়াত-শিবির চক্র নিজেকে ধর্মের ঠিকাদার মনে করে। অথচ ইসলাম ধর্মেই পরিবেশের পর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। তাই ইসলামে বৃক্ষ রোপণ এবং বৃক্ষের পরিচর্যার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান যুগে বৃক্ষ রোপণের ওপর যে গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে তার পথ প্রদর্শন করেছে ইসলাম। আজ হতে দেড় হাজার বছর আগেই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে গেছেন।
অকারণে বা বিনা প্রয়োজনে ইসলাম কাউকে গাছ কাটার অনুমতি দেয় না। কারণ যে ব্যক্তির জমিতেই গাছ জন্মাক না কেন তাতে অন্য মানুষ, এমন কি জীবজন্তু, পশুপাখির হক আছে। ইসলাম কোন ফলবান বৃক্ষের নিচে কাউকে মলত্যাগ করার অনুমতি দেয় না। মানুষ ইচ্ছেমতো গাছের ফল ভোগ করতে পারে। এমন কি কাঠ কেটে এনে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু অকারণে বনে আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে দেবার অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয় না। 
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যা করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তেও কারো হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে সে যেন তা রোপণ করে নেয়। কারণ এজন্য তাকে কিয়ামতের দিন অনেক সওয়াব দেয়া হবে। বৃক্ষরাজি সর্বদা আল্লাহকে সেজদারত থাকে এবং তারা তসবিহ পাঠ করতে থাকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তুমি কি দেখ না যে আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আকাশম-লীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রম-লী, পর্বতরাজী, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। বৃক্ষরাজি মানুষ এবং পশুপাখির কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। 
গাছ না থাকলে দেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে। যার মাসুল দিতে হবে পুরো জাতিকে। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের অস্তিত্ব। তাই মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছ পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান, যা সকল প্রাণীর জন্য যোগান দেয় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করে ধ্বংস করা হয়েছে প্রকৃতির এই মূল্যবান সম্পদকে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, যদি মানুষ হত্যা অপরাধ হয়, তাহলে মানুষের জীবন রক্ষাকারী বৃক্ষ নিধনও একই অপরাধ। মানুষ হত্যা করলে যদি কান্না আসে গাছ কাটলেও কান্না করা উচিত। রাজনীতির নামে পরিবেশ রক্ষাকারী লাখ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধের চেয়ে কম নয়। রাজনীতির নামে যারা পরিবেশ ধ্বংস করছে তারাই আবার মুখে বলছে মানুষকে বাঁচানো ও মানবতা রক্ষার জন্য এ গাছ কাটা হয়েছে। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশ ধ্বংস হোক এটা কারও কাম্য নয়। বৃক্ষ নিধনকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। 
সিটিজেন রাইটস্ মুভমেন্ট মহাসচিব তুষার রেহমানের মতে, হেফাজত ইসলামের আন্দোলন থেকে বৃক্ষ নিধনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। হেফাজত ইসলাম ও কয়েকটি ইসলামী সংগঠন ধর্মের নামে গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করেছে। এই বৃক্ষ নিধনকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার করা উচিত। 
নগরের ইটপাথর কংক্রিটের স্তূপের মাঝে গাছ মানুষকে ছায়া ও শীতল হাওয়া দেয়। উষ্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীর কার্বন শোষণ করে গাছ এ বিশ্বকে রক্ষা করে চলেছে। আর গাছ হচ্ছে, আমাদের যান্ত্রিক সভ্যতার রুক্ষতার মাঝে মমতাভরা পৃথিবীর প্রাণের পরশ। এসব গাছ বড় হতে কত সময় নেয়, কত যতœ করতে হয়। এইসব বৃক্ষ নিধন করে যে ক্ষতি হলো তা কখনও পূরণ করা সম্ভব নয়। নির্মমভাবে নিমিষে তাদের কেটে ফেলা হচ্ছে, অথচ একটি গাছ বড় করতে কত কত বছর লাগে তা কি তারা ভাবে না ? এই ক্ষতি তো তাদেরও, গাছ কি কেবল আওয়ামী দেখে ছায়া দেয়, বাতাস দেয়, কার্বন শুষে অক্সিজেন দেয়? লোকগানের চারণ এক কবি একটি গোলাপ নিহত হলে তার বিচার চেয়েছিলেন- আর হাজার হাজার এইসব বৃক্ষ হত্যার বিচার কে করবে?

লেখক : সাংবাদিক