Monday, February 3, 2014

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় এবং কার দায় কী?- মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী


ঠিক ১০ বছর আগের ঘটনা। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার জেটি ঘাটে বিপুল পরিমাণ আধুনিক মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি চালান আটকে দেওয়ার একটি পিলে চমকানো ঘটনা ঘটেছে। 'ধর্মের কল আপনা আপনিই বাজে'- বাংলার চিরায়ত এই প্রবাদটি ফলে গেল! এভাবে ফলার হয়তো কথা ছিল না। কেননা, এর সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ইচ্ছা, ইশারা এবং পরিকল্পনা যুক্ত ছিল। সুতরাং কারোরই টের পাওয়ার কিছু ছিল না। জানা বা বোঝারও কোনো সুযোগ ছিল না। তার পরও চালানটি ধরা পড়ে যায়।

এখানেই নিয়তি, কথা আসে। যেহেতু কাজটি বেআইনি, রাষ্ট্রীয় নর্মসবিরোধী- তাই সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে যারা এমন মারণাস্ত্র চালানে সহযোগিতা করেছিল, তাদের সবই করতে হয়েছিল লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে, অন্তরালে থেকে। যেহেতু চালানটি ছিল আকারে বিশাল, গন্তব্য বেশ দূরে, তাই সব চোখকে ম্যানেজ করা, ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। পরিকল্পনাকারীরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এত বিশাল এক খারাপ উদ্দেশ্য সাধন করার ব্যাপারে আস্থাশীল থাকতে পারে; কিন্তু যেহেতু বিষয়টি ছিল একটি গোপন পরিকল্পনা, তাই এর উপস্থিতি, রেখে যাওয়া চিহ্ন, পথচলা ইত্যাদি মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু এমন অপকর্মের হোতা ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল, এমন অপকর্ম করার কোনো 'যোগ্যতা' তাদের ছিল মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই জেটি ঘাটেই ঘটে গেল অভাবনীয় সেই ঘটনাটি।

 রাতের আঁধারে ঘটা ষড়যন্ত্র ফাঁস হতে শুরু করে। একটি টেলিফোন থেকে একটি অজ্ঞাত কল। ব্যক্তিটিও অজ্ঞাতই ছিলেন। কিন্তু পুলিশের কানে ফিসফিস শব্দও নাকি ভূমিকম্পের মতো সব কিছুকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। এখানেও ঘটল তা-ই। একটি-দুটি নয়, দশ-দশটি ট্রাকে এক হাজার ৪৬৩টি বাক্স ভর্তি অস্ত্র। এমন সব অস্ত্রের নামধাম যা মনে রাখাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। তবে ভড়কে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বললেও যেন কম বলা হবে।

এসব অস্ত্র দিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনীর বিদেশি বা যেকোনো আক্রমণকারী শক্তির সঙ্গে মোটামুটি একটি স্মরণীয় যুদ্ধ সংঘটিত করা সম্ভব। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পড়লে দীর্ঘমেয়াদি একটি রক্তঝরা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে জঙ্গিদের হাতে তা পড়লে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অবস্থা কী হতে পারত তা কি আমরা আদৌ কল্পনা করতে পেরেছি? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সে ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে চলে যেত, তা ভাবা উচিত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। এত অস্ত্র কোনো রাষ্ট্র তার সেনাবাহিনীর জন্য কিনতে গেলেও সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কয়েকবার। এর মূল্যমান যেমনি বড় অঙ্কের, তেমনি সামরিক গুরুত্বও অত্যধিক। তেমন একটি অস্ত্র চালান গোপনে ভিড়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি কারখানার ঘাটে। ভাবতেই মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা।

 ক্ষমতায় তখন ছিল এমন একটি সরকার- যারা কথায় কথায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একক দাবিদার বলে প্রচার করত, তাদের বিপক্ষে দলের হাতে নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া হয়! এত বড় অস্ত্র চালানটির নেপথ্যে ছিল আন্তর্জাতিক কোনো এক অপশক্তি, যা বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দিয়ে মদদ দিচ্ছিল, বাংলাদেশ সেই অপশক্তির ইচ্ছা পূরণে ব্যবহৃত হচ্ছিল! কী ভয়ানক আন্তর্জাতিক অপশক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ- হয়তোবা আগে থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে তেমনটি হয়েছিলও।

অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক একাধিক চক্র অতীতে কয়েকবার ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রের চালান পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে অন্তত দুই যুগ ধরে শান্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদান করেছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ভূ-রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পুরনো সেই অপশক্তিকে জীবিত বা সচল রাখার নীতি অব্যাহত ছিল, বাংলাদেশের একটি বিশেষ মহল সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মানসিকভাবেও একাত্ম ছিল- এমন অভিযোগও নতুন নয়, বেশ পুরনো। কিন্তু প্রমাণের অভাবে এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না অনেকের কাছেই। তবে ২০০১ সালের আগে ও পরে বাংলাদেশে যেভাবে জঙ্গিবাদী হামলা ও আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছিল, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে আন্তর্জাতিক কোনো একটি অপশক্তির আসর বাংলাদেশের ওপর ভালোভাবেই পড়েছে, গ্রেনেডসহ নানা মারণাস্ত্র বাংলাদেশে যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল তার প্রাপ্তির এ উৎস যতটা না দেশীয় জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, তার চেয়ে ঢের বেশি বিদেশি ওই সব মহল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ১৯৭১ সালে বিরোধিতা করেছিল, পরবর্তী সময়ে মেনে নিতে পারেনি। তবে তাদের আদর্শিক সহযোগী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও শক্তি এখানে নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পটপরিবর্তনসহ অনেক ঘটনাতেই দেশি-বিদেশি ওই সব মহল তৎপর ছিল, সেটিও অজানা ছিল না।
 তবে ২০০১-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একাত্তরের বিপরীত ধারায় চলে যায়, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পায়- এটি বেশ স্পষ্ট হচ্ছিল। বেশ কটি অস্ত্র চালান এই ভূমির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে, বগুড়ার কাহালুতে তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এর একটি বড় ধরনের প্রমাণ বহন করে। সেই অস্ত্রের চালানটি এভাবে প্রমাণ রেখে যাওয়ার পরও তৎকালীন সরকার কী চমৎকারভাবে চালানটি ধামাপাচা দিতে সক্ষম হয়।

চেষ্টা করেছিল দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিকেও ধামাপাচা দেওয়ার। স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের খবর শুনে কিছু বলেননি বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসায় এখন অনেক কিছুই দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের বিষয় পরদিন কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। এই মামলা দুটির ভাগ্য তখন যেভাবে নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলে মামলা এবং এত অস্ত্রের কথা অনেক আগেই হয়তো দেশবাসীকে ভুলে যেতে হতো। হয়তো অন্য কোনো জজ মিয়া নাটিকার কথা শুনে হাস্যরস উপভোগ করে সন্তুষ্ট হতে হতো! তিন বছর মামলাটি প্রায় তেমনই রূপ নিতে যাচ্ছিল। জনমনে তখন নানা সন্দেহ ও হতাশা সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। তবে ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নিলে মামলাটির মোড় ঘুরতে থাকে, বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন ভয়ানক সব তথ্য, যা আমাদের জন্য গ্লানিকর মনে হতে থাকে। মামলাটি ২০১১ সালের পর থেকে নতুন মাত্রা পেতে থাকে। তখন অবশ্য একধরনের শঙ্কাও তৈরি হতে থাকে এমন যে এর রায়টি আদৌ কোনো দিন আলোর মুখ দেখতে পাবে কি না। অবশেষে গত ৩০ জানুয়ারি বহুল প্রতীক্ষিত এই মামলার রায়টি জাতি জানতে পেরেছে। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড, একই সঙ্গে তাদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অস্ত্র আইনে করা মামলায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৮ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।

এই রায়ে বিগত জোট সরকারের দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তথা মতিউর রহমান নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের হতবাক করেছে। বেরিয়ে এসেছে সেই কালো বিড়ালের চেহারাটি, যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এত বড় অবৈধ অস্ত্র চালান পাঠাতে সাহায্য করেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে বেদনার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। যাঁরা সংবিধান রক্ষা করার শপথ নেন, যাঁরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁরা যদি গোপনে এমন ভয়ানক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, তাহলে তাঁদের রাজনীতির বাহ্যিক ও ভেতরগত চরিত্রের মধ্যে কত বড় ফারাক আছে, তা হাতেনাতে পাওয়ার এবং দেখার সুযোগ এই রায় থেকে পাওয়া গেছে।

 যতই এখন কেউ কেউ রায়টিকে 'রাজনৈতিক' বলে মন্তব্য করছেন, ভিন্নভাবে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁরাই দেশের রাজনীতির চেহারাটি এমন দ্বিবর্ণিক বা বিবর্ণিক করতে ভূমিকা রাখছেন বললে মনে হয় খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে যাবে। আমরা জানি না, উচ্চ আদালতে এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কত বছরে হবে, কেমন হবে। তবে আমরা আশা করব, দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনাটি আমাদের জাতীয় জীবনের শেষ গ্লানিকর ঘটনা হিসেবেই শেষ হবে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা দলমত-নির্বিশেষে সবাই একাত্ম হব, আমাদের ভূখণ্ড আর কোনো ষড়যন্ত্রকারী মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যবহৃত হওয়ার সামান্যতম সুযোগ পাবে না। আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও জাতিগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে সহাবস্থান করব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, মৈত্রীই আমাদের পথ চলার নীতি, কোনো ষড়যন্ত্রের কাছেই হার না মানা। দেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক সেই শক্তির নেতৃত্ব প্রদানই নিশ্চিত হবে- এমনটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment