Friday, September 13, 2013

মিনি পৃথিবী -আমেরিকা নিয়ে এক ডজন : মুহম্মদ জাফর ইকবাল



আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে, অন্যরা পি.এইচ.ডি. করতে। এরা সবাই এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে জীবন হিসেবে বেছে নিলে পি.এইচ.ডি. করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি নিজেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার এই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেছে নেওয়ার আগে কোথায় কী ধরণের প্রোগ্রাম, কোন প্রফেসর কী গবেষণা করেন, তাদের র‌্যাংকিং কী রকম এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। আমার মনে আছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক করেছিলাম তার প্যাডের কাগজটি দেখে (না, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না)।

যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকাতে আঠারো বছর ছিলাম, এরপরেও অনেকবার যেতে হয়েছে, তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোনো বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র-ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো।
আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল এরকম :

০১.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বা সহজ কথায় আমেরিকা) পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্যে সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু তাদের দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)।
এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে সব দেশে হানাহানি খুনোখনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমেরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্যে সেটি চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়, তাই থাকার জন্যে, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্যে আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।

০২.
আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথে ঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পড়ে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।

০৩.
পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয়, সবার নামের দুটো অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্য এবং শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবুর রহমান) সেটা তারা জানে না। খেয়ালি বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা জানে না। একটু ঘনিষ্ঠ হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছু দিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদেরকে মোহাম্মদ বলে ডাকছে! তাই ঘনিষ্ঠদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায়, সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বরে দেওয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD লেখা খুবই বিপজ্জনক, তারা সেটাকে ডাক্তারি ডিগ্রি মনে করে সবসময়ই নামের পিছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

০৪.
যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায়, তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু তারা যখন খরচ করতে যায়, তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখামাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমড়ি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকেট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিমের কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সন্তানের পরিবারের জন্য সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা যারা এই দেশে বনানী গুলশানের হাইফাই দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ, এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে।) কাজেই অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে মনে মনে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।

আমেরিকায় কেনাকাটার আরেকটা বিষয় হচ্ছে ‘টিপস’, এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বখশিশ। কিন্তু বখশিশ শব্দটায় তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননার ছাপ রয়েছে। টিপস শব্দটিতে তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননা নেই। আমেরিকার মূলধারায় প্রায় সব তরুণ-তরুণী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে বড় হয়েছে। তখন তাদের বেতন বলতে গেলে ছিলই না এবং খদ্দেরদের টিপসটাই ছিল তাদের বেতন। সে দেশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, নাপিত বা ক্যাব ড্রাইভারকে টিপস দিতে হয়। হতচ্ছাড়া কিপটে মানুষদের হাত গলে ১০% টিপসও বের হতে চায় না, দরাজদিল মানুষেরা দেয় ২০% আর মাঝামাঝি পরিমাণ হচ্ছে ১৫%।
কাজেই বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে কোথাও খেলে গেলে মেন‍্যতে খাবারের দামটা দেখে আগেভাগেই তার সাথে ১৫% থেকে ২০% যোগ করে রাখাটা জরুরি।

০৫.
আমরা হাত দিয়ে ডাল-ভাত-সবজি-মাছ-মাংস মাখিয়ে মাখিয়ে খাই। আমেরিকা গিয়েও বাসার ভেতরে নিজে রান্না করে সবকিছু হাত দিয়ে খাওয়া যাবে। বাইরে হ্যামবার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা পিৎজা (উচ্চারণটা পিজ্জা নয়, পিৎজা) হাত দিয়ে খেতে পারলেও বেশিরভাগ খাবার ছুরি-কাটা ব্যবহার করে খেতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে খাবার জন্য চামচ দেওয়া হয়। ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু ডাইনিং টেবিলে চামচ নেই, শুধু ছুরি আর কাটা। কোন হাতে ছুরি, কোন হাতে কাটা ধরতে হয় সেরকম নানা ধরণের নিয়ম কানুন রয়েছে। সেই নিয়ম আবার ইউরোপে একরকম, আমেরিকায় অন্যরকম। কিন্তু মূল বিষয়টা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষ ডান হাতে কাজ করে এবং কাটাকাটি করতে একটু জোর লাগে, তাই ছুরিটা থাকবে ডান হাতে (এবং খাওয়ার প্রক্রিয়াতে সেটা কখনো মুখে ঢোকানো যাবে না, প্রয়োজনে আমি ডাইনিং টেবিলে অন্যের ছুরি ব্যবহার করতে দেখেছি।) এটাই নিয়ম। আমেরিকাতে কাটার জন্য কোনো নিয়ম নেই। যারা ডান হাতে কাজ করে অভ্যস্ত তারা ছুরি দিয়ে কাটাকাটি শেষ করে প্লেটে ছুরিটা রেখে ডান হাতে কাটাকা তুলে নিয়ে খায়। শুনেছি বিশুদ্ধ এরিস্টোক্রেট (বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভ্রান্ত। শব্দটি এরিস্টোক্রেসি পুরোটা ফুটে উঠে না, তাই আসল শব্দটাই ব্যবহার করতে হলো!) মানুষেরা মরে গেলেও ডান হাতে মুখে খাবার তুলে না। এই নিয়মগুলো কে করেছে এবং কেন এই নিয়মেই খেতে হবে, অন্য নিয়মে কেন খাওয়া যাবে না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে অনেক আমেরিকানরা কিন্তু চপ স্টিক (দুই টুকরো কাঠি) দিয়ে খেতে পারে। আমার ধারণা একবার চপ স্টিক দিয়ে খেতে শিখে গেলে খাওয়ার জন্য এটা খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি।

আমার কিছু আমেরিকান বন্ধু আমাদের দেখাদেখি হাতে খেতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আঙুল দিয়ে খাবার মাখিয়ে মুখ পযন্ত নিয়ে গেলেও মুখে সেই খাবার ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। পাঁচটা আঙুল মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে সেখানে খাবারটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে- কাজটা মোটামুটি অসম্ভব। যারা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, তাদেরকে বলে দেওয়া যায় আমরা কিন্তু মুখের ভেতর আঙুল ঢোকাই না, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবারটা মুখে ঢুকিয়ে দেই। অত্যন্ত দক্ষ একটা পদ্ধতি।

০৬.
খাবারের কথা বলতে হলেই পানীয়ের ব্যাপারটা তার সাথে সাথে চলে আসে। আমেরিকায় ট্যাপেয় পানি বিশুদ্ধ, তাই পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। শুনেছি নিউ ইয়র্কের মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে বিশাল আকারের সফট ড্রিংক বেআইনি করে দেওয়া হয়েছে! তবে এ্যালকোহল জাতীয় পানীয় (সোজা বাংলায় মদ) নিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা যায়। যারা এটা খেতে চায় না, আমেরিকানরা কখনোই তাদেরকে সেটা খেতে জোরাজুরি করবে না। তবে মদ খাওয়া বাঙালিদের কথা আলাদা, তারা নিজেরা সেটা খায় বলে অন্যদের খাওয়ানোর জন্য বাড়াবাড়িতে ব্যস্ত থাকে। বাঙালিদের আসরে তারা অন্য বাঙালিদের জোর করে, তাদের চাপ দেয় এবং না খেলে তাকে নিয়ে টিটকারি-ঠাট্টা তামাশা করে। এর কারণটা কী, আমি এখনো বের করতে পারিনি।

০৭.
খাবার এবং পানীয়ের কথা বলা হলেই এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে টয়লেটের কথা বলা উচিত। লোকচক্ষুর আড়ালে এর খুটিনাটি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে কিন্তু ছাপার অক্ষরে কিছু লিখে ফেলাটা শোভন হবে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়টা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, আমরা যেভাবে শিখেছি!

০৮.
ডাইনিং টেবিল আর টয়লেটের পরে নিশ্চয়ই বাথরুমের ব্যাপারটা আসার কথা। নিজের বাসায় নিরিবিলি বাথরুমের মাঝে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমেরিকার গণ বাথরুমের মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমাকে আগে থেকে কেউ সতর্ক করে দেয়নি, তাই প্রথমবার যখন আমার ডর্মিটরির গণবাথরুমে একজন আমার সামনে জামা-কাপড় খুলে পুরোপুরি ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিল, সেই আতঙ্কের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না! এরপর অনেকদিন পার হয়েছে, আমি অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়েছি কিন্তু গণ-বাথরুমে উদাস মুখে শরীরে একটা সূতা ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দৃশ্যে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারিনি। এই জন্মে সেটা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।ছেলেরা ছেলেদের সামনে এবং মেয়েরা মেয়েদের সামনে জামা-কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলতে কোনো লজ্জা অনুভব করে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে আমি কোনোদিন বুঝতে পারব না!

০৯.
আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে, তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিনস পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাসে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা, মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কখনো আমার স্যুট-টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না! আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমায় সেরকম জাযগায় যেতে হচ্ছে না।)

১০.
আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে, তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক। পান চিবুতে চিবুতে এদিক-সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেয়ালের কোনাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্য!) শুধু পানের পিক নয়, চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে কেউ অন্যায় মনে করে না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠার আগে এই অভ্যাসগুরো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে।)

একটা বড়সরো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারাল অনুষ্ঠানে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়।) তবে পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি, ঢেকুর এরকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায়, তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো। সেটা হচ্ছে- থ্যাংক ইউ। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ অনুভব করি, তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।

১১.
আমেরিকাতে তরুণ-তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না। কারণ তাহলে অন্যরা সেটাকে বিশেষ এক ধরণের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা-কাচ্চারা সেটা পড়ে ফেলে বলে খবর পেয়েছি –তাই এই বিষয়টাকে আর বিস্তৃত করা গেল না!)

১২.
আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটা বলার জন্য উপরের কথাগুলো একটি ভনিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবারে আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, সেটা একটা কৌতুকের মতো)।
তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে, তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না। আমি আশায় আশায় থাকি, যে কোনোদিন এই দেশের সরকার একটি দুটি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে, আমার খুব ইচ্ছে তারা অত্যন্ত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক, এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।

আমাদের দেশ থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়ে সেখানে থেকে যায়, তাদেরকে আসলে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ কখনো ভুলতে পারে না যে, তারা এই দরিদ্র দেশটির মূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিদানে তারা দেশকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকাকে (বা সেরকম কোনো একটা দেশকে) সেবা করে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে।

আরেক ভাগ মানুষ এই অপরাধ বোধ থেকে বের হওয়ার জন্য অত্যন্ত বিচিত্র একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। সেটা হচ্ছে- সবকিছুর জন্য নিজের দেশটিকেই দায়ী করা। তারা প্রতি মুহূর্তে দেশকে গালাগাল দেয়। তারা বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেয়, এই পোড়া দেশে জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণোর সুযোগ নেই, তাদের মেধা কিংবা প্রতিভা ব্যবহারের সুযোগ নেই, এই দেশে জন্ম হওয়াটাই অনেক বড় ভুল হয়েছিল। এখন আমেরিকাতে আসন গেড়ে সেই ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিজের দেশটি কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তার সমস্ত পরিসংখ্যান তাদের নখদর্পণে। দেশের অবিবেচক মানুষ কীভাবে রাজনীতি করে, হরতাল দিয়ে, সন্ত্রাস করে দুর্নীতি করে পুরো দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, সেটা তারা শুধু নিজেদের মাঝে নয়, বাইরের সবার সাথেও আলোচনা করে সময় কাটায়।

আমার যে ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে, তাদের এই স্বার্থপর অংশ থেকে সতর্ক থাকতে বলেছি। সম্ভব হলে একশ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছি। পৃথিবীতে যত রকম অনুভূতি আছে, তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে সেরা জিনিসটি হচ্ছে মাতৃভূমি। মাতৃভূমিটি যখন সবকিছুতে আদর্শ হয়ে উঠবে শুধু তখন থাকে ভালোবাসব আর যখন সেটা দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হবে তখন তাকে ভালোবাসব না, সেটা হতে পারে না। যে সব তেভাগারা নিজের দেশকে ভালোবাসার সেই মধুর অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি, আমি আজকাল তাদের জন্য করুণাও অনুভব করি না।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি ছিলাম সেখানকার একমাত্র বাংলাদেশি (দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে যে ছাত্রীটি এসেছিল, ঝটপট তাকেই আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম!)।
এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাঙালি আছে, খাঁটি বাঙালি।

মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসী হওয়ার পর বাংলাদেশের সেই মানুষগুলোই হয়ে উঠে পরিবারের মানুষও, হয়ে উঠে আপনজন। সুখে-দুঃখে তারা পাশে থাকে, যখন দেশকে তীব্রভাবে মনে পড়ে তখন এই দেশের মানুষগুলোই তাদের সান্ত্বনা দেয়।

তখন কিন্তু একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুখে-দুঃখে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়েই সময় কাটাবে, নাকি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষগুলোর সাথেও একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? যারা শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গেই গল্প-গুজব, আড্ডা, রাজনীতি কিংবা অনেক সময় দলাদলি করে সময় কাটায়, তারা কিন্তু অনেক বিশাল একটা ক্যানভাসে নিজের জীবনটাকে বিস্তৃত করার একটা চমৎকার সুযোগ হারায়। একটা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা পৃথিবীর গণ্ডির মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কিন্তু অনেক বড় সুযোগ। কেউ যখন প্রথমবার আবিষ্কার করে গায়ের রং, মুখের ভাষা, ধর্ম, কালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সবাই যে হুবহু একই রকম মানুষ, সেটি অসাধারণ একটি অনুভূতি।

কাজেই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বারবার করে বলেছি, তারা যেন নিজের দেশের মানুষের পাশাপাশি আমেরিকার মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভিন্ন কালচারের বৈচিত্রের সৌর্ন্দয্যটা যেন উপভোগ করে। তারা যেন হাইকিং করে, জগিং করে, ক্যাম্পিং করে, হাজার হাজার মাইল ড্রাইভে করে ঘুরে বেড়ায়, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে বনেট খুলে ঠিক করে ফেলতে শিখে, তারা যেন তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে, সমুদ্রের নিচে স্কুবা ড্রাইভিং করে, ছবি আঁকতে শিখে, গান গাইতে শিখে, মিউজিয়ামে যায়, অপেরা দেখে, কনসার্টে যায় এক কথায় যে বৈচিত্রময় কাজগুলো কখনো করার সুযোগ পায়নি, সেইগুলো করে জীবনটাকে উপভোগ করে। (কেউ কী বিশ্বাস করবে আমার মতো একজন মানুষ পর্বতারোহণের ট্রেনিং নিয়ে আইস এক্স আর ক্লাইমিং রোপ হাতে তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে বরফের ওপর ক্যাম্প করে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি? পর্বতের চূড়ায় উঠে উল্লাসিত হয়েছি?)

কোনো কিছু থেকে কী সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে? আগে ছিল না, এখন আছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাজী নাফিসের ঘটনাটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের চেলাচামুণ্ডারা সেই দেশে আজকাল খুবই সক্রিয়। আমেরিকার সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তারা শুধু নিজেরা থাকে না, তাদের আগে পিছনের কয়েক প্রজন্মকে সেই দেশে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দেশটিকে তারা মনে করে কাফেরদের দেশ। ভিন্ন ধর্মের জন্য অবজ্ঞা দেখিয়ে যখন কেউ কাফেরদের দেশে থাকার কলাকৌশল শেখাতে এগিয়ে আসবে, তাদের থেকে সাবধান। ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন কালচার মানে খারাপ ধর্ম আর খারাপ কালচার নয়। ভিন্ন মানে বৈচিত্র আর বৈচিত্র হচ্ছে সৌন্দর্য্য। এটা যত তাড়াতাড়ি জানা যায়, ততই ভালো। যারা জানে না, তারা নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়। তাদের থেকে সাবধান।

আর সেই দেশে দীর্ঘ দিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে তখন কী করতে হবে?

তখন তারা আবার এই দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে দেশ মাতৃকাও ঠিক সেরকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে।

আমি বাড়িয়ে বলছি না –আমি এটা জানি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। priyo.com

Thursday, September 12, 2013

সম্পাদকরা না বুঝেই বিবৃতি দিয়েছেন : তথ্যমন্ত্রী


মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা নিয়ে সরকারের কার্যক্রম খতিয়ে না দেখে, না বুঝে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ভবিষ্যতে না জেনে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে 'ওকালতি' না করার ব্যাপারেও সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ প্রসঙ্গে গত শনিবার দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
ইনু বলেন, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, অশান্তি
তৈরিতে উস্কানি দেওয়া, সাইবার হ্যাকিং কি অপরাধ নয়? এ ধরনের অপরাধীরা কি আইনের ঊধর্ে্ব থাকবে?'
'আমার দেশ' প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন অসীম, দায়িত্বশীলতাও তেমনি অসীম। আমার দেশ পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে সেই দায়িত্বশীলতাকে গুরুত্ব দেয়নি। পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদক 'হ্যাকিং' বা চুরি করা এবং মিথ্যা-উস্কানিমূলক সংবাদ ও ছবি ছেপে দেশে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে, উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে পত্রিকাটি। এসব কাজ ফৌজদারি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনবিরোধী অপরাধ। মন্ত্রী বলেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতেই আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের সমালোচনা এবং ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ার কারণে আমার দেশের সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়নি।
মন্ত্রী দাবি করেন, এই সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য কখনও কাউকে বাধা দিচ্ছে না সরকার।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দৈনিক 'আমার দেশ', দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, এর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সম্পর্ক নেই। তাই মাহমুদুর রহমানের মতো কলঙ্কজনক ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া সংবাদপত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে গণমাধ্যমকর্মীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
আমার দেশের ছাপাখানা বন্ধ প্রসঙ্গে ইনু বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকলেও পত্রিকাটি ছাপাতে আইনগত কোনো বাধা নেই এবং বৈধ অনুমতি নিয়ে অন্য ছাপাখানায় তা ছাপাতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, 'তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুসারে পত্রিকাটির ছাপাখানায় তল্লাশি চালানো হয় এবং সেখানে অপরাধ সংঘটিত করার যন্ত্রপাতি ও হ্যাকিংয়ের প্রমাণাদি জব্দ করা হয়েছে এবং ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিচারকাজের স্বার্থে যতক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত শেষ না হবে, ততক্ষণ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকবে।'
মাহমুদুর রহমান তার মাকে নিয়েও জালিয়াতি করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্য ছাপাখানা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের যে নিয়ম রয়েছে দৈনিক আমার দেশ তা পালন করেনি। যে কারণে দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা আল-ফালাহর বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের মাকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান দেখিয়ে সত্য গোপন করে সংগ্রাম পত্রিকার ছাপাখানা থেকে তারা পত্রিকা প্রকাশ করেছে।'
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা করেনি। তাদের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা চিঠির জবাব দিয়েছে। জবাব সন্তোষজনক হলে চ্যানেল দুটি আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে।
১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের বিস্ময়
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের বিবৃতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল সম্মিলিত সাংস্কৃৃতিক জোটের নির্বাহী সদস্য হানিফ খান স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি, প্রগতি ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও শুধু পেশাগত ঐক্যের কারণে এসব আদর্শে বিরোধিতাকারী, রাষ্ট্রীয় আইন ও শান্তি ভঙ্গের উস্কানিদাতা মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দেশের কয়েকজন বরেণ্য সম্পাদকের বিবৃতি প্রদানে আমরা বিস্মিত, হতবাক ও মর্মাহত হয়েছি। বিবৃতিতে শুধু পেশাগত ঐক্য নয়_ মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, প্রগতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের দৃঢ় অবস্থান প্রত্যাশা করা হয়। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অনুপম সেন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, গোলাম কুদ্দুছ ও মুহাম্মদ সামাদ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিস্ময়
মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বিস্ময় ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। রোববার এক বিবৃতিতে ফোরাম নেতৃবৃন্দ মাহমুদুর রহমানকে 'সংবাদপত্রের গণশত্রু' আখ্যা দিয়ে বলেন, আমরা বিস্মিত, মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান রোববার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পবিত্র কাবা শরিফ এবং মৃত্যুদ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দৃশ্যমান_ এরকম সংবাদ ও ছবি প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার হীনউদ্দেশ্যে এ পত্রিকাটি ক্রমাগত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা ও অগি্নসংযোগে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করে। আমরা মনে করি, পরিকল্পিতভাবে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এমন একজন সম্পাদককে গ্রেফতার ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করা যে কোনো দায়িত্বশীল সরকারের অবশ্য করণীয়।
তারা বলেন, ১৬ সম্পাদকের মধ্যে প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সম্পাদকের সঙ্গে কতিপয় প্রগতিবিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্রের সম্পাদকের নাম দেখে আমরা মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করব, দেশপ্রেমিক সম্পাদকরা এ ব্যাপারে তাদের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবেন।

সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি- মনজুরুল আহসান বুলবুল



গত ১৮ই মে দেয়া ১৫ জন সম্পাদকের বিবৃতি ‘সম্ভবত কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করেছে বলে বিবৃতিদাতা সম্পাদকরাও মনে করছেন। সে কারণেই কৈফিয়ত না দিলেও বিবৃতি দেয়ার কারণটি আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হচ্ছে।

বলে রাখি; সম্মানিত সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি। যারা মনে করেন মাহমুদুর রহমান সম্পাদক নন তাদের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করি। দেশের প্রচলিত আইন যেমন সম্পাদক হওয়ার কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়নি, আবার কাউকে বারিতও করেনি। মাহমুদুর রহমানকে কেউ ‘‘হঠাৎ সম্পাদক” বলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু তিনি একজন সম্পাদক বটে। সরকার, সচেতন সম্পাদকমণ্ডলী বা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কেউ এখনও এমন একটি বিধি-আইন-নীতিতে একমত হতে পারেননি যে একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হওয়ার মাপকাঠি কি। প্রভাব থাকলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া যায়, মালিক তো হওয়া যায়ই, প্রিন্টার্স লাইনে নাম লিখে সম্পাদকও হওয়া যায়। বলতে খচ্ খচ্ করলেও সত্যি হচ্ছে, ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত একটি সংবাদপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তারা সকলেই সম্পাদক। তবে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ১৫ জন সম্পাদক নতুন কোন বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন কিনা তা তারাই বলতে পারবেন কিন্তু এই পঞ্চদশের অনেকেই যে তাদের অনেক পুরনো বন্ধুদের বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সে তো নানাভাবেই দৃশ্যমান।

কেন এ বিভ্রান্তি? সাধারণের প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো এরকম:
১. কেন ১৫ জন সম্পাদক, কেন আরও বেশি নয়? যে ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মতোই আরও যে সম্পাদকদের আমরা সম্মান করি তারা কেন এই বিবৃতিতে সই করলেন না? মানেটি হচ্ছে: কিছু সম্পাদক আছেন যারা এই ১৫ জনের মতকে ধারণ করেন না; কাজেই তারা এই পঞ্চদশের সঙ্গে নেই।

২. বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মালিক-সম্পাদকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ- বিএসপি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে; নিউজ পেপার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াব। এই সংগঠন আমন্ত্রণমূলক, সম্মানিত কয়েকজন মালিক সম্পাদক এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন; তারা যাদের আমন্ত্রণ জানাবেন তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন। সাধারণভাবে সকল মালিক বা সম্পাদক তাদের সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে; এই বিবৃতিতে নোয়াব এবং অ-নোয়াব একাকার হয়েছে। অর্থাৎ নোয়াব যে সম্পাদকদের তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেন না; এই বিবৃতিতে তারাই হয়েছেন নোয়াবের সদস্যদের সহযোদ্ধা। অন্যদিকে নোয়াব-এর তিনজন সদস্য এই বিবৃতিতে সই করেন নি। মানুষ বিভ্রান্ত হবে না কেন?
৩. বিবৃতিদাতাদের অন্তত একজন সম্পাদক বিবৃতিদাতা অপর দু’জন সম্পাদক সম্পর্কে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেছেন, রায়ও তার পক্ষেই গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী দুই সম্পাদক এই বিবৃতিতে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী সম্পাদকের সঙ্গে। মামলার ফরিয়াদি ও প্রতিপক্ষ একই কাতারে। বিস্ময় এখানেও।

৪. বিবৃতিদাতা সম্পাদকদের দু’জন এমন একটি পত্রিকার সাবেক ও বর্তমান সম্পাদক যে পত্রিকা থেকে ভারতীয় অর্থপুষ্ট সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই তালিকায় বিবৃতিদাতা একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ভারতীয়দের কাছ থেকে কত টাকা নেন তা-ও উল্লেখ ছিল। নৈতিকতাহীন ও চরম দায়িত্বহীন সেই সংবাদপত্রের সঙ্গে অপূর্ব সম্মিলনী দেখা গেল দায়িত্বশীল ও উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার সেই সম্পাদককেও। হোঁচট এখানেও।

নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও বিবৃতিদাতাদের এই একতা একদিকে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। বিবৃতিদাতা একজন সম্মানিত সম্পাদক লিখছেন; মাহমুদুর রহমানকে অনেকগুলো অভিযোগে মাসখানেক ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। গূঢ়ার্থ হচ্ছে: আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযোগ থাকলেও কাউকে আটকে রাখা যাবে না। যদি এই যুক্তিতেই এখন বিজিএমইএ রানা প্লাজার আটক গার্মেন্ট মালিক বা প্রকৌশলীদের কোন সমিতি সেই ভবনের নকশা অনুমোদনকারী বর্তমানে আটক প্রকৌশলীদের মুক্তি দাবি করেন? কারণ এখনও তো তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিবৃতিদাতাদের এই যুক্তি মেনে নিলে তো গোলাম আযম, নিজামী সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়। আদালতে ‘গিলটি’ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো তারা ‘ইনোসেন্ট’ !

এ বিবৃতি নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সম্মানিত সম্পাদকদের প্রজ্ঞার প্রতি যে প্রশ্ন তুলেছেন তারও প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিদাতা সম্পাদকগণ গত কয়েক দশক ধরে দেশ, উপমহাদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। কাজেই না জেনে-বুঝে তারা এই বিবৃতিতে সই করেছেন এমন সহজ সমীকরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন এই বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষেও যেমন এই সম্পাদকদের দৃঢ় যুক্তি রয়েছে, যদি তারা বিবৃতি না দিতেন তাহলেও তারা সফলভাবেই সেখানেও যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন। যে সম্পাদকরা বিবৃতিতে সই করেননি তারাও নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে সকল বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যথাসময়ে প্রেস নোট কেন দেয়া হচ্ছে না? স্বয়ং মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবৃতিতে পরিণত হয়। সরকারি প্রেস নোট বিষয় ভিত্তিক সরকারি ব্যাখ্যা তুলে ধরে; হতে পারে সরকারি প্রেস নোট ছলনাময়ীর প্রেমের মতোই মিথ্যা কিন্তু সরকারের অবস্থান স্পষ্টকরণের জন্য এই অন রেকর্ড সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রথাটি পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত। পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে পারে।

তবে এত বৈপরীত্য, নানা বৈচিত্র্যের একতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যেও এই সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতিতে আমরা আশান্বিত হতেই পারি। কারণ সব কিছু ভুলে অভিভাবকের মতো তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে অধিকার তা রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এই রকম অভিভাবক দেশের গণমাধ্যম জগতের দীর্ঘদিনের চাহিদা। একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে সে প্রশ্ন উঠেছে অনেক দিন আগেই। অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হন। কিন্তু এই ঐক্য তো শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের মতোই কঠিন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা যদি হন এক ইউনিয়নের নেতা আর শেখ হাসিনার টিকিট নিয়ে তার দলের এমপি প্রার্থী যদি আরেক ইউনিয়নের নেতা হন তা’হলে এই দুই ইউনিয়নের মধ্যে নেহায়েৎ অর্থনৈতিক দাবি ছাড়া আর কোথাও ঐক্যের জায়গা তো দেখি না। তার ওপর আবার এক শীর্ষ নেতা এখন লিখিতভাবে নসিহত করছেন যে, নারী সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের রিপোর্টারদের যেন স্পর্শকাতর বিষয়ে এসাইনমেন্ট দেয়া না হয়। তারপরেও রুটি-রুজির সংগ্রামে সাংবাদিক ইউনিয়নই তো আমাদের ভরসা। এর পাশাপাশি সম্মানিত সম্পাদকগণ যদি পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এক হয়ে এগিয়ে আসেন তা তো আশারই কথা। কিন্তু হতাশা সব সম্পাদকও এখানেও এক হতে পারলেন না।

সে কারণেই আশাজাগানিয়া এই উদ্যোগ নিয়ে একটু হতাশা আছেই। সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতি প্রসঙ্গে একজন সম্পাদকের ব্যাখ্যায় [দৈনিক সমকাল, ২৪শে মে ২০১৩] যে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ১৫ জনের বিবৃতিতে একটি প্যারাগ্রাফেও যদি সেই বর্ণনাটি তুলে ধরা হতো তা’হলেও বিবৃতিদাতারা এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেন না একথা বলা যায়। জানি না দৈনিক সমকাল সম্পাদকের অবস্থানটি সকলেই সমর্থন করেন কিনা। বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটটির ন্যূনতম বর্ণনা না থাকায় বিবৃতিটি দাতাগোষ্ঠী এবং দূর থেকে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠীর বিবৃতির মতোই মনে হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সময়কার তরুণ শিক্ষার্থী পরে জগৎখ্যাত ইতিহাসবিদ, অক্সফোর্ডের শিক্ষক, বাংলাদেশেরই ‘বরিশালের পোলা’ তপন রায়চৌধুরী। তাঁর ‘বাঙালনামা’য় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)

কোন মন্তব্য নেই, শুধু একটিই জিজ্ঞাসা। বিবৃতিদাতা সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত দৃশ্যপটের সঙ্গে সামপ্রতিক বাংলাদেশের কোন মিল খুঁজে পান কিনা? কোন চরিত্রের কোন খোঁজ পান কিনা? জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর বলে এই পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে বরেণ্য সম্পাদকদের মতামত এবং অবস্থান কি সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারেন।

এই বাস্তবচিত্র মাথায় রেখেই তবুও আশাবাদী হতে চাই এ কারণে যে, সাংবাদিকতা পেশার অভিভাবকরা যখন একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তখন বোধ করি এই শিল্প ও পেশার জন্য কিছু একটা হবে। প্রত্যাশা; মালিক ও পেশাদার সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সম্পাদকগণ দেশের গণমাধ্যমের সঙ্কটের এই সময় দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখবেন। তাদের কাছে এই প্রত্যাশা এ কারণেই যে, একজন সম্পাদককে সাংবাদিকরা জানেন পেশায় তাদের অভিভাবক হিসেবেই। নষ্ট সন্তান বিপদগ্রস্ত হলে তার মুক্তি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে ভ্রষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও অভিভাবকদের। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক এক জন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে- সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং তার পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? একটু পেছনে দেখুন... বাংলাদেশে যে সব গণমাধ্যম বিপদগ্রস্ত হয়েছে তা হয়েছে শুধু মালিকদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সাংবাদিকের পেশাগত কোন কারণে বাংলাদেশে কোন গণমাধ্যম বন্ধ হয়নি। সব জেনে শুনে, আইন ভাঙবেন মালিকরা আর বিপদগ্রস্ত হবেন পেশাজীবী সাংবাদিক কর্মচারীরা- এ যেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কোন গণমাধ্যম, সম্পাদক বা সাংবাদিক আক্রান্ত হলে সম্পাদক বা সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমন বাস্তবতা পাওয়া গেছে।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা আর নৈতিকতার মাপকাঠি পৃথিবী জুড়েই আজ একটি দৃশ্যমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে কারা সাংবাদিক, কারা নন- সে প্রশ্ন নিয়ে। বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সনাতনী গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কোথায় এসে মিলবে (স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দৃশ্যত ব্যাপক বিসতৃত, বিবৃতিদাতা বা মধ্যরাতের টকশো কাঁপানো অনেক সম্পাদকের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক যোগাযোগ কর্মীর অনুসারীদের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি ও কার্যকর)।
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির অতিব্যবহার এই পেশার মানবিকতাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সংবাদের তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতা কত সত্যকে হত্যা করছে, সমাজে সাংবাদিকতার অতি প্রভাবের ক্ষমতা কোন কোন গণমাধ্যমকে কিভাবে দানবে পরিণত করছে, সমপাদকদের অতিমাত্রায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চাপ রিপোর্টারকে বেশি বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে কিনা এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোড়িত এখনকার গণমাধ্যমের শিক্ষা ও গবেষণার জগৎ। গণমাধ্যমের এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে গণমাধ্যমকেই এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন অভিভাবক সম্পাদকরাই।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে অনেক অভিভাবককে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। এ কারণে কিছুকাল আগে একজন স্বনামখ্যাত সম্পাদক তার বক্তব্যে দাবি জানিয়েছিলেন সম্পাদকদেরই প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেবে কে? তবুও শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের প্রতিই আস্থা রাখতে হবে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি আমাদের সম্পাদকদের বিভক্তির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ- দেশের গণমাধ্যমের চেহারায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সকল সম্পাদকের একসঙ্গে এগিয়ে আসা। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এবং ইউনিয়নের কতিপয় শীর্ষ নেতার অতিমাত্রার রাজনৈতিক চেহারা যত হতাশাই ছড়াক ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেবে রুটি-রুজি আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পেশাদার সম্পাদকরা দেবেন পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের নেতৃত্ব। এই যৌথ উদ্যোগ দিয়েই অনেক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে।

সর্বশেষ খবর: সম্মানিত সম্পাদকগণ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খুবই আশার কথা, এই সংগঠন নিশ্চয়ই সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখবে। কোন সম্পাদকের অপেশাদারিত্বের কারণে কারও জীবন ও সম্মান বিপন্ন হলে সেদিকটাও এখন দেখতে হবে এই পরিষদকে (অপেশাদারী সম্পাদকের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে তরুণরা বিপন্ন জীবন যাপন করছেন তারা নিশ্চয়ই কথা বলার একটি জায়গা পেলেন)।
এই সংগঠন যাতে কোন অপেশাদার ও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি অনুসরণ করেন না এমন কোন সম্পাদকের আশ্রয়স্থল না হয়। তবে শেষতক মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক আর পেশাদার সম্পাদকের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। নবগঠিত সম্পাদক পরিষদের অনেক নেতাই ওয়েজবোর্ডে মালিক হিসেবেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আবারও বলি: বিবৃতি দিয়ে ১৫ সম্পাদক কতটা অর্জন করেছেন তার মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই যে হোঁচট খেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বিবৃতিদাতা অনেক সম্পাদকই যেহেতু অভিভাবকতুল্য- সে জন্যই প্রত্যাশা করি তারা যেন হঠাৎ করে আমাদের কাছে অচেনা না হয়ে যান। অভিভাবকরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিবারের নিষ্ঠাবান সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন, সে জন্যই এই রচনা। আশা করি, এই রচনায় তারা বিরূপ হবেন না। এই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক

Sunday, September 8, 2013

দুই দেশের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থেই চাই ছিটমহল বিনিময়-সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


http://www.banglanews24.com/categorizednews.php?newtype=32
৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক।