Saturday, October 19, 2013

কথিত নাস্তিকেরা “নাস্তিক” নন-পিনাকী ভট্টাচার্য



নাস্তিক শব্দটি বাংলা নয়, সংস্কৃত এবং বৈদিক। শব্দটি যখন বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়, সে সময় যারা এই শব্দটাকে বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তারা শব্দটার সঠিক অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেকারণে নাস্তিক বলতে সংস্কৃতে যা বোঝায় বাংলায় সেটা বোঝানো হয়না। বাংলায় নাস্তিককে এথিস্টের সমার্থক মনে করা হয়। এই সরলীকরণ ধর্মতত্ত্বের জন্য একটা বড় সমস্যা। কারণ সংস্কৃতে নাস্তিক মানে নিরীশ্বরবাদী নয়। বিশেষ করে নাস্তিক শব্দটি যারা আবিষ্কার করেছে তাঁদের জন্যও নাস্তিক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার অস্বস্তিকর। ধর্মতাত্ত্বিক এই জটিল সমস্যা মেটানোর জন্য প্রয়োজনে বাংলা অভিধান সংশোধন করা যেতে পারে।

হিন্দু ধর্মতত্ত্বে নাস্তিক বলতে তাঁদেরকেই বোঝায় যারা বেদের অপৌরুষেয়তায় বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ বেদকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ মনে করে না। এর মানে এটা নয় যে নাস্তিকরা নিরীশ্বরবাদী বা ধর্মদ্রোহী। হিন্দুদের মধ্যে চার্বাক পন্থীরা ধর্ম পালন করেও নাস্তিক্যবাদের চর্চা করতে পারেন। তারা বেদের পশুঘাত, শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মানেন না। হিন্দু ধর্মের মতে ভারতীয় দর্শনের মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মও নাস্তিক দর্শন।

নাস্তিক শব্দটা অবশ্য প্রথমে ঘৃণা ও অবহেলা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো। কিন্তু নাস্তিক ও আস্তিকদের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা তীক্ষ্ণ বিতর্কে হিন্দু ধর্মের কঠোরতা পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতবর্ষের অহিংসার দর্শন নাস্তিকদের অবদান। জৈন আর বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হওয়ার ক্ষেত্রে চার্বাক নাস্তিকদের অবদান অনস্বীকার্য। নাস্তিকদের কারণেই হিন্দু ধর্ম সংস্কার এবং এর ফলে মানব জীবনের আদর্শ উচ্চতর হয়েছে। তর্কবিদ্যাও নাস্তিকদের অবদান।

এথিস্টদের নিরীশ্বরবাদী বলার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে, কারণ বৌদ্ধরা নিরীশ্বরবাদী। তবে কী বলা যায় এথিস্টদের? আমার প্রস্তাব যাদের জন্য এটা মাথা ব্যথা তারা একটু এটা নিয়ে মাথা ঘামাক।

হেফাজতে ইসলামী কি জানে যে এটা একটা বিশুদ্ধ সংস্কৃত এবং কঠোর বৈদিক শব্দ?

লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট Unmochon

আলোর জরিপে এতটা আঁধার ! জামায়াত, তোমার কী লাগে আর ? -ফেরদৌস আরেফীন



বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র উদ্যোগে একটি পেশাদার জরিপ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া সর্বশেষ রাজনৈতিক জরিপটি অনেকগুলো কারণেই বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এবং নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মতানৈক্য থেকে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কারণে, জনমত ভিত্তিক রাজনৈতিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত এই জরিপটি গেল ১০ অক্টোবর দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামে বিশাল অংশ জুড়ে ছাপা হওয়ার পর থেকে অনেকেই এটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা-মন্তব্য করছেন, সোজা কথায় মাথা ঘামাচ্ছেন। জরিপের উদ্যোক্তা দৈনিক পত্রিকাটি তাদের এই জরিপটির স্বপক্ষে একাধিক মতামত তথা উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে, জরিপ থেকে উঠে আসা ফলাফলগুলো আমলে নিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারলে তারা লাভবান হবে বা হতে পারবে -এমন একটি মতবাদ দেয়ারও চেষ্টা করেছে। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জরিপটি নিয়ে আলোচনা, টক-শো আয়োজন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখ থেকেও এই জরিপ বিষয়ে যার-যার অবস্থান অনুযায়ী কম-বেশি বক্তব্য পাওয়া গেছে।
জরিপটি প্রকাশের পর এর খুঁটিনাটি পড়ে এবং ‘প্রথম আলো অনলাইন’ সংস্করণ থেকে মুল জরিপের ইংরেজি ভার্সনটিতে চোখ বোলানোর পর, দীর্ঘ রিপোর্টিং ক্যারিয়ারে জন্ম নেয়া ব্যাক্তিগত ‘সন্দেহপ্রবণ ও অনুসন্ধানী’ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করে জরিপটির গোড়াতেই অনেকগুলো বেখাপ্পা গলদ আমার চোখে পড়ে। আমি কোনো জরিপ বিশেষজ্ঞ নই, অর্থনীতি বা পরিসংখ্যানের লোকও নই। কিন্তু মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদ চর্চায় নিজেকে একজন অগ্রপথিক মনে করি। আর দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র জরিপটি তাই যুক্তির ছকে ফেলে তাতে মুক্তচিন্তার প্রয়োগের পর কিছু বিষয়ের জন্য এটিকে সোজা ভাষায় ‌উদ্দেশ্যমূলক, দূরভিসন্ধীমূলক এবং এক বা একাধিক বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টায় সুকৌশলে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে মূল্যায়ণ করা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছুই মনে করা সম্ভব হয়নি! আর, বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেনী, পেশা ও বয়সের পাঁচ হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়েছে এবং যে কোনো জরিপের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য এই ‘পাঁচ হাজার’ সংখ্যাটি একটি বৃহত্ এমনকি যথেষ্ঠেরও অধিক বলে আ্যখ্যা দিয়ে, বারবারই পত্রিকাটি এই জরিপটিকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রায়-বাস্তবসম্মত মানের একটি জরিপ হিসেবে আখ্যা দেয়ার যে চেষ্টা করছে, তার জবাবে শুধু একটা কথাই বলতে হয়- তথ্যদাতার বিশাল সংখ্যা কিংবা তথাকথিত ‘বহুস্তরবিশিষ্ট প্রণালিবদ্ধ দৈবচয়ন নমুনায়ন ভিত্তিক’ –এরকম যত কথাই বলা হোক না কেন, জরিপের ফলাফল বলতে গেলে পুরোটাই নির্ভর করে মতামত গ্রহণের জন্য প্রস্তুতকৃত প্রশ্ন ও বিষয়াবলীর ওপরই। আর এক্ষেত্রে প্রশ্নের ধরন ও মাত্রিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র জরিপে ওই পাঁচ হাজার মানুষের মতামত গ্রহণের সময় তাদের সামনে রাখা প্রশ্ন ও বিষয়াবলী এতটাই উদ্দেশ্যমূলক, একপাক্ষিক, বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতা বিবর্জিত ছিলো যে, এই জরিপের ফলাফল শেষ পর্যন্ত পুরো জাতির মনে কেবল একরাশ বিভ্রান্তি আর দোলাচলের সৃষ্টি করেছে, আর এটাই ছিলো জরিপের মূল উদ্দেশ্য।
জরিপের শুরুতেই দেখা যায়, ‘প্রথম আলো’র ছাপার ভাষায়- “এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে দেশের ৩৬.৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে, আর ৫০.৩ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে চান”। আবার এই জরিপেরই আরেকটি অংশে দেখা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পক্ষে আছেন দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসলে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াটি নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে- সে কথা পাগলেও জানে। জরিপ থেকে উঠে আসা এই দুই তথ্য দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পক্ষে থাকা ওই ৮০ শতাংশ মানুষের ৩৬.৫ শতাংশ যদি আওয়ামী লীগে ভোট দিতে ইচ্ছুক অংশের সেই মানুষেরা হয়ে থাকেন, তাহলে বিচারের পক্ষে থাকা বাদবাকি ৪৩.৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়েও কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? তারা সবাই কি এতটাই বিভ্রান্ত? নাকি জরিপ প্রতিষ্ঠানটি বেছে-বেছে কেবল বিভ্রান্ত ব্যাক্তিদের কাছ থেকেই মতামত সংগ্রহ করেছে? নাকি আবার এই সাড়ে ৪৩ শতাংশ মানুষ ভাবছেন যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া এরকমই চালু রাখবে? কিন্তু স্বয়ং বিএনপি-চেয়ারপার্সন যেখানে বলেছেন যে, “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের বিচার করা হবে”, সেখানে বিএনপি ক্ষমতা পেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভদ্রলোকের মতো চালিয়ে যাবে –এটা চিন্তা করা তো একেবারেই অসম্ভব! এই জরিপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমর্থন করা মানুষের অনুপাত এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত নিয়ে পাওয়া অনুপাত দেখে মনে হয় যেন, এই ফলাফল দুটি জরিপের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র সেই চিরায়ত আওয়ামী-বিরোধীতা সত্ত্বেও প্রগতিশীলতার ভাব রক্ষার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষাবলম্বন করা এক অদ্ভুত-সাংঘর্ষিক মানসিকতারই বহি:প্রকাশ। ঠিক এরকম বহি:প্রকাশই ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ দেখিয়েছিলো এ বছরের এপ্রিল মাসে, এই একই বিচার সম্পর্কিত অন্য একটি ইস্যুতে- যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে শাহাবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এবং ওই মঞ্চে ‘প্রথম আলো’র বেশ ক’জন সিনিয়র কর্তাব্যাক্তির নিয়মিত-সরব উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, সেই ‘প্রথম আলো’তেই আবার হাসনাত আবদুল হাই রচিত চরম বিতর্কিত একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের গোটা বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি হীন-জঘণ্য অপচেষ্টার মাধ্যমে। অব’শ্য ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে ‘মাফ চেয়ে’ গল্পটি ‘প্রত্যাহার’ করে নেয় পত্রিকাটি! (ছাপানো অক্ষর প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অদ্যাবধি ধরেনি!)
এ তো গেল একটা ভন্ডামি। এবার লক্ষ্য করুন আরেকটি আরও ভয়াবহ বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস। তা হলো এই যে, জরিপটি করার সময় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে মানুষের মতামত নেয়া হলেও, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তখন এই বিচার প্রক্রিয়া চলমান কিংবা স্থবির –এ দুই অবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কোনো ধরনের মতামতই নেয়া হয়নি! অথচ পুরো জাতির সামনে এখন এটি একটি অনেক বড় প্রশ্ন! বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিচারের কি হবে, ট্রাইবুনাল থাকবে নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাবে- এসব নিয়ে জনগণের মধ্যে যে চরম শঙ্কা-সন্দেহ-দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে, সেটি ‘প্রথম আলো’র জানা নেই- তাও কি বিশ্বাস করতে হবে! আবারও বলতে হচ্ছে, যে কোনো জরিপের ফলাফল পুরোপুরিই বিষয় আর প্রশ্নের ওপর নির্ভরশীল। প্রশ্ন না থাকলে উত্তর-অনুপাত আসবে কোথা থেকে?
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, যুদ্ধাপরাধের রায় নিয়ে বিএনপি’র নীরব ভূমিকা বিষয়েও এই জরিপে ভোট বা মতামত নেয়া হয়েছে! বিএনপি’র নীরবতা সঠিক না বেঠিক- তা নিয়ে জনগণের এত মাথাব্যাথা তো কোত্থাও দেখলাম না? তাহলে ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কিসের? অথচ এর চেয়ে অনেক-অনেক জরুরী বিষয় বিএনপি ক্ষমতায় আসলে এই বিচার প্রক্রিয়ার ভবিষ্যত্ কি হবে- সেই প্রশ্ন বা প্রসঙ্গই নেই জরিপে? আসলে বিএনপি’র নিরবতা নিয়ে জরিপে অহেতুক টানাটানির কারণ ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ না বললেও আমরা যে বুঝি না, তা কিন্তু নয়‍! রায় নিয়ে বিএনপি’র নীরবতার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপিকে কিঞ্চিত বিব্রত করার মধ্য দিয়ে বন্ধুপ্রতীম জামায়াতকে একটু খুশী করাই ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র উদ্দেশ্য? বন্ধুর খারাপ সময়ে এরকম ছোট-ছোট ‘গিফট’ মন্দ নয়! ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’কে বলতে চাই, বন্ধুকে ‘গিফট’ দেয়ার উদ্দেশ্যে, গণমানুষের প্রকৃত চিন্তাধারাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য অযাচিত-অপ্রয়োজনীয় চিন্তাকে সামনে টেনে আনার এই অপকৌশল নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর পরিনাম কখনোই ভালো হয়নি, বরং বুমেরাং হয়েছে। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন তুঙ্গে থাকা অবস্থায় নিজের গদি বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে স্বৈরাচারী এরশাদ গণমানুষের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে সারাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগানোর যে চেষ্টা করেছিলেন- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় এরশাদের সেই সাজানো খেলায় অংশ না নিয়ে, বরং এরশাদের পালিত গুন্ডা-বাহিনীর হাত থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুদেরকে নিজেদের গৃহে আশ্রয় দিয়ে, স্বৈরাচারের ওই শেষ অপচেষ্টাটিও ভন্ডুল করে দিয়েছিলো। আর আন্দোলনের শেষদিকে স্বৈরাচারের সেই রায়ট-নাটক গণঅভ্যুত্থানের পালে যেন আরও বেশি হাওয়ার যোগানই দিয়েছিলো। ‘প্রথম আলো’তে কর্মরত পরম শ্রদ্ধাভাজন সিনিরয় সাংবাদিক ভাইদের সেই ঘটনাগুলো তো ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ডসহ মনে থাকার কথা! তবুও কেন তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভবিষ্যত্ বিষয়ে বিএনপি’র যে সিদ্ধান্ত বা চিন্তাটি এদেশের প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষের এই মুহূর্তের প্রধানতম জিজ্ঞাসা- তার বিন্দুমাত্র ধারে-কাছে না গিয়ে, শুধুই জামায়াতকে খুশি করতে বিএনপি’র নিরবতা নিয়ে অহেতুক গবেষণায় মত্ত হলেন? এই বুঝি ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো’র নমুনা?
বিশাল আরেকটি গলদ রেখে দিয়েছেন কৌশলী ‘প্রথম আলো’।
খুব কৌশলে কাজ সারলেও গলদটি রয়েই গেছে তাদের অগোচরে। সেটি হলো এই যে, ‘প্রথম আলো’র আগের জরিপটির মতো এবারের জরিপেও জামায়াত নিষিদ্ধের বিপক্ষে নাকি মত দিয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ! মানবতাবিরোধী অপরাধ আইন অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধের বিচার মানে শুধু কিছু ব্যাক্তির বিচার করাই নয়, বরং অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা। মাত্র আট মাস আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনের সর্বশেষ সংশোধনটি আশা করি ‘প্রথম আলো’র বিজ্ঞতম সাংবাদিকবৃন্দ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাননি! আর তাঁরা নিশ্চই এটাও ভোলেননি যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল একাধিক আসামীর রায় ঘোষণার সময় জামায়াতে-ইসলামী নামের রাজনৈতিক সংগঠনটিকেও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ও সংশ্লিষ্ট বলে কঠোর ভাষায় মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু ‘প্রথম আলো’র আগেরটি এবং এবারেরটি- এই দু’টো জরিপেই জামায়াত নিষিদ্ধ করা বিষয়ে মানুষের মতামত নেয়া হলেও, জামায়াত নিষিদ্ধের চেয়েও অনেক বেশি জরুরী এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়- যুদ্ধাপরাধের দায়ে মানবতাবিরোধী অপকর্মে জড়িত সংগঠন হিসেবে জামায়াতে-ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখী করা নিয়ে কোনো মতামতই নেয়া হয়নি! এর কারণ কি হতে পারে? পাঠক, কষ্ট করে খুঁজতে হবে না, আমিই বলে দিচ্ছি- গত কয়েক মাসে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ‘প্রথম আলো’র সংবাদ আর উপ-সম্পাদকীয়গুলো নেড়েচেড়ে দেখলে জামায়াতে-ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখী করার প্রতি তেমন কোনো তাগাদাই চোখে পড়ে না। আবারও সেই একই ‘এরশাদীয়’ অপকৌশল! জামায়াতে-ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা বিষয়ে ‘প্রথম আলো’র জরিপে এই বিভ্রান্তিকর ‘হ্যাঁ-না’ ভোটাভুটির ফলাফল প্রকৃত অর্থে এই দাঁড়ালো যে- জামায়াত নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দেয়া যে ৭০ শতাংশ মানুষের কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে-ইসলামীর বিচার চান, কিংবা জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এই জরিপ করা সময় যেভাবে প্রশ্নটি করা হয়েছে- ঠিক সেভাবে সরাসরি সরকারের নির্বাহী আদেশে দলটিকে নিষিদ্ধ না করে বরং মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটিতে ওই দলটির রাজনীতি করার অধিকার চিরদিনের জন্য তুলে নেয়ার পক্ষে কতজনের মত আছে, অথবা উচ্চ-আদালতের রায়ে যে উপায়ে জামায়াতে-ইসলামীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো- সেরকম পদ্ধতি অবলম্বনে কিছু একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া ওই ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে কতজন আশা করছেন – এসবের প্রশ্নের একটিরও উত্তরও জানার ‍সুযোগ পাওয়া গেল না এই জরিপ থেকে। উপরন্তু, জনগণের যে বিশাল অংশটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে-ইসলামীর বিচার আশা করেন এবং যাদের তীব্র দাবির প্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধন করে ব্যাক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো- তাদের সবাইকে সুকৌশলে খাটো করার এক নষ্ট-খেলা হয়ে গেলো এই জরিপের আড়ালে! ‘প্রথম আলো’ কি মনে করে যে, তারা যেটিকে প্রশ্ন কিংবা ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করে সেটির ওপর মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে অনুপাত গুনে ছাপিয়ে দেবেন, সেটাকেই আমাদের ইস্যু হিসেবে মেনে নিতে হবে? আর অধিকাংশ জনগণের মগজে যেটি আসলেই ইস্যু হয়ে বসে আছে, সেটির কোনো খবরই থাকবে না? এমনটা মনে করলে সামনে চরম ধরা খেতে হবে, অতীতে যারা এমনটা ভেবেছে- প্রত্যেকে ধরা খেয়েছে, মনে করে দেখুন।
জরিপ ব্যবহার করে জামায়াত নিয়ে ধোঁয়া ছড়ানোর এখানেই শেষ নয়। জরিপের একটি অংশে মতামত নেয়া হয়েছে- যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে, যার বিপক্ষে ৮৬ শতাংশ এবং পক্ষে ১৩ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন। এই সমীকরণ হয়তো বোকার মতো আমিও সাত-পাঁচ না বুঝে মেনেই নিতাম, যদি না চতুর ‘প্রথম আলো’ বিএনপি, আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির পাশাপাশি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পরও এবারের জরিপে জামায়াতে-ইসলামীর জনসমর্থন বিচারের বোকামিটুকু না করতো। করেছে, বেশ করেছে, আমি সূত্র পেয়ে গিয়েছি! জরিপের হিসাব অনুসারে, দলীয় সমর্থনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী’র সমর্থক যদি মাত্র ২.৯ শতাংশই হয়ে থাকেন, তাহলে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন- এমন মানুষের সংখ্যা কেমন করে ১৩ শতাংশ হয়? জামায়াত সমর্থনকারী ২.৯ শতাংশ বাদে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থন করা বাকি ১০.১ শতাংশ মানুষ কারা? তারা কি বিএনপিকে সমর্থন দেয়া সেই ৫০.৩ শতাংশের অংশ? কিন্তু এটা তো বাস্তবে হওয়ার কথা নয়! তাই যদি হবে, তাহলে তো একের পর এক জামায়াত নেতাদের রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে বিএনপি’র কিছুটা হলেও অংশগ্রহণ দেখা যাওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু তা তো মোটেও দেখা যায়নি, বরং ক্ষমতার জোটসঙ্গী হয়েও রায়ের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে এবং হরতালে কোনো ধরনের সমর্থন ঘোষণা না দিয়ে, জামায়াতে-ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি’র দীর্ঘ-প্রেমময় সম্পর্কটি অনেকটা যেন বিচ্ছেদেই রূপ নিয়েছে। হায় রে প্রগতিশীল ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’... জামায়াতের পিঠ-বাঁচাতে আর জামায়াতের কাছে ভালো সাজতে এতটাই বুদ্ধিব্যায়!
সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে নয়, বরং দেশের একজন ক্ষুদ্র নাগরিক এবং বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন নগদ টাকায় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার একজন নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ কর্তৃপক্ষের কাছে আমি জানতে চাই- রাষ্ট্রের বা জনগণের ক্ষতি হয় ‌এমন যে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান অবলম্বন করা কি প্রতিটি গণমাধ্যমের জন্য আবশ্যক নয়? যদি তাই হবে, তবে জামায়াতে ইসলামীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি জরিপে স্থান দিয়ে এর পক্ষ-বিপক্ষ যাচাইয়ে আপনাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? যদি আরও বেশি মানুষ কিংবা ধরা যাক বেশিরভাগ মানুষই কোনো বিশেষ কারণে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষে মতামত প্রদান করতো, তাহলে কি আপনারা এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক ও বৈধ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিতেন? অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষের মতামত জানার বা নেয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, জামায়াতে-ইসলামীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষ অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়ে আপনারা কী বোঝাতে চাইলেন? দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্যই কি শুধু এটা করা? নাকি জামায়াতের হরতালে বিএনপি’র সমর্থন-অংশগ্রহণ না থাকায় জামায়াত প্রশ্নে বিএনপিকে খাটো করার এটিও আরেকটি অপকৌশল? অথবা নাকি জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মতো একটা জঘণ্য বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ-চেষ্টার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এদেশের জনগণের মধ্যে বেড়ে ওঠা অন্য কোনো বিপরীত চিন্তাধারাকে উপহাস করার উদ্দেশ্যও লুকায়িত আছে এর মধ্যে? মাননীয় ‘প্রথম আলো’, তবে কি শেষ পর্যন্ত আপনারা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে উপহাসে মেতে উঠলেন? জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষ অনুসন্ধানের প্রকৃত কারণটির ব্যাখ্যা ‘প্রথম আলো’র কাছ থেকে না পেলে এগুলোই কারণ হিসেবে বুঝে নিতে হবে আমাদের।
পাঠক, এবার বলুন দেখি, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামায়াতে-ইসলামীর রাজনীতি বিষয়ে ‘প্রথম আলো’র সাম্প্রতিক এই জরিপে এই যে এতগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্যের কথা এতক্ষণ ধরে জানালাম -এর একটিও কি আদতেই জরিপে উঠে এসেছে? নাকি খুব কৌশলের সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উঠিয়ে আনা হয়েছে? রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে-ইসলামীর যেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারই কোনো বৈধতা নেই, সেখানে দলটির জনসমর্থন যাচাই, দলটিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের কৌশলী প্রয়োগে এটিকে নিষিদ্ধের বিপক্ষে একটি বড় সংখ্যা দাঁড় করানো এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে বিচারের আওতায় আনার গণদাবি থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা, বিএনপি’র প্রতি সমর্থন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করা- একই সঙ্গে এরকম দুটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বিষয়ের পক্ষে দুটো বড় সংখ্যা প্রদর্শনের মাধ্যমে, প্রকৃতপক্ষে এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তিকর চিন্তা ছড়ানো অপপ্রয়াস, জামায়াতের ক্ষুদ্র সমর্থন সত্ত্বেও তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষে সমর্থকের চেয়ে চার-গুনেরও বেশি মানুষের মতামত প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে জামায়াতকে ধ্বংসযজ্ঞে ইন্ধন যোগানো –এভাবে একটি মাত্র জরিপ-প্রক্রিয়ার ভেতরে দেশের সবচেয়ে ঘৃণ্য সংগঠন জামায়াতে-ইসলামীকে একইসাথে এতগুলো সুযোগ-সুবিধা পাঁচ বছর ক্ষমতার সঙ্গী বানিয়ে বিএনপিও দিতে পেরেছিলো কিনা সন্দেহ! ‘প্রথম আলো’র মতো জামায়াতের এমন ঘনিষ্ট বন্ধু আর কে আছে? জামায়াত, তোমার কি লাগে আর?
চিন্তা করুন পাঠক- কতটা হাস্যকর হলে এটা সম্ভব যে, জামায়াত আর যুদ্ধাপরাধী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর খেলায় মত্ত থাকার ফলে চলমান সময়ে জনমনে শঙ্কা ছড়ানো অত্যন্ত জরুরী বেশ অনেকগুলো প্রসঙ্গ জরিপে টানাই হয়নি! এর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম, নির্বাচনে ধর্মের অপব্যবহার, মহাজোট সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক –এমন অনেকগুলো বিষয় জরিপে পুরোপুরি অনুপস্থিত! আবার, রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত যাচাই করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই জরিপে, ড. ইউনুস প্রসঙ্গে মানুষের মতামত ঠিকই নেয়া হয়েছে, এবং সেটিও একপাক্ষিক মতামত। জরিপে ড. ইউনুসের বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে একটি অনুপাত খুঁজে বের করা হলেও, বিভিন্ন বিষয়ে সার্বিকভাবে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে ড. ইউনুসের ভূমিকা-বক্তব্য-কীর্তি নিয়ে কোনো মত প্রকাশের সুযোগ জরিপে না থাকায়, ড. ইউনুসের ভূমিকা-বক্তব্য-কীর্তি বিষয়ে মানুষের মত বা চিন্তার অনুপাত জানার কোনো সুযোগই নেই। তবে কি ‘ড. ইউনুস সমস্ত ভালো-মন্দের উর্দ্ধে’ ধরে নিয়েই এই জরিপ চালানো হয়েছে?
আসলে সত্যি কথা হলো- ৩০০ আসনে ভিন্ন-ভিন্ন প্রার্থী নির্ভর নির্বাচনী ব্যবস্থায় দুই বা ততোধিক দলের জনপ্রিয়তা এবং ভূমিকা নিয়ে জরিপ করার গুরুত্ব খুব একটা বেশি নয়। নির্বাচন এলে জনগণ দল-বিবেচনায় কতটুকু, আর প্রার্থী-বিবেচনায় কতটুকু সিদ্ধান্ত নেন, তা এই জরিপ করার সময় বিবেচনাই করা হয়নি। বরং জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোনো একটি বিশেষ মহলের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি ধাপ হিসেবে বিবেচনায় নিলে, এই ধাপটি সফল করার প্রাণপন চেষ্টাই শুধু করা হয়েছে।
‘প্রথম আলো’র এরকম ভূমিকায় আমার কিংবা দেশের মানুষের বিন্দুমাত্র বিচলিত বা চিন্তিত হওয়ার কোনই কারণ নেই, কেননা ‘প্রথম আলো’ যে গোষ্ঠী বা মহলের হয়ে এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে- তারা ‘প্রথম আলো’কে না পেলে অন্য কাউকে দিয়ে এটা করাতোই, ‘প্রথম আলো’ এক্ষেত্রে একটি ‘মধ্য-স্বত্ত্বভোগী এজেন্সি’ ছাড়া আর তেমন কিছুই নয়, যে এজেন্সিটি এখন ওই গোষ্ঠী বা মহল দ্বারা পরিচালিত।
বরং এর চেয়ে অনেক বড় চিন্তার বিষয় হলো জরিপটি প্রকাশের পরদিন এটিকে নিয়ে ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত একটি উপ-সম্পাদকীয়, যার লেখক ছিলেন বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক সবার পরম শ্রদ্ধার ব্যাক্তি সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁর এই উপ-সম্পাদকীয় নিয়ে আমাদের চিন্তিত-বিচলিত হওয়ার কারণ এই যে, ওই জরিপের মাধ্যমে জামায়াতে-ইসলামী এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে হীন অপচেষ্টাগুলো করা হয়েছে, সেই সবগুলো অপচেষ্টার বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি কলামই যে যথেষ্ট, যা সুচতুর-ধুর্ত ‘প্রথম আলো’ খুব ভালোমতো জানে এবং বোঝে। কিন্তু জাতির বিবেকের ভূমিকায় দৃশ্যমান শুভ্র-পোশাকের যে নীতিবাদ-সত্-ত্যাগী-স্পষ্টবাদী প্রিয় মানুষটি –সেই সৈয়দ আবুল মকসুদ কি কিছুই বোঝেন না? আর তাই শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের এই দুর্ভাগা জাতির বিবেক নিয়েই বিচলিত-চিন্তিত-শঙ্কিত হয়ে পড়ি, আমরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাই, আমরা নীরবে চোখের জল মুছতে-মুছতে কোলাহলপূর্ণ শাহবাগ প্রজন্ম চত্তরের এক কোনে একাকীত্বের নিদর্শন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশের অনেক সন্ধিক্ষণের নিরব-সাক্ষী ওই লম্বা তালগাছটার দিকে তাকিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশের এককীত্ব অনুভব করি, বাংলাদেশের জন্য মন খারাপ করি, আর তারপর সেই তালগাছটাকেই জড়িয়ে ধরে বলি, ‘কে বলেছে তুমি একা বাংলাদেশ? এই যে আমরা আছি তো!’
‘প্রথম আলো’, আপানাকে বলছি, শুনতে পাচ্ছেন? কান পেতে মন দিয়ে শুনে নিন... আপনার থাকার কোনই প্রয়োজন নেই, আপনি থাকুন আপনার প্রিয় এজেন্ডা-বন্ধুদেরকে নিয়ে, বাংলাদেশের জন্য আমরা এরকম পিঁপড়া কিংবা মাছি অথবা প্রজাপতির মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাগল প্রেমিক ছিলাম, আছি, থাকবো।

ফেরদৌস আরেফীন,এডিটরিয়ার কোঅর্ডিনেটর, সময় টিভি
arefin78@gmail.com

Friday, October 18, 2013

আমি কেন উপাচার্য হতে পারলাম না! - রাজীব মীর



ঢাকা: শীতের নরম রোদ । বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ে লিকলিকে সাপের মত বয়ে চলা পথ। বন্ধুর সে পথে বগা লেকে অভিযাত্রা। সতেরো জনের পারিবারিক ট্যুরে আমিই একমাত্র বহিরাগত সদস্য। চাঁন্দের গাড়ি দু’টি। আমি যে গাড়িতে সেখানে একজনকে একা পিছনের সিটে বসতে হবে,বসলামও। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করার আগেই ড্রাইভারের পাশের সিট আমার সাথে শেয়ার করলেন তিনি,পাছে আমি বিপন্ন বোধ করি। ভালো লাগায় চোখে পানি চলে এসেছিলো । কী অদ্ভুত এবং সূক্ষ্ম তাঁর মনোদৃষ্টি। বগা লেকের সে ভ্রমণও ছিল কঠিন এবং দুর্গম। পথ চলতে চলতে পরিবারের মধ্যেও ছোট ছোট বিষয়ে একজন মানুষ কতটা গণতান্ত্রিক হতে পারেন, অবলোকন করে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম।পাহাড়ের চূড়া,নদীর তীর,সমুদ্রসৈকত, হাওড়ের নৌকায় তার গোটা পরিবারের সহযাত্রী হয়েছি বহুবার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো. আনোয়ার হোসেন। বছর কয়েক আগেকার কথা। তার সাথে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। অথচ টিভিতে একদিন পুলিশ বেষ্টিত তার কঠিন কষ্টকর মুখাবয়ব দেখে রক্তকণিকাগুলো অস্থির হয়ে উঠেছিলো। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সেনা সদস্যদের অপ্রীতিকর ঘটনার সময় তিনি ছাত্রদের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়ায় কারা নির্যাতনের শিকার হন। এ অবস্থান নেয়াটা অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ ছিল নিঃসন্দেহে।

ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রপ্রেমি শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি আমাদের বুকের মাঝেও স্থান করে নিয়েছিলেন। সেই সময়ের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং সে যাত্রায় মূলত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা পুনঃ বেগবান হয়েছিলো। মনে পড়ে, গত বিএনপি শাসনামলে শামসুন্নাহার হলের ভেতর ছাত্রীদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রকাশকালে পুলিশ তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলো।

এতো সেদিনের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের উষালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী যার গোটা পরিবার, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যে পরিবারের কাছে ঋণী, স্বাধীনতার সোনালী স্বপন যার হৃদয়ে অঙ্কিত, যার ভ্রাতা বুক উঁচু করে মৃত্যুকে পরাজিত করেছেন।বলেছেন,‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় কিছু নেই,’।

দেশ নিয়ে লড়বার জন্য যার স্বার্থচিন্তা কাজ করেনি, দেশকে গড়বার জন্য যার লাভালাভের বাসনা জাগেনি– তারই বিরুদ্ধে আজ মহা অভিযোগ, ‘আপনি সরুন’। তার অসততা রয়েছে,পক্ষপাত রয়েছে, তিনি প্রতিশ্রুতি রাখেন না’- যারা এ অভিযোগ এনেছেন পদাধিকার বলে তারা অনেক সম্মানিত, যোগ্য, জ্ঞানী এবং সম-সম্প্রদায়েরই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

দীর্ঘদিন থেকে তারা তাই এই ব্যক্তির উপাচার্য পদকে বিপদে ফেলতে গোষ্ঠীগত ভাবে আত্ননিয়োগ করেছেন, ঘেরাও,অবস্হান ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর দিনের রুটিন কাজ আর রাতের স্বাভাবিক ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। কিন্তু যেখানকার কথা বলছি, সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এর আগের উপাচার্যকেও একই অবস্হার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো এবং সরে যেতে হয়েছিলো। তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগের কমতি ছিলো না। সারা বছর আন্দোলনের জন্য পরিচিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ এ পদ এবং অবস্থানের জন্য লাগসই ভেবে ড.শরীফ এনামুলের স্থলে প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনে এখানে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু ড. শরীফ এনামুল কবীরের মত সুর্নিদ্দিষ্ট কোন অভিযোগ ব্যতিরেকে পুনরায় এখানে কিছু শিক্ষক কর্তৃক উপাচার্য খেদাও আন্দোলন শুরু হলো।

অধ্যাপক আনোয়ারের আত্নসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর, তিনি একদিন হুট করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। ব্যস,আর যায় কোথা! জাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা তাকে দিনরাত আটকে রাখলো, ছাড়বে না। অভূতপূর্ব সে শিক্ষার্থীপ্রিয়তা ও অফিস অবরুদ্ধতা ।

সরকারের বিশেষ অনুরোধে অনেকক্ষণ গোঁ ধরে থাকবার পর অবশেষে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা থেকে সরে আসলেন, স্বচক্ষে দেখেছি।

অল্প কিছুদিন যেতেই আবার গতানুগতিক একই আন্দোলন,সম্মানিত শিক্ষকগণের। কিছু অভিযোগ আছে, তারা দাবি প্রকাশ করলেন। উপাচার্য অস্বীকার করলেন না, দেখবেন বলে কথা দিলেন, কিন্তু তারা সেটি মানতে নারাজ, মাননীয় উপাচার্যকে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন এই বলে যে, ‘উপাচার্য হটো’। উপাচার্যের বিপক্ষে অভিযোগসমূহ সত্য হতেও পারে এটা আমরা খালি চোখে ভাবছিলাম কিন্তু অভিযোগের প্রকৃতির সাথে উপাচার্যের পদত্যাগের অনমনীয় দাবি কেন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হলো এবং উপাচার্য মহোদয়ের একটা জাতীয় দৈনিকের কলাম তা আরও স্পষ্ট করলো যে ‘ডাল মে কুচ কালা হে!’

ওখানকার শিক্ষকগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন শিক্ষককে তাদের মাথার উপর চাইবেন না, এটা তাদের অহংবোধে লাগে যে, হয়তো তারা বাইরে অযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। লাগতে পারে, মেনে নিচ্ছি । কিন্তু সেটা তো অধ্যাপক আনোয়ারের সীমাবদ্ধতা বা দোষ নয়। সরকার তাকে একটি বিশেষ পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে সেখানে যেতে অনুরোধ করেছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ধারাবাহিক ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিকে সঙ্গ দেয়ার ক্ষমতাসমপন্ন প্রখর প্রগতিশীল এবং অত্যন্ত যোগ্য একজন সংবেদনশীল শিক্ষককে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। ওখানকার শিক্ষকগণ অনেকেই উপাচার্য পদলোভী হবেন, এটা স্বাভাবিক। সে যোগ্যতা তাদের কারও কারও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সৃজনশীলতাও থাকতে হবে তো, সেটা তাদের আন্দোলনে নেই, প্রকাশেও নেই; বড় একঘেয়ে মনে হচ্ছে। বরং উপাচার্য সেক্ষেত্রে অনেক সৃজনশীল, সস্ত্রীক মাদুর পেতে বসে গেছেন পাল্টা আন্দোলনে।

এর আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের লাগানো পদত্যাগের দাবি সম্বলিত ব্যানার বাতাসে ছিঁড়ে নিচে পড়ার পর তারা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই যথাস্থানে টানিয়ে দিয়েছেন, ভাবা যায়!

চলতি সংবাদ এই যে, উভয়পক্ষ মুখোমুখি বসে আছেন,সমাধান নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ পড়াশুনা, সেটি এখন বন্ধ। চলছে, শিক্ষকদের আন্দোলন। তারা শুধু পদত্যাগ চান, কোনও ক্লাস কিংবা পরীক্ষা নয়। কিন্তু অবাক বিষয় হলো আন্দোলন বলতে সেখানে যাদেরকে বোঝানো হয়, সেই আনু মুহাম্মদ, মানস চৌধুরী, নাসিম আকতার হোসাইন কেউই এ উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে নেই। তারা এ আন্দোলনকে যৌক্তিক ভাবছেন না ,সম্পৃক্তও হচ্ছেন না !

আমি নিজে অধ্যাপক আনোয়ারের সাথে পরিচিত হই আশৈশব কৌতূহল বশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার একবার এক্সটারনাল মেম্বার হিসেবে গেলেন। প্রাণ রসায়নের সেই সময়ের চেয়ারপার্সন জনাব মু. গোলাম কবীর আমাকে এ দুর্লভ ব্যক্তির সাথে পরিচয়ের সুযোগ করে দেন । বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও আমার দু’একটি কবিতা তার মনে ধরে এবং ক্রমে আমি তার পরিবারের আপনজন হয়ে উঠি। ভরা পূর্ণিমায় আমার ডাক পড়ে,একসাথে পূর্ণিমা দেখি,গান গাই,গান শুনি।

বিশেষ কোন ভালো লাগার দিনে বাঁশিওয়ালা আসে, বাঁশি বাজে। গোটা পরিবার একসাথে উপভোগ করে। তাদের পারিবারিক বন্ধন তো অন্য রকম। ভাইবোনদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ঈর্ষণীয় রকমের ভালো। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই তারা ভীষণ রোমান্টিক, অকল্পনীয়। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়ে যার অগাধ দখল, তার মুখে কবিতা,গান, চিত্রকলার দারুণ সব অভিব্যক্তি। সুন্দর বাচনভঙ্গি, স্পষ্ট উচ্চারণ আর তার দৃঢ় বাক্যপ্রয়োগ শুনে মন্ত্রমোহিত হতে হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে তার ভাষণ ছিলো অতুলনীয়, অত্যন্ত উদ্দীপক। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত সরল হাসিখুশি এ প্রাণবান মানুষ আজ সম্মানাক্রান্ত। একা লড়ছেন। বাংলার বীর কর্ণেল তাহেরকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়, তখনও তিনি জেলের ভিতর একা দাঁড়িয়েছিলেন। আজও।

কিন্তু স্বাধীন দেশে এটা তো হওয়ার কথা নয়। শরীফ এনামূল কবীর, আনোয়ার…এর পরে কে? যারা আন্দোলন করছেন, তারা কি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে চাচ্ছেন? যদি না চান তবে তাদের আন্দোলন কি দল নিরপেক্ষ উপাচার্য চেয়ে? তাদের দাবির সারাৎসার কিন্তু অস্পষ্ট। ইতিহাস তো বলে বাংলাদেশের সব সঙ্কটে অধ্যাপক আনোয়ার মিছিলের সর্বাগ্রে ছিলেন,কখনও পিছপা হননি। দেশের জন্য পারিবারিক আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তেই বা তার মত আর কয়জনের আছে? উপাচার্য ভুল করতে পারেন না,করেননি বা করছেন না,এটা বলছি না। বলছি ত্যাগের ইতিহাস তো তার রক্তে, সেখানে যদি ছোট কোন ভুল থেকেও থাকে, প্রতিবাদ হবে না কেন ,অবশ্যই হবে। কিন্তু তাই বলে একবারে সরে যেতে হবে, এ দাবি খুব একটা জনগ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি? কে আসবেন ওনার জায়গায়! ইতিহাসের আত্মত্যাগীকেই মেনে নিচ্ছেন না! কাকে মানবেন, কার আত্মত্যাগ তার সাথে তুলনীয়? যদি যোগ্যতার কথা আসে, অধ্যাপক আনোয়ারের সমান যোগ্য হয়তো কেউ থাকতে পারেন,আত্মত্যাগী কয়জন আছেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্যের বন্ধ্যাত্বের সংস্কৃতির অবসানও তো তারই অবদান! তিনিই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সময়ের প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য। আমরা কি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের মত কাউকে চাচ্ছি, যিনি দেশ তো দূরের কথা, নিজের সমর্থিত দলের জন্যও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? নাকি এটা নিখাদ মন খারাপের আন্দোলন,আমি কেন উপাচার্য হতে পারলাম না! উপাচার্য হিসেবে উনি থাকবেন অথবা থাকতে পারবেন কি না জানি না, কিন্তু পদত্যাগের দাবির বিরুদ্ধে ওনার অবিচল অবস্থান তার দীর্ঘ সংগ্রামী সত্যের কথাই শুধু জানান দেয়। পালিয়ে আসা কোন বিপ্লবীর কাজ হতে পারে না, উনি এটা করবেনও না- আমি নিশ্চিত। উপাচার্য পদ ছেড়ে দিলেই উনি সম্মানিত আর ধরে রাখলে এটা উনাকে ছোট করবে, উচ্চতার পরিধি এভাবে অনুধাবনযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দেশ,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধার দেশ। অতএব, মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ার হোসেন আপনাকে বলছি, লড়াই করা আপনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব, স্যার! দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সচেতন শিক্ষার্থী ও অগণিত মানুষের জন্য অতীতের মত এখনও সত্যের হাল ধরে রাখুন, ছাড়বেন না! প্লিজ।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Sunday, October 13, 2013

ষড়যন্ত্রের রাজনীতির থলের বেড়ালটি বেরিয়ে আসছে - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী



প্রবীণ এক বাম নেতার এই সাক্ষাতকারটি প্রথমে আমার চোখে পড়েনি। কোন প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাতকারটি বেরোয়নি। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে বেরিয়েছে, যেটি সচরাচর আমার চোখে পড়ে না। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনে সাক্ষাতকারটি পড়লাম। দৈনিকটির ৫ অক্টোবরের সংখ্যায় তা বেরিয়েছে। ছোট সাক্ষাতকার। তবু আমার জন্য খুবই আগ্রহোদ্দীপক। কারণ, তিনি আমার কলেজ জীবনের খুবই প্রিয় শিক্ষক। পরবর্তীকালে তিনি হন দেশের এক সময়ের বৃহত্তম বাম গণতান্ত্রিক সংগঠন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এখন বিরানব্বই বছর বয়স। তাঁকে এখন বলা চলে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পিতামহ। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি।
ন্যাপের সেই সুদিন এখন আর নেই। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এখনও দলের সভাপতি আছেন বটে, বয়সাধিক্যে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু এই বয়সেও তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনা ও পরামর্শ দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। তাঁর কথা কেউ শুনছে কী শুনছে না, তার পরোয়া করছেন না। তিনি এখনও আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি বাতিঘর। ৫ অক্টোবর ঢাকার বহুল প্রচারিত দৈনিকটিতে আলাপচারিতা বিভাগে প্রকাশিত তাঁর দেয়া সাক্ষাতকারটিতেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে তাঁর প্রকৃত সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। এ জন্যই সাক্ষাতকারটি আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি।
এই সাক্ষাতকারটি পড়তে গিয়ে আমি এমন একটি তথ্যের মুখোমুখি হয়েছি, যা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো নব্বই-উর্ধ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকে বের না হলে আমার পক্ষেও বিশ্বাস করা সহজ হতো না। এ কথা অস্বীকার করব না, আমি ড. কামাল হোসেন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কঠোর সমালোচক। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের। কারণ, তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুই তাঁকে হাত ধরে টেনে এনে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন। পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির অবশ্যই সমালোচনা, এমনকি বিরোধিতাও করতে পারেন। কিন্তু হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী চক্রান্তের শিবিরে গিয়ে সরাসরি যোগ দিতে পারেন, এটা আমার কাছেও ছিল অকল্পনীয়।
ঢাকার দৈনিকটির ৫ অক্টোবরের সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আলাপচারিতায়’ দেশের বয়োবৃদ্ধ প্রবীণতম নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেছেন, ‘আমি যে রাজনীতি করি, তা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নয়। এটি সরল রাজনীতি। আমি ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই। ড. কামাল হোসেন এসেছিলেন আমার কাছে জাতীয় সরকারের রূপরেখা নিয়ে। আমার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মধ্যে নেই। আমি রাজি হইনি। আমার রাজনীতির অর্থ হচ্ছে সত্য কথা বলা, সড়ক দিয়ে হাঁটা এবং ডাল দিয়ে খাবার খাওয়া। ড. কামাল হোসেন ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রধান হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক। সে কারণে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।’
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের ‘আলাপচারিতায়’ এই বক্তব্যটি দেশের অনেক মানুষের কাছে ড. কামাল ও ড. ইউনূস জুটির বর্তমান কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেবে। আমি নিজেও দীর্ঘদিন যাবত এই জুটির কার্যকলাপ ও বক্তৃতা-বিবৃতির সমালোচনা করলেও সবসময় ভেবেছি, এরা শেখ হাসিনার প্রতি প্রচ- বিরাগবশত দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের যে ক্ষতি করছেন, তা হয়ত নিজেরাও উপলব্ধি করছেন না। কিন্তু তাঁরা যে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত গোঁ চরিতার্থ করার জন্য সরাসরি ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে যোগ দিতে এবং এতটা নিচে নেমে যেতে পারেন, তা কল্পনাও করিনি। আওয়ামী লীগ রাজনীতির একটা বড় দুর্ভাগ্য, এই রাজনীতিতে এক মোশতাকের তিরোভাব না ঘটতেই আরেক মোশতাকের আবির্ভাব হয়।
একটি তথাকথিত ‘জাতীয় সরকারের রূপরেখা’ পকেটে নিয়ে ড. কামাল হোসেন দেশে যা করে বেড়াচ্ছেন, তা যে ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’ এটা বুঝতে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো রাজনীতির বটবৃক্ষের কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ড. কামাল হোসেনকে বলে দিয়েছেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই’ এবং তাদের ষড়যন্ত্রে দোয়া (সমর্থন) দিতেও রাজি নন। শুধু অধ্যাপক মোজাফ্ফর নন, ড. কামাল হোসেন নাকি তাঁর জাতীয় সরকারের রূপরেখা (যে সরকারে তিনি কিংবা ড. ইউনূস প্রধান হবেন) নিয়ে দেশের আরও কয়েকটি ডান এবং বাম গণতান্ত্রিক দলের নেতার দরজায় গিয়ে দোয়া লাভের জন্য ধর্ণা দিয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই একবাক্যে না বলে দিয়েছেন।
শেষপর্যন্ত তিনি সম্ভবতঃ তাঁরই মতো জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কয়েকজন নেতাকে তাঁর বিতর্কিত রাজনীতিতে সঙ্গী করতে পেরেছেন। এরা হলেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। এদের অধিকাংশই সচরাচর নির্বাচনে জেতেন না। কারও কারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ড. কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু একবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদে জিতিয়ে এনেছিলেন। তারপর আর কোনও নির্বাচনে জেতেননি। শেখ হাসিনা তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন। সেখানেও বিএনপির বিচারপতি সাত্তারের কাছে হেরেছেন। গত নির্বাচনে তাঁর গণফোরামের প্রার্থীদের কারও জামানত রক্ষা পায়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রেকর্ড তো অনুরূপ উজ্জ্বল। তেজারতিতে তিনি দক্ষ। তবুও রাজনীতিতে ঢোকার খুব শখ। কিন্তু রাজনৈতিক মূলধন কিছুই নেই। ছাত্রজীবন থেকে বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের ত্রিসীমানায় তিনি ছিলেন না। গরিবের নামে ব্যবসা করে নিজে বিরাট ধনী হয়েছেন। গরিবের বাড়িতে ভুলেও যান না। তাঁর জেট সেট লাইফ। রাজারাজরাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের তিনি বিশ্বস্ত অনুচর।
ফলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রভুরা তাঁকে খুশি হয়ে অর্ধেক নোবেল পুরস্কার দিয়েছে এবং এখনও বড় বড় পুরস্কার দিচ্ছে। অর্ধেক নোবেলজয়ী হওয়ার পর আনন্দের এভারেস্ট চূড়ায় উঠে ওই নোবেল পুরস্কারকে মূলধন করে তিনি নূতন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। এই দল গঠনের এক মাসের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর দল শেষপর্যন্ত ‘কাকতাড়ুয়ার দল’ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি রাজনীতি করার আগেই জনগণ কর্র্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজনীতি ছাড়েন।
রাজনীতির সদর দরজা দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না, তাঁরা পেছনের দরজা দিয়ে সেই ক্ষমতায় যেতে চাইবেন, তা আর এমন কী বিস্ময়ের ব্যাপার। তবে কামাল হোসেনদের ক্ষেত্রে বিস্ময়ের কথা এই যে, তাঁরা গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছ রাজনীতি এ সবের কথা বড় বেশি বলেন। গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্বচ্ছ রাজনীতির পথ তো হচ্ছে জনগণের কাছে যাওয়া, স্বচ্ছ, বাস্তব ও সুস্থ কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার ম্যান্ডেট চাওয়া। সে জন্যে নির্বাচনে যাওয়া।
ড. কামাল হোসেনরা গণতন্ত্রের এই সদর দরজা দিয়ে না হেঁটে কেন পেছনের দরজা খুঁজছেন এবং তথাকথিত জাতীয় সরকারের একটি রূপরেখা (যেটি আসলে ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা) পকেটে নিয়ে একশ্রেণীর প্রবীণ-নবীন রাজনীতিক নেতার বাড়িতে ধর্ণা দিয়ে তাদের দোয়া চেয়ে বেড়াচ্ছেন? জনগণ কর্তৃক বার বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই জাতীয় সরকার নামক একটি অনির্বাচিত সরকার গঠন দ্বারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ভূতটি ড. কামাল হোসেনদের মাথায় চেপেছে।
মজার ব্যাপার এই যে, মাত্র গত ২৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বরিশালে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘...এবার দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে ছাড়ব।’ এটা খুবই ভাল কথা। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে যদি কামাল হোসেন সাহেবরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারেন, তাহলে তো বলব, তাঁরা গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জাতীয় সরকার তো এক কথা নয়।
ড. কামাল হোসেনরা কোনটি চান? যদি সত্যিই তাঁরা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সমর্থন করেন, তাহলে এই দাবি আদায়ের জন্য বিএনপি চলতি মাসেই যে আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে, সে আন্দোলনে যোগ দিন। তা না করে পর্দার আড়ালে আবার জাতীয় সরকারের খেলা খেলছেন কেন? জনগণের কাছে না গিয়ে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো প্রবীণ নেতাদের দরজায় গিয়ে গোপন ধর্ণা দিচ্ছেন কেন? আবার জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে নিজে কিংবা ড. ইউনূসের সেই অনির্বাচিত জাতীয় সরকারের প্রধান হওয়ার আগাম ইচ্ছা ব্যক্ত করছেন কেন?
ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসের জুটির নেতৃত্বে চালিত তথাকথিত সুশীল সমাজের মনস্তত্ত্বটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের আস্থা তাদের ওপর নেই, জনগণ কখনই তাদের ভোট দেবে না এবং নির্বাচন এলে যত খারাপ বা মন্দ হোক আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকেই তারা ভোট দেবে। দেশের মানুষ এই দল দুটিকে বোঝে। এই দুই দলের নেতারা যত অপরিশীলিত ভাষায় বক্তৃতা দেন, তার অর্থ তারা বোঝে। আর ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূস সাহেবরা গণতন্ত্রের অভিধান থেকে যে সব ভাল ভাল কথা বেছে নিয়ে জনগণের নাগালের বাইরের এভারেস্ট চূড়া থেকে কথা বলেন, তার অর্থ তারা বোঝে না। সে সব কথায় আস্থা স্থাপনও করে না।
অনির্বাচিত জাতীয় সরকার গঠন ড. কামাল হোসেনের বহুদিনের একটি পেট থিয়োরি। বার বার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়ে এবং জনগণকর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রবল রাজনৈতিক হতাশা থেকে সম্ভবতঃ তাঁর মনে এই থিয়োরিটির জন্ম। বহুকাল আগে তিনি তাঁর ‘সুশীল সমাজ’ দ্বারা এই থিয়োরিটি একবার জনসমক্ষে এনেছিলেন। দেশের মানুষ এই গণঅধিকার বর্জিত সরকারের থিয়োরি গ্রহণ করেনি। তখন এক বাম রাজনীতিক প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘গু মড়াবৎহসবহঃ, মড়ড়ফ ড়ৎ নধফ, রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ঁহবষবপঃবফ মড়ড়ফ মড়াবৎহসবহঃ’ (আমার সরকার, ভালোমন্দ যা-ই হোক, অনির্বাচিত ভালো সরকারের চাইতে ভালো)।
নিজের পছন্দের, নিজের ভোটাধিকার দ্বারা গঠিত সরকার মন্দ হলেও জনগণ সেই সরকারই চায়। অন্যের পছন্দের এবং অন্যদের ইচ্ছায় গঠিত সরকার ভালো হলেও জনগণ তা পছন্দ করে না। এটা গণতন্ত্রের ইতিহাসের আদি সত্য।
ড. কামাল হোসেনদের অনেক বিদ্যাবুদ্ধি। কিন্তু এই সত্যটা তাঁরা বোঝেন না। আর বোঝেন না বলে জনগণের কাছে পৌঁছতেও পারেন না। এদিকে, ক্ষমতায় যাওয়ার অদম্য লিপ্সা তাদের তাড়িত করে বেড়ায়। তখন ক্ষমতার লোভে বিদেশী সাহায্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে তাঁরা দেশ এবং গণতন্ত্রের সমূহ সর্বনাশ করেন। আমার আশঙ্কা, ড. কামাল হোসেনদের বর্তমান ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দেশের জন্য এক অকল্যাণকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।
ঢাকার বহুল প্রচারিত দৈনিকটিতে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের আলাপচারিতার বক্তব্য পাঠের আগেই আমার এক লেখায় ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসের বর্তমান কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার সন্দেহের কথা প্রকাশ করেছিলাম। লিখেছিলাম, বাংলাদেশে কারজাই অথবা জারদারি মার্কা একটি সরকার অনির্বাচিত জাতীয় সরকার হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য যে তৎপরতা চলছে, সেটি সফল করার লক্ষ্যে এই সুশীল চক্রের এক নেতা ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্র নেতাদের দরবারে তাদের সাহায্য ও সমর্থনের আশায় ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে, অন্য নেতা দেশের ভেতরে সেই জাতীয় সরকারের নীলনক্সায় রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাইরে তাঁরা দেখাচ্ছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে সমর্থন দানের জন্যই দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা করছেন।
এরা হয়ত ভাবতে পারেননি, দেশের বাম রাজনীতির এক বটবৃক্ষ নেতা এমন সোজা সরল ভাষায় তাদের গোপন তৎপরতার কথা ফাঁস করে দেবেন এবং তাকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আখ্যা দেবেন। ড. কামাল হোসেন জানেন কিনা জানি না, তিনি রাজনীতির রেসের মাঠে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যাত ঘোড়ায় পরিণত হয়েছেন। বিদেশীরা তাঁকে নিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু ক্ষমতায় বসাবে না। তিনি এখন তাদের বাতিল ও ব্যর্থ নেতাদের তালিকায় আছেন। তিনি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী থেকে কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত যাদের সঙ্গে জুটিয়েছেন তাঁরাও এই তালিকাভুক্ত নেতা। এই দলে নতুন মুখ ড. ইউনূসের। কিন্তু মাটিতে তাঁর পা নেই। তিনি শাখামৃগের মতন। শাখামৃগের ওপর কেউ নির্ভর করে না। তাকে কলা দেখিয়ে ব্যবহার করে মাত্র।

লন্ডন, ৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৩