Saturday, June 8, 2013

নারীর মানবাধিকার -চলচ্চিত্রে স্পর্ধিত উপস্থাপন :আমার দোসর ঋতুপর্ণ ঘোষ, সেলাম ! - সুমি খান


সুমি খান
৯ জুন ২০১৩ সকাল ১০টা

আমার দোসর ঋতুপর্ণ ঘোষ, গুরু সেলাম তোমায় !!
নারীর মানবাধিকার হননে পুরুষতান্ত্রিকতার ভয়ংকর শোষণের নির্মম চিত্র- মাত্র ১২টি হলেও প্রতিটি চলচ্চিত্রে কী অসাধারণ স্পর্ধিত উপস্থাপন!! কে, কবে করেছে জানি না। বড়ো ক্ষুদ্র মানুষ আমি। চলচ্চিত্র সমালোচক নই। সাধারণ একজন দর্শক মাত্র। মেঘপিয়নের সাথে সাথে মন আজ ছুটে চলেছে তাকে হারিয়ে বেদনায় ডুবেছি বারবার! তার সম্মানে আমার অনুভূতি গুলো লিখতো বসে গেলাম নিজের অজান্তেই!
কবেকার কথা মনে নেই- ১৯৯৮-৯৯ সালের কোন একদিন বিষন্ন দুপুরে হঠাৎ টেলিভিশনে 'দহন' ছবি টা দেখলাম।ছবির নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত রমিতা চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। পূজোর বাজার করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হলো । ইন্দ্রানী হালদার সাহসী সাংবাদিক ঝিনুকের চরিত্রে অভিনয় করলেন। সেই বখাটেদের বাঁচাতে প্রশাসনের সাথে একাট্টা হলো স্বামী পলাশ এবং তার পরিবার। তাদের লান্ছনা আর অপমানের শিকার হলো রমিতা এবং ঝিনুক। বখাটে দের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে ঝিনুকের প্রেমিক ও সমর্থন দিলো না। বেদনাহত ঝিনুককে তার ঠাকুরমা (কিংবদন্তী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা সেন) মানসিক সমর্থন দিলেন। রাতের পর রাত পলাশ ও নিষ্ঠুর ভাবে ধর্ষণ করতে স্ত্রী রমিতাকে ! রকবাজ বখাটে দের সাথে একই ছাদের নিচে একই বিছানার শয্যাসঙ্গী স্বামীটিও একাত্ম হয়ে গেলো! বুকের ভেতর টা চমকে উঠেছিলো। মনে হলো, নারীর মানবাধিকার হননে পুরুষতান্ত্রিকতার ভয়ংকর এই শোষণ কী অসাধারণ উপস্থাপন! কেউ কখনো পারে নি!! নিজে পুরুষ হয়ে কিছু পুরুষের অন্যায় আর বর্বরতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে জেগে ওঠা!! আধুনিকতা বলে একেই!
'দহন' এর পর 'বাড়িওয়ালী' , 'তিতলী', অন্তরমহল', 'চোখের বালি' ..আরো কয়েকটি ছবি দেখলাম! বারবার হাজারবার! মুগ্ধতায়, মোহময়তায় ভাসলাম! উজ্জীবিত হলাম সাহসে- নিজের প্রতি, নিজের শরীরের প্রতি সম্মান বোধে!যে শরীর টি কে নশ্বর বলে কখনো গুরুত্বই দেইনি! এই শরীরের অপরূপ সৌন্দর্য থাকতে পারে, তার প্রতি কেউ অসম্মান করতে পারে- এই বোধটাই তেমন অনুভব করিনি যেই আমি এতোদিন! তাকেই ঘা মেরে জাগিয়ে দিলেন ঋতুপর্ণ! অধিকারবোধ শুধু নয়, নিজের আত্মসম্মানবোধ! নিজের বেদনার দোসর হলাম যেন প্রথমবারের মতো! আর সেই দিন থেকেই মনে মনে এই মানুষটি আমার দোসর হয়ে গেলেন ।

তিনি নিজে সমকামী ছিলেন। সেটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এ্তই বাস্রতবতা তার বাবা-মা, তার পরিবার খুব সহজে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ তার উপর তার মতো প্রান্তিক মানুষগুলোর উপর এক ধরণের ভায়োলেন্স চাপিয়ে দেয়- যার কোন অধিকার এই সমাজের নেই। এবং সেটা নিয়ে হতাশার কিছুই নেই! বিভিন্ন সময়ে দৃঢ়তার সাথে এ কথা গুলো তুলে ধরেছেন তিনি। বিকল্প যৌনতা নিয়ে তার সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র 'চিত্রাঙ্গদা' প্রসঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, এই অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না আমাদের নির্বোধ সমাজ। এই যুদ্ধে কেউ 'বেচারা' নয়, কেউ তার হাত ধরে পার করে দেবে- এমন অলীক আশা নিয়ে বেঁচে থাকলে বা বসে থাকলে- সেই জীবনের অধিকারী ই সে নয়!'কোন রোমান্টিক সঙ্গী পেলাম না এই জীবনে'- এটা কোন দীর্ঘশ্বাস হতেই পারে না । হোঁচট খেতে খেতে হলে ও তার নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে যাবার দায় তার নিজের!বলেছেন,এই ভায়োলেন্স একতরফা নয়- দু'দিক থেকেই আসছে! কী চমৎকার আত্মবিশ্বাসী কথা! বোঝালেন, আমি কিভাবে বাঁচছি, সেটা বড়ো কথা নয়, আমি কিভাবে বাঁচতে চাই- আমার প্রত্যাশা কি- সেটাই বড়ো কথা!
অন্জন দত্তের কথায় বলি," পৃথিবীতে অনেক সমকামী চিত্র পরিচালক আছেন, অনেক সফল তারা। কিন্তু কে কবে নারী -পুরুষের সেক্সুয়েল সম্পর্ক এবং তার সংকট নিয়ে এতোটা খোলামেলা কথা বলেছে? আমার শরীরের ভালো মন্দ, আমার শরীরের সৌন্দর্য, আমার সৌন্দর্যের প্রতি সম্মানবোধ আর অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকবে কারো- এই বিষয়গুলো ভাবার দুয়ার খুলে দিলেন তিনি।রবীন্দ্রনাথের 'নারী অর্ধ নারীশ্বর'বিবেচনার সময় এসে গেছে। একচ্ছত্র অধিকার আমার ! বিয়ের সার্টিফিকেট বা কাবিননামা কবুল করে একজন নারী তার স্বামীর কাছে বিক্রি হয়ে যায় না। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে দু'জনে দু'জনার হতে হবে। তবেই শরীর- মন একাকার হয়ে একাত্ম হবে! এতোটা ভাবিয়েছে কে আর? কেন বলবে কেউ?


সমাজের ভ্রুকুটির মুখোমুখি হবার সাহস কার ই বা আছে? ক'জনের আছে? ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার সুখ- আনন্দ বর্জন করে একাকিত্ম বরণ করেছিলেন। এমন পরিচালক- যার নিবিড় ভালোবাসায় ভেসেছে সবাই! যদিও তার চারিদিক বড়ো প্রতিকূল ছিল। এই প্রতিকূলতা তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন, নজরুলের ভাষায়, আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার ভাঙ্গবার জন্যে । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, "অহো, কী দু:সহ স্পর্ধা !!"
নারী, নারীর শরীর কে সম্মান করতে গিয়ে লম্বা চুলের বিনুনীর উইগ পরলেন। অপরূপ সাজে নিজেকে সজ্জিত করলেন।নানান রূপে তার প্রতিটি অনুষ্ঠান কী প্রাণবন্ত!
নারীর রূপ ধারণ করলেন দু:সাহসিকতার সাথে। এসব করতে গিয়ে সমাজের গঞ্জনা- যন্ত্রনা সয়ে যাওয়ার যে সাহস, যে ক্ষ্যাপামী তিনি দেখিয়েছেন- এমনটি তার মতো কারো নেই, ছিল না। আরো অনেক অনেক দিন তার বেঁচে থাকা দরকার ছিল।
ঋতুপর্ণ ঘোষের অকাল প্রয়াণ সবাইকে ভাবাচ্ছে- হয়তো আরো কেউ এবার এগিয়ে আসবে প্রতিভা নিয়ে, সাহস নিয়ে। তার মতো আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে আমাদের কথা বলবেন কেউ- অপেক্ষায় রইলাম।

তবে আমরা ঋতু'দা এবং তার অসাধারণ সৃষ্টি কে চিরকাল চিরদিন আমাদের দোসর বলেই জানবো।
বাংলাদেশে গত কিছুদিন ইউটিউব না থাকার কারণে এতো এতো ক্ষতি হয়েছে আমাদের- কতোটা বলা যায়? তাই বেশ দেরি হয়ে গেলো। তবু ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণ এবং তাকে নিয়ে আলোচনা সব নিয়ে বসলাম কাল সন্ধ্যা থেকে। আজ আমার বন্ধুদের সাথে ও শেয়ার করছি।
এ বিষয়ে আরো লিখবো। শুরু করলাম আজ। প্রিয় বন্ধুরা , আপনাদের অংশগ্রহণ কামনা করছি!

Wednesday, June 5, 2013

বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত বই -শাম্ স নূর


ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। অন্যভাবে বলা যায়, মুখ দিয়ে শব্দ করে ভাব প্রকাশের পদ্ধতিই হল ভাষা। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এ ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ি, লিখি, আবার স্বপ্নও দেখি। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের এ প্রাণের ভাষার প্রথম বই কোনটি?




‘চর্যাপদ’ বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো সাহিত্য নিদর্শন, মানে সবচেয়ে পুরনো বই। বাংলা ভাষার এর আগের আর কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি। তবে চর্যাপদ ছাপানো কোনো বই ছিল না, ছিল একটা হাতে লেখা গানের সংকলন। চর্যাপদ যখন লেখা হয়েছিল, তখন পৃথিবীতেই ছাপাখানার প্রচলন হয়নি। তখন পুঁথি বানানো হত তালপাতা বা অন্য কোনো পাতা দিয়ে। তার উপর হাতে লেখা হত। তাড়াতাড়ি লেখার জন্য পুঁথিতে একটা মজাও ছিল; পুঁথিতে বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁকা রাখা হত না। ওভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে লিখলে সময় কম লাগত।
চর্যাপদ কবে রচিত হয়েছিল, এ ব্যাপারে বাংলা ভাষার জাঁদরেল পণ্ডিতরা একদমই একমত হতে পারেননি। একেক জন পণ্ডিত একেক মন্তব্য করেছেন। কারও মতে চর্যাপদ ৬৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত, কারও মতে ১০০০-১২০০ সালে; এমনি একেক জনের একেক মত। সবার মত মিলিয়ে অনুমান করা হয়, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল ৮৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

এই বইটি কিন্তু হারিয়েই গিয়েছিল। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের একটি খণ্ডিত পুঁথি খুঁজে বের করেন। তাও আবার নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে! বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো এই বইটি নিয়ে কিডজে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে ফিচারটির লিঙ্ক দেওয়া হল।

সবচেয়ে পুরনো বাংলা বই: চর্যাপদ
http://kidz.bdnews24.com/mainStory.php?mainstoryid=205

এ তো গেল বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো বইয়ের গল্প। এবার আসা যাক, বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত বইয়ের গল্পে।

যতদূর জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রিত বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৮২ সালে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তবে বইটি পুরো পাওয়া যায়নি, বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। এটিকেই বলা যায় সবচেয়ে পুরনো বাংলা মুদ্রণের নমুনা। এতে যে তামার মুদ্রণের নমুনা পাওয়া যায়, তার বর্ণগুলো ছিল তামার পাত থেকে মুদ্রিত। অর্থাৎ তখনও ঢালাই করা বাংলা বর্ণের প্রচলন হয়নি।


এরপর ১৭২৫ সালে জার্মানিতে সম্ভবত আরেকটি বাংলা বই ছাপা হয়েছিল। সেটিও পাওয়া যায়নি। ছেঁড়া পাতা ইত্যাদি নমুনা পাওয়া গেছে। সেসব থেকেই বইটির কথা জানা গেছে।

বাংলায় লেখা সবচেয়ে পুরনো যে মুদ্রিত বইটি পাওয়া গেছে, তার নাম-- ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’।
লিখেছিলেন মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও। তবে বইটি বাংলা বর্ণে নয়, মুদ্রিত হয়েছিল রোমান হরফে। বইটি লেখা হয়েছিল ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে। তবে স্পেনের লিসবন থেকে ছেপে বের হয় ১৭৪৩ সালে।


এখন পর্যন্ত যে তিনটি মুদ্রিত বাংলা বইয়ের গল্প বললাম, তিনটি-ই ছাপা হয় বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাইরে। মানে বাংলা ভাষাভাষীদের অঞ্চলের বাইরে। হয়তো এ কারণেই এই বইগুলো সম্পর্কে তেমন কিছু জানাও যায়নি। আর যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা দিয়ে এদের প্রথম বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের সম্মানও দেওয়া যায় না। কারণ, প্রথম দুটো তো পাওয়া-ই যায়নি। আর শেষেরটি বাংলা ভাষায় লেখা বটে, কিন্তু বাংলা বর্ণমালাতে মুদ্রিত নয়।



বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত বই হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয় A Grammer of the Bengali Language (অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ) গ্রন্থটিকে। বইটি লিখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারি ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ সালে। বইটিতে মোট পৃষ্ঠা ছিল ২১৬টি। আংশিক বাংলা হরফে ছাপা এই বইটি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থেকে কাঠের হরফে ছাপা হয়। কাঠের হরফগুলো তৈরি করেছিলেন ইংরেজ পণ্ডিত ও গ্রন্থকার চার্লস উইলকিনস। বাংলা অক্ষরের জন্য তাকে সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। বিডিনিউজ