Monday, September 22, 2014

এ কে খন্দকারের বই সম্পর্কে কিছু কথা : প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ

বদরুদ্দীন উমর আমার দীর্ঘকালের বন্ধু, অতি আপনজন। কোনো কোনো বিষয়ে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি। তবে এ নিয়ে উমরের সঙ্গে আমি কখনও আলোচনা ও তর্ক করতে চাইনি। বদরুদ্দীন উমরের মতো আমার প্রিয় বন্ধু মঈদুল হাসান। তারা দু'জনেই পণ্ডিত মানুষ, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং করেন। আমি তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনি কিন্তু তাদের সব কথা মেনে না নিলেও উত্তর দেই না বা তাদের সঙ্গে তর্ক বা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ি না। আমি শান্তি ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাস করি। এই দুই বন্ধুকে হারাতে চাই না। বন্ধুরা হয়তো মনে করতে পারেন আমি পণ্ডিতের খোলস পরে বসে আছি; কিন্তু আমি আসলে একটা মূর্খ ও নির্বোধ জীব, কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার এই লেখা পড়ে এই বন্ধুরা যদি আমার ওপর রাগ করে আমাকে ত্যাগ করতে চান, আমি কিন্তু তাদের ছাড়ছি না। মতবিরোধ যতই থাকুক, মনের মিল তো কোনোদিন নষ্ট হওয়ার নয়।

আমার বয়স হয়েছে, নব্বই পার হয়ে গেছে; আজকাল লেখালেখি করতে খুব কষ্ট হয়। তবু এই লেখাটি লিখতে বসেছি বলতে পারেন নেহাত বিবেকের তাগিদে। গত ১২ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর 'খন্দকারের বই ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' শীর্ষক একটি অগি্নগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটি পড়ে তৎক্ষণাৎ আমার যে প্রতিক্রিয়া হলো সেটাই আমার এ লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করছি।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি। এটা ছিল দীর্ঘকালের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অমোঘ ফলশ্রুতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের প্রথম দিকে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন এই ভেবে যে, এতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা, যারা ছিল সর্বক্ষেত্রে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ_ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিলে শেরেবাংলা ফজলুল হকের উপস্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এই দুই অঞ্চলে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ_ এই দুই অঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র (ওহফবঢ়বহফবহঃ ধহফ ঝড়াবৎবরমহ ঝঃধঃবং) প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে দিলি্লতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা স্রেফ ছলচাতুরীর মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে দুই রাষ্ট্রের বদলে এক রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম, যিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন_ এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে বদলানো যায় না। কিন্তু আবুল হাশিমের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে দুই পাকিস্তানের জায়গায় একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তখন থেকেই তার মনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল।
মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতাদের বাঙালিবিরোধী চক্রান্ত সম্পর্কে শেখ সাহেব সজাগ হতে শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সময় অনেক বাঙালি মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মনেও এই চিন্তাভাবনা জাগ্রত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরই যখন কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করল, তখনই শুরু হয়ে গেল আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল। 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি_' মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অমর উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল এই নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানরা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর ভাষায় 'পাকিস্তান জ্বরে আক্রান্ত', 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' ও ইসলামী জোশ-এর উন্মাদনা তখনও কাটেনি। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি ভাবছিলেন কীভাবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। স্বাধীনতা কথাটি উচ্চারণ করাই তখন অসম্ভব ছিল। শেখ মুজিব প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ববাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাদের প্রধান শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বশংবদ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ঘোষণা করেছিলেন, যতদিন তিনি গভর্নর পদে থাকবেন, শেখ মুজিবকে জেলে থাকতে হবে।
বস্তুত ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাহিনীর লোকেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর কিংবা হয়তো কিছুকাল আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এবং ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গোপনে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মতৎপরতার কথা জানা যায়। এমনকি সুদূর লন্ডনে ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল' জারির বেশ আগে থেকেই ব্রিটেনে বসবাসরত কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবী গোপনীয় কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ শুরু করেছিলেন। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে পেঁৗছাই ৩০ সেপ্টেম্বর (১৯৫৮)। তার ৭-৮ দিন পরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা মার্শাল ল' জারি করে। লন্ডন যাওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ আমীর-উল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো ঝঙঅঝ-এর লাউঞ্জে। এই যুবক এবং ব্যারিস্টারি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তিনি নিম্নস্বরে বললেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আলাপ করতে চান। তিনি আমাকে হাতে কবিরউদ্দীন আহমদের লেখা একটি পুস্তিকা দেন_ যার শিরোনাম ছিল 'টহযধঢ়ঢ়ু ঊধংঃ চধশরংঃধহ'. এটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে কীভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বঞ্চিত ও শোষণ করা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে, তার বিস্তৃত বিবরণ পরিসংখ্যানসহ দেওয়া ছিল। আমীর আমাকে বললেন, এটা গোপন দলিল, আমি যেন বাসায় নিয়ে পড়ি। তিনি উত্তর লন্ডনের ক্ল্যাপহাম অঞ্চলের একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন, আমি যেন নির্দিষ্ট দিনে ওখানে যাই। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে এসেছি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কাজ করতে। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওহফরধ ঙভভরপব খরনৎধৎু-তে কাজ করি। তবু এক সন্ধ্যায় আমীর সাহেবের বাসায় গেলাম। সেখানে দেখি ১০-১২ জন বাঙালি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তরিকুল আলম, জাকারিয়া চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। কয়েকদিন আগে ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে দেখা হলে জানালেন, তিনিও ওই বৈঠকে যোগ দিতেন। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে ঢাকা থেকে আমার পুরনো বন্ধু কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ইৎরঃরংয ঈড়ঁহপরষ-এর ংযড়ৎঃ ঃবৎস ঋবষষড়ংিযরঢ় নিয়ে লন্ডনে এলো। জহুর আসায় আমাদের বৈঠক প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সে কথা জহুর বারবার বলল। সে বলত, পাকিস্তান সৃষ্টি করে আমরা যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই_ এ কথার ওপর জোর দিত।
১৯৬০ সালের শেষ দিকে বদরুদ্দীন উমরও অক্সফোর্ডে এসেছিল। আমি ওকে আমাদের বৈঠকে নিয়ে গেলাম। উমর আসায় আমাদের বৈঠক আরও সজীব হয়ে উঠল। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার এবং বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। উমর এবং আমার পড়াশোনা ও গবেষণার চাপে আমীরের গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। তবে জহুর থাকতেই এই ভাবনা হয়েছিল যে, আমাদের জীবদ্দশায় বোধহয় পাকিস্তানের কবল থেকে দেশ স্বাধীন হবে না। তবুও আমরা স্বাধীনতার পথে পূর্বসূরির কাজ করে গেলাম। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী এই গোষ্ঠীর নাম নেওয়া হলো 'পূর্বসূরি'। এত কথা বললাম এই জন্য, সুদূর লন্ডনে বসে সেই ১৯৪৮-৬০ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা যে কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম এবং পরে জানতে পেরেছি আমাদের দেশের মধ্যেও এ ধরনের চিন্তাভাবনা অনেকেই গোপনে করে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কীভাবে ধাপে ধাপে তিনি দেশকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব নয়। সম্প্রতি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিবিদ, যাকে বাংলাদেশ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য সম্মাননা দিয়েছে, তার একটি বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৬৩-৬৪ সালে যখন তিনি ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনে জুনিয়র কর্মকর্তা, তখন গোপনে ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব তার সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব জানতে চান যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলে ভারত সরকার সাহায্য করবে কি-না কিংবা কতটা সাহায্য করবে। শশাঙ্ক বাবু শেখ মুজিবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গোপন পথে আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শেখ মুজিব সেখানে পেঁৗছালে তাকে পরিষ্কারভাবে বলা হয়, নেহরু সরকার এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দিতে পারবে না। শেখ সাহেব বিফল মনোরথ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। সে সময় ভারত সরকারের পক্ষে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না স্রেফ নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ হয়ে গেছে এবং সে যুদ্ধে ভারত ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। চীনের কাছে এই লজ্জাকর পরাজয় নেহরুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় আধুনিক ভারতের রূপকার এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জওয়াহেরলাল নেহরু মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো অনেক বাঙালি নেতা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছেন। পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রধান নেতায় পরিণত হন। নিজের পরিকল্পনামতো আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শ অনুসরণ করে পূর্ব বাংলার সব সম্প্রদায়ের মানুষ_ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হলেন। শেখ সাহেবের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি অনুসরণ করে বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যা তার আগে কোনো নেতা পারেননি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকে জনসচেতনতা বাড়তে লাগল। জনমনে প্রশ্ন জাগল, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে আমাদের কী লাভ? এই চিন্তাধারাকে শেখ মুজিব রূপায়িত করলেন তার ঐতিহাসিক 'ছয় দফায়'। সেখানে বলা হলো, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ছাড়া সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে। আলাদা মুদ্রার ও প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করার প্রস্তাবও করা হলো। বস্তুত বলা যেতে পারে, ছয় দফা দাবির মধ্যে ছিল স্বাধীনতার পূর্বাভাস। সামরিক শাসক আইয়ুব খান সেটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তীব্রভাবে দমননীতি শুরু করে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। কিন্তু ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিল। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে, 'এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলে অভিহিত করা হবে।' এটা ছিল বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক ঘোষণা। পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর আইডিয়া ছিল আমাদের স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু যেতে হবে ধাপে ধাপে। জনগণের কাছে সেটি গৃহীত হতে হবে, পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। 'আমরা স্বাধীন হলাম'_ এ কথা না বলে পাক সামরিক শাসকদের নাকের ডগায় বসে তিনি বলেছিলেন, 'যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং ... রাস্তাঘাট যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা [শত্রুদের] ভাতে মারব, পানিতে মারব।' ওই ভাষণে তিনি পাক সৈন্যদের ব্যারাকে গিয়ে থাকতে বললেন এবং যদি তারা না যায় এবং বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে, তা হলে তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, 'তোমরা আমার ভাই_ তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।' বঙ্গবন্ধু তার ওই ভাষণের শেষের দিকে বললেন, '... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব_ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
আমি এবং আমার মতো অগণিত লোক যারা রেসকোর্স ময়দানে সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শেখ সাহেবের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনছিলাম, তারা শুনলাম, বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শেষ করলেন 'জয় বাংলা' বলে। ওই সময় লোকজন বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিচ্ছিল, সেই হট্টগোলের মধ্যে তিনি জয় বাংলার পর 'জয় পাকিস্তান' কিংবা 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'ও বলেছিলেন কি-না আমি শুনতে পাইনি। আমি বলব, যদি বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেও থাকেন, তাহলে কোনো দোষ ছিল না। স্বাধীনতার পক্ষে এত কথা বলার পর জয় পাকিস্তান বলে পাকিস্তানি শাসকদের স্রেফ বিভ্রান্ত করতে নেহাত কৌশলগত কারণে তিনি এ কথা বলতে পারেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নাগের ডগায় বসে স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করা ছিল দুঃসাহসিক কাজ।
বন্ধুবর বদরুদ্দীন উমর এ কে খন্দকারের বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন : ''তিনি (শেখ মুজিব) যদি জনগণের ওপর নির্ভরশীল হতেন এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তা হলে ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানের বক্তৃতার শেষে দেশের লোককে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরির আহ্বান না জানিয়ে এবং বক্তৃতার শেষে 'জয় পাকিস্তান' না বলে ওই মহাসমাবেশেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সমবেত লাখ লাখ মানুষকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে পরিচালিত করতেন এবং বাঙালি সামরিক লোকদের ক্যান্টনমেন্টের দখল নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। বিমানবন্দর দখল সহজ হতো এবং তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের সংখ্যা কম থাকায় জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি সামরিক সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতেন। সেই সংঘর্ষে হাজার হাজার লোক নিহত হতে পারত কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ওইদিনই পাকিস্তান সরকারের পতন হতো।" উমরের এই বক্তব্য পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। তিনি তো ফরাসি বিপ্লব ও তার পরবর্তীকালের ইতিহাস ভালো করে পড়েছেন। তিনি কি ভুলে গেছেন ১৮৭১ সালে ফরাসি-জার্মান যুদ্ধে লুই ফিলিপ, যিনি নিজেকে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তার পতনের পর নতুন ফরাসি সরকারের আমলে প্যারিস কম্যুনের বিপ্লবকে কী নৃশংসভাবে ফরাসি সৈন্যবাহিনী দমন করেছিল? প্যারিসের বিপ্লবী জনতার ওপর সৈন্যবাহিনী কামানের গোলা চালিয়ে হাজার হাজার ফরাসিকে হত্যা করে কম্যুনকে ধ্বংস করেছিল। শেখ মুজিব যদি উমরের কথামতো লাখো জনতা নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করার চেষ্টা করতেন, তাহলে অবাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা সংখ্যায় যতই কম হোক তাদের হাতে প্রচুর ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ ছিল, তারা নির্বিচারে কামান দেগে শেখ মুজিবসহ লাখো বাঙালিকে হত্যা করত। বাইরের কোনো শক্তি আমাদের রক্ষা করতে আসত না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো। আমরা চিরদিনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে থাকতাম।
এবার খন্দকার সাহেব ও বাঙালি সামরিক অফিসারদের কথা বলি। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে একাধিকবার শেখ সাহেবের কাছে পরামর্শ ও নির্দেশের জন্য গেছেন; কিন্তু শেখ সাহেব তাদের আশ্বাস দিতে পারেননি। এ জন্য খন্দকার সাহেবরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। শেখ সাহেব কেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি তার কারণ ছিল। আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের হাতে কি বড় যুদ্ধ করার মতো ভারী অস্ত্র ছিল? অস্ত্র পাওয়া যেত একমাত্র ভারতের কাছ থেকে। কিন্তু ওই সময় ভারত কেন অস্ত্র দিতে যাবে? ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বাঙালিদের কোনো কার্যক্রমে বড় আকারের সাহায্য করতে ওই সময় প্রস্তুত ছিল না। যদি ভারত সে রকম করত, তখনই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত এই অজুহাতে যে, ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিনষ্ট করতে চায়। সে সুযোগে চীন ১৯৬২ সালের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আক্রমণ করে বসত, সে আক্রমণকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ভারতের ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও আমরা সমর্থন পেতাম না। খন্দকার সাহেব ও অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি দিতেন তাহলে ক্ষিপ্রগতিতে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকবাহিনী আমাদের শেষ করে দিত। আমাদের অবস্থা নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার মতো হতো।
সে সময় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যত কমই থাকুক, তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এই উপলব্ধি আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ছিল না মোটেই, যদিও তারা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কোনো কন্টিনজেন্ট প্ল্যান ছিল না। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর একটা গোপনীয় সমঝোতা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত ভারত অপেক্ষা করবে।
বস্তুত মার্চ-এপ্রিল ১৯৭১ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের অনুকূলে ছিল না। বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তখন আমরা এর শিকার হয়েছিলাম। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে আমেরিকা; আবার কমিউনিস্ট চীনের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা চীনের কাছে আসার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে চীন ও আমেরিকার পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু এই দুই পরাশক্তি নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপক্ষে। একদিকে জাতিসংঘের পক্ষেও আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার সম্ভাবনা ছিল না প্রধানত এই কারণে যে, জাতিসংঘের সনদে রয়েছে কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ তারা কখনও সমর্থন করবে না। সে পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলে টিকতেই পারত না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, ধাপে ধাপে সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। এ কে খন্দকার সাহেব তার বইয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লিখেছেন, ভারত সরকার আমাদের মুক্তিবাহিনীকে যথেষ্টভাবে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল না। তখন ভারত চায়নি মুক্তিবাহিনী ভারতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের বাহিনীর সঙ্গে কোনো বড় রকম সংঘর্ষে লিপ্ত হোক। তা হলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। ভারত সময় চাচ্ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে। তাছাড়া ভারত শীতের আগে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়নি। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যখন উত্তর-পশ্চিম হিমালয় বরফে ঢেকে যাবে সে সময় চীনের পক্ষে ওই অঞ্চল থেকে সৈন্য নামিয়ে ভারত আক্রমণ করতে পারবে না। এপ্রিল থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি অসহায় মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং এর ফলে ভারতের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন বিশ্ববাসীকে সচেতন করে দিতে। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরস্পরকে সাহায্য করার বন্ধুত্ব চুক্তি সই হয়ে গেছে। ভারতের রণকৌশল ছিল, আমাদের মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখবে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ-সাধারণ মানুষ ভারত সৈন্যবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাক সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিলেন কেন? পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর যে ছবিটি প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, তিনি অত্যন্ত শান্ত, অবিচলিত ও আত্মমর্যাদাসহ করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জের একটি সোফায় বসে আছেন। তার চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই; বরং একটা প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ সুস্পষ্ট। বস্তুত তিনি জীবনের বাজি রেখে নির্ভীক ও শান্তভাবে মৃত্যুভয়কে জয় করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানিরা তাকে হয়তো মেরে ফেলতে পারে কিন্তু বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবেই_ এ বিশ্বাস তার অটুট ছিল। ২৫ মার্চ রাতে যখন তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম শেখ সাহেবকে তাদের সঙ্গে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছিলেন, তখন শেখ সাহেব তাদের চলে যেতে বলেন। 'তোমরা চলে যাও, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।' এ কথা তাজউদ্দীনকন্যা রিমি লিখেছেন তার বইয়ে।
পরিশেষে এ কে খন্দকার সাহেব সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। তরুণ বয়সে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। গভীর স্বদেশপ্রেমের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমি বলব আমাদের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তা সম্পর্কে এ কথা বলা যায়। স্নেহভাজন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার একটা বইয়ে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর কাকুল মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষণের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এ কে খন্দকার সাহেবের মতো আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা গভীর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করেছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন। তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে আমরা যেন কোনো কার্পণ্য না করি। খন্দকার সাহেব তার সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে যা মনে হয়েছে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। বলতে হয় অত্যন্ত সীমিত প্রেক্ষাপটে, সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি উনিশশ' একাত্তরের জটিল পরিস্থিতিকে নিরীক্ষণ করেছেন, যার প্রকাশ তার বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
যারা খন্দকার সাহেবের বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে তার সম্পর্কে অশালীন উক্তি করেছেন তাদের আমি সমর্থন করি না। খন্দকার সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন। সেই ব্যাপারটাকে সম্মান জানানো দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে মতপার্থক্য হলেও তাদের অবদানের কথা মনে করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্য। তেমন যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে নিজেদেরই অসম্মান করব।


জাতীয় অধ্যাপক; প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়