Friday, May 31, 2013

চির তরুণ থাকার কিছু উপায় - জলচিকিৎসা


১• খুব ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে করতে কয়েক মাসের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে চার গ্লাস পানি খাওয়ার অভ্যাস করুন। এর পর বাথরুমে যান।

২• বাথরুম থেকে ফিরে এসে আরও এক গ্লাস পানি খান এবং তার পর খান দুধ ছাড়া খুব হালকা এক কাপ চা। আপনার ওজন বেশির দিকে হলে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিন। চা কখনোই অতিরিক্ত গরম খাবেন না।

৩• সারা দিনে ৮ থেকে ১২ গ্লাস বাড়তি পানি খাবেন। উপরোক্ত রং চা দিনে কমপক্ষে চার কাপ খাবেন।

৪• ওপরের নিয়মে পানি খাওয়ার নাম হচ্ছে হাইড্রোথেরাপি বা জলচিকিৎসা । মূলত এটি হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে- ঘুম থেকে উঠে ধীরে ধীরে চার গ্লাস পানি খাওয়ার অভ্যাস করলে প্রায় ৩৬ ধরণের রোগ হয় না এবং হলেও সেরে যায়।

৫• অপর পক্ষে, দুধহীন এবং দুধ-চিনি-হীন হালকা গরম চা হচ্ছে আড়াই হাজার বছর আগের একটি চায়নিজ হারবাল মেডিসিন। সেকালে এই চা দিয়ে হার্ট, ব্লাড প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ) ও পেটের নানা রকম রোগের চিকিৎসা করা হতো। আবার আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে- চায়ে রয়েছে অ্যান্টিঅিডেন্ট, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে নিশ্চিত অবদান রাখে। এ ছাড়াও অন্য বহুগুণ রয়েছে চায়ে। তবে যে চা-টা প্রক্রিয়াজাত হয়নি, সে চায়ের গুণাগুণই অপেক্ষাকৃত ভালো।

৬• ভিটামিন সি একটি বৈপ্লবিক খাদ্যপ্রাণ। অসংখ্য এর গুণাগুণ। জানা গেছে, দিনে ১ হাজার মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খেলে মানুষ চির তরুণ থাকে। তবে ট্যাবলেট খেলে কিছুই উপকার পাওয়া যায় না। খেতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ তাজা ফলমূল। প্রতিদিনই খেতে হবে। ভিটামিন সি ও ক্যান্সার ঠেকাতে সাহায্য করে।

৭• আমলকি, সব ধরনের লেবু, টমেটো, কমলা, পেয়ারা, নানা রকম টক স্বাদের ফলে বিভিন্ন মাত্রায় ভিটামিন সি রয়েছে।

৮• রেডমিট অর্থাৎ গরু, মহিষ, খাসি, ভেড়া ইত্যাদির মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। ফার্মের মুরগিও চলবে না। শুধু চর্বিহীন বাচ্চা মুরগির মাংস খাওয়া চলতে পারে।

৯• প্রচুর পরিমাণে আধা-সেদ্ধ শাক-সবজি, তরিতরকারি এবং খুব অল্প পরিমাণে ভাত-রুটি, এই হওয়া উচিত আপনার দৈনন্দিন মূল খাদ্য।
ভাজাভুজি খাবেন না। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, ঘি, মাখন খাবেন না। মসলার বিভিন্ন ভেষজ গুণ আছে, তবুও রান্নায় খুব বেশি মসলা ব্যবহার করবেন না।

১০• সালাদ হিসাবে প্রতিদিন বেশি করে খাবেন কাঁচা লেটুস পাতা, পুদিনা পাতা, টমেটো ইত্যাদি।

১১• বিধিনিষেধ না থাকলে সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু খাবেন।

১২• ছোট-বড় সব ধরনের মাছ খাবেন। সমুদ্রের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে পারলে তো খুবই ভালো। কেননা, ওটা মহৌষধ। গাদা-গাদা মাছের কাটা খাওয়া ঠিক নয়। ওতে পাকস্থলিতে পাথর হতে পারে।

১৩• সূর্যমূখী ফুলের বীজ হচ্ছে হার্টের ভেষজ ওষুধ। রান্নায় সূর্যমূখী তেল ব্যবহার করলে হার্টের সুরক্ষা যেমন হয়, তেমনি হার্টের অসুখ থাকলে তা সারাতে সাহায্য করে।

১৪• প্রতিদিন অল্প একটু টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। টক দই উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।

Wednesday, May 29, 2013

এক অজানা কুটকৌশলের অংশ হলেন ১৬ জন সম্পাদক:এটা কি আরও একটি দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের পদধ্বনি?


এক অজানা কুটকৌশলের অংশ হলেন ১৬ জন সম্পাদক……
by Bangladeshi Eyes
এটা কি আরও একটি দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের পদধ্বনি?

গত ১৮ মে দেশের প্রথম সারির পনেরটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক সুনির্দিষ্ট ফৌজদারী অপরাধে গ্রেফতারকৃত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এমন বিবৃতিতে বিস্মিত হয়েছেন দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। আসুন দেখে নেই কারা এই দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজঃ




তাদের সংবাদ পত্রেই বিভিন্ন সময়ে মাহমুদুর রহমান এর কালো চরিত্রের প্রকাশ

অথচ এই সম্পাদকদের সংবাদপত্রেই বিভিন্ন সময়ে মাহমুদুর রহমান এর কালো চরিত্র উঠে এসেছে তার একটি সঙ্কলন নিম্নে দেয়া হল ।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমঃ

১. তারিখঃ 22 Apr 2013 04:08:41 PM Monday BdST

URL:http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=c65002e11643db1d80afe5f0486e74fd&nttl=22042013190863






দৈনিক প্রথম আলোঃ

২. তারিখঃ রোববার ২৬ নভেম্বর , ২০০৬






দৈনিক যুগান্তরঃ

৩. দৈনিক যুগান্তর বের করেছিল মাহমুদূর ভাইজান এর আমলনামা যার শোক এ তারা এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত




সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি এবং আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দেবার অদ্ভুত দাবি জানানো সম্পাদকগণ নিজেরাই সাংবাদিকতার মুল আদর্শকে কলঙ্কিত করেছেন। এক মাহমুদুর রহমানের অপরাধের বিরোধিতা না করে তার পক্ষাবলম্বন করে তারা নিজেরাই এই অপরাধের অংশীদার হয়েছেন। এখন এই অপরাধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিভিন্ন পর্যায়ের দৌড়ঝাঁপ এবং সর্বশেষ “সম্পাদক পরিষদ (Editors Council)”গঠন তাদের উদ্দেশ্যমূলক কার্যকলাপের ইঙ্গিত দেয়। যদিও তারা বলছেন-সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন, সাংবাদিকতার পেশাগত মানোন্নয়ন ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এই পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য। কিন্তু ইতোমধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে তারা যেভাবে মাহমুদুর রহমানকে বাঁচার মিশনকে দেখছেন সেক্ষেত্রে স্বভাবত আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। আমরা মনে করি কোন সুস্থ এবং প্রকৃত সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য কোনক্রমেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং উস্কানিদাতাদের রক্ষা করা নয়।

(বিঃদ্রঃ পাঠকবৃন্দ এই বংশ কিন্তু বিএন পি – জামাত কিংবা আওয়ামীলীগ বংশ নয়।বিশ্বের গদফাদার নিজেকে অসীম ক্ষমতাবান ভাবা এই বংশের পরিচয় আমাদের সামনে খুব দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যার কথা শুনলে হয়তো আঁতকে উঠবেন অনেকেই ।)

তার আগে জেনে নিই কে এই মাহমুদুর রহমান?


শুরুতেই একটি তথ্য দিই। মাহমুদুর রহমানের স্ত্রী ফিরোজা খান জামায়াত ইসলামের রুকন ছিলেন। আপনি ভাবছেন জামায়াতেতো মহিলা নেত্রীই নেই, রুকন আসলো কোত্থেকে! রুকন হচ্ছে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামোর একটি ধাপের নাম। সমর্থক-কর্মী-সাথী-রুকন। রুকন হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়। ইসলামী ছাত্রী সংস্থা যেমন ছাত্রশিবিরের নারী উইং, ঠিক তেমনি জামায়াতেরও নারী উইং আছে।
১৯৫৩ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণকারী জঙ্গীবাদের মিডিয়া গুরু মাহমুদুর রহমান বুয়েট থেকে পাশ করা একজন মেধাবী পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত বঙ্গসন্তান(J)। জ্বলতে জ্বলতে জ্বলন্ত এই সম্পাদক সাহেব ডিগ্রি নিয়েছেন গ্লাস ও সিরামিকস বিষয়ে (এজন্য অবশ্য গ্লাস আর বোতল এর সাথে তার অকৃত্তিম ভালোবাসার সম্পর্ক ) ।

প্রথম চাকুরী একটি ব্রিটিশ অক্সিজেন কম্পানিতে। পেশাগত উত্থান ঘটে দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকোকে দিয়ে। বিয়ে করেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী হারুন অর রশিদ খান মন্নু’র মেয়েকে।

শশুরের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মন্নু সিরামিকসে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ নেন। অর্থ আত্মসাতের কারণে জামাইকে বের করে দেন শশুর হারুন অর রশিদ খান মন্নু। বেক্সিমকো গ্রুপের শাইনপুকুর সিরামিকসে সাধারণ এক্সিকিউটিভ পদে যোগদান করে চতুর মাহমুদুর রহমান এক সময় হয়ে যান প্রধান নির্বাহী। এই দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ঘটে যায় আসল ঘটনা।

গত বিএনপি সরকারের আমলে একজন কাঁচ ও সিরামিকস বিষয়ে ডিগ্রীধারী মাহমুদুর রহমান হয়ে যান জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান! দেশে তখন তুমুল বেসরকারিকরণের কাজ চলছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে মাহমুদুর রহমানের মত অযোগ্য, অনভিজ্ঞ লোকের হাতে দায়িত্ব দেয়ার ঘটনায় সবাই চমকে যান। এখনো বিনিয়োগ বোর্ডের তৎকালীন কর্মকর্তাগণ সেই স্মৃতিচারণ করেন। তাদের কাছে এটি একটি মুখরোচক গল্প। চরম অর্থলিপ্সু এই জাতীয় প্রতারক নিয়ম ভেঙে বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়েও বেক্সিমকো থেকে আর্থিক সুবিধাদি অর্থাৎ বেতন ভাতা গ্রহণ করতেন।

মাহমুদুর ভাইজান এর প্রানের সখা মতি ভাই ই তখন এই বিষয়ে দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন:




বিএনপির শেষভাগে বিভিন্ন দুর্নীতি কেলেংকারিতে জড়িয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন। কোন এক অজানা ক্যারিশমায়, অদৃশ্য এক শক্তির বলে প্রতিমন্ত্রীর বিকল্প হিসেবে জ্বালানী উপদেষ্টা নিয়োজিত হন বর্তমানে দেশের দুর্ধর্ষ সম্পাদক কারারুদ্ধ মাহমুদুর রহমান। একজন কেমিকৌশলী একাধারে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ, পরবর্তীতে জ্বালানী বিশেষজ্ঞও। যিনি জাতির জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা! বিষয়টা এমনও না যে মাহমুদুর রহমান যথেষ্ট মেধাবী। আসলে ধুরন্ধর আর মেধাবী এক কথা নয়। ছিলো না কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। বিএনপি সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় যে যে গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন, কোন দায়িত্বেরই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান তার ছিলো না। তাহলে কিভাবে তিনি এসব দায়িত্বের দায়িত্ববানের পদ অলংকৃত করেন? এক সময় তা অজানা থাকলেও এখন আর অজানা নয়।
ঘটনার পরিক্রমায় ২০০৬ সালে আবারো হোঁচট খেলো গণতন্ত্র। চাঞ্চল্যকর ওয়ান ইলাভেনের পর তত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতায় বসে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে একের পর এক গ্রেফতার হতে থাকেন দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা। শুরু হলো রহস্যজনক মাইনাস টু ফর্মূলার বাস্তবায়ন চেষ্টা। মজার ব্যাপার হলো মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ফুলবাড়িয়া কয়লা খনি সংক্রান্ত দুর্নীতি, বিনিয়োগ বোর্ডে জরিপ প্রতিবেদন দাখিলে অনিয়ম, জনতা ব্যাংক থেকে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ক্ল্যাসিক মেলাইন ইন্ড্রাস্টিকে ঋণ পাইয়ে দেয়া, বিনিয়োগ বোর্ডের দায়িত্ব পালনকালে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া, অবৈধ আর্থিক লেনদেন সহ অসংখ্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তত্বাবধায়ক সরকার এই মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করেনি। অথচ বাসায় দুই বোতল বিদেশি মদ পাওয়ার কারণে সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। বেগুন চুরি করে বেচারাকে বনবাসে চলে যেতে হলো, অথচ পুকুর চুরি করে সেই পুকুর পাড়ে বসে বসে দখিনা বাতাস খাওয়ার পরও ফখরুদ্দিনের সেনা-পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার জন্য দেখেনি। এবার নিশ্চয় কিছুটা বুঝা যাচ্ছে কোন ক্ষমতাবলে একজন কেমিকৌশলী বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান হন আবার জ্বালানী উপদেষ্টাও হন!

ওহ ভালো কথা। সিরামিকস প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার সময় সিরামিস ব্যবসার প্রেমে পড়েন প্রেমিক মাহমুদুর রহমান। আরটিসান সিরামিকস নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও মালিক হয়ে যান এরই মধ্যে।

২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে উত্তরায় এই সিরামিকস প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলা, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকসহ (১৫জন ভাসুর সম্পাদকের কয়েকজন ছিলেন) সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক গোপন ষড়যন্ত্রে বসেন। যেটাকে আমরা টিভি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের সামনে ফাইল ও ব্লেজারে চেহারা ঢাকা বহুল আলোচিত উত্তরা ষড়যন্ত্র হিসেবে চিনে থাকি। ব্যাপারটা অলৌলিক বটে। এই ষড়যন্ত্র মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিলো দুর্দান্ত রহস্যজনক এক ঘটনা।

এই সম্পর্কিত সংবাদঃ

URL:

http://www.amarblog.com/montrok/posts/167833

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2010-06-10&ni=21236

এবং অতীতের খবর তারিখঃ
দৈনিক জনকন্ঠ (২৬ নভেম্বর , ২০০৬)



দৈনিক যুগান্তর (২৬ নভেম্বর , ২০০৬)




দৈনিক প্রথম আলো (২৬ নভেম্বর, ২০০৬)




এটি একটি কৌশল ভিন্ন অন্য কিছু না। সেই থেকে এই পর্যন্ত এরকম বহু কৌশলে ব্যবহৃত হয়েছেন বুদ্ধিবেশ্যা মাহমুদুর রহমান। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরকম একটি ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরও মাহমুদুর রহমানের কিছুই হয়নি।



আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের হাতে ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হওয়ার সাথে সাথে মাহমুদুর রহমান নিহত রাজীবকে নাস্তিক হিসেবে হাজির করে ব্লগের বিভিন্ন স্রষ্টায় অবিশ্বাসী লেখকদের লেখা পত্রিকায় ছাপিয়ে দেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমানদেরকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করে।

দৈনিক আমারদেশ ব্লগারদের এই আন্দোলনকে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে বানচালের মূল কাজ শুরু করে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। ওই সময় দৈনিক আমারদেশ এর কয়েকটি সংবাদ শিরোণাম উল্লেখ করি-



ধারবাহিকভাবে এরকম আরো অনেক সংবাদই দৈনিক আমার দেশ করেছে। এবং আক্ষরিক অর্থে হেফাজতে ইসলামীর সহায়তায় দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে একটি দুর্বিসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন মাহমুদুর রহমান। আচমকা বাংলাদেশে বসে আফগানিস্তানের স্বাদ পেতে থাকে সাধারণ মানুষ। চারিদিকে ব্লাসফেমী, নারীকে গৃহবন্দী, শরীয়াহ আইনের হুমকী ধামকি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাপিয়ে বিজ্ঞাপনের মত ছড়াতে থাকে তথাকথিত নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবি। প্রকাশ্যে লিফলেট বিলি করে ব্লগারদের হত্যা করার প্ররোচনা চলতে থাকে।

তো তারা কেন এই দেশের ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসের চাষ করবে?

ঠিক এই কামড়ের শুরুটা করলো দৈনিক প্রথম আলো। বিক্রি হয়ে গেল তারা ।বিক্রি হল মতি ভাই।

তিন হাজার মানুষের উপর আজগুবি এক অসংলগ্ন তথ্যের জরিপ চালিয়ে ফলাফল প্রকাশ করলো। যে ফলাফল আমাদেরকে জানালো দেশের ৯০ ভাগ জনগণ তত্বাবধায়ক সরকার চায়। জানালো অর্ধেকের বেশি মানুষ চায় না জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হোক। অর্ধেকের কম মানুষ গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন করে। পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষ নাকি গণজাগরণ মঞ্চের নামই শোনেনি! তো, প্রকল্প উদ্বোধনের পরতো একটু নাচানাচি করতেই হয়। ঠিক তখনই সব জড়তা কাটিয়ে প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ১৫ জন সুবিবেচক নামলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আয়োজক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির আন্দোলনে। এসব কিছুর আগে একটু নমুনা দেখিয়েছিলো গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে হাসানাত আবদুল হাই নামক এক লেখকের একটি চরম মাত্রার অশ্লীল গল্প। প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নেয় প্রথম আলো সম্পাদক। এটা এই ব্যক্তির অভ্যাস। ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা খুব পছন্দ করেন। তিনি ক্ষমা চেয়েছেন ধর্মান্ধদের কাছে, চেয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে, এবার চাইলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রজন্মের কাছে। আরো কার কার চাইবে কে জানে!

১/১১ পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে কিছু কিছু সম্পাদক অতি উৎসাহী হয়ে উস্কানি দিচ্ছিলেন বিভিন্নভাবে। সে সময় তারা তেমনভাবে সংঘবদ্ধ ছিলেন না বলে অনেক কিছুই সম্ভব হয় নি। কিন্তু এবার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবি জোরালোভাবে উঠেছে তখন বিএনপি নিজেরাই জামায়াত-শিবিরকে বাঁচাবার মিশনে আছে। সেই সাথে আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিষয়ে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হবার আশংকাসহ অন্যান্য বিষয় তখন গত বারের সে সুযোগ তারা কি নিতে চাইছে অন্যভাবে;সংঘবদ্ধ হয়ে?

সাংবাদিক না হয়েও যিনি হুট করে সম্পাদক বলে দাবি করতেন সেই মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি জানানো যদি তাদের মিশনের প্রথম পদক্ষেপ হয়ে থাকে তবে পরের পদক্ষেপ কি হতে পারে তা নিয়ে আতংকিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই!
http://mitthachar.wordpress.com/2013/05/29/%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%85%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A7%8C%E0%A6%B6%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%82%E0%A6%B6-%E0%A6%B9%E0%A6%B2/

খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যে কারণে তালুকদার খালেককে সমর্থন করি : মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান


খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমার সম্মিলিত নাগরিক কমিটির সদস্য থাকা নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংবাদের মূল বক্তব্য হলো- আমার এখানে থাকা সমীচীন হয়নি। পত্রিকাগুলো আইনের কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেনি বা নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে কি-না তাও উল্লেখ করেনি। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা-২০১০-এর ১৪ অনুচ্ছেদের ক, খ ও গ- এ সরকারী সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যক্তি ও সরকারী সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এর কোনটির মধ্যে উপাচার্যের পদ বা স্বায়ত্ত-শাসিত প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রসঙ্গ নেই। তবুও আমি আইনের কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে বা কারও সঙ্গে বিতর্কে না জড়িয়ে কেন আমি তালুকদার আব্দুল খালেককে সমর্থন করি তার দু’একটি কারণ শুধু উল্লেখ করতে চাই।
বাবার কর্মসূত্রে খুলনার সঙ্গে আমার পরিচয়। এর পর কোন্ সময় থেকে যেন খুলনা আমার শেকড়ের মতো হয়ে ওঠে। ছাত্র জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে খুলনায়। ১৯৮১-৮৯ এই দীর্ঘ ৯ বছর পড়াশোনার সূত্রে খুলনায় থেকেছি। ছাত্র রাজনীতির সুবাদে খুলনার আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে তখন থেকে সখ্য। পরবর্তীতে অনেক বছর একাধিক্রমে রাজশাহী অবস্থান করায় খুলনার অনেকের স্মৃতি থেকে আমি হারিয়ে যাই। কিন্তু বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান আমাকে ভোলেননি। তালুকদার আব্দুল খালেককে সেই ৮০-র দশকে যেমন দেখেছি; এখনও তেমনি কথার চেয়ে তাঁর কাজ বেশি। ১৯৮৪ সালে খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দু’টি মিছিলের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগের মহানগর ও জেলা কমিটির জরুরী সভা বসে। আহতদের পক্ষে থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু কে মামলা করতে যাবে কর্মীদের পক্ষে এই নিয়ে গড়িমসি শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তালুকদার আব্দুল খালেকই আহতদের পক্ষে থানায় যান। সম্ভবত তিনি তখন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। এখনও সেই আগের মতো জীবনী শক্তি তাঁর মধ্যে। মেয়র থাকাকালে ফজরের নামাজের পরেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন নগরীর নির্মীয়মাণ রাস্তা পরিদর্শনে। তার গাড়িতে একটা শাবল থাকত। তার অগোচরে যদি কোন রাস্তার পিচঢালাই হয়ে থাকে তাহলে শাবল দিয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তার পিচঢালাইটা যথারীতি হয়েছে কি-না তা তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন। খুলনা শহরে চলতে গিয়ে অনেক সময়েই দেখেছি প্রখর রোদে তিনি দাঁড়িয়ে রাস্তার কাজ তদারকি করছেন। এসব দেখে মনে হয়েছে এখনও জনগণের জন্য কাজ করার মতো রাজনীতিবিদ আছেন। অনেকের কাছেই শুনেছি যে, অনেক ঠিকাদার তালুকদার আব্দুল খালেকের ওপর নাখোশ। কারণ তারা সিটি কর্পোরেশনের কাজে বেশি লাভ করতে পারেননি। তালুকদার আব্দুল খালেকের অন্য যে বড় গুণ তা হলো তার সময়ানুবর্তিতা। তাঁর সঙ্গে অনেক সভায় বসেছি। দেখেছি ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তিনি তাল মিলিয়ে চলেন। আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি আমাকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান। পাশাপাশি ঐ মুহূর্তেই একটি কথা বলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান নির্মাণ কাজগুলো যেন ভালভাবে সম্পন্ন হয়। আমি অভিভূত হই। চেষ্টা করব বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করি।
যেসব মানুষ পাঁচ বছর আগে খুলনায় এসেছেন, তারা যে কেউ এখন খুলনায় এলে তাদের চোখে বড় ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়বে। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, পূর্বের তুলনায় উঁচু এবং বেশিরভাগ রাস্তাই ঝকঝকে। কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন যেমন নগরবাসীকে ঝলমলে রাজশাহী উপহার দিয়েছেন, নগর ভবনের পশ্চিম পার্শ্ব থেকে মেডিক্যাল কলেজের পূর্বপার্শ্ব হয়ে একেবারে পদ্মা নদী পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্ত করেছেন; তালুকদার আব্দুল খালেকও সোনাডাঙ্গা এলাকা ও গোয়ালখালী মোড় এলাকার বেশ কিছু রাস্তা করতে গিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার দুঃসাহসী কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত সততা না থাকলে এ ধরনের দুঃসাহসী কাজ করা যায় বলে মনে হয় না। এর পাশাপাশি ড্রেন নির্মাণের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থের টেন্ডার হয়েছে বলে শুনেছি।
খুলনা শহরের পশ্চিম প্রান্তে ময়ূর নদী। এর পাশেই ’৭১-এর বধ্যভূমিখ্যাত গল্লামারী যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এই ময়ূর নদীতে ’৭১-এ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি গল্লামারীতে শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সুবিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন; অন্যদিকে ময়ূর নদী সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ময়ূর নদীকে ঘিরে একটা লিনিয়র পার্ক তৈরির জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা যারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি প্রতিদিনই ময়ূর নদীর ওপরে নির্মিত গল্লামারী ব্রিজ দিয়ে যখন পার হই, তখন ’৭১ আমাদের মনোজগতে এসে হাজির হয়। সে কারণে যখন প্রত্যক্ষ করি যে, খুলনার সকল খাল উদ্ধারের অভিযানসহ তিনি ময়ূর নদীকে আলাদাভাবে প্রাধান্য দেন তখন আবেগপ্রবণ না হয়ে পারি না।
তাঁর সম্পদ বিবরণী নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। পাঁচ বছর পূর্বে তিনি যে সম্পদের মালিক ছিলেন সে তুলনায় এখন সম্পদ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি বলেছেন যে, তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার মেয়র এবং তাঁর স্ত্রী হাবিবুন্নাহার রামপাল মংলা আসনের সংসদ সদস্য। তাঁদের দু’জনের বেতন-ভাতা আয়ের অংশ। তাঁর নিজস্ব ব্যবসাও রয়েছে। বৈধভাবেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি আরও বলেছেন যে, যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি একটি পয়সা উপার্জন করেছেন, তাহলে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। তাঁর এই অপরিসীম সাহস আমাকে মুগ্ধ করে।
তালুকদার আব্দুল খালেক কয়েক কোটি টাকার দেনা নিয়ে মেয়র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর দায়িত্ব পরিত্যাগের সময়ে তিনি উদ্বৃত্ত রেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে খবর নিলে নিশ্চয়ই এর সত্যতা জানা যাবে। তিনি একজন সাধারণ গ্রাজুয়েট। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতা প্রশংসার দাবি রাখে। মেয়র হিসেবে তিনিই প্রথম মেয়র পদক চালু করেন। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য তিনি প্রতিবছর এই পদক প্রদান করেছেন। গুণী মানুষদেরকে এ ধরনের সম্মাননা প্রদান অবশ্যই উন্নত রুচির পরিচায়ক।
খুলনা শহর এক সময়ে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, কমরেড রতন সেন, এসএমএ রব, সরদার আব্দুর রাজ্জাক, সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু, মোসলেম উদ্দিন, শেখ আবুল কাশেম দিন-দুপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। এজন্য তৎকালীন সময়ে বাইরের কোন লোক খুলনায় আসতে ভীতি অনুভব করত। এমনকি তালুকদার আব্দুল খালেকের জীবনও বিপন্নের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু তালুকদার খালেক মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই সন্ত্রাসীদের জনপদ খুলনা পরিণত হয় অনেকটা নিরাপদ শহর হিসেবে। তাঁর দায়িত্বপালনকালীন সময়ে পূর্বের তুলনায় মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়নি। নগরবাসী নির্বিঘেœ জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছে। খুলনা শহরের প্রতিটি মোড়ে রাত ১২-১টায় মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে তালুকদার আব্দুল খালেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়রের অফিসকে আওয়ামী লীগের অফিস বানাননি। সেখানে যে কোন দল-মতের লোকই সমানভাবে যেতে পারত। সিটি কর্পোরেশনের অফিসকে তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছেন।
আমার অনেক লেখায় আমি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছি। কালের কণ্ঠে একটি লেখায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহ্জাহান খানের আমি কঠোর সমালোচনা করেছি। তখন কেউ আমার সমালোচনা করেননি। কিন্তু একটি অরাজনৈতিক নির্বাচনে একজন সৎ মানুষকে সমর্থন করার সময় কেন সমালোচনা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ২-৩ শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ নাগরিক কমিটিতে কাজ করছেন। তাদের কর্মকা- নিয়ে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন না। যদিও ঐ নাগরিক কমিটির যেসব বক্তব্য কাগজে এসেছে তার সবই প্রায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক। অরাজনৈতিক নির্বাচনে রাজনৈতিক বক্তব্য আইনের লঙ্ঘন। এমনকি সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার মতো কথাবার্তাও রয়েছে তাদের বক্তব্যে। কিন্তু তালুকদার আব্দুল খালেকের সমর্থনে গঠিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটি কোন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করছে না। শুধু তালুকদার আব্দুল খালেকের কর্মতৎপরতা ও মানুষ হিসেবে তার বৈশিষ্ট্যের কথা বলছে। নগরবাসী এসব বিষয় গ্রহণ করতেও পারে নাও পারে। তবুও তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রতি নিরন্তর শুভেচ্ছা।

লেখক : ভিসি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক জনকন্ঠ

Tuesday, May 28, 2013

দোষ মন্ত্রীর নয়, মন্ত্রণালয়ের:প্রভাষ আমিন




বিএনপি আবারও প্রমাণ করলো তারা সত্যিকার অর্থেই জনগণের দল। নইলে তারা যেখানে টানা হরতাল দিতে পারে, সেখানে তারা কেন মাঝখানে দু’দিন বিরতি দিল? জনগণের জন্য। বিভিন্ন বইয়ে পড়েছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদাররাও কারফিউর মাঝে বিরতি দিতো, যাতে মানুষ জরুরি কাজকর্ম সেরে রাখতে পারে। ধন্যবাদ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, আমাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা এমন অন্তর দিয়ে ভাবার জন্য। রোববার সারাদেশে নামকাওয়াস্তে হরতাল পালিত হলো, বুধবার আবার পালিত হবে। জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করে। কারণ শামসুজ্জামান দুদুর ছাড়া বিএনপির আর কোনো নেতাকর্মীর হরতাল নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বুধবারের হরতালে বিএনপির একজন নেতাও মাঠে নামবেন না। শুধু জনগণকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য অফিসে বসে থাকবেন দুদু।
অবশ্য দুদুকে এখন দলের নেতা না বলে, বিএনপি অফিসের কেয়ারটেকার বলাই ভালো। কেন হরতাল ডাকা হয়, এতে কার ক্ষতি, কার লাভ? কে জানে। আমার ধারণা বিএনপি নেতারাও জানেন না। যাদের বেকায়দায় ফেলার জন্য এই হরতাল, সেই সরকার থোড়াই কেয়ার করে বিরোধী দলকে। তবে সরকারের ক্ষতি না হলেও বিএনপির ক্ষতি হয়েছে। তার সফরের সময়ে বিএনপি হরতাল ডাকায় রাগ করে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করেছেন বাংলাদেশ সফরে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতি-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন। বিএনপির হরতালে তিনি বিস্ময় ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আমরাও হতাশ। একদম মেয়েলি অভিমান- আমার সফরের সময় হরতাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীর কাছে বঙ্গ ললনাদের মতো মেয়েলি অভিমান আশা করিনি। মার্কিন সৈন্যরা যেখানে আফগানিস্তানে লড়ছেন তালেবানদের বিরুদ্ধে, সেখানে একজন আন্ডার সেক্রেটারি কিনা হরতালের ভয়ে কুপোকাত। তবে আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এসবে থোড়াই কেয়ার করে। বিএনপি জনগণের দল, জনগণের অধিকার আদায়ে তারা হরতাল ডাকে। সেই হরতাল বিদেশি প্রভূদের সফরের সময় বাতিল করতে হবে কেন? হরতাল চলছে, চলবে। কে আসলো-গেল, কবে এইচএসসি পরীক্ষা এসব ভাবতে বিরোধী দলের বয়েই গেছে। এসব তো সরকারি দলের ভাবনা, দেশ তো তারাই চালাচ্ছে, বদনাম হলে তো তাদেরই হবে।
বলছি বটে বিএনপি হরতাল ডেকেছে। তবে আমি বিশ্বাস করি এবারের হরতাল দুটি ডেকেছেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বলা ভালো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্যে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি সভা-সমাবেশ করতে দেয়া না হয়, তাহলে তারা হরতাল ডাকবে না তো কি বসে বসে আঙুল চুষবে? বিএনপি আগে অনেক অপ্রয়োজনীয় হরতাল করেছে। কিন্তু তাদের এবারের হরতাল দুটি বাধ্য হয়ে দেয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বাধ্য করেছেন। এরকম পরিস্থিতিতেই অনন্যোপায় হয়ে হরতাল ডাকতে হয়। তবে বহুল ব্যবহারে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের এই শেষ অস্ত্রটি অনেক আগেই ভোতা এবং অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্যে ডাকা এই হরতালেও জনগণের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু হবে না।
আমি বরাবরই বিশ্বাস করি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। দোষ প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তির। যেমন আমার দেশ আতাউস সামাদের সময় একরকম ছিল, মাহমুদুর রহমানের সময় হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর লিফলেট। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি আমার ভেঙে গেছে। এখানে আসলে ব্যক্তি সমস্যা নয়, সমস্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের। নইলে সব আমলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরই একই সমস্যা থাকবে কেন?
এরশাদ পতনের পর বিএনপির প্রথম দফায় একদিন সন্ধ্যায় পুলিশ প্রেস ক্লাবের ভেতরে ঢুকে সাংবাদিকদের বেপরোয়া মারধোর করেছিল। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী বললেন, পুলিশ সাংবাদিকদের দেখতে পায়নি। সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবের মতো উন্মুক্ত স্থানে পুলিশ দেখতে পায়নি, এটা কেউ বিশ্বাস করেনি। পরে তার নামই হয়ে গিয়েছিল রাতকানা পুলিশের মন্ত্রী। এরপর আওয়ামী লীগ আমল কেটেছে মোহাম্মদ নাসিমের তর্জন গর্জনেÑ প্রয়োজনে কবর থেকে সন্ত্রাসী ধরে আনা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর বিএনপি এক আমলেই মাশাল্লাহ দুই জন ‘আল্লার মাল’ উপহার দিলো। অরিজিনাল ‘আল্লার মাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী’, যিনি সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবার কোলে থাকা শিশু নওশিনের মৃত্যুর পর সেই শোকাহত বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে’। এই আল্লার মালকেও বেগম খালেদা জিয়া সরিয়ে নেয়ার পর স্বরূপে আবির্ভূত হন ততদিন আড়ালে থাকা লুৎফুজ্জামান বাবর। তার জেল দেয়া চুলের স্টাইল, অসাধারণ ইংরেজি জ্ঞান তাকে দিয়েছে অমরত্ব। যদিও অলওয়েজ ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ বাবরের গুণের কদর দিতে পারেনি বর্তমান সরকার। আগের সরকারের প্রায় সবাই ছাড়া পেয়ে গেলেও এই বেচারা ২১ আগস্ট আর ১০ ট্রাকের পাল্লায় পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। এরপর বর্তমান সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয় মাঠের সৈনিক সাহারা খাতুনকে। তার বাণী শুনতে সাংবাদিকদের প্রায়শই উত্তরখান, দক্ষিণখানের কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কাভার করতে যেতে হতো। সাগর-রুনীর খুনীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করার জন্যই। এরপর ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তাকেই প্রায় বাড়ি চলে যেতে হয়। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সপ্তাহে একাধিকবার উত্তরখান যাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার আগ্রহ কারো নেই। না সাংবাদিকের, না দর্শকদের। সাহারা খাতুন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর এক সম্পাদক টক শোতে বলেছিলেন, নতুন মন্ত্রী এসএমএস করতে পারেন না।
এরপর আমরা পেলাম ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে। সুশিক্ষিত, সারাজীবন দক্ষতার সঙ্গে সরকারি চাকরি করেছেন। শুধু তিনি নন, তার পুরো পরিবারই দেশজুড়ে পরিচিত, সম্মানিত। সত্যিকারের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান তিনি। আমি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। যেভাবে তিনি একটিও ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ না করে অনর্গল বাংলা বলে যেতে পারেন, তা রীতিমতো অনুকরণীয়। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও তা অনুকরণ করতে পারিনি। দুয়েকটা ইংরেজি শব্দ ঢুকেই যায়। আমি হলফ করে বলতে পারি, এমন সুশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ আগে কখনো পায়নি। বেস্ট অব দ্য বেস্টস। সেরাদের সেরা। কিন্তু এখন দেখছি তিনি সব দিক দিয়েই বেস্ট। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর তার নাড়াচাড়া তত্ত্ব তো ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক জোকসে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, আমার মাথা পুরা আউলাইয়া গেছে। বাংলাদেশে এখন সভা-সমাবেশ করা যাবে কি যাবে না, এটা জানতে গত দু’দিনে খোঁজ-খবর করতে গিয়ে, নানা পত্রিকা পড়ে আমার পাগল হওয়ার দশা। কোনটা বিশ্বাস করবো, কারটা বিশ্বাস করবো- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সকালের কথা না বিকেলের কথা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের কথা না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পষ্টীকরণ বিবৃতি? নাকি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য? নাকি পুলিশের আইজি? একবার ভেবেছিলাম গুগলে সার্চ দেই। খোঁজ-খবর নিয়ে যা জানলাম এখন বাংলাদেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেই, নেই কোনো প্রজ্ঞাপনও। তারপরও সরকার বেআইনিভাবে, অসাংবিধানিকভাবে, কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা ছাড়াই সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। একবার শুনি সারা বাংলাদেশে, একবার শুনি ঢাকায়; একবার শুনি এক মাস, একবার শুনি অনির্দিষ্টকাল! কোনটা বিশ্বাস করবো? পাগল হতে আর কি লাগে।
প্রিয় পাঠক, চলুন একটু ঘটনাক্রম অনুসরণ করে আসি, দেখি জিলাপির প্যাচ খোলে কিনা। ১৯ মে দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামের মিরসরাইতে জোরারগঞ্জ থানা উদ্বোধন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে আমরা উৎসাহিত করি। যারা আজ সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের মনে রাখা দরকার, সমাবেশের অনুমতি নিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দেন, জনসাধারণের ওপর অত্যাচার করেন, নির্যাতন করেন, গাড়ি পোড়ান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্র নষ্ট করেন, দোকান লুট করেন; তাদের যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে আমরা সমাবেশ করার অধিকার স্বীকার করা সত্ত্বেও আগামী এক মাস পর্যন্ত কোনো দলকেই কোনো সমাবেশ করতে দেব না।” মনে রাখুন এখানে ঢাকা না সারাদেশ তা বলা হয়নি। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে একমাস বলা হয়েছে। এবার শুনি রাতে বিবিসিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলছেন, “রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করবে, এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে কোনো দলকেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। ঢাকাকে নিরাপদ রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।”
প্রিয় পাঠক, আবার আপনাদের মনে রাখার কষ্ট দেবো। বেশি না, মাত্র দুটি পয়েন্ট। এখানে আমরা পেলাম, সারাদেশ নয়, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু ঢাকাতে। আর এক মাস নয়, এই নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকালের জন্য। এবার আমরা একটু ঘুরে আসি ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ব্রিফিং থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সব সময় সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিক মহাসেনের প্রভাবে মৃত্যুর হার বেশি না হলেও অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশে একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রয়োজন। এ জন্য এক মাস সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।” এখানে আবার একটু থামতে হবে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, তবে অনির্দিষ্টকাল নয়, এক মাসের জন্য। আর নিষিদ্ধ করার কারণ অন্যকিছু নয়, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন। তবে এই নিষেধাজ্ঞা ঢাকা না সারাদেশ তা পরিষ্কার নয়। সারাদিন এত বিভ্রান্তির পর রাত ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসে স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি, এবার নিশ্চয়ই সব ফকফকা হয়ে যাবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় “জোরারগঞ্জ থানা উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতিতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল এমন কোনো কর্মসূচি দেয় যাতে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা নাশকতার আশঙ্কা থাকে বা সেরূপ লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়, তবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার স্বার্থে সেসব দলের সভা-সমাবেশের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেবে না সরকার। তবে সাধারণ সমাবেশ করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। এটা কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং জনগণের জানমাল রক্ষার্থে পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।” হায় স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে কিছুই স্পষ্ট তো হলোই না, বরং আরো ধোয়াটে হলো পরিস্থিতি। বিভ্রান্তির অবকাশ নেই, বলা হলেও বিভ্রান্তি আরো বাড়লো শুধু। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিরসরাই এবং বিবিসিতে একবারও ঘূর্ণিঝড়ের কথা না বললেও মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে সভা-সমাবেশ না করতে না দেয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো, তার আগেই ভারতে পালিয়ে যাওয়া মহাসেনকে। আবার সৈয়দ আশরাফ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এক মাসের নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে কোনো সময় বেঁধে দেয়ার কথা তো বলা হলোই না, বরং বলা হলো এটি কোনো নিষেধাজ্ঞাই নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একবার এক মাস, একবার অনির্দিষ্টকাল বললেও মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, এটি নিষেধাজ্ঞাই নয়। আর পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিকদের বললেন, তিনি এ ব্যাপারে কোনো দাপ্তরিক আদেশ পাননি। এবার বলুন, কারটা বিশ্বাস করবেন, কোনটা বিশ্বাস করবেন? আমার মতো আপনাদের মাথাও নিশ্চয়ই এলোমেলো হয়ে গেছে।
যে যাই বলুক, আমরা দেখছি আইজির বক্তব্যই এখন পর্যন্ত ঠিক। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো দাপ্তরিক আদেশ, মানে প্রজ্ঞাপন পাননি দেশবাসী। আসলে প্রজ্ঞাপন আসবে কোত্থেকে, এভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কোনো এখতিয়ারই নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। কারণ সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।” সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি না করা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ করার অধিকার হরণের অধিকার কারো নেই। ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে হলে ডিএমপি অ্যাক্ট অনুযায়ী আবেদন করতে হয়। অনুমতি দেবেন কি দেবেন না, তার এখতিয়ার ডিএমপি কমিশনারের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়। তাই সভা-সমাবেশ একমাসের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করার কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে ডিএমপি কমিশনারের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেছেন। নইলে এই বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তের দু’দিন পর মিরপুরে নিরীহ বামদের সমাবেশেও কেন পুলিশ বাধা দেবে এবং তাদের ১৫ নেতা-কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়ে যাবে? পরে আবার মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেবে? সভা-সমাবেশ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা করছেন, তা স্রেফ গায়ের জোরে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ মে এই নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও আসলে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ব্যাপক তাণ্ডবের পর থেকেই ঢাকায় কোনো সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। এর মধ্যে বিএনপি দু’বার সমাবেশের অনুমতি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর বিএনপির এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তারা আর অনুমতির জন্য বসে থাকবে না। কিন্তু আমরা জানি, সরকারের অনুমতি ছাড়া তীব্র আন্দোলন করার হ্যাডম অন্তত বিএনপির নেই। তাই তারা ঝুঁকিমুক্ত কর্মসূচি ডেকে ক্ষান্ত দিয়েছে। হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকলেই হলো।
শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আপনারা ঠিকই পড়েছেন, সরকারি দল আওয়ামী লীগও এই সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এই বিষয়ে সরকারের ৫ রকমের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দিয়েছেন ষষ্ঠ লাইন। তিনি বলেছেন, “সভা-সমাবেশ বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়।” তিনি রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কাঁঠাল গাছে আম চেয়ে তো লাভ নেই। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যারিয়ার আমলা, তার কাছে রাজনৈতিক সমাধান আশা করা কেন? আর সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য যে যুক্তি দেয়া হয়েছে তা কোনো যুক্তি নয়, অজুহাত। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন যে তীব্রতায় আঘাত হানার আশঙ্কা ছিল, আল্লাহর রহমতে তা হয়নি। পটুয়াখালিতে হালকা ছোবল হেনেই পালিয়েছে মহাসেন। পটুয়াখালির ত্রাণ কার্যক্রমের অজুহাতে ঢাকায় এক মাসের জন্য সমাবেশ নিষিদ্ধ কেন? এর আগে বাংলাদেশে কখনো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত করা হয়নি। আর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ- এসব তো আমাদের রাজনীতির অনুসঙ্গ। যখন কেউ ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ করবে তখন সরকারের দায়িত্ব তা প্রতিহত করা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে, ততক্ষণ তাতে বাধা দেয়া বা অনুমতি না দেয়ার কোনো সুযোগ কারো নেই, অন্তত সংবিধান সে সুযোগ দেয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো সমাবেশে যদি সহিংসতার সুনির্দিষ্ট কোনো গোপন খবর থাকে, তবে সে সমাবেশের জন্য অনুমতি না দিলেই হলো। সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য দেখাতে পারেননি। এক সংগঠনের শৃঙ্খলা-বিরোধী কাজের দায় সব সংগঠনকে নিতে হবে কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব অভিযোগ করেছেন, তার সবগুলোই স্পষ্টত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের ইঙ্গিতবাহী। তাহলে হেফাজতকে সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিলেই হলো। তাই বলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, নিরীহ বাম সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে হবে কেন? সমাবেশ করতে অনুমতি লাগবে এবং মারামারি করা যাবে না- এটা তো নতুন কোনো কথা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী এক মাস পরে কি দেশে অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করা যাবে? সমাবেশের অনুমতি নিয়ে মারামারি করা যাবে?
এই লেখার প্রস্তুতি হিসেবে নানা জায়গায় ফোন করে আর বিভিন্ন পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যিক ও স্পর্শকাতর এলাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাছাড়া ব্যস্ত এলাকা বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সমাবেশ সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার নীতিতে বিশ্বাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমাবেশ নিষিদ্ধই করে দিয়েছেন। আর মারামারি হতে পারে- এমন আশঙ্কায় সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া তো মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে, তাই রাস্তায় না বেরোনো তো কোনো সমাধান হতে পারে না। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সামনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় হতে পারে ট্রাইব্যুনালে। সে জন্যই সরকার বাড়তি সতর্ক। একবার যেহেতু নিষিদ্ধ করা গেছে, সরকার হয়তো রমজানের আগে আর কোনো সমাবেশের অনুমতি দেবে না। সতর্কতায় আপত্তি নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকার সমাবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি কেইস বাই কেইস বিবেচনা করলেই পারতো। আর অনুমতি না দিলে তা ফলাও করে বলতে হবে কেন? প্রত্যেক ক্ষেত্রে আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেই আর বিষয়টি নিয়ে এত হইচই হতো না। ‘আই ডোন্ট নো’ অর্থ যে ‘আমি জানি না’, এটা সবাই জানেন। এটা চিৎকার করে বলার কিছু নেই। এরশাদের আমলে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, সীমিত আকারে রাজনীতি করা যাবে, ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি- ইত্যাদি ধরনের টার্ম। আবার সেই স্মৃতি ফিরে আসছে। আমাকে গালি দেয়া যাবে, কিন্তু ঘরে বসে। আরে যে আমাকে গালি দেবে, সে কি আর আমার কথা শুনে দেবে?
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আমার অনুরাগের কথা আগেই বলেছি। আরেকটি কারণে আমি তার ভক্ত হয়ে গেছি। তাহলো, গণমাধ্যমকে মোকাবেলার সাহস। যখনই কোনো বিতর্কিত কিছু করেন, তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন চ্যানেলের টক শো’তে অংশ নেন। আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কখনোই টিভিতে যাওয়ার সাহস দেখাননি। গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়েছিলেন ‘একাত্তর’ টিভিতে। শুরুর দিকের কিছুটা মিস করলেও অনুষ্ঠানে তার কথা শুনতে শুনতে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, “একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে হটাতে আপনারা আলটিমেটাম দেবেন, ভাঙচুর করবেন; সরকার তা মেনে নেবে না।” হায় হায়, এ যে দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম। জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর যখন সচিবের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সরকার হটাতে দলবল নিয়ে জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন, তখনকার বিএনপি সরকার কি গণতান্ত্রিক ছিল না? তিনি আরো বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দল সমাবেশের অনুমতি নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করবে, আগুন দেবে, তা মেনে নেয়া যায় না। খুব ঠিক কথা। তবে তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাস তখন থেকেই শুরু হয়েছে, এর কোনো অতীত নেই। আওয়ামী লীগ যেন গান্ধীবাদী দল। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে বিএনপি যা করছে তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র ও সহিংস আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি যে দাবিতে, মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, একসময় আওয়ামী লীগ ঠিক একই দাবিতে এর চেয়ে অনেক বেশি সহিংস আন্দোলন করেছিল। এক দলের সহিংসতার ইতিহাস, আরেক দলের সহিংসতাকে জায়েজ করে না। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে অন্তত এমন কথা মানায় না। অবশ্য জিয়াউর রহমানের খাল কাটা আন্দোলনের দোসর নব্য আওয়ামী লীগার মহিউদ্দিন খান আলমগীর যদি আওয়ামী লীগের অতীত অপকর্মের দায়-দায়িত্ব নিতে না চান, তাকে ঠিক দোষ দেয়া যাবে না। একটি সহিংসতামুক্ত, ভাঙচুরমুক্ত, হরতালমুক্ত, সমাবেশমুক্ত নতুন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখছেন; তাতে তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। একই অনুষ্ঠানে বাসা থেকে তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপি সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। স্টুডিওতে যতক্ষণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলছিলেন, তিনি তা বলছিলেন নির্বিঘ্নেই। কিন্তু যখনই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সামিয়া রহমান ব্যারিস্টার খোকনের বক্তব্য জানতে চাইছিলেন, তখনই ঘটছিল বিপত্তি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারিস্টার খোকনের বক্তব্য শেষ করার সুযোগ না দিয়েই তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিটি বক্তব্যের প্রতিবাদ করছিলেন। তাতে আমরা শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু আবছা আবছা কথা শুনেছি, ব্যারিস্টার খোকনের কোনো কথাই শুনতে পাইনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সঞ্চালককে বলছিলেন, “আমিই এই অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক, আমি কোনো বাচালের সঙ্গে কথা বলবো না।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। একই অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দলের নেতা ও মোহাম্মদ নাসিমকে ‘মুখর পুরুষ’হিসেবে অভিহিত করেছেন। মজা করে তিনি এও বলেছেন, মুখরা রমণী বশীকরণের মন্ত্র জানা থাকলেও মুখর পুরুষ বশ করার মন্ত্র তার জানা নেই। হা-হা-হা। তারা দু’জনেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। দুজনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- একজন বর্তমান, অন্যজন সাবেক। তাদের মধ্যে এমন রসিকতার সম্পর্ক থাকতেই পারে। তবে অনেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মুখরা রমণী বশীকরণের মন্ত্রটি জানতে চাইতে পারেন। যিনি মুখরা রমণী বশ করতে পারেন, বিরোধী দলকে দমন করা তার কাছে নস্যি। দায়িত্ব পালনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা পুলিশের জন্য অনেক কিছু করেন। তারপরও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা সবসময় পুলিশের প্রিয় টার্গেট। কেন জানি না। আশা করি ভবিষ্যতে পুলিশ ভাইয়েরা এ ধরনের নিমকহারামী করবেন না। তবে মহিউদ্দিন খান আলমগীর সুশীল ঘরানার মন্ত্রী। পুলিশ হয়তো ভবিষ্যতে টার্গেট বানানোর জন্য তাকে রাজপথে খুঁজেই পাবেন না।
আমি আগেই বলেছি, দোষ আসলে ব্যক্তির নয়, দোষ মন্ত্রণালয়ের, দোষ চেয়ারের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারিরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার চেয়ারটি সোনা-রুপার পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে পারেন, তাতে যদি দোষ কিছুটা কমে। আমার আবেদন, প্রায় অসীম ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি চাইলে যাকে ইচ্ছা তাকে রাষ্ট্রপতি বানাতে পারেন, স্পিকার বানাতে পারেন, মন্ত্রী বানাতে পারেন, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বানাতে পারেন, মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিতে পারেন। তবে শেষ বেলার মন্ত্রী গুণী পুরুষ ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে বাদ দেয়ার দাবি করছি না আমি। বরং তাকে পরিকল্পনা, টেলিযোগাযোগ, পাট, ডাক- এ ধরনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তার সুশীলত্ব আর শুদ্ধ বাংলার বক্তৃতার সাথে আর যাই হোক আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মতো কঠিন বিষয়টি যায় না। তিনি যেভাবে একের পর এক নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হচ্ছেন, এখনই না বদলালে এই সরকারকে ডোবাতে আর কাউকে লাগবে না।
পুনশ্চ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্ঞানের এত প্রশংসায় অন্য মন্ত্রীদের মন খারাপ হতে পারে। পরে খুঁজে দেখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একা নন, মন্ত্রিসভায় জ্ঞানী লোক অনেক আছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তো বলেই দিয়েছেন দেশের প্রথম সারির ১৬ সম্পাদক না বুঝে বিবৃতি দিয়েছেন। তার মানে সম্পাদকরা কিছু বোঝেন না, উনি সব বোঝেন। অর্থমন্ত্রীর জ্ঞানের ফিরিস্তি দিতে গেলে আলাদা মহাকাব্য লিখতে হবে। এরশাদেরও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই মন্ত্রী শেয়ার বাজার ছাড়া দুনিয়ার আর সবকিছু বোঝেন। এরশাদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন বলে কেউ আবার ওনাকে দল বদলের অভিযোগে অভিযুক্ত করবেন না। তিনি এখন মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী, যে মহাজোটে এরশাদও আছেন। তার সর্বশেষ বাণী হলো, “গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানের বেতন দিলে নাকি তাদের বেতন তার (অর্থমন্ত্রী) সমান হয়ে যাবে।” কী সাংঘাতিক সুখবর। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন, যাদের সৌজন্যে অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর রেকর্ডভাঙা বাজেট দিচ্ছেন, তাদের বেতন যদি একটু বাড়ে ওনার এত লাগে কেন? চাকরি ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উৎস নেই। কিন্তু সারা জীবন দেশে-বিদেশে বড় বড় চাকরি করা আবুল মাল আব্দুল মুহিত আমার চেয়ে কম আয়কর দেন। তার আয় কি তাহলে এতই কম, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছাকাছি, যে চাইলেই তারা অর্থমন্ত্রীকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে হিংসা না শঙ্কা কোনটা বেশি বোঝা গেল না। তবে আমি মনে করি আমাদের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে জ্ঞানী মন্ত্রীর নাম পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ পাট যখন কৃষকের গলার ফাঁস, তখন তিনি চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা না থাকা নিয়ে। আর তিনি বাসায় শুয়ে চিন্তা করেননি। উদ্যমী মন্ত্রী রীতিমতো চিঠি লিখে তার সে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। সবসময় যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য ভাববে কেন, আমাদের মন্ত্রীরাও তাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা না থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভাবতে ভালো লাগছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা ভাই ভাই মনে হচ্ছে। তবে বাঙালির যা স্বভাব, কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে অন্যরা পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে রাখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় পাটমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন, তা না করে, তিনি বলে দিলেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি এর দায়িত্ব নিচ্ছেন না। এটা খুব অন্যায়। তবে এ প্রসঙ্গে আমার কেন জানি, আদার বেপারির জাহাজের খবর- এই বাগধারাটি মনে পড়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীদের জ্ঞানের এই বহর দেখে আমার একটি ধারণা বদলে গেছে। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের ছবি দেখলে আমার এখন সিপিডির গোলটেবিল বৈঠকের কথা মনে পড়ে যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিভাবে যে এত জ্ঞানী-গুণীদের সামলান। আল্লাহ মালুম।

প্রভাষ আমিন
probhash2000@gmail.com

কমরেড নিবেদিতা নাগ আমাদের প্রেরণা : শাহ্‌রিয়ার কবির




তিন বছর একরকম শয্যাশায়ী থাকার পর পরপারে পা‍ড়ি দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নিবেদিতাদি, বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব কমরেড নিবেদিতা নাগ। ৫ই মে ২০১৩ তারিখে কলকাতার হাসপাতাল মৃত্যুবরণের সময় তাঁর বয়স ছিল ৯৫।
পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেও আমরা চেয়েছিলাম তিনি শতায়ু হবেন। অনেক দিন কলকাতা যাই না। ভেবেছিলাম ৪ঠা আগস্ট তাঁর ৯৫তম জন্মবার্ষিকীর দিন পার্ক সার্কাস-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাবো। তাঁকে নিয়ে যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম তার কাজও এবার শেষ করবো। আমাদের সে সুযোগ না দিয়ে তিনি চলে গেলেন। তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের পরিকল্পনা প্রচারবিমুখ নিবেদিতাদি সমর্থন না করলেও মেনে নিয়েছিলেন তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দাবির কারণে।

অবিভক্ত বাংলার সাম্যবাদী আন্দোলনে কমরেড নিবেদিতা নাগ এক বিশিষ্ট নাম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোগামী নেতা কমরেড নেপাল নাগের স্ত্রী হিসেবে নন, নিজের যোগ্যতায় সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে অপরিসীম শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে তিনি শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজের বিশিষ্ট স্থানটি নির্দিষ্ট করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি বিস্তৃত মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কলকাতায়। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসেবে তিনি যুদ্ধরত কমরেডদের এবং নির্যাতনের ‍‌শিকার দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

কমরেড নিবেদিতা নাগ জন্মেছেন ৪ঠা আগস্ট ১৯১৮তারিখে, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় মাতামহ আনন্দ রায়ের বাড়িতে। মা অমিয়াবালা চৌধুরী ছিলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী। বাবা অধ্যাপক সঞ্জীবকুমার চৌধুরী শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি, বেড়ে উঠেছেন এক বিপ্লবী পরিবেশে। পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল অভিযানের মহানায়ক সূর্য সেনের সহপাঠী। তাঁর কাকারা সবাই ছিলেন সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য। চট্টগ্রামের সুচিয়া গ্রামে তাঁর ‍‌পৈত্রিক বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের গোপন কর্মকাণ্ডের অন্যতম ঘাঁটি। স্কুলে থাকতেই নিবেদিতা বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলতেন, গোপন চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতেন, এমনকি বাড়িতে বিপ্লবীদের অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন।

স্কুল ছাত্রী নিবেদিতা‍‌কে বিপজ্জনক মনে হওয়াতে দু বছরের জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়, যে কারণে নারায়ণগঞ্জে মায়ের পৈত্রিক বাড়িতে থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৩৪ সালে। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। সংগঠনের ডাকে ধর্মঘট সংঘটিত করতে গিয়ে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ’৩৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে বি এ পাস করেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অসুস্থতার জন্য এক বছর পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন, যিনি পরবর্তী জীবনে তাঁকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন।

কমরেড নিবেদিতা নাগ ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ’৪৩ সালে ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন নারী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সহযোদ্ধা ‍হিসেবে পেয়েছেন আশালতা সেন, লীলা রায়, মণিকুন্তলা সেন ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য নেত্রীদের। পার্টির কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন য‌ুঁইফুল রায়, অণিমা সিংহ, কনক মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা গুপ্ত, অমিয়া দত্ত, হেলেনা বসু, নীলিমা বসু, শান্তি দত্ত, ডলি বসু, পঙ্কজ আচার্য প্রমুখ কমিউনিস্ট নেত্রীদের।

১৯৪৩-এর ১৭ই মে কমরেড নেপাল নাগকে তিনি বিয়ে করেন পরিবারের অমতে। ততদিনে তিনি স্থির করেছেন বাকি জীবন পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। নেপাল নাগ তখন ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা হিসেবে পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। স্বামী স্ত্রী দু’জন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার কারণে চরম আর্থিক অনটনে তাঁদের দিন‍ কেটেছে। শৈশবে ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খেতে দিতে পারেননি কিন্তু পার্টির কাজ এবং কমরেডদের অফুরন্ত ভালোবাসা তাঁদের সেই অভাব পূরণ করেছে। তিনি সব সময় বলেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির কমিউন জীবন ও কমরেডদের সান্নিধ্য তাঁর অভিজ্ঞতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

১৯৪৮ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের সদস্য হিসেবে এর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। গোপন কমিউনে হাতে লিখে স্টেনসিল কেটে সাইক্লোস্টাইলে ইশ‍্‌‌‍‌তেহার ছেপে বিলি করেছেন, রাতের অন্ধকারে দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়েছেন; অমানুষিক পরিশ্রমে শরীর বার বার বিদ্রোহ করেছে কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।

’৪৯ সালে জেলে গিয়েছেন, পার্টির নির্দেশে বন্দী নির্যাতনের প্রতিবাদে কারাগারের ভেতর অনশন করতে গিয়ে নিজেও নির্যাতনের ‍‌শিকার হয়েছেন, তারপরও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।

স্বামী-স্ত্রী দু’জন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হলে সন্তানদের ঠিকমতো লালন-পালন সম্ভব হয় না। নেপাল-নিবেদিতা দম্পতির দুই পুত্র কন্যা সুজয় ও সুমিতাকে আ‍‌শৈশব অপুষ্টির শিকার হয়ে নানা ধরনের অসুখে ভুগতে হয়েছে। ’৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে মস্কো যাওয়ার আগে তাদের ঠিকমতো চিকিৎসাও হয়নি। ফলে অন্য সব সর্বক্ষণের পার্টি দম্পতিদের ক্ষেত্রে যা হয়েছে — নিবেদিতা নাগ কমিউন জীবন থে‍‌কে বেরিয়ে এসে স্কুলে চাকরি নিয়েছেন। এর আগে অবশ্য নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং এই কলেজের প্রতিষ্ঠা অধ্যক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তিনি যখন দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশে আসেন তখন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁর জন্য বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কলকাতার বাড়ি ছিল কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি।

তাঁর পার্টি জীবন ও কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকা ও কলকাতায়। দীর্ঘ পার্টি জীবনে বহু বিপ্লবী নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। তারপরও ২০০০ সালে তাঁকে নিজেদের কাছে পেয়ে ঢাকার সুহৃদ, স্নেহভাজন ও শুভানুধ্যায়ীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন।

বড়দা শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের সময় একই কমিউনে ছিলেন তাঁরা। বড়দার প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসার ভাগ থেকে আমিও বঞ্চিত হইনি। ২০০২-এর জানুয়ারিতে প্রথমবার কারাগার থেকে মুক্তির পর কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে আমার প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ ব্যক্ত করেছিলেন — ‘শাহরিয়ার আমার সন্তানের মতো। ওর গ্রেপ্তারের সংবাদে আমি অসুস্থ হয়ে শয্যা গ্রহণ করেছিলাম। আজ ওর মুক্তির সংবাদ শুনে আমি সুস্থ হয়ে গেছি।’ তাঁর কলকাতার বাড়িটি আমার মতো অনেকের কাছে তীর্থ সমান। তাঁর সান্নিধ্য আজও যে কারো জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও প্রেরণাদায়ক।

তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা কনক মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে পার্টির পত্রিকায় নিবেদিতা নাগ নিয়মিত লিখছেন চল্লিশের দশক থেকে। পার্টির পত্রিকার বাইরেও লিখেছেন তিনি, প্রথম জীবনে বেতারের জন্য কথিকা লিখে ঢাকার রক্ষণশীলদের সমূহ উষ্মার কারণ হয়েছিলেন। ’৩৯ সালে ঢাকা বেতারে তাঁর প্রথম ইংরেজি কথিকা প্রচারের পর সেই সময়ের দৈনিক ‘চাবুক’ প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছিল ‘অবশেষে ভদ্রঘরের মেয়েরাও রেডিওতে নামিয়াছেন!’

তিনি যখন ২০০০ সালে ঢাকা এসেছিলেন নেদারল্যান্ডের একটি আর্কাইভের জন্য তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। এরই ভিত্তিতে আমাদের চাপে পড়ে তিনি লিখেছিলেন ‘ঢাকা থেকে কলকাতা: নয় দশকের স্মৃতি’।
তিনি কায়িকভাবে না থাকলেও তাঁর কর্মে এবং আমাদের স্মৃতিতে সব সময় সজীব থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রগতির আন্দোলনের অফুরন্ত প্রেরণা হয়ে।

Monday, May 27, 2013

• প্রসঙ্গ প্রভাষ আমিনের লেখা: “প্রিয় সম্পাদকবৃন্দ, আপনাদের দাবি প্রত্যাহার করুন” : পুলক ঘটক


আমি প্রভাষ আমিনের একজন অনুরাগী পাঠক। তিনি আমাকে বলেছেন তার লেখার উপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে। দুর্বল হাতে একজন দক্ষ লেখকের কর্মের সমালোচনায় ভয় পাই। কিন্তু নিজের ভাললাগা মন্দলাগার উপর জোর খাটেনা। সেটা স্বাভাবিক স্রোতে বেরিয়ে আসে। প্রভাষদা’র এই লেখাটা আমার ভাল লাগেনি। তার লেখার যে ধার তা এখানে তা অনুপস্থিত। ১৬ সম্পাদকের বন্দনাগীতি দীর্ঘ করে তিনি নিজের মূল উপস্থাপনাকে লঘু করে ফেলেছেন। প্রভাষ আমিনের বক্তব্যের মুল অংশের সাথে আমার ভিন্নমত নেই।
বিবৃতিদাতাদের সম্পর্কে প্রভাষ আমিন বলেছেন, “তালিকার সবাই আমার পরম শ্রদ্ধেয়।” তার এই বক্তব্য সত্য বলে আমার মনে হয় না। এদের কয়েকজনকে তিনি শ্রদ্ধা করেন, আমিও করি। তবে আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি আছেন যাদের তিনি মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। এই ১৬ জনের মধ্যে (প্রভাষদার জ্ঞাতসারেই) এমন লোক আছেন যার পেশাগত উত্থানের পেছনে পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সততার চেয়ে অন্য কিছু বিষয় মুখ্য ছিল - যা শ্রদ্ধা করার মত নয়। এই ১৬ জনের মধ্যে এমন সম্পাদকও আছেন যিনি অপ-সাম্প্রদায়িকতায় মাহমুদুর রহমানের অগ্রপথিক। প্রভাষ আমিন ভাল করেই জানেন যে এই ১৬ জনের কয়েকজন মাহমুদুর রহমানের মতই তাদের নিজ নিজ পত্রিকাকে সাম্প্রদায়িকতা ও গণহত্যার উস্কানিযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রভাষ আমিন আরও একশ’ বার লিখলেও একথা তার বন্ধুরা বিশ্বাস করবে না যে তিনি ওদের শ্রদ্ধা করেন। এ কথা লিখে তিনি বস্তুনিষ্ঠতা বিসর্জন দিয়ে, তার ব্যক্তি নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন।
সবাইকে অতি শ্রদ্ধা করতে গিয়ে তিনি “সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী” রাজনীতিকের মত Populist Policy’র আশ্রয় নিয়েছেন। কেবল ভাবিকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ময়লামাখা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে “বাবা সোনা,” “মা সোনা” বলার মানে হয় না। মানে হয়তো হয়; কিন্তু সেটা ভিন্ন রকমের।
একথায় কেউ যেন মনে করবেন না যে, আমি প্রভাষদার লেখার উদ্দেশ্য মহত্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছি। তিনি কল্যানকামী এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ইদানিং মিডিয়ায় ”নিরপেক্ষবাদের” জয়জয়কার- যে নিরপেক্ষবাদ আসলে “এ পক্ষেও থাকব, ওপক্ষেও থাকব; এদিক থেকেও নেব ও দিক থেকেও খাব” এধরণের মতবাদ বৈ ভিন্ন কিছু নয় । বর্তমান সময়ে এই “নিরপেক্ষ” ভাবমূর্তি অনেকেরই আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি। এই মিথ্যা নিরপেক্ষবাদি অতিকথনের কবলে একজন ভালমানুষও পড়তে পারে। আমার ধারণা এধরণের একটা পরিবেশে প্রভাষ আমিন তার ব্যক্তিগত নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে বসেছেন।
১৬ সম্পাদকের বিবৃতিতে প্রভাষ আমিন ভবিষ্যত সম্পাদক ফোরামের যে ভ্রুণ দেখতে পেয়েছেন তা ইতোমধ্যে বৃক্ষ্য ছানারুপে আর্বিভূত হয়েছে। আরও কিছু মুখ যুক্ত করে সম্পাদকদের একটা পরিষদ হয়েছে। এই সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহমুদুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ইনকিলাবের বাহাউদ্দিন হতে পারতেন। তারা এখনও হননি, ভবিষ্যতে হয়তো হবেন।
প্রভাষ আমিন লিখেছেন, “আমাদের সব প্রাপ্তি যখন দলবাজির চোরাবালিতে হারিয়ে যায়, তখন এই ফোরামটি হতে পারে দলনিরপেক্ষতার বাতিঘর, আমাদের সবার আশ্রয়, জাতির সত্যিকারের বিবেক। গণমাধ্যমের প্রধানদের এই ফোরামটির সঙ্গে নিত্যদিন জনগণের সরাসরি যোগাযোগ। তাই আমাদের সরকারি দল, বিরোধী দল এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন। কী করলে জনগণের ভালো হবে, জনগণ খুশী হবে, তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন।”
তার এই বক্তব্যের প্রায় প্রতিটি শব্দের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। কেবল দ্বিমত নয় তীব্র আপত্তি জ্ঞাপন করছি। প্রতিটি লাইন খন্ডন করার জন্য কথা বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবেনা। কারণ এগুলো স্বতঃখন্ডিত। বাঙ্গালীর জাতীয় মানষ এই ১৬ জনের হাতে গড়ে উঠেনি। এদের কয়েকজন কিছু সময় ভাল অবদান রেখেছেন - বাকিরা সময়ে, অসময়ে, সবসময়ে মাহমুদুরীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ঐক্যবদ্ধ বিবৃতিটি ১৬ জনকেই উগ্রসাম্প্রদায়িক মাহমুদুরের পক্ষে নিয়ে গেছে -প্রতিক্রিয়াশীল অংশটিকে প্রগতির পক্ষে একটি কথাও উচ্চারণ করাতে পারেনি। তাদের যৌথ বিবৃতিতে মাহমুদুরের গ্রেফতারের বিরোধিতা আছে- মাহমুদুরের অপকর্মের সমালোচনায় একটি শব্দও নেই। স্বেক্ষেত্রে তারা ঐকমত্য পোষণ করতে পারেন নি।
“সরকারি দল, বিরোধী দল এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন।” হায়, হায়....... এরা থাকতে সরকারি দল বা বিরোধী দলের আর দরকার কি ? সংবাদপত্র নীতিমালায় অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের অবশ্যই সুপারিস থাকবে। তবে কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
“বিভিন্ন নামে সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদকদের একাধিক সংগঠন আছে। তারা সংবাদপত্রের ছুটি, নিউজপ্রিন্টের দাম, বিজ্ঞাপনের মূল্য, ওয়েজবোর্ড- এই ধরনের নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই শুধু মাথা ঘামান,” প্রভাষদার এই বক্তব্য দিবালোকের মতই উজ্জ্বল। “কিন্তু এই বিবৃতিতে যে ফোরামের ভ্রুণ লুকিয়ে আছে তা আরো বৃহত্তর বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। নির্ধারক হতে পারে সাংবাদিকতার মানদণ্ডের,” এই বক্তব্য আমাকে আশ্বান্বিত করার পরিবর্তে শংকিত করেছে।
কোনো ভাল কাজে ৫জন গুরুত্বহীন মানুষের একত্রিত হওয়াটাও আনন্দদায়ক। খারাপ কাজে কিংবা একজন র্দুবৃত্তের মুক্তির দাবিতে ১৬ বিশিষ্টজনের একমত হতে পারাটা মোটেই আনন্দদায়ক নয়। এটা আমাদের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য একটা অশনি সংকেত।
"এই তালিকায় ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, সংগ্রাম, দিনকাল-এর মত মূলধারার বাকি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকদের যুক্ত করে নিলেই এটি হতে পারে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফোরাম।" -তার এই বক্তব্যের সাথে আমি মোটামুটি একমত। আদর্শহীন এধরণের ঐক্য দেশের জন্য ভাল কিছু দেয়ার পরিবর্তে ব্যাক্তি বা গোষি্ঠ স্বার্থে বড় ভুমিকা রাখতে পারে। নানা বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও একসাথে মদ খাওয়ার ব্যাপারে আমরা জোট পাকাতেই পারি।
এই সম্পাদকবৃন্দ হয় সংবাদপত্রের মালিক, নয়তো মালিকের প্রতিভূ। মালিক শ্রেণীর যে কোনও ধরনের ঐক্য কায়েমি স্বার্থকে সংরক্ষণ করে কিংবা নতুন কায়েমি স্বার্থের জন্ম দেয়। জনকল্যানের বিরুদ্ধেই থাকে তার অবস্থান। মালিক-সম্পাদকদের এধরণের অনেকগুলো সংগঠন এবং তাদের এযাবতকালের কর্মকান্ডের কিছুটা উল্লেখ তিনি নিজেই করেছেন। তাদের শ্রেণী স্বার্থের বাইরে তারা কিছুই করবেনন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। প্রভাষদা হয়ত বলবেন “সম্পাদকদের উপর শ্রদ্ধা হারানো পাপ।” আমিও আপাতত: আশাবাদি হয়ে সম্পাদকদের এই ফোরামকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আমার মনে হয় মালিকদের ঐক্যের চেয়ে বেশী জরুরী সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন। এদের একজন সম্পাদকও কি এক্ষেত্রে সহায়ক হবেন? সাংবাদিকদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন? আমি আশাবাদি হতে চাই।
আমার দেশ বন্ধের মধ্যদিয়ে আমাদের অনেক সহকর্মির রুট-রুজি’র উপর আঘাত এসেছে। সংবাদপত্রটি আবার প্রকাশিত হোক সেটা মনে প্রাণে চাই। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে। সংবাদপত্র কর্মসংস্থানের প্রতিষ্ঠান হলেও বিড়ি তৈরির কারখানার মত নয়। আমার দেশ বের হলেও সেটা যেন ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির উস্কানি যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মাহমুদুর রহমানের মুক্তি নয়, সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানোর অন্যতম হোতা এই ভয়ঙ্কর গণদুষমনের হাত থেকে মানুষের জান-মাল রক্ষার প্রয়োজনে আমি তাকে কারারুদ্ধ রেখে বিচার করার পক্ষে। দু’ চারটে খুনের কোনও আসামী জামিনে ছাড়া পেলে মিডিয়াগুলো সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠে। বর্তমানে শতাধিক খুণ, অগ্নিসংযোগ, মন্দির-বিগ্রহ ভাঙ্গার মূল মদদ দাতার মুক্তির দাবিতে সেই মিডিয়ার কর্ণধাররা একত্রিত হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক, “অসাম্প্রদায়িক” নির্বিশেষে ১৬-সম্পাদক একাট্টা। দাবি, মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে।
এই সম্পাদকবৃন্দ আমাদের (কামলা সাংবাদিকদের) দ্বন্ড-মুন্ডের বিধাতা। এদের সবার রোষানলে পরলে আর চাকরি করার জায়গা থাকেনা। তবুও বলব, মাহমুদুর রহমানের বিচারের দাবি উঠেছিল গণ-জাগরণ মঞ্চ থেকে। সেই দাবির সঙ্গে ছিলাম, আছি থাকব।

১৫ সম্পাদকের মাহমুদুর রহমানের পক্ষ নেয়া :স্বদেশ রায়


দেশের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাহবাগকে কেন্দ্র করে একত্র হবার পর বাংলাদেশের সমগ্র সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। দৃশ্যত মনে হতে পারে এটা বিস্ময়কর, কিন্তু বাস্তবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের পর থেকে আপোসকামী এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটে যে নষ্ট সমাজ গড়ে উঠেছে এ দেশে, শাহবাগই প্রথম তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখন এ সমাজে অনেক কিছু ঘটবে। যার কোন কিছুতেই বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই। বরং শুধু এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কঠিন নিক্তিতে ফেলে পরিমাপ করতে হবে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়।
দেশের স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ এবং নতুন প্রজন্মের ৫ থেকে ৬ কোটি তরুণ-তরুণী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে শাহবাগকে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে সত্য, কিন্তু শাহবাগ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই জাগ্রত রূপ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে অনেককে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যাদের নেতা শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন, এখন আর আমার মারা গেলেও কোন দুঃখ নেই। কারণ দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হবে। তারপরও বলতে পারি, অনেক আওয়ামী লীগার ও আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তারা ঠিক শতভাগ পছন্দ করতে পারছেন না শাহবাগের জাগরণকে। কারণ তাদের কাছে মনে হচ্ছে, এটা তারা এতদিন যে পথে চলছিল ওই পথে একটি বাধা হবে। সত্যি এটা বাধা হবে। কারণ শাহবাগের তরুণদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশে। অর্থাৎ এ দেশের মানুষের জন্য অর্থনীতি গড়তে হবে। গত প্রায় ৩৯ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী যে লাখ লাখ কোটি টাকার মৌলবাদী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে ওই অর্থনীতি কোন মতেই টিকে থাকতে দেয়া হবে না। সেটাকে বন্ধ করে দিতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের একটি অংশের জন্য খুবই সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ওই অংশটি মৌলবাদীদের সঙ্গে মিলিতভাবে ব্যবসাবাণিজ্য করে। তাই এখানে তাদের স্বার্থে হাত পড়েছে। এছাড়া আরেকটি গ্রুপ আছে আওয়ামী লীগে যারা দীর্ঘদিন মৌলবাদী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আপোস করে করে এখন আর ঠিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারছে না। তারা মনে করছে দেশের মানুষও তাদের মতো গত ৩৯ বছরে পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই তারা একটি দোদুল্যমানতায় আছে। এবং এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করছে তথাকথিত সুশীল সমাজ মিডিয়ার মাধ্যমে। কারণ এই সব আওয়ামী লীগ নেতার উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই যে, এই তথাকথিত সুশীল সমাজ পাকিস্তান আমলে আইউব-মোনায়েমের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং বাংলাদেশে জিয়া ও এরশাদের মাধ্যমে সৃষ্ট। তাই এরা শেষ বিচারে ধর্ম ব্যবসায়ী ও মৌলবাদীদের পক্ষে থাকবে।
আওয়ামী লীগের বিপরীতে বাংলাদেশে বিএনপি। বিএনপি এখন তাদের সকল পর্দা ফেলে দিয়ে প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। কারণ তরুণ প্রজন্মের মিরপুর ঘোষণার পরে বিএনপির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে গেছে, যদি না এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির অস্তিত্ব তারা টিকিয়ে রাখতে পারে। কারণ তরুণ প্রজন্ম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে অনান্য স্বাধীন দেশের মতো বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। বিএনপি জিয়াউর রহমান নামক মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্দা পরে থাকে ঠিকই, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করে। তাই বর্তমানে যে অবস্থানে বিএনপি আছে ওই অবস্থানে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এ দেশে জয়লাভ করলে বিএনপির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। ঠিক তেমনিভাবে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে মৌলবাদী অর্থনীতিসহ তথাকথিত সুশীল সমাজের। যারা আউয়ুব, জিয়া ও এরশাদ দ্বারা গঠিত।
মুক্তিযুদ্ধের এই জাগ্রত চেতনাকে রুখে দিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হবার পর থেকেই সব থেকে ন্যক্কারজনক ভূমিকা নেয় পত্র-পত্রিকার মধ্যে আমার দেশ। এবং তার তথাকথিত বা বাইচান্স সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এই পত্রিকাটি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য কী কী করেছে তা গত কয়েক মাস দেশের মানুষ দেখেছে। তারপরে দেখেছে কিভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণ সমাজকে নাস্তিক ও নষ্ট প্রজন্ম হিসেবে উপস্থিত করার জন্য, মিথ্যে বিষয় উপস্থাপন করেছে। এবং কিভাবে একের পর এক মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে দেশের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কীভাবে কাজ করেছে। পৃথিবীর কোথাও কোন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এভাবে প্রচারণা চালানো যায় না। কোন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সেটাকে গ্রহণ করে না। কোন গণতন্ত্র সে সুযোগ দেয় না। কিন্তু সেই কাজ মাহমুদুর রহমান করেছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে দাঙ্গা বাধিয়েছে। হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির ভাঙচুর করানোতে উস্কানি দিয়েছে। যে কারণে দেশের মানুষের স্বার্থে, স্বাধীনতার চেতনার স্বার্থে ও সমাজের শান্তির স্বার্থে তাকে গ্রেফতার করার সঙ্গত দাবি ওঠে নানান মহল থেকে। কিন্তু সরকার প্রথমে তাতে কান দেয়নি। যার ফলে মাহমুদুর রহমান দেশের ও দেশের মানুষের অনেক ক্ষতি করতে সমর্থ হন। যাহোক, সরকার শেষ অবধি তাকে গ্রেফতার করছে।
এখন মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর সম্পাদকের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বার্থের নামে তাকে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়েছে দেশের ১৫ বিশিষ্ট সম্পাদক। যার ভিতর ইনকিলাব ও নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক আছে। এ দুটি পত্রিকাও মূলত আমার দেশ যে কাজ করে সেই কাজই করে চলেছে। আমার দেশ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যা করেছে তারপরও এদেশে তার প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনেও এমন পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে এই পত্রিকা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই দুটি বিষয় নিয়ে মনে হয় ১৫ সম্পাদকের এই বিবৃতির পর এ সমাজে নতুন করে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ এখানে সকলেই যে মাহমুদুর রহমানের কীর্তিকে জায়েজ করার জন্য এ কাজ করেছেন এটা সাংবাদিক হিসেবে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্ট। যেমন যে পত্রিকা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাই ও অদিতি ফাল্গুনিকে দিয়ে নোংরা গল্প লিখিয়েছে। যাদের জনমত জরিপে হেফাজতীদের উত্থান, জামায়াতের তা-ব, বিরোধী দলের কর্মীদের দ্বারা হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দির ভাঙ্গা এমনকি হিন্দুদের অস্ত্রের মুখে মিছিলে নিয়ে তাদের দিয়ে নারায়ে তকবির/আল্লাহু আকবার বলানোÑএ সব নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। এসব পত্রিকার কর্ণধাররা মাহমুদুর রহমানকে সমর্থন করবেন। তাছাড়া যারা একাত্তরে রাজাকার ছিলেন পাকিস্তান বেতারে ‘প্লেন ট্রুথ’ লিখতেন। বঙ্গবন্ধু এসে তাকে প্রেস সেক্রেটারি করার পর শুধু প্লেন ট্রুথ লেখা নয়, তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য আর কি কি করেছিলেন সেগুলো দৈনিক গণকণ্ঠে ছাপা হলে বঙ্গবন্ধু তাকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তারা আজ যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বা সম্পাদক হন না কেন, তারা কিন্তু শেষ বিচারে মাহমুদুর রহমানের পক্ষেই থাকবেন। কারণ যে রাজাকার তিনি যুদ্ধাপরাধী রক্ষাকারীর পক্ষেই থাকবেন। তাই তাদের নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমরা কতদূর যাব সেটা এখনই মনে হয় ভেবে দেখার দরকার। যেমন আজ অনেক গণতান্ত্রিক দেশে অনেক নির্বাহী কাজে বিচার বিভাগ বার বার হস্তক্ষেপ করাতে সে সব দেশ নতুন করে ভাবছে কোর্টের হাত কতদূর যাবে? ঠিক তেমনি আমাদেরও ভেবে দেখার সময় এসেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমরা কতদূর যেতে পারি। ভিন্ন মত আর দেশদ্রোহিতা বা দেশের ভিতর অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য প্রচারণা চালানো কি একই বিষয়? ভিন্ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য মিথ্যা প্রচারণা চালানো কি একই বিষয়?
মাহমুদুর রহমান যেটা করেছেন সেটা কিন্তু তিনি দেশের কোন একটি মতের সঙ্গে ভিন্ন মতপ্রকাশ করেননি। তিনি মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সমাজে অস্থিরতা ও হত্যা-খুনের উস্কানি দিয়েছেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা ও সে বিচারে বাধা দেবার জন্য যা যা করা দরকার সব করেছেন। তিনি দেশকে লাদেনের অনুসারীদের দিয়ে তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। তাদেরকে তার পত্রিকার মাধ্যমে ও সশরীরে উপস্থিত হয়ে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমাদের অনেক সম্মানিত সম্পাদক কি সেখানে যাবেন? যে মত দেশের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী রক্ষার পক্ষে সর্বোপরি সেটা মতামত নয় সেটা দেশের অস্তিত্বের ও সমাজের শান্তির বিরুদ্ধে প্রচারণা।
আমার দেশের এই মিথ্যা প্রচারণার মুখোশ সত্যিকার অর্থে যদি কোন মিডিয়া উন্মোচন করে থাকে সেটা এ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টার। ফটোশপের মাধ্যমে মিথ্যা ছবি প্রকাশ করে আমার দেশ কি করেছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার মতো রিপোর্ট করেছে ডেইলি স্টার। শুধু যে এটা উন্মোচন করেছে তা নয়, এই সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক অন্ধকার সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন ২০০১ সালে যখন হিন্দুদের ওপর হাবিয়া দোযখ নেমে আসে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের মাধ্যমে। সে সময়ে বিদেশীরা কিন্তু প্রথমে বিশ্বাস করছিল না। কারণ ওই ঘটনাগুলো কেবল বাংলা পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠ ছাপছিল। সেদিন প্রথম আলো ধর্ষিতা পূর্ণিমার প্রেস কনফারেন্সের খবরও ছাপেনি। ওই দুঃসময়ে ডেইলি স্টার তাদের শুত্রুবারের ম্যাগাজিনটাই করে ওই এথনিক ক্লিনজিংয়ের ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিয়ে। এর পরে অবশ্য বিদেশীরা বিশ্বাস করে ঘটনা। তারা সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় যায় এবং ঘটনার ভয়াবহতা দেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এরপর কিছুটা রক্ষা পায় বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ। শুধু তাই নয়, গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে ডেইলি স্টারের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। পাশাপাশি সাঈদীর রায়ের পর হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার ও হত্যা নির্যাতন নেমে আসে সেখানে ডেইলি স্টার ছিল অগ্রণী ভূমিকায় সত্য তুলে ধরতে। তাই এর পর ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম যুদ্ধাপরাধী রক্ষাকারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন ওই বিবৃতিতে সই করে এটা সাংবাদিক হিসেবে বলতে পারি না। তাছাড়া মাহফুজ আনামের ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। কারণ তার পিতা আবুল মনসুর আহমদ। যিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে এই কৃষি বাংলাকে শিল্প বাংলার পথে তুলে আনার অন্যতম রূপকার। তাই মাহফুজ আনাম এক জেনারেশন নন। তার অতীত আছে। বর্তমান আছে। তার মেয়ের দিকে তাকালে বলা যায় তার পরবর্তী প্রজন্মও আছে।
তাই স্বাভাবিকভাবে এই বিবৃতিটি ছাপার পর প্রশ্ন উঠেছে, অনেকেই সই করতে পারেন। যারা ’৭১-এ রাজাকার ছিলেন তারা সই করতে পারেন। যারা সুবিধাবাদী তারা সই করতে পারেন এ বিবৃতিতে। কিন্তু মাহফুজ আনাম বা তার মতো যারাÑতারা নিশ্চয়ই কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি চিন্তা করে করেছেন।
আমরা যারা সাংবাদিক, যে কোন অবস্থায়, যে কোন মূল্যে আমরা মতপ্রকাশের পক্ষে থাকব। কিন্তু আমাদের কি ভেবে দেখতে হবে না, আমাদের মতপ্রকাশ যেন আমার দেশ সৃষ্টির মাতৃজনন কোষ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস না করে। আমার মতপ্রকাশ যেন কোন মতেই দেশ ধ্বংসকারী মৌলবাদীদের হাতকে শক্তিশালী না করে। আমেরিকা এখনও জেফারসনের কথা মানে, এখনও সেখানে প্রথম পছন্দ স্বাধীন সংবাদপত্র। তারপরও আমেরিকা কি লাদেনের কোন অনুচরকে সম্পাদক করে সেখানে লাদেনের মত প্রকাশ করার জন্য কোন পত্রিকা ছাপার অনুমতি দেবে? আর যদি লাদেনের কোন অনুচর সে কাজ করে তাহলে তাকে কি গ্রেফতার করবে না? আর তার গ্রেফতারের পর কি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বস্টন গ্লোব, নিউইয়র্ক পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, শিকাগো টাইমসের সম্পাদকরা লাদেনের ওই অনুচরের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেবেন? মাহমুদুর রহমান যে গোলাম আযম বা জামায়াতের একজন অনুচর ও তাদের জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য কাজ করছেন সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হবার পর। এরপর কি ভেবে দেখব না মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমরা কতদূর যাব? গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর এখন বাংলাদেশের সব রাজকার-আলবদর ও তাদের সন্তানরা এক হবে। কিন্তু তাই বলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে তাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে? এমনকি যারা এই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশ, এই দেশের অন্যতম জাতীয় নেতাদের সন্তান তারাও গোলাম আযমের অনুচরের পক্ষে যাবেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে কোন একটি মরীচিকাকে সামনে রেখে?
দেশে ৩৯ বছর পর তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি নিয়েছে। এ সময়ে সবারই কি একটু সচেতন হওয়া উচিত নয়? কারণ স্বাধীনতাবিরোধীরা ৩৯ বছরে অনেক অর্থবিত্ত, অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এর মতো তরুণরা শুধু প্রাণকে পুঁজি করে নেমেছে। এ সময়ে বড় অবস্থানে বসে যদি ভুল হয়, লোভের কাছে পরাজয় হয়, সেটা হয়তো তরুণ প্রজন্মের বিজয়কে ঠেকাতে পারবে না কিন্তু কিছুটা হলেও কাঁটার ক্ষত বাড়াবে। রক্ত ঝরাতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে স্বাধীনতাবিরোধীদের। সূত্র:দৈনিক জনকন্ঠ

ভিন্নমত: বিনীত নিবেদন অভিভাবকদের প্রতি:মনজুরুল আহসান বুলবুল:

গত ১৮ই মে দেয়া ১৫ জন সম্পাদকের বিবৃতি ‘সম্ভবত কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করেছে বলে বিবৃতিদাতা সম্পাদকরাও মনে করছেন। সে কারণেই কৈফিয়ত না দিলেও বিবৃতি দেয়ার কারণটি আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হচ্ছে।
বলে রাখি; সম্মানিত সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি। যারা মনে করেন মাহমুদুর রহমান সম্পাদক নন তাদের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করি। দেশের প্রচলিত আইন যেমন সম্পাদক হওয়ার কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়নি, আবার কাউকে বারিতও করেনি। মাহমুদুর রহমানকে কেউ ‘‘হঠাৎ সম্পাদক” বলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু তিনি একজন সম্পাদক বটে। সরকার, সচেতন সম্পাদকমণ্ডলী বা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কেউ এখনও এমন একটি বিধি-আইন-নীতিতে একমত হতে পারেননি যে একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হওয়ার মাপকাঠি কি। প্রভাব থাকলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া যায়, মালিক তো হওয়া যায়ই, প্রিন্টার্স লাইনে নাম লিখে সম্পাদকও হওয়া যায়। বলতে খচ্‌ খচ্‌ করলেও সত্যি হচ্ছে, ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত একটি সংবাদপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তারা সকলেই সম্পাদক। তবে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ১৫ জন সম্পাদক নতুন কোন বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন কিনা তা তারাই বলতে পারবেন কিন্তু এই পঞ্চদশের অনেকেই যে তাদের অনেক পুরনো বন্ধুদের বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সে তো নানাভাবেই দৃশ্যমান।
কেন এ বিভ্রান্তি? সাধারণের প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো এরকম:
১. কেন ১৫ জন সম্পাদক, কেন আরও বেশি নয়? যে ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মতোই আরও যে সম্পাদকদের আমরা সম্মান করি তারা কেন এই বিবৃতিতে সই করলেন না? মানেটি হচ্ছে: কিছু সম্পাদক আছেন যারা এই ১৫ জনের মতকে ধারণ করেন না; কাজেই তারা এই পঞ্চদশের সঙ্গে নেই।
২. বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মালিক-সম্পাদকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ- বিএসপি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে; নিউজ পেপার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াব। এই সংগঠন আমন্ত্রণমূলক, সম্মানিত কয়েকজন মালিক সম্পাদক এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন; তারা যাদের আমন্ত্রণ জানাবেন তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন। সাধারণভাবে সকল মালিক বা সম্পাদক তাদের সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে; এই বিবৃতিতে নোয়াব এবং অ-নোয়াব একাকার হয়েছে। অর্থাৎ নোয়াব যে সম্পাদকদের তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেন না; এই বিবৃতিতে তারাই হয়েছেন নোয়াবের সদস্যদের সহযোদ্ধা। অন্যদিকে নোয়াব-এর তিনজন সদস্য এই বিবৃতিতে সই করেন নি। মানুষ বিভ্রান্ত হবে না কেন?
৩. বিবৃতিদাতাদের অন্তত একজন সম্পাদক বিবৃতিদাতা অপর দু’জন সম্পাদক সম্পর্কে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেছেন, রায়ও তার পক্ষেই গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী দুই সম্পাদক এই বিবৃতিতে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী সম্পাদকের সঙ্গে। মামলার ফরিয়াদি ও প্রতিপক্ষ একই কাতারে। বিস্ময় এখানেও।
৪. বিবৃতিদাতা সম্পাদকদের দু’জন এমন একটি পত্রিকার সাবেক ও বর্তমান সম্পাদক যে পত্রিকা থেকে ভারতীয় অর্থপুষ্ট সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই তালিকায় বিবৃতিদাতা একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ভারতীয়দের কাছ থেকে কত টাকা নেন তা-ও উল্লেখ ছিল। নৈতিকতাহীন ও চরম দায়িত্বহীন সেই সংবাদপত্রের সঙ্গে অপূর্ব সম্মিলনী দেখা গেল দায়িত্বশীল ও উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার সেই সম্পাদককেও। হোঁচট এখানেও।
নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও বিবৃতিদাতাদের এই একতা একদিকে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। বিবৃতিদাতা একজন সম্মানিত সম্পাদক লিখছেন; মাহমুদুর রহমানকে অনেকগুলো অভিযোগে মাসখানেক ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। গূঢ়ার্থ হচ্ছে: আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযোগ থাকলেও কাউকে আটকে রাখা যাবে না। যদি এই যুক্তিতেই এখন বিজিএমইএ রানা প্লাজার আটক গার্মেন্ট মালিক বা প্রকৌশলীদের কোন সমিতি সেই ভবনের নকশা অনুমোদনকারী বর্তমানে আটক প্রকৌশলীদের মুক্তি দাবি করেন? কারণ এখনও তো তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিবৃতিদাতাদের এই যুক্তি মেনে নিলে তো গোলাম আযম, নিজামী সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়। আদালতে ‘গিলটি’ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো তারা ‘ইনোসেন্ট’ !!
এ বিবৃতি নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সম্মানিত সম্পাদকদের প্রজ্ঞার প্রতি যে প্রশ্ন তুলেছেন তারও প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিদাতা সম্পাদকগণ গত কয়েক দশক ধরে দেশ, উপমহাদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। কাজেই না জেনে-বুঝে তারা এই বিবৃতিতে সই করেছেন এমন সহজ সমীকরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন এই বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষেও যেমন এই সম্পাদকদের দৃঢ় যুক্তি রয়েছে, যদি তারা বিবৃতি না দিতেন তাহলেও তারা সফলভাবেই সেখানেও যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন। যে সম্পাদকরা বিবৃতিতে সই করেননি তারাও নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে সকল বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যথাসময়ে প্রেস নোট কেন দেয়া হচ্ছে না? স্বয়ং মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবৃতিতে পরিণত হয়। সরকারি প্রেস নোট বিষয় ভিত্তিক সরকারি ব্যাখ্যা তুলে ধরে; হতে পারে সরকারি প্রেস নোট ছলনাময়ীর প্রেমের মতোই মিথ্যা কিন্তু সরকারের অবস্থান স্পষ্টকরণের জন্য এই অন রেকর্ড সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রথাটি পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত। পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে পারে।
তবে এত বৈপরীত্য, নানা বৈচিত্র্যের একতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যেও এই সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতিতে আমরা আশান্বিত হতেই পারি। কারণ সব কিছু ভুলে অভিভাবকের মতো তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে অধিকার তা রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এই রকম অভিভাবক দেশের গণমাধ্যম জগতের দীর্ঘদিনের চাহিদা। একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে সে প্রশ্ন উঠেছে অনেক দিন আগেই। অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হন। কিন্তু এই ঐক্য তো শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের মতোই কঠিন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা যদি হন এক ইউনিয়নের নেতা আর শেখ হাসিনার টিকিট নিয়ে তার দলের এমপি প্রার্থী যদি আরেক ইউনিয়নের নেতা হন তা’হলে এই দুই ইউনিয়নের মধ্যে নেহায়েৎ অর্থনৈতিক দাবি ছাড়া আর কোথাও ঐক্যের জায়গা তো দেখি না। তার ওপর আবার এক শীর্ষ নেতা এখন লিখিতভাবে নসিহত করছেন যে, নারী সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের রিপোর্টারদের যেন স্পর্শকাতর বিষয়ে এসাইনমেন্ট দেয়া না হয়। তারপরেও রুটি-রুজির সংগ্রামে সাংবাদিক ইউনিয়নই তো আমাদের ভরসা। এর পাশাপাশি সম্মানিত সম্পাদকগণ যদি পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এক হয়ে এগিয়ে আসেন তা তো আশারই কথা। কিন্তু হতাশা সব সম্পাদকও এখানেও এক হতে পারলেন না।
সে কারণেই আশাজাগানিয়া এই উদ্যোগ নিয়ে একটু হতাশা আছেই। সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতি প্রসঙ্গে একজন সম্পাদকের ব্যাখ্যায় [দৈনিক সমকাল, ২৪শে মে ২০১৩] যে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ১৫ জনের বিবৃতিতে একটি প্যারাগ্রাফেও যদি সেই বর্ণনাটি তুলে ধরা হতো তা’হলেও বিবৃতিদাতারা এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেন না একথা বলা যায়। জানি না দৈনিক সমকাল সম্পাদকের অবস্থানটি সকলেই সমর্থন করেন কিনা। বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটটির ন্যূনতম বর্ণনা না থাকায় বিবৃতিটি দাতাগোষ্ঠী এবং দূর থেকে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠীর বিবৃতির মতোই মনে হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সময়কার তরুণ শিক্ষার্থী পরে জগৎখ্যাত ইতিহাসবিদ, অক্সফোর্ডের শিক্ষক, বাংলাদেশেরই ‘বরিশালের পোলা’ তপন রায়চৌধুরী। তাঁর ‘বাঙালনামা’য় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)
কোন মন্তব্য নেই, শুধু একটিই জিজ্ঞাসা। বিবৃতিদাতা সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত দৃশ্যপটের সঙ্গে সামপ্রতিক বাংলাদেশের কোন মিল খুঁজে পান কিনা? কোন চরিত্রের কোন খোঁজ পান কিনা? জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর বলে এই পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে বরেণ্য সম্পাদকদের মতামত এবং অবস্থান কি সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারেন।
এই বাস্তবচিত্র মাথায় রেখেই তবুও আশাবাদী হতে চাই এ কারণে যে, সাংবাদিকতা পেশার অভিভাবকরা যখন একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তখন বোধ করি এই শিল্প ও পেশার জন্য কিছু একটা হবে। প্রত্যাশা; মালিক ও পেশাদার সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সম্পাদকগণ দেশের গণমাধ্যমের সঙ্কটের এই সময় দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখবেন। তাদের কাছে এই প্রত্যাশা এ কারণেই যে, একজন সম্পাদককে সাংবাদিকরা জানেন পেশায় তাদের অভিভাবক হিসেবেই। নষ্ট সন্তান বিপদগ্রস্ত হলে তার মুক্তি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে ভ্রষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও অভিভাবকদের। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক এক জন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে- সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং তার পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? একটু পেছনে দেখুন... বাংলাদেশে যে সব গণমাধ্যম বিপদগ্রস্ত হয়েছে তা হয়েছে শুধু মালিকদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সাংবাদিকের পেশাগত কোন কারণে বাংলাদেশে কোন গণমাধ্যম বন্ধ হয়নি। সব জেনে শুনে, আইন ভাঙবেন মালিকরা আর বিপদগ্রস্ত হবেন পেশাজীবী সাংবাদিক কর্মচারীরা- এ যেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কোন গণমাধ্যম, সম্পাদক বা সাংবাদিক আক্রান্ত হলে সম্পাদক বা সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমন বাস্তবতা পাওয়া গেছে।
দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা আর নৈতিকতার মাপকাঠি পৃথিবী জুড়েই আজ একটি দৃশ্যমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে কারা সাংবাদিক, কারা নন- সে প্রশ্ন নিয়ে। বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সনাতনী গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কোথায় এসে মিলবে (স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দৃশ্যত ব্যাপক বিসতৃত, বিবৃতিদাতা বা মধ্যরাতের টকশো কাঁপানো অনেক সম্পাদকের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক যোগাযোগ কর্মীর অনুসারীদের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি ও কার্যকর)।
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির অতিব্যবহার এই পেশার মানবিকতাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সংবাদের তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতা কত সত্যকে হত্যা করছে, সমাজে সাংবাদিকতার অতি প্রভাবের ক্ষমতা কোন কোন গণমাধ্যমকে কিভাবে দানবে পরিণত করছে, সমপাদকদের অতিমাত্রায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চাপ রিপোর্টারকে বেশি বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে কিনা এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোড়িত এখনকার গণমাধ্যমের শিক্ষা ও গবেষণার জগৎ। গণমাধ্যমের এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে গণমাধ্যমকেই এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন অভিভাবক সম্পাদকরাই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে অনেক অভিভাবককে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। এ কারণে কিছুকাল আগে একজন স্বনামখ্যাত সম্পাদক তার বক্তব্যে দাবি জানিয়েছিলেন সম্পাদকদেরই প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেবে কে? তবুও শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের প্রতিই আস্থা রাখতে হবে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি আমাদের সম্পাদকদের বিভক্তির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ- দেশের গণমাধ্যমের চেহারায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সকল সম্পাদকের একসঙ্গে এগিয়ে আসা। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এবং ইউনিয়নের কতিপয় শীর্ষ নেতার অতিমাত্রার রাজনৈতিক চেহারা যত হতাশাই ছড়াক ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেবে রুটি-রুজি আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পেশাদার সম্পাদকরা দেবেন পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের নেতৃত্ব। এই যৌথ উদ্যোগ দিয়েই অনেক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে।
সর্বশেষ খবর: সম্মানিত সম্পাদকগণ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খুবই আশার কথা, এই সংগঠন নিশ্চয়ই সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখবে। কোন সম্পাদকের অপেশাদারিত্বের কারণে কারও জীবন ও সম্মান বিপন্ন হলে সেদিকটাও এখন দেখতে হবে এই পরিষদকে (অপেশাদারী সম্পাদকের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে তরুণরা বিপন্ন জীবন যাপন করছেন তারা নিশ্চয়ই কথা বলার একটি জায়গা পেলেন)। এই সংগঠন যাতে কোন অপেশাদার ও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি অনুসরণ করেন না এমন কোন সম্পাদকের আশ্রয়স্থল না হয়। তবে শেষতক মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক আর পেশাদার সম্পাদকের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। নবগঠিত সম্পাদক পরিষদের অনেক নেতাই ওয়েজবোর্ডে মালিক হিসেবেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আবারও বলি: বিবৃতি দিয়ে ১৫ সম্পাদক কতটা অর্জন করেছেন তার মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই যে হোঁচট খেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বিবৃতিদাতা অনেক সম্পাদকই যেহেতু অভিভাবকতুল্য- সে জন্যই প্রত্যাশা করি তারা যেন হঠাৎ করে আমাদের কাছে অচেনা না হয়ে যান। অভিভাবকরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিবারের নিষ্ঠাবান সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন, সে জন্যই এই রচনা। আশা করি, এই রচনায় তারা বিরূপ হবেন না। এই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক; bulbulahsan@gmail.com
সূত্র: দৈনিক মানবজমিন

Sunday, May 26, 2013

সম্পাদককে সম্পাদক না দেখিলে কে দেখিবে: মুনতাসীর মামুন



বাংলাদেশের ১৫ জন যশস্বী সম্পাদক একটি বিবৃতি দিয়েছেন সপ্তাহখানেক আগে। এই বিবৃতি নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নয়, তবে মধ্যবিত্ত যাঁরা রাজনীতি চর্চা করেন বা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের মধ্যে খানিকটা প্রতিক্রিয়া তো হয়েছে বটেই। এর প্রধান কারণ, ওই ১৫ জন যেসব সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মালিক তাদের প্রচারসংখ্যা গরিষ্ঠ। একত্রে তাঁরা ছাপা মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং যেহেতু সংবাদপত্র এখন স্বাধীন তাঁরা ইচ্ছে করলে বিদ্যমান সরকারের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারেন। তাঁরা যে শক্তিশালী এটি আবার সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তাঁরা একত্রিত হয়েছেন এবং সিভিল সমাজকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন, কোন রাজনীতিবিদ, সুশীল বা সিভিল সমাজের কেউ, কোন সাংবাদিক যেন তাঁদের দিকে আঙ্গুল উঁচানোর স্পর্ধা না দেখান। চারটি পত্রিকার সম্পাদক/মালিক তাঁদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। এই চারটি পত্রিকা কোন না কোন সময় গরিষ্ঠ পত্রিকা ছিল। সেগুলো হলো ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, আমাদের সময় ও ভোরের কাগজ। বুদ্ধিজীবী সমাজও আতঙ্কিত। কেননা ১৫ জনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে খুব কম বুদ্ধিজীবীই আগ্রহ দেখিয়েছেন। সরকার সমর্থিত বর্তমান ও প্রাক্তন উপাচার্যদের কয়েকজন, বয়োজ্যেষ্ঠ অত্যন্ত খ্যাত, অনেকে বলেছেন, কাজটি ১৫ জন অন্যায় করেছেন বটে কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে লড়াই করার ঝামেলায় পড়তে চাই না। তাঁরা যে শক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছেন এবং সবাইকে পেশীশক্তি দেখিয়ে হুমকির ইঙ্গিত করেছেন তার উদাহরণ তাঁরা যার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন তিনিও এ দেশে পরিচিত একজন পেশীজীবী হিসেবে।
একটি প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করেছেন বিভিন্ন আলোচনায় যে, হঠাৎ ১৫ জন ঐক্যবদ্ধ হলেন কেন? কারণ এদের একেক জনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বয়েস একেক রকম। এদের মধ্যে পাকিস্তান সমর্থক আছেন, হেজাবীদের [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] সমর্থকও আছেন, মাহমুদুর রহমানের মুখোশ উন্মোচন করেছেন এমন সম্পাদক যেমন আছেন বামঘেঁষা সেক্যুলার এমনকি আওয়ামী লীগার হিসেবে পরিচিত সম্পাদকও আছেন। এঁদের অধিকাংশ আমাদের অনেকের, আমারও পরিচিত, বন্ধু। আমি অন্তত দীর্ঘদিন এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে বলতে পারি, দু-একজন ছাড়া এঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সমালোচক ও অপছন্দের। সুতরাং কোন উদ্দেশ্য ছাড়া তাঁরা একত্রিত হয়েছেন তা কেউই বিশ্বাস করছে না। আমরা, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মতলববাজ, মাত্রায় কম-বেশি। আমাকেও এ দলে ফেললে একেবারে ক্রুদ্ধ হতে পারব না। আমরা দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী মতলবে ঠাসা মাথা নিয়ে ঘোরাফেরা করি বা জেগে থাকি। সুতরাং আমাদের অনেকের প্রশ্নÑ মতলবটা কী?
১৫ জন প্রতিবাদী সম্পাদককে নিয়ে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে স্বদেশ রায়ের লেখাটি অনেকেরই ভাল লেগেছে যুক্তির কারণে। তিনি সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে রাজি নন, বিশেষ করে মাহফুজ আনামকে। তিনি লিখেছেনÑ
‘এখানে সকলেই যে মাহমুদুর রহমানের কীর্তিকে জায়েজ করার জন্য এ কাজ করেছেন এটা সাংবাদিক হিসেবে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্ট। যেমন যে পত্রিকা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাই ও অদিতি ফাল্গুনীকে দিয়ে নোংরা গল্প লিখিয়েছে। যাদের জনমত জরিপে হেফাজতীদের উত্থান, জামায়াতের তা-ব, বিরোধী দলের কর্মীদের দ্বারা হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙ্গা এমনকি হিন্দুদের অস্ত্রের মুখে মিছিলে নিয়ে তাদের দিয়ে নারায়ে তকবির/আল্লাহু আকবার বলানোÑ এসব নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। এসব পত্রিকার কর্ণধাররা মাহমুদুর রহমানকে সমর্থন করবেন। তাছাড়া যাঁরা একাত্তরে রাজাকার ছিলেন পাকিস্তান বেতারে ‘প্লেন ট্রুথ’ লিখতেন। বঙ্গবন্ধু এসে তাঁকে প্রেস সেক্রেটারি করার পর শুধু প্লেন ট্রুথ লেখা নয়, তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য আর কী কী করেছিলেন সেগুলো দৈনিক গণকণ্ঠে ছাপা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁরা আজ যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বা সম্পাদক হন না কেন, তাঁরা কিন্তু শেষ বিচারে মাহমুদুর রহমানের পক্ষেই থাকবেন।’ [জনকণ্ঠ, ২৩.৫.১৩] আবার দেখুন, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম দিন থেকেই অযথা প্রথম আলোর মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণে মত্ত ছিলেন। তাঁরা যে সঠিক কাজটি করেননি সেটি প্রেস কাউন্সিলের রায়ে বলা হয়েছে এবং বিষয়টি কোন পত্রিকার জন্য শুভও নয়। কিন্তু ১৫ জনে প্রথম আলোর মতিউর রহমান যেমন আছেন, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলনও আছেন। তবে অধিকাংশ বিস্মিত ও দুঃখিত হয়েছেন বিশেষ করে সমকালের গোলাম সারওয়ার ও সংবাদের মুনীরুজ্জামানের স্বাক্ষর দেখে। এঁরা এবং এঁদের মালিকরা আওয়ামী লীগের বিপক্ষের মানুষ নন। বাকি ১৩ জন কম-বেশি আওয়ামী লীগের বিপক্ষের। বিবৃতিটা এক অর্থে বর্তমান জোট সরকারের বিরুদ্ধেও।
এ পরিপ্রেক্ষিতে দুটো বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অনেকের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বক্তৃতা, আলাপচারিতা, লেখায় কোন না কোনভাবে পুঁজি ও শ্রেণীর কথা তুলতেন। আমরা অনেকে তাঁকে নিয়ে এ জন্য ঠাট্টা করতাম। আজ তো এসব শব্দ আলাপচারিতা থেকে উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু এই ১৫ জনের বিবৃতি দেখে, স্যারের কথা মনে হলো। পুঁজি, শ্রেণী, গোষ্ঠীস্বার্থ একেবারে উধাও হয়ে যায়নি, সমাজতন্ত্র না থাকলেও। কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোই এসবের বিরুদ্ধে ছিল। একজন ব্যক্তির সঙ্গে একজন ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, কলহ থাকতে পারে, সাপে নেউলে সম্পর্কও থাকতে পারে কিন্তু দিনান্তে শ্রেণী, পুঁজির, গোষ্ঠীস্বার্থের প্রশ্নে তাঁরা এক থাকবে। কেন, সে প্রসঙ্গে আসছি পরে।
পত্রিকার মালিকানা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর প্রধান মালিক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও সংবাদের মালিকরা পুরনো পুঁজিপতি। ওইসব পুঁজিপতি আবার বর্তমান আগ্রাসী পুঁজিপতিদের মতো নন। আমার জানা ভুলও হতে পারে কিন্তু আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, বাকি পত্রিকার মালিকদের উত্থান বিএনপি আমলে। তাঁরা বিকশিত হয়ে ওঠেন এরশাদ আমলে। এঁদের একটি অংশও ঋণখেলাপী। তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী, মাঝে মাঝে জনচাপে আওয়ামী লীগ হন। তাঁদের অনেকে প্রগতিশীলতার কথা বলেন, কিন্তু প্রগতিশীলতা যখন বিপন্ন হয়, তখন প্রগতির পক্ষে থাকেন না। স্বদেশ রায়ের লেখায় তাঁর ইঙ্গিত আছে। ২০০০ সালে তাঁরা তুমুল আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় মেতে ওঠেন এবং তৃপ্তি বোধ করেন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়ায়। ঠিক নির্বাচনের আগে তাঁদের আওয়ামীবিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে, এভাবে তাঁরা পূর্বের স্মৃতি অবলেপন করেন। তাঁরা কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপারে পারতপক্ষে তীব্র মন্তব্য করেন না। করলেও পরে এমন কোন মন্তব্য করেন যাতে ফলটা বিএনপির পক্ষে যায়। বিদ্যুতায়িত মাধ্যমও একই কাজ করছে। একটি উদাহরণ দিই। বিশ্বজিৎ হত্যার পর টানা এক সপ্তাহ, তারপর প্রতি সপ্তাহে একদিন-দু’দিন করে সেই করুণ দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি যখন যাত্রীভর্তি বাস-সিএনজি পোড়াচ্ছে, পুলিশকে পিটিয়ে জামায়াতীরা মেরে ফেলছে বা কোরান পোড়াচ্ছে হেজাবীরা, সেগুলো কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে দেখানো হয়নি। এর কারণ তাঁরা কখনও ব্যাখ্যা করবেন না। সৎ সাংবাদিকতার নামে এগুলো করা হচ্ছে। বিভিন্ন টক শোতে মুক্তিযুদ্ধ সঠিক হয়েছিল কি না, যুদ্ধাপরাধ বিচার ঠিক হচ্ছে কি না এসব নিয়ে প্রতিদিন বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এবং এসব প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন তাঁদের বেশি সময় দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, হত্যা, গুম নিয়ে বিতর্ক হলে সঞ্চালক বলে ওঠেন, পুরনো কথাবার্তা তুলে লাভ নেই। বর্তমান বুঝতে হলে পুরনো সময় ভিত্তি হিসেবে থাকবে নাÑ এ মন্তব্য বালখিল্যতা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্নেহধন্য অনেককে চাহিবামাত্র টিভি লাইসেন্স, এফএম রেডিও লাইসেন্স দিয়েছেন। তাঁরা সেগুলো বিএনপি-জামায়াতীদের কাছে অর্পণ করেছেন। যাঁরা করেননি তাঁরাও অন্য চ্যানেলগুলোর মালিকের মতো ব্যবহার করছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য অনেক সম্পাদক/মালিক গত চার বছরে অনেক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বিনিময়ে তাঁদের ছুরির ফলার সম্মুখীন হচ্ছেন। দোষ তাঁরই। সুপাত্রে তিনি নিয়ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কন্যার একটিই তফাতÑ বঙ্গবন্ধু নিজের চারদিকে রাখতেন যোগ্যদের।
তবে খালি পুঁজি বা শ্রেণী বা গোষ্ঠীর কথাই নয়। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে ডানপন্থাই গরিষ্ঠ। মধ্য বা মধ্য বাম সংখ্যালঘিষ্ঠ। বামের কোন স্থানই নেই। আওয়ামী লীগকে মধ্য বা ১৪ দলীয় জোটকে মধ্য বাম বললেও তাদের মধ্য ডানের ঝোঁক প্রবল। আমরা যতই প্রগতিশীলতার ভাব করি না কেন, আমাদের অধিকাংশের পরানের গহীন গভীরে হেজাবী বা হেফাজতী বিড়ালটি ঘাপটি মেরে বসে আসে। যখন অন্তিমে পক্ষ বেছে নেয়ার কথা ওঠে, তখন থলের বিড়ালটি বেরিয়ে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে ১৫ সম্পাদক যা করেছেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রথমে দেখা যাক ১৫ সম্পাদক কী বলতে চেয়েছেন।
বিবৃতিতে আমার দেশের ছাপাখানায় তালা দিয়ে পত্রিকা ছাপা বন্ধ করা, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর নির্যাতনের অভিযোগ, বিকল্প ব্যবস্থায় ছাপতে না দিয়ে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের এবং বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন সম্পাদকরা। তাঁরা মনে করেন, সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর আশঙ্কাজনক হুমকি।
বিবৃতিতে সম্পাদকরা বলেন, মাহমুদুর রহমানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার করে আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয়া এবং কোন কারণ না দেখিয়ে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অনেক সাংবাদিককে বেকারত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা কোন নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে অনুকূল নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, একজন সম্পাদককে গ্রেফতার, পত্রিকার প্রকাশনা ব্যাহত ও দুটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। একই সঙ্গে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত ও বিবেচিত হচ্ছে।
বিবৃতিতে সই করেন ইন্ডিপেনডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম [প্রথম আলো, ১৯.৫.১৩]
সঠিক তথ্যের স্বার্থে বিবৃতি ও বিবৃতিদাতাদের নামগুলো উদ্ধৃত করলাম। এখানে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার বাইরেও একটি কারণ আছে যা উল্লেখ করব। তবে তার একটি পটভূমি দেয়া প্রয়োজন।
বিবৃতিটি যেদিন ছাপা হয় সেদিন খুলনায় এক সভা শেষ করে আমি, শাহরিয়ার কবির, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও ডা. কামরুল ফিরছিলাম গাড়ি করে। পথে কয়েকটি পত্রিকা কিনলাম। সংবাদটি চারজনই পড়লাম। এবং চারজনের কাছেই তা অবিশ্বাস্য মনে হলো। না, ক্ষোভের থেকেও প্রথম বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনাটা বড় হয়ে দেখা দিল। বাংলাদেশ কি তাহলে এমন দেশে পরিণত হলো যেখানে বিশ্বাসযোগ্য বা শ্রদ্ধেয় কোন ব্যক্তি রইলেন না? আরও বিস্মিত হলাম এ কারণে যে, তাদের একটি অংশ হেজাবীদের ধ্বংসাত্মক কাজের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। মাহফুজ আনামকে ফোন করলেন বাচ্চু এর কারণ জিজ্ঞেস করতে। বাচ্চুর কথার মূল ছিল ‘এট টু ব্রুটাস?’ মাহফুজ আনাম তাঁকে জানিয়েছিলেন দু’টি কারণে বিবৃতি দিয়েছেন, এক. সরকার মাহমুদুরকে আটক করেছে কিন্তু কোন মামলা দেয়নি। দুই. প্রফেশনাল। মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে আমি ক্ষুব্ধভাবেই কথা বললাম। আমরা তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। এবং সবারই মনে হয়েছিল, তিনি কিসের আশ্বাসে এ কাজটি করেছিলেন? মাহফুজ আনামও স্বাক্ষর করতে পারেন, কিন্তু মুনীরুজ্জামান করবেন না। সংবাদ এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ সেটি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মুনীরুজ্জামানও অত্যন্ত শীতল গলায় জানালেন, বিষয়টি প্রফেশনাল। ডা. কামরুল ছাড়া আমরা তিনজন ১৯৬৯-৭০ থেকে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বা আছি। যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের একটা বড় অংশ তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র। প্রফেশনালিজমের কথা বললে তখন এই প্রফেশন নিয়েও কিছু বলতে হয়।
ওঁরা ১৫ জন বলেছেন, ‘সরকারের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর আশঙ্কাজনক হুমকি।’
সরকার দু’টি চ্যানেল ও একটি পত্রিকা ‘বন্ধ’ করে দেয়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের হুমকি? গত সাড়ে চার বছরে যে রকম অবাধ স্বাধীনতা চ্যানেল ও পত্রিকা পেয়েছে তা আগের দু’টি আমলে ছিল? স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি এখন সারাবিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। একজন কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন? রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নটি বড় কি না, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা আছে বলে আমাদের ধারণা, সেখানেও এখন এ প্রশ্নটি উঠেছে। এবং একটি বিষয়ে সবাই মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা করছে যে, উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পাওয়র দাবি রাখে।
১৫ জনের বক্তব্যের তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
১. ‘মিডিয়ার ওপর বর্তমান সরকারের এই পদক্ষেপ সাংবাদিকতা পেশার ওপর অশুভ হস্তক্ষেপ।’
কেন অশুভ হস্তক্ষেপ তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার অশুভ হবে কেন? হাসানুল হক ইনু জানিয়েছেন, তাঁর অফিসে হ্যাকিংয়ের আলামত পাওয়া গেছে। এক পত্রিকায় জানলাম, মাহফুজ আনাম নাকি এরও প্রতিবাদ করেছেন এ বলে যে, সরকারই শুধু জানে তা ঠিক নয়। উল্টো বলা যায়, সম্পাদকরাই বাংলাদেশে একমাত্র বুঝদার লোক এই দাবিও ভয়ঙ্কর। মাহমুদুর রহমান তিনটি মাস যা করেছেন, পৃথিবীতে আর কোন সম্পাদক তা করেছেন কি না সন্দেহ। ব্রিটেনে ফোন হ্যাকিংয়ের জন্য ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নিষিদ্ধ করলে কোন সম্পাদক তার সমর্থনে দাঁড়ায়নি। পত্রিকাটি ১০০ বছরের শুধু পুরনোই নয়, জনপ্রিয়ও বটে।
অন্যদিকটি দেখা যাক। সম্পাদকরা সাংবাদিকতা পেশার ওপর কতটা গুরুত্ব দেন? একটি সংবাদপত্র শুধু সম্পাদকের বা মালিকের মেজাজমর্জির ওপর চলতে পারে না। সাংবাদিকদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে তা চালিত হয়। কিন্তু এখানে সাংবাদিকদের মতামত প্রধান নয়, মালিক/সম্পাদকের মতই পত্রিকার মত। ১৫ জন কি স্বাক্ষর করার আগে তাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছিলেন? করেননি।
এসব বিষয়ে সম্পাদকরা একক সিদ্ধান্ত নেন। ১৫ জন সম্পাদক সম্পাদিত ১৫টি পত্রিকার সাংবাদিকদের একটি অংশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, সম্পাদকরা তাঁদের শ্রমে গড়ে ওঠা পত্রিকা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছেন। অনেকে শুধু চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছেন না। সম্পাদকরা গণতন্ত্র সম্পর্কে যত ছবকই দিন না কেন নিজ নিজ পত্রিকায় কিন্তু সেই গণতন্ত্র অচল। ১৫ জন জানিয়েছেন আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ ও দু’টি চ্যানেল বন্ধ অভিপ্রেত। বহির্বিশ্বে এতে সরকারের ভাবমূর্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেবে। যেন, মাহমুদুর রহমান আর দিগন্ত টেলিভিশন খুব ইতিবাচক ধারণা দিচ্ছিল মিডিয়া সম্পর্কে। এদের কার্যকলাপ বরং মিডিয়া সম্পর্কে দেশেই নয়, বিদেশেও নেতিবাচক ভাবমূর্তির সৃষ্টি করেছে। দেশে ধ্বংসলীলা চালাতে মিডিয়ার এই অংশ যখন প্রত্যক্ষ প্ররোচনা দিচ্ছে তখন ১৫ সম্পাদকের অধিকাংশ এর বিরোধিতা করেছেন বটে কিন্তু কখনও তাকে সতর্ক করেননি। নিন্দা করেননি, তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেননি যা এক ধরনের নীরব উৎসাহ প্রদান।
ওরা ১৫ জন সাধারণ সাংবাদিকদের জন্য যে হাহুতাশ করেছেন তা দেখার মতো। তাদের মতে এই তিনটি মাধ্যম বন্ধ হওয়ার ফলে ‘অনেক পেশাদার সাংবাদিককে বেকারত্বের অভিশাপ’ বরণ করতে হবে যা গণতান্ত্রিক সরকারের বিপক্ষে যাবে। অধিকাংশ পত্রিকা এই গণতান্ত্রিক সরকারের ইতিবাচক প্রতিবেদন খুব কমই ছেপেছে। অধিকাংশ মাধ্যমে কর্মীরা নিয়মিত বেতন পান না। অনেককে চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এই সম্পাদকদের কখনও সেই সংবাদকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে এমন কথা কোন নিন্দুকও বলবে না।
তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, চ্যানেল দু’টি বন্ধ করা হয়নি তাদের কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। তারা কারণ দর্শিয়েছেন এবং তা বিবেচনা করা হবে। আমার দেশ আইনত বন্ধ করা হয়নি। তারা অন্য প্রেস থেকে তা ছাপাতে পারবে। এবং মাহমুদুর রহমানকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এবার আসা যাক মূল কথায় অর্থাৎ পেশাদারিত্ব। প্রত্যেক পেশার ভিত্তি কিছু মূল্যবোধ বা এথিক্স বা ন্যায়বোধ থাকে। আমার পেশা পাঠদান, পরীক্ষা নেয়া ইত্যাদি পেশাদারি কাজ যা না করলে ন্যায়বোধ থাকে না। আইনজীবী, ডাক্তাররাও ন্যায়বোধ অতিক্রম করলে তাদের সে পেশা চালানোর অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়। তেমনি সংবাদপত্র/সম্পাদক/সাংবাদিকদেরও কিছু মূল্যবোধ বা ন্যায়বোধ থাকা উচিত। মাহমুদুর রহমান গত ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন তার সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষের মানুষজনকে নাস্তিক নামে আখ্যা দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপির ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে প্ররোচনা যুগিয়েছেন। সংখ্যালঘু হত্যায় আনন্দিত হয়েছেন। কাবা শরিফ, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী নিয়ে মশকরা করে মিথ্যা ছবি ছাপিয়েছেন; পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি হত্যায় উল্লাস প্রকাশ করে তাদের যেন আরও হেনস্থা করা হয় তার মদদ যুগিয়েছেন। কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনষ্টকরণে আনন্দিত হয়েছেন। এগুলো পেশাদারিত্বের পর্যায়ে পড়ে কিনা বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানানো ওদের ১৫ জনের দায়িত্ব। একজন পেশাদার যখন তার পেশাদারিত্ব থেকে বিচ্যুত হন তখন তিনি পেশাদার থাকেন কিনা সেটি ব্যাখ্যারও দায়িত্ব ঐ ১৫ জনের, যদি তারা আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্রমনা হন। টাকা থাকলে একজন সম্পাদক হতে পারেন কিনা, সেটি সমর্থনযোগ্য কিনা সেটি ব্যাখ্যার দায়িত্বও তাদের। হাইকোর্ট মাহমুদুর রহমানকে বাইচান্স সম্পাদক বলেছে। মাহফুজ আনাম স্বয়ং তার পত্রিকায় মাহমুদুর রহমানের মিথ্যা প্রচার ফাঁস করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছেন, যদ্দুর মনে পড়ে তিনি তাকে ‘সম্পাদক’ স্বীকার করতেও নারাজ ছিলেন। সেক্ষেত্রে তাকে আবার সম্পাদক হিসেবে মর্যাদা দিলেন কেন সেটিও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।
মাহমুদুর রহমানের মতো একই কাজ করেছে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি। তারা মিথ্যা প্রচারণা, ধর্মের অপব্যাখ্যাÑ কি না করেছে। মাহমুদুর রহমানের ‘ আমার দেশ’ সাংবাদিকতার নামে যা করেছে চ্যানেল দু’টিও তা করেছে। মাহমুদুর রহমান থেকে তারা আরো বেশি ক্ষতি করেছে কেননা, বিদ্যুতায়িত মাধ্যমের প্রভাব বেশি। তারা একযোগে বাংলাদেশে এমন এক যুগের সৃষ্টি করতে চেয়েছে যাকে অন্ধকার যুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সংবাদপত্র প্রতিবেদনেই দেখা গেছে মাহমদুর রহমান মোটা অংকের টাকা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।
ঐ ১৫ জন যদি মনে করেন এগুলো পেশাদারি কাজের মধ্যে পড়ে না তাহলে প্রশ্ন আসবে একজন সন্ত্রাসীকে কেন তারা সম্পাদক হিসেবে মেনে নিচ্ছেন?
ফাইল আটকে একজন টাকা নিলে সে সন্ত্রাসী হয় না, বলা হয় ঘুষখোর। একজন পিস্তল উঁচিয়ে টাকা নিলে বলা হয় সন্ত্রাসী। কাজ তো একই, কিন্তু ব্যাখ্যা ভিন্ন এবং এই ব্যাখ্যা তৈরি করেছে আমাদের মতো মধ্যশ্রেণীর মানুষজনই। ফাইল যে আটকায়, যে ধোপদুরস্ত কাপড় পরে, আমাদের মতো চলাফেরা করে; সুতরাং তাকে সন্ত্রাসী বলাটা ঠিক নয়। আর যে পিস্তল উঁচিয়ে টাকা চায় সে মধ্যশ্রেণীর নয়, সব ক্ষেত্রে, ভাষা অন্যরকম, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, তাই সন্ত্রাসী। ছাত্রলীগের কর্মীর হাতে রিভলবার থাকলে সেটি সন্ত্রাসী কর্মকা-। [আমিও তা মনে করি] এবং পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম। কারণ, সে মধ্যবিত্তের নাও হতে পারে। তার চলন-বলন ‘সংস্কৃতি’বান নয়। সুতরাং সে সন্ত্রাসী। সে হয়ত খুন করেছে একজনকে বা খুনে সাহায্য করেছে একজনকে। মাহমুদুর রহমান অর্থ নিয়ে [অভিযোগ করা হয়েছে] তার পত্রিকায় মিথ্যা ও প্ররোচনামূলক খবর ছাপিয়ে কয়েক শ’ মানুষ, নিরাপত্তা কর্মী খুনে মদদ যুগিয়েছেন, দাঙ্গা লাগিয়েছেন, ধর্মপ্রাণদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ঐ ১৫ জন তখন এ রকম দৃঢ় পদক্ষেপ নেননি। পত্রিকা বন্ধের দাবিও তোলেননি। কারণ, মাহমুদুর রহমান প্রকৌশলী; তাদের মতো পোশাক-আশাক পরেন, ক্লাবে যান, গাড়ি হাঁকান আর আছে অঢেল টাকা। সুতরাং তাকে তো সন্ত্রাসী বলা যায় না। মীর কাশেম আলী ১৯৭১ সালে আলবদর হিসেবে অনেক খুন করেছেন। প্রচুর টাকা পাচার করেছেন। এখন তিনি যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু তার তো প্রচুর টাকা। ‘ভদ্দর নোক’দের মতো চলন-বলন; সুতরাং তার মালিকানার দিগন্ত তো সন্ত্রাসী হতে পারে না। বা বিএনপি নেতার মালিকানার ইসলামিক টিভি তো খারাপ কাজ করতে পারে না। মাহমুদুর রহমান, মীর কাশেম বা হেজাবিরা যুদ্ধাপরাধ বিচার নস্যাৎ-এ আগ্রহী এবং এ আগ্রহ তারা গোপন করেনি। ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত চলমান হেজাবিদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই তা। আমাদের অনেকের মতে ঐ ১৫ জনও মতলবীÑ এ মন্তব্য করলে বোধহয় নিন্দা হবে না। আমরা শুনিনি, লাদেনের পক্ষে যাদের সন্ত্রাসী বলি তারা ছাড়া কেউ দাঁড়িয়েছিল বা কোন সংবাদপত্র মানবাধিকার ভেস্তে গেছে বলে তার হত্যাকে অসমর্থন করেছিল।
গোলাম সারোয়ার লিখেছেন, “আমার দেশ প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি ও তার সম্পাদককে গ্রেফতার এবং দুটি টিভি চ্যানেল সাময়িকভাবে বন্ধ করতে যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে তা বিধিসম্মত হয়নি। আমাদের আপত্তির মূল জায়গাটি এখানেই।’ [সমকাল ২৪-৫-১৩]
কেউ যদি সন্ত্রাসী কাজ করে তাকে গ্রেফতার করা উচিত কিনা? যদি না হয় তাহলে সন্ত্রাসী বিকাশ বা সুইডেন আসলামÑ এদের গ্রেফতার করা হয় কেন? পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক টাকা দেয়নি, দেবে বলেছিল। একজনের ডায়েরির পাতায় দু’তিনটি নাম লেখা ছিল। এ কারণে ঘুষ দেয়া হতে পারে বা ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে দুর্নীতি হয়েছেÑ এমন অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সম্পাদকরা সেটি সমর্থন করলেন কেন? যাকে তারা সম্পাদক বলে স্বীকার করতে রাজি নন তাকে আবার সম্পাদক বলে স্বীকার করছেন কেন? সরকার দীর্ঘদিন আমার দেশ-এর প্রকাশনা অব্যাহত রেখে, তাকে দাঙ্গা লাগিয়ে প্রাণহানি সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছে এ কারণে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেননি কেন? শিশুকে আগুন নিয়ে খেলা করতে না দেয়া কি শিশুর স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ? মাহমুদুর রহমান যদি যোগ্য নাই হন এবং সম্পাদকের যা কাজ নয় তা করেন তা হলে তো শিশুকে আগুন নিয়ে খেলা করতে দেয়ার মতোই ব্যাপার। সেটিতে হস্তক্ষেপ করলে ‘অন্যায়’ হবে কেন? ঐ ১৫ জন ‘প্রক্রিয়াগত’ এবং ‘বিধিসম্মত’-এর কারণে ক্ষুব্ধ, রাষ্ট্রের, জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে ক্ষুব্ধ নন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে পার্থক্যটি তারা বিচারে আগ্রহী নন।
মাহমুদুর রহমান যুদ্ধাপরাধী ও হেজাবি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ, তাদের পক্ষে সেটি ঠিক। আসলে বিবৃতিটি সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের পক্ষে গেছে। বরং শফিক যে মন্তব্য করেছেন, বাজারে এখন যা প্রচলিত ১৫ জন সম্পর্কে সেটি খানিকটা গ্রহণযোগ্য।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঠিক এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ডানপন্থায় বিশ্বাসী গণমাধ্যম, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সবাই এককাট্টা হয়ে গিয়েছিল। শফিক যা লিখেছেন তা সঠিক না হলেও রাজনীতিতে আগ্রহী অনেকে শফিকের মন্তব্যেই বিশ্বাস করেনÑ“সম্পাদক মহোদয়গণ ধরে নিয়েছেন, যেভাবেই নির্বাচন হোক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অথবা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে মহাজোট এবার আর ক্ষমতায় ফিরছে না। অতএব জ্যাকটা অন্যদিকে ধরে রাখ, নির্বাচনের পর কাজ দেবে।” (২৫.৫.১৩)
স্বদেশ রায় লিখেছেন ‘১৫ সম্পাদকের মাহমুদুর রহমানের পক্ষ নেয়া’ (জনকণ্ঠ ২৩.৫.১৩)।
যেহেতু তিনি নিজেও একজন সম্পাদক সে জন্য তিনি শিরোনামটি সাদামাটাই রেখেছেন। তিনি জানেন ঐ ১৫ জন এখন কত শক্তি অর্জন করেছেন। তাই বিনীত নিবেদন করে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে?’ [ঐ, ২৩.৫.১৩]
অনেকে আর্থিক যোগাযোগের কথা আলোচনা করছেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ১৫ জনের কয়েকজন সেই ফাঁদে পড়তে পারেন, অধিকাংশ নন। তাঁরা যথেষ্ট বিত্তশালী।
আমাদের এক যশস্বী বন্ধু বলছিলেন, গত শতকের ষাটের দশকেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। আইয়ুব খান রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন ৪০ জন সাংবাদিক-লেখক আইয়ুবের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে আলীবাবা ও ৪০ চোর নামে খ্যাত হয়েছিলেন। ঐ একটি বিবৃতি তাদের দীর্ঘদিনের অর্জনকে বিনষ্ট করেছিল। পরবর্তীকালে, ‘৪০ চোর’কে কেউ মনে রাখেনি। প্রতিবাদকারীদের কথাই ইতিহাসে এসেছে।
এক রাগী তরুণ আমাকে ক্ষোভের সঙ্গে একটি প্রশ্ন করেছিলেন যার উত্তর আমি দিতে পারিনি। প্রশ্নটি ছিল তারা সন্ত্রাসী মাহমুদুর রহমানের পক্ষে, মীর কাশেমের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, সন্ত্রাসী বিকাশের কেন তারা এত সমালোচনা করে?
অন্তিমে বলব, যারা ১৫ জনের বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন আমি তাদের মতো সাহসী নই। এই ১৫ জন নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার জন্য আরও সংঘবদ্ধ হবেন। তখন প্রতিবাদকারীরা আরও বিপদে পড়বেন হয়ত। আমার মনে হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তাদের মনে একটি নকশা আছে। তাঁরা সবকিছু সেই নকশায় ফেলতে চান। এবং আশা করেন সেই মতো সবাই চলবে। তবে, সমাজে রাষ্ট্রে তারাই শুধু দায়হীনভাবে সবকিছু করতে পারবেন, বলতে পারবেন। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচার আমজনতার জন্য আলাদা শব্দ, তাদের জন্য নয়। শুধু বলব, তারা ন্যায়মূলক কাজ করেননি। এখন যেহেতু তারা শক্তিমদমত্ত তাই কেউ তাদের কিছু বলবে না। তাঁরা আরও অনেক কিছু অর্জন করবেন। কিন্তু শ্রদ্ধাভাজন আর হবেন না। সংখ্যালঘুদের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, ১৫ জনের অনেকে বিপদে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজ তারা আমাদের ত্যাগ করলেন মাহমুদুর রহমানের জন্য। বাংলাদেশে আর শ্রদ্ধা করার মতো কেউ থাকলেন না। ১৫ জনের বক্তব্য জনস্বার্থ ও দেশের স্বার্থ বিরোধী। গণতন্ত্রের নামে অন্যায় প্রশ্রয় দেয়া গণতন্ত্র বিরোধী।
আরও নমিতভাবে বলতে পারি, গণতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তাঁরা যা বলছেন, গণতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে আমরা তার বিরোধিতা করছি। তাঁরা মনে করছেন তাঁরা ন্যায়ের পক্ষে। আমরা মনে করছি আমরা ন্যায়ের পক্ষে। তবে, এখন বঙ্কিমচন্দ্রের একটি বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, হিন্দু হিন্দুকে না দেখিলে কে দেখিবে? আমরা বলতে পারি সম্পাদক সম্পাদকদের না দেখিলে কে দেখিবে?৩০ মে ২০১৩
সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ