Monday, May 27, 2013

• প্রসঙ্গ প্রভাষ আমিনের লেখা: “প্রিয় সম্পাদকবৃন্দ, আপনাদের দাবি প্রত্যাহার করুন” : পুলক ঘটক


আমি প্রভাষ আমিনের একজন অনুরাগী পাঠক। তিনি আমাকে বলেছেন তার লেখার উপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে। দুর্বল হাতে একজন দক্ষ লেখকের কর্মের সমালোচনায় ভয় পাই। কিন্তু নিজের ভাললাগা মন্দলাগার উপর জোর খাটেনা। সেটা স্বাভাবিক স্রোতে বেরিয়ে আসে। প্রভাষদা’র এই লেখাটা আমার ভাল লাগেনি। তার লেখার যে ধার তা এখানে তা অনুপস্থিত। ১৬ সম্পাদকের বন্দনাগীতি দীর্ঘ করে তিনি নিজের মূল উপস্থাপনাকে লঘু করে ফেলেছেন। প্রভাষ আমিনের বক্তব্যের মুল অংশের সাথে আমার ভিন্নমত নেই।
বিবৃতিদাতাদের সম্পর্কে প্রভাষ আমিন বলেছেন, “তালিকার সবাই আমার পরম শ্রদ্ধেয়।” তার এই বক্তব্য সত্য বলে আমার মনে হয় না। এদের কয়েকজনকে তিনি শ্রদ্ধা করেন, আমিও করি। তবে আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি আছেন যাদের তিনি মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। এই ১৬ জনের মধ্যে (প্রভাষদার জ্ঞাতসারেই) এমন লোক আছেন যার পেশাগত উত্থানের পেছনে পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সততার চেয়ে অন্য কিছু বিষয় মুখ্য ছিল - যা শ্রদ্ধা করার মত নয়। এই ১৬ জনের মধ্যে এমন সম্পাদকও আছেন যিনি অপ-সাম্প্রদায়িকতায় মাহমুদুর রহমানের অগ্রপথিক। প্রভাষ আমিন ভাল করেই জানেন যে এই ১৬ জনের কয়েকজন মাহমুদুর রহমানের মতই তাদের নিজ নিজ পত্রিকাকে সাম্প্রদায়িকতা ও গণহত্যার উস্কানিযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রভাষ আমিন আরও একশ’ বার লিখলেও একথা তার বন্ধুরা বিশ্বাস করবে না যে তিনি ওদের শ্রদ্ধা করেন। এ কথা লিখে তিনি বস্তুনিষ্ঠতা বিসর্জন দিয়ে, তার ব্যক্তি নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন।
সবাইকে অতি শ্রদ্ধা করতে গিয়ে তিনি “সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী” রাজনীতিকের মত Populist Policy’র আশ্রয় নিয়েছেন। কেবল ভাবিকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ময়লামাখা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে “বাবা সোনা,” “মা সোনা” বলার মানে হয় না। মানে হয়তো হয়; কিন্তু সেটা ভিন্ন রকমের।
একথায় কেউ যেন মনে করবেন না যে, আমি প্রভাষদার লেখার উদ্দেশ্য মহত্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছি। তিনি কল্যানকামী এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ইদানিং মিডিয়ায় ”নিরপেক্ষবাদের” জয়জয়কার- যে নিরপেক্ষবাদ আসলে “এ পক্ষেও থাকব, ওপক্ষেও থাকব; এদিক থেকেও নেব ও দিক থেকেও খাব” এধরণের মতবাদ বৈ ভিন্ন কিছু নয় । বর্তমান সময়ে এই “নিরপেক্ষ” ভাবমূর্তি অনেকেরই আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি। এই মিথ্যা নিরপেক্ষবাদি অতিকথনের কবলে একজন ভালমানুষও পড়তে পারে। আমার ধারণা এধরণের একটা পরিবেশে প্রভাষ আমিন তার ব্যক্তিগত নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে বসেছেন।
১৬ সম্পাদকের বিবৃতিতে প্রভাষ আমিন ভবিষ্যত সম্পাদক ফোরামের যে ভ্রুণ দেখতে পেয়েছেন তা ইতোমধ্যে বৃক্ষ্য ছানারুপে আর্বিভূত হয়েছে। আরও কিছু মুখ যুক্ত করে সম্পাদকদের একটা পরিষদ হয়েছে। এই সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহমুদুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ইনকিলাবের বাহাউদ্দিন হতে পারতেন। তারা এখনও হননি, ভবিষ্যতে হয়তো হবেন।
প্রভাষ আমিন লিখেছেন, “আমাদের সব প্রাপ্তি যখন দলবাজির চোরাবালিতে হারিয়ে যায়, তখন এই ফোরামটি হতে পারে দলনিরপেক্ষতার বাতিঘর, আমাদের সবার আশ্রয়, জাতির সত্যিকারের বিবেক। গণমাধ্যমের প্রধানদের এই ফোরামটির সঙ্গে নিত্যদিন জনগণের সরাসরি যোগাযোগ। তাই আমাদের সরকারি দল, বিরোধী দল এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন। কী করলে জনগণের ভালো হবে, জনগণ খুশী হবে, তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন।”
তার এই বক্তব্যের প্রায় প্রতিটি শব্দের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। কেবল দ্বিমত নয় তীব্র আপত্তি জ্ঞাপন করছি। প্রতিটি লাইন খন্ডন করার জন্য কথা বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবেনা। কারণ এগুলো স্বতঃখন্ডিত। বাঙ্গালীর জাতীয় মানষ এই ১৬ জনের হাতে গড়ে উঠেনি। এদের কয়েকজন কিছু সময় ভাল অবদান রেখেছেন - বাকিরা সময়ে, অসময়ে, সবসময়ে মাহমুদুরীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ঐক্যবদ্ধ বিবৃতিটি ১৬ জনকেই উগ্রসাম্প্রদায়িক মাহমুদুরের পক্ষে নিয়ে গেছে -প্রতিক্রিয়াশীল অংশটিকে প্রগতির পক্ষে একটি কথাও উচ্চারণ করাতে পারেনি। তাদের যৌথ বিবৃতিতে মাহমুদুরের গ্রেফতারের বিরোধিতা আছে- মাহমুদুরের অপকর্মের সমালোচনায় একটি শব্দও নেই। স্বেক্ষেত্রে তারা ঐকমত্য পোষণ করতে পারেন নি।
“সরকারি দল, বিরোধী দল এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন।” হায়, হায়....... এরা থাকতে সরকারি দল বা বিরোধী দলের আর দরকার কি ? সংবাদপত্র নীতিমালায় অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের অবশ্যই সুপারিস থাকবে। তবে কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
“বিভিন্ন নামে সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদকদের একাধিক সংগঠন আছে। তারা সংবাদপত্রের ছুটি, নিউজপ্রিন্টের দাম, বিজ্ঞাপনের মূল্য, ওয়েজবোর্ড- এই ধরনের নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই শুধু মাথা ঘামান,” প্রভাষদার এই বক্তব্য দিবালোকের মতই উজ্জ্বল। “কিন্তু এই বিবৃতিতে যে ফোরামের ভ্রুণ লুকিয়ে আছে তা আরো বৃহত্তর বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। নির্ধারক হতে পারে সাংবাদিকতার মানদণ্ডের,” এই বক্তব্য আমাকে আশ্বান্বিত করার পরিবর্তে শংকিত করেছে।
কোনো ভাল কাজে ৫জন গুরুত্বহীন মানুষের একত্রিত হওয়াটাও আনন্দদায়ক। খারাপ কাজে কিংবা একজন র্দুবৃত্তের মুক্তির দাবিতে ১৬ বিশিষ্টজনের একমত হতে পারাটা মোটেই আনন্দদায়ক নয়। এটা আমাদের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য একটা অশনি সংকেত।
"এই তালিকায় ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, সংগ্রাম, দিনকাল-এর মত মূলধারার বাকি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকদের যুক্ত করে নিলেই এটি হতে পারে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফোরাম।" -তার এই বক্তব্যের সাথে আমি মোটামুটি একমত। আদর্শহীন এধরণের ঐক্য দেশের জন্য ভাল কিছু দেয়ার পরিবর্তে ব্যাক্তি বা গোষি্ঠ স্বার্থে বড় ভুমিকা রাখতে পারে। নানা বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও একসাথে মদ খাওয়ার ব্যাপারে আমরা জোট পাকাতেই পারি।
এই সম্পাদকবৃন্দ হয় সংবাদপত্রের মালিক, নয়তো মালিকের প্রতিভূ। মালিক শ্রেণীর যে কোনও ধরনের ঐক্য কায়েমি স্বার্থকে সংরক্ষণ করে কিংবা নতুন কায়েমি স্বার্থের জন্ম দেয়। জনকল্যানের বিরুদ্ধেই থাকে তার অবস্থান। মালিক-সম্পাদকদের এধরণের অনেকগুলো সংগঠন এবং তাদের এযাবতকালের কর্মকান্ডের কিছুটা উল্লেখ তিনি নিজেই করেছেন। তাদের শ্রেণী স্বার্থের বাইরে তারা কিছুই করবেনন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। প্রভাষদা হয়ত বলবেন “সম্পাদকদের উপর শ্রদ্ধা হারানো পাপ।” আমিও আপাতত: আশাবাদি হয়ে সম্পাদকদের এই ফোরামকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আমার মনে হয় মালিকদের ঐক্যের চেয়ে বেশী জরুরী সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন। এদের একজন সম্পাদকও কি এক্ষেত্রে সহায়ক হবেন? সাংবাদিকদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন? আমি আশাবাদি হতে চাই।
আমার দেশ বন্ধের মধ্যদিয়ে আমাদের অনেক সহকর্মির রুট-রুজি’র উপর আঘাত এসেছে। সংবাদপত্রটি আবার প্রকাশিত হোক সেটা মনে প্রাণে চাই। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে। সংবাদপত্র কর্মসংস্থানের প্রতিষ্ঠান হলেও বিড়ি তৈরির কারখানার মত নয়। আমার দেশ বের হলেও সেটা যেন ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির উস্কানি যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মাহমুদুর রহমানের মুক্তি নয়, সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানোর অন্যতম হোতা এই ভয়ঙ্কর গণদুষমনের হাত থেকে মানুষের জান-মাল রক্ষার প্রয়োজনে আমি তাকে কারারুদ্ধ রেখে বিচার করার পক্ষে। দু’ চারটে খুনের কোনও আসামী জামিনে ছাড়া পেলে মিডিয়াগুলো সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠে। বর্তমানে শতাধিক খুণ, অগ্নিসংযোগ, মন্দির-বিগ্রহ ভাঙ্গার মূল মদদ দাতার মুক্তির দাবিতে সেই মিডিয়ার কর্ণধাররা একত্রিত হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক, “অসাম্প্রদায়িক” নির্বিশেষে ১৬-সম্পাদক একাট্টা। দাবি, মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে।
এই সম্পাদকবৃন্দ আমাদের (কামলা সাংবাদিকদের) দ্বন্ড-মুন্ডের বিধাতা। এদের সবার রোষানলে পরলে আর চাকরি করার জায়গা থাকেনা। তবুও বলব, মাহমুদুর রহমানের বিচারের দাবি উঠেছিল গণ-জাগরণ মঞ্চ থেকে। সেই দাবির সঙ্গে ছিলাম, আছি থাকব।

No comments:

Post a Comment