Tuesday, May 28, 2013

কমরেড নিবেদিতা নাগ আমাদের প্রেরণা : শাহ্‌রিয়ার কবির




তিন বছর একরকম শয্যাশায়ী থাকার পর পরপারে পা‍ড়ি দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নিবেদিতাদি, বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব কমরেড নিবেদিতা নাগ। ৫ই মে ২০১৩ তারিখে কলকাতার হাসপাতাল মৃত্যুবরণের সময় তাঁর বয়স ছিল ৯৫।
পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেও আমরা চেয়েছিলাম তিনি শতায়ু হবেন। অনেক দিন কলকাতা যাই না। ভেবেছিলাম ৪ঠা আগস্ট তাঁর ৯৫তম জন্মবার্ষিকীর দিন পার্ক সার্কাস-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাবো। তাঁকে নিয়ে যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম তার কাজও এবার শেষ করবো। আমাদের সে সুযোগ না দিয়ে তিনি চলে গেলেন। তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের পরিকল্পনা প্রচারবিমুখ নিবেদিতাদি সমর্থন না করলেও মেনে নিয়েছিলেন তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দাবির কারণে।

অবিভক্ত বাংলার সাম্যবাদী আন্দোলনে কমরেড নিবেদিতা নাগ এক বিশিষ্ট নাম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোগামী নেতা কমরেড নেপাল নাগের স্ত্রী হিসেবে নন, নিজের যোগ্যতায় সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে অপরিসীম শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে তিনি শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজের বিশিষ্ট স্থানটি নির্দিষ্ট করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি বিস্তৃত মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কলকাতায়। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসেবে তিনি যুদ্ধরত কমরেডদের এবং নির্যাতনের ‍‌শিকার দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

কমরেড নিবেদিতা নাগ জন্মেছেন ৪ঠা আগস্ট ১৯১৮তারিখে, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় মাতামহ আনন্দ রায়ের বাড়িতে। মা অমিয়াবালা চৌধুরী ছিলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী। বাবা অধ্যাপক সঞ্জীবকুমার চৌধুরী শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি, বেড়ে উঠেছেন এক বিপ্লবী পরিবেশে। পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল অভিযানের মহানায়ক সূর্য সেনের সহপাঠী। তাঁর কাকারা সবাই ছিলেন সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য। চট্টগ্রামের সুচিয়া গ্রামে তাঁর ‍‌পৈত্রিক বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের গোপন কর্মকাণ্ডের অন্যতম ঘাঁটি। স্কুলে থাকতেই নিবেদিতা বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলতেন, গোপন চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতেন, এমনকি বাড়িতে বিপ্লবীদের অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন।

স্কুল ছাত্রী নিবেদিতা‍‌কে বিপজ্জনক মনে হওয়াতে দু বছরের জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়, যে কারণে নারায়ণগঞ্জে মায়ের পৈত্রিক বাড়িতে থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৩৪ সালে। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। সংগঠনের ডাকে ধর্মঘট সংঘটিত করতে গিয়ে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ’৩৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে বি এ পাস করেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অসুস্থতার জন্য এক বছর পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন, যিনি পরবর্তী জীবনে তাঁকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন।

কমরেড নিবেদিতা নাগ ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ’৪৩ সালে ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন নারী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সহযোদ্ধা ‍হিসেবে পেয়েছেন আশালতা সেন, লীলা রায়, মণিকুন্তলা সেন ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য নেত্রীদের। পার্টির কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন য‌ুঁইফুল রায়, অণিমা সিংহ, কনক মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা গুপ্ত, অমিয়া দত্ত, হেলেনা বসু, নীলিমা বসু, শান্তি দত্ত, ডলি বসু, পঙ্কজ আচার্য প্রমুখ কমিউনিস্ট নেত্রীদের।

১৯৪৩-এর ১৭ই মে কমরেড নেপাল নাগকে তিনি বিয়ে করেন পরিবারের অমতে। ততদিনে তিনি স্থির করেছেন বাকি জীবন পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। নেপাল নাগ তখন ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা হিসেবে পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। স্বামী স্ত্রী দু’জন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার কারণে চরম আর্থিক অনটনে তাঁদের দিন‍ কেটেছে। শৈশবে ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খেতে দিতে পারেননি কিন্তু পার্টির কাজ এবং কমরেডদের অফুরন্ত ভালোবাসা তাঁদের সেই অভাব পূরণ করেছে। তিনি সব সময় বলেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির কমিউন জীবন ও কমরেডদের সান্নিধ্য তাঁর অভিজ্ঞতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

১৯৪৮ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের সদস্য হিসেবে এর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। গোপন কমিউনে হাতে লিখে স্টেনসিল কেটে সাইক্লোস্টাইলে ইশ‍্‌‌‍‌তেহার ছেপে বিলি করেছেন, রাতের অন্ধকারে দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়েছেন; অমানুষিক পরিশ্রমে শরীর বার বার বিদ্রোহ করেছে কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।

’৪৯ সালে জেলে গিয়েছেন, পার্টির নির্দেশে বন্দী নির্যাতনের প্রতিবাদে কারাগারের ভেতর অনশন করতে গিয়ে নিজেও নির্যাতনের ‍‌শিকার হয়েছেন, তারপরও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।

স্বামী-স্ত্রী দু’জন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হলে সন্তানদের ঠিকমতো লালন-পালন সম্ভব হয় না। নেপাল-নিবেদিতা দম্পতির দুই পুত্র কন্যা সুজয় ও সুমিতাকে আ‍‌শৈশব অপুষ্টির শিকার হয়ে নানা ধরনের অসুখে ভুগতে হয়েছে। ’৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে মস্কো যাওয়ার আগে তাদের ঠিকমতো চিকিৎসাও হয়নি। ফলে অন্য সব সর্বক্ষণের পার্টি দম্পতিদের ক্ষেত্রে যা হয়েছে — নিবেদিতা নাগ কমিউন জীবন থে‍‌কে বেরিয়ে এসে স্কুলে চাকরি নিয়েছেন। এর আগে অবশ্য নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং এই কলেজের প্রতিষ্ঠা অধ্যক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তিনি যখন দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশে আসেন তখন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁর জন্য বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কলকাতার বাড়ি ছিল কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি।

তাঁর পার্টি জীবন ও কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকা ও কলকাতায়। দীর্ঘ পার্টি জীবনে বহু বিপ্লবী নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। তারপরও ২০০০ সালে তাঁকে নিজেদের কাছে পেয়ে ঢাকার সুহৃদ, স্নেহভাজন ও শুভানুধ্যায়ীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন।

বড়দা শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের সময় একই কমিউনে ছিলেন তাঁরা। বড়দার প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসার ভাগ থেকে আমিও বঞ্চিত হইনি। ২০০২-এর জানুয়ারিতে প্রথমবার কারাগার থেকে মুক্তির পর কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে আমার প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ ব্যক্ত করেছিলেন — ‘শাহরিয়ার আমার সন্তানের মতো। ওর গ্রেপ্তারের সংবাদে আমি অসুস্থ হয়ে শয্যা গ্রহণ করেছিলাম। আজ ওর মুক্তির সংবাদ শুনে আমি সুস্থ হয়ে গেছি।’ তাঁর কলকাতার বাড়িটি আমার মতো অনেকের কাছে তীর্থ সমান। তাঁর সান্নিধ্য আজও যে কারো জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও প্রেরণাদায়ক।

তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা কনক মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে পার্টির পত্রিকায় নিবেদিতা নাগ নিয়মিত লিখছেন চল্লিশের দশক থেকে। পার্টির পত্রিকার বাইরেও লিখেছেন তিনি, প্রথম জীবনে বেতারের জন্য কথিকা লিখে ঢাকার রক্ষণশীলদের সমূহ উষ্মার কারণ হয়েছিলেন। ’৩৯ সালে ঢাকা বেতারে তাঁর প্রথম ইংরেজি কথিকা প্রচারের পর সেই সময়ের দৈনিক ‘চাবুক’ প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছিল ‘অবশেষে ভদ্রঘরের মেয়েরাও রেডিওতে নামিয়াছেন!’

তিনি যখন ২০০০ সালে ঢাকা এসেছিলেন নেদারল্যান্ডের একটি আর্কাইভের জন্য তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। এরই ভিত্তিতে আমাদের চাপে পড়ে তিনি লিখেছিলেন ‘ঢাকা থেকে কলকাতা: নয় দশকের স্মৃতি’।
তিনি কায়িকভাবে না থাকলেও তাঁর কর্মে এবং আমাদের স্মৃতিতে সব সময় সজীব থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রগতির আন্দোলনের অফুরন্ত প্রেরণা হয়ে।

No comments:

Post a Comment