Monday, May 27, 2013

ভিন্নমত: বিনীত নিবেদন অভিভাবকদের প্রতি:মনজুরুল আহসান বুলবুল:

গত ১৮ই মে দেয়া ১৫ জন সম্পাদকের বিবৃতি ‘সম্ভবত কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করেছে বলে বিবৃতিদাতা সম্পাদকরাও মনে করছেন। সে কারণেই কৈফিয়ত না দিলেও বিবৃতি দেয়ার কারণটি আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হচ্ছে।
বলে রাখি; সম্মানিত সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি। যারা মনে করেন মাহমুদুর রহমান সম্পাদক নন তাদের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করি। দেশের প্রচলিত আইন যেমন সম্পাদক হওয়ার কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়নি, আবার কাউকে বারিতও করেনি। মাহমুদুর রহমানকে কেউ ‘‘হঠাৎ সম্পাদক” বলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু তিনি একজন সম্পাদক বটে। সরকার, সচেতন সম্পাদকমণ্ডলী বা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কেউ এখনও এমন একটি বিধি-আইন-নীতিতে একমত হতে পারেননি যে একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হওয়ার মাপকাঠি কি। প্রভাব থাকলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া যায়, মালিক তো হওয়া যায়ই, প্রিন্টার্স লাইনে নাম লিখে সম্পাদকও হওয়া যায়। বলতে খচ্‌ খচ্‌ করলেও সত্যি হচ্ছে, ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত একটি সংবাদপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তারা সকলেই সম্পাদক। তবে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ১৫ জন সম্পাদক নতুন কোন বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন কিনা তা তারাই বলতে পারবেন কিন্তু এই পঞ্চদশের অনেকেই যে তাদের অনেক পুরনো বন্ধুদের বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সে তো নানাভাবেই দৃশ্যমান।
কেন এ বিভ্রান্তি? সাধারণের প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো এরকম:
১. কেন ১৫ জন সম্পাদক, কেন আরও বেশি নয়? যে ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মতোই আরও যে সম্পাদকদের আমরা সম্মান করি তারা কেন এই বিবৃতিতে সই করলেন না? মানেটি হচ্ছে: কিছু সম্পাদক আছেন যারা এই ১৫ জনের মতকে ধারণ করেন না; কাজেই তারা এই পঞ্চদশের সঙ্গে নেই।
২. বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মালিক-সম্পাদকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ- বিএসপি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে; নিউজ পেপার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াব। এই সংগঠন আমন্ত্রণমূলক, সম্মানিত কয়েকজন মালিক সম্পাদক এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন; তারা যাদের আমন্ত্রণ জানাবেন তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন। সাধারণভাবে সকল মালিক বা সম্পাদক তাদের সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে; এই বিবৃতিতে নোয়াব এবং অ-নোয়াব একাকার হয়েছে। অর্থাৎ নোয়াব যে সম্পাদকদের তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেন না; এই বিবৃতিতে তারাই হয়েছেন নোয়াবের সদস্যদের সহযোদ্ধা। অন্যদিকে নোয়াব-এর তিনজন সদস্য এই বিবৃতিতে সই করেন নি। মানুষ বিভ্রান্ত হবে না কেন?
৩. বিবৃতিদাতাদের অন্তত একজন সম্পাদক বিবৃতিদাতা অপর দু’জন সম্পাদক সম্পর্কে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেছেন, রায়ও তার পক্ষেই গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী দুই সম্পাদক এই বিবৃতিতে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী সম্পাদকের সঙ্গে। মামলার ফরিয়াদি ও প্রতিপক্ষ একই কাতারে। বিস্ময় এখানেও।
৪. বিবৃতিদাতা সম্পাদকদের দু’জন এমন একটি পত্রিকার সাবেক ও বর্তমান সম্পাদক যে পত্রিকা থেকে ভারতীয় অর্থপুষ্ট সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই তালিকায় বিবৃতিদাতা একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ভারতীয়দের কাছ থেকে কত টাকা নেন তা-ও উল্লেখ ছিল। নৈতিকতাহীন ও চরম দায়িত্বহীন সেই সংবাদপত্রের সঙ্গে অপূর্ব সম্মিলনী দেখা গেল দায়িত্বশীল ও উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার সেই সম্পাদককেও। হোঁচট এখানেও।
নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও বিবৃতিদাতাদের এই একতা একদিকে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। বিবৃতিদাতা একজন সম্মানিত সম্পাদক লিখছেন; মাহমুদুর রহমানকে অনেকগুলো অভিযোগে মাসখানেক ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। গূঢ়ার্থ হচ্ছে: আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযোগ থাকলেও কাউকে আটকে রাখা যাবে না। যদি এই যুক্তিতেই এখন বিজিএমইএ রানা প্লাজার আটক গার্মেন্ট মালিক বা প্রকৌশলীদের কোন সমিতি সেই ভবনের নকশা অনুমোদনকারী বর্তমানে আটক প্রকৌশলীদের মুক্তি দাবি করেন? কারণ এখনও তো তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিবৃতিদাতাদের এই যুক্তি মেনে নিলে তো গোলাম আযম, নিজামী সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়। আদালতে ‘গিলটি’ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো তারা ‘ইনোসেন্ট’ !!
এ বিবৃতি নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সম্মানিত সম্পাদকদের প্রজ্ঞার প্রতি যে প্রশ্ন তুলেছেন তারও প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিদাতা সম্পাদকগণ গত কয়েক দশক ধরে দেশ, উপমহাদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। কাজেই না জেনে-বুঝে তারা এই বিবৃতিতে সই করেছেন এমন সহজ সমীকরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন এই বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষেও যেমন এই সম্পাদকদের দৃঢ় যুক্তি রয়েছে, যদি তারা বিবৃতি না দিতেন তাহলেও তারা সফলভাবেই সেখানেও যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন। যে সম্পাদকরা বিবৃতিতে সই করেননি তারাও নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে সকল বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যথাসময়ে প্রেস নোট কেন দেয়া হচ্ছে না? স্বয়ং মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবৃতিতে পরিণত হয়। সরকারি প্রেস নোট বিষয় ভিত্তিক সরকারি ব্যাখ্যা তুলে ধরে; হতে পারে সরকারি প্রেস নোট ছলনাময়ীর প্রেমের মতোই মিথ্যা কিন্তু সরকারের অবস্থান স্পষ্টকরণের জন্য এই অন রেকর্ড সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রথাটি পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত। পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে পারে।
তবে এত বৈপরীত্য, নানা বৈচিত্র্যের একতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যেও এই সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতিতে আমরা আশান্বিত হতেই পারি। কারণ সব কিছু ভুলে অভিভাবকের মতো তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে অধিকার তা রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এই রকম অভিভাবক দেশের গণমাধ্যম জগতের দীর্ঘদিনের চাহিদা। একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে সে প্রশ্ন উঠেছে অনেক দিন আগেই। অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হন। কিন্তু এই ঐক্য তো শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের মতোই কঠিন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা যদি হন এক ইউনিয়নের নেতা আর শেখ হাসিনার টিকিট নিয়ে তার দলের এমপি প্রার্থী যদি আরেক ইউনিয়নের নেতা হন তা’হলে এই দুই ইউনিয়নের মধ্যে নেহায়েৎ অর্থনৈতিক দাবি ছাড়া আর কোথাও ঐক্যের জায়গা তো দেখি না। তার ওপর আবার এক শীর্ষ নেতা এখন লিখিতভাবে নসিহত করছেন যে, নারী সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের রিপোর্টারদের যেন স্পর্শকাতর বিষয়ে এসাইনমেন্ট দেয়া না হয়। তারপরেও রুটি-রুজির সংগ্রামে সাংবাদিক ইউনিয়নই তো আমাদের ভরসা। এর পাশাপাশি সম্মানিত সম্পাদকগণ যদি পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এক হয়ে এগিয়ে আসেন তা তো আশারই কথা। কিন্তু হতাশা সব সম্পাদকও এখানেও এক হতে পারলেন না।
সে কারণেই আশাজাগানিয়া এই উদ্যোগ নিয়ে একটু হতাশা আছেই। সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতি প্রসঙ্গে একজন সম্পাদকের ব্যাখ্যায় [দৈনিক সমকাল, ২৪শে মে ২০১৩] যে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ১৫ জনের বিবৃতিতে একটি প্যারাগ্রাফেও যদি সেই বর্ণনাটি তুলে ধরা হতো তা’হলেও বিবৃতিদাতারা এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেন না একথা বলা যায়। জানি না দৈনিক সমকাল সম্পাদকের অবস্থানটি সকলেই সমর্থন করেন কিনা। বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটটির ন্যূনতম বর্ণনা না থাকায় বিবৃতিটি দাতাগোষ্ঠী এবং দূর থেকে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠীর বিবৃতির মতোই মনে হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সময়কার তরুণ শিক্ষার্থী পরে জগৎখ্যাত ইতিহাসবিদ, অক্সফোর্ডের শিক্ষক, বাংলাদেশেরই ‘বরিশালের পোলা’ তপন রায়চৌধুরী। তাঁর ‘বাঙালনামা’য় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)
কোন মন্তব্য নেই, শুধু একটিই জিজ্ঞাসা। বিবৃতিদাতা সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত দৃশ্যপটের সঙ্গে সামপ্রতিক বাংলাদেশের কোন মিল খুঁজে পান কিনা? কোন চরিত্রের কোন খোঁজ পান কিনা? জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর বলে এই পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে বরেণ্য সম্পাদকদের মতামত এবং অবস্থান কি সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারেন।
এই বাস্তবচিত্র মাথায় রেখেই তবুও আশাবাদী হতে চাই এ কারণে যে, সাংবাদিকতা পেশার অভিভাবকরা যখন একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তখন বোধ করি এই শিল্প ও পেশার জন্য কিছু একটা হবে। প্রত্যাশা; মালিক ও পেশাদার সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সম্পাদকগণ দেশের গণমাধ্যমের সঙ্কটের এই সময় দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখবেন। তাদের কাছে এই প্রত্যাশা এ কারণেই যে, একজন সম্পাদককে সাংবাদিকরা জানেন পেশায় তাদের অভিভাবক হিসেবেই। নষ্ট সন্তান বিপদগ্রস্ত হলে তার মুক্তি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে ভ্রষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও অভিভাবকদের। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক এক জন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে- সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং তার পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? একটু পেছনে দেখুন... বাংলাদেশে যে সব গণমাধ্যম বিপদগ্রস্ত হয়েছে তা হয়েছে শুধু মালিকদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সাংবাদিকের পেশাগত কোন কারণে বাংলাদেশে কোন গণমাধ্যম বন্ধ হয়নি। সব জেনে শুনে, আইন ভাঙবেন মালিকরা আর বিপদগ্রস্ত হবেন পেশাজীবী সাংবাদিক কর্মচারীরা- এ যেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কোন গণমাধ্যম, সম্পাদক বা সাংবাদিক আক্রান্ত হলে সম্পাদক বা সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমন বাস্তবতা পাওয়া গেছে।
দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা আর নৈতিকতার মাপকাঠি পৃথিবী জুড়েই আজ একটি দৃশ্যমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে কারা সাংবাদিক, কারা নন- সে প্রশ্ন নিয়ে। বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সনাতনী গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কোথায় এসে মিলবে (স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দৃশ্যত ব্যাপক বিসতৃত, বিবৃতিদাতা বা মধ্যরাতের টকশো কাঁপানো অনেক সম্পাদকের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক যোগাযোগ কর্মীর অনুসারীদের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি ও কার্যকর)।
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির অতিব্যবহার এই পেশার মানবিকতাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সংবাদের তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতা কত সত্যকে হত্যা করছে, সমাজে সাংবাদিকতার অতি প্রভাবের ক্ষমতা কোন কোন গণমাধ্যমকে কিভাবে দানবে পরিণত করছে, সমপাদকদের অতিমাত্রায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চাপ রিপোর্টারকে বেশি বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে কিনা এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোড়িত এখনকার গণমাধ্যমের শিক্ষা ও গবেষণার জগৎ। গণমাধ্যমের এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে গণমাধ্যমকেই এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন অভিভাবক সম্পাদকরাই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে অনেক অভিভাবককে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। এ কারণে কিছুকাল আগে একজন স্বনামখ্যাত সম্পাদক তার বক্তব্যে দাবি জানিয়েছিলেন সম্পাদকদেরই প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেবে কে? তবুও শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের প্রতিই আস্থা রাখতে হবে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি আমাদের সম্পাদকদের বিভক্তির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ- দেশের গণমাধ্যমের চেহারায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সকল সম্পাদকের একসঙ্গে এগিয়ে আসা। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এবং ইউনিয়নের কতিপয় শীর্ষ নেতার অতিমাত্রার রাজনৈতিক চেহারা যত হতাশাই ছড়াক ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেবে রুটি-রুজি আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পেশাদার সম্পাদকরা দেবেন পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের নেতৃত্ব। এই যৌথ উদ্যোগ দিয়েই অনেক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে।
সর্বশেষ খবর: সম্মানিত সম্পাদকগণ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খুবই আশার কথা, এই সংগঠন নিশ্চয়ই সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখবে। কোন সম্পাদকের অপেশাদারিত্বের কারণে কারও জীবন ও সম্মান বিপন্ন হলে সেদিকটাও এখন দেখতে হবে এই পরিষদকে (অপেশাদারী সম্পাদকের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে তরুণরা বিপন্ন জীবন যাপন করছেন তারা নিশ্চয়ই কথা বলার একটি জায়গা পেলেন)। এই সংগঠন যাতে কোন অপেশাদার ও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি অনুসরণ করেন না এমন কোন সম্পাদকের আশ্রয়স্থল না হয়। তবে শেষতক মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক আর পেশাদার সম্পাদকের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। নবগঠিত সম্পাদক পরিষদের অনেক নেতাই ওয়েজবোর্ডে মালিক হিসেবেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আবারও বলি: বিবৃতি দিয়ে ১৫ সম্পাদক কতটা অর্জন করেছেন তার মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই যে হোঁচট খেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বিবৃতিদাতা অনেক সম্পাদকই যেহেতু অভিভাবকতুল্য- সে জন্যই প্রত্যাশা করি তারা যেন হঠাৎ করে আমাদের কাছে অচেনা না হয়ে যান। অভিভাবকরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিবারের নিষ্ঠাবান সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন, সে জন্যই এই রচনা। আশা করি, এই রচনায় তারা বিরূপ হবেন না। এই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক; bulbulahsan@gmail.com
সূত্র: দৈনিক মানবজমিন

No comments:

Post a Comment