Tuesday, May 28, 2013

দোষ মন্ত্রীর নয়, মন্ত্রণালয়ের:প্রভাষ আমিন




বিএনপি আবারও প্রমাণ করলো তারা সত্যিকার অর্থেই জনগণের দল। নইলে তারা যেখানে টানা হরতাল দিতে পারে, সেখানে তারা কেন মাঝখানে দু’দিন বিরতি দিল? জনগণের জন্য। বিভিন্ন বইয়ে পড়েছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদাররাও কারফিউর মাঝে বিরতি দিতো, যাতে মানুষ জরুরি কাজকর্ম সেরে রাখতে পারে। ধন্যবাদ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, আমাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা এমন অন্তর দিয়ে ভাবার জন্য। রোববার সারাদেশে নামকাওয়াস্তে হরতাল পালিত হলো, বুধবার আবার পালিত হবে। জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করে। কারণ শামসুজ্জামান দুদুর ছাড়া বিএনপির আর কোনো নেতাকর্মীর হরতাল নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বুধবারের হরতালে বিএনপির একজন নেতাও মাঠে নামবেন না। শুধু জনগণকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য অফিসে বসে থাকবেন দুদু।
অবশ্য দুদুকে এখন দলের নেতা না বলে, বিএনপি অফিসের কেয়ারটেকার বলাই ভালো। কেন হরতাল ডাকা হয়, এতে কার ক্ষতি, কার লাভ? কে জানে। আমার ধারণা বিএনপি নেতারাও জানেন না। যাদের বেকায়দায় ফেলার জন্য এই হরতাল, সেই সরকার থোড়াই কেয়ার করে বিরোধী দলকে। তবে সরকারের ক্ষতি না হলেও বিএনপির ক্ষতি হয়েছে। তার সফরের সময়ে বিএনপি হরতাল ডাকায় রাগ করে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করেছেন বাংলাদেশ সফরে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতি-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন। বিএনপির হরতালে তিনি বিস্ময় ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আমরাও হতাশ। একদম মেয়েলি অভিমান- আমার সফরের সময় হরতাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীর কাছে বঙ্গ ললনাদের মতো মেয়েলি অভিমান আশা করিনি। মার্কিন সৈন্যরা যেখানে আফগানিস্তানে লড়ছেন তালেবানদের বিরুদ্ধে, সেখানে একজন আন্ডার সেক্রেটারি কিনা হরতালের ভয়ে কুপোকাত। তবে আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এসবে থোড়াই কেয়ার করে। বিএনপি জনগণের দল, জনগণের অধিকার আদায়ে তারা হরতাল ডাকে। সেই হরতাল বিদেশি প্রভূদের সফরের সময় বাতিল করতে হবে কেন? হরতাল চলছে, চলবে। কে আসলো-গেল, কবে এইচএসসি পরীক্ষা এসব ভাবতে বিরোধী দলের বয়েই গেছে। এসব তো সরকারি দলের ভাবনা, দেশ তো তারাই চালাচ্ছে, বদনাম হলে তো তাদেরই হবে।
বলছি বটে বিএনপি হরতাল ডেকেছে। তবে আমি বিশ্বাস করি এবারের হরতাল দুটি ডেকেছেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বলা ভালো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্যে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি সভা-সমাবেশ করতে দেয়া না হয়, তাহলে তারা হরতাল ডাকবে না তো কি বসে বসে আঙুল চুষবে? বিএনপি আগে অনেক অপ্রয়োজনীয় হরতাল করেছে। কিন্তু তাদের এবারের হরতাল দুটি বাধ্য হয়ে দেয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বাধ্য করেছেন। এরকম পরিস্থিতিতেই অনন্যোপায় হয়ে হরতাল ডাকতে হয়। তবে বহুল ব্যবহারে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের এই শেষ অস্ত্রটি অনেক আগেই ভোতা এবং অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্যে ডাকা এই হরতালেও জনগণের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু হবে না।
আমি বরাবরই বিশ্বাস করি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। দোষ প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তির। যেমন আমার দেশ আতাউস সামাদের সময় একরকম ছিল, মাহমুদুর রহমানের সময় হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর লিফলেট। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি আমার ভেঙে গেছে। এখানে আসলে ব্যক্তি সমস্যা নয়, সমস্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের। নইলে সব আমলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরই একই সমস্যা থাকবে কেন?
এরশাদ পতনের পর বিএনপির প্রথম দফায় একদিন সন্ধ্যায় পুলিশ প্রেস ক্লাবের ভেতরে ঢুকে সাংবাদিকদের বেপরোয়া মারধোর করেছিল। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী বললেন, পুলিশ সাংবাদিকদের দেখতে পায়নি। সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবের মতো উন্মুক্ত স্থানে পুলিশ দেখতে পায়নি, এটা কেউ বিশ্বাস করেনি। পরে তার নামই হয়ে গিয়েছিল রাতকানা পুলিশের মন্ত্রী। এরপর আওয়ামী লীগ আমল কেটেছে মোহাম্মদ নাসিমের তর্জন গর্জনেÑ প্রয়োজনে কবর থেকে সন্ত্রাসী ধরে আনা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর বিএনপি এক আমলেই মাশাল্লাহ দুই জন ‘আল্লার মাল’ উপহার দিলো। অরিজিনাল ‘আল্লার মাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী’, যিনি সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবার কোলে থাকা শিশু নওশিনের মৃত্যুর পর সেই শোকাহত বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে’। এই আল্লার মালকেও বেগম খালেদা জিয়া সরিয়ে নেয়ার পর স্বরূপে আবির্ভূত হন ততদিন আড়ালে থাকা লুৎফুজ্জামান বাবর। তার জেল দেয়া চুলের স্টাইল, অসাধারণ ইংরেজি জ্ঞান তাকে দিয়েছে অমরত্ব। যদিও অলওয়েজ ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ বাবরের গুণের কদর দিতে পারেনি বর্তমান সরকার। আগের সরকারের প্রায় সবাই ছাড়া পেয়ে গেলেও এই বেচারা ২১ আগস্ট আর ১০ ট্রাকের পাল্লায় পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। এরপর বর্তমান সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয় মাঠের সৈনিক সাহারা খাতুনকে। তার বাণী শুনতে সাংবাদিকদের প্রায়শই উত্তরখান, দক্ষিণখানের কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কাভার করতে যেতে হতো। সাগর-রুনীর খুনীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করার জন্যই। এরপর ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তাকেই প্রায় বাড়ি চলে যেতে হয়। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সপ্তাহে একাধিকবার উত্তরখান যাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার আগ্রহ কারো নেই। না সাংবাদিকের, না দর্শকদের। সাহারা খাতুন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর এক সম্পাদক টক শোতে বলেছিলেন, নতুন মন্ত্রী এসএমএস করতে পারেন না।
এরপর আমরা পেলাম ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে। সুশিক্ষিত, সারাজীবন দক্ষতার সঙ্গে সরকারি চাকরি করেছেন। শুধু তিনি নন, তার পুরো পরিবারই দেশজুড়ে পরিচিত, সম্মানিত। সত্যিকারের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান তিনি। আমি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। যেভাবে তিনি একটিও ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ না করে অনর্গল বাংলা বলে যেতে পারেন, তা রীতিমতো অনুকরণীয়। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও তা অনুকরণ করতে পারিনি। দুয়েকটা ইংরেজি শব্দ ঢুকেই যায়। আমি হলফ করে বলতে পারি, এমন সুশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ আগে কখনো পায়নি। বেস্ট অব দ্য বেস্টস। সেরাদের সেরা। কিন্তু এখন দেখছি তিনি সব দিক দিয়েই বেস্ট। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর তার নাড়াচাড়া তত্ত্ব তো ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক জোকসে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, আমার মাথা পুরা আউলাইয়া গেছে। বাংলাদেশে এখন সভা-সমাবেশ করা যাবে কি যাবে না, এটা জানতে গত দু’দিনে খোঁজ-খবর করতে গিয়ে, নানা পত্রিকা পড়ে আমার পাগল হওয়ার দশা। কোনটা বিশ্বাস করবো, কারটা বিশ্বাস করবো- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সকালের কথা না বিকেলের কথা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের কথা না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পষ্টীকরণ বিবৃতি? নাকি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য? নাকি পুলিশের আইজি? একবার ভেবেছিলাম গুগলে সার্চ দেই। খোঁজ-খবর নিয়ে যা জানলাম এখন বাংলাদেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেই, নেই কোনো প্রজ্ঞাপনও। তারপরও সরকার বেআইনিভাবে, অসাংবিধানিকভাবে, কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা ছাড়াই সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। একবার শুনি সারা বাংলাদেশে, একবার শুনি ঢাকায়; একবার শুনি এক মাস, একবার শুনি অনির্দিষ্টকাল! কোনটা বিশ্বাস করবো? পাগল হতে আর কি লাগে।
প্রিয় পাঠক, চলুন একটু ঘটনাক্রম অনুসরণ করে আসি, দেখি জিলাপির প্যাচ খোলে কিনা। ১৯ মে দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামের মিরসরাইতে জোরারগঞ্জ থানা উদ্বোধন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে আমরা উৎসাহিত করি। যারা আজ সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের মনে রাখা দরকার, সমাবেশের অনুমতি নিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দেন, জনসাধারণের ওপর অত্যাচার করেন, নির্যাতন করেন, গাড়ি পোড়ান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্র নষ্ট করেন, দোকান লুট করেন; তাদের যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে আমরা সমাবেশ করার অধিকার স্বীকার করা সত্ত্বেও আগামী এক মাস পর্যন্ত কোনো দলকেই কোনো সমাবেশ করতে দেব না।” মনে রাখুন এখানে ঢাকা না সারাদেশ তা বলা হয়নি। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে একমাস বলা হয়েছে। এবার শুনি রাতে বিবিসিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলছেন, “রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করবে, এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে কোনো দলকেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। ঢাকাকে নিরাপদ রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।”
প্রিয় পাঠক, আবার আপনাদের মনে রাখার কষ্ট দেবো। বেশি না, মাত্র দুটি পয়েন্ট। এখানে আমরা পেলাম, সারাদেশ নয়, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু ঢাকাতে। আর এক মাস নয়, এই নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকালের জন্য। এবার আমরা একটু ঘুরে আসি ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ব্রিফিং থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সব সময় সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিক মহাসেনের প্রভাবে মৃত্যুর হার বেশি না হলেও অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশে একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রয়োজন। এ জন্য এক মাস সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।” এখানে আবার একটু থামতে হবে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, তবে অনির্দিষ্টকাল নয়, এক মাসের জন্য। আর নিষিদ্ধ করার কারণ অন্যকিছু নয়, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন। তবে এই নিষেধাজ্ঞা ঢাকা না সারাদেশ তা পরিষ্কার নয়। সারাদিন এত বিভ্রান্তির পর রাত ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসে স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি, এবার নিশ্চয়ই সব ফকফকা হয়ে যাবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় “জোরারগঞ্জ থানা উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতিতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল এমন কোনো কর্মসূচি দেয় যাতে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা নাশকতার আশঙ্কা থাকে বা সেরূপ লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়, তবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার স্বার্থে সেসব দলের সভা-সমাবেশের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেবে না সরকার। তবে সাধারণ সমাবেশ করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। এটা কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং জনগণের জানমাল রক্ষার্থে পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।” হায় স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে কিছুই স্পষ্ট তো হলোই না, বরং আরো ধোয়াটে হলো পরিস্থিতি। বিভ্রান্তির অবকাশ নেই, বলা হলেও বিভ্রান্তি আরো বাড়লো শুধু। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিরসরাই এবং বিবিসিতে একবারও ঘূর্ণিঝড়ের কথা না বললেও মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে সভা-সমাবেশ না করতে না দেয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো, তার আগেই ভারতে পালিয়ে যাওয়া মহাসেনকে। আবার সৈয়দ আশরাফ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এক মাসের নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে কোনো সময় বেঁধে দেয়ার কথা তো বলা হলোই না, বরং বলা হলো এটি কোনো নিষেধাজ্ঞাই নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একবার এক মাস, একবার অনির্দিষ্টকাল বললেও মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, এটি নিষেধাজ্ঞাই নয়। আর পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিকদের বললেন, তিনি এ ব্যাপারে কোনো দাপ্তরিক আদেশ পাননি। এবার বলুন, কারটা বিশ্বাস করবেন, কোনটা বিশ্বাস করবেন? আমার মতো আপনাদের মাথাও নিশ্চয়ই এলোমেলো হয়ে গেছে।
যে যাই বলুক, আমরা দেখছি আইজির বক্তব্যই এখন পর্যন্ত ঠিক। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো দাপ্তরিক আদেশ, মানে প্রজ্ঞাপন পাননি দেশবাসী। আসলে প্রজ্ঞাপন আসবে কোত্থেকে, এভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কোনো এখতিয়ারই নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। কারণ সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।” সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি না করা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ করার অধিকার হরণের অধিকার কারো নেই। ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে হলে ডিএমপি অ্যাক্ট অনুযায়ী আবেদন করতে হয়। অনুমতি দেবেন কি দেবেন না, তার এখতিয়ার ডিএমপি কমিশনারের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়। তাই সভা-সমাবেশ একমাসের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করার কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে ডিএমপি কমিশনারের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেছেন। নইলে এই বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তের দু’দিন পর মিরপুরে নিরীহ বামদের সমাবেশেও কেন পুলিশ বাধা দেবে এবং তাদের ১৫ নেতা-কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়ে যাবে? পরে আবার মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেবে? সভা-সমাবেশ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা করছেন, তা স্রেফ গায়ের জোরে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ মে এই নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও আসলে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ব্যাপক তাণ্ডবের পর থেকেই ঢাকায় কোনো সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। এর মধ্যে বিএনপি দু’বার সমাবেশের অনুমতি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর বিএনপির এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তারা আর অনুমতির জন্য বসে থাকবে না। কিন্তু আমরা জানি, সরকারের অনুমতি ছাড়া তীব্র আন্দোলন করার হ্যাডম অন্তত বিএনপির নেই। তাই তারা ঝুঁকিমুক্ত কর্মসূচি ডেকে ক্ষান্ত দিয়েছে। হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকলেই হলো।
শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আপনারা ঠিকই পড়েছেন, সরকারি দল আওয়ামী লীগও এই সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এই বিষয়ে সরকারের ৫ রকমের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দিয়েছেন ষষ্ঠ লাইন। তিনি বলেছেন, “সভা-সমাবেশ বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়।” তিনি রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কাঁঠাল গাছে আম চেয়ে তো লাভ নেই। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যারিয়ার আমলা, তার কাছে রাজনৈতিক সমাধান আশা করা কেন? আর সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য যে যুক্তি দেয়া হয়েছে তা কোনো যুক্তি নয়, অজুহাত। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন যে তীব্রতায় আঘাত হানার আশঙ্কা ছিল, আল্লাহর রহমতে তা হয়নি। পটুয়াখালিতে হালকা ছোবল হেনেই পালিয়েছে মহাসেন। পটুয়াখালির ত্রাণ কার্যক্রমের অজুহাতে ঢাকায় এক মাসের জন্য সমাবেশ নিষিদ্ধ কেন? এর আগে বাংলাদেশে কখনো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত করা হয়নি। আর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ- এসব তো আমাদের রাজনীতির অনুসঙ্গ। যখন কেউ ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ করবে তখন সরকারের দায়িত্ব তা প্রতিহত করা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে, ততক্ষণ তাতে বাধা দেয়া বা অনুমতি না দেয়ার কোনো সুযোগ কারো নেই, অন্তত সংবিধান সে সুযোগ দেয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো সমাবেশে যদি সহিংসতার সুনির্দিষ্ট কোনো গোপন খবর থাকে, তবে সে সমাবেশের জন্য অনুমতি না দিলেই হলো। সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য দেখাতে পারেননি। এক সংগঠনের শৃঙ্খলা-বিরোধী কাজের দায় সব সংগঠনকে নিতে হবে কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব অভিযোগ করেছেন, তার সবগুলোই স্পষ্টত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের ইঙ্গিতবাহী। তাহলে হেফাজতকে সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিলেই হলো। তাই বলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, নিরীহ বাম সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে হবে কেন? সমাবেশ করতে অনুমতি লাগবে এবং মারামারি করা যাবে না- এটা তো নতুন কোনো কথা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী এক মাস পরে কি দেশে অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করা যাবে? সমাবেশের অনুমতি নিয়ে মারামারি করা যাবে?
এই লেখার প্রস্তুতি হিসেবে নানা জায়গায় ফোন করে আর বিভিন্ন পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যিক ও স্পর্শকাতর এলাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাছাড়া ব্যস্ত এলাকা বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সমাবেশ সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার নীতিতে বিশ্বাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমাবেশ নিষিদ্ধই করে দিয়েছেন। আর মারামারি হতে পারে- এমন আশঙ্কায় সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া তো মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে, তাই রাস্তায় না বেরোনো তো কোনো সমাধান হতে পারে না। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সামনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় হতে পারে ট্রাইব্যুনালে। সে জন্যই সরকার বাড়তি সতর্ক। একবার যেহেতু নিষিদ্ধ করা গেছে, সরকার হয়তো রমজানের আগে আর কোনো সমাবেশের অনুমতি দেবে না। সতর্কতায় আপত্তি নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকার সমাবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি কেইস বাই কেইস বিবেচনা করলেই পারতো। আর অনুমতি না দিলে তা ফলাও করে বলতে হবে কেন? প্রত্যেক ক্ষেত্রে আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেই আর বিষয়টি নিয়ে এত হইচই হতো না। ‘আই ডোন্ট নো’ অর্থ যে ‘আমি জানি না’, এটা সবাই জানেন। এটা চিৎকার করে বলার কিছু নেই। এরশাদের আমলে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, সীমিত আকারে রাজনীতি করা যাবে, ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি- ইত্যাদি ধরনের টার্ম। আবার সেই স্মৃতি ফিরে আসছে। আমাকে গালি দেয়া যাবে, কিন্তু ঘরে বসে। আরে যে আমাকে গালি দেবে, সে কি আর আমার কথা শুনে দেবে?
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আমার অনুরাগের কথা আগেই বলেছি। আরেকটি কারণে আমি তার ভক্ত হয়ে গেছি। তাহলো, গণমাধ্যমকে মোকাবেলার সাহস। যখনই কোনো বিতর্কিত কিছু করেন, তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন চ্যানেলের টক শো’তে অংশ নেন। আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কখনোই টিভিতে যাওয়ার সাহস দেখাননি। গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়েছিলেন ‘একাত্তর’ টিভিতে। শুরুর দিকের কিছুটা মিস করলেও অনুষ্ঠানে তার কথা শুনতে শুনতে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, “একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে হটাতে আপনারা আলটিমেটাম দেবেন, ভাঙচুর করবেন; সরকার তা মেনে নেবে না।” হায় হায়, এ যে দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম। জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর যখন সচিবের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সরকার হটাতে দলবল নিয়ে জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন, তখনকার বিএনপি সরকার কি গণতান্ত্রিক ছিল না? তিনি আরো বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দল সমাবেশের অনুমতি নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করবে, আগুন দেবে, তা মেনে নেয়া যায় না। খুব ঠিক কথা। তবে তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাস তখন থেকেই শুরু হয়েছে, এর কোনো অতীত নেই। আওয়ামী লীগ যেন গান্ধীবাদী দল। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে বিএনপি যা করছে তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র ও সহিংস আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি যে দাবিতে, মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, একসময় আওয়ামী লীগ ঠিক একই দাবিতে এর চেয়ে অনেক বেশি সহিংস আন্দোলন করেছিল। এক দলের সহিংসতার ইতিহাস, আরেক দলের সহিংসতাকে জায়েজ করে না। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে অন্তত এমন কথা মানায় না। অবশ্য জিয়াউর রহমানের খাল কাটা আন্দোলনের দোসর নব্য আওয়ামী লীগার মহিউদ্দিন খান আলমগীর যদি আওয়ামী লীগের অতীত অপকর্মের দায়-দায়িত্ব নিতে না চান, তাকে ঠিক দোষ দেয়া যাবে না। একটি সহিংসতামুক্ত, ভাঙচুরমুক্ত, হরতালমুক্ত, সমাবেশমুক্ত নতুন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখছেন; তাতে তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। একই অনুষ্ঠানে বাসা থেকে তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপি সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। স্টুডিওতে যতক্ষণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলছিলেন, তিনি তা বলছিলেন নির্বিঘ্নেই। কিন্তু যখনই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সামিয়া রহমান ব্যারিস্টার খোকনের বক্তব্য জানতে চাইছিলেন, তখনই ঘটছিল বিপত্তি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারিস্টার খোকনের বক্তব্য শেষ করার সুযোগ না দিয়েই তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিটি বক্তব্যের প্রতিবাদ করছিলেন। তাতে আমরা শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু আবছা আবছা কথা শুনেছি, ব্যারিস্টার খোকনের কোনো কথাই শুনতে পাইনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সঞ্চালককে বলছিলেন, “আমিই এই অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক, আমি কোনো বাচালের সঙ্গে কথা বলবো না।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। একই অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দলের নেতা ও মোহাম্মদ নাসিমকে ‘মুখর পুরুষ’হিসেবে অভিহিত করেছেন। মজা করে তিনি এও বলেছেন, মুখরা রমণী বশীকরণের মন্ত্র জানা থাকলেও মুখর পুরুষ বশ করার মন্ত্র তার জানা নেই। হা-হা-হা। তারা দু’জনেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। দুজনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- একজন বর্তমান, অন্যজন সাবেক। তাদের মধ্যে এমন রসিকতার সম্পর্ক থাকতেই পারে। তবে অনেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মুখরা রমণী বশীকরণের মন্ত্রটি জানতে চাইতে পারেন। যিনি মুখরা রমণী বশ করতে পারেন, বিরোধী দলকে দমন করা তার কাছে নস্যি। দায়িত্ব পালনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা পুলিশের জন্য অনেক কিছু করেন। তারপরও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা সবসময় পুলিশের প্রিয় টার্গেট। কেন জানি না। আশা করি ভবিষ্যতে পুলিশ ভাইয়েরা এ ধরনের নিমকহারামী করবেন না। তবে মহিউদ্দিন খান আলমগীর সুশীল ঘরানার মন্ত্রী। পুলিশ হয়তো ভবিষ্যতে টার্গেট বানানোর জন্য তাকে রাজপথে খুঁজেই পাবেন না।
আমি আগেই বলেছি, দোষ আসলে ব্যক্তির নয়, দোষ মন্ত্রণালয়ের, দোষ চেয়ারের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারিরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার চেয়ারটি সোনা-রুপার পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে পারেন, তাতে যদি দোষ কিছুটা কমে। আমার আবেদন, প্রায় অসীম ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি চাইলে যাকে ইচ্ছা তাকে রাষ্ট্রপতি বানাতে পারেন, স্পিকার বানাতে পারেন, মন্ত্রী বানাতে পারেন, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বানাতে পারেন, মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিতে পারেন। তবে শেষ বেলার মন্ত্রী গুণী পুরুষ ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে বাদ দেয়ার দাবি করছি না আমি। বরং তাকে পরিকল্পনা, টেলিযোগাযোগ, পাট, ডাক- এ ধরনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তার সুশীলত্ব আর শুদ্ধ বাংলার বক্তৃতার সাথে আর যাই হোক আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মতো কঠিন বিষয়টি যায় না। তিনি যেভাবে একের পর এক নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হচ্ছেন, এখনই না বদলালে এই সরকারকে ডোবাতে আর কাউকে লাগবে না।
পুনশ্চ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্ঞানের এত প্রশংসায় অন্য মন্ত্রীদের মন খারাপ হতে পারে। পরে খুঁজে দেখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একা নন, মন্ত্রিসভায় জ্ঞানী লোক অনেক আছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তো বলেই দিয়েছেন দেশের প্রথম সারির ১৬ সম্পাদক না বুঝে বিবৃতি দিয়েছেন। তার মানে সম্পাদকরা কিছু বোঝেন না, উনি সব বোঝেন। অর্থমন্ত্রীর জ্ঞানের ফিরিস্তি দিতে গেলে আলাদা মহাকাব্য লিখতে হবে। এরশাদেরও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই মন্ত্রী শেয়ার বাজার ছাড়া দুনিয়ার আর সবকিছু বোঝেন। এরশাদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন বলে কেউ আবার ওনাকে দল বদলের অভিযোগে অভিযুক্ত করবেন না। তিনি এখন মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী, যে মহাজোটে এরশাদও আছেন। তার সর্বশেষ বাণী হলো, “গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানের বেতন দিলে নাকি তাদের বেতন তার (অর্থমন্ত্রী) সমান হয়ে যাবে।” কী সাংঘাতিক সুখবর। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন, যাদের সৌজন্যে অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর রেকর্ডভাঙা বাজেট দিচ্ছেন, তাদের বেতন যদি একটু বাড়ে ওনার এত লাগে কেন? চাকরি ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উৎস নেই। কিন্তু সারা জীবন দেশে-বিদেশে বড় বড় চাকরি করা আবুল মাল আব্দুল মুহিত আমার চেয়ে কম আয়কর দেন। তার আয় কি তাহলে এতই কম, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছাকাছি, যে চাইলেই তারা অর্থমন্ত্রীকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে হিংসা না শঙ্কা কোনটা বেশি বোঝা গেল না। তবে আমি মনে করি আমাদের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে জ্ঞানী মন্ত্রীর নাম পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ পাট যখন কৃষকের গলার ফাঁস, তখন তিনি চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা না থাকা নিয়ে। আর তিনি বাসায় শুয়ে চিন্তা করেননি। উদ্যমী মন্ত্রী রীতিমতো চিঠি লিখে তার সে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। সবসময় যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য ভাববে কেন, আমাদের মন্ত্রীরাও তাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা না থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভাবতে ভালো লাগছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা ভাই ভাই মনে হচ্ছে। তবে বাঙালির যা স্বভাব, কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে অন্যরা পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে রাখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় পাটমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন, তা না করে, তিনি বলে দিলেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি এর দায়িত্ব নিচ্ছেন না। এটা খুব অন্যায়। তবে এ প্রসঙ্গে আমার কেন জানি, আদার বেপারির জাহাজের খবর- এই বাগধারাটি মনে পড়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীদের জ্ঞানের এই বহর দেখে আমার একটি ধারণা বদলে গেছে। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের ছবি দেখলে আমার এখন সিপিডির গোলটেবিল বৈঠকের কথা মনে পড়ে যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিভাবে যে এত জ্ঞানী-গুণীদের সামলান। আল্লাহ মালুম।

প্রভাষ আমিন
probhash2000@gmail.com

No comments:

Post a Comment