Wednesday, May 29, 2013

খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যে কারণে তালুকদার খালেককে সমর্থন করি : মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান


খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমার সম্মিলিত নাগরিক কমিটির সদস্য থাকা নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংবাদের মূল বক্তব্য হলো- আমার এখানে থাকা সমীচীন হয়নি। পত্রিকাগুলো আইনের কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেনি বা নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে কি-না তাও উল্লেখ করেনি। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা-২০১০-এর ১৪ অনুচ্ছেদের ক, খ ও গ- এ সরকারী সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যক্তি ও সরকারী সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এর কোনটির মধ্যে উপাচার্যের পদ বা স্বায়ত্ত-শাসিত প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রসঙ্গ নেই। তবুও আমি আইনের কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে বা কারও সঙ্গে বিতর্কে না জড়িয়ে কেন আমি তালুকদার আব্দুল খালেককে সমর্থন করি তার দু’একটি কারণ শুধু উল্লেখ করতে চাই।
বাবার কর্মসূত্রে খুলনার সঙ্গে আমার পরিচয়। এর পর কোন্ সময় থেকে যেন খুলনা আমার শেকড়ের মতো হয়ে ওঠে। ছাত্র জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে খুলনায়। ১৯৮১-৮৯ এই দীর্ঘ ৯ বছর পড়াশোনার সূত্রে খুলনায় থেকেছি। ছাত্র রাজনীতির সুবাদে খুলনার আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে তখন থেকে সখ্য। পরবর্তীতে অনেক বছর একাধিক্রমে রাজশাহী অবস্থান করায় খুলনার অনেকের স্মৃতি থেকে আমি হারিয়ে যাই। কিন্তু বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান আমাকে ভোলেননি। তালুকদার আব্দুল খালেককে সেই ৮০-র দশকে যেমন দেখেছি; এখনও তেমনি কথার চেয়ে তাঁর কাজ বেশি। ১৯৮৪ সালে খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দু’টি মিছিলের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগের মহানগর ও জেলা কমিটির জরুরী সভা বসে। আহতদের পক্ষে থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু কে মামলা করতে যাবে কর্মীদের পক্ষে এই নিয়ে গড়িমসি শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তালুকদার আব্দুল খালেকই আহতদের পক্ষে থানায় যান। সম্ভবত তিনি তখন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। এখনও সেই আগের মতো জীবনী শক্তি তাঁর মধ্যে। মেয়র থাকাকালে ফজরের নামাজের পরেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন নগরীর নির্মীয়মাণ রাস্তা পরিদর্শনে। তার গাড়িতে একটা শাবল থাকত। তার অগোচরে যদি কোন রাস্তার পিচঢালাই হয়ে থাকে তাহলে শাবল দিয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তার পিচঢালাইটা যথারীতি হয়েছে কি-না তা তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন। খুলনা শহরে চলতে গিয়ে অনেক সময়েই দেখেছি প্রখর রোদে তিনি দাঁড়িয়ে রাস্তার কাজ তদারকি করছেন। এসব দেখে মনে হয়েছে এখনও জনগণের জন্য কাজ করার মতো রাজনীতিবিদ আছেন। অনেকের কাছেই শুনেছি যে, অনেক ঠিকাদার তালুকদার আব্দুল খালেকের ওপর নাখোশ। কারণ তারা সিটি কর্পোরেশনের কাজে বেশি লাভ করতে পারেননি। তালুকদার আব্দুল খালেকের অন্য যে বড় গুণ তা হলো তার সময়ানুবর্তিতা। তাঁর সঙ্গে অনেক সভায় বসেছি। দেখেছি ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তিনি তাল মিলিয়ে চলেন। আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি আমাকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান। পাশাপাশি ঐ মুহূর্তেই একটি কথা বলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান নির্মাণ কাজগুলো যেন ভালভাবে সম্পন্ন হয়। আমি অভিভূত হই। চেষ্টা করব বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করি।
যেসব মানুষ পাঁচ বছর আগে খুলনায় এসেছেন, তারা যে কেউ এখন খুলনায় এলে তাদের চোখে বড় ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়বে। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, পূর্বের তুলনায় উঁচু এবং বেশিরভাগ রাস্তাই ঝকঝকে। কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন যেমন নগরবাসীকে ঝলমলে রাজশাহী উপহার দিয়েছেন, নগর ভবনের পশ্চিম পার্শ্ব থেকে মেডিক্যাল কলেজের পূর্বপার্শ্ব হয়ে একেবারে পদ্মা নদী পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্ত করেছেন; তালুকদার আব্দুল খালেকও সোনাডাঙ্গা এলাকা ও গোয়ালখালী মোড় এলাকার বেশ কিছু রাস্তা করতে গিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার দুঃসাহসী কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত সততা না থাকলে এ ধরনের দুঃসাহসী কাজ করা যায় বলে মনে হয় না। এর পাশাপাশি ড্রেন নির্মাণের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থের টেন্ডার হয়েছে বলে শুনেছি।
খুলনা শহরের পশ্চিম প্রান্তে ময়ূর নদী। এর পাশেই ’৭১-এর বধ্যভূমিখ্যাত গল্লামারী যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এই ময়ূর নদীতে ’৭১-এ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি গল্লামারীতে শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সুবিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন; অন্যদিকে ময়ূর নদী সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ময়ূর নদীকে ঘিরে একটা লিনিয়র পার্ক তৈরির জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা যারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি প্রতিদিনই ময়ূর নদীর ওপরে নির্মিত গল্লামারী ব্রিজ দিয়ে যখন পার হই, তখন ’৭১ আমাদের মনোজগতে এসে হাজির হয়। সে কারণে যখন প্রত্যক্ষ করি যে, খুলনার সকল খাল উদ্ধারের অভিযানসহ তিনি ময়ূর নদীকে আলাদাভাবে প্রাধান্য দেন তখন আবেগপ্রবণ না হয়ে পারি না।
তাঁর সম্পদ বিবরণী নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। পাঁচ বছর পূর্বে তিনি যে সম্পদের মালিক ছিলেন সে তুলনায় এখন সম্পদ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি বলেছেন যে, তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার মেয়র এবং তাঁর স্ত্রী হাবিবুন্নাহার রামপাল মংলা আসনের সংসদ সদস্য। তাঁদের দু’জনের বেতন-ভাতা আয়ের অংশ। তাঁর নিজস্ব ব্যবসাও রয়েছে। বৈধভাবেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি আরও বলেছেন যে, যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি একটি পয়সা উপার্জন করেছেন, তাহলে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। তাঁর এই অপরিসীম সাহস আমাকে মুগ্ধ করে।
তালুকদার আব্দুল খালেক কয়েক কোটি টাকার দেনা নিয়ে মেয়র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর দায়িত্ব পরিত্যাগের সময়ে তিনি উদ্বৃত্ত রেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে খবর নিলে নিশ্চয়ই এর সত্যতা জানা যাবে। তিনি একজন সাধারণ গ্রাজুয়েট। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতা প্রশংসার দাবি রাখে। মেয়র হিসেবে তিনিই প্রথম মেয়র পদক চালু করেন। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য তিনি প্রতিবছর এই পদক প্রদান করেছেন। গুণী মানুষদেরকে এ ধরনের সম্মাননা প্রদান অবশ্যই উন্নত রুচির পরিচায়ক।
খুলনা শহর এক সময়ে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, কমরেড রতন সেন, এসএমএ রব, সরদার আব্দুর রাজ্জাক, সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু, মোসলেম উদ্দিন, শেখ আবুল কাশেম দিন-দুপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। এজন্য তৎকালীন সময়ে বাইরের কোন লোক খুলনায় আসতে ভীতি অনুভব করত। এমনকি তালুকদার আব্দুল খালেকের জীবনও বিপন্নের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু তালুকদার খালেক মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই সন্ত্রাসীদের জনপদ খুলনা পরিণত হয় অনেকটা নিরাপদ শহর হিসেবে। তাঁর দায়িত্বপালনকালীন সময়ে পূর্বের তুলনায় মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়নি। নগরবাসী নির্বিঘেœ জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছে। খুলনা শহরের প্রতিটি মোড়ে রাত ১২-১টায় মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে তালুকদার আব্দুল খালেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়রের অফিসকে আওয়ামী লীগের অফিস বানাননি। সেখানে যে কোন দল-মতের লোকই সমানভাবে যেতে পারত। সিটি কর্পোরেশনের অফিসকে তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছেন।
আমার অনেক লেখায় আমি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছি। কালের কণ্ঠে একটি লেখায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহ্জাহান খানের আমি কঠোর সমালোচনা করেছি। তখন কেউ আমার সমালোচনা করেননি। কিন্তু একটি অরাজনৈতিক নির্বাচনে একজন সৎ মানুষকে সমর্থন করার সময় কেন সমালোচনা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ২-৩ শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ নাগরিক কমিটিতে কাজ করছেন। তাদের কর্মকা- নিয়ে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন না। যদিও ঐ নাগরিক কমিটির যেসব বক্তব্য কাগজে এসেছে তার সবই প্রায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক। অরাজনৈতিক নির্বাচনে রাজনৈতিক বক্তব্য আইনের লঙ্ঘন। এমনকি সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার মতো কথাবার্তাও রয়েছে তাদের বক্তব্যে। কিন্তু তালুকদার আব্দুল খালেকের সমর্থনে গঠিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটি কোন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করছে না। শুধু তালুকদার আব্দুল খালেকের কর্মতৎপরতা ও মানুষ হিসেবে তার বৈশিষ্ট্যের কথা বলছে। নগরবাসী এসব বিষয় গ্রহণ করতেও পারে নাও পারে। তবুও তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রতি নিরন্তর শুভেচ্ছা।

লেখক : ভিসি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক জনকন্ঠ

No comments:

Post a Comment