Thursday, January 16, 2014

চলে গেলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক ত্র্রিদিব চৌধুরী - সুমি খান

  সবার প্রিয় টুলু' দা, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক,রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি ত্রিদিব চৌধুরী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৬৩ বছর বয়স হয়েছিলো তার।   কয়েকদিন আগেই দেশের বাইরে থেকে চলে এলেন ভোট দেবার জন্যে ।ভাই বারবার অনুরোধ করলেন দেশের এ পরিস্থিতিতে না ফিরতে, শোনেন নি ভাইয়ের কথা। দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে একজন সচেতন নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ না করে থাকেন কী করে?  আশা করি নির্বাচিত সাংসদরা এমন সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিক দের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
১০৫ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে টুলু'দা কয়েক দিন বাড়িতেই ছিলেন । কোন চিকিৎসক দেখান নি।দেরি হয়ে গেলো বড়ো! তিনি চিরকুমার ছিলেন। প্রচন্ড জ্বর নিয়ে চট্টগ্র্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি হবার দু'দিনের মধ্যেই ১৫ জানুয়ারী  বুধবার সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, টুলু'দার প্রত্যঙ্গ সমূহ একের পর একে  নিস্ক্র্রিয় হয়ে যাচ্ছে।১৭ জানুয়ারী রাত  প্রথম প্রহর ২টা ২০ মিনিটে সব চেষ্টাই ব্যর্থ  করে টুলু'দা চলে গেলেন। ভোর ৪টায় তাকে চট্টগ্রাম বৌদ্ধমন্দিরের পাশে এনায়েতবাজার 'কল্যাণী'  তে আনা হয়েছে। সেখানেই আছে  তার শবদেহ।
আজ বিকেল ৩ টায় কল্যাণী তে শোকসঙ্গীতের আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল ৫টায় অভয়মিত্র শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন  করা হবে।
ধলঘাট.গ্রামে টুলু 'দার জন্ম ।উদিচী চট্টগ্রামের প্রথম কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন ত্রিদিব চৌধুরী।
   আজ খুব  মনে পড়ছে আমাদের বড়োদদিমিণির কথা!  অপর্ণা চরণ স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী প্রণতি সেন এর ভাগ্নে টুলু'দা। আমাদের বড়ো  দিদিমণি প্রণতি সেন  থাকতেন তাঁর বান্ধবী এবং তার আমৃত্যু সহযোদ্ধা কল্যাণী সেনের সাথে তাঁর এনায়েত বাজারের বাড়িতে।দুই বন্ধুই চিরকুমারী ছিলেন। কল্যানী সেন এবং  প্রণতি সেন বীরকন্যা প্রীতিলতার  শিষ্য অনুসারী  নিবেদিতা প্রাণ শিক্ষক ছিলেন। প্রীতিলতা অপর্ণা চরণ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। প্রণতি সেন এবং কল্যাণী সেন তাদের মেধা মনন এবং জীবনযাত্র্রায়  অনন্য  ছিলেন। যা  স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁদের ছাত্রীদের হৃদয়ে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক চিকিৎসক বিপ্লবী  ডা. কেশব সেনের  একমাত্র কন্যা   কল্যাণী সেন দেশমাতৃকার কল্যানে শিক্ষাব্রতী হিসেবেই আমৃত্যু নিবেদন করেন তার জীবন । অপর্ণা চরণ স্কুল পরচিালনা করতে গিয়ে চট্টগ্রামের সমাজপতিদের চরম অসহযোগিতা এবং অন্যায় হস্তক্ষেপের চাপে   ১৯৮৪ সালের ৭ জুন হৃদযন্ত্র্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন   স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্র্রী প্রণতি সেন । সেদিন   আমাদের স্কুলে বড়োদিদিমণির মরদেহ আনার সাথে সাথে  বড়োদিদিমণির শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী  রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হয়। কাবেরী সেনগুপ্তা , জয়ন্তী লালা আমাদের দিদিমণিরা একের পর একে গেয়ে গেলেন, তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে, আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,.....! সেদিন  প্র্রথম মায়ের সাথে কেশব ভবনে গেলাম। দেখলাম টুলু'দা, অরুণ কাকা ( কবি , সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত) সবাই মাটিতে বসে আছেন। রবীন্দ্র্র সঙ্গীত গাইছেন অনেকে।  দাদা (টুলু'দা) মাথা নেড়ে আমাকে ও গাইতে বললেন। বড়ো দিদিমণিকে হারিয়ে শোকগ্রস্থ হৃদয়ে গান ধরলাম, 'আগুনের পরশ মণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পূণ্য করো.....এ জীবন পূণ্য করো দহন দানে..।'

চিরবন্ধু  হারানোর শোক বুকে নিয়ে আরো কিছু দিন বেঁচে ছিলেন কল্যাণী সেন। তিনি মৃত্যু বরণ করেন ২০০০ সালের দিকে। এর আগে তিনি  টুলু'দাকে  বাড়িটি দান করে যান ।
কল্যানী সেনের বাড়ির জায়গাতেই ষ্টুডিও করে  ফটোগ্রাফী করতেন ত্রিদিব চৌধুরী। পরবর্তীতে  কল্যানী সেনের  এলাকার সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে বাড়িটি ডেভেলাপার কে দিয়ে দেন।
 কল্যাণী দিদিমণিকে দেখতে  আমার অতুলন কে নিয়ে একবার গেছি '৯৯ সালের দিকে সম্ভবতঃ। খুব আশীর্বাদ করলেন!  এর পর আর ঐ বাড়িতে আর যাই নি।
 স্মিত হাস্য নিভৃতচারী মৃদুভাষী মানুষ টুলু 'দাকে শেষ দেখা দেখলাম  ১৫ জানুয়ারী রাত ১১টায় মেট্রোপলিটন হাসপাতালের এইচ ডিইউ বেডে শায়িত। আমার পুত্র ইরাবান আলীম অতুলন , আলেক্স আলীম আর আমি দরোজার বাইরে থেকে দেখলাম  টুলু'দা একটু নড়াচড়া করছেন !!  আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম সেরে উঠবেন ভেবে। না হয় নি!  টুলু'দা আর  ফিরলেন না আমাদের মাঝে!‍! সেখানে দেখা হলো ড. অনুপম সেন স্যার, অরুণ দাশগুপ্ত,  আবুল মোমেন, অনুপ সাহা,  কুন্তল বড়ুয়া, সোমা বড়ুয়া সহ অনেকের সাথে। সবার মধ্যেই হতাশা। কেন সময়মতো ডাক্তার দেখালেন না, টুলু'দা? কেন এতো উদাসীনতা নিজের প্রতি? ভারতের সহকারী হাই কমিশনার সোমনাথ সেনগুপ্ত বললেন, " খুব রাগ হচ্ছে আমার, কেন উনি এতো জ্বর নিয়ে বাড়িতে রয়ে গেলেন? ..." !! এমন ই নিভৃতচারী টুলু 'দা আজ আমাদের সব রাগের উর্ধ্বে !!
 সকালে মা ই প্রথম এ দুঃসংবাদ জানালেন কলম্বো থেকে। মা ক'দিন আগেই কলম্বো গেছেন আমার আপা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী  কিশওয়ার কামাল খানের সাথে তার বাড়িতে। কিশু আপা আর টুলু'দা  সহপাঠী এবং  বন্ধু ! তিনি সকালেই এ দুঃসংবাদ পেয়েছেন। মা ও জেনেছেন ।  আমার মা নূর জাহান খান স্বাভাবিক ভাবেই টুলু'দা র এমন আকস্মিক প্রয়াণে ভীষণ মর্মাহত। সশরীরে আসতে না পারলে ও তিনি যেন সর্বক্ষণ চট্টগ্রামেই আছেন। বললেন তাঁর পক্ষ থেকে যেন ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাই টুলু'দার শেষযাত্রায়!

 আত্মকেন্দ্রীক ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের এই দুঃসময়ে ত্রিদিব চৌধুরীর মতো সৎ, নিঃস্বার্থ এবং  সচেতন সংগঠক বিরল! তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রজন্মের কাছে তার কর্ম এবং জীবন সঠিক ভাবে উপস্থাপনের আশা প্রকাশ করছি।
টুলু'দার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

Tuesday, January 14, 2014

সংখ্যালঘুদের আজ ঘুরে দাঁড়ানোর সময় : দেবাহুতি চক্রবর্তী


 সাম্প্রতিককালে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কিত আলোচনার শীর্ষ বিষয়গুলোর অন্যতম বিষয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। এ বিষয়ে বিভিন্ন মহলের ও বিশিষ্টজনদের বক্তব্য, লেখনী আমরা পড়ছি, দেখছি। আমরা কেউ কেউ আবেগে আপ্লুত হচ্ছি। কেউ কেউ ক্ষোভে ফুঁসে উঠছি। অথচ বিষয়টা কোন অপ্রত্যাশিত নয়। বিস্মিত হওয়ার মতোও কোন ঘটনা নয়। বিভিন্ন সময়ে বিশেষত দেশে কোন নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের ঘটনা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে পত্র-পত্রিকায় আমি নিজেও কিছু লেখালেখি করেছি। মিলিয়ে দেখলাম, আবেগ দিয়ে লিখতে গেলে একই লেখার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। একই লেখা হুবহু প্রকাশ করলেও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।

কিন্তু আজ আমি সম্পূর্ণ আবেগমুক্ত। শরীরে কঠিন ব্যাধি ক্যান্সার নিয়ে ভারতে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সম্প্রতি দেশে এসেছি। একটা কথা জেনেছি, ক্যান্সার কোন সংক্রামক ব্যাধি নয়। জেনেটিক কিনা সে বিষয়েও চিকিৎসাবিজ্ঞান দ্বিধাগ্রস্ত। দেশে ফিরে যা দেখছি, যা শুনছি তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গে অঙ্গে ক্যান্সার। যার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ এ নিরবচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িকতা। ভাবতে ইচ্ছে করে এ কি সংক্রামক হিসেবে না উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়াজ্জ?

তা না হলে এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। এ ভূখ-ে সাম্প্রদায়িকতার উৎসজ্জ তার স্বরূপজ্জ তার বিবর্তিত ইতিহাস খুঁজতে বহুদূর যাওয়া যেতে পারে। একাত্তরজ্জ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়জ্জ ব্রিটিশ ভারতজ্জ মোগল আমলজ্জ সেসব অনেক দূরবর্তী ইতিহাস। সেসব বিষয়ে ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরা এযাবৎ আলোচনা-পর্যালোচনায় রয়েছেন, থাকবেন। সেটাই স্বাভাবিক।

জ্জ আমরা সাধারণ মানুষ সোজাসুজি দেখেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তার বাঙালি দোসরদের হাতে আনুপাতিক হিসাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়। তবু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পরে খুব অল্পসংখ্যক হিন্দু পরিবারই ভারতে থেকে গেছে। নতুন বিশ্বাসে ফিরে এসেছে অধিকাংশ শরণার্থীই। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভে সে বিশ্বাস আরও গ্রথিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য একাত্তর পরবর্তী হিন্দু জনসংখ্যা আজ এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এ কি শুধুই হিন্দুদের ভারতপ্রীতি আর দেশপ্রেমের অভাব?

বাস্তবতা অনেক কঠিন। ১৯৬৪'র পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর থেকে শত্রু সম্পত্তি আইনের নামে হিন্দু সম্পত্তি আত্মসাতের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তা স্বাধীন বাংলাদেশে নানা ছদ্মনামে; নানা বাতাবরণে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

২০১২'র অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন অবশ্যই বিগত সরকারের প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু ক্রমশ আইনের প্রায়োগিক সমস্যায় ও বিচারাঙ্গন এবং সরকারের রাজস্ব দফতরের দীর্ঘসূত্রতা ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতির মুখে হিন্দু সম্প্রদায় এখানেও নানাভাবে নাজেহাল হচ্ছে। নিজের মাটি নিজের করে পেতে যে আর্থিক ও মানসিক খেসারত আইনের আড়ালে জোগান দিতে হচ্ছে তা দুঃখজনক এবং এক্ষেত্রেও নতুন করে নানাবিধ হুমকি ও শত্রুতা সৃষ্টি হচ্ছে। যার সবটা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু সরকারের দূরদৃষ্টি স্বচ্ছ হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

একাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের যেসব তালিকা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকবাহিনী ও তার বাঙালি দোসরদের হাতে নিহত হিন্দুদের তালিকা কখনই যথাযথভাবে প্রস্তুতের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমার অসুস্থকালীন সময়ে আমি নিজে কিছু অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দরখাস্ত তৈরি করতে যেয়ে দেখেছি হিন্দু পরিবারগুলোয় মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষগুলোর নাম শহীদ হিসাবে অন্তর্ভুক্তি তো দূরের কথা তাদের সম্পত্তি ভিপি তালিকাভুক্ত হয়ে আছে। রাজবাড়ী জেলায় একমাত্র শহীদ অ্যাডভোকেট কালীশঙ্কর মৈত্রের সম্পত্তি ও ভিপি সম্পত্তি দাবি করে সরকার দীর্ঘদিন মামলায় লড়ে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এ শহীদ অ্যাডভোকেটের নামে বহুবার প্রস্তাব দেয়া সত্ত্বেও রাজবাড়ী জেলায় কোন জনপ্রতিনিধি বা সরকারের পক্ষ থেকে একটা নামফলক পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যাবে না। দেশজুড়ে হিন্দুদের প্রাপ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রকম।

পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর পর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা মহাজোট সরকার যার মধ্যে কথিত প্রগতিশীল বাম নেতারাও রয়েছেন পঞ্চদশ সংশোধনী এনে হিন্দু ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়কে চিরস্থায়ীভাবে সংখ্যালঘু ও দ্বিতীয়  শ্রেণীর নাগরিক এ পরিণত করেছেন।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সহজেই চিনতে পারে। ভয় পায়। আওয়ামী লীগ বা বাম দলগুলোকে অপেক্ষাকৃত কাছের মনে করতেই পারে। তাদের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যান-ধারণার জন্য। কিন্তু তাদের হাতেই ধর্ম নিরপেক্ষতার বকচ্ছপ মূর্তি। বিষয়টা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বোঝে না তা নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষার জন্য এ আপসকামিতার হিসাব সাধারণ মানুষ গুনতে জানে।

সব সরকারের আমলেই মুষ্টিমেয় দু'চারজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে বেছে নেয়া হয়। যারা কখনই নিজেদের স্বার্থ সুবিধা আদায় ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তার সর্বশেষ উদাহরণ সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। যার ছত্রছায়ায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বাইরে ছুড়ে দেয়া হয়েছে।

বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই যে কোন ধরনের অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেই যদি সাম্প্রদায়িক চরিত্রের হয় তাহলে প্রতিকার পাওয়ার অবকাশ কোথায়?

২০০১ থেকেই যদি ধরি। অদ্যাবধি খুব অল্পসংখ্যক সহিংসতার ঘটনার বিচারে দোষীরা শাস্তি পেয়েছে। তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। তার প্রস্তাব চাপা পড়ে যায়। বিদায়ী সরকারের আমলে রামু, কক্সবাজার, হাটহাজারী, সাতক্ষীরা অন্যান্য জায়গার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কয়টি ঘটনার বিচার হয়েছে? শত শত মানুষকে আসামি করে যেমন-তেমন একটা চার্জশিট গঠন করে আদৌ কি বিচার পাওয়া সম্ভব? পাবনার সাতক্ষীরার ঘটনার স্পষ্টত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার অনুসারীদের নামটা উঠে এলো। সত্য-মিথ্যা যেটাই হোক। কোন নিরপেক্ষ তদন্ত এযাবৎ হয়নি। কোন নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুচানোর জন্য প্রকাশ না করে শাসকপক্ষ তাকেই আবার সংসদীয় প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত করলেন।

এসব কথাগু উঠে আসার অর্থ সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা জাতিগত সম্প্রদায়ের কোন মানুষই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিশ্বাস করতে পারে না। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কাছে টানার মতো যথেষ্ট প্রচেষ্টা রাখেনি। বৃহৎ বাম দলগুলোর প্রধানরা একই নৌকায় একই সুরে ভাটিয়ালি গান করছেন। অন্য বাম দলগুলো নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে এতই খ- বিখ- যে তারা কোন বিকল্প শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাহলে কী চিরদিন এদেশে একদিকে নির্যাতন-ধর্ষণ-সর্বস্ব হারানো, অন্যদিকে করুণা আর সহানুভূতির পাত্র হয়েই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের দিন যাপনের গ্লানি বইতে হবেজ্জ ?

চিকিৎসার সুবাদে দীর্ঘ নয় মাস ভারতে থাকার সুবাদে নানা আলাপ-আলোচনায় যেটুকু বুঝেছি, এদেশের হিন্দুরা ভারত সরকারের কাছে সম্পূর্ণই এখন অবাঞ্ছিত, বহিরাগত ক্ষেত্রবিশেষে সন্ত্রাসী। একাত্তর পরবর্তী সময়ে ও ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। কিন্তু আইন-আদালত থেকে সব সময় নিজেদের রক্ষা করার জন্য সেখানেও তারা শামুকের মতো গুটিয়ে আছে। অন্যায়-অবৈধ পথে কাগজপত্র তৈরি করতে যেয়ে এ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তিকেও লিখতে হচ্ছে শুধুমাত্র স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন। আইনসম্মতভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে তাদের দু'চার প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ফলে সেখানেও সব সময়ই নানা নিরাপত্তাহীনতায় তাদের দিন কাটছে। এ বাস্তবতায় এখান থেকে ঠেলা খেয়ে ভারতে যাওয়ার চিন্তাও এখন সচেতন হিন্দু সম্প্রদায় করতে পারে না। যাদের আর্থিক ক্ষমতা আছে, তারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো বেছে নিতে পারে। কিন্তু সেটা কজন?

আজ তাই সময় এসেছে, সত্যিকার অর্থে ঘুরে দাঁড়ানোর। ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থ এই নয় সশস্ত্র সহিংসতার পথ। হিন্দুদের এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ রাজনৈতিক চিন্তা, নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের কর্মী সংগঠন হিসেবে পরিচয় বা অন্তর্ভুক্তি থাকতেই পারে। সেখানে কোন বাধা নেই। কিন্তু সম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রশ্নে দল মতের ঊর্ধ্বে দাঁড়ানোর আজ সময় এসেছে। সেখানে নিজেদের লেজুড় বৃত্তির বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে একাত্তরে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রাজাকার বা মৌলবাদীর সংখ্যা যা ছিল, আজ তার চেয়ে এই সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি। এর কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন আমলের সরকারি নীতি ও পৃষ্ঠপোষকতা। আজওজ্জ আগে বাঙালিজ্জ নাজ্জ মুসলমানজ্জ এ আত্মপরিচয়ের সংকট সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অনেকেরই কাটেনি। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, বাংলাদেশের সত্যিকার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহকরা আজ ধর্মীয় এবং জাতিগত-ভাষাগত বিভেদের বাইরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে সাহসী পদক্ষেপ রেখে চলেছেন। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। তাদের সঙ্গে তাদের পাশে এদেশের সব ধরনের সংখ্যালঘুদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার সংকট, বিভিন্ন শাসক ও রাজনৈতিক দলের সাম্প্রদায়িকতার সংকট নিরপেক্ষভাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংহত করতে হবে। তবেই সম্ভব মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী শক্তিকে এদেশ থেকে প্রতিহত করা। আজ আর পলায়নবাদের পথ নেই। কুণ্ঠিতজ্জ সংকুচিত হয়ে করুণা ভিক্ষার সময় নেই। আজ আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশের তরুণ প্রজন্ম ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিয়মতান্ত্রিক লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আজ তাই সব সংকোচের বিহবলতা; সব সংকটের দুঃসহতা কাটিয়ে নিজেদের আত্মশক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। কিছু কিছু প্রশ্ন জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে অমীমাংসিত আছে। কিন্তু এদেশের সব শ্রেণীর সংখ্যালঘুদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আত্মপরিচয়ের কোন সংকট নেই। এ গর্ব আর অধিকারবোধ নিয়েই নতুনভাবে পথ চলার পথ তৈরি করতে হবে। তা না হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

Monday, January 13, 2014

তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

জানুয়ারী ১২, ২০১৪

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালখুব সহজে আমার মন খারাপ হয় না। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে আমার খুব মনখারাপ। যারা এক নজর পত্রিকার দিকে তাকাবে কিংবা টেলিভিশনে খবর শুনবে তাদেরও মন খারাপ হয়ে যাবে। শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে এই দেশে মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভয়ে আতংকে জীবন বাঁচাবার জন্যে এই মানুষগুলো নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। বাড়ির মেয়েদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
১৯৭১ সালে হিন্দু মুসলমান সবাই আক্রান্ত হয়েছিল। মুসলমান হলে কখনও কখনও হয়েতো মানুষ বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু হিন্দু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে কেউ কখনও প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেনি। ১৯৭১ সালে আমরা গ্রামে লুকিয়ে আছি, তখন দেখেছি একজন হিন্দু মা তার শিশুসন্তানকে বুকে চেপে ধরে স্বামীর পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছেন, তাদের চোখ-মুখের সেই উদভ্রান্ত অসহায় দৃষ্টি আমি কখনও ভুলতে পারব না।
তেতাল্লিশ বছর পর এই বাংলাদেশে এখনও একজন অসহায় হিন্দু মা তার সন্তানকে বুকে চেপে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছুটে যাচ্ছেন। তার মানে যে দেশকে নিয়ে আমরা এত গর্ব করি সেই দেশটি আসলে তেতাল্লিশ বছরে এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হয়নি। এর চাইতে বড় দুঃখ, লজ্জা আর অপমান কী হতে পারে?
আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করি আমি যদি এই দেশে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে আমার কেমন লাগত। আমি জানি তাহলে গভীর হতাশায় আমার বুক ভেঙে যেত। আমি কোনো দোষ করিনি, কিন্তু শুধুমাত্র একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে আমার উপর যে নৃশংস অত্যাচার করা হচ্ছে তার জন্যে আমার বুকে যেটুকু ক্ষোভ জন্ম নিত তার চাইতে শতগুণ বেশি অভিমান হত আমার চারপাশের নির্লিপ্ত মানুষজনকে দেখে। কেউ কোনো কথা বলছে না, নিরবে এক ধরনের করুণা নিয়ে আমাকে দেখছে।
সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ হত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। প্রতিবার নির্বাচনের পর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হবার পর, রায় কার্যকর হবার পর আমাদের উপর হামলা করা হবে। বিএনপি-জামাত হামলা করবে, আওয়ামী লীগ বা বাম দলগুলো সেটা ঘটতে দেবে। খুব বেশি হলে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রতিবাদ করবে। কিন্তু বুক আগলে কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না।
এই দেশে আমি যদি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমার বার বার মনে হত আমি এই দেশের মানুষ, কিন্তু এই দেশটি আমাকে রক্ষা করছে না। আমি নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে বলতাম– ‘‘তুমি কেন আমকে এমন একটি দেশে জন্ম দিয়েছ যেই দেশ আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় না? এই দেশে আমাকে প্রতি মূহুর্ত আতংকে থাকতে হয়?’’ কিন্তু আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী নই; তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের বুকের ভেতর যে গভীর দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা আর অভিমান পুঞ্জিভূত হয়ে আছে আমি সেটা কোনোদিন অনুভব করতে পারব না।
আমাদের প্রিয় দেশটি নিয়ে আমাদের কত কল্পনা, কত স্বপ্ন। আমরা আশা করে আছি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে, একদিন দেশটা মাথা তুলে দাঁড়াবে। আমরা এর মাঝে সেগুলো এই দেশে শুরু হতে দেখেছি। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। যদি আমরা একজন মানুষকে শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্যে এই দেশে নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে এই দেশটি কাদের জন্যে?
আমার মনে হয়, এই দেশ নিয়ে আমাদের যত কল্পনা, যত স্বপ্ন, যত পরিকল্পনা সবকিছু পেছনে সরিয়ে সবার আগে আমাদের এখন একটি মাত্র লক্ষ্য টেনে নিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষ্যটি হচ্ছে, এই দেশে একটি হিন্দু শিশু যেন নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় তার মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। গভীর রাতে ধর্মান্ধ মানুষের উম্মত্ত চিৎকারে তাদের যেন জেগে উঠতে না হয়। আগুনের লেলিহান শিখায় আপনজনের আতংকিত মুখ দেখতে না হয়। একজন হিন্দু কিশোরীকে যেন তার বাবার রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে থরথর কাঁপতে কাঁপতে বলতে না হয়– “এখন কী হবে বাবা?”
আমরা পদ্মা সেতু চাই না, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাই না, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ চাই না, শতকরা একশভাগ নিরক্ষর চাই না, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ চাই না। শুধুমাত্র হিন্দু এবং অন্যসব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা চাই যেন তারাও ঠিক আমাদের মতো এই দেশটিকে তাদের নিজেদের ভালোবাসার দেশ বলে ভাবতে পারে। তীব্র অভিমানে তাদের বুক ভেঙে যেন আর কোনোদিন খান খান হয়ে না যায়।
আমি কার কাছে এটি চাইব জানি না, তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে চাইছি। তোমরা আমাদেরকে একটি নূতন বাংলাদেশ উপহার দাও। যে বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চিরদিনের জন্যে মুছে দেওয়া হবে। আমি জানি তোমরা পারবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।